Saturday 26 October 2019

#এই_সপ্তাহের_শেষে-4

#এই_সপ্তাহের_শেষে

৪. ওষুধ আবিষ্কার (পর্ব-৩) 
--------------------------------
আচ্ছা, কোথায় ছিলাম যেন আমরা? হ্যাঁ, কলমিশাক ব্রেস্ট ক্যান্সার কমায় কিনা এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে একজন বিজ্ঞানী প্রথমে পড়াশুনা করে এই আজব ধারণার আদৌ কোনো ভিত্তি আছে কিনা তা খুঁজেছেন, তারপর সরকারি সংস্থায় আবেদন করে গ্রান্ট জানিয়েছেন, তারপর সেই প্রকল্পে করা কাজ করবে সেইসব লোকজনকে জোগাড় করেছেন, তারপর ব্রেস্ট ক্যান্সারের কোষ জোগাড় করেছেন এবং শেষে চেনা রাসায়নিক বা অচেনা জৈব পদার্থ, এক্ষেত্রে কলমিশাকের নির্যাস (রাসায়নিক বৈশিষ্ট্য অনুসারে বিভিন্ন অংশে ভাঙা) সেই কোষে প্রয়োগ করে কিছু আশাব্যঞ্জক ফলাফল পেয়েছেন। ইতিমধ্যে অন্তত পাঁচ বছর পেরিয়ে গেছে। এইবার পরের গল্প বলি। পূর্ববর্তী অংশগুলিকে অনুসরণ করলে পরের গল্পটি দাঁড়ায় সাত নম্বর স্তরে। সেখান থেকেই শুরু করি তবে।  

৭. কোষস্তরে (In vitro) আশাব্যঞ্জক ফলাফল পাবার পর এবার আপনি আর একটু এগোবেন। দেহের বাইরে আপনি চেষ্টা করেছেন কোষগুলিকে দেহের মত একটি পরিবেশ দেবার। কিন্তু দেহের ভেতরে আসল পরিবেশ এর থেকে অনেকটাই আলাদা। ক্যান্সার কোষগুলি আশেপাশের অন্য কোষের সাথে কিরকম ব্যবহার করে? কি তাদের আদানপ্রদান? দেহের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা এই কোষগুলির ওপর কিরকম ব্যবহার করে? সেসবই প্রভাব ফেলবে ওই কম্পাউন্ডটির কার্যকারিতার ওপর। সুতরাং দেহের ভেতরে আপনার ওই কলমিশাক থেকে প্রাপ্ত কম্পাউন্ডটি বা কম্পাউন্ডগুলি একইরকম কাজ নাও করতে পারে। সুতরাং এবার আপনার চাই ব্রেস্ট ক্যান্সারওয়ালা একটি দেহ যেখানে আপনি এই কম্পাউন্ডগুলি প্রয়োগ করবেন। কোনো মানুষ নিশ্চয়ই নিজের দেহে আপনাকে আপনার এই সাধের কম্পাউন্ডটি প্রয়োগ করতে দেবে না। দেবে কি? সুতরাং আপনার চাই একটি অন্য প্রাণী যার দেহে আপনি ব্রেস্ট ক্যান্সার তৈরী করে তারপর ওই কম্পাউন্ডটি প্রয়োগ করবেন। নানা ধরণের বায়ো-মেডিক্যাল গবেষণার ক্ষেত্রে নানান ধরণের প্রাণী ব্যবহার করা হয়। প্রয়োজন মত। ছোট কেঁচো জাতীয় প্রাণী, সি এলিগেন্ট থেকে শুরু করে ড্রোসোফিলা নামের মাছি, বিভিন্ন রকম ইঁদুর- ছোট (mouse) এবং বড় ইঁদুর (rat), খরগোশ, গিনিপিগ, শূকর, কুকুর, নানা ধরণের বানর, শিম্পাঞ্জি, গরিলা সমস্ত কিছুকেই ব্যবহার করা হয়। আপনার এক্সপেরিমেন্টের ধরণের ওপর কোনধরনের প্রাণী ব্যবহার করা হবে তা নির্ভর করে। ক্যান্সার রিসার্চের কথাই যখন হচ্ছে তখন ছোট ইঁদুর (mouse) এর কথাই বলি। কারণ সবচাইতে বেশি এদেরই ব্যবহার করা হয়। আমায় অনেকেই জিজ্ঞাসা করেছেন আগে যে আমরা পরীক্ষার জন্য ইঁদুর কোথায় পাই?  আরে না না মাঠে ঘাটে ইঁদুর ধরার ব্যাপার নয়। যেমন কোষ সাপ্লাই দেবার জন্য ATCC র মত সংস্থা আছে, তেমনি lab mice সাপ্লাই দেবার জন্য বেশ কয়েকটি কোম্পানি আছে। যারা বিভিন্ন বায়োলজিক্যাল বৈশিষ্ট্যযুক্ত ইঁদুর ব্রিড করে বয়স, লিঙ্গ এবং এক্সপেরিমেন্টের প্রয়োজন মত রিসার্চের জন্য সাপ্লাই করে। যেমন একটা হলো জ্যাকসন ল্যাবরেটরি। তাদের থেকে আপনি দরকার মতন ইঁদুর কিনে নিতে পারেন। নতুবা একটি male-female breeding pair কিনে তাদের থেকে বাচ্চা তৈরী করে নিতে পারেন আপনার এনিম্যাল ল্যাবরেটরিতে।সেটি অবশ্যই সময়সাপেক্ষ। নানা ধরণের ইঁদুর হয়। জীববিজ্ঞানসম্মত ভাবে তারা সবাই ইঁদুর গোত্রীয় হলেও বিশেষ পার্থক্য থাকে। আপনার প্রয়োজন মত কোনো একটি বিশেষ জিনের কার্যকারিতা দেখার জন্য সেই জিনবিহীন বা সেই জিন বেশি করে কাজ করবে এমন ইঁদুর নিয়েও আপনি কাজ করতে পারেন। কিন্তু সেসব পরের ধাপের গল্প। সেসব গল্প প্রয়োজন মতন বলা যাবেখন। আপাতত এটুকু বলি যে, ইঁদুর কিনে বা ইঁদুরের মা-বাবাকে কিনে, তাদের থেকে বাচ্চা পাড়িয়ে আপনার প্রয়োজন মত আপনি ইঁদুর জোগাড় করতে পারেন। কিন্তু এর আগে একটা ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ ধাপ আছে।  সেটি হলো, ইঁদুর (বা যেকোনো ধরণের প্রাণী) নিয়ে গবেষণা করার অনুমতি জোগাড় করা।

আপনি যেমন খুশি, যতগুলো খুশি ইঁদুর নিলেন আর তাদের ওপর যা খুশি তাই পরীক্ষা করলেন সেটি হচ্ছে না। ওরা ইঁদুর বলে কি আপনার মানবতা নেই নাকি?

প্রতিটা ইনস্টিটিউট বা ইউনিভার্সিটি যেখানে আপনি রিসার্চ করছেন, সেখানে একটি ইন্টারনাল কমিটি থাকে। যেখানে অন্য বিজ্ঞানী, আইনজীবীরা থাকেন। 'ইঁদুরে (বা অন্য প্রাণীতে) কাজ শুরু করব'- একথা মনে হলেই আপনাকে একটি আবেদনপত্র পাঠাতে হবে এই কমিটিতে। সেই আবেদন পত্রে আপনাকে স্পষ্ট করে জানাতে হবে কেন ইঁদুরে কাজ করা আপনার প্রয়োজন? এক্কেবারে সঠিক ভাবে কতগুলি ইঁদুর আপনার লাগবে বছরে এই কাজ করতে গেলে সেই সংখ্যাটি আপনাকে জানাতে হবে। গ্রান্ট লেখার সময় যদি আপনি ইঁদুরে কাজ করবার প্রস্তাব করে থাকেন, তখনও আপনাকে নির্দিষ্ট করে এই সংখ্যাটির উল্লেখ করতে হবে। আপনার এক্সপেরিমেন্টের প্রয়োজন অনুসারে এই সংখ্যাটি  নির্ণয় করতে হবে সংখ্যাতত্ত্বের অঙ্ক কষে। এই পর্বে আপনার একজন স্ট্যাটিস্টিশিয়ানের সাহায্য নিতে হতে পারে। কারণ, এই সংখ্যার কম ইঁদুর নিয়ে পরীক্ষা করে পাওয়া কোনো ফলাফলের statistical significance থাকবে না ফলে এতদিন ধরে করা আপনার সাধের গবেষণায় প্রাপ্ত ফলাফলের পরবর্তী ক্ষেত্রে ধ্রুবত্ব পাওয়ার সম্ভাবনা কমবে। বাতিলও হয়ে যেতে পারে।  আর এই সংখ্যাটা পার হয়ে বেশি প্রাণী নিয়ে আপনি গবেষণা করছেন মানে আপনি প্রয়োজনের বেশি প্রাণীহত্যা করছেন। সেটি আপনি করতে পারেন না। সুতরাং এই সংখ্যাটি পার হয়ে যাওয়াটা আপনার পক্ষে মঙ্গলজনক নয়। আবার কম হলেও পরীক্ষার ফলাফল সম্পর্কে সন্দেহ থেকে যায়। ইঁদুর কেনার সময় থেকেই আপনি নজরবন্দি। কটা কিনছেন তার হিসেবে ইনস্টিটিউটের কমিটির কাছে থাকবে। আর ব্রিডিং করিয়ে নেব ভাবলে, আনিম্যাল হাউসিং ফেসিলিটি, মানে যেখানে আপনি ইঁদুরগুলোকে রাখবেন এবং পরীক্ষা নিরীক্ষা করবেন সেই এলাকাতে আপনার ইঁদুরের খাঁচাগুলিকে নজর দেবার জন্য অনেক লোক আছে। তারা এনিম্যাল হাউসের কর্মী। সুতরাং গন্ডগোল নাস্তি।

যাই হোক, যা বলছিলাম, তো সেই ইন্টারন্যাল কমিটিতে আপনাকে এটাও জানাতে হবে আপনি ঠিক কি কি করবেন ইঁদুরদের ওপরে। কোনো রকম পদ্ধতিতে যদি নিষ্ঠুরতা থাকে তবে আপনার আবেদনপত্র থেকে সেই পদ্ধতিটি বাদ দিতে হবে। পরীক্ষা শেষে ইঁদুরদের মারার প্রক্রিয়াতেও আগে তাদের অজ্ঞান করে তারপর তাদের মারতে হবে যাতে যন্ত্রণাদায়ক না হয়। এই পদ্ধতিগুলির নির্দিষ্ট নিয়ম আছে যা ওই কমিটি দ্বারা কঠোর ভাবে নিয়ন্ত্রিত হয়। ইন্টারনাল কমিটির ওপরে স্টেট্ এবং ন্যাশন্যাল কমিটি আছে। তারা নির্দিষ্ট সময় অন্তর আপনার সাধারণ ল্যাব এবং এনিম্যাল ল্যাব ভিসিট করবে। সমস্ত নিয়ম, প্রটোকল মেনে চলা হচ্ছে কিনা খুঁটিয়ে দেখবে। কিছুমাত্র এদিক ওদিক হলেই গন্ডগোল, বিস্তর গন্ডগোল। এমন বহু বহু উদাহরণ আছে যেখানে এই প্রোটকল বা নিয়ম থেকে বিচ্যুতির জন্য সেই বিজ্ঞানীর এনিম্যাল নিয়ে কাজ করা সাময়িক বা বহুকালের জন্য বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে।
আমায় একজন উচ্চশিক্ষিত মানুষ কোনো এক কম্পাউন্ডের প্রসঙ্গে বলেছিলেন, "আরে কটা ইঁদুরে পটাপট মেরে দিয়ে (ইনজেক্ট করে) দেখ না কি হয়।" যদিও তিনি রিসার্চার নন, তার নিয়ম জানার কথাও নয় তবুও বলি- না, "দেখিই না কি হয়" বলে ওরকম ভাবে কোনো প্রাণীতে পটাপট কিছু ইনজেক্ট করে দেওয়া যায় না। আমাদের সে ক্ষমতা আছে বলেই সে ক্ষমতা প্রয়োগ না করার জন্য এত কঠোর নিয়ম আছে। আর সেটা সুষ্ঠ ভাবে মেনে চলাটাই এনিম্যাল এক্সপেরিমেন্টের নৈতিকতা।

যাই হোক এবার এই এনিম্যাল প্রটোকল লিখে, কমিটির রিভিউয়ারদের থেকে সম্মতি নিয়ে, ইঁদুর কিনলেন বা ইঁদুরের মা বাবাকে কিনে বাচ্চা তৈরী করে নিলেন। মোটকথা কাজ শুরু করলেন। এবার তার দেহে ক্যান্সার তৈরী করতে হবে। কি করে করবেন? এক, তাদের দেহে ক্যান্সারের কোষ ঢুকিয়ে আর দুই তাদের শরীরে এমন কিছু জিনগত পরিবর্তন করে যাতে তাদের দেহে নিজে থেকেই ক্যান্সার তৈরী হয়। প্রথম পদ্ধতিতে সময় কিঞ্চিৎ কম লাগে কারণ যেখানে আপনার ক্যান্সার দরকার সেখানে সেই ক্যান্সার কোষই আপনি সরাসরি ইঞ্জেক্ট করছেন। সুতরাং সব কিছু ঠিক থাকে থাকলে কয়েক সপ্তাহেই সেই অঙ্গে টিউমার তৈরী হবে। এক্ষেত্রে ইঁদুরের দেহে ইঁদুরের ক্যান্সার কোষ ঢোকাতে হবে।কিন্তু দ্বিতীয় ক্ষেত্রে ব্যাপারটা খানিক সময়সাপেক্ষ (অবশ্য কোন অঙ্গে বা কোন জিনের পরিবর্তনে আপনি ক্যান্সার তৈরী করছেন তার ওপর নির্ভর করবে সময়ের পরিমাপ)।

প্রথম ক্ষেত্রে একটা সমস্যা আছে, মানুষের ক্যান্সার নিয়ে আপনি কাজ করছেন, জানতে চাইবেনই মানুষের ক্যান্সার কোষগুলি প্রাণীদেহে কেমন ভাবে বাড়ে আপনার ওই কম্পাউন্ডটি প্রয়োগের পর। তাইতো? এখন, ইঁদুরের দেহে আপনি মানুষের ক্যান্সারের কোষ ঢোকালে ইঁদুরের দেহ তাকে নিজের শরীরে বাঁচতে দেবে কেন? অন্য প্রজাতির কোষ দেখলেই তো ঠেলে বের করে দেবে, মানে শরীরের প্রতিরোধশক্তি (immune system) কার্যকরী হয়ে মানুষের ক্যান্সার কোষগুলিকে মেরে ফেলবে। যেমন ভাবে লক্ষ ব্যাকটেরিয়ার সমুদ্রে বাস করেও আমাদের সবসময় শরীর খারাপ হয়না ব্যাকটেরিয়াল ইনফেকশনের জন্য। তাহলে মানুষের ক্যান্সার কোষ দিয়ে ইঁদুরের শরীরে ক্যান্সার তৈরী হবে কি করে? 

হবে। তারও উপায় আছে। ইঁদুরের শরীরের প্রতিরোধ ক্ষমতা কমিয়ে দিয়ে তারপর তার দেহে মানুষের ক্যান্সারের কোষ ঢুকিয়ে টিউমার তৈরী করতে হবে। এই যে বললাম, 'ইঁদুরের শরীরের প্রতিরোধ ক্ষমতা কমিয়ে দিয়ে', এই কথাটির ঠিকঠাক মানে হলো, যে ধরণের শ্বেতরক্তকণিকা আমাদের শরীরে বাইরের কোনো কোষ দেখলে চিনতে পারে এবং তারপর মেরে ফেলে, বা গিলে খেয়ে ফেলে সেই ধরণের প্রতিরোধক কোষ এবং তাদের সমস্ত সহায়ক কোষগুলিকে তৈরী হতে না দেওয়া। ভ্রূণাবস্থা থেকেই ইঁদুরগুলিকে সেইভাবে তৈরী করা হয়। এদের বলে Athymic mice. কেন athymic? কারণ আমাদের শরীরে ওই ধরণের শ্বেত রক্তকণিকা (T lymphocyte) তৈরী করে থাইমাস গ্রন্থি। এই ধরণের ইঁদুরদের এই গ্রন্থিটি কার্যকরী নয়। থাইমাস নেই তাই athymic। এদের দেহে আবার লোম টোম কিচ্ছু গজায় না। গোঁফটি থাকে যদিও দিব্যি। তাই এদের আবার nude mice বলেও ডাকা হয়। এদেরও আপনি কোম্পানি থেকে সোজা কিনে নিতে পারেন। যাই হোক এদের দেহে যেহেতু প্রতিরোধ ক্ষমতাটি প্রায় নেই, তাই মানুষের ক্যান্সার কোষ এদের দেহে ঢোকালেও তাকে বিজাতীয় বলে চিনতে পারবে না ইঁদুরের দেহ। সুতরাং দিব্যি টিউমার তৈরী হবে। তবে অন্য ইনফেকশন হবার সম্ভাবনা এদের বেশি। তাই খাঁচা পরিষ্কার রাখা ইত্যাদির ওপর জোর দিতে হবে।

তা সে যেভাবেই হোক না কেন, আপনি ইঁদুরের শরীরে ক্যান্সার তৈরী করলেন। এবার একটি নির্দিষ্ট সময়ে আপনাকে আপনার তৈরী সমস্ত ইঁদুরগুলি থেকে  আপনাকে বেছে নিতে হবে কেবল তাদেরই যাদের কিনা টিউমারের সাইজ একই। কোষ ঢুকিয়ে টিউমার তৈরী করতে গেলে তাই সবকটা ইঁদুরে সমসংখ্যক কোষ ইনজেক্ট করতে হয়। অর্থাৎ কিনা আপনি যখন আপনার কম্পাউন্ডটি প্রয়োগ করতে শুরু করবেন তখন ভাগ্যক্রমে আপনি ছোট বা বড় টিউমার নিয়ে শুরু করেছেন তাই এমন ফল পেয়েছেন এমন কথা না ওঠে। টিউমার বাইরে থেকে ছবি তোলার নানান পদ্ধতি আছে যেমন মানুষের হয় আর কি। CT scan, MRI ছাড়াও আরো কিছু পদ্ধতি আছে যেখানে ক্যান্সার কোষগুলিকে ইঁদুরের দেহে ঢোকানোর আগেই তাদের এমন ভাবে বদলে দেওয়া যেতে পারে যাতে তারা বাইরে থেকে ছবি তোলার উপযুক্ত একটি প্রোটিন তৈরী করে। ফলে পরে আপনি যখন ছবি তুলবেন তখন টিউমারটি দিব্যি জ্বলজ্বল করবে ছবিতে। এই নিচে একটা ছবি দিচ্ছি দেখুন। এবার তাদের মেপে নিলেই হলো। যাইহোক, ইঁদুরগুলিকে এমন ভাবে দুটি ভাগে ভাগ করতে হবে যাতে দুটি ভাগের টিউমার সাইজের কোনো বিশেষ পার্থক্য না থাকে। এবার একটি দলে আপনি আপনার কম্পাউন্ডটি প্রয়োগ করলেন। কতটা পরিমাণে, সপ্তাহে কতগুলি ডোজে এসব আপনাকে বার বার করে করে বুঝে নিতে হবে। নতুবা আপনার আগে কেউ একই ক্যান্সারে ওই একই কম্পাউন্ড নিয়ে ইঁদুরে প্রয়োগ করে থাকলে তার প্রকাশিত গবেষণাপত্র থেকে আপনাকে আন্দাজ করতে হবে। আর অন্য ভাগে আপনি ওই কম্পাউন্ডটি যে দ্রাবকে গোলা সেই দ্রাবকটি সমপরিমানে ইনজেক্ট করতে হবে। যাতে এটি নিশ্চিত হয় যে কেবলমাত্র আপনার ওই কম্পাউন্ডটিই টিউমারের কমা বা বাড়ার জন্য দায়ী। দ্রবনের অন্য আর কিছু নয়। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই এই পরিমান আর দেবার সময় ভীষণ ভীষণ ক্রিটিক্যাল থাকে। ওই ট্রায়াল এন্ড এরর মেথডে সেই ক্রিটিক্যাল স্তরে পৌঁছাতেই বছর দুয়েক লেগে যায়। তারপর শুরু হয় আসল পরীক্ষা। এই বার আপনি বেশ কয়েকসপ্তাহ পরীক্ষা করে তারপর আবার বাইরে থেকে ছবি তুলে টিউমারগুলির অবস্থা দেখে নিতে পারেন বা ইঁদুরগুলির দেহ থেকে টিউমার বের করে নিয়ে তাদের সাইজ, ওজন মেপে দেখতে পারেন টিউমার কমছে কিনা। অনেকসময় ও দেখা যায় যে, টিউমার সাইজ না কমলেও ক্যান্সারের ছড়িয়ে যাওয়া (metastasis) কমছে। সেটিও বড়োই কার্যকরী বিষয়।

এবার এই একই পরীক্ষা আপনাকে বার বার করে দেখতে হবে। নির্দিষ্ট সংখ্যার ইঁদুরে করে স্টাটিস্টিক্যাল সিগ্নিফিকেন্স অবধি পৌঁছাতে হবে। তারপর আপনি ভাববেন আচ্ছা তাহলে কোষস্তরে শুধু নয়, প্রাণীদেহেও কম্পাউন্ডটি কাজ করছে। দাঁড়ান দাঁড়ান, এখনো এই কম্পাউন্ডটিকে আমরা ওষুধ বলতে পারিনা। এখনো অনেক কাজ বাকি। এবার আপনাকে আপনার কোষস্তর (in vitro) এবং প্রাণীদেহের (in vivo) পরীক্ষার পদ্ধতিগত খুঁটিনাটি এবং তার থেকে প্রাপ্ত সমস্ত ফলাফল গবেষণা পত্রের আকারে লিখে বৈজ্ঞানিক পত্রিকায় (জার্নালে) প্রকাশ করতে হবে। কোনো ভুল থেকে থাকলে তাঁরা প্রকাশের আগে জার্নালের রিভিউ বোর্ডে থাকা বিজ্ঞানীরা তা খুঁটিয়ে দেখে ভুল সংশোধন করে তবেই তা প্রকাশ হবে। সেটি তখন পৃথিবীর সমস্ত বিজ্ঞানী মহলে উন্মুক্ত। তারপর অন্তত দশ বছর লাগে এই অবস্থা থেকে মানুষে ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল শুরু হতে। কেন? সে গল্প  পরের দিনে বলি বরং। আজ এপর্যন্তই থাক। পরের দিন বলব ইঁদুর থেকে মানুষে প্রয়োগ শুরু হবার মাঝের সংগ্রামের কথা।

ভাল থাকবেন সবাই।
আজ আসি।

অর্পিতা 

Saturday 19 October 2019

#এই_সপ্তাহের_শেষে-3

#এই_সপ্তাহের_শেষে

৩. ওষুধ আবিষ্কার (পর্ব-২) 
--------------------------------

যত দূর বলেছিলাম তার পর থেকে বলি কেমন? কদ্দুর যেন বলেছিলাম? হ্যাঁ, কলমিশাক এর সাথে ব্রেস্ট ক্যান্সারের সম্পর্ক নিয়ে যথা সম্ভব পড়াশুনা করেছেন আপনি, তারপর ফান্ডিং এজেন্সিতে গ্রান্ট লিখে তার বহু বহু পরিমার্জনা করে তারপর কিছু টাকা পেয়েছেন গবেষণা করার জন্য। তারপর আপনি আপনার প্রয়োজন মত সহকারী জোগাড় করেছেন। এই তিন ধাপ পেরিয়ে আপাতত আপনি চতুর্থ ধাপে। কাজ শুরু করবেন এইবার।   

৪.  কাজটি কি? না "কলমিশাক কি ব্রেস্ট ক্যানসারকে আটকাতে পারে?" - এই প্রশ্নের উত্তর খোঁজা। কি করে সেকাজ শুরু হবে? ব্রেস্ট ক্যান্সার এর রোগীর ওপর তো সরাসরি কিছু পরীক্ষা করা সম্ভব নয়। যদি আপনার কারিকুরির ফলে রোগীটির কিছুমাত্র সমস্যা হয়, তবে আপনি এবং আপনার বিজ্ঞানসাধনা তো চিরজীবনের মত গেলেনই আপনার ইন্সটিটিউটের ওপরও ঝড় কম যাবে না। তাই শুরু করা হয় ক্যান্সারের কোষ দিয়ে। কোথায় পাব ক্যান্সারের কোষ? ধরা যাক, কোনো রোগীর ব্রেস্ট টিউমার সার্জারি করে বের করা হয়েছে বা বায়োপসি করে টিউমার থেকে খানিকটা অংশ নেওয়া হয়েছে। সেই অংশে অসংখ্য ক্যান্সার কোষ (Cell, সেল) থাকবে। আপনি কোষ পাবেন সেখান থেকে। এই অংশে আপনার মানে বিজ্ঞানীর সাথে সার্জেন বা অঙ্কোলজিস্ট অর্থাৎ ডাক্তারদের কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করতে হবে। গবেষকদের প্রতি তাঁদের সদর্থক সহযোগিতা ছাড়া এটি বড়োই কঠিন। দুৰ্ভাগ্যবশতঃ কলকাতায় লিউকেমিয়া পেশেন্ট ব্লাড স্যাম্পেল জোগাড় করার প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি, আমাদের বড়োই কষ্ট করতে হয় একটা পেসেন্ট স্যাম্পেল জন্য। একটি স্যাম্পল পেতে বেশিরভাগ সময়েই রিসার্চারকে পুরো একটি দিন হাসপাতালে ধর্ণা দিয়ে পড়ে থাকতে হয়। তাতেও যে ব্যবহারযোগ্য অবস্থায় স্যাম্পলটি মিলবে, তার কোনো স্থিরতা নেই। কোনো সঠিক লিখিত পদ্ধতিই নেই কোনো হাসপাতালে। এখানে ব্যাপারটা অপেক্ষাকৃত সহজ। ফলে রিসার্চের ফলাফলের ওপর ভিত্তি করে ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালগুলো শুরু করাও সহজ হয় এখানে। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ এবং চিকিৎসকদের সক্রিয় সহযোগিতা বাড়লে তবেই একমাত্র আমাদের দেশে হওয়া বায়ো-মেডিক্যাল রিসার্চের জোর বাড়ে।

যাক যা বলছিলাম, মনে করুন সার্জারির পর যত তাড়াতাড়ি সম্ভব টিউমারের অংশটি থেকে খানিকটা নিয়ে কুচি কুচি করে খুব ছোট ছোট অংশে ভাগ করে নেওয়া হল। এবার যদি ওই ছোট ছোট কুচি গুলোকে এক্কেবারে মানুষের দেহের ভেতরের পরিবেশ না হলেও মোটামুটি একইরকম একটা পরিবেশ দেওয়া হয় (যেখানে তারা খেয়ে পরে বেঁচে থাকতে পারবে কিছুদিন, মানে আমার এক্সপেরিমেন্ট যতদিন চলে ততদিন অন্তত), তাহলে তারা কিন্তু সেখানে বেঁচে থাকবে এবং সংখ্যায় বাড়বেও। এই যে সরাসরি রোগীর দেহ থেকে নিয়ে ল্যাবরেটরিতে তাদের বাঁচিয়ে রাখার বিষয়টা, তাকে ল্যাবের ভাষায় বলব প্রাইমারি কালচার (primary culture)। প্রাইমারি কেন? না যেহেতু সোজা রোগীর দেহ থেকে ল্যাবের প্লাস্টিকে এসেছে। ওহো , 'প্লাস্টিক' বললাম কারণ, ল্যাবে সাধারণত বিশেষ ধরণের প্লাস্টিকের তৈরী পাত্রে (Cell culture quality) কোষগুলিকে বাড়তে দেওয়া হয়। আপনার এক্সপেরিমেন্টের প্রয়োজনীয়তা অনুসারে সেসব পাত্রের আকার আয়তন বিভিন্ন হয়। নীচে কয়েকটা ছবি দিচ্ছি culture vessel এর।

এখন প্রশ্ন, বলে তো দিলাম এই সব পাত্রে কোষ গুলি ফেলে দিলে তারা কিছুদিন খেয়ে পরে বেঁচে থাকতে পারবে। দেহের ভেতরে তো খাবার অভাব নেই। কিন্তু দেহের বাইরে তারা খাবেটা কি? সুতরাং Culture vessel-এ আমাদের সেই কোষের বেঁচে থাকার প্রয়োজনীয় সঠিক খাবার দিতে হবে। বেশির ভাগ সময়েই সেটি তরল। কারণ সেখান থেকে প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র টেনে নিতে কোষের সুবিধা হয়। এই তরলে থাকবে নির্দিষ্ট অনুপাতে নানান ধাতব লবন, হরমোন, আরো নানান বায়োকেমিক্যাল সাপ্লিমেন্ট। এই অনুপাতটি ভীষণ ভীষণ সতর্ক ভাবে ঠিক রাখা দরকার নইলে কোষগুলি বাঁচবে না। এই তরলটি হলো গ্রোথ মিডিয়া (growth media)। এই মিডিয়ায় রেখে সাধারণত সাঁইত্রিশ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় এবং পাঁচ শতাংশ কার্বন ডাই অক্সাইড গ্যাসে কোষগুলিকে রাখা হয়। সাধারণত বললাম কিন্তু। বিভিন্ন ধরণের কোষের বাঁচার পরিবেশ বিভিন্ন তাই দেহের বাইরে তাদের বাঁচিয়ে রাখার জন্য প্রয়োজন বিভিন্ন ধরণের মিডিয়া। বিভিন্ন ধরণের এবং বিভিন্ন স্টেজের ব্রেস্ট ক্যান্সার হয়। সবরকম ক্যান্সারের ক্ষেত্রেই এই কথাটি প্রযোজ্য। এবং একটি ব্রেস্ট টিউমারের মধ্যেই বিভিন্ন ধরণের কোষ থাকে যাদের কাজ, বাঁচার শর্ত আলাদা। ধরা যাক, আপনি এই ব্রেস্ট ক্যান্সারের এই কোষগুলির জন্য উপযুক্ত মিডিয়া কি হবে তা জানেন। গ্রোথ মিডিয়া তৈরী করে এমন নানা বায়োমেডিক্যাল কোম্পানি আছে। তাদের তৈরী করা মিডিয়ার লিস্টে যদি আপনি আপনার দরকারি মিডিয়াটি পেয়ে গেলেন তো ভালোই। তাদের থেকে কিনে নিলেন। নইলে আপনার প্রয়োজনীয় গ্রোথ সাপ্লিমেন্ট, লবন ইত্যাদি কিনে কোনো পরিচিত মিডিয়ায় মিশিয়ে আপনার নিজের মিডিয়া বানিয়ে নিতে হবে। আর যদি একেবারেই নতুন ধরণের কোষ হয় তাহলে তো আরো কাজ বাড়লো। আপনাকে ট্রায়াল এন্ড এরর মেথডে আস্তে আস্তে কোষগুলির সঠিক মিডিয়া খুঁজে নিতে হবে।

কিন্তু এখনো একটা বড় প্রশ্ন আছে। এই প্রাইমারি কোষগুলি বেশিদিন দেহের বাইরে বেঁচে থাকে না। দু- চার সপ্তাহ বড় জোর। তাহলে? বার বার তো মানুষের শরীর থেকে কোষ নেওয়া যাবে না। তাহলে উপায়? তার সমাধান হলো কোষগুলির আয়ুষ্কাল কোনোভাবে বাড়িয়ে দেওয়া বা অমর করে দেওয়া। সেইটি কি সম্ভব? নিশ্চয়ই সম্ভব। কিকরে সেটা এখনই বলছি না। মহাভারত হয়ে যাবে এই লেখাটিই তবে। সে পদ্ধতি সম্পর্কে পরে একদিন বলবখন। এখন এটুকু বলি যে, আপনি নিজে সে কোষের আয়ুষ্কাল বাড়িয়ে দিতে পারেন। নতুবা, বেশ কিছু কোম্পানি আপনার কাজ কমানোর জন্য সে দায়িত্ব নিয়ে নিয়েছে। যেমন American Type Culture Collection (ATCC). আপনি সে কোম্পানি থেকে কিছু সংখ্যক কোষ কিনে নিতে পারেন। তারপর মনে করুন তাদের থেকে কিছু কোষ নিয়ে উপযুক্ত মিডিয়ায় রেখে সংখ্যায় বাড়িয়ে তারপর ছোট ছোট অংশে ভাগ করে অত্যন্ত ঠান্ডায় (-১৪০ থেকে -২০০ ডিগ্ৰী সেলসিয়াস) রেখে দিলে তারা বেশ কিছু বছর ঠিক থাকে। প্রয়োজন মত একটা অংশ বের করে নিয়ে আবার মিডিয়ায় রেখে বাড়িয়ে নিয়ে কাজ শুরু করলেই হলো। এই সংরক্ষণের কাজে ওই অত ঠান্ডা কি করে করা হয়? কেন? তরল অবস্থায় নাইট্রোজেন (লিকুইড নাইট্রোজেন) আছে তো। প্রায় -২০০ ডিগ্রি তাপমাত্রা তার। তবে সাবধান, লিকুইড নাইট্রোজেন একবার চামড়ায় লাগলো মানে কিন্তু সে অংশের চামড়াটি আপনার গেল।

আর একটা কথা, কোম্পানি হিসেবে আমি কেবল ATCC র কথা বললাম কেন? কারণ আপনি যেখান থেকে আপনার culture টি কিনছেন তাদের সেই কোষটির সমস্ত বৈশিষ্ট্য বজায় আছে এমন গ্যারেন্টি দিতে হবে।  সময় এবং culture এর বয়স অনুসারে কোষের কিছু বৈশিষ্ট্য বদল হয়ে  যেতে পারে। তখন আপনি ভাববেন এক, আর কোষটি আচরণ করবে সম্পূর্ণ অন্যরকম। সেই কোষ থেকে পরীক্ষা করে আপনি কিছুই ঠিকঠাক প্রমাণ করতে পারবেন না। ATCC সেই গুরুদায়িত্ব সসম্মানে পালন করে আসছে। সারা পৃথিবীতে bio-medical রিসার্চে সেল টাইপ এর প্রধান এবং নির্ভরযোগ্য ভাঁড়ারঘর তাই ATCC। তবে এছাড়াও আরো বেশ কিছু কোম্পানি এবং সংস্থা আছে  যারা এই কোষ সরবরাহের কাজটি করে থাকেন। এখন আপনার কাজের প্রয়োজনে আপনি নিজে যদি কোনো নতুন ধরণের কোষ খুঁজে পান এবং তার বৈশিষ্ট্যগুলো শুদ্ধভাবে বজায় রেখে তাকে অমরত্ব দান (Immortalized) করে দিতে পারেন, তবে সেই কোষ ও আপনি কোনো কোষ ব্যাংক, রিপোজিটরিতে দিতে পারেন। যাতে পৃথিবীর যেকোনো জায়গা থেকে সে কোষ গবেষকরা প্রয়োজন মত ব্যবহার করতে পারেন। বা আপনাকে সরাসরি কেউ যোগাযোগ করলে আপনাকে সেই কোষ তাঁকে পাঠাতে হবে। এটিই পৃথিবী জুড়ে গবেষণার নৈতিক নিয়ম (ethical rule)। আপনার আবিষ্কার নিঃসন্দেহে আপনার। প্রত্যেকে সে আবিষ্কারকে ব্যবহার করার সময় আপনার ঋণস্বীকার করবে। কিন্তু আপনাকে আমার জিনিস বলে আপনার আবিষ্কারকে আগলে রাখলে চলবে না। 

৫. যাই হোক, আপনার হাতে এতক্ষনে ব্রেস্ট ক্যান্সার কোষটি এলো। এবার আপনার চাই কলমিশাক এর নির্যাস। তার জন্য আপনার চাই একজন রসায়নবিদ, কেমিক্যাল বায়োলজিস্ট বা কেমিস্ট যিনি আপনার হয়ে ওই নির্যাস বানাবেন এবং তাকে রাসায়নিক বৈশিষ্ট্য অনুসারে বিভিন্ন রকম অংশে ভেঙে কোষে দেবার উপযুক্ত করে তুলবেন। আমি কেবল উদাহরণ হিসেবে কলমিশাক কথাটি ব্যবহার করছি। এই পর্বটি দরকার হবে না যদি আপনি আগে থেকে জানা কখনো রাসায়নিক বা বায়োলোজিক্যাল কম্পাউন্ড নিয়ে কাজ করেন। সেক্ষেত্রে আগে থেকেই কোনো রসায়ন বিজ্ঞানী এই কাজটি করে রেখেছেন। আপনি ওই কম্পাউন্ড কিনে নিতে পারেন বা ফার্মাসিউটিক্যাল ল্যাব থেকে পেতে পারেন। অবশ্যই কতটা কিনবেন বা পাবেন তার অত্যন্ত সূক্ষ্ম হিসেব সময়মত আপনাকে জমা দিতে হবে।

৬. এবার আপনি এই কম্পাউন্ডটি কোষে প্রয়োগ করে নানান পরীক্ষা করতে শুরু করবেন। এই অংশটি আমি এখনই বিশদে যাচ্ছি না কারণ এটির কোনো শেষ নেই। কি কি করতে হতে পারে, তা নির্ভর করবে আপনার প্রশ্নের ওপর। আমি এই সিরিজে আস্তে আস্তে এই পরীক্ষাপর্বের কিছু কিছু সংক্ষেপে বলার চেষ্টা করব। আপাতত মনে করুন আপনি জানতে চান ওই কম্পাউন্ড ব্রেস্ট ক্যান্সাররের বৃদ্ধি কমায় কিনা? এর জন্য সাধারণত অন্তর্নিহিত প্রশ্নগুলি কি হতে পারে? মোটামুটি এরকম ধরা যেতে পারে। প্রাপ্ত ফলাফলের পরিপ্রেক্ষিতে এর পরিবর্তন হতে পারে যদিও। তবে গতিটা মোটামুটি এরকম। কম্পাউন্ডটি কি ব্রেস্ট ক্যান্সার কোষের সংখ্যা বৃদ্ধি কমায়? উত্তর হ্যাঁ হলে,  পরবর্তী প্রশ্ন কি করে? কোষগুলিকে একেবারে মেরে ফেলে? নাকি তাদের বংশবিস্তার রোধ করে? তাদের অন্য জায়গাতে ছড়িয়ে যেতে বাধা দেয় কি? নাকি সেই চলনে বাধা দিতে পারে না কিন্তু প্রাথমিক বৃদ্ধিতে বাধা দেয়? তাই যদি হয় তবে এই কম্পাউন্ডটি প্রাথমিক অবস্থায় কাজ করতে পারে। এডভান্স স্টেজে নয়। বা উল্টোটাও হতে পারে। আরো আরো নানান প্রশ্ন এবং তার উত্তর খোঁজা। পরীক্ষা পদ্ধতির গল্পটা বরং এখন থাক। পরে নিশ্চয়ই কিছু কিছু করে বলবো।

যাইহোক, আপনার এই প্রাথমিক পরীক্ষা-নিরীক্ষার ফলে যদি কিছু আশাব্যঞ্জক উত্তর মেলে তবে সেই পরীক্ষা আপনাকে অন্তত তিন বা বেশি বার করে করে সে সম্পর্কে নিশ্চিন্ত হতে হবে যে অন্তত কোষস্তরে কম্পাউন্ডটি কাজ করছে। এখানে গবেষকদের মধ্যে প্রচলিত একটা টার্ম বলে রাখি, পরে কোথাও পড়লে "বুঝি না" বলবেন না যেন। যেকোনো কোষ স্তরের পরীক্ষা নিরীক্ষা, যা কোনো প্রাণীদেহের বাইরে কালচার ভেসেলে করা হচ্ছে তাকে আপনি ইন ভিট্রো (In vitro) এক্সপেরিমেন্ট বলতে পারেন। কিছু না, সংক্ষেপে বলার জন্য একটা শব্দবন্ধ আর কি। এই In vitro এক্সপেরিমেন্ট করে মোটামুটি খুব ছোটখাটো একটা আশার আলো দেখতে খুব তাড়াতাড়ি হলেও বছর দুই-তিন সময় লাগে। কারণ, আপনার পরীক্ষা পদ্ধতির সমস্ত স্টেপ আপনাকে বার বার টেস্ট করে সম্পূর্ণ প্রটোকলটিকে আগে নিশ্ছিদ্র করে নিতে হবে। অর্থাৎ আপনি এ ব্যাপারে প্রথমে নিশ্চিন্ত হবেন যে, আপনি 'যেভাবে' পরীক্ষাটি করছেন তাতে প্রাপ্ত রেজাল্টটি বিশ্বাস যোগ্য হচ্ছে কিনা। এই অংশটি  হলো 'assay optimization' । তারপর আপনি আসল পরীক্ষাটি করবেন। এবং অন্তত বার বার বিভিন্ন সময়ে তিন থেকে পাঁচবার একই ফল পেলে তবে বলবেন যে "হ্যাঁ কিছু একটা হলেও হতে পারে।"  তিন থেকে পাঁচ বার অন্তত একই ফলাফল পেতেই হবে আপনাকে। এবং যদি কোনো আশাব্যঞ্জক বদল দেখেন তবে সেই বদলটি যে সংখ্যাতত্ত্বগত ভাবে গুরুত্বপূর্ণ (statistically significant) বদল, সেটিও আপনাকেই অঙ্ক কষে দেখতে হবে। নইলে বিশ্ব জুড়ে বিজ্ঞানীদের কাছে আপনার প্রাপ্ত ফলাফলের কোনো মূল্যই থাকবে না। ফলে সময় লাগবেই। আমি বছর দুই-তিন  বললাম যুক্তরাষ্ট্রের নিরিখে। ভারতে এই কাজ করতে কমপক্ষে অন্তত পাঁচটি বছর লাগবে। কারণ, প্রায় প্রতিটি দরকারি জিনিস আমাদের তখন বিদেশ থেকে কিনতে হবে। ভারতে প্রায় কিছুই আমরা তৈরী করে উঠতে পারিনি এখনো। করলেও তার নির্ভরযোগ্যতা কম বলে তার গ্রহণযোগ্যতাও কম। এটি একটি মস্ত সমস্যা। অতি সাধারণ একটি এক্সপেরিমেন্ট যা যুক্তরাষ্ট্রে একসপ্তাহে করা সম্ভব সেটি করতে ভারতে মাসের পর মাস অপেক্ষা করতে হতে পারে। কারণ সেই পরীক্ষার জন্য প্রয়োজনীয় একটি জিনিস হয়ত অর্ডার করার পর ট্যাক্স, কাস্টমস, কাগজপত্র পেরিয়ে বিদেশ থেকে আসতে তিন মাস সময় নিয়ে নিলো।

এই রে! অনেক গল্প হয়ে গেল আজ। বড্ড দেরি করিয়ে দিলাম না? কোষস্তরে আশার আলো দেখার পর প্রাণীদেহে পরীক্ষা নিরীক্ষা শুরু হয়। সে গল্প বরং পরের সপ্তাহে বলব। আজ তাহলে এটুকুই থাক। কেমন! আসি তবে? পরের সপ্তাহে ইঁদুরদের নিয়ে হাজির হয়ে যাবোখন।

ভাল থাকবেন সক্কলে।

অর্পিতা

Saturday 12 October 2019

#এই_সপ্তাহের_শেষে-2

#এই_সপ্তাহের_শেষে

২. ওষুধ আবিষ্কার (পর্ব-১) 
-------------------------------
'শেষ পর্যন্ত ক্যান্সারের ওষুধ আবিষ্কার বাঙালি বিজ্ঞানীর।'

ধরা যাক, রোব্বারের সকালে ঘুম থেকে উঠে আপনি খবরের কাগজটি খুললেন বা ফেসবুকের পাতাটি স্ক্রল করতে শুরু করলেন আর এরকম একটি শিরোনাম দেখতে পেলেন। অনেকসময় এরকম ধরণের খবর পড়া যায় তো পত্র-পত্রিকায়, ফেসবুকেও। তাই না? আপনি বেজায় উত্তেজিত হয়ে খবরটি পড়তে শুরু করলেন। সাধারণত এধরণের খবরের জন্য খবরের কাগজে বিশেষ বেশি জায়গা খরচ হয়না। সুতরাং খবরের সংক্ষিপ্ততার জন্য চটপট খবরটি পড়ে ফেলতে আমাদের কারোরই কোনো অসুবিধা হলো না। তারপর আপনার চেনা জানা কারো প্রয়োজনের সময় দেখা গেল, ওই পরিবেশিত খবরটি কোনো কাজেই লাগছে না। যে নতুন ওষুধটির কথা বলা হয়েছিল, সেটি দিয়ে চিকিৎসা তো হচ্ছে না। তখন আপনার মনে দুই ধরণের ভাবনা আসতে পারে। এক, পরবর্তী সময়ে এরকম কোনো খবর আসলে আপনি বিন্দুমাত্র উৎসাহিত না হয়ে পাতা উল্টে চলে যাবেন। এবং "রিসার্চ-ফিসার্চ করে আদতে কিস্যু হচ্ছে না"- এই ধারণা আপনার দৃঢ় হবে। আর দুই, 'বায়ো-মেডিকেল সায়েন্টিস্ট' বলে একদল লোক আধুনিক চিকিৎসাপদ্ধতি এবং নতুন ওষুধ এনে যুগের পর যুগ ধরে চিকিৎসা শাস্ত্রকে আধুনিকতা প্রদান করে চলেছেন এবং অসংখ্য ডাক্তারদের হাত ধরে আপনার প্রেসক্রিপশনে সে আধুনিক চিকিৎসার ছোঁয়া লাগছে সে সম্পর্কে আপনি বিন্দুমাত্র মনোযোগ দেবার প্রয়োজন অনুভব করবেন না।

তাহলে পরিবেশিত খবরটি কি ভুয়ো? খবরের মূল বিষয়টি ভুয়ো নাও হতে পারে, কিন্তু পরিবেশনাটি ভুল নিঃসন্দেহে। কারণ হয়ত খবরটি এরকম ছিল, 'অমুক গবেষণা কেন্দ্রের অমুক বিজ্ঞানী দেখেছেন, অমুক জিনিসটি প্রয়োগ করলে অমুক ক্যান্সারের কোষ মারা যাচ্ছে। তিনি এবং তাঁর দল বিষয়টি অমুক জার্নালে প্রকাশ করেছেন।' এই পর্যন্ত খবরটি সঠিক। এরকম অজস্র আবিষ্কার অহরহ হয়ে চলেছে। কিন্তু সমস্যা পরের অংশ টুকু নিয়ে। কোনো একটি জিনিসে ক্যান্সারের কোষ মারা যাওয়া মানেই সেই জিনিসটি কোনো ডাক্তার কোনো রোগীর প্রেসক্রিপশনে লিখতে পারেন না। আর আগে পরে অজস্র ধাপ থাকে। ভ্যালিডেশনের। সুতরাং খবরের ওই "ওষুধ আবিষ্কার" শব্দবন্ধটি এক্ষেত্রে সম্পূর্ণ ভুল এবং সংবাদ পরিবেশকের দায়িত্বজ্ঞানহীনতার পরিচায়ক ছাড়া কিচ্ছু নয়।

তাহলে "ওষুধ আবিষ্কার" কথাটি বলার সময় কখন আসবে?

মনে করা যাক, এরকমই একটা উদাহরণ, 'কলমিশাক খেলে ব্রেস্ট ক্যান্সার হয়না।' এটা সত্যি সত্যি কোনো খবর নয়, কোনো কাগজেও বেরোয়নি। এমনি উদাহরণ হিসেবে 'কলমিশাক' কথাটা ব্যবহার করছি (এইমাত্র ভাত দিয়ে খেলাম তো, তাই ঐটাই মনে পড়ছে এখন)। এই 'কলমিশাক' কথাটির জায়গায় আপনারা X, Y, Z যেকোনো কেমিক্যাল বা বায়োলজিক্যাল কম্পাউন্ড বসিয়ে নিতে পারেন। এখন এই কথাটি থেকে কলমিশাককে ব্রেস্ট ক্যান্সারের ওষুধ হিসেবে প্রেসক্রিপশনে লেখার মাঝে রয়েছে অজস্র প্রশ্ন আর সে প্রশ্নের উত্তর খোঁজার অজস্র ধাপ। সে ধাপগুলি প্রশ্নাতীতভাবে উত্তীর্ণ হলে, তবেই বলা যেতে পারে যে কলমিশাক খেলে ব্রেস্ট ক্যান্সার হয়না। তা কি সেই প্রশ্ন এবং কিই বা তার সমাধান পদ্ধতি? বেশ, কোনো একজন বৈজ্ঞানিক এই বিষয়ে কাজ করলে তাঁকে কোন কোন পদ্ধতির মধ্যে দিয়ে যেতে হবে তার একটা ধারণা দেবার চেষ্টা করা যাক।

এক লাইনে পদ্ধতিটার একটা ধারণা দিতে গেলে বলতে হয়, প্রথমে কলমিশাক আর ব্রেস্ট ক্যান্সারের আদৌ কোনো সম্পর্ক থাকলেও থাকতে পারে এমন তথ্য সম্পৰ্কে পড়াশুনা করে প্রমাণ জোগাড় করা। তারপর সে সম্পর্কে গবেষণার জন্য টাকাপয়সা জোগাড় করা। নব্বইভাগ ক্ষেত্রেই অর্থের সংস্থান হয়না কারণ এর জন্য কোনো প্রোডাকশন হাউস নেই। যদি ধরা যায় টাকার জোগান হলো, তখন লোকজন জোগাড় করা। তারপর ল্যাবে বছরের পর বছর ধরে কোষস্তরে কলমিশাকের আন্টিক্যান্সার গুণকে প্রমাণ করা। তারপর প্রাণীদেহে মানে ইঁদুর বা বানর জাতীয় প্রাণীতে প্রমাণ করা। তারপর সেই ফলাফল গবেষণা পত্ররূপে জার্নালে প্রকাশ করা। সারা পৃথিবীর বিজ্ঞানীরা প্রয়োজন মত আপনার সেই ফলাফলের সত্যতা নিজেদের ল্যাবে প্রমাণ করে দেখার বা তাতে কিছু যোগ বিয়োগ করার কাজ চলবে বেশ কিছু বছর ধরে। তারপর যখন বারে বারে পৃথিবীর বিভিন্ন জায়গায় একই ফলাফল পাওয়া যাবে, তখন মানুষের দেহে সেই এন্টিক্যান্সার কম্পাউন্ড প্রয়োগ করার আবেদন করা। সেই আবেদন পত্র গৃহীত হলে খুব অল্পসংখ্যক মানুষে মানে রোগীদের কাছ থেকে লিখিত সম্মতিপত্র নেওয়া। তারপর তাঁদের দেহে অন্য ওষুধের সাথে সেটি প্রয়োগ করা। কোনো অযাচিত বিষক্রিয়া না থাকলে আরো বেশি মানুষে প্রয়োগ করা। সেখানে ভাল ফল পাওয়া গেলে আরো বেশি সংখ্যক মানুষে তা প্রয়োগ করা।  তারপর তাঁদের বেশ কিছু বছর ধরে নজরে রাখা। যদি কোনো বাজে ঘটনা না ঘটলে তবে সেই কম্পাউন্ডের তখন প্রয়োগ শুরু হবে। এই অবস্থায় তাকে আপনি ওষুধ বলতে পারেন। প্রায় ত্রিশ পঁয়ত্রিশ বছর পেরিয়ে গেছে ইতিমধ্যে। সারা পৃথিবীর অন্তত পাঁচশ জন মানুষ কাজ করেছেন এই প্রকল্পে। একসাথে ছোট ছোট দলে বা আলাদা আলাদা ভাবে। কিন্তু এই এত চেষ্টা সত্ত্বেও বছর পাঁচ দশের মধ্যে সেই ওষুধ আবার কাজ করা বন্ধ করে দিতে পারে। কেন? বলব। বিশদেই বলব। এর প্রত্যেকটি ধাপ সম্পর্কে আলোকপাত করব বলেই এই লেখা লিখতে শুরু করেছি। এই যুদ্ধের সলতে পাকানো থেকে যুদ্ধজেতার পর বিজয়োৎসব পর্যন্ত আমি আপনাকে আমার সাথে নিয়ে ঘুরিয়ে দেখাবো। গলিঘুঁজিগুলো না হলেও রাজপথের আশপাশের মাইলস্টোনগুলো তো নিশ্চয়ই দেখাবো। ধৈর্য্য রাখুন একটু।

প্রথম থেকেই শুরু করি তবে? তাহলে পুরো গল্পটা বুঝতে সুবিধা হবে। কেমন!

তাহলে, কলমিশাকের এন্টিক্যান্সার গুণ আছে এটি গবেষণা করে দেখতে গেলে একজন বিজ্ঞানীকে কি করতে হবে?     

১. প্রথমেই সেই বৈজ্ঞানিককে যে প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হবে সেটি হলো, কলমিশাক এর সাথে ব্রেস্ট ক্যান্সার উপশম হওয়া বা না হওয়ার সম্পর্ক থাকতে পারে এমন উদ্ভট কথা মনে করার কারণ কি?
সুতরাং কলমিশাক এবং ব্রেস্ট ক্যান্সার সম্পর্কে সেই বৈজ্ঞানিকের কিছু পড়াশুনা, কাজের অভিজ্ঞতা, প্রাথমিক ছোটখাটো কিছু গবেষণার তথ্য বা অন্য পূর্বজ বৈজ্ঞানিকদের প্রকাশিত কিছু গবেষণালব্ধ প্রমাণ বা গবেষণাপত্র থাকতে হবে। সেই প্রমাণ ব্রেস্ট ক্যান্সার সংক্রান্ত না হলেও অন্তত যার থেকে অনুমান করা যায় যে কলমিশাকের কিছুমাত্র এন্টিক্যান্সার গুণ থাকলেও থাকতে পারে। যদি সে বৈজ্ঞানিক কলমিশাক সংক্রান্ত যাবতীয় তথ্য (কেবল মাত্র প্রমাণিত গবেষণা পত্র, কোনো ওয়েবসাইটের প্রকাশিত খবর নয়) জোগাড় করে, পড়াশুনা করে মনে করেন, এই বিষয়ে কিছু গবেষণার প্রয়োজন তবেই তিনি পরবর্তী ধাপে এগোবেন। সে গবেষণার হাইপোথেসিসটি আগেই বলেছি, "কলমিশাক খেলে ব্রেস্ট ক্যান্সার হয় না।" অর্থাৎ এই ধাপটি হলো 'Review of literature and preliminary data collection.'

২. পরবর্তী ধাপটি সবচেয়ে কঠিন এবং হতাশাজনক। সেই গবেষণার জন্য খরচ জোগাড় করা। এখন, এই ধরণের গবেষণার জন্য ফান্ডিং করেন কারা? প্রথম নামটা কিন্তু কখনোই কোনো ওষুধ কোম্পানির নয়। সুতরাং, ওই যে আগের দিন বলছিলাম, "রিসার্চ আজকাল পুরোটাই মার্কেটিং আর কোম্পানিগুলো থেকে ফান্ডিং পাবার ধান্দা" এজাতীয় কথাবার্তা একাডেমিক রিসার্চের ক্ষেত্রে মোটেই গ্রহণযোগ্য নয়। এক্ষেত্রে প্রথম এবং প্রধান পৃষ্ঠপোষকঃ হলেন, সংশ্লিষ্ট দেশের সরকার। সায়েন্স এন্ড টেকনোলজি ডিপার্টমেন্ট বা হেলথ ডিপার্টমেন্ট। যেমন ভারতের কোনো বায়োমেডিক্যাল সায়েন্টিস্টের নতুন কোনো রিসার্চ প্রপোজাল এর ফান্ডিং এর জন্য আবেদন পাঠানোর ঠিকানা হলো, ডিপার্টমেন্ট অফ বায়োটেকনোলজি (DBT), ডিপার্টমেন্ট অফ সায়েন্স এন্ড টেকনোলজি (DST), কাউন্সিল অফ সায়েন্টিফিক এন্ড ইন্ডাস্ট্রিয়াল রিসার্চ (CSIR), ইন্ডিয়ান কাউন্সিল অফ মেডিকেল রিসার্চ (ICMR), ডিফেন্স রিসার্চ এন্ড ডেভেলপমেন্ট অর্গানিজশন (DRDO) ইত্যাদি। আবার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষেত্রে bio-medical রিসার্চের প্রধান পৃষ্ঠপোষক হল ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অফ হেলথ (NIH), যার মধ্যে অজস্র বিষয়ভিত্তিক ভাগ আছে। যেমন  ক্যান্সার সংক্রান্ত প্রপোজালের জন্য ন্যাশন্যাল ক্যান্সার ইনস্টিটিউট (NCI), ডায়াবেটিস সংক্রান্ত রিসার্চের জন্য ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অফ ডায়াবেটিস এন্ড ডাইজেস্টিভ এন্ড কিডনি ডিজিসেস (NIDDK) ইত্যাদি। এছাড়াও আছে ডিপার্টমেন্ট অফ ডিফেন্স (DOD) ইত্যাদি। এই গেল কেন্দ্রীয় সরকারি ফান্ডিং এজেন্সিগুলোর কথা। এছাড়াও রাজ্যসরকারী বা স্থানীয় কিছু সরকারি ফান্ডিং থাকে। তার পরিমাণ খুবই সামান্য এবং সর্বদা সেখানে আবেদন গ্রহণ করা হয় না।

এই গেল সরকারি ফান্ডিং এর কথা। এছাড়াও কিছু বড় কোম্পানি বা সংস্থা কিছু কিছু ফান্ডিং করে থাকেন কিন্তু সে ফান্ডিং এবং তা থেকে প্রাপ্ত গবেষণার ফলাফল কোনো ভাবেই তারা কেবলমাত্র নিজস্ব লাভের জন্য ব্যবহার করতে পারবে না এই শর্তে। অর্থাৎ 'conflict of interest' নিয়মকানুন কঠোর ভাবে মানা হয় সেখানে। ভারতে এরকম একটি ননপ্রফিট ননগভর্ণমেন্ট ফান্ডিং এজেন্সি হলো টাটা। তাঁদের বদান্যতায় শুরু হওয়া TIFR এখন দেশের অন্যতম রিসার্চ ইনস্টিটিউট যেখানে তাবড় তাবড় ভারতীয় বৈজ্ঞানিকরা সরকারি ফান্ডিংয়ে বড় বড় কাজ করছেন। যুক্তরাষ্ট্রে এরকম আরো অনেক বিষয়ভিত্তিক সংস্থা আছে যারা নির্দিষ্ট বিষয়ে পৃষ্ঠপোষকতা করে। যেমন, আমেরিকান হার্ট এসোসিয়েশন (AHA), আমেরিকান ডায়াবেটিস এসোসিয়েশন (ADA) ইত্যাদি।

এখন এই ফান্ডিং জোগাড়ের প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে ওই বৈজ্ঞানিককে তার কাজের ধরণ এবং তার অন্তিম প্রয়োগ অনুসারে এইসব ফান্ডিং এজেন্সির কোনো একটিকে পছন্দ করতে হবে, যেটি তাঁর ওই কাজের জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ দিতে ইচ্ছুক হতে পারে। অর্থাৎ ক্যান্সার সংক্রান্ত কাজের আবেদন হার্ট এসোসিয়েশনে না করাই শ্রেয়।

এইবার ওই বৈজ্ঞানিককে পূর্ববর্তী প্রকাশিত তথ্য এবং তা থেকে ভবিষ্যতে কি করা যেতে পারে তার ভিত্তিতে একটি আবেদন পত্র লিখতে হবে ওই ফান্ডিং এজেন্সিকে। এই ধাপটি হলো 'Grant writing.' এই পদ্ধতিটি সঠিক ভাবে শেখা এবং তা সঠিক ভাবে প্রয়োগ করাই সফলভাবে গবেষণা চালানোর মূলমন্ত্র বর্তমান সময়ের বৈজ্ঞানিকদের জন্য। কারণ, আপনার অনুমান, তার সপক্ষে ১০০% নিশ্ছিদ্র তথ্য না দিতে পারলে এবং সেই ভিত্তিতে আপনি ঠিক কী প্রমাণ করতে চাইছেন সেটি ফান্ডিং এজেন্সির রিভিউইং বোর্ডের সে বিষয়ে অভিজ্ঞ বৈজ্ঞানিকদের পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে বোঝাতে না পারলে আপনি ফান্ডিং পাবেন না। এই অর্থ জোগাড়ের পদ্ধতিটি সম্পর্কে পরে আরো বিশদে লেখার ইচ্ছে রইল। কারণ, কতখানি সতর্কতার সাথে, অভিজ্ঞ বিশেষজ্ঞদের দ্বারা বিজ্ঞান ও বাজেটের বিন্দু বিন্দুর হিসেব রেখে এই অর্থ বরাদ্দ এবং খরচ হয় সেটি না জানলে, "রিসার্চ আজকাল পুরোটাই মার্কেটিং আর কোম্পানিগুলো থেকে ফান্ডিং পাবার ধান্দা"  - এজাতীয় ধারণার বদল হওয়া সম্ভব নয়।

এবং এত করেও অনেক সম্ভাবনাময় আবেদনপত্র খারিজ হয়ে যায়। সংশ্লিষ্ট সংস্থার যথেষ্ট টাকা না থাকার কারণে, সঠিক রিভিউইং বোর্ডের হাতে না পড়ার কারণে, প্রজেক্টটি নিশ্ছিদ্র না হবার কারণে বা আরো অন্য কারণে। এমন অনেক উদাহরণ আছে যে একটি প্রজেক্ট বহু বছর ধরে বার বার বিভিন্ন ফান্ডিং এজেন্সিতে আবেদন করেও স্যাংশান না হয়ে শেষ পর্যন্ত বৈজ্ঞানিক হাল ছেড়ে দিলেন। তারপর অন্যান্য প্রজেক্টের ঝড়তি পড়তি অর্থ ব্যবহার করে আস্তে আস্তে অল্প অল্প করে কাজ করে বহু বছর পরে সাংঘাতিক গুরুত্বপূর্ণ একটি আবিষ্কার করেছেন সেই প্রজেক্টটি থেকে, যা সম্পূর্ণ নতুন একটি দিক খুলে দিয়েছে সেই সংক্রান্ত গবেষণার।

যাই হোক, আপাতত ধরা যাক, আমাদের ওই বৈজ্ঞানিকের লেখা কলমিশাক সংক্রান্ত আবেদনপত্র বা গ্রান্ট বার বার রিভিউ, পরিবর্তন, পরিমার্জন, পরিবর্ধন হবার পর, যুক্তি-প্রতিযুক্তির বেড়া ডিঙিয়ে বছর খানেক বা তারও বেশি সময় পরে স্যাংশন হলো। অর্থাৎ ওই যে প্রথমে বলেছিলাম-"কলমিশাকের কি ব্রেস্ট ক্যান্সার আটকাবার ক্ষমতা আছে?" এই প্রশ্নের উত্তর পাবার জন্য ওই বৈজ্ঞানিক কিছু অর্থ পেলেন। এখানে বলে রাখি, এই অর্থ কিন্তু কোনো মতেই ওই বৈজ্ঞানিকের নিজস্ব, তা নয়। কারণ, ওই অর্থ থেকে ওই বৈজ্ঞানিকের ব্যাংক ব্যালেন্স বাড়বে না। যথেচ্ছ ভাবে ওই অর্থ খরচ করতে তিনি পারবেন না। ওই অর্থ যে কেবলমাত্র অনুমোদিত প্রজেক্টই খরচ করা হয়েছে সেই রিপোর্ট তাঁকে সায়েন্টিফিক রিপোর্টসহ যথোপযুক্ত অডিট হবার পর ভবিষ্যতে ফান্ডিং এজেন্সিকে জমা দিতে হবে।  এবং অর্থটি আসবে সেই বিজ্ঞানী যে ইউনিভার্সিটি বা ইনস্টিটিউটে কাজটি করছেন সেই ইউনিভার্সিটি বা ইনস্টিটিউটের একাউন্টে। যাই হোক, এখন টাকা স্যাংশান হবার চিঠি বা ইমেলটি পাবার সময় থেকে অর্থটি সত্যি সত্যি একাউন্টে আসার মাঝে অনেকসময়ই বিস্তর সময়ের ব্যবধান থাকে। সে কথা বাদ দিলে অতি সংক্ষেপে এই হলো 'Grant writing and funding approval' এর গল্প।

৩. এবার সেই প্রজেক্টে কাজ শুরু হবে। এখন যদি প্রজেক্টটির বাজেট অনুসারে বৈজ্ঞানিককে সাহায্য করার জন্য অন্য আরো একটি বা দুটি সাহায্যকারী নিয়োগ করার সুযোগ থাকে তবে তাদের এই পর্যায়ে নিয়োগ করা হবে। সাহায্যকারী বলতে বিভিন্ন শিক্ষাগত যোগ্যতা এবং অভিজ্ঞতা অনুসারে গ্রান্ট লেখার সময়েই সেই বিজ্ঞানী টেকনিসিয়ান, ছাত্র (PhD স্টুডেন্ট) বা পোস্টডক্টরাল ফেলো ইত্যাদি দরকার বলে আবেদন করবেন। সেই সাহায্যকারীর বেতন বা ফেলোশিপও সেই গ্রান্ট থেকেই আসবে। সুতরাং গ্রান্টটি যদি তিন বা পাঁচ বছরের হয় তবে ওই সাহায্যকারীর ফেলোশিপ বা বেতনের মেয়াদও তিন বা পাঁচ বছর। অনেক সময় বিজ্ঞানীর নিজস্ব বেতনের একটা শতাংশও যদি এর মধ্যে থাকে তবে গ্রান্ট এর মেয়াদ শেষে বিজ্ঞানীর বেতনের ওই শতাংশ অর্থ তিনি আর পাবেন না। সুতরাং আমাদের ওপরতলা থেকে নিচেরতলা সমস্ত ক্ষেত্রেই টাকাপয়সার ব্যাপারটা নড়বড়ে। আজ আছে কাল নাও থাকতে পারে। এসব হলো যদি গ্রান্টটি বড় গ্রান্ট হয় তবেই। বেশিরভাগ ছোট গ্রান্ট এর ক্ষেত্রে লোকজন নেবার সুযোগ থাকে না। সেক্ষত্রে নতুন শুরু করা বিজ্ঞানী নিজেই কাজ করেন। আর সিনিয়র সায়েন্টিস্টরা তাঁদের আগের বা অন্য ongoing প্রজেক্টে কাজ করা লোকজনের মধ্যে কাজটি বাঁটোয়ারা করে দেন। অথবা অনেক সিনিয়র সায়েন্টিস্টকে দেখেছি সব কিছু সামলে সন্ধ্যার পরে নিজে ল্যাবে কাজ করেন।

এবার ল্যাবের কাজ শুরু হবে। কিন্তু সে অনেক লম্বা পদ্ধতি। সংক্ষেপে বললেও বড্ড বড় হয়ে যাবে লেখাটা। তখন আর আপনার পড়তে ইচ্ছে করবে না। তার চাইতে আজ বরং এই পর্যন্তই থাক কেমন? পরের সপ্তাহে বরং আমি আপনাকে নিয়ে ল্যাবে ঢুকবো।

আজ আসি।  ভালো থাকুন সবাই।
অর্পিতা 

#এই_সপ্তাহের_শেষে-1

#এই_সপ্তাহের_শেষে

১. কৈফিয়ৎ
---------------

নাহ, এবার ভাবলাম শুরু করেই ফেলি। অনেকদিন ধরেই ভাবনাটা ছিল। বলা ভাল, ভাবনাটা তৈরী হচ্ছিল, বিবর্তিত হচ্ছিল। কিন্তু ভাবনার প্রকাশ যে করতেই হবে, করাটা যে অত্যন্ত জরুরি, সে বিষয়ে কোনো দ্বিধাই ছিল না। কোনো একটি কাজ শুরু করার আগে সে সংক্রান্ত ভাবনার বীজটা থেকেই থাকে ভেতরে। কোনো একটা ঘটনায় সেই ভাবনাটা তীব্র হয়ে ওঠে। তারপর নানান ঘটনায় কাজটা শুরু করা একটা দায় হয়ে পড়ে।

ভাবনা বা কাজটা কী সেটা বলার আগে একটা কথা প্রথমেই বলি, এখানে আমি সোজা কথা সোজা এবং সপাটেই বলব। কোনো সাহিত্যসৃষ্টি, ভনিতা বা অপ্রয়োজনীয় বিনয় না করেই। করলে, যে উদ্দেশ্যে এই আয়োজন, সেটার গোড়াতেই গলদ রয়ে যাবে।

এবার ভাবনাটা তীব্র হয়ে ওঠার পেছনের ঘটনাটা বলি। ২০১৬ সাল জুলাই-আগস্ট মাস। ওমাহায় কাজ করতে আসার আট-নয় মাস পরের কথা। ড্রাইভিং টেস্ট দিতে গেছি। ওমাহায় পাবলিক বাস হাতে গোনা কয়েকটা চলে নির্দিষ্ট রুটে। সুতরাং, গাড়ি থাকাটা লাক্সারি নয়, বাজার দোকান করার জন্যই অত্যাবশকীয়। যেসব শহরে বাস ট্রেন চলে, সেখানে রিসার্চ স্কলাররা বিলাসিতা দেখাতে গাড়ি কেনে না। একাডেমিক রিসার্চ স্কলার বা পোস্টডক্টরাল ফেলোদের আর্থিক সামর্থ্য যা, তাতে বিলাসিতার জায়গাই নেই। তারা পুরোনো, ব্যবহৃত গাড়ি কম দামে কেনে। কেনে মানে, চার-পাঁচ বছরের কন্ট্রাক্টে, মাসিক কিছু ডলারের কিস্তিতে। আর কিছুটা ডাউন পেমেন্টের জন্য বেশিরভাগ সময়েই তাদের চেনাশোনা সিনিয়র বা ব্যাংক থেকে ধার নিতে হয়। আমরাও তাই করেছিলাম। এত কথা বলছি কি জন্য? কারণ, এই সিরিজের পাঠকদের মাথায় এইটা সর্বদা থাকা উচিৎ বলে আমার মনে হয়েছে যে, আমেরিকা (বা অন্য ইউরোপিয়ান দেশে) যারা রিসার্চ করতে আসে তারা টাকার গদিতে শুয়ে থাকে না। প্রথমে আসে কাজটা করবে বলে, অনেক ডলার রোজকার করবে বলে নয়। রিসার্চে টাকা রোজকার করা যায় না। একথা যেকোনো দেশে রিসার্চের জন্য বাজেটে বরাদ্দ টাকার পরিমাণ বা শতকরা ভাগ থেকেই  আপনারা যে কেউ, যে কোনো সময় মিলিয়ে নিতে পারেন। এবং সবচাইতে বড় কথা, এসব কথা জেনেই তারা রিসার্চ করতে আসে। কেন আসে, সে কথা অন্য আর একদিন বুঝিয়ে বলবখন। 

সুতরাং খেয়ে পরে বেঁচে থাকার রসদ সংগ্রহ করতেই ওমাহার মতন জায়গায় আমাদের মতন আজন্ম বাসে-ট্রেনে গলদঘর্ম হয়ে যাতায়াত করা লোকজনের গাড়ি চালানোর দরকার হয়ে পড়ে। মাস দেড়েক সিনিয়র দাদার কাছে হাতেখড়ি আর অভ্যাস করে একদিন ড্রাইভিং টেস্ট দিতে গেলাম। আমার পাশে বসে এক্সামিনার আমায় নিয়মমত সকালের ব্যস্ত রাস্তায় এদিক ওদিক ঘুরিয়ে, এমার্জেন্সি স্টপ করিয়ে, আরো যা যা ওদের নিয়ম আছে সেসব দেখে আধঘন্টা পর ফিরিয়ে নিয়ে এলেন। সেযাত্রা যদিও আমি লাইসেন্স পাইনি। কারণ, সমস্ত রাস্তাটা ঠিকঠাক চালিয়ে আসার পর ব্যস্ত চৌমাথায় প্রায় চোখের সামনে একটা এক্সিডেন্ট হতে দেখে ভয়-টয় পেয়ে আমি রাস্তার পাশে বাঁধানো জায়গায় (কার্ব বলে এখানে) গাড়ির একটা চাকা তুলে দিয়েছিলাম। স্বভাবতই পরীক্ষক আমায় ফেল করিয়েছিলেন। পরের মাসে আবার পরীক্ষা দিয়ে সসম্মানে অনুমতি পেয়েছিলাম। যাক সেসব অন্য গল্প। এ সিরিজের সাথে তার কোনো সম্পর্ক নেই। এই সিরিজের সাথে যুক্ত এর পরের অংশটি।

আমার ফেল করে ফিরে আসার পর পিনাকী গেল ওই একই পরীক্ষকের সাথে পরীক্ষা দিতে। আধঘন্টা পর ফিরে এলো হাসি মুখে। পাশ করেছে। এরপর থেকে মন দিয়ে শুনুন। গাড়িতে ওঠার সাথে সাথে পরীক্ষক পিনাকী জিজ্ঞাসা করেছেন, সে কি করে। পিনাকী বলেছে সে রিসার্চ করে। বিষয়টা প্যানক্রিয়াটিক ক্যান্সার। এই একটি কথা শুনেই নাকি পরীক্ষক একেবারে আপ্লুত হয়ে পড়েছেন। ওমাহায় ভারতীয় রিসার্চ স্কলারের সংখ্যা নেহাত কম নয়। সুতরাং এই কথায় এত বিহ্বল হবার কি আছে? কারণটা পরীক্ষকের পরের কথায় পরিষ্কার হবে। "ওহ, প্যানক্রিয়াটিক ক্যান্সার! খুব খারাপ ক্যান্সার, মরণ ব্যাধি তাইনা? আর TGF-beta এর জন্য দায়ী তাই না?" পরীক্ষকের বলা বাক্যটার প্রথম অংশে অবাক হবার মতন কিচ্ছু ছিল না। প্যানক্রিয়াটিক ক্যান্সার যে মারণ ব্যাধি একথা সকলেই জানে। কিন্তু দ্বিতীয় অংশটায় অবাক হবার মতন যথেষ্ট মশলা রয়েছে। একজন মোটর ভেইকেল ডিপার্টমেন্টের রাজ্যসরকারী কর্মচারী প্যানক্রিয়াটিক ক্যান্সার জানতে পারেন কিন্তু "TGF-beta" কথাটা জানবেন কি করে? পিনাকীও যথেষ্ট অবাক হয়েছিল। এতটাই অবাক হয়েছিল যে, গাড়ির সিটবেল্ট না লাগিয়েই ড্রাইভিং টেস্ট দিতে শুরু করে দিয়েছিল। অতঃপর পরীক্ষক ব্যাখ্যা করেছেন যে তিনি ইন্টারনেটে প্যানক্রিয়াটিক ক্যান্সারের কথা পড়তে গিয়ে TGF-beta সম্পর্কে জেনেছেন। এবং তার পরে পুরো ড্রাইভিং টেস্টের রাস্তাটাই প্যানক্রিয়েটিক ক্যান্সার, রিসার্চ এইসব সংক্রান্ত কথাবার্তা বলেছেন এবং প্রায় বিনা প্রশ্নেই পিনাকীকে পরীক্ষায় সসম্মানে উত্তীর্ণ ঘোষণা করেছেন। গল্প এখানেই শেষ। এবার কাজের কথা বলি। এই ঘটনা থেকেই তিন বছর পর আমার এই সিরিজের উৎপত্তি। কেন? বলছি।

এখন ভাবছেন তো, TGF-beta আবার কি? একটা বাক্যে বললে, আমাদের দেহের কোষ নিঃসৃত অসংখ্য অত্যাবশকীয় পদার্থের মধ্যে একটি, যা কোষকে বাঁচিয়ে রাখতে সাহায্য করে।  আর বেশি হলে শুধু প্যানক্রিয়াটিক কেন, অনেক রকম ক্যান্সার বা অন্য রোগও বাঁধতে পারে। কিন্তু আজকের লেখাটা এই TGF-beta নিয়ে নয়। ভয় পাবেন না। এবিষয়ে আপনাদের জ্ঞানদান করব না। তাহলে এই গল্প আপনাদের সামনে ফেঁদে বসলাম কেন? কারণটা আরো একটু বিশদ। আরো বেশি ভাবনার দাবি রাখে। 

ভাবুন, সরকারি অফিস কাজ করা একজন মানুষ, প্যানক্রিয়াটিক ক্যান্সারের কথা জানতে ইচ্ছে হয়েছে বলে ইন্টারনেটে কিছু পড়াশুনা করেছেন। সেখান থেকে TGF-beta র নাম জেনেছেন। অর্থাৎ স্বাস্থ্য সংক্রান্ত বিষয়ে কিছু জানার থাকলে, জীববিজ্ঞান তেমন ভাবে না জানা মানুষও ইন্টারনেট থেকে পড়ে কিছুটা ধারণা করতে পারেন। এটা আশার কথা। কিন্তু সাথে সাথে ভয়েরও কথা। কারণ, এক, তিনি জানবেন না-যেখান থেকে তিনি পড়ছেন, সেটি নির্ভরযোগ্য উৎস কিনা। অর্থাৎ, টাইপ করা লাইনগুলির সত্যতা, বিশেষজ্ঞের দ্বারা যাচাই করার পর ওই ওয়েবসাইটে দেওয়া হয়েছে কিনা? আর দুই, যা পড়ছেন, আর যা বুঝছেন, দুটোই একই কিনা? যেমন এক্ষেত্রে, TGF-beta র ব্যাপারটা। TGF-beta কোনো ভাইরাস বা ব্যাকটেরিয়া নয়, যে শরীরে এলো আর আপনার প্যানক্রিয়াটিক ক্যান্সার হয়ে গেল। এর জন্যেই যে প্যানক্রিয়াটিক ক্যান্সার হয় তার কোনো স্থিরতা নেই। কিন্তু ভদ্রলোক পড়েছেন, ভগবান জানেন কোন সোর্স থেকে, আর কনফিডেন্সের সাথে বলছেন যে TGF-beta থেকে প্যানক্রিয়াটিক ক্যান্সার হয়। আমাদের দেশে আরো একটি সমস্যা এর সাথে যুক্ত হয়। সেটি হলো, আমাদের অনেকেরই ইংরাজিতে পড়বার অভ্যাস নেই। আর ইন্টারনেটের তথ্য প্রায় পুরোটাই ইংরেজিতে। মনে করুন, অতি অল্প পড়াশুনার সুযোগ পেয়েছে এমন একজন মানুষ, যাঁর হাতে স্মার্টফোন আছে, তিনি কেবল ভাষাটিতে সড়গড় নন বলেই গুগুল থেকে তার প্রশ্নের উত্তর পেলেও পুরোপুরি আত্মস্থ করতে পারবেন কি? ফলে আমাদের আশেপাশেই এমন অনেক মানুষ আছেন যাঁরা পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত unsupervised স্বাস্থ্যবিজ্ঞান সংক্রান্ত খবর পড়ে বিভ্রান্ত হন। 

এজন্যই এখন বহু চিকিৎসক অমূল্য সময় ব্যয় করে তাদের লেখা লিখছেন। মানুষ অনেক কিছুই স্পষ্ট জানতে পারছেন। কিন্তু তবুও একটি গ্যাপ এখনো আছে। সেটি হলো আমাদের মত মানুষরা ঠিক কি করি, কিভাবে করি, করে কি এমন ব্যাঙের মাথা উপকার হচ্ছে, সেটি সম্পর্কে বিশেষ কোনো লেখা আমার চোখে অন্তত পড়ে না। তার একনম্বর কারণ হলো, আমরা জানাতে আগ্রহী নই অনেক সময়েই। সময়ের অভাবে, লেখার ইচ্ছের অভাবে এবং অবশ্যিই পাঠকের উৎসাহের অভাবে কারণে। মানুষ জানতে চান না গবেষনা সম্পর্কে। কিন্তু পত্র পত্রিকা পড়ে বিজ্ঞানের অজস্র ভুল ব্যাখ্যা করেন অহরহ। অনেকসময়ই যার বিন্দুমাত্র সত্যতা থাকে না। আবার গুছিয়ে লিখলে সেটি একটু বেশি মাথা খাটাতে হবে বলে, "পরে পড়বখন" বলে পাশে সরিয়ে রাখেন। স্টিফেন হকিংস এর প্রকাশক তাঁর 'A brief history of time' প্রকাশের আগে তাঁকে বলেছিলেন, ওয়ান ফর্মুলা ইক্যুয়াল টু টেন থাউজেন্ড রিডার। মানে লেখায় একটি ফর্মুলা থাকা মানে ১০০০০ কম লোক বইটি কিনবে। এবং এই জন্য সে বইয়ের ভূমিকায় তাঁকে পাঠকদের আশ্বস্ত করতে লিখতে হয়েছিল, যে, E=mc^2 ছাড়া এই বইতে কোনো ফর্মুলা ব্যবহার করা হয়নি। 

আমাদের মুখ না খোলার কারণে বেশ কিছু বাজে এবং ভুল ধারণা চলে আসছে। তার দায় আমিও অস্বীকার করতে পারিনা। যেমন, 

১. আমারই আত্মীয়, বন্ধু, পরিচিত মহলে যদি এজাতীয় ধারণা চলে যে, "ক্যান্সার কোনো রোগ নয়, ভিটামিন-C এর অভাব। ড্র্যাগ কোম্পানি গুলো ব্যবসা করবে বলে এসব চালাচ্ছে।" তবে তার কিছুটা দায় আমারও বটে। এই ধারণাকে লালন করলে, অজস্র ক্যান্সার রিসার্চারের দিবারাত্র এক করে, টাকা-পয়সার তোয়াক্কা না করে, পুরো জীবনের পরিশ্রমকে কি পরিমাণ অপমান করা হয় সে ধারণা দেব বলে এই সিরিজের শুরু। 

২. "রিসার্চ আজকাল পুরোটাই মার্কেটিং আর কোম্পানিগুলো থেকে ফান্ডিং পাবার ধান্দা" এই বাক্যের সত্যতা আদপে কতটা সেটা আমার ট্রেনিং, শিক্ষানবিশির অভিজ্ঞতা থেকে ধারণা দেওয়ার ইচ্ছেতেই এই সিরিজ। 

৩. নতুন গবেষণার (Bio-medical science) কথা গল্পাকারে শোনাবো বলেই এই সিরিজ। 

৪. এবং সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত খবর গুলির সত্যতা এবং অথেন্টিসিটি কিভাবে বিচার করতে হয়? কি তার মাপকাঠি? বায়ো-মেডিক্যাল রিসার্চের কোয়ালিটি কন্ট্রোল কিকরে করা হয়? কোনো কোম্পানির সে রেজাল্টে কারচুপি করার কোনো ক্ষমতাই যে নেই সেকথা ততক্ষণ বোঝানো সম্ভব নয়, যতক্ষনণ না গোড়া থেকে শেষ পর্যন্ত পুরো পদ্ধতিটা মানুষ জানছেন। নইলে অত্যন্ত কনফিডেন্সের সাথে যেকোনো একটি ওয়েবসাইটে প্রকাশিত, যেকোনো একটি খবরে তিনি বিশ্বাস করবেনই। কারণ, ঠিক-ভুল বিচার করার পদ্ধতিটি তাঁর সামনে কেউ তুলে ধরছে না। 

মানুষ সমস্ত কিছু সম্পর্কে উৎসাহী, কেবল বিজ্ঞান বাদে। তার কারণ হিসেবে তাঁরা এই বাক্যটি খাড়া করেন-"আমরা তো সাধারণ মানুষ, আমরা কি বুঝবো?" এর মধ্যে আমাদের খুব খুব কাছের লোকেরাও আছেন। আসলে মাথা খাটাতে অনীহা। এত পরিশ্রম কে করে? হয়ত উৎসাহ দেখালে দেখতেন, যিনি বলছেন, তিনি অত্যন্ত সহজ করে গল্পাকারে বলছেন। পরিশ্রম ছাড়াই সঠিক তথ্য আপনার হাতে চলে আসত। 

আমি একটু আধটু জীববিজ্ঞান শিখেছি, শিখছি এবং আশা করছি ভবিষ্যতেও শিখব। সেই অভিজ্ঞতা আর ট্রেনিং থেকে আমি Bio-medical science এর গবেষণা এবং গবেষকদের কথা লিখব। যেমন পারি তেমনই লিখব। সপ্তাহে হয়ত একটাই লিখে উঠতে পারব (সেজন্যই সিরিজের নাম: 'এই সপ্তাহের শেষে')। প্রতিটি তথ্যনির্ভর লেখা reference সমেত লিখব। যা জানিনা, সেটা লিখব না। কিন্তু এটুকু নিশ্চয় করে আমি বলতে পারি, যা লিখব, তা ১০০% অথেন্টিকেটেড। কারণ সে ট্রেনিং আমার আছে।

সুতরাং আমি চেষ্টা করব। এবং আরো একটা কথা, আমি যেটুকু লিখি ফেসবুকে, কখনো বিশেষ কারণ ছাড়া কাউকে ট্যাগ করি না। তাতে আমার মনে হয়, জোর করে ঘাড় ধরে মানুষকে আমার লেখা পড়তে বাধ্য করছি নাতো? কিন্তু এই সিরিজের ক্ষেত্রে আমি বেশ কিছু মানুষকে ট্যাগ করব। কারণ, তাদের সূত্র ধরে এই লেখা বেশি সংখ্যক মানুষের কাছে পৌঁছোবে। আর সেটাই আমার একমাত্র উদ্দেশ্য। তাতে যদি অন্তত এই হাস্যকর ভুলভাল ধারণাগুলির কিঞ্চিৎ বদল হয়। যদি কারো ট্যাগিংএর জন্য কিছুমাত্র অসুবিধা থাকে, নির্দ্বিধায় বলবেন। আমি ট্যাগ সরিয়ে নেব।   

পড়ুন। কিছু ভুল লিখলে শুধরে দিন। বাজে কথা বলছি মনে হলে, আপনার যুক্তি দিয়ে আমায় খণ্ডন করুন। যদি মনে হয়, আরো কিছু না বলা রয়ে গেল, জিজ্ঞাসা করুন। আমি না জানলে, আমার পরিচিত কেউ সে বিষয়ে বিশেষজ্ঞ হলে তাঁকে টেনে এনে আমরা দুজনেই শিখে নেব। কিন্তু ঠিকটা না জেনে কোনো ধারণা করবেন না দয়া করে। বেসিক রিসার্চ সম্পর্কে উদাসীন থাকাটা আমার-আপনার দুতরফেরই লজ্জার। আমি আমার কাজ শুরু করলাম। আপনাকেও ডাক দিলাম হাতে হাত ধরার। 

ভাল থাকবেন সবাই।

অর্পিতা