Saturday 30 August 2014

অসম্পূর্ণ দিন

অধৈর্য্য মানুষের ভিড়ে আর অবান্তর সব প্রতিযোগিতায়
ফুরিয়ে যায় সম্ভাবনাময় এক-একটা দিন

হয়ত সেদিন অপেক্ষা করেছিল কোনো নিভৃত প্রেমালাপের,
হয়ত শেষ হতে পারত বহুদিনের অসম্পূর্ণ কোনো ছবি
হয়ত প্রত্যক্ষদর্শী হতে পারত কোনো অমলিন সূর্যাস্তের
নয়তো কিছুই না করে একান্তে ডুব দিতে পারত নিজেরই মধ্যে
হয়ে উঠতে পারত আদ্যন্ত সফল একটি দিন।

কিন্তু দুর্বল অস্থির মন
নিজেকে টেনে হিঁচড়ে কিছুতে বেরই করে আনতে পারে না
ভেসে যাওয়া কথোপকথন থেকে
নিরর্থক অভিযোগ আর অপরিনয়ের শেকল থেকে

অগত্যা সন্ধ্যে নেমে আসে খোলা বারান্দায়
মৃদু শীতল হাওয়ায় ক্রমে ক্রমে শেষ হয়ে যায় আবছা বিকেল
অস্ত যায় শেষ সম্ভাবনার আলোও, সেদিনের মতো
সংক্ষিপ্ত দীর্ঘশ্বাসে শেষ হয়ে যায় একটি গোটা দিন।
অসম্পূর্ণ।
      

Thursday 28 August 2014

ফেরা-৩

ফেরা-২ এর পর......

খানিকটা যেতেই বুঝতে পারল মানুষটাকে। সাইকেল থেকে তাড়াতাড়ি নেমে পড়ে নব।
-দাদু, তুমি এখনও বাড়ি যাওনি? এত বেলা পর্যন্ত মাঠে কি করছিলে? এত রোদ? ছাতা-ফাতাও নাওনি একটা! মা চিন্তা করবে যে।
-কে রে? লবা নাকি? এই যে এবার যাচ্ছি। আমার আবার ছাতা? পুন্ন সামন্ত আর কবে রোদ-বিস্টির ধার ধেরেছে রে? আমায় ছাতা লিতে দেখছু কখনও?
-সে নাহয় নাওনি আগে, এখন তো বয়স হয়েছে। এরকম করে কেউ রোদে ঘোরে? মাঠে কি করছিলে এতক্ষণ?
-এই গরমের ধান উঠতেছে, ঘরের বাখুলে তো গাদা দিবার জাগাই রাখেনি তর বাপ। ফ্যাসানের ঘর-দালান হচ্ছে তার। এখন ধান উঠলে কোথায় রাখা হবে সেসব তো কেউ দেখবেনি লয়? সেতো এই বুড়োটাকেই দেখতে হবে। গেছিলুম রতনের খামারটা যদি দেয় তাই জিগাতে।
- তা ধান উঠবে তো রাজিবুল চাচা তো আছে, সব দেখেশুনে গুছিয়ে দেবে, তুমি ছোটাছুটি করছ কেন?
-নিজের জমির ধান, সে তো নক্ষ্মী রে বাপ। তা ঘরের নক্ষ্মীর বসার জাগা সেকি বাইরের নোক ঠিক করে দিলে হয়?
-তাই বলে এই বয়সে.........।
-কি করব? তর বাপ দাদারা তো... দাদারা আর কেন বলি, মেজবাবু তো মোদের বাপ ঠাকুরদাদা বলে পরিচয় দিতে নজ্জা পায়। পরাশুনা শিখছে। শিক্ষিত। নাথি মারি অমন শিক্ষের মুখে। বিয়ে করে সেই যে বাবু বিবি গ্যালেন, বচ্ছরান্তে একবারও তো ঘরের কথা মনে করেনি। তুই যেন অমন করিসনি লবা।
- ছাড়ো না দাদুআবার ওসব কথা কেন? যে যার মতো আছে।
-না বাপ, আমার আর কি? তমরা সব ভাল থাকলেই ভাল। কিন্তু নিজের বাপ পিতেমোর ভিটেকে হেলাছেদ্দা করা ভাল নয় বাপ। ভাল নয়। তাতে অভিশাপ লাগে। তমরা এখনকরার ছেলেপুলে, তমরা মানবেনি। নিজের জন্মভিটে-যে তমায় থাকতে দিল, নিজের জমিজিরেত-যে তমায় খেতে দিল তাদের আশিব্বাদ না পেলে কোথাও শান্তিতে থাকতে পারবেনি জেনে রেখ।
এই যে তর বাপ দাদা, জমি জায়গা পুখুর বাগান ফেলে কি করছে? পঞ্চায়েত- পাটি- মিটিন- ভোট। যতসব উঞ্ছ কাজ। ক্ষমতা চাই। ট্যাকা চাই। নিজের ছেলে, লাতি কি বলব বল। আর আমার কথা কেই বা শোনে? লিজেরটুকুনি লিয়ে শান্তিতে থাক, তা সইবেনি। কুন পথে যে তর বাপ লতুন ঘর দালান তুলছে সে কি আমি বুজিনি রে বাপ? সবই বুঝি। তর মা কে আমি বলেছি। সব উচ্ছুন্নে যাবে দেখ বউমা সব উচ্ছুন্নে যাবে।   
-মা কি বলে?
-সে আমার ঘরের নক্ষ্মী রে লবা। সে সবই বোঝে কি আর বলবে? বলে, বাবা আপনি চুপ করুন। এখনি শুনতে পেলে চিল্লাবে। সেই বা কি করবে? দুদিক রক্ষে করে চলেছে। কত মানা করল তর বাপকে পুরানো ঘর দুয়ার ত ভালই আছে কি হবে লতুন ঘর? তর বাপ শুনলে তো। পুরানোতে মন উঠেনি তার? বলে আমি হলুম পঞ্চায়েত পরধান। কত নোক আসে ঘরে। মাটির ঘর কি ভাল দেখায়? আরে বাপ আজ তুই পরধান তো কি? তুই মানুষটার কি তাতে চারটে ঠ্যাং বারাইছে? পরের মেরে লিজের ঘর তুলবি? ছ্যা ছ্যা। বলেছি বলে বলে কি জানিস? বলে, তুমি কি ট্যাকা দিবে ঘর বানাতে? দাওনা মনসাতলার পুখুরটা বেচে।
-তা বেচে তো তোমায় একদিন দিতেই হবে দাদু। কদ্দিন তুমি বাঁচিয়ে রাখতে পারবে বল?
-কেন? রাখতে পারব না কেন? আমি কি খেতে পাইনা নাকি যে পুখুর জমি বেচে খেতে হবে? নিজের হাতে করা পুখুর জমি রে বাপ। তর বাপ দাদা তার দাম বুজলনি। এখনও যদি ওসব ছেড়ে জমিজিরেতগুলোকে দেখে তো এখনকার চেয়ে দুইগুণ পয়সা ফিরে দিবে এই জমি আমি তকে বলে রাখছি লবা। আমার শরীল আর দেয় না বাপ তাই পরের হাতে দায় ছেড়ে দিতে হয়েছে। ওই রাজিবুল যা করে করে। মেনে লিয়েছি। তর দাদাকে আমি কতবার বলছি জানিস? তর মা ও বলছে, দৌড়াদৌড়ী ছেড়ে জমিজমাগুলো দেখ। চাকরি বাকরিও তো করিসনি কো। তা ত্যানার নিজের ঘরের জমি চাষ করতে মানে লাগে। কিন্তু দেখ গে যা ভোটের সময় ন্যাতাবাবুর গু-মুত পরিস্কার করতে মানে লাগে না। কুলাঙ্গার হতভাগা। বৌটাও তেমনি জুটেছে। লেচে বেড়াচ্ছে।
-যাক গে দাদু ছাড়ো। চলো বাড়ি চলো। অনেক বেলা হল। চান-খাওয়া হয়নি
--তা হোক। চ ত বাপ, পিপুলতলায় দুদণ্ড জিরিয়ে যাই।
 - সে কি দাদু? তুমি সাইকেলের পেছনে ওঠো না। এখুনি বাড়ি পৌঁছে যাব। তারপর জিরিয়ো না হয়। খাওয়া দাওয়া করবে না? মা বকবে তোমায় দেখো। এমনিতেই এত বেলা হল।
-তর মা তো আমাকে সর্বদাই বকছে। হবেখন নাওয়া খাওয়া। একদিন দেরি হলে কি এমন মহাভারত অশুদ্ধু হবে?
-বোসো তবে।
সাইকেলটা স্ট্যান্ড করে নব। দাদু নাতি পিপুলতলার বাঁশের মাচানে উঠে বসে। এই দুপুর রোদেও জায়গাটা বেশ আরামদায়ক। অল্প হাওয়া দিচ্ছে। সেই হাওয়াতে পিপুলতলার মানসিকের লাল সুতোয় বাঁধা ঢেলার টুকরোগুলোকে দুলতে দেখল নব। মনে পড়ল সে ও একবার এই পিপুল গাছে সকলের চোখ এড়িয়ে একটা ছোট ইঁটের টুকরো রাস্তা থেকে কুড়িয়ে যেমন তেমন একটা সুতো দিয়ে এখানে বেঁধে দিয়ে গিয়েছিল। উপকরণগুলো যেমন তেমন করে জোগাড় করলেও প্রার্থনায় কোনও ভেজাল ছিলনা ক্লাস সিক্সের নবর। অঙ্ক পরীক্ষা দিয়ে মনে হয়েছিল পাশ করবে না সে। জন্ম ভীতু সে। সবেতেই তার ভয়। ঢিলের জোরেই হোক বা অন্য কোনও কারণে সেবছর সে অনেক নম্বর না পেলেও মোটামুটি ভদ্রস্থ নম্বর নিয়ে অঙ্কে পাশ করে গিয়েছিল নব। মনে পড়তে অজান্তেই একটু হাসি এল নবর। চমক ভাঙল দাদুর ডাকে।
-লবা......
-বোলো দাদু।
-তুইও আর গেরামে ফিরবি নি বল? শহরে চাকরি করছিস, শহরেই থেকে যাবি তাই লয় রে বাপ?
- কেন দাদু? এই যে এসেছি?
-এরকম শৌখিন আসার কথা লয় রে, গেরামে থাকার কথা কইছি। এখান থিকে কাজের জাগা অনেক দূর বল? রোজ রোজ যাওয়া-আসা করা যাবেনি লয়?
- না দাদু সেতো সম্ভব নয়। এখান থেকে তো অনেক দূর।
-হ্যাঁ, বৌমাও তাই বলতেছিল। সেতো হবেনি।
-কেন দাদু?
-আচ্ছা লবু, আমি তকে কাঁধে করে মাঠে আনতুম। এই পিপুলতলায় বসিয়ে রেখে মজুরদের সঙ্গে মাঠে নামতুম। তর মনে আছে?
- তখন পিপুলতলার এই সামনের জমিটা আমাদের ছিল তাই না দাদু? এখানেই তো হাল দিতে, না?
-তর মনে আছে লবা! মনে আছে তর? এই চারবিঘা জমিটা রতনগভভা ছিল রে, রতনগভভা। তর মেজদার চাকরির জন্যে ঘুষ দিতে তর বাপ এটা জোর করে বেচে দিল নগেন পাত্তরের কাছে। কি লাভ হল? সে ছেলে তো ভুলেই গেছে বাপকে। পরাশুনা শিখলে ঘুষ দিয়ে চাকরি পেতে হবে কেন বাপ। পেটে বিদ্যে থাকলে সৎপথে পেটের ভাত জোটানো কি যায়নি? তুইও তো নেখাপড়া শিখছু, বলনা।
এই প্রশ্নের উত্তর দেবার ক্ষমতা নবর নেই। সে নতমুখে দাদুর ধুতি থেকে একটা একটা করে শেয়ালকাঁটা বেছে তুলতে থাকে।      
-‘জমি হল মা রে বাপ। জমি হল গে মা। মাকে বেচে ঘুষ!’ রোদে ভেসে যাচ্ছে সামনের জমিটা। গরমের ধান উঠে ফের হাল পড়েছে তাতে। সেইদিকে তাকিয়ে কিছুক্ষণ চুপ করে বসে রইল পূর্ণদাস সামন্ত, তারপর মাথাটা ধীরে ধীরে দুদিকে নাড়তে নাড়তে নামিয়ে দুই হাঁটুর উপর রাখল। দাদুর দিকে তাকিয়ে ভাবল নব, এই তার দাদু পূর্ণদাস সামন্ত, সম্পন্ন কৃষক। এককালে তাদের চারটে তাগড়াই হেলে গরু ছিল। আর দুটো হাল। তার ছোটবেলায় মনে আছে দাদু তাকে এককাঁধে বসিয়ে অন্যকাঁধে হাল নিয়ে মাঠে যেতো। সেখানে তাকে জমির আলের উপর বসিয়ে রেখে মাঠে নামত দাদু। সঙ্গে রাজিবুল চাচার বাবা রফিকুল আলি। এখন সেই হেলে গোরুগুলো আর নেই। দাদুও বোধহয় জমি, গরু এসবের সাথে সাথে আস্তে আস্তে শেষ হয়ে যাচ্ছে। অসুরের শক্তি ছিল যে হাতে, শিরা ওঠা দুবলা সেই হাতে এখনও নখের ভেতরে মাটি জমে আছে। তখনও যেমন থাকত। দুই হাঁটুতে মুখ নামিয়ে কেমন যেন কুঁকড়ে আছে মানুষটা। দুমড়ে যাওয়া বৃদ্ধের পিঠে হাত রাখে নব। মুখ তোলে বৃদ্ধ। কাঁপা কাঁপা গলায় বলে,
-চ ঘর চ, তর নাওয়া খাওয়ার দেরি হয়ে গেল লয় রে বাপ?
- না দাদু কোন দেরি হয়নি। তুমি বাবাকে এই জমিটা বেচতে দিলে কেন দাদু? বারণ করলে না?
- আমার কথা কে শোনে ক? বুড়ো হয়েছি। আমার কি জোর? বাপ-পিতেমোর এত সব জমি আমি মলেই শেষ রে, কেউ চোখ দিয়ে দেখলনি একবার। সবাই বাবু হতে চায় মাঠে নেমে চাষ করলে নাকি বাবু হওয়া যায়নি। সব চলে যাবে রে, সব চলে যাবে। তর বাপ বলে- ‘মলে কি জমি শুদ্ধু চিতেয় যাবে নাকি?’ আরে আমি কি নিজের জন্যে এসব বুক দিয়ে আগলাচ্ছি? বলে, ‘সব বেচে দাও। এতসব হ্যাপা কে দেখবে?’ সক্কলেই যদি হ্যাপাটাই দেখে রে বাপ ফসলটা ফলাবে কে? খাবি কি?
- আচ্ছা দাদু, রাজিবুল চাচা তো আছে। সে দরকার মত মজুর লাগিয়ে কাজ করিয়ে নিলেও কি অনেক হ্যাপা?
-রাজিবুলই তো আমার ভরসা রে। সবই সে করে, কাউকে তো আর মাঠে নেমে আমি লাঙ্গল দিতে বলছিনিরে বাপ। শুধু একটু নজর রাখা সবদিকে। নিজের ছেলেপুলেকে কি আর পরের হাতে তুলে দিয়ে নিশ্চিন্তে থাকা যায় রে? তার সাথে সুখ-দুখের কথা কইতে হয়, তাকে আদর করতে হয়। তা নইলে সে কখন পরের হাতে থাকতে থাকতে পরই হয়ে যায় টেরও পাওয়া যায়নি। সেটুকুনইও করার মতন কেউ নেই রে লবা আমার ঘরে।
যাক, যা হবার হবে, আমি আর কদ্দিন। তারপর তো......। চ তকে আর আটকাবনি রে বাপ, চ ঘরকে যাই। চাট্টি মুখে দিয়ে ফের একবার যেতে হবে।
-আবার কোথায় যাবে?
-কাজ কি আর একটা রে বাপ? মনসাতলার পুখুরের পাশে যে জমিটা তাতে তলা ফেলতে হবে, এখনও যদি মাটি তৈরি না করা যায় কবে তলা বোনা হবে, কবে ফের রুইতে পারব ক? তো সে জমি তো তুই জানিস চোঁ চোঁ করে জল টানে। এখন পুখুর থেকে এই হপ্তায় জল ছেঁচতে না পারলে অনেক দেরি হয়ে যাবে যে। তাই যাব দেখি যদি পরাণ মোড়লের বড় পাইপটা ভাড়ায় পাওয়া যায় তাইলে পুখুর থেকে জলটা কাল পরশু করে ছেঁচে দিতে বলব রাজিবুলকে। তা এই ভরা মরশুমে সে পাইপ কি আর ফাঁকা বসে আছে? দেখব হয়ত আগেই কেউ ভাড়ায় লিয়ে লিছে। দেখি গিয়ে।
-পাইপ তো হল, তা মেসিন? জলসেচের মেসিন?
- সে তো ঘরেই আছে। তর বড়দা সে ম্যাসিন ভাড়া দিচ্ছে যে। তাও জানিস, হারামজাদা বলে, ‘সে তো ভাড়া হয়ে গেছে তুমি আর কারো থেকে লিয়ে লাও।’ ঘরে ম্যাসিন থাকতে আমি ভাড়া লুবো? একটা দিন সে ম্যাসিন ফাঁকা রাখতে পারেনি? সব বজ্জাতি, অখে চিনিনি আমি? ঘরের জমির কাজে লাগালে ভাড়ার ট্যাকাটা পাবেনি যে। শেষে তর মা বলতে বলে, ‘ঠিক আছে একদিন লাও তবে। একদিনেই যা করার কর।’
-আচ্ছা দাদু, তোমাকে কতবার পরাণজ্যাঠার কাছ থেকে পাইপ ভাড়া করতে হয়?
- সে তো ধর না কেন বছরে পাঁচ-সাতবার তো বটেই। একদিনে দুশ করে। গেলবারেও দেড়শ ছিল। একধাক্কায় দুশ করে দিল। হবেনে কেন? অতবড় পাইপ, সবাই খোঁজে। আর তো কারো কাছকে নেই লয়।
কিছুক্ষণ মাথা নিচু করে নিজের হাতের তালুর দিকে তাকিয়ে চটপট মনের মধ্যে কতকগুলো অঙ্ক কষে নেয় নব। আর নয়, অনেকদিন ধরে বিষয়টা তাকে খোঁচাচ্ছে। সিদ্ধান্তটা সে নিয়েই ফেলল। এই দোনোমন, এই নড়বড়ে শিরদাঁড়া, এই সিদ্ধান্তহীনতার কারণে অনেক বিষয়ে তার অনেক দেরি হয়ে গেছে। অনেক কিছুকে সে হারিয়েছে চিরকালের মত। আর না। এবারে সে প্রত্যয়ী। আর ভাববে না। এবার কাজ করার সময়। সোজা দাদুর দিকে তাকিয়ে বলল,      
- তা অমন একটা পাইপ ঘরে কেনা থাকলে সুবিধা হয় না?
- তা তো হয়। সে আর আমায় কে ব্যবস্থা করে দিচ্ছে? অত ট্যাকা একসাথে......।
চট করে উঠে পড়লো নব। কপালের জমে থাকা ঘামটা জামার হাতায় মুছে নিয়ে সাইকেলের স্ট্যান্ডটা তুলে দিয়ে বলল, চলো দাদু, বসে পড়ো সাইকেলের পেছনে।
-চ লবা, অনেক বেলা হল, তর মা হানটান করবে।
-না দাদু, বাড়ি একটু বাদে যাব। এখন একবার চলো তো বিকাশের সাথে একটু কথা বলতে হবে। সে এই বাড়ি গেছে। ফের বেরিয়ে যাবার আগেই ধরতে হবে। চলো, বসে পড়ো ক্যারিয়ারে।
-কার সঙ্গে কথা কইতে হবে?
-বিকাশ গো, আমার বন্ধু, সেই যে একসাথে স্কুলে পড়তাম। আমাদের বাড়ি যেত গো, মনে নেই তোমার?  
-অ, সাঁতেদের? হরেন সাঁত-এর ছোট লাতিটা লয়? তার সাথে এখন আবার কি দরকার রে বাপ? বিকেলে যাসক্ষণ। এখন ঘর চ। বেলা হল।
-না গো দশ মিনিট লাগবে, কথাটা বলেই যাই।
-তাইলে তুই যা, আমি বরং ঘরকে যাই এবার।
- না দাদু তুমি ছাড়া হবে না। কত বড় পাইপ, কি ব্যাপার আমি তো বলতে পারব না। তুমি চলো বিকাশকে বুঝিয়ে বলবে, ওর তো এইসব লোহা-লক্কর, বালি-সিমেন্ট এর ব্যবসা, ও তোমার পাইপ কিনে এনে দিতে পারবে। আমি টাকা দিয়ে দেব, ও কাল পরশু এনে দিলে, তুমি এই সপ্তাহেই জমিতে জল দিয়ে দিতে পারবে। আর ও যদি না পারে তো আমি পরের সপ্তাহে নিয়ে আসব কিনে। তোমায় আর পরাণজ্যাঠার কাছে যেতে হবে না আজ। দুচার দিন অপেক্ষা করো তোমার নিজের পাইপ এসে যাবে।
কিছুক্ষণ হাঁ করে নাতির মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে পূর্ণ। বলে, ‘সে যে অনেক ট্যাকা দাম রে লবু...তুই এত টাকা......আমি রাজিবুলকে দিয়ে খোঁজ লিয়েছিলুম, সে পাইপের তো হাবিবপুরের বাজারে হাজার তিনেক ট্যাকা দাম রে......তর বাপ জানলে রাগ করবে যে বাপ।’
-তা হোক দাদু, আমি তো এখন কলেজে পড়াচ্ছি দাদু, আমি এ টাকাটা খরচা করতে পারব। আর বাবা কেন রাগ করবে, আমি তো বাবার থেকে টাকা চাইছি না। বাজে কাজে টাকা উড়িয়েও দিচ্ছিনা। ঘরের কাজে কাউকে তো খরচা করতেই হবে বলো? বাবার সাথে আমি কথা বলে নোবো। তুমি ও নিয়ে চিন্তা কোরো না। কি করতে হবে তুমি আমাকে সময় সময় শুধু বোলো। এখন চলো দেরি হচ্ছে।
-সত্যি লবু, তুই কিনে দিবি আমায় পাইপটা? তর অসুবিধে হবেনি? এতগুলা ট্যাকা?
-তোমায় কিনে দিচ্ছি কোথায় দাদু? ও পাইপটা কি আমার কাজে লাগবে না? তখন তুমি আমায় এই পিপুলতলায় বসিয়ে রেখে মাঠে নামতে, এখন তোমায় আমি জমির আলে ছাতা মাথায় বসিয়ে রেখে মাঠে নামবো।
-ঠাট্টা করছিস বাপ? এসব কি তদের শহরের ছাত্তর পড়ানো রে? মাঠের মাটি মাথায় মাখতে পারবি? অনেক পরিশ্রম।
-ঠাট্টা করব কেন দাদু? কলেজে ছাত্রও পড়াবো, মাঠের মাটিও মাখব। না পারলে তুমি তো আছ, দেখিয়ে দেবে।
কৃশকায় শরীরটাকে টানটান করে নাতির মুখের দিকে ভাল করে তাকায় পূর্ণচন্দ্র। এতদিনে তবে কি সে হাত রাখার মত একটা কাঁধ পেল? নেওটা এই ছোট নাতিটাও যখন শহরে পড়তে চলে গেল তখন থেকেই সে সব আশা ছেড়ে দিয়েছিল। বাকিদের প্রতি তার ভরসা কোনদিনই ছিল না।
-চলো দাদু, বিকাশ আবার কোথাও বেরিয়ে যেতে পারে। তাড়াতাড়ি ফিরে চান-খাওয়াও তো করতে হবে নাকি?- নব তাড়া দেয় দাদুকে।
-কিন্তু লবা, তুই যে বললি, তুই পরের হপ্তায় পাইপ এনে দিবি, তুই কি করে পরের হপ্তায় ফের আসবি? অনেকদূর যে তর কাজের জাগা। তবে?
-ভাবছি দাদু কাল-পরশু করে বরং চলেই যাই। ফের শনিবার আসব। এবার থেকে ভাবছি প্রতি শনিবারেই আসব। আর সোমবারে যাবো। যেমন কলেজে পড়ার সময় আসতাম গো। এখনও আসব। পাঁচদিন কলেজে পড়াব, শনি-রবিবার বাড়ি এসে তোমার সাথে থাকব। তুমি আমায় আস্তে আস্তে সব শিখিয়ে দেবে।
রোদ পড়ে চোখের কোণটা চকচক করে ওঠে পূর্ণচন্দ্রের। শিরাওঠা ডানহাতটা তার আদরের নাতির বুকের ওপর রেখে আস্তে আস্তে কয়েকবার হাত বোলায় পূর্ণ। নব হাতটা ধরে ফেলে দাদুর।  
-ঠিক বলছিস তো রে লবু? তুইও আমায় ঠকাবিনি তো বাপ?
-দেখ না দাদু, পারি কিনা। চেষ্টাটা তো করি।
দুজনেই কয়েক মুহূর্ত নীরব। সামনের জমি, যেটা একদিন তাদেরই ছিল সেটার দিকে তাকিয়ে পূর্ণচন্দ্র একসময় বলে ওঠে, ‘চ লবু, তর বন্ধুর সঙ্গে কথা কইবি যে? চ, সে যদি আবার কোথাও চলে যায়।’
-চলো দাদু, বোসো ক্যারিয়ারে, সাবধানে।

সাইকেলটা ঘুরিয়ে নিয়ে, দাদুকে বসিয়ে, সাইকেলের প্যাডেলে চাপ দেয় নবকুমার। চালাতে চালাতে বুঝতে পারে সে, দাদু তার জামাটাকে প্রানপণে দুহাতে চেপে ধরে বসে আছে তার সাইকেলের ক্যারিয়ারে। সামনের বাঁকটা ছেড়ে মিনিট পাঁচেক গেলেই পৌঁছে যাবে তারা বিকাশদের বাড়ি। তাড়াতাড়ি পৌঁছতে হবে তাকে, এমনিতেই অনেক দেরি করে ফেলেছে সে। প্যাডেলে চাপ দিয়ে গতি বাড়ায় নব।

Tuesday 26 August 2014

ফেরা-২


-‘একটু দেরি হয়ে গেল ভাই। আরে শালা হাবিবপুরের তারাপদ জানা, ওই যে রে শনিমন্দিরের পাশে হার্ডওয়্যারের গুদাম।
-‘হ্যাঁ, হ্যাঁ বুঝেছি।’
-‘সাড়ে সতের হাজার টাকার মাল নিয়ে তিন হাজার টাকা ঠেকিয়ে শালা একমাস ধরে ঘোরাচ্ছে। আজকে শালা বহুত ক্যাচাল হয়ে গেছে। সেই সকালে গেছি। এই করতে গিয়েই তো দেরি হয়ে গেল। যাক গে ছাড়, কেমন আছিস বল। শালা চাকরি পেলি খাওয়াবি কবে? মালকড়ি ছাড়। ষ্টেশনের পাশে নতুন হয়েছে একটা একদম আসলি মাল, ফরেন। চল আজ সন্ধ্যেবেলা বেরোই, বাইক তো আছেই।’
- ‘ধুস কি যে বলিস? আমি কি খাই? তুই ত জানিস। এমনি কি খাবি বল না খাওয়াব।’
-‘এখনও খাস না? তুই শালা বদলালি না। থালে আর কি? মুড়ি পেঁয়াজি, অনেকদিন পেঁয়াজি খাওয়া হয়নি কাকিমার হাতে, যাবখন সন্ধ্যেবেলা। কেমন আছেন রে কাকিমা? অনেকদিন যাওয়া হয় না তোদের ওপাশে।’
-মা আছে একইরকম, খাটাখাটনি, দাদুর বয়স হয়েছে, তাঁকেও নজর দিতে হয় আজকাল।
-দাদুর আবার কি হল? মাঠে দেখি তো মাঝে মাঝে।
-হ্যাঁ যায় তো মাঠে রোজই, এই বয়সে, বললে তো শোনে না। মায়ের কথাই যা একটু শোনে টোনেতাই মাকেই দেখতে হয়। তাছাড়া ঘরের কাজ গোয়ালের কাজ সবই তো আছে।
-হ্যাঁ তা যা বলেছিস, দেবুদার বৌটাকে তো বাইরেই বেশী দেখি। সেদিন তো আমাদের পাড়ার মোড়ের গেঞ্জিকলের সামনে দেখি গেঞ্জিকলেরই দুটো চ্যাংড়া ছেলের সাথে দাঁড়িয়ে খুব হাসছে। সাথে বাচ্চাটাও ছিল। তোর বৌদি কি গেঞ্জি কলে কাজ নিয়েছে নাকি রে? মাঝে মাঝে দেখি আমাদের পাড়ায়।
-হ্যাঁ, তাই তো শুনছি এসে। বড়দার তো সেরকম কোন......মানে জানিসই তো।
-তোদের ঘরের বউকে সেজন্যে কাজে যেতে হবে? দেবুদাকে তো দেখি রাধেশ্যাম হাজরার কোঁচা ধরে লটকে আছে সারাক্ষণ। এই তো ভোটের আগে লিফলেট বিলি করছে, মাইক নিয়ে বেরোচ্ছে, দিনরাত পার্টিঅফিসে পড়ে আছে। পঞ্চায়েত অফিসে দশটা জল ছেঁচা মেসিন এসেছিল। শালা ভাবলুম একটা তুলব। দরখাস্ত দিলুম। তা কোথায় কি! কারা যে পেল পাত্তাই পেলুম না। ফাঁকতালে দেবুদা কি করে যেন একটা পেয়ে গেল। দিব্বি ভাড়ায় খাটাচ্ছে।
- তো তুই বড়দাকে বলতে পারতিস।
- ছাড়, তোর দাদার ব্যাপার আলাদা, বাপ পঞ্চায়েত প্রধান, রাধেশ্যাম হাজরার ছাতা মাথায়। আরও নানা ব্যাপার আছে। তোর দাদা পাবে না কি আমি পাব? আমি ওসব দুনম্বরির মধ্যে নেই। হলে হল না হলে না। তাই তো বলছি দেবুদার বউএর গেঞ্জি কলে যাবার দরকার কি? ছেলে ছোকরা গুলোও সুবিধার নয়। তাদের সাথে এখান ওখান যাওয়া, একদিন তো আমি বসন্তপুরের মেলায় দেখলুম।
- আমি মানে কি বলব বল?
-না না তোকে আমি এমনিই বললুম। বাদ দে, তোর খবর বল, কলেজে পড়াচ্ছিস তোর তো ব্যাপার আলাদা রে নবু। বিয়ে ফিয়ে কর এবার একটা। চুটিয়ে মস্তি হোক।  
- আরে না না কই আর। এই তো সবে ঢুকলাম। আর বিয়ে ফিয়ে.........বাদ দে।
-কেন বাদ কেন? প্রেম ট্রেম করছিস না?
-ধুর। আমার দ্বারা ওসব......।
-তা আমি জানি। তোর মুরোদে কুলবে না। নইলে শালা অতসীটার এই দশা হয়?
- মানে?
- মানে জানো না? নেকুচরণ । তুই যদি সত্যকাকাকে গিয়ে একবার বলতিস তবে ওর বিয়েটা আটকাত না? এই ভাবে শ্বশুরবাড়ির লাথি খেয়ে বাচ্চা কোলে বাপেরবাড়ীতে পড়ে থাকত ও? মাথাটা কত পরিস্কার ছিল তুইই তো বলতিস।
- আমি কি করে ওর বিয়ে আটকাব বল? আমার কি অধিকার?
-কেন? ওর বাপ মা তোকে পছন্দ করত না? না কি তোর বাপ মা ওকে পছন্দ করত না? নাকি তুই ওকে পছন্দ করতিস না? সত্যি কথা বল।
-কিন্তু তখন আমি কলেজে পড়ি বিকাশ, আমি কি করে......?
-তখন কেন? এখন করতিস। বলতিস ওর বাপ কে গিয়ে দুচার বছর অপেক্ষা করতে। মেয়েটার দিকে তাকিয়ে দেখেছিস? কি অবস্থা করেছে শ্বশুরবাড়ীর চামারগুলো? শালা স্বামীটা তো এক নম্বরের হারামি। হাবিবপুরের বাজারে তো আমারও কম দিন হল না। প্রথম থেকেই অন্য মেয়ে নিয়ে ঢলাঢলি। বাজারে তো সবাই জানে। সত্যকাকা না জেনেশুনে ফট করে সস্তায় জামাই পাচ্ছি ভেবে বিয়ে দিয়ে দিল। মারধর কম করেছে মেয়েটাকে? শোনা ইস্তক মনে হচ্ছে সব তোর জন্যে।
-কিন্তু বিকাশ আমি তো কখনোও অতসীকে কিছু...... মানে কিছু তো বলিনি কখনও।
-জানি তো, তা বলবে কেন? বললে ত মেয়েটা তাও ভরসা পেত। বিয়েটা ঠেকানোর চেষ্টা অন্ততঃ করত। কিন্তু ও যে তোকে আকারে ইঙ্গিতেও কিছু বলেনি এটা আমায় বিশ্বাস করতে বলিস নি। ব্যাটাছেলে হয়ে তোর মুখে যদি একটা বাক্যিও না সরে ও মেয়েমানুষ কোন ভরসায় বাড়িতে বলে বল? তুমি কলকাতায় পড়ছ, গৌরাঙ্গনগরের কালো অতসীকে ছেড়ে যে কলকাতায় কোনও অপ্সরীকে ধরে ফেলনি সেটা তুমি না বললে সে বুঝবে কি করে?
-এখন আর এসব কথা বলে .........? 
-না রে শালা মেয়েটাকে দেখলে কষ্ট হয়। আমার হাতে থাকলে না প্রথম দিনই ওই সিঁদুর-ফিদুর মুছে ফের ইস্কুলে দিয়ে আসতুম।
দুজনেই কিছুক্ষণ চুপ করে বসে থাকে চাতালে। রোদ বেড়ে উঠেছে। বেশ গরম। শেষে আস্তে করে বলে নব, বাড়ি যাই এবার বিকাশ। তুই সন্ধ্যেবেলা আসবি তো?
-হ্যাঁ যাবো। চ উঠি।
-তোর খবর তো জানাই হল না রে বিকাশ। মোটরসাইকেলটা কবে কিনলি?
-আমার আর কি খবর? হার্ডওয়্যারের অর্ডার সাপ্লাই তো চলছেই। প্রচুর চাপ বুঝলি। এদিক ওদিক মাল তুলতে, টাকা আদায়ে যেতে হয়। হুট বলতেই হাবিবপুর যাওয়া তো আছেই। তাই কিনে ফেললুম। পুরো পেমেন্ট হয়নি এখনোও, দশ হাজার টাকা বাকি আছে। আজই ভেবেছিলুম, তারাপদ জানা টাকাটা দিলে ফুল পেমেন্ট করে দোবসে শালা হল না। যাক ঠিক আছে। হয়ে যাবে। ষ্টেশন-হাবিবপুর রুটে একটা বাস নামাব ভাবছি বুঝলি। হেব্বি লাভ। বছর পাঁচেকে উঠে আসবে টাকা। দেখি কথাবার্তা চলছে। পারমিটের একটু ঘোঁটালা আছে ওই শালা রাধেশ্যাম হাজরা। বড্ড বেশি দর হাঁকছে। বাবা একবার বলেছিল দেবুদাকে বলতে ।
-তা বললি না কেন?
-দাঁড়া না কদিন দেখি। ওই লোকের পা চাটতে ভাল্লাগেনা। না খেতে পেয়ে মরছি নাকি?
-তা বিয়ে করবি না? রোজকারপাতি তো মন্দ হচ্ছে বলে মনে হচ্ছে না।
-না ভাই, ওই নাটকে আমি নেই।
- নাটক কেন?
- নাটক নয় তো কি? ঘরে দিন দুবেলা কাক চিল বসতে পারছে না। দুই বউ এর ঝগড়ায়। শালা দুই বউদি তো নয় যেন শ্মশানের দুটো পাগলা শেয়াল। দিনরাত কিছু না কিছু নিয়ে খামচাখামচি। আমার দাদা দুটোও তেমন। শালা দুই ডাকিনী-যোগিনীর জন্যে নিজের বাপ-মায়ের গায়ে হাত তুলতে শুধু বাকি রেখেছে। আবার বিয়ে! পাগল?
- কি বলছিস?
- ঠিকই বলছি। সারাদিন নিজের ধান্দায় ঘুরে বেড়াই। নানা ধান্দাবাজ লোক নিয়ে কারবার। তারপর রাতে ফিরেও যদি চুলোচুলি করতে হয়......। তার চেয়ে নিজের কাজ কারবার বাড়াব। পয়সাকড়ি জমিয়ে বাড়িটাকে একটু ভদ্রস্থ করতে হবে বুঝলি। বাপ মা টাকে একটু ভাল ভাবে রাখতে ইচ্ছে হয় এই আর কি। বড়ভাই দুটো তো শালা এক-একটা যন্তর। কিছুই আশা করিনা ওদের থেকে। মাল খাচ্ছে, বউ পেটাচ্ছে, রোজকারের তো বেশিটাই চলে যাচ্ছে মনসাতলার চোলাই ঠেকে। উপরন্তু এক একটার দুটো তিনটে করে প্রোডাক্ট। সারাদিন কাঁইকিচির। শালা ঘেন্না ধরে গেল। ভাল আছিস তুই কলকাতায়। মাঝে মাঝে মনে হয় চলে যাই। হাবিবপুরের বাজারে মজুমদারদের নীচতলায় একটা গ্যারাজ ঘর ভাড়া নিয়েছি জানিস। কারবারে লোকজনের সাথে বসে কথা বলার তো একটা জায়গা চাই কি না বল?
- আচ্ছা, তোর অফিসঘর বল।
-তা বলতে পারিস। তা মাঝে মধ্যে ভাবি মজুমদারদের বলে নীচের একটা ঘরও ভাড়ায় নিয়ে নি। ওখানেই থেকে যাবো। রোজ-রোজ আর এই কেত্তন ভাল্লাগেনা। মা-বাবা-বাচ্চা ভাইপো ভাইঝিগুলোর জন্য আবার পিছিয়ে আসি। শালার সংসার হয়েছে।
-তোর মনে আছে বিকাশ, ক্লাস এইটে তুই আর আমি ঠিক করেছিলাম উত্তরমেরুপ্রভা দেখতে যাব বড় হয়ে। পয়সা জমাতেও শুরু করেছিলাম, মনে আছে?
- মনে আছে কিরে? আমি তো এখনও পয়সা জমাচ্ছি। এত নতুন নতুন কারবার, এত খাটছি কি এমনি এমনি নাকি? পঁয়তাল্লিশ-পঞ্চাশ বছর পর্যন্ত মোষের মত খাটবো, টাকাপয়সা জমাব। বাপ মা যদ্দিন আছে আছে, তারপর পয়সাকড়ি নিয়ে ঝোলা কাঁধে বেরিয়ে পড়ব। উত্তরমেরু না হোক উত্তরপ্রদেশটাতো পৌঁছাতে পারবনা কি বল? হা হা করে গলা খুলে হাসতে থাকে দুজনে।
দুই বন্ধু এবার প্যান্টের ধুলো ঝেড়ে উঠে পড়ে। বাইকে উঠে স্টার্ট দেয় বিকাশ। বলে, ‘এখন চলি রে নবু। সন্ধ্যেবেলা যাচ্ছি, কাকিমাকে বলিস পেঁয়াজি খাব গিয়ে। তুই তো আবার সাইকেল এনেছিস। নাহলে তোকে দিয়ে আসা যেতো।’
-আরে না না আমি সেই সকাল থেকে এদিক ওদিক ঘুরছি। তাই সাইকেলটা নিয়ে বেরিয়েছি। তুই আয়। সন্ধ্যেয় আসিস।
-হ্যাঁ যাবো। একটু পাত্রপাড়ায় যেতে হবে বিকেলে। একটু দেরি হতে পারে, এই ধর সাতটা-সাড়ে সাতটা।
- হ্যাঁ হ্যাঁ তুই আয় না। আমি তো বাড়িতেই থাকব।

বিকাশ চলে যাবার পর একবার আকাশের দিকে তাকায় নব। চড়া রোদ। বেশ ঘাম হচ্ছে। এবার বাড়ি না গেলেই নয়। সামনে ধানকল পেরিয়ে মাঠের রাস্তা, তারপরেরই পিপুলতলার মাচানের পাশ দিয়ে তাদের পাড়ার রাস্তা। তাড়া নেই। সাইকেলে উঠে পড়ে প্যাডেলে চাপ দেয় নব। মাঠের রাস্তায় পড়তেই দূরে দেখল আদুর গায়ে হেঁটো ধুতি পরে কেউ একজন খুব ধীরগতিতে হেঁটে চলেছে তার রাস্তাতেই। চোখের উপর হাত দিয়ে রোদ আড়াল করে বোঝার চেষ্টা করল নব। বুড়ো মানুষটাকে বোঝা যাচ্ছেনা এত দূর থেকে। এই রাস্তায় যখন তখন তাদের পাড়ারই কেউ হবে। এই রোদে বুড়োমানুষটা হেঁটে যাচ্ছে, সাইকেলের ক্যারিয়ারে তুলে নেবে সে গতি বাড়ালো নব। 

শেষাংশ ফেরা-৩ ......

Sunday 24 August 2014

ফেরা -১

বুড়োবটতলার চাতালে বসে আনমনে ডান হাত দিয়ে বাঁ হাতের কব্জির বোতামটা ঘোরাচ্ছিল নবকুমার। একটু খিদে খিদে পাচ্ছে। এবার বাড়ি যেতে হবে। সেই কোন সকালে ‘ধুত্তেরি’ বলে বেরিয়ে এসেছে। তারপর ঘোষপুকুরের পাড়ে বসেছিল ঘণ্টাখানেক। নানান এদিক ওদিকের চিন্তা কাজ করে চলেছিল তার মাথার মধ্যে। চমক ভাঙল অতসীর ডাকে। ‘কি গো নবদা, এখানে পুকুরপাড়ে ভূতের মত বসে আছো কেন?’ চমকে উঠে নব বলেছিল ‘ওহ! তুই এখানে?’ হাতের কাপড়চোপড় সামলে গায়ের আঁচলটা ডানদিকে পেঁচিয়ে নিয়ে অতসী বলেছিল ‘আমিতো রোজই এমনসময় এখানে চান করতে আসি। তুমি এই বর্ষাকালের বনবাদাড়ে বসে কি করছ বল দেখি। কোথায় কি আছে তার ঠিক নেই এই বর্ষায়।’ নব কিছু একটা মনগড়া এদিক ওদিক উত্তর দিয়ে কোনোমতে জিজ্ঞ্যাসা করেছিল ‘কেমন আছিস?’ কেমন যেন আলতো হেসে উত্তর দিয়েছিল অতসী ‘যেমন দেখছ।’ সিঁথির আবছা হয়ে আসা সিঁদুরের দাগ, চোখের কোলে কালি, সবুজ রঙের জংলাছাপ শাড়ীতে কেমন যেন জট পাকিয়ে গেছে অতসীটা। কিন্তু তাও অতসীর চোখের দিকে সরাসরি তাকিয়ে কথা বলতে পারেনি নব। কোনদিনই স্বছন্দে কথাবলা হয়ে ওঠেনি নবর অতসীর সঙ্গেসেই যখন সে বসন্তপুরের মাঠ পেরিয়ে হাইস্কুলে যেত আর অতসী ঝুঁটি নাড়িয়ে তার সাথে তিলের খাজার ভাগ নিয়ে ঝগড়া করত তখনও সে পারত না ওর সাথে কথায়। আবার কলেজ থেকে সপ্তাহান্তে বাড়ি ফিরে সত্যকাকার কথায় যখন সে ক্লাস নাইনের অতসীকে পড়াতে যেত তখনও তার মুখের দিকে তাকিয়ে স্বছন্দে কথা বলতে পারত না সে। সে নিয়ে কম টিটকিরি করেনি ছটফটে অতসী। বছর পাঁচেক আগেও যখন সে বাড়ি আসতে বড়বৌদি বলল, ‘তোমার ছাত্রীর তো পাত্তর ঠিক হইছে গো, আসচে মাঘে, বড়োলোক শউরঘর, হাবিবপুর বাজারে দোকান, চালকল।’ অবাক হয়ে নব প্রশ্ন করেছিল ‘সেকি? ও পরীক্ষা দেবে না? ইলেভেনে এত ভাল করে পাশ করল, আর কমাস বাদেই তো ফাইনাল পরীক্ষা!’ চোখ ঘুরিয়ে বড়বৌদি বলেছিল ‘আরে রাকো তোমার ফাইল্যান পরীক্কাওকি তোমার মতন কলিকেতায় থেকে পাশের পর পাশ দিবে নাকি? মেয়েছেলে, একটা পাশ দিছে আবার কি? ছেলের বাপ এসে পচন্দ করে গেছে, ছেলের বয়স একটু বেশি, তা হোক, এত বড়লোক।’ আস্তে করে নব জিজ্ঞ্যাসা করেছিল ‘অতসী রাজি? ও পরীক্ষা দেবে না বলেছে?’ ‘আরে, সে ছুঁড়ি তো কেঁদে-কেটে একশা, কাকী এসে বলতে তো আমি গেলুম। তা কে শোনে কার কতাবল্লুম ওরে অতী, মেয়েছেলে, রান্নাবান্না করে সোয়ামী- পুত্তুরকে খাওয়াবি, শউর-শাউরির যন্নআত্তি করবি, আর কি? কত্ত বড়লোক তোকে যেচে পছন্দ করেচে বল। এত কমে তোর বাপ তোকে পার কত্তে পারবে? একটা মোটরসাইকেল, চল্লিশ হাজার আর যা গয়নাগাঁটি, সে ধর না কেন তোর নিজেরই রইল। এর চেয়ে কমে হয় তুমিই বলনা? ওই ত ভুশুণ্ডি রঙ গায়ের। তা মেয়ে শুনলে তো। শুধু বলে পরীক্কাটা হয়ে যাক অন্ততঃ। আরে বারো কেলাসের সারটিফিট নিয়ে কি তুই ধুয়ে খাবি রে হতভাগী।’ সেবারও মনে আছে নবর ফেরার সময় সত্যকাকাকে প্রনাম করার জন্যও অতসীদের বাড়ি যাওয়া হয়নি। পাছে অতসীর সাথে দেখা হয়ে যায়। তারপর তো এই দেখা । প্রায় বছর পাঁচেক মাঝে। নব এর মধ্যে কলেজ-ইউনিভার্সিটি পেরিয়ে গেছে। নিজেই সে এখন একটা কলেজে পড়াচ্ছে আজ সাত- আট মাস হল। চাকরিটা পেয়েই সে এসেছিল বাড়িতে একবার দুদিনের জন্যতারপর তো এই প্রায় মাস পাঁচেক বাদে বাড়ি এসেছে সে। ইচ্ছে ছিল সপ্তাহ দুয়েক থাকার। সেইমত ছুটিছাটারও ব্যবস্থা করে এসেছে সে। অনেকদিন পর বাড়ি, ছোটবেলাকার মাঠঘাট বড় টানছিল তাকে। কিন্তু দিন চারেক যেতে না যেতেই আর ভাল লাগছে না নবর। বসন্তপুর হাইস্কুলের প্রণববাবু একবার পড়াতে পড়াতে তাকে বলেছিলেন শিক্ষা দান করার জিনিস জানো নবকুমার। যা জানো পারলে অন্ততঃ আর একজনকেও দিয়ে যেয়ো। শুধু বই পড়া বিদ্যে নয়, জীবনের শিক্ষা বুঝলে? তখন সেই বয়সে বিশেষ কিছুই বোঝেনি নব। এখন কলেজে ছাত্রপড়াতে গিয়ে কিছুটা বোধহয় বুঝতে পারে সে সেদিন প্রণববাবু কি বলতে চাইছিলেন তাকে। কলকাতার কলেজের ছাত্রছাত্রীদের বা অন্যান্য মাষ্টারমশাইদের মাঝে নিজেকে কেমন যেন বেমানান মনে হয় নবর। শহরের ফ্যাশান, কথাবার্তার চালিয়াতি, অর্থের প্রদর্শনী সবেতেই সে আজও সেই কোন অজগাঁয়ের ছেলে হয়ে রয়ে গেল। এইসব ছাত্রছাত্রীদের সে কি পড়াবে, কি ভাবেই বা পড়াবে বুঝে উঠতে পারে না সে। সে সাহিত্যের ছাত্র ছিল। আজও বাংলা সাহিত্যের রূপ-লালিত্যর সঙ্গে পরিচয় করাতে চায় তার ছাত্র ছাত্রীদের, সাহিত্যের প্রতি ভালবাসা তৈরি করাতে চায়কিন্তু এই সাত মাসে সে পুরোপুরি ব্যর্থই বলা যায়। কেউ চায় না জানতে নিজের ভাষাকে, তার ইতিহাসকে। কারণ এপথে সহজে অনেক টাকা রোজকার করা যায় না যে। ছেলেমেয়েরা কলেজে আসে, নতুন নতুন নানান ফ্যাশানের জামাকাপড় পরে, নামি দামি জায়গায় কফি খায়, বিদেশি সিনেমা দেখে আর যে দুচার জনকে সে বইপত্তর পড়তে দেখেছে তার সবই প্রায় বিদেশি উপন্যাস। মুখচোরা লাজুক নবকুমার এই শহুরে মিশ্র সংস্কৃতিতে ঠিক মানিয়ে নিতে পারেনি এখনও। হয়ত সময়ে সবই সয়ে যাবে। কে জানে? ভেবেছিল দুদিন বাড়িতে এসে জিরিয়ে নেবে। কিন্তু পৃথিবী বদলাচ্ছে, আর তাদের এই গৌরাঙ্গনগর বদলাবে না তাতো হয়না। হলেই বা ধাদ্দেড়ে গোবিন্দপুর, কলকাতা থেকে ট্রেনে আসতে অন্ততঃ ঘণ্টাতিনেক সময় লাগে, ট্রেন থেকে নেমে বাস, তারপর আবার ভ্যান। এখানেও সুস্থ ভাবে বাঁচতে দেবেনা এরা একটা বাচ্চাকেও। ঘুম থেকে উঠেই আজ জোলা পাড়ায় শীতলা পূজোয় তারস্বরে মাইক বাজতে শুনল সে, ‘মুন্নি বদনাম হুয়ি’, আর তার সাথে বড়দার সাত বছরের পুঁচকে মেয়ে টুকি সাত সকালে খামারে দাঁড়িয়ে কি বিশ্রী ভঙ্গিতে নাচ সেই দেখে হেসে ঢলে পড়ছিল বড়বৌদি আর কুসমী। কুসমীটাকে জন্মাতে দেখল নব। অথচ কি অশ্লীল বাচালতা চোখেমুখে এরই মধ্যে। অতসীরই তো বোন, কিন্তু কি আকাশপাতাল তফাত দুজনের। টুকির জন্য সে এবার আসার সময় অবন ঠাকুরের রাজকাহিনী কিনে এনেছে। সে এসে থেকে অনেক ভাবে চেষ্টা করেছে রাজকাহিনীর গল্প বলে মেয়েটার খানিকটা বইপড়ার নেশা ধরানোর। কিন্তু কদিনে বেশ বুঝে গেছে রাজকাহিনী আপাদমস্তক হেরে ভূত হয়ে গেছে ‘মুন্নি বদনাম হুয়ি’-র কাছে। টুকি, কুসমী এদের কাউকেই বোধহয় আর বাঁচানো যাবে না। প্রণববাবুর কথাটা ইদানীং বড় খোঁচাচ্ছে তাকে। সত্যি কি তার বিদ্যেটুকু কাউকে দিয়ে যেতে পারবে? কলকাতার ছাত্রছাত্রীরা বা কুসমী বা টুকি বা এদের মত কেউ কি সত্যিই চাইবে তার কাছে কিছু জানতে? সে কি পারবে তাদের মনে জানার ইচ্ছেটা জাগাতে? পেরেছিল একজনের মধ্যে কিন্তু সে তো আজ তার আবছা সিঁদুর আর বছর তিনেকের রুগ্ন বাচ্চা নিয়ে বাপের বাড়িতে ফিরে আসার অপরাধে সকলের করুনা আর লাঞ্ছনার পাত্রী।


বোতামটা ঘোরাতে ঘোরাতে বুড়োবটতলায় বসে এইসবই ভাবছিল নবকুমার। বোতামটা আলগা হয়ে খুলে এল হাতে। খানিকক্ষণ বোতামটার দিকে তাকিয়ে একটা ছোট নিঃশ্বাস ফেলে ঘড়ি দেখল নব। নাহ আর অপেক্ষা করবেনা সে অনেক বেলা হয়েছে, এবার বাড়ি না গেলেই নয়। সে এসেছে বলে বাবা আজ মিটিং এ যায়নি। টুকটাক কাজ করছে ঘরেই আর অপেক্ষা করছে একসাথে দুপুরে খাবে বলে। মাও রান্নাবান্না করেছে একাহাতেইপকেটে বোতামটা রেখে উঠে পড়ল নব। সাইকেলটা ঘুরিয়ে নিয়ে সিটে উঠতে গিয়ে দেখল দূরে মাঠের রাস্তায় একটা মোটর সাইকেল আসছে। বিকাশ নাকি? চোখ কুঁচকে ওইদিকে তাকিয়ে একটু অপেক্ষা করল নব। বিকাশই মনে হচ্ছে। বিকাশই কাল তাকে বলেছিল আজ এখানে অপেক্ষা করার জন্য। বিকাশের জন্য সে স্কুলে যাবার সময়ও এখানেই অপেক্ষা করত। তখন অবশ্য দুজনেই পায়ে হেঁটে, হাফপ্যান্ট আর একহাঁটু ধুলো নিয়ে প্রায় আধঘণ্টা হেঁটে বসন্তপুর হাইস্কুলে যেতো। বিকাশ এসে প্যাচ করে একমুখ গুটখার পিক ফেলে ভটভটি বন্ধ করে দাঁড়াল। একগাল হেসে বলল ‘কিরে নবু কদ্দিন বাদে দেখা। কেমন আছিস বল।’ নব বলল, ‘তোর দেরি দেখে তো আমি চলেই যাচ্ছিলাম।’ 


Friday 22 August 2014

স্লিপারে ফেরা


ছোট্ট ছোট্ট টিলা। সবুজে মোড়া। বর্ষার জলে নেয়ে ধুয়ে চকচকে একেবারে। মাঝেমধ্যে দুচারটে খাড়া ন্যাড়া পাহাড়, তার টং-এর ওপর আবার পুঁচকে পানা মন্দির। কি করেই বা ওই টং এ উঠে কেই বা যে ওই মন্দির বানিয়েছিল কে জানে। আর ছিল সাঁ সাঁ করে পিছনে ছুটে চলা নরম সবুজ প্রান্তর। কোথাওবা ঢেউ খেলানো, কোথাওবা একদিকে ঢালু। মাঝে মাঝে এমনি সমতল যেন মনে হয় দুরমুশ পেটা করে, দামী ঘাসের বীজ লাগিয়ে, সেই ঘাস সমান করে ছেঁটে তৈরী করা বড়লোক বাড়ির লন বুঝি। মাঝে মাঝে ছায়া দেবার জন্য দুএকটি বড় গাছ। একদম পিকচার পারফেক্ট। ঠিক যেন ছোটবেলার আঁকার খাতা থেকে উঠে আসা একটি দৃশ্যচিত্র। বর্ষা তার দুহাত উজাড় করে সাজিয়েছে রাঢ় বাংলা আর সংলগ্ন ঝাড়খন্ডকে। কুল্লে সাত বা আটটি ছোট ছোট টিলা আর তার চারপাশের উঁচু নিচু মাঠ ঘাট পুরোটাই সবুজ-সবুজ আর সবুজ। কি অপূর্ব লাগলো যে পারশনাথ স্টেশন পার হবার পরে এই দৃশ্যটা। কেবলমাত্র এটুকু দৃশ্য আরো একবার দেখার জন্যই বর্ষাকালে পারশনাথ আসতে রাজি আমি। মনে দাগ কেটে গেল ছোট্ট খুদাই নদী। হয়ত বর্ষা ব্যতীত এ নদীর কোনো অস্তিত্বই থাকে না, কিন্তু বর্ষায় খুদে খুদাই নদীর রূপ আর ধরে না। মাঝে মাঝে মসৃণ পাথর পেরিয়ে লাফিয়ে ঝাঁপিয়ে চলেছে।


এপথে আমি আগেও এসেছি। কিন্তু বছরের এইসময়ে নয়। আর পথ পার হয়েছি সন্ধ্যে নামার পরে। ভরা বর্ষায় দিনের বেলা এ রাস্তায় আসা আমার প্রথম। মনে হলো ভাগ্যিস এসেছিলাম, ভাগ্যিস এই ট্রেনে টিকিট কেটেছিলাম। বাড়ি থেকে ফিরে আসার মনখারাপ রাস্তাতেই উধাও। তার ওপরে আবার অনেক দিন পর স্লিপারে ফেরা। হাজার কিলোমিটার রাস্তা, হু হু করে ছুটে চলা ট্রেন, দুপাশে ছুটে চলা মন মাতানো ল্যান্ডস্কেপ, মাঝে মাঝে ঝিরঝিরে বৃষ্টি। মুখের ওপর পাগলা হওয়ার ঝাপটা। এই হওয়াটাই ট্রেনজার্নির মজা যেটা এসি তে অমিল। অনেকদিন পর দুর্গাপুর স্টেশন থেকে ওঠা হকারের কাছ থেকে মৌরি লজেন্স কিনে খেলাম। মনে হচ্ছিল ছোট্ট হয়ে গেছি। ভেবেছি চান্স পেলে আবার স্লিপারের টিকিট কাটব। বর্ষাকাল হলে তো নিশ্চয়ই। সূর্যাস্তে লাল হয়ে আসা চারদিক, ট্রেন থেকে দেখা পরেশনাথ পাহাড়, পাহাড়ের টং এ ছোট্ট মন্দির, টানেল, সবুজ মাঠ আর হু হু বাতাস বয়সটা কমিয়ে দিয়েছে প্রায় দশ বছর। শুধু মনে হচ্ছে আবার কবে?



Thursday 14 August 2014

বাড়ির ভুঁড়ি-ভোজন

আপাতত দিনদুবেলা প্রচণ্ড ভালমন্দ খাওয়া দাওয়া চলছে। খাদ্যাখাদ্য থেকে মুখতোলারই সময় পাচ্ছিনা তো আর কি গল্প করব আপনাদের সাথে। প্রচুর গপ্প করার মত বিষয় জমে আছে সেগুলো সব পরে রসিয়ে বলবখন। আপাতত কি কি খেলাম তার একটা বিশদ ফিরিস্তি দিয়ে ফেলি কেমন? হিংসে করবেন না যেন । আপনারাও যখন বাড়ি যাবেন তখন আপনারাও আমার মত ভাল মন্দ খেয়ে জানাবেন। আমি তখন ‘জানব আর জ্বলব, লুচির মত ফুলব’। আপাতত বলি অ্যাঁ?

আমরা বেরিয়েছি শুক্রবার সেদিন থেকেই শুরু করছি কেমন।

শুক্রবারঃ দুপুরে কাবাব এক্সপ্রেসসের মালাই চিকেন কাবাব, তান্দুরি চিকেন আর প্লেন নান । আর সঙ্গে ছিল কোক। এখানে দুই হাঁদারাম একটা কীর্তি করেছি । কি বুঝে দু দুখানা বড় কোক order করে ফেলেছি । তারা তো ৬৫০ml এর দুখানা ঢাউস কোকের গ্লাস ধরিয়ে দিয়ে গেল। আর আমরা ভাবতে বসলাম যে এবার কি হবে এতটা কোক । ব্যাগ ব্যাগেজ নিয়ে হাতে কোকের গ্লাস নিয়ে তো ছোটাও যাবে না সুতরাং চলো বোতলে ভরো। ছাড়ব না। বোতলের জল একটা খালি কোকের গ্লাসে ঢেলে বাকি খানিকটা জলের ওপরেই কোক ঢালা হল। ফলে যেটা দাঁড়ালো সেটা হল একটা diluted হলদেটে বিকট জোলো তরল। পিনাকীকে বললাম, “তুই এটা খাবি?” বলল, “ঠিক আছে ঠাণ্ডা তো জিনিসটা, একটু করে খাব”। বললাম, “লোকে ভাববে মেট্রোতে বসে মদ খাচ্ছিস”। বলল, “বেশ তো তখন তাদেরকেও একটু offer করব। একবার খেলে আর বলবে না”। বুঝলাম ওই অখাদ্য পানীয়টা সঙ্গে যাবেই। দেখুন বিষয়টার ছবি তুলে রেখেছি।


আর বিকেল থেকে তো রাজধানীর গতের খাবার । সেসব আর কি নতুন করে বলব। খাওয়া শুরু হল তো শনিবার দুপুরে বাড়ি পৌঁছানোর পর থেকে। গুছিয়ে বলা যাক। কি বলেন?

শনিবারঃ দুপুরে তিন পিস ইলিশ মাছ। ভাজা আর সর্ষেবাটার ঝাল। ডাল, দু তিনটে তরকারি সহযোগে একপেট ভাত। রাতে তো কুমড়োর স্যুপ আর দুর্দান্ত একখানা চিকেন, ফ্রেঞ্চ ফ্রাই এর তেহাই সমেত।

রবিবারঃ দুপুরে ফের তিন পিস ইলিশ, সঙ্গে জাম্বো সাইজের খয়রা মাছ আর ভেজিটেবিল বেকড, ইলিশের মাথা দিয়ে মোচার ঘণ্ট, শেষপাতে আম। খেয়ে মনে হচ্ছিলো এইবার নিশ্চয়ই ফেটে যাবে পেটটা। সৌভাগ্যবশতঃ ফাটে যে নি সেতো দেখতেই পাচ্ছেন ।

সন্ধ্যায় তালের ফুলুরি। তাল আমার বড় ভাল লাগে। বেছে বেছে তাই এই সময়টায় বাড়ি এসেছি। আমার বাড়িতে অতীব প্রাচীন এবং অতীব মিষ্টি স্বাদের একটা তালগাছ আছে নাম ‘ঘোষাল গাছ’, চ্যাটার্জী পাড়ায় কেন ঘোষাল গাছ সে ইতিহাস আমি জানি না। সে যাই হোক প্রচুর তাল রয়েছে। আমি নিশ্চিন্তে আছি আয়েশ করে কয়েকদিন তালের ভুষ্টিনাশ করা যাবে। তাল নিয়ে পিনাকীর হাজারও ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ এক কান দিয়ে ঢুকিয়ে আর এক কান দিয়ে বার করে দিচ্ছি তুশ্চু করে।

রাতে রুটি-দুধ এর সাথে মামার গাছের অ্যায়সা বড় মর্তমান কলা, পণ্ডিতের দোকানের special রাজভোগ, আর লাইন দিয়ে হরেক রকম তরকারি।

সোমবারঃ  সকালে তো গেলাম কলকাতা ইউনিভার্সিটি । সেখানে তো আর এক কাণ্ড। সে গল্পও তোলা রইল গুছিয়ে বলতে হবে । সে চক্করে দুপুরে বিশেষ কিছু ভাল-মন্দ জোটেনি । চিন্তা করবেন না রাতে ফুল লোড নিয়ে পুষিয়ে নিয়েছি। রাতে খেলাম কি শুনুন- ভাত, চিংড়ি মাছ আলু পোস্ত, আবার ইলিশ দু পিস, ডাল, ডবল-কুসুমের ডিম সেদ্ধ, পুঁটীমাছের ঝাল।

মঙ্গলবারঃ সকালে আবার ডবল-কুসুমের ডিম দিয়ে পোচ আর টোস্ট সৌজন্যে আমাদের মাস্টার শেফ শ্রীমান পিনাকীচরন। দুপুরে ইলিশ মাছের ঝাল, পুঁটী মাছের ঝাল, গোবদা গোবদা চিংড়ীর মালাইকারী, চিংড়ীর পোস্ত, ডাল, চাটনি।

রাতে পেটকে রেস্ট দিতে দুধ-পাঁউরুটি-কলা-রাজভোগ

বুধবারঃ এদিন আবার কলকাতা ইউনিভার্সিটি। সকালে দুধ-ভাত, আলুসেদ্ধ, ধ্যাবড়া একটা পোস্তর বড়া, আর মেদিনীপুর জেলার special গয়নাবড়ি ভাজা দিয়ে গাঁতিয়ে খেয়ে ইউনিভার্সিটি গেলাম। বিকেলে ফিরে এসে একবাটি বড়কাঁকড়ার ঝাল এমনি এমনি খেয়ে ফেললাম। রাতে চিকেন রোল।

বৃহস্পতিবারঃ আজ দুপুরে ভাতের সাথে থালা আলো করতে ছিল ডাল, পুঁইশাক-কুমড়ো-ইলিশ মাছের মাথা দিয়ে চচ্চড়ি- উফফ অমৃত অমৃত! ভাবলেই ঢোঁক গিলতে হচ্ছে। আর ছিল চিংড়ী মাছ- বেগুন-আলু ইত্যাদি ইত্যাদি দিয়ে ফাটাফাটি একটা তরকারী । আর ইলিশ মাছ। আমার বাবা সম্ভবতঃ ঠিক করেছেন আমায় এই সাত দিনে সারা বছরের ইলিশ সাধ মিটিয়ে খাইয়ে দেবেন। আর আমিও উচ্চবাচ্য না করে দিব্য দিন-দুবেলা পেটপুরে সাঁটিয়ে চলেছি। পেটের ভেতরের যন্ত্রপাতি আর অ্যাডিপোসাইট কোষের বাড়-বৃদ্ধি সম্পর্কে বিন্দু মাত্র তোয়াক্কা না করে।

রাতে মা তাল দিয়ে পুলি পিঠে বানাচ্ছে দেখে নিয়েছি। অতএব রাতে আমার প্রিয় আরও একটি বিষয় হতে চলেছে। এমতাবস্থায় আর বেশি কিছু লিখছি না।

এই হল এখনও পর্যন্ত আমার ‘ভুঁড়ি-ভোজনের’ ইতিকথা। আর মাঝেমধ্যেই যে সব পান্তুয়া-ঝুরিভাজা-ডাঁশাপেয়ারা-নারকেল নাড়ু ইত্যাদি প্রভৃতি চলছে সেসব তো বললামই না। এসব সকাল-দুপুর-সন্ধ্যে-রাত্রি অঢেল পরিমাণে খেয়েদেয়ে যদি সত্যি সত্যি পেট ফেটে মরে না যাই তবে আবার গপ্প হবে। আপাতত টা-টা। পিঠে খেতে হবে।

Friday 8 August 2014

বাড়ি যাচ্ছি

আপাতত আজ বাড়ি যাচ্ছি। এক সপ্তাহের জন্য। গত তিন চার দিন ধরে প্রচন্ড কাজকর্ম করছি। মানে চক্ষুলজ্জা বলেও তো একটা ব্যাপার থাকে নাকি বলুন? এই যে সাত-সাতটা দিন আমি ল্যাবে বসে প্রচন্ড ভালো ভালো আবিস্কারের চেষ্টা মানে ল্যাপটপে মুখ ডুবিয়ে নানান হাবিজাবি সাইটে ঘোরাঘুরি করে টাইমপাস করব না। তার একটা ব্যাকআপ তো থাকা উচিত নাকি? নইলে লোকে কি বলবে? তার পর কাল রাতে যথারীতি লাস্ট মোমেন্টে ব্যাগ গোছাতে গিয়ে যা তা কান্ড। পঁচিশবার জিনষপত্র ঢোকাচ্ছি-বার করছি-এই ব্যাগ নয় ওই ব্যাগ এই সব করতে গিয়ে ইচ্ছেখাতা তো রাগ করে খাটের তলায় লুকিয়েছে। কি আর করা যাবে? বাড়ি গিয়ে নাহয় ভালো করে ওর রাগ ভাঙানো যাবে।

আমি তবে এটা ভেবেই উল্লসিত যে আবার ট্রেন জার্নি মানে আবার নানান ইন্টারেষ্টিং লোকজন মানে আবাব্র আমার নতুন রামবাবু আর শ্যামবাবুর সন্ধান পাবার চান্স। সন্ধান পেলে মুখিয়ে থাকব আপনাদেরকে গল্প করার জন্য। কথা দিচ্ছি। আর বাড়ি গিয়ে ভালো মন্দ খাবার দাবার যা খাব সে সবেরই গল্প বলে আপনাদের হিংসের উদ্রেক করাব সেটাও কথা দিচ্ছি। আর একটা খবর যে কাল থেকে আমাদের বাড়ির পাশে মেলা বসছে। না না আমি যাচ্ছি সেই আনন্দে নয়। এমনিই বাত্সরিক গ্রামীন মেলা। মেলায় এন্তার আবোলতাবোল খাব, পুঁচকে পানা নানান হাবিজাবি জিনিস কিনব।আপনাদের শুধু ছবি দেখাতে পারি। শেয়ার পেতে গেলে আসতে হবে আমাদের বাড়ি। 

আপাতত ল্যাবের আরো কিছু চমকপ্রদ আবিষ্কারের কাজ বাকি আছে। সামনের এক দুই ঘন্টার মধ্যে শেষ করতে হবে। ব্যাস, তাহলেই ছুটি। একসপ্তাহের জন্য দোকান গুটিয়ে টাটা। এখান থেকে সোজা নিউ দিল্লি স্টেশন, সেখান থেকে রাজধানীর রঙ্গমঞ্চে করে বাড়ি। গিয়েই ইলিশ মাছ অপেক্ষা করছে। খবর পেয়ে গেছি। অতএব, আপাতত টাটা। কয়েকদিনের মধ্যেই আবার আসব আপনাদের সাথে বক বক করতে। ততদিন বন্ধু ভালো থেকো। টা টা।        

Tuesday 5 August 2014

5th August, 1965

5th August দিনটা বিশেষ বিখ্যাত নয় হয়ত। আর পাঁচটা সাধারণ দিনের মতই ক্যালেন্ডারের একটা তারিখ। কিন্তু আজ থেকে প্রায় অর্ধ শতাব্দী আগে এরকমই এক 5th August এই সূচনা হয়েছিল এমন এক পরিস্থিতির যার ফলে হয়ত আমাদের মত আমজনতার গায়ে বিশেষ কোনো আঁচ না লাগলেও ভারতীয় সৈন্য বিভাগে রীতিমত হুলুস্হুল পড়ে গিয়েছিল।

১৯৬৫ সালের ৫ই অগাস্ট সাতসকালে হঠাতই তানমার্গ পুলিশচৌকিতে ছুটতে ছুটতে এসে হাজির গুলমার্গের দক্ষিন-পশ্চিমের একটি ছোট্ট গ্রাম 'দাড়াকাসসী'-র পুঁচকে গুর্জর ছোঁড়া 'মহম্মদ দীন'।....... "আরে আরে করে কি করে কি, বলা নেই কওয়া নেই সোজা পুলিশ চৌকিতে? ব্যাটার ভয়ডর বলে কিছু নেই নাকি? এই, কি চাই রে তোর? সাতসকালে এখানে এসে হল্লা করছিস কেন?"........... এইসব যখন প্রশ্নবান চলছে মহম্মদ দীন তো হাঁপাতে হাঁপাতে বলে - "হ্যাঁ হ্যাঁ বলছি দাঁড়ান....... দুটো লোক....ওই হোথায়.....পেল্লায় চেহারা.....হাতে বন্দুকও আছে.....আমায় অনেক টাকা দিল......মিলিটারি ক্যাম্পটা কোথায়, কত দূর, কত লোক আছে সেখানে.......এসব অনেক কিছু জিজ্ঞাসা করছিল।"

--"আরে ধুর ছোঁড়া দাঁড়া দাঁড়া, তড়বড় করে বলেই যাচ্ছে। ব্যাপারটা বুঝতে দে ভালো করে। কে লোক? তোকে তারা কোথায় পেল? কেমন দেখতে তাদের? কোথায় তারা?"
--"বলছি তো, আমি ওই হোথায় পাহাড়ের ঢালে ভেড়ার পাল নিয়ে গেছিলাম তো সকালে। সেখানেই তো দেখলাম। সবুজ রঙের সালওয়ার কুর্তা পরা দুটো লোক আগে কোনদিন দেখিনি, আমায় টাকা দিল তো অনেক, এই দেখো না, বলল আরো দেবে যদি আরো খবর দিতে পারি।"
--"কি খবর?"
--"সেনা ছাউনির সব রকমের খবর"।
--"বলিস কি রে? ঠিক বলছিস তো? ভুল হলে কিন্তু বেদম পিটিয়ে সোজা জেলে ভরে দেব, মনে থাকে যেন।"
--"আরে না না, চল না, এখুনি তো কথা বলে এলাম। আমার কেমন যেন সুবিধের মনে হচ্ছিল না তাই তো বলতে এলাম।"
--"চল তো দেখি।"

উপরের কথোপকথনটা আমার বানানো, কিন্তু ঘটনাটা এবং স্থান কাল পাত্রের নাম আদ্যন্ত নির্য্যস সত্যি। মোটামুটি জুন মাসের শুরু থেকেই আস্তে আস্তে তখনকার সিজ ফায়ার লাইন (CFL) যেটা বাহাত্তর সালের শিমলা চুক্তিতে 'লাইন অফ কন্ট্রোল' বলে পরিচিত হবে সেই আগাপাশতলা অশরীরী বেড়াটাকে টপকে সাধারণ কাশ্মিরীদের পোশাকে কাশ্মির উপত্যকায় ঢুকতে থাকে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর জওয়ানরা সঙ্গে 'আজাদ কাশ্মীর ব্যাটেলিয়ান' নামধারী কিছু সেনা। মহম্মদ দীন এর দৌলতে সেদিন ততক্ষনাত বর্ডার পুলিশ এবং ভারতীয় সেনাদল তত্পর হয়ে ওঠে। সাতজন অনুপ্রবেশকারী গ্রেপ্তার হয়েছিল সেদিন। পরের তিন চার দিন ধরে লাগাতার তল্লাশিতে ধরা পড়ে আরো অনেক অনুপ্রবেশকারী, সঙ্গে আগ্নেয়াস্ত্র। আটই অগাস্ট গ্রেফতার করা হয় দুজন পাকিস্তানি সেনা অফিসারকে। আর তাদের থেকেই উদ্ধার করা হয় পাকিস্তানের 'অপারেশন জিব্রাল্টার' সংক্রান্ত বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ নথিপত্র। মতলব ছিল ছোট ছোট ভাগে ভাগ হয়ে বিভিন্ন সময়ে CFL টপকে ঢুকবে পাকিস্থানি সেনা। এবং পরে কোনো এক নির্ধারিত জায়গায় মিলিত হয়ে ভ্যালিতে নেমে আসবে। আমাদের পুঁচকে সাহসী মহম্মদ দীন যে সে গুড়ের নাগড়িতে একসাথে একশ পঁচিশ মণ বালি ঢেলে দেবে তাতো তারা জানত না না। তার ওপরে কয়েক মাস আগে এপ্রিল মাসে কচ্ছের রান নিয়ে দুপক্ষের কামড়াকামড়িতে বেচারারা বেমালুম হেরে বসে আছে। পাকিস্থানের দাবি, কচ্ছের রানের ওই পান্ডববর্জিত রুক্ষ জায়গাটার একানব্বই হাজার বর্গকিলোমিটারই নাকি তাদের চাই। ওটা নাকি তাদেরই। ভারত উত্তরে বলল, 'ইল্লি আর কি? মামার বাড়ির আবদার? 'বিনা যুদ্ধে নাহি দিব সূচ্যগ্র মেদিনী।' সুতরাং, 'লাগ-লাগ-লাগ নারদ! নারদ!' সেই রণঝটাপটি থামাতে শেষ পর্যন্ত বাইরে থেকে উকিল ধরে আনতে হলো। সে উকিল অর্থাত ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী হ্যারল্ড উইলসন যখন অনেক ভেবে চিন্তে পেন্সিল টেন্সিল চুষে প্রেসিডেন্ট আয়ুব খানের হাতে একানব্বই হাজার বর্গকিলোমিটার এর জায়গায় মাত্র নয়শ দশ বর্গকিলোমিটার এর চুষিকাঠি ধরিয়ে দিলেন তখন তো মানে বুঝতেই পারছেন আয়ুব খানের মুখের অবস্থা কি হয়েছিল। খানিকটা ওই চার বছরের ছানা যদি এক প্লেট মাটন বিরিয়ানির পুরোটাই খাবে বলে আর তাকে যদি ভুজুং ভাজুং দিয়ে একটা চাটনি খাবার বাটিতে করে বিরিয়ানি খেতে দেওয়া হয়, অনেকটা সেরকম আর কি। এইসব রাগ যাবে কোথায়? সুতরাং পয়লা সেপ্টেম্বর থেকে পাকিস্থান শুরু করে দিল 'অপারেশন গ্র্যান্ড স্লাম'। সেসব তো বহুল চর্চিত ব্যাপার-স্যাপার। সেসবের মধ্যে আর যাচ্ছি না এখন। আমার যেটা বলার সেটা হলো এই ৫ই অগাস্ট তারিখটা কিন্তু ফেলনা নয়। আর 'দাড়াকাসসী'-গ্রামের 'মহম্মদ দীন' তো 'হিরো অফ ফিফথ অগাস্ট'।

আমার প্রচন্ড চেনা একজন লোক, যিনি ১৯৬২ থেকে ১৯৭৭ পর্যন্ত ইন্ডিয়ান আর্মিতে থাকার এবং ১৯৬৫ ও ১৯৭১ সালের দু-দুটি যুদ্ধের প্রত্যক্ষ বিরল অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করার সুযোগ পান, তাঁর ১৯৬৫ সালের একটি ডায়েরি আমার হাতে এসে পড়ে। আর ডায়েরির মালিকের সম্মতিক্রমে সে ডায়েরি আমার পড়ার সৌভাগ্য হয়। ফলে আমি জানতে পারি যে, ১৯৬৫ সালের ৫ই অগাস্ট ভারতীয় সেনাদলের সর্বস্তরে এই অনুপ্রবেশের খবর তখনও পৌঁছায়নি। কারণ সেদিনের ডায়েরির এন্ট্রি অনুসারে তিনি তখন তাঁর অসমাপ্ত পড়াশুনার জন্য আক্ষেপ, আর সেসময়ে তাঁর জীবনে এই মিলিটারি চাকরিটির প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কেই লিখে গেছেন। পরবর্তী দু এক মাসের ডায়েরির পাতায় পাতায় অবশ্য অন্য ইতিহাস। গ্রামের দরিদ্র পরিবারের ছেলে পড়াশুনা ছেড়ে পেটের জন্য সেনাবাহিনীতে যোগ দিয়েছে। সেখানে দেশপ্রেম কতটা, কতটাই বা নিজের পায়ে দাঁড়ানোর তাগিদ, কতটা মিলিটারী নিয়মানুবর্তীতার প্রতি শ্রদ্ধা, কতটাইবা দারিদ্রের উর্দ্ধে উঠে কাজের প্রতি সততা, সত্যের প্রতি সততা, আগের দিন পাশে দাঁড়িয়ে যুদ্ধরত বন্ধুর মৃতদেহ পরদিন কফিনবন্দি হতে দেখার যন্ত্রণা আর কতটাইবা যুদ্ধবিজয়ী পাকিস্থানি গ্রামে স্বজন পরিত্যাক্তা বৃদ্ধাকে দেখে গ্রামে রেখে আসা বৃদ্ধা মায়ের মুখ মনে পড়ে যাওয়ার কষ্ট সেসবেরই ইতিহাস সেই ডায়েরি। এককথায় ভারতীয় সৈন্যবাহিনীর সিগনালিং ব্যবস্থার দায়িত্বে থাকা যেকোনো সাধারণ একজন সেনানীর কাছে ১৯৬৫ সালের এই ভারত-পাকিস্থান যুদ্ধের একটি জ্বলন্ত প্রমাণ সেই ডায়েরি।

যুদ্ধের হার জিত, রাজনৈতিক নীতি, ক্ষয়ক্ষতির হিসেব, বড় বড় সেনা নায়কদের কীর্তি এসবের তো হাজার হাজার তথ্য ছড়ানো চার দিকে। কিন্তু সে যুদ্ধে যাঁরা 'টিনের তলোয়ার' নয় সত্যিকারের তলোয়ার হাতে 'জয়্মা' বলে সম্মুখ সমরে ঝাঁপিয়ে পড়েন তাঁরা তাঁদের জীবনটাকে ঠিক কিভাবে দেখেন তার সঠিক তথ্য মেলা ভার। তাই সেরকম একজনের যুদ্ধকালীন সময়ের রোজনামচা যখন এসেই পড়ল হাতে তখন আর হাত গুটিয়ে বসে থাকি কেন?দিনলিপিটির আসল মালিকের সর্বান্তসম্মতিক্রমে সে ডায়েরির অনেক গল্পই ভবিষ্যতে বিশদে আপনাদেরকে বলার আশা রাখি। কেমন যেন মনে হচ্ছে, বলাটা বোধহয় আমার দায়িত্ব। কারনটা শুধু মাত্র এই নয় যে ডায়েরির মালিক হলেন আমার বাবা, সঙ্গে এটাও যে এই গল্প বোধহয় শুধু আমার বাবার একার নয়। ১৯৬২, ১৯৬৫, ১৯৭১ অথবা হালের কার্গিল যুদ্ধসহ সীমান্তে প্রতিদিনের লড়াইতে জীবন না মৃত্যু, দেশপ্রেম না গ্রাসাচ্ছাদনের সংস্থান- এসবের মধ্যে দোলাচলে দিনযাপন করে চলা ভারতবর্ষের প্রত্যন্ত গ্রাম-গ্রামান্ত থেকে উঠে আসা হাজার হাজার সাধারণ সেনানীরও এই একই গল্প। হয়ত একটু এদিক ওদিক।

Monday 4 August 2014

রামবাবু আর শ্যামবাবু

মনটা বেশ খুশি খুশি হয়ে আছে জানেন। কেন বলুন তো? কারণ পরের সপ্তাহে এতক্ষণ বাড়িতে। হে হে। আট মাস পর বাড়ি গেলে বাড়ির লোকজনও বেশ জমিয়ে আপ্যায়ন করে। অলরেডি খবর পেয়ে গেছি যে বাবা ডজন তিনেক ডিমের অর্ডার দিয়ে ফেলেছে। না না যে সে ডিম নয়। এই ডিম হলো সাধারণ মুরগির ডিমের ঠাকুর্দা। দু-দুটো কুসুম ভেতরে। আমরা বলি ডবল ডিম। খাব, ছাঁদা বেঁধে নিয়ে আসব। ঝুমরোদাকে মনে আছে? সেই যার কথা বাবার ঝামেলা মেটানোর কথা বলতে গিয়ে বলেছিলাম। সেই ঝুমরোদা, আমি যাচ্ছি শুনে কাঁকড়া-ছোটমাছ ইত্যাদির বন্দোবস্ত করছে। দারুন দারুন ব্যাপার স্যাপার। ভেবেই ঢোঁক গিলছি। এই সপ্তাহের আর চার পাঁচ দিন মাত্র কাটিয়ে ফেললেই হলো। তারপরে একদিন রাজধানীর ঠান্ডা স্যান্ডউইচ চিবোতে পারলেই পরদিন বাড়িতে ভোজ। আহ! উপরি পাওনা ট্রেনে যাবার সময় হরেককিসিমের লোক দেখা। আমার আর একটা প্রিয় কাজ। লম্বা ট্রেনজার্নিতে সাধারণত আমি তিনটে কাজ করে থাকি। এক, জানলার বাইরে তাকিয়ে তাকিয়ে দারুন দারুন সব চিন্তা করা। দুই, আপার বার্থে উঠে মোষের মত ঘুমানো বা গল্পের বই পড়া। আর তিন, আশেপাশে ইন্টারেষ্টিং কোনো সহযাত্রী থাকলে তাকে নেক্সট ষোলো-সতের ঘন্টার জন্য নজরবন্দী করা, যাতে পরে তাকে নিয়ে খানিক হ্যা হ্যা করা যায় আর এরকম একটা ব্লগ পোস্ট লেখা যায়।

গতবার নভেম্বরে বাড়ি যাবার সময়কার ঘটনা। যাচ্ছিলাম ঠিক দেওয়ালির আগের দিন। স্বভাবতই নিউ দিল্লি স্টেশনে ঢোকার মুখে পা দেবার জায়গা নেই। পৃথিবীর সাড়ে সাতানব্বই পার্সেন্ট লোক সেদিন একই সাথে নিউ দিল্লি স্টেশন থেকে ট্রেনে উঠতে চায়। ফলে বেশ একটা মুখরোচক পরিস্থিতি তৈরী হয়েছে ঢোকার মুখে। আমরা তো কোনক্রমে নিজেদের সিটে গিয়ে অবস্থিত হলাম। মাঝের সেসব ডিটেলে যাচ্ছিনা। কারণ তার চেয়েও সাতকাহন করে বলার মত বিষয় আসছে। সেইবার কি মনে হয়েছিল যে দুজনেই জানলার ধারে বসে যাব, তাই দুটো লোয়ার বার্থ নিয়েছিলাম আর পরে বুঝেছিলাম যে কত বড় ভুল করেছি। দুজনের দুটো লোয়ার বার্থ জমিয়ে বসেছি। আর ভাবছি যে লোয়ার বার্থ নিয়ে খুব একটা লাভ হলো না বোধহয়। কোনো বয়স্ক মানুষ থাকলে তো ছেড়ে দিতেই হবে। উপরন্তু হাঁটুতে ব্যথা-কোমরে ব্যথা-আঙ্গুলে ব্যথা- বুক ধড়ফর ইত্যাদি ইত্যাদি জনগণ তো আছেই। এত জনসংখ্যার মধ্যে আমাদের ভাগ্যে একজন না একজন কেউ কি জুটে যাবে না? সুতরাং দম বন্ধ করে বসে থাকি কখন আমাদের কেউ এসে বলবে, "লোয়ার বার্থটা মানে হেঁ  হেঁ বুঝতেই তো পারছেন বয়স্ক মানুষ/ পায়ের এই অবস্থায়/ কোমরে দেখুন না বেল্ট.......মানে রাতে শোবার সময়.....হেঁ  হেঁ মানে......", আর আমরাও বলব, "না ঠিক আছে রাতে তো কোনো প্রবলেম নেই আমরা একজন ওপরে উঠে যাবখন।" রাতে তো আর জানলা দিয়ে প্রকৃতি দেখা যায় না, অতএব ট্রেনে আমার করণীয় প্রথম কাজটা হচ্ছে না। দ্বিতীয় আর তৃতীয় কাজটার জন্য আপার বার্থটাই উপযুক্ত জায়গা। সুতরাং রাতের জন্য কাউকে নিচের জায়গাটা ছেড়ে দেওয়াই যায়, সানন্দে। সকালে উঠে নিশ্চয়ই আমার জায়গা আমায় ছেড়ে দেবে। কিন্তু না। একবার স্বেচ্ছায় জায়গা ছেড়ে দেওয়া মানে হয়ে গেল। বাকি পুরো সময়টুকুর জন্যই আপনাকে সে সিটের মায়া ত্যাগ করতে হবে। সেটাই নাকি রেল যাত্রার অলিখিত নিয়ম। কতরকম নিয়মই যে জানা যায় রাস্তা ঘাটে বেরোলে তার ইয়ত্তা নেই।

সেবারেও নতুন নিয়ম শিখলাম। প্রথমে ব্যাপারটা আমাদের দুই হাবার মাথায় ঢোকেনি। ট্রেনে উঠে জাঁকিয়ে বসে তো ভাবছি এই বুঝি লোয়ার বার্থের কোনো দাবিদার এলো। শেষ পর্যন্ত উঠলো ছয় জনের একটি পরিবার। অমি তো সঙ্গে সঙ্গেই নিজের জানলার সিটে চেপে বসে পরিবারের প্রত্যেকের বয়স, এবং কোমর ও হাঁটু সম্পর্কে জ্ঞানার্জনে সচেষ্ট হযে পড়ি এবং নিশ্চিন্ত হই। যাক বাবা, প্রত্যেকেই চল্লিশের নিচে, আর দিব্বি তো হই হই করেই চলাফেরা করছে তার মানে প্রত্যেকের শরীরের প্রত্যেকটি অঙ্গই ঠিকঠাক আছে বলেই মনে হয়। দলে আছে দুই ভদ্রলোক, যাঁদের আমি যথাক্রমে 'রাম' আর 'শ্যাম' বলব এবার থেকে আপনাদের বোঝাবার সুবিধার জন্য। আর রাম আর শ্যামের দুই বউ, পরে জানতে পারি তাঁরা দুই বোন আর তাঁদের একটি করে ছানা, একটি ছেলে আর একটি মেয়ে। এই ধরুন বছর আটেক আর দশেক বয়স। এই হলো গিয়ে আমাদের সেবারের সহযাত্রী পরিবার। আমি তো উল্লাসে আটখানা হয়ে উঠলাম যে যাক বাবা আমায় জানলার ধার ছাড়তে হলো না।

কিন্তু মারে হরি রাখে কে? ট্রেনে উঠেই অভূতপূর্ব তত্পরতার সঙ্গে যেভাবে ছয় জনের ছ-ছয়ে ছত্রিশ খানা ব্যাগ-সুটকেস-পোঁটলা-হ্যান্ডব্যাগ-লম্বা কাপড় জড়ানো কি একটা যেন-মিল্টনের জলের জার-চটের বস্তা ইতাদি প্রভৃতি সারা পৃথিবীর জিনিস দিয়ে 'রামবাবু' আমাদের দুটো সিটের তলা-সাইড লোয়ার-এর তলা-নিজেদের দুটো আপার বার্থ ভর্তি করে ফেললেন তাতে করে তিনিই যে এই টিমের লিডার তার আর কোনো সন্দেহই রইলো না। সাত-আট মিনিটের মধ্যে দেখা গেল যে দুই সিটের মাঝের হাঁটা-চলার জায়গাটা পর্যন্ত নেই। ভুলবশতঃ আমি জুতো খুলে বাবু হয়ে বসেছিলাম সিটে। পা নামাতে গিয়ে দেখি জুতো কোথায় হরির লুট হয়ে চলে গেছে তার কোনো পাত্তা নেই। তার ওপরে অন্ততঃ গোটা তিনেক নেড়ি-নেড়ি বোঁচকা। আমার পাশে শ্যামবাবুর স্ত্রী (তখন জানতাম না পরে জেনেছি) পুঁচকে আয়নার দিকে অখন্ড মনোযোগে তাকিয়ে ঠোঁটে লিপস্টিক ঘসছেন, দুটি বাচ্চা নিজেদের মধ্যে মোবাইল গেম নিয়ে মারামারি করছে, শ্যামবাবু স্বয়ং বসে বসে দেশলাই কাঠি দিয়ে দাঁত খোঁচাচ্ছেন। আর উল্টোদিকে পিনাকীর পাশে রামবাবুর স্ত্রী (এটাও পরে জেনেছি) সর্বহারার মত মুখ করে বসে আছেন, ভাবলাম বুঝি কোনো প্রবলেম কিন্তু না পরবর্তী ষোলো ঘন্টা ওঁনার মুখের চেহারার কোনো পরিবর্তন আমি দেখিনি-সে যেকোনো ধরনের কথাই হোক না কেন। কারনটা আমি পরে নিজে নিজে বিশ্লেষণ করেছিলাম, পরে বলছি আপনাদের। তাঁর পাশে গোটা পাঁচেক ছোটবড় ব্যাগ এখনো ঠিকঠাক প্লেসমেন্ট না পেয়ে বেকার ছেলেমেয়েদের মত গড়াগড়ি খাচ্ছে। আর রামবাবু মহা হম্বি তম্বি করে ব্যাগ ট্যাগ নিয়ে নড়াচড়া করছেন।

রামবাবু তার পর গেলেন পাশে এক দুটো কিউবিকল ছেড়ে ওঁনাদের যে আর একটা সিট আছে তার তদারকি করতে। ততক্ষণে শ্যামবাবুর স্ত্রী ঠোঁটের তদারকি সেরে আমায় মিষ্টি হেসে জানিয়ে দিয়েছেন যে বাচ্চারা যদি কখনো জানলার ধারে বসতে চায় আমি যেন তাদের বসতে দি। তাঁদের নিজেদের কোনো ব্যাপার নয় বাচ্চাদের জন্যই বলছেন। আমিও তো সাদা মনে লম্বা করে ঘাড় নেড়ে হ্যাঁ বলে দিয়েছি। অনতিবিলম্বেই রামবাবু ফিরে এসেই দেখে নিলেন কার কোনটা সিট মানে আমরা কোনো বজ্জাতি করে ওঁনাদের সিট নিয়ে নিয়েছি কিনা। আমি তো আগে থেকেই একটা সিটে বাচ্চা বড় মিলিয়ে পাঁচ-পাঁচজন বসায় এমনিতেই সিঁটিয়ে বসেছিলাম, তার ওপরে এই হম্বি তম্বি শুনে তো "আতঙ্কে ল্যাম্পপোস্ট হয়ে গেলাম"। জানা গেলো যে আমি নাকি ওঁনাদের সিটে বসে আছি। আমি আমার সিট নম্বর মিলিয়ে নিলাম আরেকবার। না তো। আমার কোনো ভুল হচ্ছে না। হঠাত শুনি আমায় উদ্দেশ্য করে বাজখাঁই গলায় রামবাবু বলছেন- "এই যে, হ্যালো, আপনি একটু এদিকে আসুন তো, এদিকে এসে বসুন। ওখানে আমাদের বাচ্চারা বসবে।" বিশ্বাস করুন একটুও বানিয়ে বলছি না। ঠিক এইভাবেই এই কথাগুলোই বলেছিলেন তাই আমার মনে আছে এখনো। ভাবলাম, যাহ বাবা, এরকম করে বলে কেন। বাচ্চারা বসবে তো ভালো করে বললেই হয়, আর বাচ্চারা তো সেই ট্রেনে ওঠা থেকে মোবাইল নিয়ে ঝটাপটি চালিয়ে যাচ্ছে। মোটেই বায়না করছে না জানলার ধারে বসার। লোহার উইণ্ডোর চেয়ে মোবাইলের উইন্ডো অনেক বেশি আকর্ষনীয় তাদের কাছে। এখনকার মোবাইলের অবদান। তা সে যাই হোক, আমার সিট নম্বর অনুযায়ী আমার লোয়ারের এই সিটটাই হবার কথা। পিনাকী বলল সে কথা। আমিও মিন মিন করে বললাম আমার এত নম্বর সিট, আর সেটা এটাই। ভবি ভোলার নয়। অনেক কিছু বলে টলে শেষ পর্যন্ত এটা দাঁড়ালো যে এসব তাঁর অনেক দেখা আছে। আমি যেন মানে মানে সরে বসি।

আমি দেখলাম যে এই লোকের সাথে তর্ক করা আর দেওয়ালের সাথে তর্ক করা একই ব্যাপার। আমি উঠে পিনাকীর পাশে বসলাম আর শ্যামবাবুর স্ত্রী জাঁকিয়ে বসলেন জানলায়। বাচ্চারা যেমন হুটোপুটি করছিল তেমনিই করতে লাগলো। মাথাটা বেদম গরম হয়ে গেল আমার। বললাম, দেখুন সিট আমি ছেড়ে দিচ্ছি কিন্তু সিটটা আমাদেরই। আপনি নিজের সিট নম্বর মিলিয়ে দেখে নিন। তখন রামবাবু আমায় সেই মারাত্মক জ্ঞানটা দিলেন যে, লোয়ার বার্থের দুটি জানলাই কোনো একটি ফ্যামিলির দখলে থাকতে পারে না। একটা জানলা সবসময় ছেড়ে দিতে হয়। এটা নাকি নিয়ম। মানবিকতা বা সহযাত্রার নিয়ম নয় কিন্তু। রেলের নিয়ম। শুনে হাসব না কাঁদব না রেগে যাব বুঝে উঠতে পারছিলাম না। ভেবে চিন্তে হাসাটাই সাব্যস্ত করলাম। আমি ফ্যাঁচ করে হেসে উঠতে দেখি পিনাকীও আমার সাথে সাথে খুক খুক করে হাসতে লেগেছে। পরের পুরো সময়টা জুড়ে আমার এ ধারণা বধ্যমূল হয়েছিল যে রামবাবুর এইধরনের হাস্যকর হম্বিতম্বির কারণেই হয়ত রামবাবুর স্ত্রী সদা সর্বদা 'অনিত্য এ সংসার' - এরকম মুড এ থাকেন।

যাই হোক এতক্ষণ তো রামবাবুর কথাই বললাম। দাঁত খোঁচানোর পর শ্যামবাবুর কি হলো সেকথা তো বলাই হলো না। রামবাবুর বিশেষণ যদি 'পরিচালক' হয় শ্যামবাবু হলেন আদর্শ 'পরিচালিত' এবং অবশ্যই 'খাইয়ে'। তিনি কেবলমাত্র রামবাবুর কথা শুনে চলেন। এবং যা পান তাই বিনা দ্বিধায় অনবরত খেয়ে চলেন। একটা কথোপকথন না বলে থাকতে পারছি না। রামবাবুদের একটি সিট খানিকটা দূরে ছিল। আর সেখানে এঁনাদের ছত্রিশটা ব্যাগের কয়েকটা হয়ত ছিল তাই দলের লিডারকে ওখানে থাকতে হচ্ছিল। এদিকে রাত্রের খাবারের জন্য যখন শ্যামবাবুর কাছে অর্ডার নিতে এলো তখন বেচারা শ্যামবাবুর অবস্থা দেখে আমার হাসি তো পাচ্ছিলোই কিন্তু বেশ খারাপও লাগছিল। আমি কথোপকথনটা মোটামুটি আপনাদেরকে রিলে করার চেষ্টা করছি, কেমন-
--"রাতে কি খাবেন? ভেজ না ননভেজ?"
--"রাতে? দাঁড়ান একটু।" বলে রামবাবুর থেকে জেনে এলেন।
--"মাংস, মাংস, সবাই মাংস-ভাত।"
--"আর কাল ব্রেকফাস্টে?"
--"ও আচ্ছা, দাঁড়ান।" আবার রামবাবুর কাছে গমন।
--"ডিম খাব। তিনটে ডিম আর বাকি এমনি।"
--"এমনি মানে? ভেজ? তাইতো?"
-- "হ্যাঁ ওই।"
--"ডিম কি অমলেট না বয়েলড?"
--"ডিম?" বলে একটু থমকালেন।  আর বোধহয় উঠে যেতে ইচ্ছে করলো না। এবার একটু মুখ বাড়িয়ে চেঁচিয়ে-"কিরে, ডিম ভাজা খাবি না সেদ্ধ?"
ওদিক থেকে উত্তর এলো, "সেদ্ধ, সেদ্ধ"। আর পাশ থেকে, মানে মহিলা দল বলছে "ভাজা ভাজা"। শ্যামবাবুর মহা মুস্কিল। কি বলবেন এখন?
আমিও ততক্ষণে কথোপকথনে প্রায় ঢুকে গেছি। আর একটু হলে প্রায় বলেই ফেলছিলাম, "তাহলে দুটো ভাজা আর দুটো সেদ্ধ হয়ে যাক, আর দুটো ভেজ।" শেষ মুহুর্তে বাপ বাপ বলে সামলে নিলাম। তারপর দেখি লিডার উঠে এসেছে। দেখি কি বলে কিনা, "দুটো ভাজা, দুটো সেদ্ধ"। আমি গর্বিত মুখে পিনাকীর দিকে তাকালাম। সেও দেখি আমার দিকে তাকিয়ে দাঁত বের করে আছে। এইভাবে তো শ্যামবাবু নিজেই প্রায় একা একা পুরো অর্ডার টর্ডার করে বসে বসে পা নাচাতে লাগলেন। আমরাও ভাবলাম কোনো গাইড এরকম অনুগত ছাত্র পেলে বর্তে যেত।

তারপর তো তাঁর খাবার ক্ষমতারও দারুন নমুনা পেলাম রাতে খাবার সময়। ট্রেনে উঠে সপরিবারে বাড়ি থেকে আনা পরটা থেয়েছিলেন দেখেছি। তারপর রাজধানীর স্ন্যাকস। স্বভাবতই রাতে বাচ্চারা আর মহিলারা বেশি খেতে পারছিলেন না। শ্যামবাবুর ছেলে সন্ধ্যেথেকেই মোবাইল ছেড়ে দিয়ে ঘুমোচ্ছে। রাতের খাবার আসতে তার মা তাকে তোলার চেষ্টা করতে দেখি তার বাবা বলে কিনা, "ছেড়ে দাও, ছেড়ে দাও, ঘুমোচ্ছে যখন আর তুলে লাভ নেই। পরটা তো খেয়েছে।" আর তখনি দেখলাম শ্যামবাবুর ক্ষমতা। নিজের পুরোটা, স্ত্রীর প্রায় অর্ধেক সঙ্গে ছেলের পুরোটা। সঙ্গে আইসক্রিম, দই ইত্যাদি ইত্যাদি যা যা থাকে স অ অ অ অ ব .......আমরা হাঁ আ আ আ আ করে তাকিয়ে দেখলাম আর মনে মনে নমস্কার করলাম। ভাবলাম আর যাই হোক দুই রতনের সাক্ষ্যাত পেলাম এযাত্রায়। একজন প্রসিদ্ধ নেতা আর একজন প্রসিদ্ধ খাইয়ে। এহেন আমি, যে কিনা যা পাই তাই হাঁউমাঁউ করে খেয়ে খেয়ে এইরকম বিশাল বপুখানি বানিয়েছি সেও কিনা শ্যামবাবুর ভোজনপটুত্ব চোখের সামনে দেখে টেখে কেমন যেন ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে কোনক্রমে একটা রুটি খানিকটা ভাত দুটো চিকেন পিস দিয়ে চিবিয়ে, আইসক্রিম, দই-টই গুলোকে হাঁ হাঁ করে 'না' বলে জল খেয়ে শুয়ে পড়লাম।

পরে আর একটি জিনিস আবিস্কার করেছিলাম যে, আমাদের দুজন বাদ দিলে এখানে বাকি সিটের সংখ্যা চার। আর দূরে ওঁনাদের একটা সিট। সবমিলিয়ে পাঁচটা সিট। অথচ ওঁনাদের জনসংখ্যা ছয়। ব্যাপারটা কি? বছর আস্টেকের বাচ্চা মেয়েটি কি ফাউ? খাবার দাবারের দাম দিয়েছে। আর বাচ্চাটিকে নিয়ে একটা সিটে মা শুয়ে পড়েছে? যাক বাবা, এসব কূট প্রশ্ন আমার মনে না আনাই ভালো। তবে এটুকু বুঝেছিলাম যে করিতকর্মা পরিবার। আমাদের মত ন্যালা ক্যাবলা নয়। কি বলুন?    

Friday 1 August 2014

বরেকালা

ওয়েদার রিপোর্ট বলছে এখন নাকি প্রবল বর্ষাকাল। হরিয়ানায় নাকি মুহুর্মুহু বৃষ্টি হচ্ছে। হবে হয়ত! আমি তো ছিটেফোঁটাও প্রসাদ পাচ্ছি না। বাড়িতে থাকলে বৃষ্টিটাকে আস্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ঘুমোনো যেত। যাই হোক সে যখন সম্ভব নয় তখন আর কি করা যাবে? বৃষ্টির স্মৃতিচারণের ঘোলই খেতে হবে।অনেকদিন আগের এক বৃষ্টির সন্ধ্যের কথা মনে পড়ে যাচ্ছে। বছর কুড়ি আগে যখন আমাদের পুঁচকে গ্রামে মাসের মধ্যে তিন মিনিটের বৃষ্টি-আড়াই মিনিটের ঝড়-কোদালে অমাবস্যা-চড়ক ষষ্ঠী-ইলেকট্রিক অফিসের বড়বাবুর সেজজামাই এর জন্মদিন ইত্যাদি ইত্যাদি বিভিন্ন জরুরি কারণ উপলক্ষ্যে একাদিক্রমে দেড়দিন-দুদিন ধরে ইলেকট্রিসিটি থাকত না তখন কার কথা বলছি। তখন আমি ক্লাস ফাইভ বা সিক্স এ পড়ি। আমার বাবা লোকজনের চিঠি-চাপাটির ঠিকঠাক বিলি ব্যবস্থা করতে ইন্ডিয়ান পোস্টাল ডিপার্টমেন্টে একদিন অন্তর রাত জাগছেন। আর আমার মা আমাকে ইতিহাস-ভূগোল-বিজ্ঞান-অঙ্ক-বাংলা-ইংরাজিতে পন্ডিত করে তুলতে গিয়ে প্রতি সন্ধ্যেতে আমার এই মোটা মাথা নিয়ে হাবুডুবু খাচ্ছেন। এরকমই একদিনে ইলেকট্রিসিটি নেই, আগের দিন বেশ ঝড়-বৃষ্টি হয়েছে। সেদিনও টুপটাপ ঝরছে। মা টুকটাক রান্নাবান্না করছেন আর আমি হ্যারিকেনের আলোয় রান্নাঘরেই বসে ঘেমে নেয়ে মায়ের বকুনি আর মশার কামড় খেতে খেতে বই খাতা খুলে ল্যাজেগোবরে হচ্ছি।

এমনসময় এলো পার্বতী বৌদি। কালোকোলো, বেঁটে-খাটো, সদাসর্বদা হাস্যমুখের এই ভদ্রমহিলা আমাদের বাড়িতে দুধের যোগান দিতেন অনেকদিন। সেদিন বৃষ্টি পড়ছিল আর লোডশেডিং। পার্বতিবৌদী বাড়ি যেতে পারছিলেন না। বৃষ্টি থামা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হচ্ছিল। তো সেদিন মায়ের বোধহয় কাজকর্ম শেষ হয়ে গেছিল। তাই মাও পার্বতিবৌদির সাথে টুকিটাকি গল্পগাছা শুরু করলেন। আর লোডশেডিং এর মধ্যে আমায় খাতা পেন্সিল নিয়ে যত্পরোনাস্তি গলদঘর্ম হতে দেখে হয়ত মনে কিঞ্চিত দয়া হয়েছিল তাই খানিক পরে আমি যখন পড়া ছেড়ে গুটি গুটি পায়ে মায়েদের গল্পের মধ্যে এসে দাঁড়ালাম মা বিশেষ কিছু বললেন না। ফলে আমিও হাঁপ ছেড়ে নিবিষ্ট মনে পেন্সিল চুষতে চুষতে পার্বতিবৌদির আগের দিনের ঝড় বৃষ্টির মধ্যে বাড়ি পৌছানোর এডভেঞ্চারের গল্প শুনতে লাগলাম।

বৌদি বলতে লাগলেন-

--"কাল কত রাতে গেছি বাড়ি জানো কাকিমা?" (আমার মাকে কাকিমা বলতেন পার্বতীবৌদি)
--"কখন গেলে? তুমিতো বেরোলে আর তার সঙ্গে সঙ্গেই প্রায় বৃষ্টি নামল।"
--"আর বোলো নি, আমি তো স্বপনদাদের ঠাকুর দালানে দাঁড়িয়ে ছিলুম। কি ঝড় বৃষ্টি বাপরে বাপ! একা একা দাঁড়িয়েছিলুম কি ভয় করছিল কি বলব। কি জোর জোর বিদ্যুত চমকাচ্ছিল বলো ? শেষে একটা বরেকালা এসে দাঁড়ালো। তার পর বৃষ্টি কমতে সেই তো আমায় টর্চ দেখিয়ে বাড়ি অবধি পৌঁছে দিল। "
মা প্রচন্ড অবাক হয়ে বললেন, "কে পৌঁছে দিল?"
--"ওই যে বরেকালাটা, যে দাঁড়িয়েছিল এসে।"
--"ব-রে-কা-লা?"-মা খুব অবাক হয়ে আমার দিকে তাকালেন। যদি আমি কিছু উদ্ধার করতে পারি। কিন্তু আমারও বোধগম্য হলো না ব্যাপারটা।
আমাদের দুজনকে অকূল জলে পড়ে খাবি খেতে দেখে পার্বতীবৌদি উদ্ধারকর্ত্রী রূপে মাঠে নেমে পড়েন।
--"আরে বরেকালা জাননি ই ই ই ই?" আমাদের অজ্ঞতার সীমা পরিসীমা নাই দেখে বৌদি যারপরনাই অবাক হন।
--"আরে বরেকালা গো, যারা বরেক বিককিরি করে।"
আমাদের কাছে তো 'বরেক', 'বরেকালা' দুটোই সমান হিব্রু লাগছে। কি বলছে রে বাবা! 'বরেকালা' টা আবার কি?
বৌদি আবার বলেন "বরেক গো.....বরেক জাননি?"
এই ভাবে প্রায় চার পাঁচ মিনিট ধরে বৌদি প্রাণপণে 'বরেক' জিনিসটা সম্পর্কে নানা তথ্য দিতে থাকেন। তাতেও আমাদের বোধদয় না হতে দেখে শেষে খানিকটা হল ছেড়ে দিয়েই বলে ওঠেন, "আ গো তোমাদের পাড়ায় যে বরেক কল আছে নি, সেখানে যে বরেক তৈরী হয়, সেই বরেক।"

"হা ভগবান !!!!!! বরফ? তাই বল।" মা বলেন। আমিও "হরি হে" বলে হাঁপ ছেড়ে বাঁচি। এতক্ষণ দুজনে নিজেদের অজ্ঞতার পাথারে সাঁতরে কূল পাচ্ছিলাম না।

ব্যাপারটা হলো, আমাদের পাড়ার মোড়ে একটি বরফ তৈরী করার ছোটো কারখানা আছে। সেই যার কথা আমি আমার ছোটবেলার স্বর্গীয় সব খাবার দাবারের কথা বলতে গিয়ে বলেছিলাম না আপনাদের? সেই বরফকল থেকে অনেকে সকালে একটা বড় কাঠের বাক্স করে নানারকম কাঠি আইসক্রিম নিয়ে দিগ্বিদিকে বেরিয়ে পড়ত বিক্রি করতে। সন্ধ্যে বেলায় বরফকলে ফিরে বাক্স রেখে টাকা পয়সার হিসেব নিকেস করে বাড়ি ফিরত। সেরকমই একজন সেদিন বৃষ্টিতে আটকে পড়েছিল পার্বতী বৌদির সাথেই। তাকেই বৌদি এতক্ষণ ধরে 'বরেকালা' 'বরেকালা' বলে চলেছিলেন। বলতে চেয়েছিলেন বরফওয়ালা > সেখান থেকে বরফালা > সেটিও পরিবর্তিত হয়ে 'বরেকালা'-র চেহারা নিয়েছিল। শব্দের কি সাংঘাতিক পরিবর্তন একবার ভাবুন!