Thursday 4 January 2018

কেক


১৯৯৩-৯৪ সাল নাগাদ কলকাতা থেকে প্রায় ৫০ কিলোমিটার দূরে পশ্চিমবঙ্গের কোনো একটি গ্রামে বছর দশ-বারোর বালিকার জন্য কেক মানে ছিল বাপুজী কেক। নকল চেরির মোজাইক করা ময়দার চৌকোনা টুকরো আর ওপরে সবজে-লাল তেলতেলে কাগজের মোড়ক। তার স্বাদ যদিও তখনও অপূর্ব লাগতো, এখনো এই কেক-প্যাস্ট্রির দেশে একশো রকম কেক খেয়েও অপূর্ব লাগে। যদিও অনেকের মতে বাপুজী কেক জঘন্য। আমার মত উল্টো। ২৫শে ডিসেম্বর তখন ছিল আমবাঙালির কাছে কেক আর পিকনিকের উৎসব। আমাদেরও তাই ছিল। ঐদিন বাবা দোকান থেকে বা বেকারি থেকে একটু বড় সাইজের গোল বা চৌকো কেক আনতো। গঠনগত বা গুণগত দিক থেকে বাপুজী কেক এর সাথে তার বিশেষ তফাৎ না থাকলেও এই কেকগুলির একটা বিশেষ গন্ধ থাকতো। জানিনা কিসের। বড়দিন উপলক্ষে বিশেষ সুগন্ধী মেশানো হতো বোধহয়। আমার ভালো লাগতো না। কিন্তু ভালো লাগছে না বলে খাবোনা, এই মারাত্মক ঘটনা ঘটানোর মতন সাহস ছিল না তখন, তাই ওই শুকনো, ভালো না লাগা গন্ধের বড়দিন স্পেশাল কেক খেতেই হতো দুচার দিন ধরে। মনে মনে বাপুজি কেক খাচ্ছি মনে করে। তখন কেকের গুণগত মান নির্ণয়ের জন্য বাপুজি কেকের চেয়ে ভালো আর কোনো মাপকাঠির কথা আমার জানা ছিল না।

তা বাপুজী কেকই খাচ্ছিলাম। আমার সেই একনিষ্ঠ বাপুজী প্রেম প্রথম বারের জন্য টাল খেলো যখন মা আমাদের কোনো একজন সৌখিন রাঁধিয়ে আত্মীয়ার কাছ থেকে কেক বানানো শিখলো। কেক বানানো হবে চোখের সামনে? তাও আবার বাড়িতে? এতো অবিশ্বাস্য ব্যাপার। বেকিং পাউডার এলো বড়বাজার থেকে অফিসফেরতা বাবার ব্যাগে চড়ে। ডিম-ময়দা-চিনি এসব তো ছিলই। কিছু চালকুমড়োর মোরব্বা (টুটি-ফ্রুটির কাজ করবে), চেরি (রং করা করমচা, তখন ঐগুলোকেই চেরি বলে জানতাম) এসবও এলো অবিশ্বাস্য জিনিসটি তৈরী হওয়ার পর তার সৌন্দর্য্য বৃদ্ধির কাজে লাগবে বলে। তার পর বহু অপেক্ষা আর "কবে বানাবে?" "কবে বানাবে?" বলে মা কে অবিরত বিরক্ত করার শেষে একদিন এলো সেই মাহেন্দ্রক্ষণ। আগেকার রান্না ঘরে তখন বোধহয় গ্যাস আসেনি আমাদের বাড়িতে। কেরোসিনেই স্টোভ, কয়লার আঁচের তোলা (portable) উনুন আর কাঠের উনুনের যুগ চলছিল। কেরোসিনের স্টোভে বসানো হলো প্রেসার কুকার। তার ভেতরে secondary heating procedure এ বেকিং হবে বলে আর একটি তেল মাখানো শক্তপোক্ত অ্যালুমিনিয়ামের বাটি। সেই তৈলাক্ত বাটিতে রইলো ময়দা-ডিম- দুধ-চিনি-বেকিং পাউডার এর মহার্ঘ্য মিশ্রণ। এবার প্রেসার কুকারের ঢাকনা থেকে ভারী প্রেসার কন্ট্রোলার, মানে যাকে বাঙালির রান্নাঘরে "সিটি" বলে, সেটি খুলে দিয়ে কুকার ঢাকা দিয়ে দিব্য একটি ছোট খাটো ভারতীয় কেক ওভেন বানানো হলো। এই বার অপেক্ষা। এখনো মনে আছে, স্টোভের পাশে উবু হয়ে তীর্থের কাকের মতো বসে আছি আর ভাবছি কখন অমৃত প্রস্তূতি সমাপ্ত হবে আর সেখান থেকে একখণ্ড খসে পড়বে সোজা আমার রসনায়। আর বড়দিনের আগে পরে বন্ধুমহলের গালগল্পের আসরে আমার ঝুলি একধাক্কায় চড়চড়িয়ে "বাবা বড়দিনে কেক এনেছে " থেকে "বড়োদিনে মা কেক বানিয়েছে" -তে উত্তরিত হবে। সে অপেক্ষাটা বড্ড বেশি ছিল মনে পড়ে। মা থেকে থেকেই প্রেসার কুকারের ঢাকনা খুলে দেখে আর উলবোনার কাঁটা গেঁথে দেখে যে ভেতরটা এখনো তরল কিনা। আমিও সাথে সাথে চক্চকে চোখ নিয়ে উঠে আসি মায়ের পাশে আর প্রতিবারেই মা আর আমায় হতাশ করে উলের কাঁটার সাথে সাথে খানিকটা করে অর্ধতরল ময়দার মিশ্রণ উঠে আসে। তা সমস্ত অপেক্ষার মতোই ক্রমে একসময় শেষ হলো সেই অপেক্ষাও। স্টোভ নিভলো। কুকার ঠান্ডা হলো। কুকারের ঢাকনা খোলা হলো আর তিন জোড়া তৃষিত হৃদয় (আমার, মায়ের আর কাকিমার) ঝুঁকে পড়লো ছোট্ট অ্যালুমিনিয়ামের কুকারটার ওপর।

আর মুচমুচে উৎসাহ একসেকেন্ডেই ন্যাতানো মুড়িতে পর্যবসিত হলো।

এতদিনের দেখা সমস্ত কেকই সুন্দর বাদামি রং হয়। এই কেকের ওপরটা সম্পূর্ণ ফ্যাটফ্যাটে সাদা।  এ আবার কিরকম কেক? মায়ের কতটা খারাপ লেগেছিলো জানিনা। আমার চোখ ফেটে প্রায় জল আসার জোগাড়। যাই হোক, সেই কেক কাটা হলো। খেয়ে দেখি ওমা!!!!! দিব্যি স্বাদ। বাপুজি কোথায় লাগে! মায়ের মুখেও হাসি। যাক ব্যাপারটা একেবারে ফেলে দেবার মতো হয়নি তাহলে। তবে তো protocol এর main structure রেডী। ওপরের রঙের ব্যাপারটা নিয়ে protocol-এ কিছু fine tuning করতে হবে। সে তো করতেই হয় সমস্ত নতুন এক্সপেরিমেন্টে। ব্যাপারটি হলো, প্রেসার কুকার আর কেরোসিন স্টোভের কম্বিনেশন কেককে ওপর থেকে উত্তাপ না দিতে পারায়, ওপর দিকটা বেকড হয়েছে কিন্তু রং ধরেনি। যাই হোক, এরপর পরবর্তী কেকগুলোয় ক্রমে ক্রমে ভ্যানিলা ফ্লেভার, কমলালেবুর শুকনো খোসার গুঁড়ো দিয়ে অরেঞ্জ ফ্লেভার এসব যোগ হলো। আমি থাকতাম কেক বানানো শেষ হলে তাকে বাদাম আর চেরি (করমচা)-র টুকরো দিয়ে কনে সাজানোর কাজে। ক্রমে বাড়িতে কেক বানানোর ছোট ওভেন এলো। সেই ওভেন মায়ের সাথে সাথে একসঙ্গে বুড়ো হলো। এখনো দুই বৃদ্ধা সঙ্গিনী মিলে তারা প্রতি শীতে কেক বানিয়ে যাচ্ছে। আর একটু বড় হবার পর মায়ের সেই রেসিপি কে অল্প একটু আধটু পরিবর্তন- পরিবর্ধন করে আমিও নেমে পড়েছি মাঠে। বাপুজি এখন দ্বিতীয় স্থানে। 'মা' জী টাই ফার্স্ট।                               

এই বেলা আর একটি ছোট্ট ঘটনা বলতে ইচ্ছে করছে। সময়টা ছিল এই ২৫শে ডিসেম্বর থেকে পয়লা জানুয়ারির মধ্যে বা জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহ। তখন বৎসরান্তের এই পুরো সপ্তাহটা ছুটি থাকতো বলে মনে পড়ে না। ২৫শে ডিসেম্বর ছুটি। আর পয়লা জানুয়ারি ছুটি। আমার সেবছরই প্রথম হাই স্কুল। অর্থাৎ কিনা পঞ্চম শ্রেণী। স্কুলের টিফিন ব্রেকে আমি-সাবিনা-অপর্ণা-স্বাতী চারজনে প্রতিদিনের মতো রোদে পিঠ দিয়ে টিফিন খেতে বসেছি। ভাগাভাগি করে নাকে মুখে গুঁজে খাওয়া হবে যাতে খেলার জন্য যথেষ্ট সময় পাওয়া যায়। তা সেদিন আর খেলা হয়েছিল কিনা মনে পড়ে না। কিন্তু অন্য একটা কারণে ওই দিনটা আমার মনে জ্বলজ্বলে হয়ে রয়েছে। সবার টিফিন বাক্স খুলে রোজকারের মতন বেরোলো রুটি-তরকারি, পাউরুটি-কলা-মিষ্টি বা মুড়ি-চানাচুর ইত্যাদি চেনা খাবার দাবার। অপর্ণার বাক্স খুলতেই ম্যাজিক। একি !!! হলদেটে সাদা হালকা ফুরফুরে কেক। বাপুজি- র থেকে শতগুণ নরম। সবচেয়ে অবাক করা ব্যাপার, সেই নরম তুলতুলে কেকের ওপর সবুজ রঙের পুরু পরতটা কি? লালচে গোলাপি নকশা করা?

ক্রিম!!!!!!

ওটা ছিল প্যাস্ট্রি। আমরা তখন বলতাম ক্রিম কেক। অপর্ণার বাবা কলকাতা থেকে নিয়ে এসেছেন বড়দিন উপলক্ষে। এই ধরণের একটি বস্তূর অস্তিত্ব যে পৃথিবীতে আছে সেটা আমার জানা থাকলেও চর্মচক্ষে তা অবলোকন করার সুযোগ আমার তখনো হয়নি। এই তবে 'ক্রিম কেক?' ওখানে উপস্থিত অন্য কেউ 'ক্রিম কেক?' চোখে বা চেখে দেখেছিলো কিনা আমি জানিনা, আমি তার আগে চেখে তো দূরস্থান, চোখেও দেখিনি। সেদিন দেখলাম। চাখলাম। জ্ঞানবৃক্ষের নিষিদ্ধ ফলের মতো। মানবজন্মের প্রথম পাপের মতো। তারপর আর কি? পাপ করতেই থাকলাম। আজও করে চলেছি।সেদিনের সেই প্রথম 'প্যাস্ট্রিপ্রাশন' হবার পর বাড়ি এসে খুব সাধারণভাবে মাকে বলেছিলাম বটে অবিশ্বাস্য স্বাদের কথা কিন্তু এমন ভাবে, যাতে মা বুঝতে না পারে যে খাদ্যটি আমার বালিকা রসনায় অমৃতসমান মনে হয়েছে। কারণ কোনোদিন মুখে না বললেও সেই দশ এগারোর গ্রাম্যবালিকাটি কোনো ভাবে বুঝতো যে, বস্তূটি যতই সুস্বাদু হোক না কেন তার বাবার পকেটের পক্ষে খুব একটা স্বাস্থ্যকর নয়। তদুপরি, কোনো জিনিস ভালো লেগেছে বলে নির্লজ্জের মতো তার জন্য বায়না করাটা কোনো ভদ্রশিশুজনিত আচরণ নয় এটিও ততদিনে মগজে ঢুকে গেছিলো খুব ভালো করে। তাই কয়েক বছরের জন্য 'ক্রিম কেক' খাওয়ার পাপ কাজ থেকে নিজেকে সন্তর্পনে আগলে রেখেছিলাম। তারপর ২০০১ সালে কলকাতায় কলেজে ভর্তি হবার কয়েকমাস পর সপ্তাহান্তে বাড়ি যাবার আগে বাড়ির জন্য কিছু নিয়ে যাবার বাসনায় কি নেবো কি নেবো ভাবতে ভাবতে দেখি, পল্লবীর পিছন পিছন গিয়ে ঢুকেছি কোথায়?  না, কলেজপাড়ায় কাঁচ ঢাকা কেক-প্যাস্ট্রির দোকানে। আর কিছু ভাবতে হয়নি। পুরো কলেজজীবনে বাড়ি যাবার দিন আমার হাতে বেশিরভাগ দিনই থাকতো সেই 'ক্রিম কেক' বা প্যাস্ট্রির বাক্স।