Thursday 31 July 2014

The lost key

I have tried my best
To reach to the light
All the doors were closed
Keys were inaccessible to me
I am waiting for some spark
Please snatch me from this room
Only you can convert me to a tiny river
I am not hoping for a huge flow 
Only a tiny inner flow is enough for that tiny river
Freezing cold everywhere like death
Inadequate air to breathe fully
Please take me out before my death
I lost my mind
Lost my strength
Lost my urge of wisdom
In these useless business
A dark curtain all around me
I failed to annihilate it off
You only can make me free from this blank
Now I can only wait for your loving hand
To acquire the key for coming out from this room

Tuesday 29 July 2014

চক্রবর্তী to চ্যাটার্জী

একটা মানুষের পদবী কতরকম ভাবে স্থির হতে পারে? সাধারনভাবে জন্মানোর পর 'ভ্যাঁ' বেরোনোর আগেই আপনার আমার পদবী ঠিক হয়ে গেছে। আমি পিজি হাসপাতালে ল্যান্ড করার সাথে সাথেই আমার বাবা আমাকে দেখার আগেই আমি অমুক 'চ্যাটার্জী' হয়ে গেলাম। কোনো এক সত্য যুগে আমার মা 'চক্রবর্তী' ছিল। আমার মধ্যে সেই চক্রবর্তীত্বের ছিটেফোঁটাও নেই। এটাই নাকি নিয়ম। হবে হয়ত। কার যে নিয়ম কে জানে। আমি যদি না চাই তবুও আমায় শুধুমাত্র নিয়ম বলেই নামের পেছনে একটা এক্সট্রা লেজুড় বয়ে বেড়াতে হবে। অবশ্য তাতে আমার কোনো অসুবিধা হয়নি বরং 'অর্পিতা'-র পরে 'চ্যাটার্জী' বিষয়টা বেশ ভালই লাগে। কিন্তু এমনও একজনকে জানতাম যার নাম ও পদবী কোনো ফর্মে ইংরিজি বানান করে লিখতে গেলে মাঝের স্পেসটা ধরলে চব্বিশটা খোপ লাগে। বেচারার পদবি হলো গুহঠাকুরতা। নামটিও ততোধিক লম্বা। সে বেচারাকে মাঝেমাঝেই ফর্ম পূরণ করতে গিয়ে আক্ষেপ করতে শুনেছি "ওফফ ! পদবিটা যখন এতবড় নামটা তো অন্ততঃ ছোটো করে কিছু একটা দিতে পারত। এখন আমি লিখব কোথায়? অতগুলো খোপই তো নেই ফর্মে।" বেচারাকে নাম লেখার জায়গায় পেন দিয়ে কয়েকটা এক্সট্রা খোপ বানাতে হত প্রায় প্রতিটা ফর্মেই। এখন যদি সে নিজের সুবিধার জন্য সে পদবির জায়গায় 'সেন', 'রায়' বা 'দে' লেখে অথবা কিছুই না লেখে তবে তো তার এই আজন্মের ফর্ম পূরণের সমস্যার সমাধান হতে পারে? পারে কিনা বলুন? কিন্তু তা সে পারবে না। কারণ 'নিয়ম নেই'। অতএব "চল নিয়ম মতে"।

যাক গে এইসব গোলমেলে নিয়ম নিয়ে পরে একদিন বসা যাবেখন। আপাতত আমার মায়ের পদবী কি করে 'চক্রবর্তী' থেকে রাতারাতি 'চ্যাটার্জী' হয়ে গেল সে ঘটনার দুচারটে মুখরোচক গল্প বলি। কুমারী মায়ারানী চক্রবর্তী তো কোনক্রমে হুগলী জেলার কোনো এক গন্ডগ্রাম থেকে স্কুলের পড়াশুনা শেষ করে নিজচেষ্টায় চন্দননগর কলেজে ভর্তি হয়ে চুঁচুঁড়ার বড়দির বাড়ি থেকে যাতায়াত শুরু করলো। কলেজের শেষ পরীক্ষার পর কোনো এক সময় হঠাতই জানতে পারল, সেই যে সে তার চারফুটিয়া চেহারাটা নিয়ে স্টেশন যাবার রাস্তাটা দিয়ে দিন দুবেলা গুড়গুড় করে যাতায়াত করত, সেই সময় সে একজনের চোখে পড়ে গেছে। না না, যা ভাবছেন তা নয়। আমার বাবা তখন অনেক অনেক কিলোমিটার দূরে মিলিটারি ব্যারাক থেকে বেরিয়ে প্যারেড ট্যারেড করছেন হয়ত। তাঁর এসব জাগতিক রোম্যান্স-টোম্যান্সের দিকে তাকাবার সময় নেই। আমার মাকে দেখতে পেয়ে গেছিলেন আমার ছোটোপিসি। তিনিও কয়েকদিন সেই গুড়গুড়ে মেয়েটিকে লক্ষ্য নজর করে টরে মনে মনে নিজের 'বিয়েই করবনা' পণ করে বসা ছোটোভাইটির জন্য পছন্দ করে ফেললেন। তারও পরে বেশ কয়েকদিন গেল ভাইটিকে বিয়ের জন্য রাজি করাতে। শেষে দুপক্ষের সম্মতিক্রমে পাত্র-পাত্রীর ছবি দেওয়া নেওয়ার বন্দোবস্ত করা হলো। কুমারী মায়ারানীর বাড়ির লোকজন তো তার সম্ভব্য পাত্রপক্ষকে দেওয়ার জন্য আগে থেকেই তুলে রাখা ঠোঁটের কোণে পাতলা হাসিসহ আড়চোখে তাকানো কুমারী মায়ারানীর একটা ছবি পাঠিয়ে দিলেন আমার ছোটোপিসির জিম্মায়। সমস্যাটা হলো পাত্রপক্ষে। একে তো অনেক কষ্টে ছোটো ভাইটিকে রাজি করানো হয়েছে বিয়ে করতে। তারপর যদি আবার ছবির উত্কর্ষতা নিয়ে বেশি কথাবার্তা বলা হয় তবে হয়ত মিলিটারী মেজাজের চোটে বিয়ের প্ল্যানটাই ভেস্তে যাবে। ফলে হাতের কাছে যে ছবিটা পাওয়া গেল শ্রীমান প্রশান্তকুমারের বাড়ির লোকজন সেটিকেই মেয়ের বাড়ি পাঠিয়ে দিলেন পাত্রীর পাত্র পছন্দ কিনা জানতে। আমি আপনাদের ছবিটি দেখাচ্ছি। দেখে বলুন এই ছবি দেখে কোনো পাত্রীর পক্ষে পাত্র পছন্দ করা সম্ভব কিনা?

           
না না ! আমি মোটেই বলব না কে আমার বাবা। আপনারাই খাবি খাচ্ছেন তো? তাহলেই ভাবুন আমার মা কতখানি খাবি খেয়েছিল বাচ্চা বয়সে বিয়ে করতে গিয়ে। ছবিটা কিন্তু আপনারা যতটা বড় দেখছেন ততটা বড় নয়। digitization এর ফলে খানিকটা বড় দেখাচ্ছে। কি সাংঘাতিক ব্যাপার ভাবুন। তাজমহলের সামনে আপাদমস্তক মিলিটারী পোশাকে দাঁড়ানো দুজন লোকের পুঁচকে এতটুকু একটা ছবি। ভগবানই জানেন এর মধ্যে কে সাম্ভব্য পাত্র। আমার মা বা তার বাড়ির লোকজন কি করে বুঝেছিলেন, রাম-দুই-তিন-চার গুনে, নাকি টস করে, নাকি আমার পিসির কাছে বর্ণনা শুনে আমি জানিনা। আমার শুধু এই ছবিটা দেখে একটা কথাই মনে হয়েছিল যে এই ছবিটার বদলে নিচের এই দ্বিতীয় ছবিটা পাঠালেই বা কি ক্ষতি ছিল?


পাত্র যে মিলিটারী চাকরির সাথে সাথে বেশ জাঁদরেল একখানা ফুটবল প্লেয়ার সেটাও বেশ বলা হয়ে যেত ওই এক ছবিতেই। পাত্রীর চোখে পাত্রের জন্য আরো খানিকটা সমীহ জেগে ওঠার সম্ভাবনা থাকত তাহলে। শুধু ছবিটার মধ্যে পাত্রের মুখটাকে পেন দিয়ে গোল করে মার্ক করে দিলেই চলত বা মাথার ওপর একটা টিক মার্ক।

যাই হোক না কেন এইসব গন্ডগোলের মধ্যে তো সব কিছু সামলে সুমলে আমার মামার বাড়ির সবাই আর পিসি-জ্যেঠু-জ্যাঠিমা ইত্যাদি সবাই মিলে শ্রীমান প্রশান্তকুমার আর কুমারী মায়ারানির শুভবিবাহ সুসম্পন্ন করার একটা দিনক্ষণ বার করলেন। তখনও পাত্র-পাত্রীর চাক্ষুষ দেখা হয়নি। শ্রীমান প্রশান্তকুমারের মনে মনে বোধহয় পাত্রীকে দেখার একটা সুপ্ত বাসনা ছিল। কিন্তু বেচারা মিলিটারী চাকরি থেকে বিয়ের আগে প্রয়োজনীয় ছুটি না পাওয়ায় সে ইচ্ছা পূরণ করতে পারেনি। দাদা-দিদি-বৌদিদের পছন্দের ওপরেই ভরসা করতে হয়েছিল। অগত্যা বিয়ের দিন আমার মামারবাড়িতে পৌঁছে সে প্রানের বন্ধুকে পাঠালো ভিতর বাড়িতে গিয়ে একবার পাত্রীটিকে দেখে আসতে। বন্ধু এসে আস্বস্ত করলো পাত্রীটি বেশ ভালই। সুন্দরী। শ্রীমানের এতে কি চতুর্বর্গ লাভ হয়েছিল জানিনা। কারণ বিয়ে করতে এসে বিয়ের একঘন্টা আগে যদি জানা যায় পাত্রীটি খেঁদি-পেঁচি বিশেষ, তবে তো আর যাই হোক বিয়ে আটকায় না। যাই হোক বন্ধুর মুখে শুনে আস্বস্ত হয়ে শ্রীমান প্রশান্তকুমার প্রশান্ত মনে বিয়ে করতে বসলেন। বিয়ের দিন আর বিশেষ কিছু গন্ডগোল হয়নি। শুধু বিয়ে করতে করতে শ্রীমান প্রশান্তকুমার মাঝে মাঝেই অধৈর্য্য হয়ে পুরোহিতমশাইকে প্রতি পনের মিনিট অন্তর অন্তরই নাকি জিজ্ঞাসা করছিলেন আর কত পাতা মন্ত্র পড়া বাকি আছে? এই তথ্যটা আমায় আমার মায়ের সাপ্লাই দেওয়া।

এই বিয়ে সংক্রান্ত আর একটি মজার ঘটনা বলে শেষ করব। আমার এক জ্যেঠুর ইচ্ছে ছিল গাড়ি করে বিয়ে করে ফেরার। নিজের বিয়েতে সেই ব্যবস্থা তিনি করতে পারেননি। জ্যেঠিমার মুখে শোনা যে তাঁদের বিয়ের একটি বিশেষ প্রমান হলো একটা ছবি। যাতে দেখা যাচ্ছে সার সার রিক্সার পিছন দিক। আর ছবির পেছনে লেখা ১৯৬২। সুতরাং জ্যেঠু তাঁর আদরের ছোট ভাইয়ের বিয়েতে সেই সার সার রিক্সার পুনরাবৃতির যাতে না হয় তার জন্য পড়িমড়ি করে একখানা ambassador গাড়ির ব্যবস্থা করেছিলেন। পরের দিন নতুন বরকনেকে নিয়ে সেই গাড়িটি এসে পৌঁছালো আমাদের গ্রামের বাড়ির কাছে। তখন সেই ১৯৭৭ সালে গাড়ি চেপে বিয়ে করার রেওয়াজ বিশেষ ছিল না। বিশাল ভাই বোনেদের পরিবারে আমার বাবাই প্রথম গাড়িতে করে মাকে বিয়ে করে আনেন। আমার ঠাকুমার কাছেও গাড়ি বিষয়টি বিশেষ পরিচিত ছিল না। নতুন বরকনেকে গ্রামের মন্দিরে প্রনাম করে তবে ঘরে ঢোকার রীতি। গাড়িটিও নতুন বরকনেকে নিয়ে সোজা মন্দিরের সামনে এসে থামল। সেখানে ভিড় করে আছে বাড়ির বাকি সব লোকজন সঙ্গে আমার ঠাকুমাও। বরকনে মন্দিরে ঢুকে যাবার পরে আমার রসিক সেজজ্যেঠু তাঁর মা অর্থাত আমার ঠাকুমাকে নিয়ে খানিক মজা করার লোভ সামলাতে পারলেন না। তিনি আমার ঠাকুমাকে বললেন যে, "মন্দির থেকে তুমি কেন হেঁটে বাড়ি যাবে মা? গাড়িতেই চলে যাও, উঠে যাও গাড়িতে।" ঠাকুমা উঠে বসলেন গাড়িতে। জ্যেঠু হাঁ হাঁ করে উঠলেন। "কর কি? কর কি? ওখানে নয় ওপরে উঠে বসো।" ঠাকুমা আকুল হয়ে বললেন, "ও বেণী (জ্যেঠুর নাম ছিল বেনীমাধব), মাথা তুলতে পারছিনা যে। মাথা ঠেকে যাচ্ছে তো গাড়ির ছাদে।" জ্যেঠু গম্ভীর হয়ে বললেন, "তা তো যাবেই, গাড়িতে তো ওরকম করেই বসে হয়। তুমি গাড়িও চাপবে-মাথা সোজা করেও বসবে, দুটো তো একসাথে হবে না মা। ওভাবেই বসতে হয়। চুপ করে বসে থাক।" ঠাকুমাও ঘাড় গুঁজে বসে রইলেন। ঘটনাটা হলো, জ্যেঠু ঠাকুমাকে গাড়ির সিটে না বসিয়ে ব্যাকরেস্টের ওপর বসিয়েছেন সিটের ওপর পা রেখে এবং বুঝিয়েছেন যে গাড়িতে ওভাবেই বসতে হয়। বুঝিয়ে সুঝিয়ে জেঠু তো সরে পড়েছেন অকুস্থল থেকে। আর বেচারী আমার নির্দোষ ঠাকুমা তাঁর সারারাত বিয়ে করে -সারা সকাল জার্নি করে ক্লান্ত-রাগী ছোটোছেলেটির কাছে বকুনি টকুনি খেয়ে একসা।

এইভাবে সাড়ে চার ফুটের কুমারী মায়ারানী চক্রবর্তী সাড়ে পাঁচ ফুটের শ্রীমান প্রশান্তকুমারের হাত ধরে রাতারাতি নিজের চক্রবর্তীত্বের মায়া সম্পূর্ণ ত্যাগ করে শ্রীমতি মায়ারানী চট্টোপাধ্যায় হয়ে গেলেন। আর ভবিস্যতে পারফেক্ট average কম্বিনেশনের পুরোপুরি পাঁচফুটিয়া আমার জন্ম দিলেন।

Sunday 27 July 2014

কম্পোজিশন

যাহ, ব্যাটারী শেষ ক্যামেরাটার। বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে লোকদুজন যে গাড়ি পরিস্কার করছিল সেই ছবিটা দূর থেকে জুমিং করে তুলবে ভেবেছিল দেহলী। কয়েক দিনের বর্ষায় চারিদিক সবুজ হয়ে উঠেছে। এখানে আর যাই হোক না হোক গাছপালার কোনো অভাব নেই। তাই ঝম ঝম বৃষ্টির মধ্যে সাদা রঙের গাড়িটাকে একজন সাদা আর একজন টুকটুকে লাল টি-শার্ট পরা লোকদুজন যখন দুদিক থেকে পরিস্কার করতে শুরু করলো তখন সবুজ পটভূমিতে সাদা-লাল আর ঝম ঝম বৃষ্টির এক সুন্দর জলছবি ফুটে উঠেছিল। জানলা দিয়ে সেই জলছবি দেখে দেহলীর মনে হয়েছিল, বাহ, বেশ পারফেক্ট কম্পোজিশন তো! কম্পোজিশন শব্দটা সে খুব ছোটবেলা থেকে জানে। সে যখন স্কুলে ভর্তি হয়নি প্রায় তখন থেকেই আঁকার মাস্টারমশায়ের মুখে শব্দটা শুনে শুনে শিখে গেছিল। যদিও মানে বুঝেছে অনেক পরে। ছবি আঁকতে আঁকতে মাস্টারমশাই তাকে আস্তে আস্তে দেখতে শিখিয়েছেন কেমন করে ঠিক করতে হয় ছবির কম্পোজিশন, পার্সপেক্টটিভ। দেহলী ছোট থেকেই দৃশ্যচিত্র বেশি আঁকত। কেন কে জানে। বোধহয় অন্য কিছু মনের মত করে আঁকতে পারত না তাই। কিংবা ছোটো থেকেই চারপাশের দৃশ্যপট ঠিক নিজে যেমনটি চায় তেমনটি করেই সাজাবার একটা প্রবণতা অবচেতনে ছিল তাই। তার ফলে ধীরে ধীরে আর কিছু হোক না হোক দৃশ্যচিত্রের কম্পোজিশন এবং পার্সপেক্টটিভ এর একটা মোটামুটি স্বচ্ছ ধারণা তৈরী হয়ে গেছিল অনেক ছোট বয়সেই। এই মধ্য তিরিশে এসে রং তুলির চেয়ে যদিও ক্যামেরাটাই হাতে আসে বেশি, তবু সেই ছোটবেলার ল্যান্ডস্কেপ আঁকা আর তার কম্পোজিশন, পার্সপেক্টটিভ এর ভূত এখনো তার ঘাড় থেকে নামেনি। তাই সে এখনো ক্যামেরাদিয়েই সাজাতে চায় তার মনমত দৃশ্যচিত্র।

সাদারঙের গাড়ি আর তার দুপাশের লাল- সাদা টি- শার্টের লোক দুজনের অবস্থান ধরে রাখতে ক্যামেরা অন করতেই ডিসপ্লে দেখালো ব্যাটারী শেষ। পারফেক্ট কম্পোজিসনটা আর ধরে রাখতে পারল না দেহলী। এই হয় ওর সাথে। আর ও জানে এর জন্য ও-ই দায়ী। কাল বারান্দা থেকে সূর্যাস্তের ছবি তোলার সময়ই দেখেছিল ব্যাটারি লো, গড়িমসি করে চার্জ দেওয়া হয়ে ওঠেনি। আসলে সে ভাবেই নি যে, ছুটির দুপুরে এরকম ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি নামবে আর সে এরকম একটা কম্পোজিসন পেয়ে যাবে তোলার জন্য। অনেক কিছুই তার এই অহেতুক আলসেমির জন্য এরকম ভাবেই বেরিয়ে যায় হাত থেকে জানে সে। কিন্তু তাও মাঝে মাঝে তাকে যে কি আলসেমির ভূতে চেপে ধরে কে জানে। দেহলীর অবশ্য ভালই লাগে এই সময়গুলো, যখন হাতে বেশ খানিকটা কাজ থাকা সত্বেও সে চুপ করে বুঁদ হয়ে নিজের মধ্যে ডুবে থাকে। আশে পাশে লোকজন থাকলে হয়ত ভাবে তার মন খারাপ। প্রথম প্রথম দেহলী তাদের বোঝাতে চেষ্টা করত যে তার কিছুই হয়নি। তাতে সকলে ভাবত যে, সে কোনো কারণে রেগে আছে কারো ওপর। অবশ্য ভাবাটাও কিছু অস্বাভাবিক নয়, কিন্তু তার আজকাল আর এসব কথায় লোকজনকে আর শুধরে দিতেও ইচ্ছে করে না। তাতেও কেমন একটা আলসেমি পেয়ে বসে তাকে। মনে হয় ঠিক আছে থাক না। বুঁদ হয়ে বসেই থাকে, বসেই থাকে যতক্ষণ না চারপাশ চঞ্চল হয়ে উঠছে।

এখনও যেমন বৃষ্টি ভেজা দুপুরে ফাঁকা ঘরে বেয়াদব এক আলসেমি পেয়ে বসেছে তাকে। ক্যামেরাটার ব্যাটারী জবাব দিতে কিছুক্ষণ বৃষ্টির মধ্যে বাইরে তাকিয়ে রইলো সে। চারপাশ সাদা করে বৃষ্টি পড়ছে। ব্যালকনির দিক থেকে বৃষ্টির ছাঁটে ভিজে যাচ্ছে পুরু পাপোষটা। শোকাতে অন্তত তিনদিন লাগবে। ওটা সরিয়ে নিতে হবে, হাতের ক্যামেরাটা চার্জে লাগাতে হবে, দুপুরে খাবার পর রান্নাঘরে ঢোকা হয়নি-টুকিটাকি অনেক কাজ এইবেলা সেরে ফেললে ভালো হয়, ফ্রিজে চিকেনপিসগুলো অনেকক্ষণ থেকে ম্যারিনেটেড হচ্ছে- এবার রান্না না করলেই নয়। এইসব ভাবতে ভাবতে দেহলী ক্যামেরাটা কোলে নিয়ে আস্তে আস্তে বসেই পড়ল ঘরের মেঝেতে। ব্যালকনিতে ঝুপ-ঝুপ বৃষ্টি পড়ছে। জল বেরোনোর নালীটা ঠিকঠাক না হওয়ায় চট করে জল বেরোয়না খোলা ব্যালকনিটা থেকে। ফলে জোরে বৃষ্টি পড়লে বেশ পায়ের পাতা ডোবা ছিপছিপে জল জমে ব্যালকনিতে। তার ওপর বড় বড় বৃষ্টির ফোঁটা পড়লে কেমন যেন তার বাড়ির পাশের ডোবাটার কথা মনে পড়ে যায়। বৃষ্টি হলেই বাড়িতে থাকলে দেহলী সোজা গিয়ে ডোবাটার দিকের জানলায় গিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ত। জলের মধ্যে বৃষ্টির ফোঁটা দেখতে তার খুব ভালো লাগে। মাঝে মাঝে বর্ষাকালে বড়পুকুরে স্নান করতে গেলে বৃষ্টি পড়তে শুরু করলে সে উঠে আসতেই চাইতো না পুকুর থেকে। একবুক জলে দাঁড়িয়ে ভিজত। ব্যালকনির ছিপছিপে জলের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে দেহলির মনে হলো কতদিন সে পুকুরে সাঁতার কেটে স্নান করে না, কত দিন সে জানলায় দাঁড়িয়ে জলের ওপর বৃষ্টি পড়া দেখেনি। এবার বাড়ি গেলে যদি বৃষ্টি নামে সে নিশ্চয়ই বড়পুকুরে একবার স্নান করতে যাবে। মা সেদিন তাকে ফোনে বলছিল আজকাল নাকি কেউ পুকুরে স্নান করে না, সকলের ঘরে ঘরে পঞ্চায়েত থেকে জলের ব্যবস্থা করে দিয়েছে। যে যার ঘরেই স্নান সেরে নেয়। তাদের গ্রামটাও আস্তে আস্তে শহর হয়ে যাচ্ছে। তাতে অবশ্য সকলের সুবিধাই হচ্ছে। দেহলী বোঝে সে কথা। তার ছোটোবেলায় মনে আছে গরমকালে সকাল দশটা থেকে বারোটা পর্যন্ত বড়পুকুরে স্নান করতে গেলে অনেক সময় ঘাটে সাবান-গামছা নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে হত। একদল স্নান করে উঠলে আর একদল নামবে। বড়পুকুরের জল ভালো, সারাদিন রোদ পায়। ওই জলে স্নান করলে কারো শরীর খারাপ হয় না তাই সক্কলে ওখানেই আসত স্নান করতে। ওই পুকুরেই পিতলের কলসী ধরে সাঁতার শিখেছে দেহলী। বেশ ছোট থেকেই বড়পুকুর পারাপার করতে পারে সে। আর সেই নিয়ে সেই ছোট বয়সেই বোধহয় তার একটা চাপা গর্বও ছিল। নইলে বাড়িতে কেউ বেড়াতে এলেই সে নিজের সাঁতারের পারঙ্গমতা দেখাতে অতিথিকে নিয়ে সোজা স্নানের সময় বড়পুকুর চলে যেত কেন? এত বছর পর সেসব বোকামির কথা মনে পড়ে যেতে ঘরের মেঝেতে বসে ঠোঁটের কোনে একচিলতে হাসি এলো দেহলীর। আজন্ম হাঁদা সে।

চোখে মুখে বৃষ্টির ছাঁট আসছে দেহলীর। ক্যামেরাটাকে হাত দিয়ে যথাসাধ্য আড়াল করে চুপ করে বাইরের দিকে তাকিয়ে বসে আছে সে। দেখছে মোটা পাপোষটা ক্রমশঃ ভিজে চুপচুপে হয়ে উঠছে। পরে ওটা তাকেই উল্টে পাল্টে শুকনো করতে হবে। তাও উঠে গিয়ে পাপোষটা সরিয়ে নিতে ইচ্ছে হলো না। একসময় টমির পায়ের ঠেলায় সম্বিত ফিরল দেহলীর। টমিটা ঘরের মেঝেতে শুয়ে সেই কখন থেকে ঘুমোচ্ছে। দুপুরে খেতে বসার আগেই ওকে খাইয়ে দিয়েছে সে। সেই থেকে এপাশ-ওপাশ করে ঘুমোচ্ছে। পাশ ফিরতে গিয়ে দেহলীর গায়ে পা ঠেকেছে বিচ্ছুটার। শোবার জায়গা কম পড়তে পা দিয়ে ঘুমের ঘোরেই ঠেলছে দেহলীকে। একটু গায়ে হাত বুলিয়ে আদর করে দিল দেহলী টমিকে। গায়ে একটু আধটু পোকা হচ্ছে টমির। দেখতে পেলে তুলে ফেলে দেয় দেহলী। বজ্জাতটা বাইরের কুকুরদের সাথে মারামারিতে পারে না, তাও রাগ দেখানো চাই। শেষে মার খেয়ে পায়ে ক্ষত নিয়ে ফিরে এসেছে। যদিও নিজেই চেটে চেটে ভালো করে এনেছে। টমিকে একবার ডাক্তারখানা নিয়ে যেতে হবে। তাও হচ্ছে না। সবেতেই আলসেমি তার। টমির পেটে একটা মাঝারি গোছের নির্দোষ টিউমার আছে। দেহলীর এক জ্যেঠুর পিঠেও ওরকম একটা টিউমার আছে। ছোটোবেলায় সেটা সে যথেচ্ছ টেপাটেপি করত, কারণ টিপলে তাতে আঙ্গুল বসে যেত আবার কিছুক্ষণ পর ঠিক হয়ে যেত। সেটা বেশ একটা মজার খেলা ছিল তার। জ্যেঠুও কিছু বলতেন না তাকে। টমির পেটের এই টিউমারটা দেখলেই সেটা মনে পড়ে যায় দেহলীর। টমিকে ঠেলে সরাবার চেষ্টা করলো সে। ঘুমের ব্যাঘাত হতে রাগী গলায় গোঁ-গোঁ করে বিরক্তি প্রকাশ করলো টমি।

বৃষ্টিটা কমে এসেছে। বারান্দায় সব জামাকাপড় ভিজেছে। তোলেনি দেহলী। বৃষ্টি থামলে দেখা যাবে। আস্তে আস্তে টমির পিঠে হাত বোলাতে বোলাতে মৃদু গলায় গাইতে শুরু করলো 'জীবন মরণের সীমানা ছাড়ায়ে বন্ধু হে আমার রয়েছ দাঁড়ায়ে'। বেশ কয়েকটা গান দু-চার লাইন করে গেয়ে মনটাকে যখন ফিরে পেল দেহলী বৃষ্টি তখন যাব যাব করছে। বারান্দায় ছোট্টো টবের পুঁচকে গাছটা চকচকে হয়ে উঠেছে। জামাকাপড় শুকনো করার ক্লিপ গুলো থেকে টুপ টুপ করে ঝরছে জল। আরও কিছুক্ষণ বুঁদ হয়ে নিজের মধ্যে ডুবে রইলো দেহলী। শেষে ছাতার পাখিরা যখন চেঁচামেচি করতে করতে তার ব্যালকনিতে হুটোপুটি করতে শুরু করলো তখন একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে উঠে দাঁড়ালো সে। ব্যালকনিতে পাতলা  রোদ। ক্যামেরাটা চার্জে লাগাতে লাগাতে চোখ গেল পাশে রাখা ইজেলটার দিকে। ধুলো জমেছে। অনেক দিন আঁকে না সে। আলতো করে হাত বোলালো ইজেলটার গায়ে। এসময় হঠাতই যেন ভেতর থেকে একটা তাড়া অনুভব করলো দেহলী। ক্যামেরাটা ঝটপট প্লাগে লাগিয়েই ফ্রিজ খুলে চিকেনসমেত কৌটোটা নিয়ে রান্নাঘরে যেতে যেতে দেখল টমিটা কুন্ডলী পাকিয়ে শুয়েছে। বৃষ্টি হয়ে একটু ঠান্ডা হয়েছে আবহাওয়াটা। শীত করছে বোধহয়। টমির মাথায় একবার হাত বুলিয়েই গুন গুন করতে করতে রান্না ঘরের দিকে চলল দেহলী। চটপট সব কাজ সেরে নিতে হবে তাকে। আজ দেহলী অনেকদিন পরে ছবি আঁকবে একটা। তার মনের মতন সুন্দর একটা দৃশ্যচিত্র। যেমন সে আঁকত আগে পারফেক্ট একটা কম্পোজিশন। ঠিক সেরকম।                  

Friday 25 July 2014

ন্যাড়াবাবুর কথা


হযবরল এর ন্যাড়াকে মনে আছে? সেই যে গানওলা? সেই যে- "না ভাই, না ভাই, এখন আমায় গাইতে বোলো না, সত্যি বলছি আজকে আমার গলাটা তেমন খুলবে না।" সেই ন্যাড়ার কথা বলছি। আমি আজ আপনাদের আমার দেখা আরো এক ন্যাড়ার কথা বলব। এই ন্যাড়ার সাথে আমার দেখা হয়েছিল মায়াবতীতে। আপনাদের খানিকটা বলেছিলাম তাঁর কথা। তবে কিনা বড় বড় লোকেদের কথা বড় করে না বললে ঠিক ভালো লাগে না তাই ভাবলাম একটু গুছিয়ে বলি এই ন্যাড়ার কথা। এই ন্যাড়া গানওলা নন। আমাদের দুর্ভাগ্যক্রমে তিনি লেখা লেখি করে থাকেন। কবি কবি ভাব।

প্রথম থেকে বলি, মায়াবতী আশ্রমে পৌঁছেছি সকাল সাড়ে দশটা নাগাদ। শান্ত মেঘলা সকাল, আশ্রম চত্বরের অদ্ভূত সুন্দর ফুলের বাগান আর সর্বোপরি অনাবিল শান্তি। পিনাকী ক্যামেরা বাগিয়ে শুয়ে-বসে-বেঁকে-নিচু হয়ে-উঁচু হয়ে ফটোগ্রাফির শেষ দেখে ছাড়বে এমন একটা চেষ্টায় আছে। আমি ওসব কায়্দাবাজিতে বিশেষ কিছু করে উঠতে পারব না বলে 'আঙ্গুর ফল টক' এরকম একটা ভাব দেখিয়ে দূরে বসে আমার প্রিয়তম কাজ করছি। মানে নানান মাথামুন্ডুহীন আবোলতাবোল চিন্তা ভাবনা করছি আর ফুল টুল দেখে মাঝে মাঝেই মুগ্ধ হয়ে যাচ্ছি।

এমন সময় দেখলাম আশ্রমের কয়েকজন মহারাজ প্রেসের বিল্ডিং থেকে বাগান পার হয়ে মূল ভবনের দিকে আসছেন আর সঙ্গে এক পাজামা-পাঞ্জাবি পরা, শান্তিনিকেতনি ঝোলা কাঁধে ভদ্রলোক তাঁদের সাথে আশ্রমের শান্ত সকালকে ছিন্নভিন্ন করে চেঁচাতে চেঁচাতে আসছেন। ইনিই আমাদের 'ন্যাড়াবাবু'।
---"হ্যাঁ, নরেন্দ্রপুরে অমুক মহারাজ তো বলতেন আমায়, তোমার হবে। লেগে থাকো।"   
---উত্তরে মহারাজরা বললেন "ওহ, আচ্ছা তাই?"
---"আমি তো নরেন্দ্রপুরের ছাত্র। ওখানের পরিবেশটাই অন্য জানেন তো?" রামকৃষ্ণ মিশনের মহারাজরা প্রথম জানলেন নরেন্দ্রপুর সম্পর্কে।
মহারাজরা বললেন, "হ্যাঁ, সেই তো।"
ন্যাড়াবাবু বললেন, "আপনাদেরকে শুনিয়ে শান্তি, একটু শোনাই আমার এই লেখাটা। অমুক মহারাজকে শুনিয়েছি জানেনতো। দারুন খুশি হয়েছেন।"
প্রমাদ গুনে মহারাজরা বললেন, "তা আপনি যেন কবে বেরোচ্ছেন? গাড়ির ব্যবস্থা হয়েছে তো?"
ন্যাড়াবাবু বললেন, "হ্যাঁ হ্যাঁ, সেসব হয়েছে। তার পর শুনুন না এই যে এইখানটা........।"
বুঝলাম যে গত কয়েকদিন ধরে নিশ্চয় ন্যাড়াবাবু এঁনাদের প্রচন্ড জ্বালাতন করেছেন তাই সংযমী সাধুরা পর্যন্ত পালিয়ে বাঁচতে চাইছেন। শেষে কিছুটা কবিতা শুনিয়ে, জোর করে মহারাজদের লাইন করে দাঁড় করিয়ে তাঁদের ছবি তুলে, নিজে তাঁদের সঙ্গে দাঁড়িয়ে অন্যদের দিয়ে ছবি তুলিয়ে, বেশ খানিকটা হেঁ হেঁ করে মহারাজরা অবশেষে প্রায় মিনিট পনের কুড়ি পর ছুটি পেলেন।

তখন থেকেই কেমন যেন মনে হচ্ছিল - এই রে, এইবার বোধহয় আমায় চেপে ধরে ন্যাড়ার মত "মিশিমাখা শিখিপাখা......"শোনাবে। কারণ আশেপাশে আর কেউ নেই পিনাকী ছাড়া। সে তো আবার ওই দূরে প্রায় মাটিতে থুতনি ঠেকিয়ে ক্যামেরা চোখে কিসব যেন করছে। অতএব নেক্সট সম্ভব্য টার্গেট আমিই।মনের শান্তি, প্রানের যতসব তূরীয় চিন্তা ভাবনা তত্ক্ষনাত জলাঞ্জলি দিয়ে প্রমাদ গুনতে শুরু করলাম। যা ভেবেছি। দেখি ন্যাড়াবাবু এদিক ওদিক তাকাতে তাকাতে কি যেন একটা গান গুন গুন করতে করতে গুটি গুটি এদিকেই আসছে। প্রাণভয়ে পিনাকীর পেছনে লুকোবার একটা ব্যর্থ চেষ্টা করলাম বটে, হলনা।

--"আপনারা কোথা থেকে এসেছেন? কলকাতা?"
--"না, গুড়গাঁও।"
--"ও আচ্ছা, উনি কি আপনার হাসব্যান্ড?"
--"হ্যাঁ।"
--"উনি কি করেন?"
--"রিসার্চ"
--"আপনি?"
--"আমিও।"
--"না মানে চাকরি টাকরি.....?"
--"আমরা রিসার্চই করি।"
.
.
.
.
ক্রমে ক্রমে আমাদের অরিজিনাল বাড়ি কোথায়? আমরা কবে, কোত্থেকে মায়াবতী এসেছি? এখান থেকে কবে, কোথায় যাব? গুড়গাঁওতেই আমরা কাজ করি কিনা? কেন চাকরি করি না? কেন রিসার্চ করি?.........ইত্যাদি ইত্যাদি পেরিয়ে যখন প্রায় 'কটি বাচ্চা'......'কদ্দিন বিয়ে হয়েছে' এইসব অবশ্যম্ভাবী প্রয়োজনীয় প্রশ্নাবলীর দিকে গাড়ির মুখ ঘুরবে ঘুরবে তখনই দেবদূতের মতো পিনাকী এসে আমায় বাঁচিয়ে দিল। আমিও এই তালে সুট করে সরে গিয়ে মন দিয়ে ফুলের ছবি তুলতে লাগলাম। আর দূর থেকে দেখলাম পিনাকী বেচারা ফেঁসে গেছে। কিছুক্ষণ পর ভয়ে ভয়ে ওদিকে গিয়ে দেখি পিনাকীকে ন্যাড়াবাবু বলছেন "আপনাদের লেখালেখি করার অভ্যেস আছে নাকি?" পিনাকী "না" বলতেই ন্যাড়াবাবু ঝড়ের মত বলতে শুরু করলেন যে তিনি একজন লেখক। অনেক কবিতা-গদ্য লিখেছেন। নানা জায়গায় ছাপাও হয়েছে। ওঁনার একটা লিটিল ম্যাগাজিনও আছে....ইত্যাদি ইত্যাদি। পিনাকীর ফোন নম্বর নিলেন আর হাতের একতাড়া কাগজের বান্ডিল থেকে একটা পাতা আমাদের দিয়ে হাসি হাসি মুখে বললেন, "আমার রিসেন্ট লেখা পড়ে দেখবেন"। দেখি অত্যন্ত ঝাপসা একপাতার একটি লেখার ফোটো - কপি, সুচিত্রা সেনের জীবনাবসান নিয়ে। আমরাও হাসি হাসি মুখে নিয়ে বললাম "নিশ্চয়ই নিশ্চয়ই।" তারপর বললেন "বিবেক লেক দেখেছেন? ওই যে ওদিকে?" বললাম, "নাতো, যাই আমরা বরং দেখে আসি বেশি দূর নয় তো?" ন্যাড়াবাবু বললেন," না না, এই তো সামনে।আমি আপনাদের সঙ্গে গিয়ে বরং দেখিয়ে নিয়ে আসি।" আমরা সমস্বরে বলে উঠলাম " না না আমরা পারব। এই তো সামনেই।" ন্যাড়াবাবু এতে বড়ই মনক্ষুন্ন হয়ে পড়লেন কিন্তু আমরাও বাঁচতে চাইছিলাম। কি করব বলুন? তাই তাঁকে টা টা করে আমরা বিবেক লেক দেখতে গেলাম।

ততক্ষণে মনে যে শান্ত ভাব আসব আসব করছিল তা তালেগোলে কোথায় কেটে পড়েছে। বিবেক লেকের ধরে বসে তিলক মহারাজের সাথে কথা বলতে বলতে আর শুনতে শুনতে ফের যখন সেটা ফিরে আসব আসব করছে, দেখি দূর থেকে ন্যাড়াবাবুও হেলে দুলে ঝোলা কাঁধে এদিকপানেই আসছেন। আমার মতো বোধহয় আর সকলেও প্রমাদ গুনেছিলেন। সকলেই দেখি গা ঝাড়া দিয়ে উঠি উঠি করছেন। "চলো খাবার সময় হয়ে গেছে", "যাই ওদিকটা একটু ঘুরে আসি" ইত্যাদি ইত্যাদি নানান মন্তব্য করে টরে সবাই উঠে পড়লেন। বুঝলাম ন্যাড়া সবাইকেই কোনো না কোনো সময় গান শুনিয়েছে।

পরে আশ্রমের বুকষ্টলে বই কিনতে গিয়ে দেখা হলে ন্যাড়াবাবু আমাদের আবার জিজ্ঞাসা করেছিলেন আমরা লিখি টিখি কিনা। দুজনেই একবাক্যে 'না' বলতে খুব মুষড়ে পড়ে বললেন, "কাজ টাজ সামলে সময় হয় না বোধহয় না?.....হুম.....।" আমার খুব খারাপ লাগছিল বিশ্বাস করুন কারণ হযবরল-র ন্যাড়ার গান তাও শেষ পর্যন্ত কেউ শুনেছিল। আমাদের এই বেচারা ন্যাড়াবাবু নিজের লেখা সবাইকে ফোটো - কপি করে বিলি করা সত্বেও সবাই ওঁকে এড়িয়ে গেল। ভাবলাম বাড়ি গিয়ে ন্যাড়াবাবুর হ্যান্ডবিলটা পড়ে দেখতে হবে। বাড়ি ফিরে অনেক চেষ্টা করলাম জানেন। দুজনের দুটো ব্যাগই হাঁটকালাম। কোথাও খুঁজে পেলাম না ন্যাড়াবাবুর দেওয়া হ্যান্ডবিলটা। সত্যি সত্যি সরি ন্যাড়াবাবু।

Thursday 24 July 2014

Once again

I forgot your message once again
I started complaining once again

You taught me to fill my heart with patience
I lost it in a moment once again

You told me to gaze to the straight only
I was distracted in the crowd once again

You trained me to forgive every moment against me
I became agitated in the storm once again

You advised me not to expect
I cried for my belief once again

Forgive me Oh my lord once again
I have failed to follow your trail once again.   

Wednesday 23 July 2014

সেমিনার শুনতে শুনতে কি করে জেগে থাকতে হয় বলুন তো?

গুগল ইমেজ থেকে

আজ একখানা সেমিনার শুনতে হচ্ছিলো। সকাল সকাল ছিল আর ভদ্রলোক বলছিলেন ভালই। যথেষ্ট গলার জোর, দারুন উদ্যম তাই রক্ষে। খুব একটা অসুবিধা হয়নি। দুপুরবেলা একপেট ভাত-ডাল-তরকারী-মাছ-টাছ দিয়ে সাপটে খেয়ে ঠান্ডা-ঠান্ডা সেমিনার হলে টানা দুঘন্টা বসে সেঁতানো মুড়ি মার্কা গলায় বোরিং বক্তৃতা শুনতে হলেই হয়েছিল আরকি।

বেশিরভাগ সেমিনার শুনতে গিয়ে প্রথম কয়েক মিনিট আমার অন্ততঃ যে অভিজ্ঞতা হয় সেটা হলো-বক্তা প্রাণপণে বোঝাবার চেষ্টা করে চলেছেন যে মনুষ্যদেহের কোনো একধরনের কোষকে মেরে ধরে-রং করে-টেনে বাড়িয়ে-দুমড়ে ছোট করে-নানান আবোলতাবোল প্রোটিন ঢুকিয়ে-বার করে-তাকে আবার ইঁদুর বাঁদরের দেহে ঢুকিয়ে-আরো নানান কিছু ঐন্দ্রজালিকসুলভ কাজকর্ম করে মানব দেহের সব রহস্যই প্রায় তিনি উদ্ধার করে ফেলেছেন, আর আমি ভুরু-টুরু কুঁচকে, পেন্সিল কামড়ে প্রাণপণে সেসব বোঝবার চেষ্টা করে চলেছি। তারপর আস্তে আস্তে ঘটনাবলী আমার মোটা মাথার বোধবুদ্ধি থেকে পিছলে যেতে থাকে আর আমি প্রানপণে খামচে-খুমচে তাকে আটকাবার একটা ব্যর্থ প্রচেষ্টা করতে থাকি। শেষে বক্তা নিজের মতো করে নিজের মহিমাকীর্তন করে যেতে থাকেন, আর আমি নিজের বুদ্ধির পায়ে একটা সাষ্টাঙ্গ প্রণাম সেরে কীর্তন শোনায় ক্ষান্ত দি। আর তখন থেকেই আমার পরবর্তী চেষ্টাটা থাকে কি করে নিজেকে সোজা রাখা যায় আর চোখ দুটো খোলা রাখা যায়। কি জ্বালা! তারপর, সেমিনার শেষে বোদ্ধারা সবাই যখন বক্তার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে চোখা চোখা প্রশ্নবান ছুঁড়তে থাকেন তখন আমার একটা মিশ্র অনুভূতি হয়। প্রথমত আমার মনে হয় আমি ছাড়া আর সবাই সব কিছুই কেমন জানে-কাল থেকে আমিও ইন্টারনেটের আবোলতাবোল সাইটে সারাদিন ঘুরে না বেড়িয়ে প্রচুর পড়াশুনা করব। আর দ্বিতীয়ত মনে হয় "হে ভগবান, বক্তাটিকে সসম্মানে বাড়ি ফিরে যেতে দাও।" এই দ্বিতীয় চিন্তাটা আমার আসে কারণ মা বলেছে, "কারো কোনদিন খারাপ চাইবে না তাহলে তোমারও একদিন ওই খারাপটাই হবে।" আর বক্তার জায়গায় আমি থাকলে সাধারণত যে পরিমাণ ল্যাজেগোবরে হয়ে থাকি তা যদি আপনারা জানতেন তাতে বক্তার জন্য আমার এই মঙ্গলকামনা আমার নিজের জন্য কতটা জরুরি সেটা বুঝতে পারতেন।        

যাক গে যাক সে সব দুঃখের কথা। আসল কথাটা হলো গিয়ে, সেমিনার হলে কি করে জেগে থাকতে হয় জানেন? আমি তো জানতাম না এতদিন। হলে ঢুকলেই রাজ্যের ঘুম আমার চোখে চলে আসে। বাপরে! চেয়ারে সোজা হয়ে বসে-বেঁকে বসে-ঝুঁকে বসে-চোখ কচলে-জল খেয়ে কিছুতেই আর মস্তিস্কটাকে সজাগ রাখতে পারিনা। আর লাঞ্চব্রেকের পরের সেশন হলে তো আর কথাই নেই। অনেক খুঁজে পেতে শেষে আমি একটা পদ্ধতি বার করেছি সেমিনার হলে ঘুমিয়ে পড়া রুখতে। মাঝে মাঝে ইন্টারেষ্টিং কিছু কথাবার্তা শুনতে পেলে অবশ্য শুনিনা তা নয়, তবে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই স্ক্রীনের দিকে তাকিয়ে থেকে আকাশ-পাতাল চিন্তা করি। নানারকম আকাশ কুসুম কল্পনা করাটা আমার বেস্ট টাইমপাস। আর তার জন্যে বেস্ট জায়গা হচ্ছে আমার মতে সেমিনার হল। আপনাকে কেউ বিরক্ত করার নেই। সবাই আপনারই মতো শোনার ভান করছে। উপরন্তু বক্তার বক্তব্যের একটানা গুনগুনানি দারুন একটা আবহসঙ্গীতের কাজ করে। যত বেশি বোরিং বক্তৃতা তত বেশি আপনি নিজের ভাবনায় ডুবে যেতে পারবেন, যত বেশি আপনার না জানা বিষয় তত বেশি আপনি নিজের সঙ্গে থাকতে পারছেন। সুতরাং আমার যদি গভীর ভাবে কিছু ভাবার থাকে আমি তক্কে তক্কে থাকি সেমিনার হচ্ছে খবর পেলেই হই হই করে বোরিং বক্তৃতা শুনতে ছুটে যাই। বক্তা যখন ডেটা-ফেটা নিয়ে নাস্তানাবুদ, আমি হয়ত তখন ভাবছি, 'আজ রাতে ইচ্ছেখাতায় কি হাবি জাবি গপ্প করা যায়' কিংবা 'পরেরবার বাড়ি গেলে কি কি মাস্ট টু ডু' বা 'কি কি দারুন ইন্টারেষ্টিং খবর পিনাকীকে সাপ্লাই করে দুজনে সন্ধ্যেবেলা খানিক হ্যা হ্যা করা যায়'..........ইত্যাদি ইত্যাদি। তখন আর একটুও ঘুম পায় না বিশ্বাস করুন।

এ তো গেল আমার নিজের পদ্ধতি। সেদিন দেখি সেমিনার হলে ঘুম কাটানো নিয়ে ইন্টারনেটে রীতিমত দারুন সব যুক্তিতে ছয়লাপ। কত কি সব পদ্ধতি। আমার না খুব পছন্দ হয়েছে বিষয়গুলো। আপনাদের একটু শিখিয়ে দি। কাজে লাগবে দেখবেন। বিশেষজ্ঞরা বলছেন-

১. সামনে ঝুঁকে বসুন। পেছনে ঠেস দিলে ঘুমনোর সময় আপনার মুখ হাঁ হয়ে যাবে আর আপনার নাক ডাকতে থাকবে।

২. দেয়ালে ঠেস দেবেন না। ঘুমোতে ঘুমোতে মাথাটা দেয়ালে ঠক করে ঠুকে গেলে আপনার তো লাগবেই সবাই সাথে সাথে আপনার দিকে তাকিয়ে থাকবে আওয়াজে। তখন কি হবে?

৩. সোফা -টোফা দেখে আহ্ললাদিত হয়ে ছুটে গিয়ে বসে পড়বেন না। তাতে ঘুমটা বেশ ভালো হবে আর পাশের লোকের গায়ে ঢলে পড়ে যাবার সম্ভাবনা একশ শতাংশ। তবে সিঙ্গল সোফা হলে আলাদা ব্যাপার।

৪. বেশি নোট ফোট নেব বলে পেন পেন্সিল চাট্টি সঙ্গে করে সেমিনার হলে যাবেন না। ঢুলতে ঢুলতে হাত থেকে পেন্সিল পরে গেলে কিন্তু বড্ড শব্দ হয়।

৫. সম্ভব হলে প্যাডিংওয়ালা চেয়ারে বসুন যাতে চেয়ার শুদ্ধু উল্টে গেলে বেশি শব্দ না হয়।

৬. হঠাত চটকা ভেঙ্গেই চশমা টশমা পরে প্রশ্ন করতে শুরু করে দেবেন না যেন। পুরো পরিস্থিতিটা আগে বুঝে নিন।

৭. এত সব কিছু করেও যদি আপনি হঠাত ঘুম ভেঙ্গে দেখেন সবাই আপনার দিকে তাকিযে হাসছে, তাহলে আর কি করবেন? কমপ্লিমেন্ট হিসাবেই নিন আর কি?

৮. সবথেকে ভালো নৈঃশব্দের শব্দে জেগে উঠতে পারলে। তাহলে ঠিক যখন স্পিকার শেষ করবেন তখনি আপনার ঘুম ভাঙবে। এই ব্যাপারটা খুব কঠিন হলেও খুব উপকারী আমার মতে। দেখুন দেখি চেষ্টা করে পারেন কিনা? আমি তো ডাহা ফেল।

৯. আগের দিন রাতে বেশি ঘুমোবেন না। বেশি ঘুমোলে কিন্তু আরো বেশি ঘুম পায়। এ আমি নিজেকে দিয়ে হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছি।

১০. একই সেমিনার বার বার শুনবার বদভ্যাস আছে নাকি? ত্যাগ করুন, ত্যাগ করুন। একই জিনিস শুনতে শুনতে ঘুমিয়ে পড়ার চান্স সবচেয়ে বেশি।

১১.  অন্য শ্রোতাদের সাথে একই সাথে ঘুমোবেন না please। পালা করে ঘুমোন। সবাই মিলে একসাথে ঘুমলে শুনবে কে? বক্তার জন্য ব্যাপারটা বড় বেশিরকম খারাপ হয়ে যাবে না কি?

১২. কাগজপাতি নিয়ে সেমিনার শুনতে যাবেন না। তাতে আপনি ছাড়া অন্যরা আপনার থেকে নিয়ে আপনার কাগজ পড়বে আর হাত ফেরি হতে হতে শেষে আর জিনিসটা ফেরত আসবে না আপনার কাছে।

এর মধ্যে কোন কোন যুক্তি গুলো আপনার মনে ধরছে দেখুন। যেটা সুবিধা সেটা কাজে লাগান। আমি তো আমার ওই সেমিনার হলে ঘুম পেলেই আবোলতাবোল কল্পনা করার মতন কাজের জিনিস একটাও পেলাম না। আপনারাও প্রয়োগ করে দেখুন।

সেমিনারে ঘুমের দুটো মজার গল্প দিয়ে শেষ করব।

প্রথম গল্পটা এই আমাদের দিল্লির। বিজ্ঞান বিষয়ক আন্তর্জাতিক কনফারেন্স চলছে। সবাই মন দিয়ে শুনছে। বক্তা বিদেশী। কোন দেশীয় ভুলে গেছি। বক্তার গুরুগম্ভীর বক্তব্যের মাঝখানে হঠাত কোনো টেকনিকাল কারণে ইলেকট্রিসিটি failure। স্ক্রিন কালো হয়ে গেছে। সবাই বিব্রত। বিদেশী স্পিকার এদিক ওদিক তাকাচ্ছেন। তার মধ্যে হঠাত সেশনটি পরিচালনা করছিলেন যিনি সেই গণ্য মান্য ভারতীয় বিজ্ঞানীটি ধড়ফড় করে বলে উঠলেন-"Now this session is open for discussion"। অর্থাত সেশনের সব স্পিকারদের সব বক্তব্য বলা হয়ে গেলে পরিচালকের যা বলা উচিত আর কি। ভদ্রলোক পুরো সময়টা ধরে ঝিমোচ্ছিলেন। মাঝে ঘুম এতটাই গভীর হয়ে গেছিল যে এই যে কারেন্ট অফ এর ঘটনাটা উনি টেরই পাননি। হঠাত চটকা ভেঙ্গে দেখেছেন স্ক্রিন কালো। ধরেই নিয়েছেন বক্তব্য শেষ সুতরাং প্রশ্নোত্তর পর্ব শুরু করা যেতে পারে। বুঝুন ব্যাপার। বিদেশী স্পিকার তো ব্যাপার দেখে থ। শেষ অবধি বলেই ফেললেন "Incredible India indeed!!!!!"

আর দ্বিতীয় গল্পটা হলো আমার এক বন্ধু আর তার বাবা কে নিয়ে। বেচারা গিয়েছিল একটি গুরুত্বপূর্ণ কনফারেন্সে লখনৌতে। বাবাও গেছেন সঙ্গে উদ্দেশ্য এই ফাঁকে একটু লখনৌ শহরেরে আনাচে কানাচে ঘোরাফেরা করা। তো খুবই গুরুত্বপূর্ণ বক্তৃতা ছিল নিশ্চয়ই বন্ধু তাই বক্তৃতাটি মিস করতে চায়নি। তাই বাবাকে লখনৌ শহরে একা ছেড়ে না দিয়ে বাবাকে নিয়েই সেমিনার হলে ঢুকেছিল। মনোগত বাসনাটা এরকম ছিল যে, এই বক্তৃতাটা শুনে নিয়েই লাঞ্চ খেয়ে বাবাকে নিয়ে বেরিয়ে পড়বে। সবাই তো মন দিয়ে শুনছে বক্তৃতা। খুব হোমড়াচোমড়়া স্পিকার। ফলে হলে তিল ধারণের জায়গা নেই। গম্ভীর গলায় প্রবীন বিজ্ঞানী বলে চলেছেন। শ্রোতারা মুগ্ধ হয়ে শুনছে। হলে পিন পতনের শব্দ শোনা যাবে। এমন সময় "আ আ আ ...খা খা" করে একটা শব্দ হলো। সবাই এদিক ওদিক তাকাচ্ছে। কি রে বাবা? নামজাদা প্রবীন বিজ্ঞানী থমকেছেন। কেউ কি তার এই স্বতসিদ্ধ প্রমানের বিপক্ষে? নাকি কোনো প্রশ্ন আছে? নাকি তাঁর বক্তব্য একঘেয়ে লাগছে কারো? এমন সময় আবার। "আ আ আ ...খা খা খা ", এবারে আর একটু জোরে। এতক্ষণে বোঝা গেছে কে সেই ব্যক্তি? যিনি হিউমান জেনেটিক্স এর প্রবাদপ্রতিম বিজ্ঞানীকে বক্তব্যের মাঝে থামিয়ে দেবার ক্ষমতা রাখেন। সবাই মুগ্ধ হয়ে শুনলেও একজন কিন্তু বোর হচ্ছিলেন। আমার ওই বন্ধুর বাবা। কারণ তিনি বিষয়টির আদ্যোপান্ত কিছু বোঝেন না। কতক্ষণ আর এদিক ওদিক তাকিয়ে, কান চুলকে, মাথা চুলকে, নখ পরিদর্শন করে সময় কাটানো যায়? বিশেষ করে এই লাঞ্চের আগে খিদে পেটে নিয়ে? স্বভাবতই ঘুম পেয়ে যাচ্ছিল। তাই তিনি ওই অদ্ভূত শব্দ করে হাই তুলে ফেলেছিলেন। বন্ধু তো পারলে চেয়ারের তলার ঢুকে আশ্রয় নেয়, তাকাচ্ছে না ওঁনার দিকে। যেন চেনেই না। বাড়িতে ওই ভাবেই হাই তুলে তুলে অভ্যাস খারাপ হয়ে গেছে, ভুল করে বাড়ি ভেবেই বোধহয় শব্দটা করে ফেলেছিলেন। সঙ্গে সঙ্গে তিনি অবশ্য নিজের ভুল বুঝতে পেরেছিলেন কিন্তু ততক্ষণে যা হবার তা হয়ে গেছে।

আপনাদের পরিশেষে বলে রাখি, আমার এই দ্বিতীয় গল্পটিতে যে বন্ধুটির বাবার কথা বললাম তার নাম- পিনাকী। অর্থাত গল্পটির নায়ক হলেন আমার বাপি। অর্থাত কিনা আমার আদরের শ্বশুরমশাই। 

Monday 21 July 2014

ছুটির দুপুর আর বারান্দায় রোদ্দুর


রবিবার দুপুরে আমি এই ছবিটি তুলেছি। এটি আমাদের তিনটি ব্যালকনির একটি। অনেকদিন পর ছুটির দুপুরে বারান্দার ফাঁক দিয়ে আসা এই রোদ্দুর আমাকে একধাক্কায় নিয়ে গিয়ে ফেলল আমার ছোটবেলাকার দোতলার বারান্দায়। আমার নিজের বাড়িটা জানেন গ্রামের দোতলা মাটির বাড়ি। এখনো। যদিও এখন সেই বাড়িতে অনেক পরিবর্তন ও পরিবর্ধন হয়েছে। কিন্তু মূল বাড়ির কাঠামোটি একই আছে। আমি যখন ক্লাস ফাইভ-এ পড়ি তখন বাড়ির একটা অংশ ভেঙ্গেচুরে নতুন করে ইঁট-সিমেন্ট দিয়ে ছাদ ঢালাই করা হয়। মাটির দোতলার বারান্দার অংশটুকুও তার সাথে সাথে ভেঙ্গে ছাদের সাথে মিশিয়ে দেওয়া হয়। ফলে বিষয়টা এখন যা দাঁড়িয়েছে তা হলো আমাদের মূল বাড়িটুকু অর্থাত শোবার ঘরগুলি বর্তমানে মাটির দেওয়াল-ওপরে মাটির পাটাতন-তার ওপরে দোতলার মাটির ঘর-তার ওপরে টিনের ছাউনি। দোতলার বারান্দা আর ছাদ পাকা ইঁটের। বাড়ির বাদ বাকি অংশ মানে ঠাকুরঘর, রান্নাঘর, টেনিস কোর্টের সাইজের উঠোন, এক্স্ট্রা আরো দুচারটি ঘর, উঠোন ও বাগান ঘেরা পাঁচিল সবই পাকা। হয়ত আমার বাবা চাইলে উপর ও নিচের ঘর চারটিকেও ভেঙ্গে কাঁচা থেকে পাকা করে নিতে পারতেন, তাতে তাঁর বাড়ি সংরক্ষণ ও মায়ের বাড়ি পরিস্কার দুটোরই সুবিধা হত। কিন্তু তৈরী ঘর ভেঙ্গে দেওয়ার হ্যাপা, যথাসময়ে যথেষ্ট পয়সাকড়ির অভাব এইসব কারণে হয়ত ভাঙ্গাটা হয়ে ওঠেনি। একটা সময় পর্যন্ত পাকা ঘরে থাকার একটা লোভ যে ছিল না তা বলব না। কিন্তু এখন মনে মনে ভাবি, ভাঙ্গা যে হয়নি ভালই হয়েছে। কারণ, বাবার ছোটোবেলা-বড়বেলা সবই ওই বাড়িতে। তাঁর মা বাবা দাদা দিদির বিশাল একান্নবর্তী পরিবারের সমস্ত স্মৃতিই তো এই বাড়ি জুড়ে। আগেকার বাড়ির একটা অংশ শুনেছি ১৯৭৮ সালের বন্যায় ভেঙ্গে পড়ে গেছিল-যে জায়গাতে এখন বাগান। বাকিটা পরিবর্তিত হতে হতে ক্রমশঃ নতুন রূপ পেয়েছে। সুতরাং বাবার স্মৃতির বাড়ির অবশিষ্টাংশ বলতে এখন ওই মাটির চারটি ঘর। কত কত বছর কেবলমাত্র মা ও বাবা ছাড়া ওই বাড়িতে কেউ না থাকা সত্বেও প্রতিটা ঘর এখনো তাঁর কাছে 'মায়ের ঘর'-'বড়দার ঘর'-'দাদার ঘর' বা 'সেজদার ঘর'। আমার এখন মনে হয় ওই ঘরগুলিও না থাকলে বোধহয় বাবা তাঁর ছোটবেলা-তাঁর মূল জীবনটিকেই হারিয়ে ফেলতেন। যাঁরা নানা কারণে মূল বাড়ি থেকে বেরিয়ে এসে নতুন বাড়ি বানিয়ে থাকেন তাঁদের আবেগ অনেকাংশেই দ্বিখন্ডিত হয়ে যায়। কিছুটা পড়ে থাকে জন্মভিটে যেখানে তাঁদের ছোটবেলা কেটেছে তার কাছে, কিছুটা তাঁদের রক্ত জল করা পয়সায় বানানো নতুন বাড়ির কাছে। প্রথমটি বাবা মা কে ভালবাসার মতো, যাঁদের কাছে পা ছড়িয়ে বসে আবদার করা যায়। আর দ্বিতীয়টি নিজের সন্তানকে ভালবাসার মত, যাকে নিজের হাতে তিল তিল করে তৈরী করে তার গায়ে লাগা প্রতিটা ধুলোর কণাও ঝেড়ে পরিস্কার করে দিতে ইচ্ছে করে। বাবার ক্ষেত্রে দ্বিতীয়টি হয়নি, তাঁর আবেগ-নস্টালজিয়া-সুখ দুঃখের সমস্ত স্মৃতিই এই বাড়ি জুড়ে। তাই পুরো বাড়ির মধ্যে মাটি দিয়ে বানানো পুরনো এই কটি ঘর শুধু বাবা নয় আমার অন্যান্য জ্যেঠুমনি-পিসিমাদের জন্যও হয়ত বড় আদরের-বড় আপনার ছিল। এখনো আছে। যার টানেই হয়ত বড়-মেজ বা সেজ জেঠুমনিরা বৃদ্ধ বয়সে কলকাতার সমস্ত সুখস্বাচ্ছন্দযুক্ত নতুন বাড়িতে বসেও মৃত্যুর আগে পর্যন্ত একবার এই বাড়িটাতে আসতে চেয়েছিলেন। দুর্ভাগ্যবশতঃ অসুস্থতার কারণে কেউই তাঁদের সেই ছোটোবেলার স্মৃতিটুকু ফিরিয়ে দিতে পারেনি। এজন্য মনে হয়, আমার বাবার জন্য এই ধুলো পড়া মাটির বাড়িরটুকুর টিকে থাকাটা বড় জরুরি। নইলে এই বাড়ি সংলগ্ন তাঁর পুরো ছোটোবেলাটাই হয়ত বেমালুম হাওয়া হয়ে যাবে। 

অনেকদিন পর্যন্তও এভাবে ভাবতাম না। অনেকদিন বাড়িতে না থাকার কারণেই হোক বা বয়স বাড়ার কারণেই হোক নিজের ছেলেবেলাটা কোথাও যেন তেমন করে খুঁজে পাই না। তাই নিজেকে দিয়েই বুঝতে পারি যে ছোটবেলাকার বাড়িটা বড় হয়ে যাবার পর কেন মানুষের এত কাছের হয়ে পড়ে। দোতলার পুরনো মাটির বারান্দাটা যখন ভেঙ্গে পাকা করে নিয়ে ঠাকুরঘর আর রান্নাঘরের ছাদের সাথে মিশিয়ে দেওয়া হলো তখন আমার ক্লাস ফাইভ।ছেলেবেলাটা তখনও ফুরোয়নি। তাই তেমন করে বুঝিনি কিছুই। কিন্তু পরে ওই বারান্দার লোহার রড দেওয়া সবুজ রঙের কাঠের ফ্রেমের রেলিং, শীতের দুপুরে রেলিঙে পিঠ দিয়ে গল্পের বই পড়া, বর্ষায় ওই বারান্দায় দাঁড়িয়ে টিনের চালে বৃষ্টি দেখা এসবের জন্য মাঝে মাঝে বড় কষ্ট হত। তাই বোধহয় এখন মনে হয় আমাদের ওই মাটির চারটে ঘর অন্ততঃ বাবার জন্য বড় বেশিরকম জরুরি।

দোতলার ওই বারান্দাটাকে আমি খুব ভালোবাসতাম জানেন। যেহেতু আমি, মা আর বাবা এই আড়াই জনের জন্য উপরের ঘর দুটো প্রতিদিন খোলার দরকার হত না, নিচের দুটো ঘরেই হয়ে যেত। তাই উপরের দুটি ঘর বছরের বেশির ভাগ সময়টাই চাবি দেওয়া থাকত। স্বভাবতই মা-বাবারও ওপরে আসা যাওয়ার বিশেষ দরকার পড়ত না। ফলে দোতলার ওই রেলিং দেওয়া মাটির বারান্দাটা সম্পূর্ণ আমার একার একান্ত নিজস্ব এলাকা হয়ে গেছিল। ওই বারান্দার সাথে যে আমার কত স্মৃতি জড়িয়ে তা বলার নয়। পরে ওই রেলিংহীন ন্যাড়া বারান্দা যা কিনা প্রায় ছাদের একটা অংশই হয়ে গেছিল তার সাথে ঠিক তেমন করে আর আমার বন্ধুত্ত্ব হয়ে ওঠেনি। রুমার কথা তো আগেই বলেছি, সেই রুমার সাথে ঝগড়া হলে বিকেলে খেলতে না গিয়ে দোতলার বারান্দায় রেলিঙে চড়ে বসে সারা বিকেল পা দুলিয়েছি আর পরদিন কি করে রুমার সাথে ভাব করা যায় তার যুক্তি করেছি মনে মনে। আবার ফেলে দেওয়া প্যাকিং কেস আর ঝ্যাঁটার কাঠি দিয়ে ঘর বানিয়ে পুতুল খেলেছি ওই বারান্দার কোণে রুমার সাথেই। চুরি করে গুঁড়ো দুধ খাওয়াই হোক বা নিচের এক আলমারি ভর্তি গল্পের বইয়ের মধ্যে থেকে বেছে বেছে বড়দের জন্য নির্দিষ্ট একটি বই বের করে নিয়ে চুপি চুপি পড়ে ফেলাই হোক সব নিষিদ্ধ কাজের জন্যই আমার নির্দিষ্ট ছিল ওই রেলিং ঘেরা মাটির বারান্দা। ওই বারান্দাতেই মনে আছে একবার একবাড়ি ভর্তি লোকজনের একসাথে সবাই মিলে চলে যাওয়া রুখতে গড়াগড়ি করে কেঁদেছিলাম। এবং বাড়ির ক্ষুদ্রতম সদস্যের প্রবল কান্নাকাটিতে গলে গিয়ে জেঠু-পিসি-দাদা-দিদি সবাই সেদিন যাওয়া ক্যানসেল করে বাসস্ট্যান্ড থেকে ফিরে এসেছিল। আবার বাবা বা মায়ের কাছে চড়-চাপাটি বা উত্তাল বকাঝকা খেলেও ওই বারান্দাতেই গিয়ে রেলিঙে উঠে পা ঝুলিয়ে বসে কাঁদতাম। বারান্দাটা ছিল আমার খেলার, নিষিদ্ধকে ছোঁয়ার, মন খারাপের, এককথায় আমার সমগ্র বড় হয়ে ওঠার একান্ত নিজস্ব সঙ্গী। 

বর্ষাকালে বারান্দাটাকে ছই বা ত্রিপল দিয়ে ঢেকে দেওয়া হত। কারণ নইলে বৃষ্টির ছাঁটে মাটির বারান্দা থেকে সব মাটি ধুয়ে যেত। ওই সময়টা মনে আছে আমার বড় মনখারাপ হত। কারণ ওই কয় মাস আমি রেলিঙে উঠে বসতে পারব না, বারান্দা অন্ধকার হয়ে যাওয়ায় বসে বই পড়তে পারব না। আমি তখন বৃষ্টি পড়লে বারান্দার ছই বা ত্রিপলের বাঁধন কোথাও কিছুটা খুলে ফাঁক-ফোঁকর দিয়ে টিনের চালে বৃষ্টি পড়া দেখতাম মনে পড়ে। কালিপুজোর দিন রেলিঙে মোমবাতি দিয়ে সাজাতাম আর পরদিন সেই মোমের গলেপড়া জমে থাকা অংশ খুঁটে খুঁটে তুলে আনতাম। কাঠের রেলিং থেকে সহজেই উঠে আসত মোম। পরে বালি-সিমেন্টের খরখরে ছাদের আলসে থেকে আর ঐভাবে মোম খুলে আসত না।  সেই থেকেই বোধহয় কালিপুজোর পরদিন ওই মোম খুঁটে তোলার উত্সাহটাই আমি হারিয়ে ফেলেছিলাম। শীতকালে দুপুরে মা একটা ছোট্ট মাদুর নিয়ে ওপরে বারান্দায় রোদে শুতে যেত। ছুটির দিনে আমি মায়ের সঙ্গী। একটা স্মৃতি খুব জ্বলজ্বলে এখনো আমার কাছে। শীতকালে তখন রাজ্যভিত্তিক বিজ্ঞান প্রদর্শনী ও প্রতিযোগিতা বলে একটা সপ্তাহব্যাপী অনুষ্ঠান হত আমাদের গ্রামে। দূর্গাপুজো ছাড়া ওই এলাকার সবচেয়ে বেশি উত্সাহ উদ্দীপনা থাকত এটি নিয়ে। তাতে নানা বয়সের প্রতিযোগীদের জন্য গণসঙ্গীত, বিতর্ক, তাত্ক্ষণিক বক্তৃতা, একাঙ্ক নাটক, কুইজ, ছবি আঁকা, ছোটখাটো বিজ্ঞানভিত্তিক মডেল প্রদর্শনী ইত্যাদি নানান প্রতিযোগীতা থাকত। সব কিছুরই বিষয় বিজ্ঞান বা সমাজসংস্কার। এরকমই একবার বাচ্চাদের বিভাগের বসে আঁকো প্রতিযোগিতার বিষয়বস্তু ছিল সাক্ষরতা অভিযান। মনে আছে আমি আঁকার মাস্টারমশাই তথা আমার জ্যাঠতুতো দাদার কাছে শিখে আসা ছবি বাড়িতে এসে ওই বারান্দায় শীতের রোদে পিঠ দিয়ে বসে মায়ের তত্বাবধানে অভ্যেস করছি আর মা আমার একের পর এক ভুল ধরে চলেছে। দুপুর শেষ হয়ে ক্রমশঃ বিকেল হয়ে চলেছে আর বারান্দায় রেলিঙের লোহার রডগুলোর ছায়া ক্রমশঃ লম্বা হয়ে চলেছে। এত চকচকে এই ছবিটা আমার মনে যে বারান্দা-ছুটির দুপুর আর রোদ্দুর বলতে আমার সবার প্রথমেই এই দৃশ্যটাই মনে পড়ে।  

তাই বাড়ি থেকে এত দূরে এসে সরকারী কোয়ার্টারের অস্থায়ী বাসস্থানের এই বারান্দার ইঁটের ফাঁক দিয়ে আসা রোদ্দুর যেন একপলকেই মনে করিয়ে দিলো মন জুড়ে বসা একবারান্দা ভর্তি রোদ্দুর আর সেই রেলিং ঘেরা আমার সমস্ত ছেলেবেলাটাকেই। যা কিনা কতদিন আগে আমার ক্লাস ফাইভে পড়া দশ-এগারো বছরের মনটাকে নিয়ে আমায় কিচ্ছুটি না বলে কোথায় যেন নিরুদ্দেশ হয়ে গেছে। হাজার চেষ্টাতেও যাকে আর চেপে ধরতে পারবনা কোনদিন।কক্ষনো।   

Sunday 20 July 2014

হাচিকোরা আর আমরা

সকলের হাচিকো-গুগল থেকে
হাচিকোকে মনে আছে তো? সেই যে, টোকিও শহরের প্রোফেসর উএনো-র বন্ধু কুকুরটি যে কিনা প্রোফেসর উএনো-র মৃত্যুর নয় বছর পর পর্যন্তও তাঁর জন্য স্টেশনে অপেক্ষা করত। শেষে হাচিকো তার এই বিশ্বাস আর প্রভুভক্তির জন্য কিংবদন্তিতে পরিনত হয়েছিল। আমরা মনুষ্যকুল তাকে নিয়ে দু দুখানা সিনেমা পর্যন্ত বানিয়ে ও দেখে ফেলেছি। সেই হাচিকোর কথা বলছি। সেদিন প্রেসিডেন্সি কলেজ থুড়ি ইউনিভার্সিটির একটা খবর পড়তে গিয়ে নতুন করে হাচিকোদের কথা মনে পড়ে গেল।

খবরটা এখানে পড়ে নিতে পারেন। সংক্ষেপে ব্যাপারটি এরকম, প্রেসিডেন্সি ক্যাম্পাসে ছাত্রছাত্রী, অধ্যাপককুল ছাড়াও ছিল চোদ্দটি কুকুর। এবং যথারীতি কিছু লোকজন তাদের বিরুদ্ধে তত্পর হতে শুরু করেছিলেন ক্যাম্পাসছাড়া করতে। এবং যথারীতি আরো অন্য ছাত্র-ছাত্রী দল ও কিছু অধ্যাপক তাদের পাশে দাঁড়ান ও সকলে মিলে তাদের ভ্যাকসিনেশন, স্টেরিলাইজেশন ইত্যাদির ব্যবস্থা করেন। বর্তমানে তারা বহাল তবিয়তে গম্ভীর হয়ে নতুন বাকলস পরে প্রেসিডেন্সি ক্যাম্পাসে ঘুরে বেড়াচ্ছে। এই হলো সংক্ষেপে খবরটি।

কিন্তু আমি জানি এই পুরো ঘটনাটা এত সহজে হয়নি। কারণ দেখুন, আমরা হলুম গিয়ে দুপেয়ে মানুষের দল। ভগবানের নাকি শ্রেষ্ঠতম সৃষ্টি। আমাদের সাথে কিনা এই নোংরা, কালোকোলো চারপেয়ে গুলো একই সাথে ঘুরে বেড়াবে? তা কি করে হয়? যদিও ওরা আমাদের খাবারে ভাগ বসাচ্ছে না, আমরা যে যেন তেন প্রকারেণ অন্যের পাওনা থেকে ছোটোখাটো চুরি চামারি করে-দুচার পয়সা ঘুষ-ঘাষ নিয়ে নধর ভুঁড়িটুকু কোনো মতে টিকিয়ে রাখার চেষ্টা করছি তাতেও ভাগ বসাচ্ছে না। কিন্তু তবুও, এই যে চারপাশ থেকে আমরা এত চাপ খাচ্ছি-অফিসে দিবারাত্র বস ঝাড়ছে, বাড়িতে নিত্যদিন বউ অন্তর্টিপুনি দিচ্ছে, বাচ্চার স্কুল থেকে অহরহ কমপ্লেইন আসছে, অফিস কলিগ চোখের ওপর দিয়ে নতুন গাড়ি হাঁকাচ্ছে-সুইত্জারল্যান্ডে ছুটি কাটাতে যাচ্ছে আর আমি ছুটিতে লিলুয়া কিংবা গোবরডাঙ্গার বাইরে ভাবতে পারছিনা.........এইসব চাপের একটা রিলিজ পয়েন্ট তো থাকা উচিত তাই না? বলুন? তা আমি কি করব? নিশ্চয়ই বস বা বউ বা বাচ্চা বা কলিগ কাউকেই মনের ঝাল মিটিয়ে কষিয়ে একটা লাথি মারতে পারব না? তা কাউকে তো একটা মারতে হবে, নইলে তো চাপ খেতে খেতে ক্রমশঃ চ্যাপ্টা হয়ে যাব। তা হাতের সামনে এই হাড়-হাভাতে চারপেয়ে গুলো থাকতে আর কাকে লাথি মারব বলুন তো? সুতরাং, ওরা যতই আমায় দেখে কানদুটো নামিয়ে, মিনিটে তিনশ পঞ্চাশ বার প্রবলভাবে লেজ-টেজ নাড়ুক না কেন, আমি দেখতে পেলেই ওদের দুরছাই করব, লাঠি দেখাবো, পাথর ছুঁড়ব, দরকার পড়লে লাথি মেরে এলাকা ছাড়া করব। যতই হোক, পৃথিবীটা আমার বাপের সম্পত্তি। পৃথিবীকে চিবিয়ে ছিবড়ে চচ্চড়ি পাকাবার অধিকার একমাত্র আমার জন্মগত। এইসব কুকুর ছাগল তো জন্মেছে হয় আমার খিদে মেটাতে নয় আমার মনের ঝাল মেটাতে। এদের নিয়ে আবার অত আদিখ্যেতা কি - হ্যাঁ ?

সুতরাং যারা এইসব চারপেয়েদের হয়ে প্রেসিডেন্সিতে গলা ফাটিয়েছেন তাঁদের যে বেশ অনেকখানিই গলা ফাটাতে হয়েছে সে বিষয়ে আমার কোনো সন্দেহই নেই। কিন্তু তবুও যে শেষ পর্যন্ত তাঁরা পেরেছেন এটাই যথেষ্ট। আমি আজ এমন একটি সরকারী প্রতিষ্ঠানের কথা বলব যেখানে মাত্র দুটি অতীব শান্ত কুকুর ও তাদের তিনটি বাচ্চাকে সেই প্রতিষ্ঠানের ছাত্র-ছাত্রীরা মিলে সম্পূর্ণ প্রতিরক্ষা দিতে পারেনি। বাচ্চাগুলিকে চলে যেতে হয়েছে।

দুই তিন বছর আগে একটি পুঁচকে কুকুরছানা এই মহার্ঘ্য প্রতিষ্ঠানের চত্বরে ভুল করে ঢুকে পড়েছিল। প্রেসিডেন্সির মত কিছু বোকা কুকুরপ্রেমী তাকে খাইয়ে দাইয়ে -ভ্যাকসিনেশন দিয়ে ক্যাম্পাসেই থাকতে অভয় দিলেন। সেও আদরে-আদরে, নেচে কুঁদে, পুঁচকে লেজ নাড়িয়ে, স্পেনসার্স এর চিকেন লেগ পিস এর সূপ আর পেডিগ্রী খেয়ে আস্তে আস্তে প্রবল ভিতু আর প্রচন্ড আদুরে একটা কুকুর তৈরী হতে লাগলো। এবং কিংবদন্তি কুকুর হাচিকোর নামে তার নাম হলো 'হাচিকো'। এখন আমাদের হাচিকো লায়েক হয়েছে। তারই মত একটি কালোকোলো বান্ধবীও জুটেছে। 'হাচিকোর বান্ধবী', তাই তাকে আমি 'হাবা' বলে উল্লেখ করব এখন থেকে।

        আমাদের ছোট্ট হাচিকো তখন - হাচিকোর ফেসবুক প্রোফাইল থেকে           আমাদের প্রবলপ্রতাপশালী হাচিকো এখন -পিনাকীর তোলা ছবি
গতবছরে হাচিকো- হাবা এবং হাবা-হাবার অন্যান্য বন্ধুবান্ধবের মিলিত প্রচেষ্টায় হাবার আট-আটটি বাচ্চা জন্মায়। প্রথম প্রথম বিষয়টায় কারো কোনো গাত্রজ্বালা ছিল না। গাত্রজ্বালা শুরু হলো যখন তারা টলমল পায়ে ক্যাম্পাসের রাস্তায়, মাঠে খেলে বেড়াতে লাগলো। ততদিনে অবশ্য তারা সংখ্যায় আট থেকে কমে তিনে দাঁড়িয়েছে। ক্যাম্পাসের দুচারটি ছাত্র-ছাত্রী সদ্যজননী হাবা আর তার বাচ্চাতিনটির খাওয়াদাওয়ার দায়িত্ব নিল। বেশ ছিল। সারাদিন ঘুমোত ক্যাম্পাসের বিল্ডিং এর পেছনে জঙ্গলের কাছে একটি পান্ডব বর্জিত জায়গায়, কেউ গিয়ে দুধ বা বিস্কুট দিলে কাড়াকাড়ি করে খেত। আর মাঝে মাঝে বাইরে এসে দৌড়াদৌড়ি করে আবার আস্তানায় ঢুকে যেত। আমাদের প্রবল প্রতাপশালী হাচিকো পর্যন্ত তাদের মেনে নিয়েছিল।
হাবার ছানাদের একটি-ছবিটি পিনাকীর সৌজন্যে   

হাচিকো-রাগী বাবার ভূমিকায় 

হাবা আর তার ছানারা-তখনও পাঁচ জন টিকে আছে

কিন্তু তা বললে কি করে হবে? ভারতসরকারের খাসতালুকে বিজ্ঞান গবেষনার এতবড় প্রতিষ্ঠানে কখনো অর্বাচীন কোনো কুকুরছানা থাকতে পারে? হাচিকোকে তার শুভানুধ্যায়ীদের দৌলতে সবাই মনে না নিলেও মেনে নিয়েছে। তাকেও অবশ্য বেশ কয়েকবার পাশের ন্যাশনাল হাইওয়ে পার করিয়ে দূরের জঙ্গলে ছেড়ে আসা হয়েছে। সৌভাগ্যবশতঃ প্রত্যেকবারেই সে ফিরে আসতে সক্ষম হয়েছে। কিন্তু এই হাবা এবং তার তিনটি ছানাকে তাড়াতে উঠে পড়ে লাগলো ক্যাম্পাস প্রশাসনিক দফতররের সবাই। কেউ মুখে না বলে, কেউ সরাসরি। শেষে যেদিন বাচ্চা তিনটিকে পিটিয়ে, লেজ ধরে একটা বস্তায় ঢুকিয়ে জঙ্গলে ছেড়ে আসা হলো সেদিন কিছু ছাত্র-ছাত্রীর সাথে প্রশাসনিক দফতরের সরাসরি ঝামেলা শুরু হলো।

খবর পাওয়ামাত্র প্রথমেই তো ছাত্রছাত্রীরদল জঙ্গলে ঢুকে এক দেড় ঘন্টার প্রচেষ্টায় খুঁজে পেতে হাচিকোর সাহায্যে বাচ্চাতিনটিকে ক্যাম্পাসে ফিরিয়ে নিয়ে এলো। তার পর তো জানা গেলো যে, কোনো একজন প্রচন্ড দায়িত্বশীল কর্মচারী গার্ডদের নির্দেশ দিয়েছেন যে দেখলেই যেন লাঠির বাড়ি মেরে কুকুরদেরকে ক্যাম্পাস ছাড়া করা হয়। কারণ? কি বোকা- বুঝতে পারলেন না? ক্যাম্পাসে নাকি বিদেশী ভিজিটররা আসবেন রিসার্চের মান নির্ণয় করতে, এমতাবস্থায় ক্যাম্পাসে চাট্টি কুকুর থাকলে কেমন কেমন দেখায় না? তা এখন ছানাগুলো নেই, গবেষনার কি উন্নতি হয়েছে জানিনা। তাই তিন তিনটে মায়ের দুধ না ছাড়া বাচ্চাকে একই বস্তায় পাশবিক ভাবে ঢুকিয়ে এমন জায়গায় দিয়ে আসা হলো যার পাশেই ন্যাশনাল হাইওয়ে, ভুল করে ওদিকে চলে গেলেই দানবীয় ট্রাকের চাকা অপেক্ষা করছে পিষে দেবার জন্য। কেউ যুক্তি দিল ক্যাম্পাসে স্টাফ কোয়ার্টারে এত ছোটো বাচ্চা, যদি কামড়ে দেয়? জানিনা তাঁরা বেবি সিটার ডগ বিষয়টি জানেন কিনা। কোনো মহানুভবের আবার যুক্তি যদি সিঁড়িতে নোংরা করে রাখে। সবই 'যদি', তাই নির্দিষ্ট পদ্ধতি ছাড়া যেমনতেমন ভাবে তাদের পেছনে পড়া গেল। কারণ আমাদের তো বুদ্ধি আছে না? তাই আমরা জানি অজস্র পায়রা যারা ক্যাম্পাসের প্রতিটা কোয়ার্টার এর প্রতিটা ঘর, সিঁড়ি সবসময় নোংরা করছে তাদের ধরতে আমরা পারব না, ধরতে গেলেই পালাবে। কিন্তু এই তিন আঙ্গুল চেহারার কুকুর ছানা গুলো যারা ঠিক করে হাঁটতেই পারে না, তারা তো পারবে না পালাতে, উল্টে লেজ নেড়ে খাবারের আশায় সামনে আসবে। দে নোংরা বলে তাদের ওপর গায়ের ঝাল মিটিয়ে। দুচারটে লাঠির বাড়ি মারলেই বা কোন মানেকা গান্ধী আসছে দেখতে। অতএব, চালাও লাঠি। শোনা গেল যে হাবা সহ হাচিকোকেও নাকি ক্যাম্পাস ছাড়া হতে হবে। তাঁরা অনেক সহ্য করেছেন, কি সহ্য করেছেন তা ঠিক জানা গেল না। এই ভিতুর ডিম কুকুরগুলো কাউকে কোনদিন কামড়ায় না, যাঁরা বলছেন তাঁরা কেউ কোনো দিন তাদের খেতে টেতে দেন বলে জানা যায় না, তাদের ঘরেও এরা যায় না যে নোংরা হবে।

সমস্যাটা হলো যখন দু দশজন ছাত্র ছাত্রী কোমর বেঁধে তাদের হয়ে সওয়াল করে সরাসরি দফতরে চলে এলো। এসে পরিস্কার ভাষায় জানালো যে, হাচিকোর তো বাইরে যাবার প্রশ্নই নেই কারণ ও বাইরে গেলে নিজের মত করে বেঁচে থাকতেই পারবে না, ছোটো থেকেই সে বাড়ির কুকুরের মত ক্যাম্পাসে আছে নিয়মিত সমস্ত ভ্যাকসিনেশন সহ। আর বাচ্চাগুলোর সাথে এই ঘটনা যেন আর না ঘটে, তাদের যথার্থভাবে কোনো adaptation সেন্টারে যতক্ষণ না পাঠানো হচ্ছে ততক্ষণ তারা এখানেই থাকবে। এবং ঠারেঠোরে এটাও জানালো যে তাদের উপর লাঠি-টাঠি চালালে কে কোনদিন ছবি টবি তুলে কোথাও লাগিয়ে দিলে 'PETA' র দলবল এসে পেটালে সেটা কি আর ভালো হবে? সম্ভবত শেষের কথাটিতেই কাজ হলো। কারণ বড় বড় দায়িত্বশীল নাগরিকদের দেখেছি ততক্ষণই দায়িত্বপালন করেন যতক্ষণ সাধের পিঠটা বাঁচছে। যখনই তাতে একটুও আঁচ আসার সম্ভবনা থাকে তখনই সব দায়িত্ব ব্যাগে ভরে মুখ মুছে 'গোপাল বড় ভালো ছেলে' হয়ে যায়। যাই হোক, কয়েক সপ্তাহ পর ছাত্র-ছাত্রীরাই উদ্যোগ নিয়ে বাচ্চা তিনটির adaptation এর বন্দোবস্ত করলো, হাচিকোর স্টেরিলাইজেশন করালো। তালেগোলে হাবাকেও আর বাইরে যেতে হলো না।

বর্তমানে হাচিকো দুপুরে পেডিগ্রী দিয়ে দুধ- চিঁড়ে খেয়ে বহাল তবিয়তে আমাদের বাড়িতে ঘুমোচ্ছে। সন্ধ্যে হলেই বাইরে ক্যাম্পাস এর বাকিদের খবরাখবর নিতে যাবে। আর হাবা বাইরের অন্য কুকুরদের দৌলতে আবার এই বছর কয়েকটি বাচ্চার জন্ম দিতে চলেছে। তাদের কি হবে কে জানে।বছর বছর আমাদের মায়ের থেকে বাচ্চাদের আলাদা করার কাজটা করে যেতে হবে হয়ত। আর তারপর হাবার নীরব শান্ত দৃষ্টির দিকে সোজাসুজি চোখ তুলে তাকাবার পরীক্ষা দিয়ে যেতে হবে। নইলে কিছু অতি দায়িত্বশীল নাগরিকদের অতি দায়িত্বশীলতার ধাক্কায় হাচিকোর মত হাবাকেও তার স্বাভাবিক প্রবৃত্তি থেকে জোর করে টেনে সরিয়ে আনতে হবে। বোকা হাঁদা চারপেয়ে গুলোর জন্য আমাদের মত স্বার্থপর, নিজের কোলে ঝোল টানা দুপেয়েরা আর কি ই বা করতে পারি? প্রেসিডেন্সির ওরা যেমন করেছে।

Saturday 19 July 2014

আপনার জীবনের লক্ষ্য কি?

আমি জীবনের লক্ষ্য সম্পর্কে উত্সাহিত হয়ে অনেক দেখে, এসোসিয়েশন স্টাডি করে, কাই স্কোয়ার টেস্ট করে প্রচুর-প্রচুর স্ট্যাটিসটিকাল সিগনিফিকেন্স টেস্ট করে নিচের সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছি। এবং মানুষের বয়স অনুসারে ধীরে ধীরে সেই লক্ষ্যের পরিবর্তন বা বলা যায় বিবর্তন বা বৃদ্ধিও হতে থাকে। আমি আমার সিদ্ধান্তগুলো বয়স অনুসারে সাজানোর চেষ্টা করছি। পরিবেশ, পরিস্থিতি বিচার করে হয়ত লক্ষ্যের একটু-আধটু এদিক ওদিক হতে পারে কিন্তু মোটামুটি গতটা একই। দেখুনতো মিলছে কিনা?


 আপনার যখন বয়স
আপনার বাড়ির লোকজন আপনাকে যা বলছেন  
আপনার পাশের বাড়ির লোকজন যা ভাবছেন
আপনি সবকিছু শুনে যা আপনার জীবনের লক্ষ্য বলে ভাবছেন 
 - বছর 
"ওলে বাবা ....কুচুসোনাটা....আন্টিকে একটু 'জ্যাক এন্ড জিল' টা বলে দাও তো সোনা"....কি সুন্দর বলে জানেন তো এখন আপনাকে দেখে লজ্জা পাচ্ছে।" 
"আদিখ্যেতা! আমার বাবু যেন পারে না! কাল বিকেলে শুনিয়ে দেব। বাবুসোনা, 'ব্যা ব্যা ব্ল্যাক শিপ' টা মুখস্ত করে নাও তো ভালো করে।
"আমি তো বাড়ির বাবুসোনার সঙ্গে খেলতে যাই.....পড়া কেন বলতে হবে তখন?" 
 - বছর 
 "কুচু, নো মোর প্লে, গুড বয়.....সামনের মাসে XXX ইন্টারন্যাশনাল স্কুলে ভর্তি হতে হবে তো না?.....চল আমরা একটু পড়াশুনা করে নি কেমন? পাশের বাড়ির বাবুসোনা যদি পেয়ে যায় তুমি যদি না পাও কি হবে?"
"দেখব দেখব, ওরকম লাখটাকা ডোনেশন দিলে আমার বাবুসোনাও পারবে XXX ইন্টারন্যাশনাল স্কুল এ ভর্তি হতে।"
"তাহলে কি বাবুসোনার সাথে খেলব না মা?"
 -১৫ বছর (মাধ্যমিক/10th)
"কুচু, সামনে মাধ্যমিক। আমার হয়নি, আমার স্বপ্ন তোমাকে কিন্তু 10th এর মধ্যে হতেই হবে.....অমুককাকুর মেয়ে কিন্তু গতবার 90% পেয়েছিল....দেখো আমদের নাক যেন না কাটা যায়।"
"HS এ সাইন্স না পেলে......দেখব দেমাক কোথায় থাকে।.....বাবুসোনা জান লড়িয়ে দে কোনমতেই যেন তোকে টপকাতে না পারে।"
"হে ভগবান, অন্ততঃ 10th পজিসনটা দিও ঠাকুর। নিদেন পক্ষ্যে 91% 
 ১৫-১৭ বছর (উচ্চমাধ্যমিক/12th)
"মাধ্যমিক আর উচ্চমাধ্যমিকের কিন্তু আকাশ-পাতাল তফাত কুচু......খুব সাবধান সামনে জয়েন্ট......পেতেই হবে। হবেই.....মেডিকেল হলে তো দারুন নইলে ইঞ্জিনিয়ারিং.....rank ঠিকঠাক না হলে কিন্তু লাইফ শেষ মনে রেখো।"
"খুব তো শুনছিলাম এত ভালো তত ভালো......মাধ্যমিক এ rank কি পেল?.....নেহাত আমার বাবুসোনার পরীক্ষার আগে সাতদিন অমন জ্বর হলো তাই নইলে কি আর আমার বাবুও পারতনা অমন রেজাল্ট করতে?......দেখব জয়েন্ট এ কি করে?"
"ঠাকুর, জয়েন্টটা ঠিকঠাক পাইয়ে দাও ভগবান। নাহলে তো আমায় সুইসাইড করতে হবে? নো ফিউচার ইন জেনারেল লাইন......ওরে বাবা!"
 ১৭-২১ বছর (গ্র্যাজুয়েশন)
"অনেক তো হলো কুচু, জয়েন্টটাও ঠিকমত লাগাতে পারলে না....করোটা কি সারাদিন?.....এত টাকা টিউশন ফী দিয়ে যে কোর্সটায় ভর্তি করানো হলো রেজাল্ট ঠিকঠাক না হলে চাকরি বাকরি জুটবে না কোনদিন বলে দিলাম.....ফালতু প্রেম ফ্রেম ছেড়ে পড়াশুনাটা করো ঠিক করে।"
"হলো তো?.....জয়েন্ট এ লবডঙ্কা?....বলেছিলাম না এমন কিছু নয়.....ওই তো জেনারেল লাইন এ অনার্স পড়ে করবেটা কি?.....আমার বাবুসোনাকে তো ব্যাঙ্গালোরে পাঠালাম সেজন্যই। একটু বেশি অ্যাডমিশন ফী লাগলো কিন্ত ওদের কলেজ এ ক্যাম্পাসিংটা দারুন। "
"হে ভগবান, গ্রেডটা যেন ঠিকঠাক আসে, PG তে না পেলে......উফফ ভাবতে পারছি না......কলেজে 'বুঁচি' already ওর কোন পাড়াতুতো দাদার JNU তে পোস্টগ্র্যাজুয়েশনের গল্প দিয়ে রেখেছে।"   

 ২১-২৩ বছর (পোস্টগ্র্যাজুয়েশন)
"যাই কর কুচু, এখন থেকেই PSC, SSC, UPSC গুলো দিতে থাকো....কিছুই তো হলো না.....কত স্বপ্ন ছিল......ফোঁ ও ও ও ও স (মানে দীর্ঘশ্বাস).....একটা চাকরি তো পেতে হবে.... নাকি?"
"এই তো আমার বাবু কেমন ক্যাম্পাসিং এ পেয়ে গেছে। লাস্ট সেমেস্টারের পরেই joining....স্টার্টিং এ একটু কমই দিচ্ছে....কিন্তু বাড়বে.....আচ্ছা আপনার কুচু এরপর কি করবে টরবে বলছে?" 
"হে ভগবান! বুঁচির সেই *&$#@ দাদা স্কলারশিপ-টিপ পেয়ে বিদেশে চলে গেল পিএইচডি করতে.......দেখো ঠাকুর যেন নেট ফেট পেয়ে দেশেই না হয় একটা পিএইচডি জোটাতে পারি।"
২৩-৩০ বছর (ডকটরাল গবেষণা)
"আচ্ছা কুচু, তোর এই পিএইচডি বিষয়টা বেশ করে বোঝা তো দেখি.....কি যে চাকরির চেষ্টা না করে করছিস?....বললাম কতো করে প্রাইমারি স্কুল এ পাচ্ছিলি ছাড়িস না, পরে না হয় batter কিছু পেলে ছেড়ে দিতিস। চাকরি কেউ পেয়ে ছেড়ে দেয়?....কি যে করছিস? বিয়ে টিয়ে করতে হবে তো নাকি.....তিরিশ হতে চলল ।" "যাই বল বাবা, চাকরি is চাকরি, ওসব গবেষণা-টবেশনা যাই বল না কেন সবই তো চাকরির জন্য সেই জন্যই তো আমার বাবু প্রথম চান্সেই accept করে নিয়েছে.....এখন তো দারুন স্কেল হয়ে গেছে.....ভাবছি তো সামনের নভেম্বরে বিয়েটা দিয়ে দেব। " "যাক, বুঁচিটা শেষ পর্যন্ত রাজি হয়েছে। এবার থিসিসটা কোনক্রমে জমা করতে পারলে হয়, কিন্তু পেপারটার যে কি হলো? খালি ফেরত আসে.....হে ভগবান, পেপার-থিসিসটা ভালয় ভালয় নামিয়ে দাও ঠাকুর। বিয়েটাও আটকে আছে এর জন্য।"
 ৩০-৩৫ বছর (পোস্ট ডকটরাল গবেষণা )
 "আচ্ছা কুচু, পিএইচডি তো হলো চাকরি করবি কবে?.....বিয়ে হলো এবার তো বাচ্চা চাই তাই না......আমাদের তো শখ আছে....সবাই কেমন সেটেলেড......"
"আমার বাবুর তো সেকেন্ড বেবি আসতে চলেছে দিদি......আপনাদেরই তো পাড়ার মধ্যে সবচয়ে কাছের মনে করি তাই প্রথমে আপনাকেই বলছি আর কেউ জানে না.....বড়টা? ক্লাস ওয়ান হবে এবার। কি ভালো নাচে কি বলব....আমি তো  তাই বৌমাকে বলছিলাম ডান্স বাংলা ডান্স এর অডিশনে যাও একবার.... ওর বাবা মায়েরও খুব ইচ্ছা......আচ্ছা কুচু কি চাকরি-টাকরির apply করছে না? এইসবই করবে?"  
 "হে ভগবান, বিদেশে একটা ভালো পজিশন পাইয়ে দাও ঠাকুর। নাহলে দেশেই.....সবাই কেমন সেটেলেড"


 আমি কিনা এই বয়সসীমা পার হতে পারিনি এখনো তাই আর পরের লক্ষ্য গুলো সম্পর্কে কিছু বলতে পারছি না এখনই। পরে কখনো দেখা যাবে। আপাতত সমীকরনটা যা দাঁড়ালো তা হলো এই- আপনি গবেষনা, চাকরি, ব্যবসা ইত্যাদি হাবিজাবি যাই করুন না কেন আপনার জীবনের লক্ষ্য হলো,
ভালো স্কুল-ভালো রেজাল্ট-জয়েন্ট এন্ট্রান্স-চাকরি-চাকরি মানেই বিয়ে-বিয়ে মানেই বাচ্চা। আপনি ঠিকঠাক মানুষ না হলেও চলবে, অপার মিথ্যে কথা বললেও চলবে, ধরা না পড়ে টুকটাক ঘুষ নিলেও চলবে, চিপস খেয়ে রাস্তায় প্যাকেট ফেলাটা কেন দোষের সেটা না বুঝলেও চলবে......... কিন্তু 'রেজাল্ট-চাকরি-বিয়ে-বাচ্চা' এই সমীকরণটিই হলো আপনার জীবনের লক্ষ্য। মিলিয়ে নিন ঠিক বললাম কিনা? এই গতে না চললে আপনার জীবনে ষোলো আনাই ফাঁকি। তা সে আপনি যত বড় জগদীশ বোস-ই হন না কেন।