Wednesday 24 December 2014

তারকেশ্বর-বালিপুর-রাধানগর............ শেষ পর্ব

তারকেশ্বর-বালিপুর-রাধানগর............দ্বিতীয় পর্বের পর

রাজা রামমোহন রায় এর বসত বাড়ির ধ্বংসাবশেষ দেখে বেরিয়ে আসতে আসতে  মনে হচ্ছিল যে বাড়িটির যেটুকু অংশ এই দেড়শ-দুশো বছর ধরে প্রকৃতির সাথে যুদ্ধ করে এখনো টিকে আছে সেটিকে যদি সঠিক ভাবে সংরক্ষণ না করা হয়, উপরে একটা ছাউনির বন্দোবস্ত অন্তত না করা যায় তবে আর কতদিন এটি টিকে থাকবে? আর পাঁচটা ঐতিহাসিক স্থাপত্যের মতন এটিও ধ্বংস হবে কালের নিয়মেই। বর্তমানে সামান্য দু-পাঁচ টাকা এন্ট্রি ফী নিয়ে এটিকে পার্ক হিসেবেই ব্যবহার করা হচ্ছে। স্থানীয় লোকজন-প্রেমিক প্রেমিকার দল বাগানে ঘুরে বেড়াচ্ছে। এই বাড়িটি, তার মালিক বা তাঁর লড়াই, তাঁর মতবাদ, তাঁর কুসংস্কারবিহীন-স্বচ্ছ দৃষ্টিভঙ্গি এসব নিয়ে বিশেষ উত্সাহী নন কেউই। ভাবতে ভাবতে আবার এটাও মনে হলো যে সত্যিই কি  সংরক্ষণ করার আদৌ দরকার আছে? এই বাড়ি তো কতকগুলি ইঁট মাত্র। যাঁর কারণে এই জায়গার মাহাত্ম, সেই লোকটির কথা কতজন মনে রেখেছে? নিজের জীবন দিয়ে জগদ্দল গোঁড়া সমাজটাকে নাড়িয়ে দিলেন যিনি, সারা ভারতবর্ষের মেয়েদের নবজীবন দিলেন যিনি, তাঁর মতাদর্শ কি সত্যিই বাংলাদেশের লোকেরা আত্মস্থ করতে পেরেছে? ব্রিটিশ শাসককুল আইন করে সতীদাহ বন্ধ না করলে আরো কতদিন চলত কে জানে? এই দুশো বছর পরেও এখনো জন্মানোর পর থেকেই মেয়েদের বৃহত্তর অংশকে তাদেরই মা ঠাকুমার দল বোঝাতে থাকে যে তাদের জন্মানোর উদ্দেশ্য বিয়ে, আর তার অব্যবহিত পরেই সন্তান। পরবর্তী জীবনে সন্তান পালন। এই মনোভাবের গ্রাম-শহর-শিক্ষিত-অশিক্ষিত কোনো ভেদাভেদ নেই। পরিস্থিতি ভেদে বলার ভঙ্গিটা শুধু বদলে যায়। কোনো এক চার-পাঁচ বছর বয়সী বাচ্চা মেয়ের কথা মনে পড়ছে। তার ঠাকুমা তার সম্পর্কে তার সামনেই আমাদের বলেছিলেন "ওর মনে খুব দুঃখ জানত? গায়ের রং কালো তো, দিদিরা সবাই ফর্সা।" সেই শুনে একজন আধুনিকমনস্ক ব্যক্তির উত্তর ছিল, "ও নিজেই যত্ন নিতে শিখলে বয়সকালে সব ঠিক হয়ে যাবে।" অর্থাত ফর্সা হওয়াটা জরুরি। আমি বাচ্চাটিকে ততক্ষনাত জিজ্ঞাসা করেছিলাম, "কেন রে? ফর্সা না হলেই বা কি হয়?" বিনা দ্বিধায় বাচ্চাটির উত্তর ছিল, "বিয়ে হবেনা তো কালো হলে।" একটি পাঁচ বছরের বাচ্চা জন্ম থেকে বিয়ে-বাচ্চা-সংসার-স্বামী এসব শুনে শুনে বড় হলে সে এর বেশি আর কি উত্তর দেবে? এই যখন এখনো আমাদের বাংলার নব্বই ভাগ বাচ্চা মেয়েদের ভবিষ্যত তখন রামমোহন রায় এর বাড়ির ইঁট কটা রইলো না খসে পড়ল তা নিয়ে মন খারাপ করে আর কি হবে?

এগিয়ে চললাম রাধানগরের দিকে। পথের দুপাশে মাঝে মাঝেই বহু পুরনো সুন্দর কারুকার্য করা মন্দিরের ভগ্নাবশেষ। যার কোনো ইতিহাস কেউ জানে না। স্বপনকাকাও কিছু বলতে পারলেন না। এভাবেই আর কিছু বছর পরে এগুলোও নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে। রাধানগরে আছে রামমোহন মেমোরিয়াল হল। আমরা গিয়ে দেখলামতার সদর দরজায় তালাবন্ধ। আর বাইরে থেকে এক ভদ্রমহিলা তালাটার সাথে যুদ্ধরত। চাবি দিয়ে তালাটা কিছুতেই খুলছে না। বললেন তিনি নাকি সেখানকার দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মচারী। ভাবলাম ভালই হলো। ইনিই সব ঘুরিয়ে দেখাতে পারবেন। অমা! সে গুড়ে বড় বড় দানার বালি। তালাটা স্বপনকাকা চেষ্টা করে খুলে দেবার পর, তিনি চট করে ভেতরে ঢুকে কোলে করে তুলে নিয়ে এলেন একটি ছাগলছানা। আমরা গোল গোল চোখে তাকিয়ে আছি দেখে একগাল হেসে বললেন "এর জন্যই তো তালাটা খোলার চেষ্টা করছিলাম, তা তোমরা ঘুরে দেখো না। আমি একে বাড়িতে রেখে আসি। তোমাদের হয়ে গেলে দরজাটা টেনে দিও। গরু-টরু ঢুকে পড়ে তো নইলে।" বলে পান খাওয়া বাদামী দাঁতের এবড়ো খেবড়ো সারি আরো একবার দেখিয়ে চলে গেলেন। আমরাও গুটি গুটি ঢুকে পড়লাম। এখানেই নাকি রাজা রামমোহন রায়ের বাড়ি ছিল এখন একটি স্মৃতিমন্দির। আর আছে একটি বেদী যেটি নাকি ১৮৫৯ সালে রেভারেন্ড জেমস লঙ বলেছিলেন এটিই রাজা রামমোহন রায়ের জন্মবেদী। এই রইলো ছবি।

   
এই বাড়িটির ঠিক উল্টোদিকেই আছে ব্রিস্টলে রাজা রামমোহন রায়ের সমাধি মন্দিরের হুবহু নকল একটি স্মৃতিসৌধ। তার লাগোয়া একটি গ্রন্থাগার।  সেই নকল স্মৃতিসৌধের ছবি দিলাম নিচে। সঙ্গের লেখাটাও ব্রিস্টল এ আসল সমাধি মন্দিরের গায়ে উত্কীর্ণ লেখাটির প্রতিরূপ।


রামমোহন রায় কে এখানেই ফেলে রেখে এখান থেকে আমরা গেলাম খানাকুলের ঘণ্টেশ্বর মন্দির দেখতে। নাম শুনে যদিও মনে হয় যে শিব মন্দির আসলে এটি শক্তি মন্দির।   ভেতরে পাথরে খোদাই করা দশবাহু দুর্গার মূর্তি।


খানাকুল হলো স্বপনকাকার পূর্বতন কাজের জায়গা। সুতরাং তিনি সবই চেনেন। চেনা একটি দোকানে চা খেয়ে গোপীনাথ মন্দিরের উদ্দেশে রওনা হলাম। পথে একটি ঘটনা ঘটল যেটি বলার লোভ আমি সামলাতে পারছিনা। পথে পড়ল একটি দর্জির দোকান। যেখানে নাকি স্বপনকাকা একদম প্রথম জীবনে দর্জির কাজ শিখেছিলেন। আমরা বাইরে  রইলাম। স্বপনকাকা ভেতরে গিয়ে কথা বলতে লাগলেন। হটাত দেখি মালিক বেরিয়ে এসেছেন। স্বপনকাকা ভেতরে গিয়ে কি বলেছিলেন জানিনা। তিনি দেখি প্রচন্ড গদগদ হয়ে পিনাকীকে বলছেন, "আমার কি সৌভাগ্য, আপনি আমার দোকানে এসেছেন। আমার দোকান ধন্য হয়ে গেল। আপনার সাথে আলাপ করে খুব খুশি হলাম। আমি স্বপনের কাছ থেকে ফোন নম্বর নিয়ে মাঝে মাঝে আপনাকে ফোন করব কিন্তু। কি সৌভাগ্য! একটু  অন্তত: বসে যান, একটু চা-কফি-ঠান্ডা কিছু খান........" সত্যি বলছি ঠিক এই কথাগুলোই বলেছিলেন আমাদের যথাসম্ভব "হেঁ হেঁ.....না মানে....ইয়ে ঠিক আছে......হেঁ হেঁ......" এসব উপযুক্ত ধরতাই এর ফাঁকে ফাঁকে। পিনাকীর মুখটা দেখছি ক্রমশঃই ভেবলু হয়ে উঠছে। উনি তাকে বোধহয় নোবেলজয়ী কোনো বৈজ্ঞানিক ভেবেছেন। আর আমার পেট থেকে ক্রমশঃই ভসভসিয়ে হাসি উঠে আসছে। কোনোক্রমে তাঁর হাত থেকে ছাড়া পেয়ে ফের মোটরবাইক এ উঠেই হ্যা হ্যা করে মিনিট পাঁচেক হেসে নিলাম। তারপর স্বপনকাকাকে বললাম তুমি ঠিক কি বলেছিলে আমাদের সম্পর্কে বলত? সেও দেখি খ্যাক খ্যাক করে হাসছে। যাই হোক হাসি টাসি সামলে একটা কথা ভেবে অবশ্য খুব লজ্জা পেয়েছিলাম যে, আমাদের দেশে বিজ্ঞান গবেষণা বিষয়টা পাঁচজন সাধারণ মানুষ যাঁরা এই পেশায় নেই তাঁদের কাছে কতটা দূরের বিষয় এখনো। নুন্যতম ধারণা নেই কারো। সুতরাং ভালো মেধার তুখোড় বুদ্ধির ছাত্ররা কেমন করে আকৃষ্ট হবে এ রাস্তায় হাঁটতে। এটা আমাদেরই লজ্জা। আমরা যারা এই বিষয়ে কিছুটা অন্তত জানি তারাই পারিনি আমাদের বাবা-কাকা-মামা-বন্ধুবান্ধবদের এ সম্পর্কে অবগত করতে। তাই এখনো একজন সাধারণ গবেষককে কেউ বিশিষ্ট বৈজ্ঞানিক ভেবে ভুল করে, আশা করে তার থেকে বিশাল কিছু স্বাস্থ্য বা সামাজিক পরিবর্তনের।

গেলাম গোপীনাথজীর রাসের মেলা দেখতে। মেলা বিশেষ কিছু দেখলাম না। সাধারণ দোকান পাতি। আর পাঁচটা মেলার সাথে বিশেষ ফারাক নেই। যদিও জিলিপির দোকানগুলো চোখ টানছিল খুবই। কিন্তু দুপুরের ভরপেট খাওয়া আর রাতের জোরদার মেনু স্মরণ করে কষ্ট করেই লোভ সামলালাম। মন্দির দেখলাম।

গোপীনাথ মন্দির 
পাশেই রাধা-গোবিন্দ মন্দিরের সামনে তিনদিন ধরে হচ্ছে নর-নারায়ণ সেবা। এত লোক একসাথে বসে খাচ্ছেন। সামান্যই খাবার। খিচুড়ি। হয়ত সবার বাড়িতেই আজ এরচেয়ে ভালো মেনু। তাও চারচাকা দামী গাড়ি থেকে নেমে আর দুচাকার লড়ঝরে সাইকেল থেকে নেমে পাশাপাশি বসে একহাতা ঝোল ঝোল খিচুড়ি খাওয়ার আমেজ বোধহয় আলাদা। পাশেই সুন্দর করে আলোয় সাজানো রাধাগোবিন্দ মন্দির।

রাধাগোবিন্দ মন্দির 
ফেরবার পথে রাসপূর্নিমার ঝকঝকে জ্যোত্স্নায় মনে হচ্ছিল এই যে রাস উপলক্ষ্যে মেলা-আনন্দ-লোকসমাগম এতকিছু মানুষের এই ছোটছোট আনন্দটা সত্যি? নাকি ইন্টারনেট-বিদেশযাত্রা-মহাকাশ ভ্রমণ-ইন্টারন্যাশনাল স্কুল-সবকিছুর ছোঁয়া বাঁচিয়ে স্কুল এর পড়া শেষ হতে না হতেই স্বপনকাকার মেয়ের মত হাজার হাজার ভারতীয় মেয়েদের শুধুমাত্র বিয়ের জন্য তাড়াহুড়ো এই চরম সত্যিটাই সত্যি?

মোটরসাইকেল-এর হুহু গতি, চকচকে জ্যোত্স্না, দুপাশে মাঠের পর মাঠ ধানক্ষেত আর শিরশিরে ঠান্ডায় মনটা দোলাচলে দুলছিল। খুশি হতে গিয়েও কিরকম ভাবে যেন পুরোপুরি খুশি হতে পারছিলাম না। ভারী হয়ে আসছিল মনটা।


(শেষ)  
    

Friday 19 December 2014

তারকেশ্বর-বালিপুর-রাধানগর............দ্বিতীয় পর্ব

তারকেশ্বর-বালিপুর-রাধানগর ভ্রমনের যে গল্পটা আপনাদেরকে বলতে শুরু করেছিলাম, ঠান্ডার চোটে আর ল্যাবের চাপে সে গপ্পে খানিক বাধা পড়ে গেছিল। সে জন্য আমি আন্তরিক ভাবে দুঃখিত। গলবস্ত্র হয়ে ক্ষমা টমা চেয়ে নিয়ে বাকি অংশটা বরং বলে ফেলি কেমন?

বালিপুরে দুদিন ধরে ঠাকুমা-কাকিমাদের অনবদ্য রান্নাখেয়ে দেয়ে যখন মনটা তর-চোখটা আধবোজা আর ভুঁড়িটা আরো খানিকটা মোটা হয়ে উঠেছে তখন এসে পৌঁছালো মাধবী পিসি। যাঁর কথা আগের পর্বে বলেছি। সঙ্গে বিশাল এক ক্যান ভর্তি বাড়ির গরুর ঘন দুধ। আর স্বপন কাকা এনে হাজির করলো সাড়ে তিন কেজি ছোটো ছোটো পুঁটি মাছ। কারণ বৌমাটি দুধ এবং পুঁটি মাছের ভক্ত। বৌমাটির তো তখন "এতা কাবো, ওতা কাবো, থব কাবো" গোছের অবস্থা। কোনটা ছেড়ে কোনটা খাই? উঠোনে পা ছড়িয়ে বসে সবাই মিলে সেই মাছের পাহাড় বাছা শেষ হলো। তারপর উঠেই শুনি একটা অপ্রত্যাশিত খবর। বালিপুর থেকে রাধানগর মানে রাজা রামমোহন রায় এর জন্মস্থান নাকি খুব সামনে। ওঁনার নিজের তৈরী বাড়ির ধংসাবশেষ এখনো রয়েছে। এবং আমরা সেখানে যাব দুপুরে খাওয়া দাওয়ার পরে। স্বপনকাকা সারথী। সঙ্গে খানাকুলের বিখ্যাত গোপীনাথজী-র রাসের মেলা আর ঘণ্টেশ্বর মন্দির ফাউ পাওনা। একটা দেখলে দুটো ফ্রি। শুনেই তো আমার পায়ের নিচে সর্ষেগুলো কিলবিল করে উঠলো। মনটা উড়ু-উড়ু হয়ে গেল। এখানে এসে যে অমন একটা দর্শনীয় স্থান অপ্রত্যাশিত ভাবে দেখা হয়ে যাবে, কে জানত? আনন্দের চোটে কোঁত-কোঁত করে খানিকটা দুধ খেয়ে, ঝপাঝপ স্নান সেরে, পুঁটিমাছের ঝাল দিয়ে তারিয়ে তারিয়ে ভাত খাওয়ার লোভ সামলে চটপট ভাত-মাছ খেয়ে নিয়ে, তীর্থের কাকের মত স্বপনকাকার দিকে চেয়ে বসে রইলাম দুজনে। সে বেচারা ব্যবসাপাতি সামলে-সুমলে, ঘরে ফিরে, স্নান খাওয়া সারছে। আর আমাদের দুজনের দুজোড়া চোখ ড্যাবডেবিয়ে তাকে অনুসরণ করে চলেছে। আমাদের নীরব তাড়ার চোটে কোনক্রমে নাকেমুখে দুটো গুঁজেই বেচারাকে মোটরবাইক নিয়ে বেরোতে হলো। 

দুপুর তিনটের সময় দুজনে স্বপনকাকার পিঠে চেপে রওনা হলাম। পথে মুন্ডেশ্বরী পার হলাম কুড়কুড়ি-র ঘাটে। 

কুরকুড়ি ঘাটের পথে

সেই বাঁশের সাঁকো। অদ্ভূত সুন্দর জায়গাটা। নেহাত পঁচিশে ডিসেম্বর আর পয়লা জানুয়ারিতে পিকনিক করিয়ের দল জায়গাটার খোঁজ পায়নি তাই জায়গাটি এখনো কুমারীই রয়ে গেছে। আমাদের রূপনারায়ণ-এর তীরের মতন এখনো একে বছর বছর ডিসেম্বর-জানুয়ারী মাসে গণধর্ষিতা হতে হয়না। শান্ত নিরিবিলি বালির চর। তন্বী মুন্ডেশ্বরী সিধে একটা বাঁশের সাঁকো। সেখানে কখনো কখনো বাচ্চা কাঁকে মা, ধুতি পরা দাদু, সাইকেল বা মোটর সাইকেল এ সাধারণ যাত্রী পারাপার করছে।সেখানে আমাদের মতন শহুরে জামাকাপড় পরা চোখে সানগ্লাস আঁটা বেয়াদবরা বড়ই বেমানান। বাঁশের সাঁকোটার ঠিক সোজাসুজি একটা ঋজু তালগাছ যেন ঠিক ছবি তোলার জন্য মাপ করে বসানো। 

কুরকুড়ি-র ঘাটে মুন্ডেশ্বরী 

সাঁকো পেরিয়ে এসে একটা বাঁশেরই ছোটো মাচা। পারানির কড়ি দিতে হবে এখানে। মন ভরে গেল কুড়কুড়ি-র ঘাট দেখে। স্বপনকাকাকে বলে কিছুক্ষণ দাঁড়ালাম এখানে। তিনি অবাক। তার রোজকারের এই রাস্তা এই সাঁকোতে কেন এতটা সময় নষ্ট করছি আমরা বুঝতেই পারলেন না। আমাদের ছেলেমানুষী দেখে হেসেই খুন। "চল চল দেরী হয়ে যাচ্ছে, অনেকটা রাস্তা যেতে হবে, আরো সুন্দর সুন্দর জায়গা আছে সামনে।" অগত্যা আবার এগোলাম। 

আবার আসতে রাজি আছি এই সাঁকো পেরোতে     
গ্রাম পঞ্চায়েতের তরফ থেকে গ্রামের ভেতর ভেতরের রাস্তা গুলোকেও বাঁধিয়ে দেওয়া হয়েছে, এতটা রাস্তা যেতে কোথাও পুরনো সেই লাল মোরাম ফেলা রাস্তা নেই, সবই ঢালাই করা রাস্তা। কিন্তু এখনো এইসব জায়গা কিরকম গ্রাম তা বলে বোঝানো যাবে না। ভালো হাসপাতাল, ভালো স্কুল- কলেজ কিচ্ছু নেই। শুধু ঘরে ঘরে ডিস্-এন্টেনার বাহুল্য চোখে পড়ার মত। স্বপনকাকা নানান রকম গল্প করতে করতে চলেছিলেন। আমার পেছনে বসে বসে একটা কথা মাথায় ঘুরছিল শুধু। আমরা চলেছি রাজা রামমোহন রায় এর বসত বাড়ি দেখতে। যে বাড়ি নাকি তিনি নিজে বানিয়েছিলেন থাকার জন্য, যখন নাকি তাঁর বাবা তাঁকে ত্যাজ্যপুত্র করেছিলেন সমাজবিধির বিরুদ্ধে যাবার জন্য। আমার মাথায় ঘুরছিল একটা কথা যে, এই জায়গা এখনই এরকম গ্রাম, আজ থেকে প্রায় দুশো বছর আগে রামমোহন রায় এর সময়কালে এই জায়গা কেমন ছিল তার আন্দাজও বোধহয় আমরা আজ ২০১৪ সালে বসে করতে পারি না। সেই শিক্ষা -সভ্যতার সংস্পর্শবিহীন গ্রামে রক্ষণশীল গোঁড়া হিন্দু পরিবারে জন্মে এত মনের জোর, এত পরিস্কার মাথা, এত সজাগ দৃষ্টিভঙ্গি কেমন করে পেলেন তিনি? দাপুটে জমিদার বাবার বিরুদ্ধে গিয়ে, পারিবারিক সম্পত্তির মায়া ত্যাগ করে, সমাজের বিরুদ্ধে গিয়ে এই অজ গাঁয়ের এই লোকটির মত কিছু লোক সেদিন দূরদৃষ্টির পরিচয় দিয়ে সব প্রতিকূলতাকে সরিয়ে মেরুদন্ড সোজা করে দাঁড়াতে পেরেছিলেন বলেই হয়ত আজ আমার মতন মেয়েরা ব্লগ এ নিজের কথা লিখতে পারছে। নইলে শিক্ষা-সভ্যতার আলো দেখতে এদেশের মেয়েদের আরো কত শত বছর লাগত কে জানে? মনে মনে সেইসব মহামানবদের প্রনাম করলাম। চলতে চলতে এসে পৌঁছলাম নাঙ্গুলপাড়া। এখানেই সেই তীর্থস্থান। জীর্ণ বোর্ড ঢোকার মুখে গেটের ওপরে।



ভেতরে ঢুকতেই ডানহাতে বাড়ির মালিকের আবক্ষ মূর্তি। আর সোজা নাক বরাবর তাকালে একটি পাকা ভাঙ্গা বাড়ির কঙ্কাল। সেইটিই আমাদের দ্রষ্টব্য। এই বাড়িতে থাকতেই নাকি নিজের বৌদিকে সহমরণে বাধ্য করার প্রতিবাদে রাজা রামমোহন রায় সহমরণ প্রথার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ান। সেসব কথা এই বাড়ির বাগানের এখানে ওখানে বড় বড় বোর্ড এ লেখা আছে। সাথে তাঁর  জীবনের নানা ঘটনার কথা। এই সেই বাড়ি।

  




আর ডানদিকে বাঁদিকে বাগান। বহু পুরনো আমলের বড় বড় গাছ জায়গাটিকে যেন থমথমে করে রেখেছে। কেমন যেন পুরনো দিনের অনুভূতি মনের মধ্যে জেগে ওঠে। আছে একটি পুকুরও। সেখানে নাকি পিকনিক মরশুমে বোটিংও হয়। এখন পুকুরে অযত্নের ছাপ স্পষ্ট।

বাগানে আছে একটা তিনতলা watch tower, মনে হয় ওটা পরে বানানো। সেখানে উঠে চারপাশটা সুন্দর দেখা যায়। বাগানের প্রাচীনত্বের সাথে এই watch tower টি বেমানান। বসত বাড়িটি দেখে মনটা কেমন যেন ভারী হয়ে গেল। বেরিয়ে এলাম। পরবর্তী গন্তব্য রাধানগর গ্রাম। যেখানে আছে রামমোহন মেমোরিয়াল হল। সেখান থেকে যাব কাছাকাছির মন্দিরগুলো দেখতে। কিন্তু আমার কেমন যেন আর ভালো লাগছিল না কোথাও যেতে। যাই হোক, এগিয়ে চললাম রাধানগরের দিকে।

Sunday 14 December 2014

আজকে স্নান? পাগল?



সেই গল্পটা মনে আছে তো? ওই যে প্রচন্ড কিপ্টে একজন লোক কে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল, "আপনি স্নান করেন না কেন?" তার উত্তরে তিনি বলেছিলেন, 'ধরো, তোমায় দুটো দড়ি দেওয়া হলো। একটা তুমি রোজ কূয়ো-র জলে ডোবাবে আর তুলবে। আর অন্যটা বাড়িতে শুকনো জায়গায় রেখে দেবে। কোনটা বেশিদিন টিকবে বলে তোমার মনে হয়? আমাদের শরীরটাও হলো গিয়ে ওরকম দড়ির মতো। যত জল লাগবে তত তাড়াতাড়ি নষ্ট হবে। তার পর ধরো না কেন স্নানের সময় তেল, সাবান, গামছা এসবের খরচখরচা তো আছেই।' গল্পতে এই কিপ্টে ভদ্রলোক যতই হাসির খোরাক হন না কেন আমি কিন্তু মাঝে মাঝে এই লোকটির এই কথাটি বেদবাক্যি বলে মনে করি। বিশেষতঃ এই শীতকালে। না দাঁত বার করার মতন কিছু হয়নি। আজকের মতন এরকম একটা দিনে চান ফান করার মতন বিতিকিচ্ছিরি কাজে কেউ সময় নষ্ট করে? এ কি আর আমার সেই ছোটবেলার শীতকালের স্নান? চরচড়ে শীতের রোদে অনেকক্ষণ ধরে সর্ষের তেল মেখে রোদে রাখা গরম জলের সাথে আরো খানিক গরম জল মিশিয়ে উঠোনেই রোদের মধ্যে ঝুপঝাপ স্নান সেরে নেওয়া? একে শীতকাল, তায় আবার আকাশ জুড়ে মেঘ করেছে, সঙ্গে তেহাই হিসেবে আজ আবার রবিবার। ত্রহ্যস্পর্শ। সকাল দশটার সময় পর্দার ফাঁক দিয়ে আলো আসছে কিনা দেখে নিয়ে অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে বিছানায় উঠে বসতে হয় এবং সঙ্গে সঙ্গে কতগুলো শপথ করে ফেলতে হয়। যেমন, আজ আমায় কেটে ফেললেও আমি ঘর থেকে বেরোব না। তারপর কিছু রান্নাবান্না করব না, ফ্রিজ হাঁটকে যা বেরোবে তাই দিয়ে কাজ চালাব। কাজ না চললে দোকানে ফোন করে কাজ চালাবার ব্যবস্থা করব। অত্যন্ত জাগতিক ও জৈবিক প্রয়োজন ছাড়া সারাদিন লেপের ওম ত্যাগ করবনা। বিছানায় বসেই সিনেমা দেখা, গপ্পের বই পড়া, গান শোনা, ইন্টারনেট এ দেশের দশের খবর নেওয়া, হাচিকোকে ভ্যাংচানো, হাচিকোর ঘুমের সময় বিটকেল আওয়াজ করে ওকে চমকে ঘুম ভাঙিয়ে দেওয়া ইত্যাদি ইত্যাদি যাবতীয় গুরুত্বপূর্ণ কাজকর্ম সারব। আর মঝে মাঝেই একটু করে ঘুমিয়ে নেব। আর এর মধ্যে স্নান? পাগল? আজকে স্নান মানে তো অপরাধ। এইসব শপথ টপথ নিতে নিতেই দশটা থেকে অন্ততঃ এগারোটা বাজবে। তারপর জনগনের ঠেলায় ঝুঁটি টুঁটি সামলে আয়নার সামনে নিজেকে মুখ ভ্যাংচাতে-ভ্যাংচাতে দাঁত মাজতে হবে। তারপর বারোটার সময় ফ্রিজে রাখা চিকেন আর ভাত খেয়ে সারাদিনের জন্য আবার লেপের তলায় চলে যেতে হবে। 

বাপরে বাপ। কত্ত কাজ। এসব কাজ সেরে, হাচিকোকে খুঁচিয়ে শেষে মনে প্রবল বিরহ পেল। 'এএএই শীইইতে-মেঘলা দিইইনে-বাইরেএএএ  থাআআআকে নাআতও  মওওন। কবে যাবওও, কাছে পাবওও, ওগো লেপের নিমওওন্ত্রণ।'-গাইতে গাইতে লেপে ঢুকতে যাব, সেই মাহেন্দ্রক্ষণে জনগণ আমায় খোঁচালো। "কিরে তুই সত্যি স্নান করবি না?" 
করুণার দৃষ্টিতে তাকালাম। মনে মনে বললাম "ভগবান, এই অর্বাচীনকে তুমি ক্ষমা করে দিও ঠাকুর। এ জানে না এ নিজের কি ক্ষতি করছে এই শীতে রোজ রোজ স্নান করে। ভিজে দড়ি আর শুকনো দড়ির গল্পটা একে মনে করিয়ে দিও ঠাকুর।" কিন্তু এসব কথা তো আর মুখে বলা যাবে না। সুতরাং বললাম, "আজকে ছেড়ে দে। কাল ঠিক করব। কাল রোদ উঠবে, আমি ওয়েদার ফোরকাস্ট এ দেখে নিয়েছি (এখন দেখাচ্ছে কালও নাকি মেঘ বৃষ্টি হবে। হায় হায়!!!!! কাল আর ছাড়ান পাবোনি গো ঠাকুর। কাল গায়ে জল ঢালতেই হবে। নইলে জনগণ আমার গায়ে ঠান্ডা জলই না ঢেলে দেয়! নিজে করলে তাও গরম জল পাব। কি যন্ত্রণা!!)।"
মনটা সেই আগামীকালের সমাগত দুঃখে এত ভারী হয়ে গেল কি বলব। এরকমও মনে হতে লাগলো কেউ আমার বন্ধু নয়। আপনজন? ছোঃ !! আপনজন কি এই শীতে-মেঘলায় গায়ে জল ঢালার পরামর্শ দেয়? রাগে-দুঃখে বারান্দায় চলে গেলুম। গিয়েই বাপ বাপ বলে আবার ঘরে ঢুকে আসতে হলো যদিও। কি হওয়া কি বলব! তার মধ্যে ঝির ঝির বৃষ্টি। বারান্দায় রাখা একমেঅদ্বিতীয়ম কারিপাতার গাছটা পর্যন্ত এই হাওয়ায়-ঠান্ডায়-বৃষ্টিতে দিব্যি স্নান টান করে চকচকে ভেজা সবুজ পাতা নাড়িয়ে আমায় ভ্যাংচাচ্ছে। 



দেখে শুনে মনে মনে ভেউ ভেউ করে কাঁদতে কাঁদতে আর কাঁপতে কাঁপতে আরো দীর্ঘ্য দীর্ঘ্যশ্বাস ফেলে ঘরে ঢুকে এলাম। গুটি গুটি লেপের তলায় ঢুকে আপাতত প্রার্থনায় বসব ভাবছি। "হে ভগবান, কিছু একটা করো, কাল যেন রোদ ওঠে, নইলে যেন ঠিক স্নানের সময়টাতে অন্ততঃ ইনস্টিটিউট এর জলের সাপ্লাই বন্ধ হয়ে যায় ঠাকুর।"


Monday 8 December 2014

তারকেশ্বর-বালিপুর-রাধানগর............প্রথম পর্ব

আগের দিন যে কথাটা বলছিলাম, ওই যে বালিপুর বেড়াতে যাবার গল্প। সে গল্পটাই আজ শোনাতে বসেছি। বালিপুর হল হুগলী জেলার ছোট্ট গ্রাম। তারকেশ্বর থেকে দুই নম্বর জাতীয় সড়ক ধরে আরামবাগের দিকে যাবার সময় চাঁপাডাঙ্গা-র পরে দামোদরের পাকা সেতু পেরিয়েই পুরশুড়া থেকে যে পাকা রাস্তাটা গাছ-গাছালি আর আদিগন্ত ধানক্ষেতের মধ্যে দিয়ে বামদিকে ছত্রশালের দিকে এগিয়ে গেছে সেই রাস্তা ধরে দশ বারো কিলোমিটার গেলেই বালিপুর। সেই যেখানে মুন্ডেশ্বরী নদী পথচলার ক্লান্তিতে দুভাগ হয়ে আবার পরে দুটি ধারা মিশে গিয়ে সৃষ্টি করেছে 'উদনা'-র চর, সেই সেখানে হলো গিয়ে বালিপুর গ্রাম। সেখানে আছে একটি মাত্র স্কুল- একটিমাত্র বাজার-বেশ কয়েকটি মন্দির-সঙ্গে ঘরে ঘরে হরেক চ্যানেল এর হরেক কিসিমের সিরিয়াল এর সাড়ে বত্রিশ ভাজা-এমুড়ো থেকে ওমুড়ো পর্যন্ত ধান আর শাকসবজির ক্ষেত-মুন্ডেশ্বরী নদীর বাঁকে প্রতিদিনের নরম-আদুরে সূর্যাস্ত-আর আছে পিনাকীর ফেলে আসা ছেলেবেলার প্রথম পাঁচটি বছর। 
বালিপুরে সন্ধ্যে নামার আগে মুন্ডেশ্বরী নদীর ঘাটে 
সেই ফেলে আসা পাঁচটি বছরের স্বাদ নিতেই এত বছর পর আবার যাওয়া। তারকেশ্বরে ট্রেন থেকে নেমে আমরা গেলাম তারকেশ্বর মন্দির দেখতে। বহু ছোটোবেলায় আমি নাকি গেছিলাম, মা বাবার মুখে শুনি। অবশ্যই একা নয়, আয়েশ করে গ্যাঁট হয়ে তাঁদের কোলে চেপে বসে। তা  "সেসব আমার মনে তো নেই।" তাই সে অর্থে আমার প্রথম বার দেখা তারকেশ্বর মন্দির। বিশেষ কিছু বলার নেই। বিখ্যাত মন্দির যেমন হয়। জল-কাদা-অতি উত্সাহী ভক্ত কুলের ঠেলাঠেলি। এই বুঝি পুণ্যের খাতায় এন্ট্রিটা ফসকে গেল। মন্দিরের সামনে গলি। পেঁড়ার দোকান। জুতো রেখে যাবার জন্য আকুল টানাটানি ইত্যাদি ইত্যাদি। আমরা চারজন মন্দিরের সামনে থেকে ঘুরে, দুধপুকুর দেখে,  "এই ঠেলাঠেলিতে আর তোমার দরবারে সশরীরে পৌঁছবার দুঃসাহস দেখালাম না বাবা, খ্যামা দাও"- এই বলে দূর থেকে বাবা শিবের কাছে এপ্লিকেশন পাঠিয়ে গলির দোকানে ধোঁয়া ওঠা ভাত-তরকারী সাঁটিয়ে সোজা বালিপুরের দিকে। 

বালিপুরের কথা আমি পিনাকীর মুখে শুনে এসেছি সেই প্রথম দিন থেকেই। পরের দিকে হয়ত বারবার বলার কারণে উত্সাহ হারিয়ে হুঁ-হা দিয়ে কাজ সেরেছি। আমার ছেলেবেলা-বুড়োবেলা সবটাই একই জায়গায় কেটেছে এবং ভবিষ্যতেও কাটবে বলে হয়ত ছোটবেলার একটা বড় অংশ বেমালুম হাতছাড়া হয়ে যাবার ব্যথাটা ধরতে পারতাম না ঠিক করে। কিন্তু সেখানকার সময়টুকু, মানুষজন বোধহয় ঢুকে গেছিল আমার ভেতরেও। তাই সেখানে যাবার প্ল্যানিং হতেই দেখলাম আমিও চার হাত পা তুলে "কবে যাওয়া হবে? কবে যাওয়া হবে?"বলে নাচতে লেগেছি। আসলে মানুষ তার ছোটবেলার প্রতিটি কণা সঞ্চয় করে রাখতে চায় সযত্নে। তাই এত বছর পরেও জীবনের প্রথম পাঁচটি বছর যে জায়গার সাথে আস্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে, যার বেশিরভাগ স্মৃতিই মস্তিক কোষে জায়গা নিয়ে পারেনি এই ত্রিশ-বত্রিশ বছরের অজস্র হাবিজাবি স্মৃতির ভিড়ে, সেই জায়গাটার-সেই এককামরার ভাড়ার ঘর- প্রথম স্কুল-দুচার টুকরো স্মৃতির সন্ধানে ফের আমরা বালিপুরের পথে। বালিপুরে কি কি আছে বলতে গিয়ে যে কথাটা বলা হয়নি সেটা হলো ওখানে আছে একটি এলাহাবাদ ব্যাঙ্কের শাখা। আর সেই শাখাটিই হলো বাপি মানে পিনাকীর বাবার প্রথম চাকরিস্থল। ব্যাঙ্কটি এবাড়ি-ওবাড়ি ঠিকানা বদলে বদলে এখন বালিপুর বাজারের কাছে গিয়ে স্থায়ী ঠিকানা পেয়েছে। প্রায় পঁয়ত্রিশ বছর আগে পুঁচকে এই ব্যাঙ্কটিতেই লোটাকম্বল নিয়ে জীবিকার প্রয়োজনে এসে থানা গেড়েছিলেন বাপি। প্রথমে ব্যাঙ্কের মেস তারপর বিবাহপরবর্তী জীবনে বাজারের কাছেই বারোয়ারী এক ভাড়াবাড়ির এককামরার ঘরে। সেই ঘরে এখন জরির এমব্রয়ডারীর কাজ হয়। পুরো বাড়িটিতেই এখন আর কোনো পরিবার বাস করে না। কোনো ঘরে কাঠের কাজ, কোথাও হারমোনিয়াম তৈরী হয়। এই সেই ঘর দেখুন। এই যে ছবি। 

এই ঘরেই বছর ত্রিশ-বত্রিশ আগে পিনাকী বাবু চুষিকাঠি মুখে গম্ভীর হয়ে হামাগুড়ি দিতেন 
সেখানথেকে বালিপুর বাজারে আমরা টহল দিলাম পথে পড়ল একটি জায়গা। যেটি এককালে পিনাকীর স্কুল ছিল। কুঁচো বেলার প্রথম কিন্ডারগার্টেন স্কুল। আমাদের দুজনের অনেক মিল আর অমিলের লিস্টে প্রথমেই যেটা আসে সেটা হলো প্রথম স্কুল। আমি হলুম গিয়ে সরকারী প্রাইমারী স্কুল-বাংলা মাধ্যম ওয়েস্টবেঙ্গল বোর্ড স্কুল-অনামী কলেজ-ইউনিভার্সিটি-অনামী পিএইচডি ল্যাবরেটরি পেরিয়ে আসা আপাদমস্তক তকমাহীন এক মহিলা। পিনাকীও তাই হতে হতেও হলো না তার একটা কারণ তার পিএইচডি ল্যাবরেটরিটি অন্ততঃ কলকাতা শহরের ছাত্রছাত্রীরা চেনে। আর দ্বিতীয় কারণটা এই অখ্যাত বালিপুরের আনন্দমার্গ স্কুল। যেটিতে নাকি লাল জামা-কালো প্যান্ট-কালো জুতো-সর্বোপরি একটি কালো টাই পর্যন্ত পরে, কপালে ধেবড়ে যাওয়া ইয়াবড় একটা কাজলের টিপ নিয়ে প্রচন্ড গম্ভীর হয়ে পিনাকীচরণ এককালে বছর দুয়েক প্রচন্ড পড়াশুনা করেছিলেন। পরে অবিশ্যি খড়গপুরের সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে এসে ক্লাস ওয়ানে ভর্তি হয়েছিলেন। আমার স্কুলের গল্প তো আগেই বলেছি আপনাদের। সেসব কথা মনে থাকলেই বুঝবেন প্রথম স্কুল এর ব্যাপারটাতেই তার সাথে আমার কোথায় অমিল। যাই হোক, তো সেই আনন্দমার্গ কিন্ডারগার্টেন স্কুল এখনো আছে। কিন্তু এরও ঠিকানা বদল হয়েছে। নতুন ঠিকানায় আর যাওয়া হয়নি। পুরনো ঠিকানাটা বর্তমানে হোমিওপ্যাথি ওষুধ আর ডাক্তারখানা। এই যে দেখুন এখানেই পিনাকীচরণ গাল ফুলিয়ে টিনের বাক্স হাতে রিম্পার হাত ধরে পড়াশুনা করতে যেতেন। বাল্যপ্রেম-ট্রেম ছিল কিনা সেটা অবিশ্যি আমি জানিনা। যাক গে যাক, অবান্তর কথা ছেড়ে এই যে দেখুন ছবি। 
এটি এককালে পিনাকীর স্কুল ছিল
 তারপর বালিপুর হাইস্কুলের মাঠে। আজ থেকে ত্রিশ বছর আগেকার যে কিরকম গ্রাম ছিল সেটা আজকের বালিপুর দেখেই আন্দাজ করা যায়। তখন সেই অজ গ্রামে বাইরে থেকে গিয়ে ব্যাঙ্ক কর্মচারী বা স্কুলের মাস্টারমশাইরা কাজের শেষের বাকি সময়টা কিভাবে কাটাবেন বুঝে উঠতে পারতেন না। কোনোরকম এন্টারটেইনমেন্ট এর ব্যবস্থা ছিলনা সেদিনের বালিপুরে। তাই বহিরাগত সেসব ব্যাঙ্ক কর্মচারী বা স্কুলের মাস্টারমশাই দের উদ্যোগেই গড়ে উঠেছিল একটি ক্লাব। এবং তাদেরই ব্যবস্থাপনায় হয়েছিল ব্যাঙ্ক কর্মচারী vs স্কুলের মাস্টারমশাই ফুটবল ম্যাচ স্কুল এর মাঠে। গ্রামবাসীদের প্রবল উত্সাহের সেই খেলা মনে রাখার একটি কারণ হলো বাপির দেওয়া গোল। এই সেই মাঠ। এখন নাকি অনেক ছোটো হয়ে গেছে। এই যে ছবি। 

বালিপুর স্কুলের মাঠ
সেখান থেকে মুন্ডেশ্বরী নদীর পাড়ে গেলাম। সন্ধ্যে নেমে এলো আসতে আসতে। ফিরে এলাম বালিপুর বাজারে। পথে অবশ্য অজস্র লোকজন-অজস্র দোকানপাটে দাঁড়াতে দাঁড়াতে আসতে হলো। পুরনো চেনা লোকজন। আমরা দুজন অবশ্য হোঁদল কুতকুতের মত দাঁড়িয়ে দাঁত বের করে রইলাম সব ক্ষেত্রেই। আমার তো প্রশ্নই ওঠেনা, পিনাকীও চেননা  কাউকে। বড়রা দুজন আপ্লুত হয়ে কথাবার্তা বললেন। তারপর আমরা ফিরে এলাম বাড়িতে। কি বললেন? বাড়ি মানে? বাড়ি মানে স্বপনকাকাদের বাড়ি। এঁনাদের কথা একটু গুছিয়ে বলতে হবে। বালিপুরে থাকার পুরো সময়টাতেই এই পরিবারটিকে পাশে পেয়েছিলেন বাপি মামনি। এঁনাদের টানেই, এঁনাদের ডাকেই এই বালিপুর ভ্রমণ। রক্তের সম্পর্ক টম্পর্কের কথা যাঁরা বলেন তাঁদের জন্য শ্রেষ্ঠ উদাহরণ হলো এই দুটি পরিবারের সম্পর্ক। আপনজন হয়ত এঁদেরই বলে।

ছোটখাটো কারখানার মজদুরি, বাড়ির গরুর দুধ বিক্রি, মুড়ি-বাদাম ভেজে বিক্রি ইত্যাদি নানান ছোটখাটো কাজ করে সৎপথে কোনোমতে দিন আনি দিন খাই এর সংসার ছিল দাদু মানে স্বপনকাকার বাবার। তিনটি ছেলেমেয়ে। তপন, স্বপন আর মাধবী। নয়- দশ বছরের ছোট্ট মাধবী পিসির সাথে কেমন করে যেন আলাপ হয়ে গেল মামনির। সেই থেকে সদ্যজাত পিনাকীর টানে তার মায়ের নেওটা হয়ে পড়ল মাধবী পিসি। সেই থেকে দুটি পরিবারের সম্পর্ক শুরু। ত্রিশ-বত্রিশ বছরের সময়ের টানে এই পরিবারটি অর্থনৈতিক ভাবে উঠে এসেছে অনেকখানিই। কিন্তু বদলায়নি এঁনাদের আন্তরিকতা আর সততা। জীবনে প্রথমবারের জন্য এখানে গিয়ে আমার মনে হচ্ছিল বুঝি কত কালের চেনা এঁনারা আমার।  

এই বাড়ির আর এক সদস্য হলো কুহেলি। কুহেলি চেহারাতেই গরু। স্বভাবে কুকুর। বাড়িতে নতুন কেউ ঢুকতে গেলে কুহেলির সামনে যদি পড়ে তবে তাকে টপকে বাড়িতে ঢোকা প্রায় অসম্ভব। শিং নাড়িয়ে তেড়ে যাবে সে। রোজ দুকেজি আলু খায় সে। সাথে আর যা কিছু গরুর খাবার সেসব তো আছেই। সবচেয়ে আশ্চর্যের কথা সে নাকি ছোটবেলায় ঠাকুরমার সাথে মশারির মধ্যে শুতো। সে অভ্যাস খানিকটা বদলে আজও বর্তমান। তার জন্য গোয়ালঘরে রাতে মশারি টাঙিয়ে দিতে হয়। সে রাতে মশারির ভেতরে ঘুমোয়। এই যে দেখুন ছবি। কুহেলীর পেছনে তার মশারিটি দেখা যাচ্ছে কি? 

কুহেলি ও তার মশারি 
পুরনো শিব মন্দিরে যাওয়া হলো দল বেঁধে। মন্দির তো নতুন রং এ সেজেগুজে একদম নতুন হয়ে গেছে। মন্দিরের গায়ে দশ মহাবিদ্যার মূর্তি গড়া রয়েছে। তাতে আধুনিকতার ছাপ সর্বত্র। তবে মন্দিরে যাবার তন্বী রাস্তাটি ধানক্ষেতের মধ্যে দিয়ে এঁকেবেঁকে সুন্দর গতিতে চলেছে। ধানক্ষেতে অজস্র সারস সবুজের মধ্যে যেন সাদা বুটিদার শাড়ী তৈরী করেছে।

গ্রামের শিব মন্দিরে যাবার রাস্তা

মন্দিরের গায়ে দশমহাবিদ্যা 

শিব মন্দির নতুন রূপে, পাশে নির্মীয়মান শীতলা মন্দির
আমরা যেদিন গিয়ে পৌছলাম বালিপুর সেদিন ছিল রাসপূর্নিমা। আর হুগলীর এই অঞ্চলে রাসপূর্নিমা পালন করা হয় বড় জাঁকজমক সহকারে। স্বপনকাকাদের বাড়িতেও পাড়ার অন্যবাড়ির মত রাধা কৃষ্ণের রাস উত্সব পালন করা  হচ্ছিল। আর পাশেই রয়েছে মনসা মূর্তি। বালিপুর বাজারেও দোকানে দোকানে বিক্রির জন্য রাখা অজস্র রাধাকৃষ্ণ আর গোপিনীদের মূর্তি। 


পরেরদিন আমরা যখন রাধানগর গেলাম তখনও খানাকুলের বিখ্যাত গোপিনাথজীর রাসের মেলা দেখলাম। সাথে দেখলাম আরো অনেক কিছু। সে গল্প পরের দিন হবেখন আজ এপর্যন্তই থাক কেমন?  

  

Wednesday 3 December 2014

কৈফিয়ৎ ও জগদ্ধাত্রী পুজো

গত একমাস যাবৎ ঘাপটি মেরে থাকার পর আজ আবার ইচ্ছেখাতার পাতায় ভুস করে ভেসে উঠেছি। যদিও এই একমাস এর সবকটি দিনই আমায় প্রচন্ড ব্যস্ত থাকতে হয়নি তাও আমি কষ্ট করে এক অাধ দিনের জন্য আর ভেসে উঠতে চাইনি আর কি। একমাসের বেজায় হুল্লোড়বাজি ছেড়ে আজ থেকে আবার নিজের কূয়োতে প্রত্যাবর্তন করেছি তো তাই আবার পুরনো বন্ধুর কাছে গত একমাসের গল্পের ঝাঁপি নিয়ে হাজির হয়ে গেছি। কি বললেন? কি করলাম এই একমাস? আরে কি করিনি তাই বলুন। দাঁড়ান গুছিয়ে বসি।  হ্যাঁ, এবার লিস্টি রেডি। বলছি। 'মুসকান' এর কুঁচোগুলোর সাথে একটা অনবদ্য দেওয়ালী কাটিয়ে গত ২৮শে অক্টোবর আমরা দুজনে দুটো খালি ব্যাগ নিয়ে কলকাতা রাজধানী চেপে সো ও ও ও ও জা যে যার বাড়ি গেছি। খালি ব্যাগ কেন? সোজা তো। বাড়ি থেকে ফেরার সময় যাতে ভর্তি করে আনতে পারি সেজন্য। তারপর তো দেদার মজা। পয়লা নভেম্বর জগদ্ধাত্রী পুজো ছিল। আমাদের বাড়িতে প্রায় শতাধিক বছর ধরে চলে আসছে জগদ্ধাত্রী পুজো। আক্ষরিক অর্থেই শতাধিক বললাম। কারণ শুনেছি দাদুর বাবার পাঁচ বছর বয়স থেকে চলে আসছে এই পুজো। দাদু মারা গেছেন ১৯৭৭ সালের জুলাই মাসে। তখন তাঁর বয়স ছিল বিরাশি-তিরাশি বছর। সুতরাং তিনি বেঁচে থাকলে তাঁর এখন বয়স হত ১১৯ বছর। তাঁর বাবার পাঁচবছর বয়সের পুজো মানে আরো ধরে নেওয়া যাক কুড়ি বছর। সুতরাং কাক্কেশ্বরের হিসেব অনুসারে প্রায় একশ চল্লিশ বছরের পুজো। আমাদের রাবনের গুষ্ঠির প্রতিনিধিরা মোটামুটি বছরের এই সময়টা যে যার কূয়ো ছেড়ে এই একশ চল্লিশ বছরের বৃদ্ধা মা জগদ্ধাত্রী আর পারিবারিক হ্যা হ্যা হি হি র টানে লোটা কম্বল নিয়ে আমাদের বাড়িতে গুটি গুটি হাজির হয়। সেই চার পাঁচ দিন একই বিছানায় গুঁতোগুঁতি করে শুয়ে-সকাল থেকে স্নানের লাইন দিয়ে-পুজোর পর প্রসাদ খাওয়া নিয়ে বাচ্চাদের মত হইচই করে ছোটোপিসিমার ঘাড় ভেঙ্গে মিষ্টি-সিঙ্গারা খেয়ে মনেই পড়ে না যে আমি হরিয়ানার জঙ্গুলে গবেষণাগারে সারা বছর ধরে নানা হাস্যকর পরীক্ষা নিরীক্ষার ভান করি। আর প্রতিপদে অকৃতকার্য হয়ে চূড়ান্ত হতাশায় গুরগাঁও গিয়ে pizza খাই আর মোটা হই। যাই হোক, আজ আর এসব বাজে কোথায় সময় নষ্ট করব না। পুজোর শেষে মন খারাপের সুযোগ কিন্তু এবছর ছিল না।  কারণ, পুজোর পরই গেলাম বালিপুর। হুগলী জেলা। একটা দুর্দান্ত দুদিনের ভ্রমণ হলো। সেখানকার গল্প পরের দিন বলছি। বালিপুর থেকে ফিরে এখানে এলাম এবং তখনও কোনো মন খারাপ হলো না বরং আনন্দে নাচতে নাচতে ফিরে এলাম। কারণ সঙ্গে বাবা। বাবাকে আমরা দুজনে এবার "যেতেই হবে" বলে প্রায় হাইজ্যাক করে নিয়ে চলে এসেছিলাম। বাবার সাথে weekend এ গেলাম দিল্লির নতুন সংযোজন অক্ষরধাম মন্দির, যা বাবার দিল্লি বাসের সময় ছিল না। সাথে ফাউ হুমায়ুনের সমাধি। বাকি দিল্লি বাবার চেনা। তাই আর রাস্তায় সময় নষ্ট না করে ভুরিভোজ হলো গুছিয়ে। সেসব গল্পও ধীরে ধীরে বলবখন। তারপর আমরা তিনজনে পরের সপ্তাহান্তে গেলাম জয়পুর। সেসব গল্পও পরে হবেখন। দুদিনে জয়পুর চষে বেরিয়ে সোমবার সকালে ব্যাক টু কূয়ো। আরও খারাপ খবর হলো ঠিক তার পরের দিন অর্থাত মঙ্গলবার বাবা ব্যাক টু বাড়ি। আর আমরা দুই মক্কেল কাল সন্ধ্যেয় বাবাকে নিউ দিল্লি স্টেশন এ তুলে দিয়ে আবার গুটি গুটি পায়ে খোঁয়াড়ে ফিরে এসেছি। মুখ চুন করে মুরগি সেদ্ধ আর রুটি গিলে ঘুমিয়ে পড়েছি। আজ আবার ল্যাবে এসে পুরোনো ভ্যানতাড়ায় সময় নষ্ট করছি। এবছরের মত খেল খতম। পুরনো ছবি দেখে মন ভরাও। আর কি? এই আমার একমাস ডুব মেরে থাকার কৈফিয়ত। কৈফিয়ত সেরে আপনাদের জন্যে রইলো এই বছরের আমাদের জগদ্ধাত্রী পুজোর কটা ছবি।




Sunday 26 October 2014

দেওয়ালী.........৩


দেওয়ালী.........২ এরপর  

“আরে ভাই ম্যায় ক্যায়া তেরে লিয়ে পুরি রাত ব্যায়ঠে রহুঁ? যো বাকি হ্যায় জমা কর দে, প্যায়সা লেকে ঘর যা......আরে উও প্যাকেট দে মুঝে......শালা।” বিনোদ মকবুলের হাতের প্যাকেটটার দিকে ইঙ্গিত করে।
মকবুল পায়ে পায়ে এগিয়ে এসে প্যাকেটটা বাড়িয়ে ধরে। শনু নিঃশ্বাস বন্ধ করে অপেক্ষা করে পরবর্তী অগ্নুৎপাতের জন্য। বিনোদ এসে ছিনিয়ে নেয় প্যাকেটটা। নিজে নিজেই বিড়বিড় করে, “অ্যায়সে হি শালা দের হো গ্যায়া।” প্যাকেট খুলে ভুরু কুঁচকে কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে থাকে বিনোদ। শনু এসে মকবুলের পাশে এসে দাঁড়ায়। মকবুল অনুভব করে তার হাঁটুর গরম ভাবটা চলে গিয়ে আস্তে আস্তে ঠাণ্ডা হয়ে যাচ্ছে হাত আর পায়ের পাতা।
বিনোদ তাকালো মকবুলের দিকে। “ইয়ে ক্যায়া? মজাক হো রাহা হ্যায় ক্যায়া?”
শনু এগিয়ে আসে। “বিনোদ ভাইয়া, শুনো না, অ্যাকসিডেন্ট হুয়া হ্যায় মকবুলকা, দেখো না ক্যায়সে খুন নিকল রাহা হ্যায় ঘুটনে সে। গাড়ি ডাঁয়ে প্যায়ের কে উপর সে চলতে চলতে রাহে গ্যায়ে।”
এত বলেও বিনোদের দৃষ্টি প্যাকেট থেকে মকবুলের পায়ের দিকে ঘোরাতে পারলো না শনু। কয়েক সেকেন্ড মকবুলের দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে ভেতর দিকে চলে গেল বিনোদ।
শনু এসে মকবুলের বরফঠাণ্ডা হাত ধরে বলল, “ঘাবড়ানা মৎ ইয়ার। ম্যায় ভি তো হুঁ।” মকবুল একহাতে একটা খুঁটি অন্য হাতে শনুর হাত চেপে ধরল। বিক্রম শেঠ বেরিয়ে এল খুব শান্ত ভাবে। -“কিতনে প্যাকেট দিয়ে থে তুনে শালে কো আজ বিনোদ?”
-পাঁচাশ শেঠজি।
-পুরা গ্যায়া?-মকবুলের দিকে তাকিয়ে শান্ত স্বরে জিজ্ঞাসা করে বিক্রম শেঠ।
শনু তাড়াতাড়ি বলে ওঠে “নেহি শেঠ, বেচা থা না পেহেলে কুছ। দশ- বারা প্যাকেট তো বিক গ্যায়ে থে......হ্যায় না মকবুল?”
“তু চুপ কর শালে, তুঝ সে পুছা ম্যায়নে কুছ?” এক ধমক দিয়ে ওঠে শেঠ শনুকে। তারপর দুপা এগিয়ে গিয়ে মকবুলের মুখোমুখি দাঁড়ায়। “তু বোল, কিতনে প্যাকেট বিকা থা?”
-“চার” মুখ নিচু করে বলে মকবুল।
হঠাৎ ঠাসিয়ে একটা চড় কষায় বিক্রম শেঠ মকবুলের গালে। তার ধাক্কায় পাশে রাখা বস্তা-প্যাকিং কেসের ডাঁই এর ওপরে প্রায় পড়তে পড়তে সামলে নিল মকবুল। “শালা চার প্যাকেট বিকা হ্যায় পুরি দিন মে। বাকি কে সারে ধুল বানা কর লে আয়ে মেরে মু পে ডালনে কে লিয়ে? বাকি কে প্যায়সা কৌন দেঙ্গে? তেরা বাপ? শালা উসকা ভি তো পতা হ্যায় মুঝে। বাকি চালিশ-প্যাঁয়তাল্লিশ প্যাকেটকা প্যাঁয়তিশ রূপেয়া কে হিসাবসে পুরা প্যায়সা ওয়াপাস চাহিয়ে মুঝে। সমঝা কুত্তা শালা?” –চেঁচিয়ে ওঠে শেঠ।
-“শেঠ?”-আস্তে করে ডাকে শনু।
-“তু বিচ মে মৎ বোলনা। তুঝকো ভি ক্যায়া দুঁ ক্যায়া খিঁচকে এক?”
শনু তাও দু পা পিছিয়ে গিয়ে বলে ওঠে, “বহুত খতরনাক অ্যাকসিডেন্ট হুয়া থা শেঠ মকবুল কা। প্যায়ের দেখিয়ে না উসকা শেঠ জি।”
-“সব দিখতা হ্যায় মুঝে। শালা মর তো নেহি গ্যায়া না? আপনে প্যায়ের কি উপর হি তো খাড়া হ্যায় না? কোই হাড্ডি-উড্ডি নেহি টুটা না? কিতনা খতরনাক অ্যাকসিডেন্ট সব পতা হ্যায় মুঝে। শালা কামচোর। পুরি দিন মে চার প্যাকেট? শালা বাকি কে দিন ক্যায়া কর রাহা থা বোল।”
-“শেঠ, উও প্যাকেট কা মোম ফ্যাক্টরি মে দে দেনে সে ফির সে বন যায়েগা” – শনু একটা শেষ চেষ্টা করে।
মকবুলকে ছেড়ে শনুর দিকে এগিয়ে আসে বিক্রম শেঠ। কোমরের প্যান্টটা একটু তুলে নেয়। তারপর খুব ঠাণ্ডা গলায় শনুর ঘাড়টা শক্ত হাতে ধরে বলে, “চল, নিকল ইঁহা সে। বহুত দের সে ফটর-ফটর কর রাহা হ্যায় তু। তু দেগা প্যায়সা মেরা? চল শালে, নিকল ইঁহাসে।” এক ধাক্কায় দরজার কাছে এসে পড়লো শনু।
গোডাউনের দরজায় একটা হাত রেখে হতভম্বের মত দাঁড়িয়ে আছে আসলাম শেখ। উঠে দাঁড়িয়ে তার কাছে গিয়ে অসহায়ের মত বলল শনু, “মকবুল কো বাঁচা লিজিয়ে চাচা। উসকা কোই গলতি নেহি হ্যায় চাচা।” যাকে উদ্দেশ্য করে বলা তার কথাটা কানে ঢুকেছে কিনা বোঝা গেল না। আকুল চোখে ছেলের পরবর্তী হেনস্থা কি হতে পারে তাই দেখছে। তার পেছনে দুচোখে ভর্তি প্রশ্ন নিয়ে জড়ো হচ্ছে সিগন্যাল ফেরত বাকি মনসুর-সুরিন্দর-জাভেদ-রোশনী-আসমারার দল। কারো হাতে টিস্যু পেপার, কারো হাতে গাড়ি মোছার নরম কাপড়, কারো হাতে প্লাস্টিকের বাঁশি, কারো হাতে আবার তাদের মতই মোমবাতি বা আবিরের প্যাকেট। সারাদিন নানান সিগন্যালে ঘুরে ঘুরে ধুলোমাখা রুক্ষ চুল আর খড়ি ওঠা লিকপিকে হাতপা নিয়ে অন্নসংস্থানে বেরিয়েছিল। সবারই টিকি বাঁধা এই বিক্রম শেঠের গুদামে।
বিক্রম শেঠ বাঁ হাতে মকবুলের গলাটা ধরে খুঁটির সঙ্গে ঠেসে ধরল ওকে। বুটপরা পা টা পড়ল মকবুলের জখম ডান পায়ের নখের উপর। যন্ত্রণায় কাতরে উঠলো মকবুল। চোখ- মুখ কুঁচকে হজম করছে সে ব্যাথাটাকে। “বহুত দরদ হো রাহা হ্যায় না শালে। কৌন সি দুনিয়া মে রহেকে কাম করতে হে বোল? কিসিকো কুছ নেহি হোতা তেরে সাথহি খতরনাক অ্যাকসিডেন্ট হোতা হ্যায়? ঝুটে শালা। মুঝে মেরে প্যায়সা চাহিয়ে ব্যস।”- সাথে সাথে হাতও চলছে সমান তালে। মকবুল একদম নেতিয়ে পড়েছে।
ততক্ষণে আসলাম শেখ আর জাভেদ-রোশনীর দল জেনে নিয়েছে পুরো ঘটনা। মকবুলের অবস্থা দেখে বিনোদ এগিয়ে আসে। “শেঠজি, ছোড় দিজিয়ে। মর যায়েগা নেহি তো।”
“ছোড় দিজিয়ে মতলব? কিতনে রূপিয়ে কা নুকশান হুয়া হ্যায় পতা হ্যায় তুঝে? শালা অ্যাকসিডেন্ট দিখা রাহা হ্যায় মুঝে। কৌন ভরেগা নুকশান?”
“উসকা হি রোজ সে কাট লেনা আপ। আভি আউর মৎ মারিয়ে, কুছ হো যায়েগা তো আপ কে উপর মুস্কিল আ সকতা হ্যায়।”
একটু থমকাল বিক্রম শেঠ।
এতক্ষণে সম্বিৎ ফিরে এল আসলাম শেখের। সামনে গিয়ে হাতজোড় করে বলে, “ছোড় দিজিয়ে জনাব। মর যায়েগা বেচারা। দেওয়ালী কে দিন হ্যায় শেঠজি, মাফ কর দিজিয়ে।”
“দেওয়ালী সে তেরা ক্যায়া হ্যায় রে? শালা মুসলমানকে বাচ্চে। দেওয়ালী দিখাতা হ্যায়। মেরা চালিশ প্যাকেট কা প্যায়সা তুঝে ভরনা পড়েগা।”
মাথা নিচু করে বসে পড়ে আসলাম শেখ। “ছোড় দিজিয়ে শেঠজি। ফির সে অ্যায়সা কভি নেহি হোগা মকবুলসে।”
“ফির সে কভি নেহি হোগা ইয়ে তো মুঝে ভি পতা হ্যায়। কিঁউকি কাল সে তু নেহি আয়েগা সমঝা?” –মকবুলকে ঠেলা মেরে বলল বিক্রম শেঠ। মকবুলকে ছেড়ে বিনোদের দিকে গিয়ে বলল, “ইস কো কাল সে গোডাউন মে ঘুসনে মৎ দেনা বিনোদ। ইস তরহ কে বাচ্চে সে মেরা কাম নেহি চলেগা। সমঝা?”
-“অর নেহি হোগা শেঠজি। নিকাল মৎ দিজিয়ে মুঝে।”-এতক্ষণে কোনমতে বলতে পারে মকবুল। খুঁটি থেকে খসে ওখানেই বসে পড়লো মকবুল। আর দাঁড়িয়ে থাকার শক্তি ছিল না তার।
“চোপ শালে।”-চেঁচিয়ে ওঠে বিক্রম শেঠ।
“অ্যায়সা মৎ করনা শেঠজি। মাফ কর দিজিয়ে। ম্যায়নে আপকা পুরা প্যায়সা চুকা দুঙ্গা।” –হাতজোড় করে বলে আসলাম শেখ।
“উও তো তু দেগা হি।”- বলে ভেতরের দিকে চলে যেতে থাকে শেঠ।
বিনোদ হঠাৎ বলে ওঠে, “শেঠজি, মেরা এক বাত শুনিয়ে, আপ ইসকো নিকাল দেঙ্গে ত ইস কা বাপ আপকো প্যায়সা না দে তো? আপ উসকো কাঁহা ঢুঁড়েঙ্গে, মকবুল আপকে আন্ডার রহে তো আপ উসকে রোজ সে প্যায়সা কাট সকতে হেঁ।”
“নেহি বিনোদ তু মুঝে মৎ সমঝা। অ্যায়সা মাফিক কাম করে তো ক্যায়া ফায়দা, পুরি দিন মে চার-পাঁচ প্যাকেট বিকা, উপর সে নুকশান। ইস সে নেহি চলেগা।”
“ঠিক হ্যায় আপ প্যায়সা ওয়সুল তক রাখ লিজিয়ে। ফির নিকাল দেনা। নেহি তো আপ কা প্যায়সা ভি ওয়সুল নেহি হো সাকতা হ্যায়............” –শেঠজির পেছন পেছন ভেতরের অফিস ঘরের ভেতর মিলিয়ে যায় বিনোদ।
এতক্ষণে শনু পায়ে পায়ে এগিয়ে আসে মকবুলের দিকে। “উঠ মকবুল।”
মকবুলের গলার কাছে কেমন যেন একটা হচ্ছে। কান্না পাচ্ছে। শুখনো চোখে আব্বুর দিকে তাকাল মকবুল। গোডাউনের মেঝেতেই বসে আছে সেই থেকে মানুষটা মাথা নিচু করে।
“আব্বু”- আস্তে করে ডাকে মকবুল। কোনো সাড়া নেই। শনুর হাতে ভর দিয়ে উঠে দাঁড়ায় মকবুল। মার খেয়ে তার কান-গাল গরম হয়ে গেছে। নাক দিয়ে গরম নিঃশ্বাস পড়ছে। ঠিক জ্বর হলে যেমন হয়। আস্তে আস্তে এগিয়ে যায় সে আব্বুর দিকে। পাশে বসে পিঠে হাত দিয়ে ডাকে, “আব্বু?”
হঠাৎই যেন রক্ত চড়ে যায় আসলাম শেখের মাথায়। বসে বসেই এক লাথি কষায় মকবুলকে। “শালা, শুয়ার। সরে যা সামনে থিকে। কোথাও শান্তি নেই? একটা কাজও মন দিয়ে করতে পারনি শালা ইবলিসের বাচ্চা? দুটো পয়সা রোজগার হচ্ছিলো, সইলনি সেটা? বাপের ঘাড়ে বসে গিলতে লজ্জা করেনে? খেতে বসে তো কোন ভুল হয়নে। শালা তোকে গোরে দিয়ে তবে আমার শান্তি।”
এতক্ষণে যেন সন্ধ্যে থেকে তার সাথে ঘটা সব ঘটনার যন্ত্রণা উপচে ওঠে মকবুলের দুচোখ বেয়ে। এতক্ষণের মারধর-গালিগালাজ-ডান পায়ের জখম সবকিছুকে দাঁত চেপে সহ্য করেও এবার আর পারে না মকবুল। মেঝেতে বসেই অঝোরে কাঁদতে থাকে সে। দুহাত দূরে দাঁড়িয়ে পাথর হয়ে যায় শনু।
আসলাম শেখ ততক্ষণে বাঁ হাতের উল্টোপিঠটা দিয়ে একবার চোখটা মুছে নিয়ে গোডাউনের দরজা ছেড়ে বেরিয়ে যাচ্ছে। “জাভেদ, মকবুল কো দেখ না”- বলে পেছন পেছন দৌড়োয় শনু।
বিক্রম শেঠকে ভেতর থেকে বেরিয়ে আসতে দেখে মকবুল তাড়াতাড়ি জামার হাতায় চোখ-মুখ মুছে উঠে দাঁড়ালো। তার দিকে এতটুকুও না তাকিয়ে পেছন পেছন আসা বিনোদকে বলল বিক্রম শেঠ, “ম্যায় চলতা হুঁ, ইসকো সমঝা দেনা, ম্যায় এক মাহিনা দেখুঙ্গা, মেরা নুকশান কা প্যায়সা ইসকে অন্দর ভর জানা চাহিয়ে। কৌন ভরেগা, ইয়ে ক্যায়া ইসকে বাপ উস সে মুঝে কই লেনা দেনা নেহি। ফের সে অ্যায়সা হোগা তো উস হি দিন উসকা লাস্ট হোগা। অর বাকি বাচ্চোঁকা হিসাব বরাবর রাখ দে। আজ কা পেমেণ্ট কাল একসাথ হো জায়েগা।”
দরজার সামনে গিয়ে হাতের জাঁদরেল হেলমেটটা মাথায় পরে বাকলস আঁটতে আঁটতে বলে, “হাঁ বিনোদ, জলদি সে গোডাউন বন্ধ করকে শুখলাল কো চাবি দে দেনা। দেওয়ালী কে দিন ফালতু বখেড়া শালা মুসলমানকা বাচ্চা, শালা হারামি, দিন হি খারাব কর দিয়া।” তার দিকে একবার তাকিয়ে মোটরবাইকে স্টার্ট দিয়ে বেরিয়ে যায় বিক্রম শেঠ। মকবুল খুঁটি ধরে দাঁড়িয়ে থাকে।
“আজ কা পেমেণ্ট নেহি মিলেগা ক্যায়া বিনোদ ভাইয়া? মালিক তো চলা গ্যায়া।”- আসমারার কথায় তাকায় বিনোদ। বলে, “শুনি নেহি? মালিক নে ক্যায়া বোলা? কাল একসাথ হো জায়েগা। আভি কিস কে পাশ ক্যায়া বাঁচা হ্যায় জলদি এন্ট্রি কর দে। গোডাউন বন্ধ করনা হ্যায় মুঝে।” আসমারা উশখুশ করে ওঠে। “হামলোগ ক্যায়া কিয়া? উস কে লিয়ে মেরা পেমেন্ট কিঁউ রুকেগা? মুঝে প্যায়সা চাহিয়ে।” 
“এ বাচ্চি, যাদা বোল মৎ। মালিক কো কিঁউ নেহি বোলা ফির? তেরে সামনে সে হি তো গ্যায়া না? ম্যায় তুঝে পেমেন্ট করতা হুঁ ক্যায়া? ইধার আ সব। কিসকা কিতনা প্যাকেট বাকি হ্যায় বোল জলদি।”
বিনোদের টেবিলের চার পাশে ভিড় করে সবাই। আসমারা যাবার সময় ভুরু কুঁচকে তাকায় একবার খুঁটিতে হেলান দেওয়া মকবুলের দিকে। সবার ফেরত আনা জিনিসপত্র জমা করতে করতে একসময় মকবুলের দিকে তাকিয়ে বলে ওঠে বিনোদ, “তু আভি ভি ইঁহাপর কিঁউ খাড়েঁ হ্যায়? যা ঘর যা। কাল সুভে আ যা না জলদি। অর শুন, যাতে টাইম সাঁই মেডিকেল হল সে ডেটল-ওয়েটল- দাওয়াই যো চাহিয়ে লাগা লেনা প্যায়ের মে। সুঁই লাগানা হে তো ওহি লাগা লেনা। ইস সে ফির বুখার-উখার চড় যায়ে তো কাম চৌপাট। তব ম্যায়নে ফির সে তেরে লিয়ে  শেঠ কো কুছ না বলুঙ্গা। ইয়ে ম্যায়নে আজ সাফ বোল দিয়া। যা ঘর যা? কাঁহা গ্যায়া তেরা বাপ?”
সে কথাটা মকবুলও ভাবছিল। পায়ে পায়ে রাস্তায় বেরিয়ে এসে এদিক ওদিক দেখল মকবুল। না শনু না আব্বু কাউকেই দেখতে পেল না মকবুল। শনুটারও হেনস্থা হল আজ তার জন্য। কোথায় যে গেল আব্বুর পেছন পেছন? চকের দিকে কয়েক কদম এগিয়ে ফুটপাথের একধারে ডান পা টা মেলে বসে পড়লো মকবুল। পায়ে অসহ্য ব্যাথা। হাঁটুটা ভাঁজ করতে পারছে না সে। মার খেয়ে নেতিয়ে পড়েছে। সারাদিনের পর খিদেও পেয়েছে প্রচুর। আর টানতে পারছে না সে। আবছায়ায় বসে বসে হঠাৎ মায়ের জন্য মনটা হু হু করে উঠল মকবুলের। কান্নাটাকে কিছুতেই থামাতে পারল না সে। বাঁ হাঁটুতে মাথা রেখে ফুঁপিয়ে উঠলো মকবুল।
হঠাৎই শুনল, “আরে বিচ মে বৈঠ গ্যায়া দেখ। আ বে হট না শালে। ফুতপাথ মে ভি চলনা মুশকিল হো গ্যায়ে হে ইয়েসব কে লিয়ে।” মাথা তুলে মকবুল দেখল বুটপরা দু-জোড়া পা ফুটপাথে ঠিক তার সামনে। তাড়াতাড়ি উঠে দাঁড়ালো সে। লোকদুটো চলে গেল ওর দিকে তাকাতে তাকাতে। ভাল করে চোখ-মুখ মুছে ডানদিক-বাঁদিক দেখতে দেখতেই দেখতে পেল আব্বু আসছে সাথে শনুও। রাস্তার আলো তাদের মুখে না পড়লেও দূর থেকে মানুষ দুজনকে চিনতে ভুল হয়না মকবুলের। ওকেও তারা দেখতে পেয়েছে। সোজা তার দিকেই আসছে।
ভয়ে ভয়ে আব্বুর দিকে তাকালো মকবুল। আব্বুর ভাগেরটা এখনো বাকি আছে তার। শনু বলে ওঠে, “তুমলোগ ইঁয়হি পে থোড়ি দের রুকো চাচা। ম্যায় আজ কা পেমেণ্ট লেকে আভি আয়া।”
“গোডাউন বন্ধ হ গ্যায়া শনু। সবকা পেমেন্ট কাল হোগা, মালিক চলা গ্যায়া আজ।”-মকবুল জানায় শনু কে।
“তুঝে ক্যায়া বোলা মালিক নে যানে কে টাইম পে?” প্রশ্নটা শনু করলেও আব্বুরও চোখে একই প্রশ্ন দেখতে পেল মকবুল। “কাল জলদি গোডাউন আনে কে লিয়ে বোলা হ্যায়। উসকা প্যায়সা এক মাহিনাকে অন্দর ওয়াপাস করনা হ্যায় ব্যাস”-আব্বুর দিকে আড়চোখে তাকিয়ে জানায় মকবুল। শনুর মুখে হাসি ফুটে ওঠে।
আর মকবুলকে অবাক করে একটা পাতলা হাসি ফুটে ওঠে আসলাম শেখের মুখেও। মকবুল তাকিয়ে থাকে আব্বুর মুখের দিকে। আব্বু বলে ওঠে, “চল তবে, ও টাকা আমি রিসকা টেনে শোধ দিয়ে দুবো অনে। এখুন চ মেলার মাঠে বাজি দেখতে যাবি যে তোরা আজ? শনু বলেছে মোকে সব।” হাঁ করে তাকিয়ে থাকে মকবুল আব্বুর দিকে। তারপর শনুর দিকে তাকায়। শনু হাসছে মিটিমিটি। আব্বু বলে- “কি রে চল। রাত দশটা অবধি হবে রোশনাই। এরপর গেলে আর দেখতে পাবিনি। হাঁটতে হবেনি অতটা আর। তোরা ডেঁইরে থাক ইখানে। আমি ঝট করে রিসকাটা লিয়ে আসি। এই যাব আর আসব, ইস্ট্যান্ডে তালা মেরে এসেছি রিসকাটা।”
“ঘরে গিয়ে রান্না করতে হবে যে আব্বু। দেরি হবে।” অস্ফুটে বলে মকবুল।
“নাহ, আসার সময় আমাদের ইস্ট্যান্ডের পাশে জিতেন্দরের ঠ্যালা থেকে তিনটে এগরোল আনব ঠিক করেছি। পরে খিদা পেলে না হয় ঘরকে গিয়ে ভাত ভিজানো আছে, প্যাঁজ লঙ্কা মুলে খেয়ে লিলেই হবে। কি বল? শনু তু এগরোল খায়েগা না?”
শনু একগাল হেসে ঘাড় কাত করে।

মকবুলের চুলগুলোকে একটু ঘেঁটে দিয়ে পিঠে আলতো চাপড় দেয় আসলাম শেখ। বলে, “ডাঁড়া ইখানে দুজনে এট্টু। আমি এই যাবো আর আসবো।” মুখে আলতো হাসি নিয়ে দ্রুত পা চালায় আসলাম শেখ রিক্সা স্ট্যান্ডের দিকে। শহরের হলদে আলোর নিচে দাঁড়িয়ে মকবুল দেখে তার আব্বুর দ্রুত মিলিয়ে যাওয়া অবয়ব। পাশ থেকে শনুর চোখে পড়ে তার বন্ধুর চোখে এক ফোঁটা টলটলে জল রাস্তার আলোয় চকচক করছে। বাঁ হাতটা দিয়ে মকবুলের ডান হাতটা জড়িয়ে ধরে শনু।                     

(শেষ)
দীপাবলি  
অর্পিতা চ্যাটার্জী 



Friday 24 October 2014

দেওয়ালী............২

দেওয়ালী............১ এর পর 

চলতে চলতেই বাঁ-দিকে চোখ ফিরিয়ে দেখতে পেল আবার একটা আলোর ফুলকি। ওপরে উঠে বিশাল ফুল হয়ে ফাটবো ফাটবো করছে। “শনু-উ-উ-উ-উ উপর দেখ”-চেঁচিয়ে উঠল মকবুল। শনু তার দিকে তাকালো তার ডাক শুনে। আর তখনি কেমন যেন সব গণ্ডগোল হয়ে গেল মকবুলের। বাঁ দিকের আকাশ থেকেই যেন বিশাল একটা আলোর ঝরনা নেমে এল মকবুলের ওপর। চারপাশ থেকে গাড়িগুলো হুহু শব্দে ছুটে চলেছে সিগন্যাল সবুজ হতেই। চারপাশ থেকে ধেয়ে আসা অজস্র গালিগালাজ আর হায় হায় এর মধ্যে নিজেকে নিয়ে কোনোক্রমে ছিটকে গেল মকবুল ফুটপাথের দিকে। টেনে-হিঁচড়ে ডান পা খানা ফুটপাথে উঠিয়ে যখন হাপরের মত হাঁপ ছাড়ছে মকবুল ততক্ষণে তার ডান পায়ের হাওয়াই চপ্পলখানা কোথায় চলে গেছে। ডান হাঁটুটা রাস্তায় ঘসে গিয়ে রক্ত ঝরছে। পায়ের বুড়ো-আঙ্গুলের নখ উঠে গিয়ে ঝুলছে।

শনু দৌড়ে এসে দাঁড়িয়েছে তার কাছে। হাতের প্যাকেটগুলো রেখে বসে পড়ে দুহাতে জড়িয়ে ধরেছে মকবুলকে। উদ্বিগ্ন গলায় বলে উঠলো-“ঠিক তো হ্যায় না মকবুল?” হাঁপাতে-হাঁপাতেই আস্তে করে ঘাড় নাড়ে মকবুল। “প্যায়ের মে ক্যা হুয়া? দিখা। আরে দিখা না।” ডান পা টা জোর করে নিজের দিকে টেনে নেয় শনু। মকবুল ততক্ষণে ভয়টা একটু সামলেছে। ব্যাথার অনুভূতিটা আস্তে আস্তে ফিরে আসছে। ক্ষতবিক্ষত হাঁটু আর নখের ব্যাথা দাঁত চেপে সহ্য করে মকবুল। “আরে এ ক্যায়া হুয়া? ইতনা খুন! আরে ইশ!” আস্তে করে হাত বোলাতে থাকে তার পায়ে। “চল উসপার। পানি সে পেহেলে ধো না হোগা। তু তো দেখা থা উস তরফকা সিগন্যাল খুল গ্যায়া থা। ম্যায় দুসরে ফুটপাথকে তরফ চল দিয়ে থে। তো তুঝকো সমঝনা চাহিয়ে থা না কি ইস তরফ ভি এক হি টাইমপে সিগন্যাল খুলেগা। তু বেওকুফ কি তরহ রোড ক্রস কিঁউ করনে লগা?” কি আর বলবে মকবুল? এত যদি সে শনুর মতন সিগন্যাল বুঝত তবে ত হয়েই যেত। “চল,পানি তো উধার দুকানপে মিলেগা। চল পায়েগা?”- তাড়া দেয় শনু। গলার শুখনো ভাবটা এতক্ষণে অনুভব করে মকবুল। আস্তে করে বলে-“হাঁ চল। পানি পিনা হ্যায়।” নিজের আবিরের প্যাকেটগুলো গুছিয়ে নেয় শনু। হঠাৎ খেয়াল হয় মকবুলের।

-“শনু, মেরা প্যাকেট? মোমবাত্তিয়া?”  

নিজের প্যাকেটগুলো গুছিয়ে হাতে ঝুলিয়ে নিতে নিতে চমকে তাকায় শনু। “কাঁহা? তেরা মাল?” বলেই রাস্তার দিকে তাকায় শনু। এদিক ওদিক তাকিয়ে রাস্তায় চোখ যায় মকবুলেরও। ঠিক যেখান থেকে সে আলোর ফুলকিটা দেখতে পেয়ে শনুকে চেঁচিয়ে ডাকতে শুরু করেছিল, আর তার সেই বেয়াদবিকে পিষে ফেলার উদ্যম নিয়েছিল সবুজ সিগন্যাল পাওয়া আটকে থাকা গাড়ির দল, ঠিক সেখানেই তার ডান পা টা একচুলের জন্য পিষে ফেলতে না পারার আক্রোশেই হয়ত তার হাত থেকে পড়ে যাওয়া, তার সারাদিনের রোজগার, সবুজ-গোলাপি-হলদে-রংবেরঙের মোমবাতিগুলোকে নির্দ্বিধায় রাস্তার সাথে মিশিয়ে দিয়ে চলে যাচ্ছে একের পর এক গাড়ি।

কিছুক্ষণ দুজনেই চুপ করে সেদিকে চেয়ে থাকার পর শনু তার কাঁধে হাত রাখে। বলে, “চল মকবুল। পানি লে লেতে হ্যায় দুকান সে।”

কথাটা কানে ঢুকলেও মাথায় ঢোকে না মকবুলের। পঞ্চাশ প্যাকেটের মধ্যে মাত্র চার-পাঁচ প্যাকেট বিক্রি করতে পেরেছিল সে। বাকি পুরোটাই তার হাত আর হাতের বড় প্লাস্টিকের প্যাকেটে ছিল। যেগুলো বাইরে বেরিয়ে আছে সেগুলো এখন রঙ-বেরঙের ধুলো ছাড়া আর কিছু নয়। কিন্তু প্লাস্টিকের প্যাকেটের মধ্যে যে প্যাকেটগুলো ছিল সেগুলোর মধ্যে থেকেও কি এক আধ প্যাকেটও বাঁচবে না? সামনেই আছে। দু পা বাড়ালেই পেয়ে যাবে প্যাকেটটা। সিগন্যাল লাইটের দিকে তাকায় মকবুল একবার। এখনও লাল হতে দেরি আছে। এখনও যদি তুলে আনা যায় প্যাকেটটা- নয়ত সিগন্যাল লাল হতে হতে প্যাকেটের একটি মোমবাতিও বাকি থাকবে না। আস্তে আস্তে ব্যাথা ভুলে উঠে দাঁড়ায় মকবুল। সিগন্যাল লাইটের দিকে আরেকবার দেখে নিয়ে ঝড়ের মত ছুটে আসা গাড়িগুলোর গতি মাপতে থাকে মকবুল। শনু ততক্ষণে বোধহয় তার মতলব বুঝতে পেরেই পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। বলে, “নেহি মকবুল, ছোড় দে। উসমে অর কুছ বাঁচা নেহি।”
“পাঁচাশ প্যাকেট হ্যায় শনু উসমে।”- আর্তনাদ করে ওঠে মকবুল।
“গাড়ি আ রাহা হ্যায় মকবুল। সিগন্যাল খুলা হুয়া হ্যায়।”- বলে শনু নিজের ছোট্ট হাতটা দিয়ে সর্বশক্তিতে চেপে ধরে মকবুলের সরু দুবলা কব্জিটা।
“আভি বাঁচা পাউঁ তো এক দো প্যাকেট মিল ভি সকতা হ্যায়, ছোড় দে মুঝে।”
-“বেওকুফি মত কর ইয়ার, প্যাকেট কা হাল তো দেখ। উসমে এক ভি বাঁচা নেহি। দেখ আভি ভি গাড়ি চল রাহি হ্যায় উসকে উপর।”

দুজনে নিঃশব্দে অপেক্ষা করে সিগন্যাল লাল হওয়া পর্যন্ত। ডান পা টা হাঁটু থেকে নখ পর্যন্ত গরম হয়ে উঠেছে মকবুলের। জ্বালা করছে কেটে যাওয়া জায়গাগুলো। সিগন্যাল লাল হতে তাকে যেতে না দিয়ে শনুই গিয়ে উদ্ধার করে আনে প্যাকেটটা। ফুটপাথে উঠে এসে মুখ খুলে দেখে একটা নির্বাক দৃষ্টি মেলে তাকায় মকবুলের দিকে। যে দৃষ্টির মানে বুঝতে একটুও অসুবিধা হয়না মকবুলের এই বয়সেও। তাও শেষবারের মত প্যাকেটটা শনুর হাত থেকে নিয়ে ভেতরটা আঁতিপাঁতি করে খোঁজে মকবুল। একটা মোমবাতিও যদি গোটা পায় সে আশায়। হতাশায় ছুঁড়ে দেয় প্যাকেটটা ফুটপাথের ধারে ঘাসের ওপর। শনু এসে প্যাকেটটা তুলে নিয়ে ধীরে ধীরে বলে, “ফেঁকনা মৎ ইয়ার, ফ্যাক্টরি মে দে দেনেসে ফির সে মোমবাত্তি বন সকতা হ্যায়। শেঠকে গুদামমে ইস কো লৌটাএঙ্গে তো থোড়া ডাঁট কম ভি পড় সকতা হ্যায়।” অসহায় চোখে শনুর চোখের দিকে তাকায় মকবুল। বিক্রম শেঠের মুখটা ভেসে ওঠে চোখের সামনে।

এরপর দুই বন্ধু মিলে যখন মকবুলের ডানপায়ের চটিটা উদ্ধার করে, রাস্তার পাশের দোকান থেকে জল নিয়ে পা ধুয়ে, শনুর পকেটে থাকা রুমাল দিয়ে ডান পায়ের বুড়ো আঙ্গুলের আধখানা উঠে যাওয়া নখকে বেঁধে উঠে দাঁড়ালো তখন মকবুলের হাঁটু জবাব দিয়েছে। অসহ্য যন্ত্রণা আর জ্বালা। এখনও রক্ত ঝরছে। পিঠে হাত রাখল শনু। “বহুত দরদ হো রাহা হ্যায় ক্যায়া মকবুল? ধীরে ধীরে চলেঙ্গে ইয়ার।” শনুর কাঁধে ভর দিয়ে প্রায় আধঘণ্টা ধরে হেঁটে বহু কষ্টে যখন তারা বিক্রম শেঠের গুদামের দরজায় এসে পৌঁছালো তখন মকবুলের আর বিন্দুমাত্র শক্তি নেই দাঁড়িয়ে থাকার।

তাদের দেখে শেঠের কর্মচারী বিনোদ বলে ওঠে, “আরে, আ গ্যায়া ছোটু? আচ্ছা হি হুয়া। তুম দোনো কে লিয়ে ওয়েট কর রাহা থা। চল, বাকি কে মাল রাখ দে। জলদি জলদি হিসাব নিপটাকে ঘর জানা হ্যায়। দিওয়ালী কে দিন, জলদি কর। কিতনে প্যাকেট বাঁচা হ্যায় বোল। প্যায়সা লে লে মালিক সে। শনু, বাকি কে প্যাকেট দে দে মুঝে।”

শনু আর মকবুল স্থানুর মত দাঁড়িয়ে থাকে বিনোদের মুখের দিকে তাকিয়ে। তাদের দিকে অবাক চোখে তাকায় বিনোদ। বিরক্ত হয়ে বলে ওঠে, “আরে ক্যায়া হুয়া? জলদি কর। ইধার আ শনু কিতনে প্যাকেট বাকি হ্যায় তেরে পাশ? তুঝে গুলাল দিয়ে থে না আজ ম্যায়নে? আরে মকবুল প্যায়ের মে ক্যায়া হুয়া তেরা?”

এতক্ষণে বিনোদের চোখ গেছে মকবুলের পায়ের দিকে। বিপদ বুঝে চট করে সামনে এগিয়ে যায় শনু। “বিনোদ ভাইয়া, ইয়ে মেরা বাকি কে প্যাকেট। পাঁচাশ দিয়ে থে, ইয়ে ষোলা বাকি হ্যায়।”

-“আচ্ছা, সহি হ্যায়? অর মকবুল তেরা কিতনে বাকি হ্যায়?”


ভেতরের ধুকপুকুনিটা শুনতে শুনতে মকবুল শনুর দিকে তাকায়। শনুও ভয়ার্ত চোখে তার দিকে তাকিয়ে আছে। 




Tuesday 21 October 2014

দেওয়ালী........১

“এ ছোটু, ইধার আ। কিতনে কা হ্যায়?” সাদা রঙের লম্বা গাড়িটার কাঁচটা একটু নেমে এল। ভেতর থেকে গোঁফওয়ালা ফর্সা লোকটা মুখ বাড়িয়ে জিজ্ঞাসা করল। মকবুল আকাশ থেকে চোখ নামিয়ে সামনের মেটে গাড়িটাকে পাশ কাটিয়ে এগিয়ে গেল সাদা গাড়িটার দিকে। ভেতর থেকে সবুজ জামা পরা টোবা গালের ফর্সা বাচ্চাটা মকবুলের হাতের দিকে আঙ্গুল তুলে বলে উঠল, “পাপাজি উও অরেঞ্জওয়ালা, উও অরেঞ্জওয়ালা লে লিজিয়ে না।” পাশ থেকে লাল চকমকে সালওয়ার-কামিজ পরা তার মা সাথে সাথে বলে উঠল, “ওয়েট বেটা, কিমাত তো পুছনে দো পাপাজি কো।” “চালিশ রুপেয়া প্যাকেট স্যার, লে লিজিয়ে না স্যার, বহুত দের তক জ্বলেগি”- মুখস্থ স্বরে বলে ওঠে মকবুল। ততক্ষণে তার চোখ চলে গেছে বাচ্চা ছেলেটার হাতের দিকে। কি দারুণ চকচকে বন্দুকটা। নতুন বোঝাই যাচ্ছে। নিশ্চয়ই অনেক ক্যাপও কিনেছে। ইশ তারও একটা বন্দুক ছিল। মা কে বায়না করে আদায় করেছিল। বছর তিনেক আগে অবশ্য। তারপর জং ধরে গেল, আর ওটা দিয়ে ক্যাপ ফাটানো যায় না। অবশ্য ক্যাপই বা কোথায় তার? গেল বার থেকেই তো সেসবের পাট উঠেছে মকবুলের।
“চালিশ!!!? পাগল হ্যায় ক্যা? বিশ পে বিক রাহা হ্যায় পিছলে ক্রসিং পে। সিগন্যাল হো গয়া, দে দে বিশ পে।”-চমক ভাঙ্গে মকবুলের। “নেহি স্যার, প্যাঁয়তিশ দে দিজিয়ে।”
“হঠ শালে, সিগন্যাল হো চুকা। ইশ উম্র সে হি শিখ গয়া শালা বিশ কে চিজ চালিশ পে।”-গাড়ির প্যাঁ-পোঁ হর্নের মধ্যেই কোন ক্রমে গাড়ির জঙ্গল থেকে ছিটকে বেরিয়ে এসে ফুটপাথে ওঠে মকবুল হাতের মোমবাতির প্যাকেটগুলো সামলে। পঁয়ত্রিশ-এর এক পয়সা কমে বেচতে বারণ করেছে বিক্রম শেঠ। কুড়ি টাকায় দিলে তো হয়েই যেত। বাকিটা তার পয়সা থেকে কেটে নিত শেঠ। চলতে থাকা গাড়ির স্রোতের মধ্যে ঘাড় উঁচু করে এদিক ওদিক দেখল মকবুল। শনুকে দেখা যাচ্ছে না কোথাও। বোধহয় উল্টো দিকে আছে। ওদিকের গাড়িগুলোকে থামিয়ে রেখেছে এখন। ওখানেই আছে নিশ্চয়ই শনু। শনু কখনও দাঁড়ায় না। এই এত্তবড় চৌমাথায় কোন না কোন দিকের গাড়ি সব সময়ই আটকে থাকে। শনু ঠিক সিগন্যাল দেখে শুনে খরগোশের মতন লাফ মেরে আটকে থাকা গাড়িগুলোর কাছে পৌঁছে যায়। কোনদিকের কোন সিগন্যালটা কার পরে খুলবে এই ব্যাপারটায় ও-র মতন এখনও সড়গড় হয়নি মকবুল। পরবর্তী লাল সিগন্যালের জন্য অপেক্ষা করে মকবুল।            
ফুটপাথে দাঁড়িয়ে গাড়ির মিছিল দেখতে দেখতে মকবুলের মনে তক্ষুনি দেখা চকচকে কালো রঙের বন্দুকটা চোখের সামনে ভেসে ওঠে। ক্যাপ ফাটাতে দারুণ লাগে মকবুলের। যে বছরে বন্দুকটা কিনে দিয়েছিল মা সেবছর সে আর দীপক মিলে খুব ক্যাপ ফাটিয়েছিল পুরো দশটার প্যাকেট কিনে দিয়েছিল দীপকের বাবা তাদের। আজও সে দেখেছে শেঠের গুদামে কাল নতুন মাল এসেছে। তাতে বন্দুক, ক্যাপ আর অনেক কিছু আছে। এগুলো অবশ্য তাদের দিয়ে বিক্রি করাবে না শেঠ। এগুলো সব দোকানে দোকানে যাবে। জানে মকবুল। সেগুলো অবশ্য এখুনি গাড়িতে দেখা বাচ্চা ছেলেটার হাতের বন্দুকটার মত অত ভাল নয়। সেটা তো যেমন বড়, তেমনি চকচকে। সামনের নলটা কত বড়। শেঠের গুদামের মতনই একটা বন্দুক থাকলে বেশ ভাল হত। একটা ক্যাপের প্যাকেট পেলে শনুর সাথে দেওয়ালীতে বেশ ফাটানো যেত। আব্বুকে বললে হয়ত রাগের মাথায় দুচার ঘা দিয়েই দেবে পিঠে। কি যে হয়েছে আব্বুর? সবসময় রেগেই আছে। কালকে রাতে বিক্রম শেঠের গুদাম থেকে বাকি মাল জমা করে ফেরার সময় চকে এগরোলের গন্ধে দাঁড়িয়ে পড়েছিল মকবুল। খিদেও পেয়েছিল বেজায়। এগরোল সে খেয়েছে দু-দুবার। একবার দুর্গাপুজোর সময় মতিকাকা রোলের দোকান দিয়েছিল হাসপাতাল মাঠের মেলায়। তাকে রেখেছিল মতিকাকা হাতে হাতে যোগান দেবার জন্য। আর একবার দীপকের সঙ্গে রসুলপুরের মেলায় গিয়ে একটা রোল কিনে দুজনে খেয়েছিল। দীপকের কথা মনে পড়লে বড্ড মন খারাপ করে মকবুলের, যদিও এখানে শনুর সাথে তার ভালই ভাব হয়েছে এই দেড়বছরে। তাও দীপকের মত কি আর? শনুর সাথে তো হিন্দি বলতে হয়। যদিও সে এখানকার ভাষা দিব্বি চালিয়ে নিতে পারে তাও ভাল করে কি আর গল্প করা যায় হিন্দিতে? ব্যাটা একবর্ণ বাংলা শেখেনি তার সাথে থেকেও। কাল রোলের দোকানের সামনে শনুও ছিল তাদের সাথে। সে জানত এগরোল কিনতে দেবেনা আব্বু। তাও মুহূর্তের জন্য থেমে রোলের ঠ্যালাগাড়িটার দিকে তাকিয়েছিল সে। আব্বু ওর সামনেই কান ধরে এক থাপ্পড় মারল মকবুলকে-“খাবার দেখলেই ছোঁক-ছোঁক করা না খালি? পেটে কি সেঁধিয়েছে রে হতচ্ছাড়া? চল পা চালিয়ে।” খুব কান্না পাচ্ছিল তখন। মা তাকে খাওয়া নিয়ে কখনও বকেনি। মায়ের কথা মনে হলেই এখনও মনটাকে অন্যদিকে ঘুরিয়ে নিতে হয় তাকে। কতদিন হল? দু-বছর প্রায়। এখানেই তো তাদের প্রায় দেড় বছর হয়ে গেল। সরকারী হাসপাতাল থেকে আব্বু আর চাচাদের সাথে মাকে আনতে গেছিল মকবুল। কেমন যেন ন্যাকড়া জড়ানো পুঁটলি মনে হচ্ছিলো মাকে। অথচ মাটি দেবার আগে সেই মুখটাই কেমন হাসি হাসি লাগছিল মকবুলের। কেমন যেন শান্ত। পুঁচকে ভাইটাও বাঁচলনা, যে জন্য মায়ের হাসপাতালে যাওয়া। আর তারপর থেকেই আব্বুও যেন কেমন হয়ে গেল। মকবুলের সঙ্গে কথাই হত না। চাচীর দাওয়ায় ভাত খেতে বসে একদিন বলল, “তোকে আর ইস্কুলে যেতে হবেনি কাল থেকে। আমরা সামনের রোববার চলে যাব।” “কোথায় যাব”- জিজ্ঞাসা করতে বলেছিল, “অতকথায় তোর কি রে? পেট ঠুসে ভাত গিলছিস, তাই গেল না। আমার সনে যাবি রোববার ব্যাস।” তারপর তো একটা অচেনা লোকের সাথে সারারাত ধরে ট্রেনে চেপে এই শহরে। লোকটা নাকি কামালুদ্দিন চাচার কোন কুটুম। হবে হয়ত। আব্বু তো তার সাথে হেসে হেসে কথা কইছিল ট্রেনে। ট্রেনে আসতে ভালই লাগছিল মকবুলের। এত দূরে ট্রেনে চেপে কোনদিন আসেনি সে। কেমন হু হু করে হাওয়া দিচ্ছিল জানলায় দাঁড়ালে। শুধু দীপকের জন্য একটু একটু মন খারাপ লাগছিল তার। তারা দুজনে এলে বেশ ভাল হত। কিন্তু দীপক কেন আসবে তার সাথে? দীপক তো ইস্কুল ছেড়ে দেয়নি তার মত। সে তো নতুন শহরে কাজ করবে। আব্বু বলেছে এই লোকটাকে তার জন্যও কাজ দেখতে। তারপর সেই লোকটা মানে আব্দুল ভাই-ই আব্বুর রিক্সার মালিকের কাছে আর তার এই সিগন্যালের হকারির জন্য বিক্রম শেঠের কাছে তাদের নিয়ে গেছিল।
সকালে বিক্রম শেঠের গুদাম থেকে মাল তুলেছে সে। কদিন ধরেই রংবেরং এর নানান কিসিমের মোমবাতির প্যাকেট দিচ্ছে তাকে শেঠের লোক। সামনে দেওয়ালী। এসময় বিকবে ভাল। শনুকে আজ দিয়েছে নানা রঙ এর আবির। একটু অবাক হয়েছিল মকবুল তা দেখে। আবির তো দোলের সময় লোকে কেনে বলে জানে সে। এখানে যাকে বলে হোলি। শনু- গুদাম থেকে বেরিয়ে বুঝিয়ে দিয়েছিল, “আরে দেওয়ালী কে টাইম ইশসে রঙ্গোলী বানাতে হ্যায় না, পতা নেহি তুঝে?”
-রঙ্গোলী?
- আরে উও ডিজাইন বানাতে হ্যায় না ঘর পে? ভগবান কে সামনে?
- ও, আলপনা? বুঝেছি।
- ক্যা?
- আরে হামারে দেশ মে আলপনা বলতে হে ইশকো। ম্যায়নে দেখা হ্যায় দীপক কে ঘর মে। কিন্তু শনু উও তো আবির সে নেহি বানাতে থে। এক হি রঙ কা হতে থে। সাদা।
- সাদা? ক্যা? তু ছোড়। ইঁহা পে ইস সে বানাতে হে। রঙ্গোলী-লাড্ডু-মিঠাই-পটাকে ইয়ে সব হোতা হ্যায় দেওয়ালী।
- হ্যাঁ রে, আমাদের ওখানেও সবাই কালীপূজোতে মানে...ইয়ে......দেওয়ালীতে পটকা ফাটাত। কালিপটকা, চকলেট বোম। মুঝে না উও লাইটিংওয়ালী বাজি মানে পটাকে আচ্ছে লাগতে হ্যায়। তুবড়ি, চরকি, তারাবাতি, ইয়েসব।
-আরে হাঁ ইয়ার, তুঝে পতা হ্যায় দেওয়ালী মেলা লগে হ্যায় না পিছে, উঁহা পে না ইয়েসব রোশনাই হোগা, আজ সে হি স্টার্ট। তিনদিন হোগা। চলেঙ্গে ইয়ার। আশমানমে দেখনা কিতনে রোশনাই, তারে-ফুল জ্যায়সা।
-হাঁ শনু, পতা হ্যায় মুঝে। শুন না, আমাদের গ্রামে...মানে...
-হাঁ হাঁ পতা হ্যায় তেরে গাঁও মে......
-দেখা হ্যায় ম্যায়নে। হোতা থা ওয়াসি রোশনাই...         
দেশে থাকতে মায়ের হাত ধরে ফলহারিনী কালিপুজোর দিনে শ্মশান কালী মন্দিরের পেছনের মাঠে বাজি পোড়ান দেখতে যেত মকবুল। দূরে দাঁড়িয়ে হাঁ করে আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকতো। ওপর থেকে আলোর মালা, আলোর ফুলঝুরি, নেমে আসতো। নিচে ঝরনার মত বাজি পুড়ত। একবার সে আর দীপক মিলে ঠিক করেছিল বড় হয়ে যখন টাকা হবে তাদের তখন একটা অন্ততঃ ওরকম বাজি কিনবে তারা। সেই যে যেটা আকাশে উঠে বিশাল জায়গা জুড়ে ফুলের মতন হয়ে ফেটে পড়ে, ওরকম।
তারা কালীপুজোয় বাজি পোড়ান দেখতে যেত শুনে অবাক হয়েছিল শনু।
-তু যাতা থা? কালিপুজা মে?
- হাঁ। কিঁ?
- নেহি...মতলব...তু মুসলমান হ্যায় না?
-তো ক্যায়া হুয়া? হামারে উঁহা পে সব লোক যাতে থে। বাজি...মতলব রোশনাই দেখনে মে ক্যায়া হ্যায়? সবেবরাত মে ভি তো দীপক আতে থে মেরে ঘর। ইঁহা পে নেহি যাতে ক্যায়া?
-নেহি...উও বাত নেহি...পর...ঠিক হ্যায় ছোড়...আজ রাত যায়েঙ্গে...রোশনাই দেখনে। পাক্কা।
-আব্বু কো পুছনা হোগা শনু।
- ঠিক হ্যায় ইয়ার, পুছ লেঙ্গে, রাত কো শেঠকে গুদাম সে তুঝে লেনে আয়েঙ্গে না? তব পুছ লেঙ্গে। জায়েঙ্গে জরুর।
-ঠিক হ্যায়।
সকাল থেকে সময় যেন আর কাটছে না মকবুলের। তিন প্যাকেট মোমবাতি বিক্রি করতে পেরেছে সে সকাল থেকে। দুটো পঁয়ত্রিশে আর একটা চল্লিশে। পঞ্চাশ প্যাকেট দিয়েছে গুদাম থেকে আজ। অন্ততঃ পঁচিশ প্যাকেট না বেচতে পারলে রোজ দেবার সময় কথা শোনাবে শেঠ। কিন্তু বাজির কথা শোনার পর থেকেই আকাশে চোখ চলে যাচ্ছে মকবুলের। পেছনের মাঠের বাজি শুরু হলে লম্বা বাড়িটার পাশ দিয়ে দেখা যাবে। তাই মাঝে মাঝেই ওদিকে চোখ চলে যাচ্ছে তার। বিকেল থেকেই ওদিক থেকে চকলেট বোমের আওয়াজ শুনতে পাচ্ছে মকবুল। কখন শুরু হবে কে জানে।
এইসব এদিক –ওদিক ভাবনার মাঝে দেখল আবার সিগন্যাল লাল হয়েছে। চোখ চারালো মকবুল। গাড়িগুলো এসে জমছে আস্তে আস্তে। মকবুল প্যাকেটগুলো সামলে রাস্তায় নামলো। দূরে শনুকে দেখতে পেল সে এতক্ষণে উল্টোদিকের ফুতপাথে। এদিকে আসার চেষ্টা করছে। সাঁই-সাঁই গাড়ির মিছিল ভেদ করে আসতে পারছে না। নিজের কাজে মন দিল মকবুল। “মোমবাত্তি লিজিয়ে।” লিজিয়ে না আঙ্কল, আচ্ছা হ্যায়।”
-“কিতনে ধুল হ্যায় ইয়ার, সিসা উঠা দে।”- গাড়ির ভেতর থেকে গলা ভেসে এলো। কাঁচ উঠে গেলো গাড়ির।
পেছনের গাড়িটার দিকে গেল মকবুল। যেতে যেতেই শুনল-“দিয়া লেনা থা।” সাথে সাথে গাড়ির পেছনের জানলা দিয়ে চোখ চারিয়ে বলল- “মোমবাত্তি হ্যায় দিদি...বহুত বড়িয়া...আচ্ছা সেন্ট ভি হ্যায় ইশমে...রোজ...জেসমিন... স্রেফ চালিশ রুপেয়া প্যাকেট। লে লো না দিদি।”
-“আচ্ছা এক প্যাকেট দে দে। জেসমিন।”
একটা প্যাকেট গাড়ির জানলা দিয়ে বাড়িয়ে দিয়ে মকবুল বলে ওঠে- “স্রেফ এক? দিদি অর এক লে লিজিয়ে না। বহুত বড়িয়া হ্যায় দিদি। বহুত দের তক জ্বলেগি।”
-“নেহি অর নেহি, দিয়া লেনা থা। ইয়ে লে লিয়া।” কিছুতেই আর আর একটা বেচতে পারল না মকবুল।
চারটে দশ টাকার নোট কোমরের থলিতে গুঁজতে গুঁজতেই প্রথম আতশবাজিটা চোখে পড়লো মকবুলের। আকাশে উঠে বিশাল ফুলের মতন ছড়িয়ে পড়লো সারা বাঁ দিকের আকাশ জুড়ে। বাজির রোশনাই শুরু হয়ে গেছে পিছনের মাঠে। তারপর আর একটা...তারপর আরও একটা। দুমদাম আওয়াজের সাথে আকাশে আলোর মেলা। এখনি শুরু হয়ে গেল, তবে যদি তারা যেতে যেতে শেষ হয়ে যায়? চঞ্চল হয়ে উঠলো মকবুল। শনুকে খুঁজল। এই দিকেই আসছে মনে হচ্ছে। ওহ না তো। কোণাকুণি উল্টো দিকে যাচ্ছে যে। হ্যাঁ তাইতো। ওদিকেই তো গাড়ি আটকাবে এখন এদিকের সবুজ সিগন্যাল দিলে। “শনু-উ-উ-উ” বলে চেঁচিয়ে ডাকল একবার মকবুল। শুনতে পায়নি শনু। শনুকে কথাটা বলে আবার এদিকে চলে আসতে হবে। তাড়াতাড়ি রাস্তা পেরিয়ে ওপারে যেতে শুরু করল মকবুল।