Monday 23 March 2020

বদল


একসাথে গাঁথা শব্দেরা যখন সুর খুঁজে পায় তখন কবিতা হয়ে ওঠে। পরপর রং জুড়ে জুড়ে ছবি হয়ে ওঠে।  আর পরের পর অনুভূতি যোগ করে করে গড়ে ওঠে একটা গোটা জীবন। বিচিত্র সব অনুভূতি, অযুত তার প্রভাব। এক একটি ঘটনা, এক একটি মন্তব্য মুহূর্তে বদলে দেয় একটি মানুষকে।  আগাপাশতলা। কখনো রাতারাতি, কখনো অতি ধীরে, একটু একটু করে সারা জীবন ধরে। আজন্মের ভীতু মানুষটি একরাতে ভয় সম্পর্কে বেমালুম উদাসীন হয়ে পড়ে। আবার কুড়ি বছরের ক্ষণিকবাদী মানুষটিই ষাট বছরে জীবনের আবহমানের চলমানতা অনুভব করে শান্ত দর্শকমাত্র হয়ে ওঠে।

আসলে বোধহয় বদলটা আসবে বলে আসে না। বদলটা চাও বা না চাও, হয়েই যায়। একজন মানুষ সারা জীবনে এতটুকুও বদলায়নি এমনটা হয়না। এবং আমার বিশ্বাস বদলটা ভালোর দিকেই হয়।  এখন তুমি বলবে বদলটা ভাল না খারাপের দিকে সে আমি জানছি কেমন করে? ভাল বা খারাপটা তো আপেক্ষিক। তা ঠিকই। অবশ্যই আমি বলব, আমার যেটুকু ভালো বলে মনে হয় সেটুকুই। এতে বিশেষ সমস্যা নেই। সমস্যাটা তখনই শুরু হয় যখন আমার ভালোটা আমি তোমার ওপর চাপিয়ে দিতে চাইবো। তাই না? আমার ভাবনাটা যতই যুক্তিযুক্ত হোক না কেন, ততক্ষণ তোমার সেটা চাপিয়ে দেওয়া বলেই মনে হবে যতক্ষণ না তুমি নিজে সেটাকে ভালো বা যুক্তিপূর্ণ বলে মনে করছ, তাই না? তার আগে পর্যন্ত তোমার যুক্তিটিকে টিকিয়ে রাখতে বা হয়ত নিজের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে প্রানপণে তুমি সেটার বিরুদ্ধে কথা বলে যাবে। স্থিতধী মানুষ বেশি নেই। যাঁর ক্ষমতা আছে আদ্যন্ত সঠিক যুক্তির কাছে নিজের ভুল বুঝতে পেরে আত্মসমর্পন করার। আমরা বেশির ভাগ মানুষই প্রথমে নিজের যুক্তিটা সঠিক মনে করেই যেকোনো বিষয়ে তর্ক করতে শুরু করি। তারপর তর্কের মাঝেই যুক্তি-প্রতিযুক্তির মাঝে পড়ে হয়ত কখনো নিজের যুক্তির ফাঁকটুকু নজরে আসে। মজাটা শুরু হয় তারপরেই। এতক্ষন পর্যন্ত যুক্তি তর্কের পর্যায় থেকে ব্যাপারটা "আমার যুক্তিকে হেরে যেতে দেব না" জাতীয় একটা আত্মরক্ষাসুলভ লড়াইয়ের চেহারা নিয়ে আসি আমাদের নিজেদের বাঁচাতে। আর কে না জানে যে আত্মরক্ষার সেরা উপকরণ হলো আক্রমণ। অর্থাৎ তখন আমরা প্রতিপক্ষকে আক্রমণ করতে শুরু করি। আর যেহেতু ততক্ষনে আমাদের যুক্তির ভাঁড়ার শূন্য, অতএব আমরা যুদ্ধের নিয়ম ভুলে দাঁত নখ বের করে আঁচড়াতে থাকি। অসভ্যের মত "অমুকে তো করেছে, তাই আমিও করেছি।" "বেশ করেছি, আবার করব" ইত্যাদি বলে কৃতকর্মের সামনে যাহোক একটা ঢাল খাড়া করার চেষ্টা করি। আমরা সবাই এরকম। বিশ্বাস করো, তেমন তেমন পরিস্থিতিতে পড়লে তুমি, আমি প্রত্যেকে এরকম। কেউ ব্যতিক্রম নই। This is simple human nature, self-defense. এক্ষেত্রে, Defense to protect self opinion. আত্মধারণা সমর্থন। অনেকক্ষেত্রেই সেটি ভুল ধারণা। আর সেটি যে ভুল, আমরা সেটা খুব ভালো করে জানি মনে মনে। তবুও গলা ফাটিয়ে লড়ে যাই ওই basic human nature রক্ষার তাগিদে।

যাক গে যাক। এসবে তোমার বিশেষ কিছু দোষ দেখিনা। এতদিন মুখে রক্ত তুলে তর্ক করেছো, তারপর মনে মনে নিজের ভুল বুঝতে পেরে "হেঁ হেঁ, যাহঃ যাহঃ, এসব অনেক দেখা আছে" বলে ছদ্ম তাচ্ছিল্য করেছো,  আর সব শেষে "ও কেন করেনি? তাই আমিও করিনি" - এরকম ক্লাস টু এর বাচ্চাদের মতো যুক্তি খাড়া করে দুর্গ আগলানোর চেষ্টা করেছো। শেষকালে আর না পেরে ফাটিয়ে ঝগড়া করেছো। কিন্তু এবার তো পরিস্থিতি তোমায় সুযোগ দিয়েছে বদলানোর। নিজেকের খোলসটাকে বদলানোর। ওই যে আমি প্রথমেই বলছিলাম না, ঝপ করে একদিন সুযোগ চলে আসে নিজেকে বদলানোর। আগে পিছে কিছু ভাবার আগেই দেখবে সামনে বিশাল সুযোগের সমুদ্দুর। সেটা হাতছাড়া করার বোকামি কি তোমার না করলেই নয়? বাইরে তোমায় যতই লোকে গালাগাল করুক না কেন যে তুমি "মূর্খ", "গাড়োল", "কিছুই বোঝোনা", তার পর আরো কিসব পড়লাম- "আবোদা", "আবাল"-ইত্যাদি ইত্যাদি বাছাই করা নতুন-পুরোনো বিশেষণ, তুমি লোকটা আদপে কি সেরকম নাকি? মোটেওনা। বিশ্বাস করো, এসব বিশেষণ প্রয়োগ করে যাঁরা তোমায়  গন্ডমূর্খের একনম্বর উদাহরণ বলে দাগিয়ে প্রবল ধিক্কার আর ছ্যা ছ্যা করে মুখে মাস্ক পরে ঘরে খিল তুলছেন, তাঁরাও তার আগে দোকানে গিয়ে প্রয়োজনের অনেক অনেক অতিরিক্ত নিত্যপ্রয়োজনীয় খাবার জিনিস আর হাত ধোয়ার জিনিস কিনে ঘর বোঝাই করেছেন। যাঁরা বলছেন তাঁরা, যাঁরা বলছেন না তাঁরা, যারা এসবের সমস্ত কিছুর ঊর্র্ধে কেবল কোনোক্রমে বেঁচে আছেন তাঁরা, তুমি আমি সক্কলে একই রকম গাড়োল। কেবল কে কোন বিষয়ে গাড়োলত্ত্ব প্রকাশ করবো সেই বিষয়ে খানিক তফাৎ আছে।

এই যেমন মনে করো, এখন তুমি নাক খুঁটে সেই হাতে এলিভেটরের সুইচ টিপলে আমি মুখে মাস্ক আর হাতে গ্লাভস পরে তোমার গলাটাই টিপে দেব। কিন্তু এই আমিই আবার সারা শহর ঘুরে গাড়ির ট্রাঙ্ক ভর্তি করে জিনিস কিনে ফ্রিজ বোঝাই করি। আমিই বা তবে এই পরিস্থিতিতে গাড়োল নই কেন? যদিও আমার যুক্তি আছেই এখানে যে "সবাই সব কিছু কিনে দোকান ফাঁকা করে দিলো, আমি তবে বোকার মতো কিনবো না কেন।" এরপর এই ধরো, আপিস-কাচারী-ইস্কুল-কলেজ বন্ধ বলে বাক্স প্যাঁটরা গুছিয়ে বেড়ু করতে চললুম। তারপর পুলিশের তাড়া খেয়ে, ফেসবুকের গুঁতো খেয়ে তারপর বুঝলুম যে "এহেঃ, কাঁচা কাজ হয়ে গেছে বড্ড। এখন ফেসবুকে ছবিও দেওয়া যাবে না। "ভয় পাইনা" বলে বাহাদুরিও নেওয়া যাবেনা। আসাটাই ফালতু হলে গেলো।" কেন যে আদপেই আপিস-কাচারী-ইস্কুল-কলেজ বন্ধ তার কারণটা ঠিক করে বুঝে নেব? ফুহঃ, অতো সময় নেই। তারপর ধরো একদিনের কারফিউ, সেই একটা দিন ঘরে বসে থাকতে আমার অসুবিধা হচ্ছে। তাই মনে করো পাড়ার চায়ের দোকানে গিয়ে আরো পাঁচজনের সাথে গুলতানি করতে করতে বর্তমান পরিস্থিতি কতটা ভয়ঙ্কর সেই আলোচনা যে করব একটু, তারও উপায় নাই বাপু? কে না কে এসে বলবে "এইও, চায়ের দোকান খুলেছো কেন? এই তোমরা এখানে জড়ো হয়েছো কেন? জানোনা কারফিউ?" আমি বাপু ফেসবুকে বাঘ মারা লোক, আমায় সহজে হারলে চলে? তাই আমার সামনে গামছা গায়ের লুঙ্গি পরা তুমি যদি মিনমিন করে বলো "চা খাবো না আমরা?" আমি চ্যাঁচাবো, "আমলার ছেলেকে জিজ্ঞাসা করো, ও কেন বেরিয়েছে, তাইলে আমি বলব।" তোমার থেকে বেশি জোরে চিৎকারটা আমাকেই করতে হবে তাই না? তুমি গামছা গায়ে, লুঙ্গি পরে আর আমি চশমা পরে ইন করে শার্ট-প্যান্ট। তুমি আমি দুজনেই গাড়োল। পরে অবশ্য ঘরে গিয়ে ফেসবুকের পাতায় তোমায় গাড়োল বলতে আমার একটুও আটকাবে না। কারণ আমি ছাড়া বাকি সবাই আমজনতা। আমজনতার মুণ্ডপাত করা আমার হক। এবার যদি মনে করো একমাস ঘরে থাকতে হয় তাহলে ভাইরাস কেন, স্নায়বিক রোগেই স্রেফ মরে যাবো।  

তবে আমি কিন্তু আশাবাদী। আমি মনে মনে স্থির বিশ্বাস করি, তুমি যতই গাড়োল হওনা কেন একখানা দারুন পরিস্থিতির সম্মুখে সময় তোমায় দাঁড় করিয়েছে। কেবল দর্শক হয়ে থাকবে না তুমি-এ আমি ঠিক জানি। নিজের সবজান্তা খোলসটিকে ফেলে দিয়ে ঠিক নিজেকে পরিবর্তন করবে জানি। আর ইয়ে ওই "ও কেন করেছে ? আমিও বেশ করেছি। ওকে আগে বকো, নইলে আমিও করবো।"- এই বস্তাপচা, মানে এই ক্লিশে, মানে এই ভীষণ পুরোনো ডায়লগটা না - ভাবে দেখলুম আর চলছে না বুঝলে। সব স্টাইলেরই তো একটা এক্সপায়ারি ডেট থাকে তাই না? ঐটা বরং বাদই দিয়ে দাও বুঝলে। "দেখ কেমন দিলুম" লুকটার জন্য আরো একটা ভীষণ কার্যকরী ডায়লগ বলি বরং চুপিচুপি। আগামী দিনে ভীষণ "ইন" হয়ে যাবে ব্যাপারটা। আগেভাগে বলি বরং। এই মনে করো, সত্যি সত্যি নিজেকে বদলে একদম ভেতর বাইরে এক করে দিলে। বুক বাজিয়ে সত্যি সত্যি ভালো হয়ে গেলে। তুমি নিজেই জানো ভালো বলতে আমি কি বলছি। সব আছে তোমার ভেতরে। কেবল করতে ভয় পাও। আজকে যারা গাড়োল বলছে কালকে তারাই পিষে মারবে বলে। কিন্তু প্রথম বাধাটা কাটিয়ে সাহস করে সঠিক পথে অন্যের অসুবিধা না করে লড়াইটা করে দেখাও দিকি একবার, সবাই বলবে "দেখেছো, লোকটার কলজের জোর! যা বলে তাই করে দেখায় কিন্তু। লড়াইটা দেখলে?"

জৈব মারণাস্ত্র ব্যাপারটা সত্যি কিনা, রাজ্য এবং কেন্দ্রীয় সরকারের সমস্ত সৎপ্রচেষ্টার কথা বেমালুম ভুলে গিয়ে কেবল থালা বাজানো আর কেমন ভুল পদ্ধতিতে কাশি ঢাকতে হবে এই নিয়ে খিল্লি করা, এবং আশ্চর্য সব গুজবের ভিডিও শেয়ার করার ফাঁকে ফাঁকে, এই ক্রাইসিস মিটে গেলে 'কেবল নিজেরটি ছাড়া কিছু বুঝিনা' এই মুখোশটা সরিয়ে ফেলে সত্যিকারের একজন স্বাস্থ্যসচেতন, নাগরিক-দায়িত্ব সচেতন, সুনাগরিক হয়ে দেখাও দিকি। আমি জানি তুমি ঠিক পারবে। কারণ আদতে তুমি সেরকমই। এই ক্রাইসিস তোমার মুখোশটা খুলে নিক এই শুভেচ্ছা রইলো। যেটা তুমি নানান ভয়ে কেবল খুলে উঠতে পারছো না।

এ লেখা যতক্ষণে তোমার চোখে পড়বে ততক্ষনে ওপরের স্ট্যাটিসটিক্স অনেকটাই বদলে যাবে, দুৰ্ভাগ্যবশতঃ খারাপের দিকেই। খুব বেশি না বদলানোটা তোমার হাতেই। এবার বোলো কতোটা শক্তিধর তুমি। ভেবে দেখো বদলটা আনবে কি না?

আর আমি? ধুর বোকা। আমি তো আগে থেকেই ভীষণ ভালো। আগেই তো বললাম। আমি বাদে বাকি সকলে তো আমজনতা। আর আমজনতারই তো সব দোষ এযাবৎ কাল পর্যন্ত যখন যা যা হয়েছে।

দোলখেলা

অন্য কিছু খুঁজতে গিয়ে হঠাৎই সেদিন একটা বাক্স পেলুম। যত্ন করে গুছিয়ে রাখা। কি যে রেখেছিলুম তাতে ভুলেই গেছি। তাড়াতাড়ি খুলে দেখি একটা রঙিন পুঁটুলি আর পুঁটুলির মধ্যে কত্ত রং। কালো মেয়ের কপালের টিপের মতন লাল, গোধূলির আকাশের মতন কমলা। আহির ভৈরব যখন বাজে, তখন যেমন রং হয় রোদ্দুরের, তেমনি এক হলুদ রং ও পেয়ে গেলুম সেখানে। আর ছিল প্রথম প্রেমের স্পর্শের মতন এক গোলাপি রং, আর মধ্যদিনের ঝকঝকে আকাশের মতন স্বচ্ছ এক আসমানী রং।

রঙের সাথে রং মিলিয়ে ছবি আঁকতে গিয়ে দেখি আঁকব কি তাই তো ঠিক করিনি। সাদা পাতায় রং দিয়ে আঁকিবুকি কেটেছি কেবল সারা সকাল জুড়ে। ছবি তো ফোটেইনি তাতে বরং সাদা পাতায় এতোলবেতোল আনাড়ি রঙের ছোপ। কোনো অবয়ব নেই তার। আমার খানিকটা রং আর সারাটা সকাল অপচয় হওয়া ছাড়া আর কোনো গল্প নেই তাতে।

রং দিয়ে দোল খেলতে গিয়ে দেখি দোল খেলার সাথীই নেই তো রং মাখাবো কাকে? নিজেই নিজের গালে রং মাখানো যায় বোলো? দোল খেলার সাথীরা সক্কলে বড় হয়ে গেছে। আমার মতন অঢেল সময়ই বা কৈ তাদের? রং মাখতে তাদের ভারী বয়েই গেছে।

কি করি ? কি করি? ভাবতে ভাবতে ভারী অভিমান হল, কার ওপরে তা বলতে পারবোনা বাপু। কেন এই রং দিয়েও একটা সুন্দর ছবি আঁকা হলো না? কেন কেউ নেই প্রাণভরে রং মাখাবার, রং মাখবার? এইসব আনাড়ি ছেলেমানুষী।  

ভাবতে ভাবতে মনে পড়ল সেই একলা পলাশ গাছটার কথা। বেচারা সারা মরশুমে একলা একলাই রং মাখে। আশে পাশে আর কোনো গাছে রঙিন ফুল আসেনা যে। ঠিক করলুম, রং কে নিয়ে নির্বাসনে যাব সেই আধা জঙ্গুলে জায়গাটায়, সেই যেখানে আছে পলাশ গাছটা। যার ফুল কেউ তোলেনা, সুঁচ-সুতো দিয়ে জবাই করে গায়ে মাথায় গলায় নরমুণ্ড মালিকার মতন দোলাবে বলে। মুঠো মুঠো লালরং ছড়িয়ে দিলুম সেই একলা পলাশ গাছটার আশেপাশে। বাকি ন্যাড়াবোঁচা মামুলি আগাছাগুলোও নাহয় একদিনের জন্য রঙিন হলো। পলাশের সে কি খুশি। একা একা রঙিন হতে ভাল লাগে নাকি? পলাশ আমার রঙের বাক্স থেকে একমুঠো লাল আবির নিয়ে মাখিয়ে দিল আমারই দুগালে। 

এখনো তো অনেক রং বাকি বাক্স ভরে। কি করি? কি করি? ভাবতে ভাবতে সামনে দেখি সেই আউল-বাউল মানুষটা একলাটি দাঁড়িয়ে পথের ধারে। পথিকের একতারা আজ সুর ভুলেছে। আড়বাঁশিটি এসেছে ফেলে সেই কবেই তার নিজের ভিটেয়। ফেলে আসা ঘরের উঠোনের কোণে আজও অপেক্ষায় বুঝি সেই বাঁশি। বাঁশিটিকে আর একবার হাতে নিয়ে সুর তুলতে মন গিয়েছে চুরি। তাই সে পথ ভুলেছে। তারও তো একদিন একটা আপন ভিটে ছিল। ভিটে তো সেই কবে গেছে দূরে যেদিন থেকে সে পথ চিনতে নেমেছে পথে। ঘর গিয়েছে, সাথে সাথে রংও গেছে জানো? রংকে বললুম, এসো রং, সেই পথিকের খাঁচার ভেতর ঢুকে পড়ি বরং তোমায় নিয়ে। গিরিমাটি লেপা তার উঠোনের রঙে রং মিলিয়ে কমলা রঙের আল্পনা দিই পথের ওপর। সেই পুরোনো নকশা মেলাই তোমায় আমার আঙ্গুল দিয়ে জড়িয়ে নিয়ে। সারা পথ জুড়ে কমলা রঙের আল্পনা আঁকলুম দুজন মিলে। আঁকার শেষে দেখি একতারাটি তার কখন যেন আবার বাজতে লেগেছে। নতুন রকম সুর উঠেছে তাতে। ক্রমশঃ সেই সুর নেশার মতন দুলতে দুলতে আমার কপালে বুলিয়ে দিল রঙিন পালক। ওমা! দেখি সারা কপাল জুড়ে আমার কমলা রং। 

এত্ত এত্ত আল্পনা দিয়েও এখনো এতো রং বাকি আমার বাক্সতে। কি করি? কি করি? ভাবতে ভাবতে দেখি একটা মস্ত বড় বাড়ি। ভারী গম্ভীর বাড়ি। বাড়িটার চারপাশে মস্ত পরিখা কাটা। সামনে এগিয়ে দেখি, সে হল ভয়ের পরিখা। অনিশ্চয়তা আর হতাশার কুয়াশা দিয়ে দৃষ্টিপথ বন্ধ করে রেখেছে। কিচ্ছু দেখা যাচ্ছে না সামনে। দেখিইনা কি হয় বলে দিলুম একমুঠো রং ছড়িয়ে সেই কুয়াশার দিকে। ওমা! যেইনা ছোঁড়া, রঙিন আবিরের ছোঁয়ায় টুক করে খানিকটা কুয়াশা গেল কেটে। ভয়, অনিশ্চয়তা আর হতাশার কুয়াশা দিয়ে রং কে দূরে রেখেছিল। তাইতো সামনে যা কিছু সব এক্কেবারে রংহীন। বাড়িটা, বাড়িটার সামনের সারি সারি মানুষ। সবকিছু রংহীন, বিষণ্ণ। কেন বলতো? বাড়িটা একটা হাসপাতাল। প্রিয়জন অসুস্থ হলে হাসপাতালের বাইরে সব সারি সারি অনিশ্চিত মুখের ভিড়ে, ভয় জড়ো হয়। অনিশ্চয়তা আর হতাশার মেঘ ঘনিয়ে আসে। তাইতেই তো বাড়িটার চারিদিকে অনিশ্চয়তা আর হতাশার কুয়াশায় মোড়া ভয়ের পরিখা তৈরিহয়েছে। রঙের প্রবেশ নিষেধ করতে। বিবর্ণ কুয়াশায় দিন দুবেলা রং হারানো মায়ের মুখ, প্রাণপণে রং খুঁজে ফেরে ইষ্ট-উপাসনায়। অপেক্ষা করে খেলতে খেলতে ঝিমিয়ে পড়া মেয়ের জন্য। কিংবা ধরো, রংহীন মেয়ে বাবার সুস্থতার অপেক্ষা দিয়ে সাদাকালো বিনুনি বানায়। কেন জানো? ভয় যেখানে বাসা বাঁধে, রং সেখানে থাকে না। কিংবা ধরো রং ফুরোলে অনিশ্চয়তা জন্ম নেয়। তাই তো সেখানে রঙের খুব প্রয়োজন। রং দিয়েই তো ওই কুয়াশায় নজর পথ আবার খোলা যায়। এই আমি যেমন করে রং দিয়ে পথ খুঁজলুম, তেমন করেই।
   
রংকে বললুম, তোমায় নিয়ে বরং নির্বাসনেই যাই হাসপাতালে বাইরে বসা এই সবার মাঝে, যেখানে ভয় আর হতাশায় বর্ণহীন করেছে আশা আর আনন্দকে। বাইরে থেকে রং না পেলে অসুস্থ মানুষগুলো যুঝবে কেমন করে বলো দেখি? যেই না তুমি বুকের মাঝের পদ্মটা ভেদ করে সোজা হৃদমাঝারের সুখ জাগালে, অমনি মনের অসুখ গায়েব। আর মনের অসুখ হার মানলে দেহের অসুখের আর জোর কি যে রং কে দূরে ঠেলে রাখে? যারা অসুখের বাইরে আছে, তাদের মনে রং পৌঁছতে না পারলে কেমন করেই বা ভয়, অনিশ্চয়তা আর হতাশার কুয়াশা কাটিয়ে অসুখের ভেতরে থাকা প্রিয়জনদের মনে রং পৌঁছে দেবে? 

তারপর সেই গোটা রঙের বাক্সটা দিলুম উপুড় করে বিবর্ণ মুখ গুলোকে রঙিন করতে। দেখি এইবার কেমন করে ভয়, অনিশ্চয়তা আর হতাশার মেঘ দিয়ে অসুখকে রঙের থেকে দূরে রাখতে পারে। যেই না এক একটা রংহীন মুখ রাঙিয়ে উঠতে শুরু করলো, সেই রং আমার গায়েও এসে লাগতে লাগলো।  ক্রমশঃই আমার সারা শরীর লাল, কমলা, হলুদ, সবুজ, গোলাপি, আসমানিতে রঙিন হয়ে উঠতে লাগলো। আশ মিটিয়ে দোল খেলব আজ। দেখি এইবার অসুখ পেরিয়ে আনন্দের দোলরং আসে কিনা।        

উৎপটাং

দরজা দিয়ে বেরিয়েই দেখি অজস্র তুলো তানের বিস্তাররত শত শত গান্ধর্বীর মত সুরলোক থেকে নেমে আসছে যেন। উড়ছে। চলতে ফিরতে হাতে পায়ে মুখে এসে লাগছে। দুপাশের ঘাসের আস্তরণ ভরিয়ে তুলেছে সাদা সাদা তুলোয়। প্রতিটি তুলোর গোছায় একটা করে বীজ। দল বেঁধে প্রাণপণে প্রাণের বিস্তার করে চলেছে। এখানে প্রায় ছয়মাস শীতকাল। শীতের শেষে গাছেদের দেখলে সন্দেহ হয় যে এদের দেহে প্রাণের সামান্য কিছুও অবশিষ্ট আছে কিনা। হাড়সর্বস্ব গাছেরা তারপর কি করে যে শীতশেষে প্রথম বসন্ত সমাগমে পাতাহীন দেহে ফুটিয়ে তোলে কত রংবেরঙের ফুল সে এক রহস্য। পাতা নেই, কঙ্কালসার গাছগুলো যৌবন পায় গা ভর্তি ফুলে। কি তাদের রূপ তখন। দেমাকে ডগমগ। তারপর ফুল ঝরতে থাকে। যৌবনের যেমন ধর্ম। ততদিনে পাতা এসেছে শরীর জুড়ে। আর ফুলের বোঁটায় বীজ। সে বীজ ছড়িয়ে দিতে আবার কত রকম আয়োজন। একদলের কথা তো বললামই। তুলোয় মুড়ে দিকে দিকে খবর পাঠাচ্ছে -' এই রইল আমার স্বাক্ষর। ভুলে যেও না যেন আমায়।' আবার প্রতিদিনের যাতায়াতের পথে কয়েকজন আছে, তারা উত্তরাধিকারীকে দূর দূরান্তে পাঠাবার জন্য রঙিন ডানার বন্দোবস্ত করেছে। হাওয়ায় ভর দিয়ে কিছুদূর যাতে সাম্রাজ্য বিস্তার করতে পারে। কি অভিনব সব পদ্ধতি তাই না? আদতে একটাই কথা যে- রেখে যেতে হবে আমার উত্তরসূরী। আমার বৈশিষ্ট্য কিছুতেই ভুলে যেতে দেব না কাউকে। সে যেমনই বৈশিষ্ট্য হোক না কেন। আমার নিজের মতন আর একটা আমিকে বা অজস্র আমিকে যে কোনো উপায়ে রেখে যেতে হবে পৃথিবীর বুকে। আমি তাকে প্রাথমিক শিকড় বিস্তারের বন্দোবস্ত করে দেব। তুলো বা  ডানার পাথেয় দেব যাতে সে আরো কিছুটা দূরে গিয়ে দখলদারি কায়েম করতে পারে। আশা করব, ছোটখাট ঝোপঝাড়, গুল্ম, বাকি আর সকলকে দমিয়ে মাথা তুলবে একা। ভাগের সূর্যালোক ব্যতীত আরো কিছুটা পাবে, এমন আশাও করব। এ পর্যন্ত বোধহয় বিবর্তনের সাধারণ নিয়ম। গাছেরা এ পর্যন্তই মানে। আমরা বাদে বাকি অন্যরাও। আমাদের কথা আলাদা। বিবর্তনের দাবি মেনে হাত পা, নখ, দাঁত, শারীরিক শক্তি কোনো কিছুরই বলবার মতন বিশেষ উন্নতি না হলেও,  ঘাড়ের ওপরের অঙ্গটির যে অদ্ভুত এবং আকস্মিক পরিবর্তন হয়েছিল তার সু এবং কু দুই ফলই দীপ্যমান। আমরা কিছুই মানিনা। না বিবর্তনের বেঁধে দেওয়া দখলদারির নিয়ম, না আমাদের নিজেদের বেঁধে দেওয়া সুস্থ ভাবে বেঁচে থাকার কানুন। আমরা দখলদারি করি বোধহয় কেবলমাত্র দখলদারি করবো বলেই। ভীষণ রকম একটা হুলুস্থুল ফেলে দিয়ে নিজেদের এবং বাকিদের বিপর্যস্ত করে শেষপর্যন্ত দখলদারিত্ব হয়ত কায়েম হয়। কিন্তু দখল করার পর দখলীকৃত সম্পত্তিটিকে নিয়ে ঠিক কি যে করব, কি যে করা উচিৎ সেইটিই ভাবা থাকে না বলে দখলদারীর খেলাটা শেষ হয়ে যাবার পর আর কিচ্ছুটি করার থাকে না। মাথা চুলকে ভাবতে বসতে হয় তাহলে বরং আরো কিছুটা জায়গা দখল করা যাক। রীলে রেস এর মতন। জন্মেছ? বেশ করেছ। বড় হচ্ছো? ভীষণরকম সাংঘাতিক একটা লেখা পড়া করে তাক লাগিয়ে দাও দেখি তবে। দারুন একটা ডিগ্রী পেয়েছো? বেশ করেছো। এবার ছোট থেকে যা যা ভাল বলে জেনেছো, দিনরাত এক করে সারা পরিবারকে তটস্থ করে সমস্ত শুভাকাঙ্খী, সামাজিকতাকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে এতদিন যা পড়াশুনা করেছো ডিগ্রি পাবার জন্য সবটা বেমালুম ভুলে যেতেও পারো। উঁহু উঁহু, ডিগ্রির কাগজটা ফেলো না। ওটা লাগবে। আচ্ছা বেশ, এবার যেন তেন প্রকারেণ গ্রাসাচ্ছাদনের একখানা ব্যবস্থা করে ফেলতে হবে বুঝলে। করে ফেলেছো। আরে ব্র্যাভো। ডিগ্রিটা কি এমনি এমনি নাকি? যাক বাবা, দখলদারির পঞ্চাশ ভাগই মেরে এনেছো। বাকিটা অবিশ্যি একার দ্বারা হবেনা। এবার আস্ত একখানা মানুষকে দখল করে ফেল বরং বুঝলে। তারপর তাকে নিয়ে আরো একখানা মানুষ বানিয়ে ফেল, ব্যাস হয়ে গেল গোল্লা সম্পূর্ণ। এবার এই পুঁচকে মানুষটা সাদা পাতাকে নিজের মতন আঁকিবুঁকিতে ভরিয়ে তোলার আগেই তার মগজ ধোলাইটি করে ফেলা চাই। নইলে কিন্তু রীলে রেসের এখানেই ইতি। 

এতগুলি দখল হলো কিন্তু কেন যে হলো সেটা বোঝা গেল না। জ্ঞানের দখল হল, হিসেবের শেষে জ্ঞান গেল বাড়ি, হাতে রইল পেন্সিল। থুড়ি, ডিগ্রির কাগজ। কাগজ দিয়ে জবরদস্ত একখানা কাজ দখল হলো। তারপর কাজের কি হলো খোদায় মালুম। থাকার বাড়ি, চড়ার গাড়ি, বেড়ানোর প্যাকেজ, আরো কি কি যেন সব হলো যখন, তখন আর অন্য কিছু ভাবতে নেই। ওসব বোকায় ভাবে। এরপর আস্ত একখানা মানুষ পর্যন্ত দখল করে ফেললে। তারপর সংসার, সমাজ ইত্যাদি প্রভৃতির ভুজুং দিয়ে তাকে টিপে মেরে ফেলতে পারলেই- 'যাক বাবা সুখের সংসার।' তারপর কিচ্ছুটি না ভেবেই, একখানা আস্ত মানুষ তৈরী করে ফেললে। কেবল তৈরী করা যায় বলেই আর প্রোটোকলে আছে বলেই। সম্পূর্ণ সাদা পাতা নিয়ে জন্মানো সেই মানুষটাকে তারপর আর কিছুতেই সাদা থাকতে দেওয়া যাবে না। দখলদারির চক্করে নিজের রেপ্লিকাকেও ছাড়বে না। তাকে আমার মতন হতেই হবে। হতেই হবে। নইলে আজই পৃথিবী গেল রসাতলে। খেলাটা চলতেই থাকলো। দখলীকৃত সম্পত্তিগুলোর ওপর ধুলো জমে জমে পাহাড় হয়ে গেল। আর তারপর কোনো কিছুর গোড়া অবধি শিকড় পৌঁছাবার আগেই দুম করে একদিন খবর এলো- 'নাও নাও অনেক হয়েছে, এবার তল্পি গোটাও।' ততদিনে টনক নড়ল তো ভালো নইলে গোটা একটা জীবন স্রেফ ফক্কা। গুটি সাজিয়েই সময় গেল আসল খেলাটা জানাই হলো না।     

তবে, কোনোদিনই সবটা একরকম হয়না এই যা। বিবর্তনের পথে দু চারটে বেয়াড়া, উৎপটাং জীব থেকেই যায়। ঘাড় বেঁকিয়ে যারা নিজের নিয়মে চলতে থাকে। ফলাফল ভাল না খারাপ তক্ষুনি বোঝা যায় না যদিও। তবে তার ঘাড় সোজা করতে লোকেরও অভাব হয়না। হয়নি কোনোদিন। যদিও এসব অযথা শক্তিক্ষয়। বেঁকা ঘাড়ের নিয়ম যদি প্রকৃতির পছন্দ হয় তবেই সে সেটিকে অভিধানে জায়গা দেবে নচেৎ নয়। সুতরাং এই দায়িত্ব আর নিজের ঘাড়ে নেওয়া কেন বাবা? প্রকৃতিকেই ভাবতে দাওনা কোনটা রাখার কোনটা ফেলার। প্রতিদিনের যাতায়াতের পথে আরো একটা গাছ বাস করে। বেশ কিশোর বয়স্ক গাছ। শীতের শুরুতেই দেখি একদিন কয়েকজন মিলে অনেকটা মাটি খুঁড়ে তাকে আক্ষরিক অর্থেই সমূলে উৎপাটিত করে অন্য কোথাও নিয়ে গেল। বিশাল একটা বীভৎস গর্ত হয়ে পড়ে রইল তার অস্তিত্বের স্মৃতি। আশেপাশের ঘাসজমির পরিবর্তন হচ্ছিলো। শীতটা বাড়ছিল এমনি করেই। পাশ দিয়ে যেতে অস্বস্তি হত। মনে হতো গর্তটা বুজিয়ে দেয়না কেন রে বাবা? তারপর শীতের মাঝামাঝি সেই গাছটাকেই আবার এনে বসলো তার পুরোনো বসতে। চারিদিক থেকে ঠেকা দিয়ে গাছটার কঙ্কালটাকে বসিয়ে দেওয়া হলো পুরোনো মাটিতেই। আর গাছেরও কেমন বেঁকা ঘাড় দেখো, এত বড় গাছ, এতদিন ধরে উদ্বাস্তু। বেঁচে যাওয়াটাই যেন লজ্জার। প্রোটোকলের বাইরের গল্প। তবুও ছিল বুঝি পুরোনো মাটিতে বেঁচে ওঠার জেদ। রইলো পড়ে ফুল ফোটানো, রইলো পড়ে বীজ ছড়ানো। শীতের শেষে দেখি উৎপটাং সেই ব্যতিক্রম টুকুর টুকুর করে ফুটিয়ে ফেললে কচি পাতা। বাঁচতে হবে তো আগে। জীবন আছে যখন, সূর্য্যালোক সেঁচে জীবনটাকে পল্লবিত করার দায় তো বর্তায় আগে। তারপর নয় কুঁড়ি আসুক। 

কাল দেখলাম গোল্লা গোল্লা হলদেটে কুঁড়ি এসেছে গাছটায়। সবার যখন খেলা সেরে ফেলে 'এবার কি করি তালে' জীবন, তখন তাদের ঠিক নাকের ডগায় বেমালুম নির্লজ্জের মতন বেঁচে উঠেছে আর প্রতিদিন আরো একটু বেশি করে বেঁচে উঠছে একটা উৎপটাং জীব। বিবর্তনকে চ্যালেঞ্জ নাকি বিবর্তনের চ্যালেঞ্জ?  

Friday 6 March 2020

দ্য ক্যাফে - ৩

উৎসব পরবর্তী আধো আলোকিত একটা ক্যাফে। জায়গাটা এ শহরের দুটি বড় বাজার সংলগ্ন দুটি ব্যস্ত রাস্তার চৌমাথায়। সপ্তাহান্তে এই ছোট্ট দোকানটিকে বসতে জায়গা পাওয়া কষ্টকর হয়ে যায় মাঝে মধ্যে। তবুও শীতের রবিবারের সন্ধ্যায় সেখানে লোকজন সেদিন কম। রবিবার বলেই হয়ত। শুক্র বা শনিবার হলে মানুষের বাড়ি ফেরার ব্যস্ততা থাকে না এখানে। রবিবারে তা নয়। সোমবার ভোর ভোর কাজের জায়গায় পৌঁছানোর তাড়ায় রবিবারের সন্ধ্যেটুকুও তাড়াহুড়োর কবলে পড়ে ছটফটায়। এমনই এক রবিবারের পড়ন্ত বিকেলে কোণের দিকে একটা ছোট্ট টেবিলে গিয়ে বসেছিলাম দুজনে। রোজকারের মতন নানান আবোলতাবোল বিষয়ে কথাবার্তা আলোচনা চলছিল। বাইরে বিকেল ফুরিয়ে সন্ধ্যে হয়ে আসছে। মরা মরা একটা হলদে আলো এসে পড়েছে কাঁচের বাইরে। কাঁচের ওপারে রাস্তা। তার ওপারে একটা ছোট্ট বাড়ি। এখন থেকে বাড়িটার পিছনের দিকটাই দেখা যায়। এতদিন এই ক্যাফেতে আসছি, কখনো বাড়িটার এইদিকে কাউকে আসতে দেখিনি। পিছনদিক বলেই হয়ত। এই ক্যাফেটার একটা আলাদা বিশেষত্ব আছে। বাঁদিকে একটু গেলেই এশিয়ান মার্কেট। আমাদের মত দেশীয় খাবার-দাবারের রোজকার কারবারিদের জন্য ওরিয়েন্টাল শাকসব্জী-মশলাপাতির প্রধান যোগানকেন্দ্র। ডাইনে কিছুটা এগোলেই বাকি রোজকার অন্য প্রয়োজনীয় গার্হস্থ্য জিনিসপত্রের বাজার। আর পুরো এলাকাটা জুড়েই বিভিন্ন দেশের খাবারের সম্ভার নিয়ে অজস্র সস্তার রেস্টুরেন্ট। আমাদের মত ইউনিভার্সিটির মানুষদের জন্য কম পয়সায় উদরপূর্তির নিখুঁত আয়োজন। এসব কারণেই ইউনিভার্সিটি অফ ওমাহা আর মেডিকেল সেন্টারের আমাদের মত ভিনদেশি ছাত্র ছাত্রী বা কর্মী দলের জন্য এই ক্যাফেটা বড়োই প্রিয়।
         
ওই পাশে দুটো টেবিল জোড়া লাগিয়ে একদল ছেলে কলকল করে বিদেশী ভাষায় কথা বলে চলেছে। ওরা এখানকার প্রতি রবিবারের নিয়মিত আড্ডাধারী। মধ্যপ্রাচ্যের কোনো একদেশ থেকে এখানে এসেছে। ওদের একজনকে চিনি। আমাদের ইনস্টিটুটেরই রিসার্চার। বাকিরা সম্ভবতঃ ইউনিভার্সিটি অফ ওমাহায় ছোট বড় কোনো কোর্স করতে এসেছে। ওরা কি ভাষায় কথা বলছিলো সে আমাদের বোঝার কথাও ছিল না। ভাষা না বোঝার একটা বেশ উপকার আছে। বক্তব্যের ওপর থেকে মনোযোগ সরে গিয়ে মানুষের ওপর মন পড়ে। মানুষ দেখার সেরা জায়গা এই ক্যাফেগুলো। এককাপ পানীয় নিয়ে এককোণায় বসে নিশ্চুপে বহু কিছুর সাক্ষী থাকা যায়। সামনের মানুষগুলো সম্পর্কে মনে মনে কিছু ধারণা করা যায়। এই যেমন এই ছেলেগুলির পরিচ্ছদ দেখে অনুমান হয় প্রত্যেকেই উচ্চবিত্ত পরিবার থেকে এসেছে। অবশ্য নইলে দেশ ছেড়ে রিসার্চ করতে আসলেও, ব্যাচেলার বা মাস্টার্স ডিগ্রি করতে কোন মধ্যবিত্ত পরিবার থেকে ছেলেমেয়েরা এদেশে আসে না। আমাদের দুজনের আলসেমি মাখা বিকেল শেষ হচ্ছিল নিরুত্তাপে। ওদের হাসাহাসি কথোপকথন আর উচ্ছলতা দেখতে দেখতে। সাথে ছিল দুইকাপ উষ্ণ তিতকুটে তরল।

প্রায় অন্ধকার হয়ে আসছে। একজন মানুষ এসে ক্যাফেতে ঢুকলেন। মানুষ দেখার একটা অলিখিত নিয়ম রয়েছে। দুইধরনের মানুষকে আর একজন মানুষ নজর করে দেখে। এক, যদি সেই মানুষটিকে দেখে যথেষ্ট সম্ভ্রমের উদ্রেক হয়। অর্থাৎ মানুষটিকে দেখে যদি নিজের চাইতে সামাজিকতায় বড় বলে  মনে হয় অথবা দুই, যদি মানুষটিকে দেখে সন্দেহের উদয় হয়। সন্দেহটা বেশিরভাগ সময়েই পোশাক দেখে অনুমিত হয়। এর বাইরে যাঁরা, তাঁরা তো নিতান্তই গড়পড়তা মানুষ। তাঁদের না আছে চোখ গোল গোল করে দেখার মতন আড়ম্বর। না আছে দুরছাই করার মতন মাটি সংলগ্ন নমনীয়তা। যদিও এসবের কোনো সুনির্দিষ্ট পদ্ধতি আছে বলে মনে হয় না। আমিও আর পাঁচজনার মতনই অজস্র ভুল ধারণার বশবর্তী সাধারণ একজন মানুষ দেখিয়ে। যে মানুষটি এসে ক্যাফেতে ঢুকলেন তাঁকে দেখে আমি বিনা দ্বিধায় দ্বিতীয় দলে ফেলে দিলাম। একগোছা ঝোলাঝুলি ব্যাগ। বেঢপ জ্যাকেট। এবং সন্ধ্যেবেলায় রোদচশমা ও টুপি। এমন ধারা মানুষকে নিঃসন্দেহেই সন্দেহ করা চলে, তাই না? আর সন্দেহ করার মতন হলেই তিনি পর্যবেক্ষণের বস্তু। সুতরাং আমার চোখও তাঁকে বিনা লজ্জায় অনুসরণ করে চললো। তিনি তিনটে টেবিল বদলালেন। কোথাও বসে তাঁর ভালো লাগলো না। অবশেষে চার নম্বর টেবিলে গিয়ে তাঁর অজস্র জিনিসপত্র নিয়ে থিতু হলেন। ঝোলা থেকে বেরোলো একটা বহুল ব্যবহৃত কফির কালচে দাগধরা কফিমগ। সেই মগ নিয়ে তিনি চললেন কাউন্টারে। ওতেই খানিকটা কফি ঢেলে দিতে বলবেন সম্ভবতঃ। তাঁর দিকে অনেকেই নজর পড়েছে এতক্ষনে। কাউন্টারের ছেলেমেয়েগুলোর তো বটেই। কিছু সমস্যা হলে ওদেরকেই সামলাতে হবে। এই ক্যাফেতেই একবার এক মহিলার পিছু ধাওয়া করে এসেছিলো একজন মানুষ। ক্যাফের বাইরে উল্টোদিকের রাস্তায় দাঁড়িয়ে ধূমপান করতে করতে মহিলাকে চোখে চোখে রাখছিলো। তারপর ক্যাফের ভেতরে ঢুকে কিছু করার আগেই এই কাউন্টারের ছেলে মেয়েরা পুলিশে ফোন করে। আর আমাদের সামনেই মিনিট কয়েকের মধ্যে পুলিশ এসে মানুষটিকে ধমকে-ধামকে সেখান থেকে সরিয়ে নিয়ে যায়। এই মানুষটির হাবেভাবেও সাধারণ কিছু ছিল না। ফলত: সকলেই সতর্ক। আমাদের কফি শেষ হয়ে গিয়েছিলো। আমরাও উঠে পড়লাম। কারণ আমরা আরো বেশি সতর্ক।

বাইরে এসে গাড়িতে উঠে স্টার্ট দিয়েছি সবে। দেখলাম ক্যাফের দরজা ঠেলে দৌড়াতে দৌড়াতে আসছেন তিনি। মন বুঝলো নিশ্চয়ই কিছু গোলমেলে ব্যাপার। শীতকাল বলে গাড়ির কাঁচ তো তোলাই ছিল। আরো সিঁটিয়ে বসলাম। পিনাকী ততক্ষণে গাড়ির মুখ ঘুরিয়েছে। বেরিয়ে যেতে হবে এখন থেকে।মানুষটি সোজা এসে আমার জানলার কাঁচে টোকা দিচ্ছেন। হাতে একটা নোটবই। সেটা দেখিয়ে কি যেন বলছেন। এখানে এমন ঘটনার কথাও শুনেছি যে, ভবঘুরে মানুষরা এক-দুই ডলার চেয়েছে কারো কাছে এবং সেটি না পাওয়ায় সোজা গুলি করে মেরেছে। সেসব গল্প মাথায় চট করেই চলে আসে এই সব পরিস্থিতিতে। দোনোমোনা করে পিনাকীর হাজার 'না'-এর মাঝেও কেন জানিনা সেদিন জানলার কাঁচটা খুলে ফেলেছিলাম খানিকটা। তিনি হাতের নোটবইটা দেখিয়ে বললেন, "এটা তোমরা ফেলে যাচ্ছিলে।" আমরা যে টেবিলে বসেছিলাম তার পাশেই কাউন্টারের কোণের দিকে একটা কলমসহ এই সুন্দর নোটবইটা রাখা ছিল। সম্ভবতঃ আমাদের আগে কেউ এতে কিছু লিখছিলো, তারপর ফেলে চলে যায়। ওটা আমাদের নয়। সেকথা তাঁকে জানাতে তিনি বললেন, "ওহ, তাহলে ঠিক আছে। আমি ভাবলাম তোমরা ভুলে রেখে যাচ্ছ বুঝি। আসলে এরকম ব্যক্তিগত জিনিস একবার হারিয়ে গেলে দোকানে তো কিনতে পাবে না, তাই না? কত কি স্মৃতি, হয়ত কোনো মানুষের দেওয়া উপহার এটা।  তাই ভাবলাম দিয়ে আসি।  ঠিক আছে। তোমাদের নয় যখন তাহলে এসো।  তোমাদের দেরি করালাম বলে দুঃখিত। শুভরাত্রি।" এই বলে পিছন ঘুরলেন।

একবুক লজ্জা নিয়ে কাঁচটা বন্ধ করতে করতে দেখলাম এতক্ষনে পুরোপুরি অন্ধকার হয়ে গেছে আমাদের চারপাশটা। গাড়ির হেডলাইটের আলো গিয়ে পড়েছে তাঁর ওপর। পিছন ফিরে হেঁটে ফের ঢুকে যাচ্ছেন আমাদের ফেলে আসা ক্যাফেটার দরজা ঠেলে। সেই বেঢপ জ্যাকেট গায়ে, অপরিষ্কার কফিমগ আর নোটবইটা হাতে করে নিয়ে।