Monday 21 December 2020

মহাভারত ও পাটিসাপ্টা

 

সাতসকালে কড়ে আঙ্গুলের আকারের দেড়খানি কলা, দড়কচা মার্কা ছিল বলে অর্ধেকটা ফেলে দিতে হল, আর সাথে দুটি ঘসঘসে বিস্কুট আর চা। তারপর থেকে এই যে দুপুর গড়িয়ে বিকেল হতে চলল, খাবার কথা কারো মনেই নেই যেন। একা খাবার কথা ছিল না আজকে। সুতরাং অপেক্ষা করতেই হয়। খিদের জ্বালায় দু কুঁচি শশা, গাজর চিবিয়েছি ছাগলের মত। সেসব আবার খিদের সময় অনুঘটকের কাজ করে। পেটের ভেতর ইল্বল, বাতাপি একসঙ্গে ভীমপলশ্রীর আরোহণ সেই যে শুরু করেছে তার আর অবরোহণের নামটি নাই। ইচ্ছে করে দুবাক্স খাবার একাই খেয়ে ফেলি। কিন্তু সেসব তো আর করা যায় না। পেটে কিল মেরে রোদ খাচ্ছি তাই। এমন শীতের রোদ্দুর! এমন সময় চাট্টি গরম ফুরফুরে ভাত আর পোস্তর বড়া একখানা পাওয়া গেলে, আহা রে! এই বড়া বলতে মনে পড়লো, একজনের কি যেন একটা ভাল দিনে সাথে থেকেছিলুম বলে সে বেজায় উদার হয়ে বলেছিল, “কি খাবি বল খাওয়াব।“ তা আমি বাঙালি ভোজনপটীয়সী নোলা সামলে বললুম “কদ্দিন বড়ার ঝাল খাইনি।“ এ বড়া অবশ্য বড়োলোক পোস্তর বড়া নয়। নেহাতই ডালের বড়ার ঝাল। এ জিনিস আমি শয়নে-স্বপনে- জাগরণে সর্বদাই খেতে পারি। করে খাওয়ানোর লোক পাওয়া ইদানিং দুস্কর বলে মাঝে মধ্যে বিরহ অসহ্য হলে নিজেই নিজের জন্য বানিয়ে খাই। তা এমন উদার “কি খাবি বল?” আবাহন শুনে স্বাভাবিক ভাবেই বড়ার ঝাল ছাড়া আর কিই বা মনে আসে! তা সে নাকি আমায় ছুটির দিনে সে জিনিস বানিয়ে খাওয়াবে বলেছিল। তারপর অবশ্য দু-দুটো ছুটির দিন কেটে গেছে। আমার বড়া এখন ডালের কৌটোর ভেতরেই বিরাজ করছে। যাক গে, পেলে ভালো নইলে বানিয়েই নেবো। এসবে কি আর আমি ডরাই, সখি! 

এই যে, বসে বসে খটমট করে টাইপ করতে করতে কটা মনের কথা কইছি, তাতেও মাঝে মধ্যে শীতের খাবার-দাবারের কথা মনে করে প্রাণটা হু হু করে উঠছে। বাড়ি গেলে ঘরে-বাইরে কতই না খাবারের অনুসঙ্গ। এই মনে কর, সকালে ডাইজেস্টিভ বিস্কুট আর চা এর বদলে সাদা সাদা ফুলকো লুচি আর ঝাল-ঝাল আলুর তরকারি, মটরশুঁটি আর ধনেপাতার অলংকারসহ। তারপর মনে কর, তার সঙ্গে যদি একখানি পন্ডিতের দোকানের নলেন গুড়ের রসগোল্লা জুটেই যায়, তাহলে তো! যাক যে যাক, এসব মনে করে বড় বড় শ্বাস বের হয়ে আসছে। কদিন ধরে পিঠে আর পাটিসাপ্টার জন্য দীর্ঘশ্বাস ফেলে ফেলে প্রায় লোকজনের মনে সন্দেহই ঢুকিয়ে দিচ্ছিলুম যে নির্ঘাত এ ব্যাটার কোভিড হয়েছে। শ্বাসকষ্ট হচ্ছে। সেদিন আর থাকতে না পেরে নিজেই কটা রেসিপি ইত্যাদি দেখে পাটিসাপ্টা বানাতে গেলুম। ভেতরের পুরটা আদতে ক্ষীরের হবার কথা। কিন্তু অত করার ধৈর্য্য থাকলে তো হয়েই যেত! এমনই মরিয়া দশা যে ফ্রিজে দুধের বোতল নেই দেখে সেটা আর দোকান থেকে আনার পর্যন্ত তর সইলো না। কফির জন্যে রাখা কফিমেটের কৌটোটা হাতে পেয়েই- 'জয়তারা, এইটাই গুলে ঢেলে দেব', বলে কানে মহাভারত গুঁজে শুরু করে দিলুম। নারকেলের গুঁড়ো, ফ্রিজে থেকে থেকে প্রায় জীবাশ্ম পর্যায়ে চলে যাওয়া একখাবলা গুড় আর খানিকটা কফিমেটের গুঁড়ো মিশিয়ে একখানা মিষ্টি মণ্ড তৈরী হলো। যেটা দেখিয়ে- এই দেখ 'পাটিসাপ্টার পুর' বললে আমার মা কেন, আমার গোপালনগরের বাড়ির বেড়ালটাও হাসবে। একবার মনে হলো যাক যা হয়েছে হয়েছে। একে নিয়ে আর উচ্চাশা করে লাভ নেই। এইটাই নাড়ুর মত পাকিয়ে খেয়ে নিই বরং। কিন্তু কানের ভেতর দিয়ে ততক্ষণে গলগল করে ঢুকে যাচ্ছে অরণি, উপমন্যু আর বেদ এর পরম অধ্যবসায় আর শত প্রলোভনেও লক্ষ্যে স্থির থাকার কাহিনী। আমিও পূর্বপুরুষদের সেসব সুকীর্তির কথা শুনে সেই কুক্ষনেই ভুল করে লক্ষ্যে স্থির থাকার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললুম। যতক্ষণে বুঝতে পারলুম যে ভুলটা করেই ফেলেছি ততক্ষনে দেখি হাতে চালের গুঁড়ো, ময়দা-টয়দা আর ভগবান জানেন কি কি মিশিয়ে একটা ট্যালট্যালে গোলার বাটি হাতে মুখ ভেটকে দাঁড়িয়ে আছি। ইয়ারফোনে শুনি মহাভারতের ব্যাখ্যাকার বলছেন-'অনুশোচনা রাখবে না, কাজের ভালো মন্দ কিছু হয় না। কাজ কাজই।' মহাভারতেরই কোনো উপকাহিনীর ব্যাখ্যা দিচ্ছেন নিশ্চয়ই। আমি মাঝখানে কিছুক্ষন শুনিনি বোধহয়। তাল পাচ্ছিনা। এরপরেও ফেঁদে বসা কাজ শেষ না করলে মহাভারত রচয়িতা ঠিক পাপ দেবেন। "জয় বেদব্যাস" বলে একহাতা ওই ট্যালট্যালে বস্তুটি ফ্রাইং প্যানে ঢেলে দিয়ে আর এক হাত দিয়ে জিমন্যাস্টিকের স্টাইলে তাকে ছড়িয়ে দিতে গিয়ে দেখি সে ব্যাটা প্যানের গায়ে সেঁটে গেছে। তাকে নাড়াতে না পেরে আর এক হাতা। তারপর আরো একহাতা। এই করে যতক্ষণে ব্যাপারটা পুরো প্যানে ছড়ালো ততক্ষনে সেটা আর পাটিসাপ্টার পাতলা ফুরফুরে খোল নয়, মোটা কাঁথার মতো ধুসকো একটা কি যেন হয়ে দাঁড়িয়েছে। 

তারপর আর কি? সেই কাঁথার মধ্যে নারকেল গুঁড়ো, প্রাগৈতিহাসিক গুড় আর কফিমেটের মন্ডটা যত্ন করে শুইয়ে কাঁথা দিয়ে মুড়ে বাক্সে তুলে দিলুম। যতই হোক, সুচিন্তা নিয়ে শুরু করা কাজ যত্ন করে শেষ করতে হয়। তার পরিণতির কথা না ভেবেই। মহাভারতে বলা আছে।  

এই সেই কাঁথায় মোড়া নারকেলের মন্ড 

  

Sunday 20 December 2020

গপ্পগাছা

আচ্ছা খাঁদু, তুই কি সকালবেলার সদ্য নামানো তালের রস খেয়েছিস? একবার ছোটবেলায় খুব সকালে, রোদ ওঠেনি তখনও মনে আছে। কুয়াশা হয়েছিল বোধহয়। সদর দরজা দিয়ে ঢুকেই উঠোনের সামনেটা বুঝলি। ঝুমরোদা দেখি এক ক্যান ভর্তি তালের রস নিয়ে এসেছে। সদ্য নামানো। উফফ সে নাকি এক মহার্ঘ্য ব্যাপার। না মানে সদ্য নামানো তালের রস তো সত্যিই খুব মিষ্টি। আমার জানিস খেয়ে বিশেষ ভাল লাগেনি। তা সেকথা বলতেই তিনজনে বিস্তর অবাক হল। তখন অমন খারাপ লাগলে দুমদাম বলে দেওয়া যেত।  তিনজন মানে মা- বাবা- আর ঝুমরোদা। তারা পুরো একগ্লাস করে খেয়ে ধন্য ধন্য করছে। আর এদিকে আমার নাকে যেন বদখত একটা গন্ধ আসছে মনে হচ্ছে। এমন ছাড়া ছাড়া করে বলছি তার কারণ, অমনই মনে পড়ছে। ঘটনার আগা-পাশ-তলা আর কিছুটি মনে নেই। মিষ্টি স্বাদের বাজে গন্ধওয়ালা তরলটিকে এত তোল্লাই দেওয়ার কি আছে সেটা বুঝতে না পেরে নিজের রসনাকে দোষ দেব, না আর দুচুমুক দিয়ে দেখবো সেই দোটানায় ভোম্বলের মতন দাঁড়িয়ে ছিলাম মনে পড়ে। সত্যিই বেশ খারাপ খেতে লেগেছিল। আসলে কি বলত ছোটবেলায় নাক- কান- জিভ ইত্যাদি বেশ তীক্ষ্ণ ছিল বুঝলি। যত দিন গেছে তত ব্যবহার না করে করে ভোঁতা করে ফেলেছি। ঐ অসাধারণ শর্করার ভাণ্ডারকে ফাঁপিয়ে সুধারস তৈরির পদ্ধতি ততক্ষনে শুরু হয়ে গিয়েছিল যার প্রাথমিক গন্ধটাই আমার নাকে এসে লেগেছিল। ছোটকালে খারাপ অনুভূতি ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য তো থাকেই তার সাথে সাথে খারাপ কে খারাপ বলার উৎসাহও দেখেছি বেশ থাকে। এখন হলে হয়ত ওইটুকু গন্ধ নাক অবধি পৌঁছাতও না। বেশিরভাগ অপছন্দের জিনিস ইন্দ্রিয় অগ্রাহ্য করতে পারে এখন। বড় হয়ে যাবার এই একখানা বেজায় সুবিধা আছে বুঝলি। তুইও যখন আরও বড় হয়ে যাবি দেখবি নাকে বদ্গন্ধটন্ধ বিশেষ পাচ্ছিস না। বদবাক্য কান পর্যন্ত তেমন করে আর পৌঁছচ্ছে না। দূষিত দৃশ্য চোখ পার হয়ে মাথা পর্যন্ত যাবার পথ পাচ্ছে না। ইত্যাদি বিস্তর সুবিধা দেখবি। কেমন নিজেকে বেশ সাধক সাধক মনে হবে। খাবি, ঘুমবি আর নিজের কাজ করবি। একেবারে সরলরৈখিক জীবন। হ্যাঁ তা যা বলছিলাম। এখন মাঝে মাঝে মাথায় দুষ্টু বুদ্ধি খেলে জানিস, মনে কর যদি মাকে বলি, “তুমি আমায় বাচ্চা মানুষ পেয়ে জোর করে সেদিন তাড়ি খেতে বলছিলে! তারপর যদি ভাল লেগে যেত? আর কালক্রমে তাড়িখোর মাতাল হয়ে যেতুম! ও জিনিষের তো অভাব কোনোকালেই ছিল না আশেপাশে।” মনে কর, খুব গম্ভীর, আলোচনাযোগ্য পরিণত মানুষের গলায় যদি মাকে জিজ্ঞাসা করি এসব? করে দেখবো কি জবাব পাই, তারপর তোকে জানাবো। তবে কি জানিস আর কিছুটা বড় হয়ে একবার খালনা গিয়ে গুড়ের শাল থেকে অর্ধতরল তালের গুড় খাবার সৌভাগ্য হয়েছিল। আহা রে! সে কি ভাল! কি ভাল! তোর খালনার কথা মনে আছে? তুই গিয়েছিস বেশ কয়েকবার তোর বাবার মোটরসাইকেলে চেপে। তুই অবশ্য তখন পুঁচকে। মনে থাকার কথাও নয়। তা সে যাই হোক। খালনায় সাবেকি বাঁড়ুজ্জে বাড়ির জটলাটা থেকে বেরিয়েই বাঁয়ে ওই যে জগদ্দল দীঘির মতন পুকুরটা রে, আর তাকে পাক মেরে ইঁট বাঁধানো পায়ে চলা রাস্তাটা। সেইটে ধরে বড় রাস্তায় ওঠার আগেই ডাইনে প্রতি বছরই ওরা গুড় বানাতো জানিস। গুড় বানানোর ওই আয়তাকার জায়গাটা কি দিয়ে ওরা বানাতো সে আমি জানি না। মাটি দিয়ে? কে জানে? কি বিশাল রে বাবা! ওকে যে শাল বলে সে আমি জানতুম না। সেই আমার গুড় তৈরি দেখা। সারা পাড়া ম ম করছে গন্ধে। কি ভাল গন্ধ রে! ওই একই তালের রস থেকে তাড়ির অমন উৎকট গন্ধ আর গুড়ের ওই সুবাস! ভাবা যায়! ওই আর কি যেমন রান্না তেমন স্বাদ। আমি আর টুকুনদিদি বোধহয় ছিলুম। কিরে টুকুনদিদি তুই ছিলি তো সেদিন আমার সাথে? আর কে থাকবে ওখানে! তুইই ছিলি। দাঁড়িয়ে দেখছিলুম দেখে তারা দুজনকে দুটি ছোট বাটিতে করে গরম গুড় দিলে খেতে। ঈষদুষ্ণ গুড়ে তর্জনী ডুবিয়ে তারপর সাবধানে টপ করে পুরো আঙ্গুলটা মুখে ঢুকিয়ে দিবি, বুঝলি। তারপর আর সব ভুলে যাবি। বাটিটা ছোট ছিল বড্ড বুঝলি। তারপর আর কি, বাটি ফেরত দিয়ে দুজনে আঙ্গুল চাটতে ফিরে গেলুম আমি আমার পিসিমার বাড়ি আর টুকুনদিদি তার মামারবাড়ি। সে আর এক দারুণ মজার জায়গা ছিল তখন।