Tuesday 23 September 2014

বিশ্বকর্মা পুজো ও লাউগাছ

এই সেদিন একজনের সাথে কথা হচ্ছিল। আমি তাকে যত্পরোনাস্তি যুক্তিসঙ্গত ভাবে বোঝাবার চেষ্টা করছিলাম যে আমার এই পাঁচফুটিয়া চেহারাটা দেখে যতই শান্তশিষ্ট-সাত চড়ে রা না কাড়া জাতীয় মনে হোক না কেন আমি কিন্তু অত্যন্ত জটিল-অত্যন্ত কুচুটে-ঝগড়াটে আর পাজির পা ঝাড়া একটি মহিলা। বিটকেল বদমায়েসি বুদ্ধি কিন্তু আমার একটুও কম নেই। সে কিছুতেই ব্যাপারটার সত্যতা বোঝেনা। খালি হাসে আর মাথা নাড়ে। কি করে যে বোঝাব? যাক গে বলে তাকে আর ঘাঁটালাম না তখনকার মত। তারচেয়ে বরং আপনাদের কাছে আমার কুচুটেপনার একটা উদাহরণ দেওয়া যাক।

অনেকদিন আগে যখন আমি সত্যি সত্যি ছোট ছিলাম মানে এইরকম সাইজে ছোট মাথায় বদ-বুদ্ধি গুলো বড়বড়, সেরকম নয়। চেহারা, বয়স আর মন তিনটেই যখন ছোট আর সাদা ছিল তখনকার কথা বলছি। আমার প্রানের বন্ধু রুমা। তার কথা তো আপনাদের আগেই বলেছি। তার জ্যেঠুদের ছিল ডেকোরেটিং-এর ব্যবসা। সেসব জিনিসপত্র রাখার জন্য বাড়ির লাগোয়া গুদামঘর। আর তাঁদের বাড়ির সামনে থাকত প্রচুর বাঁশ যেগুলো ছিল আমাদের মানে সারা পাড়ার কুঁচোদের বৈকালিক হুড়োহুড়ির জায়গা। বছরের একটি বিশেষ সময় এই বাঁশগুলি সরিয়ে ফেলা হত। কারণ তখন বাঁশগুলো দিয়ে খাঁচা বানিয়ে প্যান্ডেল বানানো হতো বিশ্বকর্মা পুজোর জন্য। আর যতদিন না সেই বাঁশের খাঁচার ওপরে লাল-গোলাপী-সাদা কাপড় লাগিয়ে প্যান্ডেলের অবয়ব তৈরী হত ততদিন ওই বাঁশের খাঁচাটা ছিল আমাদের সম্পত্তি। বিকেলে ওই খাঁচার সবচেয়ে নিচের ধাপের বাঁশে উঠে পা দোলানো, বা বাঁশ ধরে ঝুলে পা দুটিকেও বাঁশের ওপরে তুলে দিয়ে বাদুড়ঝোলা হয়ে থাকা এজাতীয় দুর্দান্ত এডভেঞ্চার করা চলত। যারা আমার মতন হাঁ করা বাচ্চা ছিল না, প্রাণে কিঞ্চিত সাহস এবং বাড়ির লোকের তুমুল উত্তম-মধ্যম হজম করার মত কলিজা ছিল, তারা বাঁশের খাঁচার আরো উপরের দিকে উঠে নানা কসরত দেখাত আর আমরা একদম নিচের ধাপে বসে জুলজুল চোখে সার্কাস দেখতাম আর মুগ্ধ হতাম। 

ক্রমে বিশ্বকর্মা পুজোর দিন এগিয়ে আসত। পুজোর আগের দিন বিকেল থেকে আমাদের বাঁশে চড়ার খেলা বন্ধ হত আর আমরা প্যান্ডেলে বসে প্যান্ডেলে কাপড় চাপানো আর একটা নারকেল দড়ি দিয়ে বাঁধা বাঁশের খাঁচা কেমন করে সুন্দর সাজানো ঘরের মত প্যান্ডেল হয়ে উঠছে সেটা অবাক চোখে বসে দেখতাম। রুমার সাথে হলায়-গলায় বন্ধুত্বের দৌলতে সেই পুজোবাড়িতে আমার অবাধ যাতয়াত ছিল। পুজোর আগের দিন রাত থেকে তাদের বাড়িতে রুমার সাথে সাথে আমারও পাত পড়ে যেত। এবং সেই সূত্রে বিশ্বকর্মা পুজোর আগের দিন সন্ধ্যেয় মা দয়া করে আমার পড়ার ছুটি দিত। আর সেই ছুটি আমি আর রুমা আমাদের পাড়ার বাকিদের সাথে যথেচ্ছভাবে উদযাপন করতাম।

সেরকমই একবছর বিশ্বকর্মা পূজোর আগেরদিন সন্ধ্যেয় প্যান্ডেল বানানো চলছে। ডেকোরেটিং এর জিনিসপত্রের গুদামে বিশ্বকর্মা ঠাকুর হাতির গায়ে ত্রিভঙ্গ মুরারী হয়ে হেলান দিয়ে চার হাত ছড়িয়ে দাঁড়িয়ে পড়েছেন। তাঁর চারপাশে কাগজের ফুল-শিকলি-মাথার পেছনে কাগজের জাপানি পাখা সব লাগানো কমপ্লিট। এদিকে তখনও প্যান্ডেলের কাপড় সেলাই চলছে। বোরিং কাজ। এরপর লাগানো হবে তারপর সাজানো হবে। সেই অবাককরা ব্যাপারটা আসতে অনেক দেরী। আমাদেরও লুকোচুরি-কুমিরডাঙ্গা-পিট্টু সব শেষ হয়ে গেছে। এমনকি প্রতিটি খেলার শেষে যে ইন্টারেষ্টিং ঝগড়াঝাঁটি-চেঁচামেচির বিষয়টা থাকে সেটাও শেষ। সবাই বসে বসে প্যান্ডেলের কাপড় সেলাই দেখছে আর নাক-কান-হাত-পা খুঁটছে। মোদ্দাকথায় বেজায় বোরিং একটা ব্যাপার চলছে। এমন সময় আমাদের হাতে এসে পড়ল একটা নতুন ব্লেড। এই জিনিসটা সাধারণতঃ আমাদের হাতে কেউ তখন দিত না। কারণ উত্সাহের চোটে নিজেদের হাত পা-ই কেটে বসে থাকব হয়ত। প্যান্ডেলের কারিগরদের হাত থেকেই কোনভাবে এই নিষিদ্ধ বস্তুটি আমাদের হাতে এসে পড়েছিলো। সঙ্গে সঙ্গে সবাই পুনরুজ্জীবিত হয়ে উঠলো। চকচকে ধারালো ব্লেডটা নিয়ে কিছু যে  করতেই হবে এ বিষয়ে  দ্বিমত ছিল না। কিন্তু কি কাটা হবে  সেটাই প্রশ্ন। আমার মাথার বদ বুদ্ধির ঢিপি নড়ে উঠলো। বললাম চলে আয় সবাই আমার সাথে। প্রথমেই যে বাড়ির পুজো তাদের বাড়ির পেছনের বাগানে। সর্বসম্মতিক্রমে ঠিক হলো এখান থেকেই অভিযান শুরু। বেছে বেছে লাউ-কুমড়ো বা চালকুমড়ো গাছ খুঁজে নেওয়া হলো। কারণ এইসব গাছ ছাড়া ব্লেড দিয়ে কোনো গাছই কাটা যায় না। এই সময় এইসব গাছ সকলের বাগানেই লকলকিয়ে উঠেছে। আমরা আনন্দে নাচতে নাচতে সারা পাড়ার সমস্ত লাউ কুমড়ো গাছের গোড়া মানে মাটির ঠিক উপরেই কচাত করে কেটে সেই নতুন ব্লেড -এর ধার পরীক্ষা করতে লাগলাম। আমাদের লোকজনদের নিজেদের বাড়ির গাছও বাদ গেল না। রেহাই পেল কেবল যেসব বাড়ির পাঁচিলের মধ্যে গাছপালা আছে তারা। যেমন আমাদের বাড়ি, রুমাদের বাড়ি ইত্যাদি। ভর সন্ধ্যেবেলা, অন্ধকারে কোনো বাড়ির সদস্যদেরই মনে হয়নি বাড়ির পেছনের লাউ-কুমড়ো গাছ পাহারা দেবার কথা। সুতরাং পরদিন সকালে দেখা গেল পাড়ার এমুড়ো থেকে ওমুড়ো পর্যন্ত সমস্ত লাউ-কুমড়ো-চালকুমড়ো গাছ কোনো এক অজানা কারণে নেতিয়ে যাচ্ছে। সন্ধ্যের মধ্যে নেতিয়ে যাবার কারণটি আর অজানা রইলো না। প্রত্যেক বাড়ির মা জ্যেঠিমারা এই নিয়ে আলোচনা করতে লাগলেন এবং যে বা যারা এই কাজটি করেছে তাদের মুন্ডুপাত করতে লাগলেন।

আমরা যারা ভালোমানুষ মুখে এই আলোচনাচক্রে শ্রোতার ভূমিকায় ছিলাম তাদের যে মা-জ্যেঠিমা-কাকিমার দল বিন্দুমাত্র সন্দেহই করেননি বলাই বাহুল্য। কারণ আমাদের মত ক্যাবলাকান্ত-আঙ্গুলচোষা-শান্ত বাচ্চারা যে এসব গর্হিত অপরাধ করতে পারে এ তাঁদের কল্পনাতেও আসেনি। তাঁদের আমাদের প্রতি অগাধ আস্থার জোরে আমাদের পিঠ-কান-গাল সেযাত্রা বেঁচে গিয়েছিল।

এখন আমাদের সেদিনের দলবলের দিকে চোখ দিলে দেখা যায় কেউ প্রচন্ড কড়া মা , বাচ্চাকে শাসন করতে পেলে সন্ধ্যের সিরিয়াল পর্যন্ত ভুলে যায়। কেউ আপাদমস্তক গম্ভীর সরকারী কর্মচারী, প্রচন্ড দায়িত্বশীল পদে অধিষ্ঠিত। কেউ বা আমার মতন হাড়-হাভাতে গবেষক, আজীবন ছাত্র থাকার জন্যে অঙ্গীকারবদ্ধ। মোটকথা কাউকে দেখলেই শান্ত-শিষ্ট রামগরুড়ের ছানা ছাড়া কিছু মনে হবার যো নেই। পেটে পেটে কিন্তু আমরা যে একেকটি বদের গাছ সেটার একটা উদাহরণ তো পেলেন? আরো আছে ক্রমশঃ প্রকাশ্য। এই তো পুজো আসছে, পুজোর সময়েই একটি ঘটনা ঘটিয়েছিলাম।সেটা আরো এককাঠি সরেস ব্যাপার। কয়েকদিন বাদে বলব নিশ্চয়ই।

0 comments:

Post a Comment