Monday 20 April 2015

সকাল

মিটমিটে হলুদ রং হয় বুঝি বিষণ্নতার
তখন হাওয়াতেও বুঝি স্তব্ধতার গতি
জঙ্গুলে ঘন অন্ধকারে তাকিয়ে থাকতে থাকতে
বেতাল মন কেবলি সমন্বয়ে আসার চেষ্টা করে চলে
নিরন্তর।

মধ্যরাতে নিরর্থক ক্লান্ত চোখে নেমে আসে
ঘুমের অনিবার্যতা
পরদিন আবার সকাল।
তারপরদিন আবারও
ভোরের পর ভোর আলো ছড়িয়ে যায়
নিজের নিয়মেই।

শুধু আমারই আজও কি করে যেন
রাত কাটিয়ে সকাল হয়ে ওঠা আর হয়ে ওঠে না।    

Thursday 16 April 2015

নববর্ষ

আপাতত এই বছরের নববর্ষটা বিশেষ শুভ বলতে পারছিনা। কারণ আবার আমাদের অন্ধকার বন্ধ বাড়িতে চাবি খুলে ঢুকতে হচ্ছে আবার আমাদের খিদে বোধ ফিরে এসেছে (এর আগের দুই সপ্তাহ খিদে পাবার আগে হাঁ করলেই মুখে টপাটপ সুখাদ্যের বর্ষণ হচ্ছিল)আবার আমাদের সকালে উঠে একা একা ফাঁকা ঘরে ঘুরঘুর করতে হচ্ছে আবার আমাদের সন্ধ্যেবেলায় ইন্টারনেট মুখে করে সময় কাটাতে হচ্ছে........ইত্যাদি ইত্যাদি। ব্যাপারটা আর কিছুই নয় দিন কুড়ি আমাদের মতন দুই অপগন্ডকে নাইয়ে-ধুইয়ে-গান্ডেপিন্ডে খাইয়ে-পরিস্কার জামাকাপড় পরিয়ে আরো একশরকম বায়নাক্কা সামলে খাটতে খাটতে পনেরো দিনে সাড়ে পনেরো শতাংশ রোগা হয়ে গিয়ে অবশেষে এই নববর্ষের ঠিক আগের দিনেই দুইজনের দুই মা বাড়ির দিকে ইঞ্জিনের মুখ করে রাখা রাজধানীর সিটে গিয়ে বসে হাঁপ ছেড়ে বেঁচেছে। আর আমরা তাদের সিটে বসিয়ে দিয়ে এসে সামনের দশদিনের জন্য তাদেরই তৈরী ফ্রিজ বোঝাই করে রেখে যাওয়া খাবার দাবার বের করে খাচ্ছি আর ফোঁসফাঁস দীর্ঘশ্বাস ফেলছি আর ভাবছি ঘরদোর জামাকাপড় বেশ পরিস্কার-পরিষ্কার লাগছে। কিছুদিন চলে যাবে হাত-পা না নাড়িয়েই। তারপর যাক গে বসে বসে আঙ্গুল চোষা ছাড়া গতি নেই। আসলে ঘোড়া যখন থাকেনা থাকেনা হেঁটেই দিন চলে যায়। কিন্তু একবার ঘোড়ায় চড়া অভ্যেস হয়ে গেলে পর আর দুই পা হাঁটতে গেলেই ঘোড়ার অভাব বোধ হয়। তাই এই নববর্ষটা ব্যাজার মুখে শুরু হয়েছে। আর তাই হয়ত আগের সব নববর্ষগুলো বেশি বেশি করে মনে পড়ছে। 

কুঁচো বয়সে যখন মায়ের বাধ্য ভদ্র বাচ্চা ছিলাম তখন নববর্ষের বেশ একটা উত্সব উৎসব ব্যাপার অনুভব করতে পারতাম। সেটা সাদা মনের অমলিন উৎসবের প্রভাবেই হোক বা অন্য কোন কারণে। একটা কারণ অবশ্যই ছিল এই যে, নববর্ষের ঠিক আগেই শেষ হয়ে যেত বার্ষিক পরীক্ষা। পরীক্ষার খাতায় কতটা হাবিজাবি আর কতটা ঠিকঠাক লিখে এসেছি সেটা বাড়িতে প্রকাশ পাবার এবং জীবনে ভয়ানক দুর্যোগ নেমে আসার জন্য আরো প্রায় দুই সপ্তাহ বাকি থাকতো। সুতরাং 'সখের প্রাণ গড়ের মাঠ'। তার ওপরে আবার বাংলা নববর্ষে নতুন জামা। সে জামা বুকে কমলা সুতোর দিয়ে হাঁস আঁকা সাদা সুতির টেপফ্রক থেকে শুরু হয়ে আমার বয়সের বয়সের সাথে সাথে বিবর্তিত হতে হতে দুই কাঁধে ফিতে বাঁধা সুতির ফ্রক, তারপর সুতির স্কার্ট-ব্লাউজ হয়ে বর্তমানে শালওয়ার-কামিজে এসে ঠেকেছে। সে জামা যেমনই হোক সেটি কেনার সময় দুটি অবশ্য মান্য বিষয় হলো-জামাটিকে অতি অবশ্যই সুতির কাপড়ের তৈরী হতে হবে এবং রংটি গরমে পরার উপযুক্ত, চোখের পক্ষে আরামদায়ক হতে হবে। মানে এযাবৎকালে তাই হয়ে এসেছে আমার ক্ষেত্রে। সুতরাং বার্ষিক পরীক্ষার জুজুকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে কাটিয়ে আসার পরে উপরি হিসেবে নতুন একখানা জামা পেয়েও যদি পয়লা বৈশাখে উত্সব না হয় তবেই বরং আশ্চর্যের বিষয় হত। হাঁস আঁকা টেপজামা বা দুই কাঁধে ফিতে বাঁধা ফ্রক পরার আমলে অবশ্য পয়লা বৈশাখে জামাটা আমার একার জন্যেই আসছে, নাকি মা বাবারও নিদেন পক্ষে একটা ব্লাউজ বা লুঙ্গি গোছের কিছুও দোকান থেকে এসে পৌঁছোচ্ছে কিনা সে বিষয়ে নজর পড়তনা আমার। পরে ঘটি হাতা ফ্রক বা স্কার্টব্লাউজ পরার সময় থেকে এবিষয়ে নজর পড়তে শুরু করলো। আর কোনো বছরে আর্থিক কারণে আমার একার জন্য দোকান থেকে জামা এলে "আমার একার কেন নিয়ে এলে? আমার অনেক জামা আছে, আর চাইনা"-ইত্যাদি বৃথা চেঁচামেচি করা ছাড়া আর আমার কিছু করার না থাকায় ব্যাজার মুখে বিকেল বেলা নতুন জামা পরে খেলতে যেতাম। এবং নতুন জামার কল্যানে সেদিন খেলায় আছাড় খাওয়া বা কাটাছেঁড়ার পরিমাণটা খানিক কম হত। মাঝে মধ্যে অবশ্য না পরে রেখে দেওয়া আগের বছর পুজোয় পাওয়া কোনো সুতির ছাপাশাড়ি ম্যাজিকের মতন বের করে মা বলত এই দেখ আমার নতুন শাড়ি। আর বাবা "আমি এই ঘামে গরমে সাইকেলে করে বাজার দোকান যাই টাই, আমার আর নতুন জামা কি হবে? অনেক জামা আছে, রোদে ঘামে নষ্ট হয়ে যাবে"- এইসব ভুজুং দিয়ে আমায় ঘুরিয়ে দিত। অনেক পরে অবশ্য তিন জনেরই কিছু না কিছু আসতো পয়লা বৈশাখ উপলক্ষ্যে। 

আর একটি জিনিস সে বয়সে কি করে যেন মাথায় ঢুকে গেছিল, মা-ই ঢুকিয়েছিল নির্ঘাত, সেটা এই যে, বর্ষশুরুর দিনে সক্কাল সক্কাল উঠে ভালো মেয়ের মতন পড়াশুনা করতে হয় তাহলে সারাবছর ভালো পড়াশুনা হয় (তখন থেকেই লেট রাইজার মেয়েটাকে একদিন অন্তত ভোর ভোর ঘুম থেকে তোলার চেষ্টা আর কি)। আর দূরদর্শনের সে জমানায় একটি উত্সাহ বড়দের মধ্যে ছিল সেটি হলো নববর্ষের বৈঠক। সেটি এবছর কোথায় হচ্ছে মেট্রো রেল এ, নাকি গঙ্গাবক্ষে বজরায়, নাকি অভিনব অন্য কোনোখানে এবং কোন কোন বিদগ্ধজন এ বছর সেই বৈঠকে আছেন সেটি নিয়ে বিশেষ গবেষণা হতে দেখতাম। আমাদের বাড়িতে সকালে টিভি খোলা হত বছরে মাত্র দুটি দিন। মহালয়ার দিন আর নববর্ষের দিন। নববর্ষের সকালে উঠে টিভিতে সকলে নববর্ষের বৈঠকে গান-কবিতা-আলোচনা শুনত। আর আমাকেও সেখানে বসিয়ে রাখার চেষ্টা করা হত। কিন্তু বিশ্বাস করুন আমার একটুও বসে থাকতে ইচ্ছে করত না। খুব খারাপ লাগত অনুষ্ঠানটা। কারণ যে সময়ের কথা বলছি সে সময় অনুষ্ঠানে একটা নাচ অন্তত না থাকলে সে অনুষ্ঠান আমার কাছে নিতান্তই অর্থহীন লাগত। মনের ভাবটা এরকম থাকত যে-অন্য দিন টিভির কাছে বসার অনুমতি বিশেষ পাওয়া যায়না। সেই অনুমতি যখন পাওয়া গেছে (উপরন্তু ডেকে ডেকে টিভি দেখতে বলছে! এ তো অবিশ্বাস্য ব্যাপার!) তাও আবার সকাল বেলা যখন নাকি ঘুম কাটতে না কাটতেই পড়তে বসাটাই ভালো বাচ্চার লক্ষণ তখন এইসব বকবকানি শুনতে হবে বসে বসে কি যে সময়ের অপব্যবহার! আমি বসে বসে দুধ আর মারি বিস্কুট খেতাম আর অপেক্ষা করতাম যদি ভুল করেও একটা নাচের অনুষ্ঠান থেকে থাকে এই বৈঠকে সেই আশায়। এরপর খানিক বাদে মা বাবা যে যার কাজে উঠে পড়লে আমার ও সে আশায় জল পড়ে যেত। আমাকেও দুধের গ্লাস নামিয়ে রেখে বই-এর ব্যাগ খুলে বসতে হত। আসলে বেশ খানিকটা সাজুগুজু করে রবীন্দ্র সঙ্গীতের সাথে লীলায়িত ভঙ্গিতে নাচ ব্যাপারটা আমার বড়ই লোভের জিনিস ছিল। তার একটা কারণ এখন আমার মনে হয় এই যে, আমি কোনো দিন নাচ শিখিনি। কিন্তু অনেক ছোট থেকে গান টান গাওয়ানোর একটা চেষ্টা করা হয়েছিল আমার ওপর। যার ফলে এদিক ওদিকের অনুষ্ঠান নাচ-গানের যৌথ স্কুল ইত্যাদির কল্যানে বন্ধুবান্ধবদের ছোটো থেকে নাচতে দেখেছি। আর বর্ষবরণ বা পঁচিশে বৈশাখ জাতীয় পাড়ার অনুষ্ঠানে আমি যখন সাদা ফ্রক পরে দুপাশে ঝুঁটি বেঁধে সাত সন্ধ্যেবেলা ফাঁকা আসরে খানিক প্যাঁ প্যাঁ করে গলাবাজি করে নেমে আসতাম তখন বন্ধুরা কেমন ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে শাড়ি টাড়ি পরে, মাথায় ফুল, কাজল, লিপস্টিক, টিপ, চুড়ি ইত্যাদি প্রভৃতিতে ঝলমলিয়ে মঞ্চ দাপিয়ে নাচতো। আর আমি জুলজুল চোখে নিচ থেকে দেখতাম। সেই থেকেই বোধহয় আমার নৃত্যপ্রীতির সূচনা। 

তার কিছুবছর পরে শুরু হলো বৈশাখের অবশ্য পালনীয় আর একটি অনুষ্ঠানের জন্য মহড়া। পঁচিশে বৈশাখ। পয়লা বৈশাখ থেকেই পাড়ার বড় দাদা দিদিরা আমাদের চুনোপুঁটির দলকে নিয়ে তালিম দেওয়া শুরু করত। পয়লা বৈশাখ থেকেই কেন শুরু করত কে জানে? বছরের শুরুতে বাচ্চারা ভালো শিখতে পারে নাকি টিচারদের ঐদিন মাথা ঠান্ডা থাকে? তারা না পারলে বকুনির বহরটা খানিক কম থাকে? তারপর যত বছর পুরনো হতে থাকে ততই টিচারদের মাথার তাপমাত্রা বাড়তে থাকে? কেজানে? মোটকথা পয়লা বৈশাখ থেকে শুরু হয়ে যেত পঁচিশে বৈশাখের মহড়া। কখনো কখনোবা একাধিক অনুষ্ঠানের মহড়া। পঁচিশে বৈশাখের এক দুই দিন এদিকে ওদিকে করে আশেপাশের পাড়ায় হত অনুষ্ঠান। কুশীলবরা সব মোটামুটি একই মুখ। সুতরাং অনুষ্ঠানের কিঞ্চিত বৈচিত্র থাকতে হবে বৈকি। সেসব অনুষ্ঠানে যে আমরা কিরকম কুশলতার পরিচয় রাখতাম সেসব বলতে গেলে একটা আলাদা ব্লগপোস্ট লিখতে হয়। মোটকথা বাংলা বছর শুরু হলেই বঙ্গদেশের বাকি সমস্ত অংশের মতই আমাদের পাড়াতেও সংস্কৃতিপ্রেম উদ্বেলিত হয়ে উঠতো। আমরা ট্যাঁপাটেঁপির দল ছিলাম সে সংস্কৃতি রক্ষা করার গুরুত্বপূর্ণ হাতিয়ার। একে পরীক্ষা শেষ বলে নিয়ম করে পড়তে বসার বালাই নেই তার ওপরে নতুন জামা। এর পরেও বলতে হবে কেন পয়লা বৈশাখ উত্সব ছিল? ছিল বলছি কারণ এখন এই পয়লা এবং দোসরা বৈশাখ আমি উপরোক্ত ভালো ভালো কাজ করার জায়গায় ল্যাবে বসে গবেষণা গবেষণা খেলছি আর ব্লগ লিখছি। কি আর করব-যখন যেমন তখন তেমন।



শুভ নববর্ষ। নতুন বছর সবার খুব ভালো কাটুক। সক্কলে খুব ভালো থাকবেন।  





Monday 13 April 2015

বিছানা-২

বিছানা-১ এর পর.......


জাগরী নিজের বিছানা পাতা সম্পর্কে একটু সচেতন। দিনের বাকি সবকিছুর ওপর বিশেষ নজরদারি না করলেও রাতের বিছানাটি পরিস্কার না হলে তার মন খুঁতখুঁত করে। কিছুটা পিটপিটেই সে বলবে নিজেকে এই ব্যাপারে। বেশ করে বিছানা ঝেড়ে ঝুড়ে তবে সে শোয় বিছানায়। কিন্তু একজন মানুষ নিজের বিছানাটা যে কতখানি আদর করে তৈরী করতে পারে সেটা দেখা বাকি ছিল জাগরীর। স্টেশনই যাঁর রাতের ঠিকানা সেরকম এক বৃদ্ধার রাতের বিছানা তৈরী হতে দেখল সে রাতের ট্রেনের জন্য অপেক্ষা করতে করতে।

বৃদ্ধা মাথা-পিঠ-কাঁধের বোঝা নামিয়ে নিলেন একে একে। তারপর নিজের কাঁধের শুশ্রূষা চলল কিছুক্ষণ কাঁধে হাত ঘষে ঘষে। জাগরীর বেঞ্চের পাশের জায়গাটা মোটামুটি পরিষ্কারই ছিল। খাবারের দোকানের ডাস্টবিনের থেকে একটু দূরে ব্যাগগুলোকে পাশাপাশি রাখলেন বৃদ্ধা। মাথা থেকে নামানো নাইলনের ভারী ব্যাগটা থেকে বেরোলো একটা বহুলব্যবহৃত প্লাস্টিকের শিট, আর একটি ছোটো কাপড়ের টুকরো। কাপড়ের টুকরোটি দিয়ে বেশ করে মেঝেটা ঝেড়েঝুড়ে প্লাস্টিকের শিটটি পেতে ফেললেন বৃদ্ধা। তারপর এদিক ওদিক থেকে টেনেটুনে টানটান করে ফেললেন তাকে। এইটুকু ঘটনা ঘটতে অন্তত মিনিট পাঁচ-সাত সময় লাগলো। প্রতিটি ঘটনা অতি যত্নে সম্পন্ন হচ্ছিল ধীরে ধীরে। তারপর কাঁধ থেকে নামিয়ে রাখা কাপড়ের ব্যাগ থেকে বেরোলো একটি মোটা চাদর গোছের জিনিস। পিটপিটে চোখে লক্ষ্য করলো জাগরী সেটিতেও বেশ ব্যবহারের ছাপ। চাদরটিকে বের করে প্রথমে একটু দূরে নিয়ে গিয়ে ভাঁজ খুলে বেশ করে ঝেড়ে নিলেন বৃদ্ধা। তারপর ফিরে এসে প্লাস্টিকের শিটের ওপরে সুন্দর করে বিছিয়ে দিলেন। এবার হাতের পাতা বুলিয়ে বুলিয়ে চারিদিক থেকে সমান করছেন তিনি। এত যত্নে যে কেউ এই সামান্য বিছানা তৈরী করতে পারে তাই দেখতে দেখতে বিভোর হয়ে যাচ্ছিল জাগরী। সম্বিত ফিরলো মশার কামড়ে। ডানহাতের কনুই এর কাছে জব্বর কামড়েছে মশাটা। প্রতিবর্তে বাঁহাতটা দিয়ে চাপড় মেরেও লাভ হলো না। কনুই চুলকাতে চুলকাতে আবার নজর দিল জাগরী বৃদ্ধার রাত্রিকালীন সংসারের দিকে। 

ততক্ষণে চাদর বিছানো শেষ হয়েছে তাঁর। এবার ব্যাগগুলোর দিকে নজর দিলেন বৃদ্ধা। প্রথমে পিঠ থেকে নামিয়ে রাখা বস্তাটাকে বিছানার মাথার দিক মানে খাবারের দোকানের দেওয়ালের দিকে ঠেসে দিলেন। তার দুইপাশে বড় নাইলনের ব্যাগ আর কাপড়ের ব্যাগদুটোকে এমন ভাবে রাখা হলো যে একটা মাঝারি মাপের মাঝের দাঁড়িটা ছাড়া একটা ইংরাজির 'ই' তৈরী হয়ে গেল। ব্যাপারটা ঠিক বোধগম্য হচ্ছিলো না জাগরীর। এতে করে তো বিছানার প্রায় অর্ধেক অংশই ভরে গেল ব্যাগ রেখে।শোবার জায়গা কই? তার চেয়ে ব্যাগগুলো মাথার কাছে সারি দিয়ে রাখলেই তো ভালো হত। দোকানের দেওয়াল থাকার জন্য নিরাপদও থাকত আর বেশ চওড়া শোবার জায়গাও পাওয়া যেত। নিজের মনেই হিসেব করছিল জাগরী। বৃদ্ধা ততক্ষণে চতুর্থ ছোটো ব্যাগটাকে 'দাঁড়ি ছাড়া ' -এর ঠিক মাঝখানে সুন্দর করে জায়গা করে দিয়েছেন। জাগরী ভাবছিল এবার ঠিক কতটুকু জায়গায় সারারাতের জন্য শোবেন বৃদ্ধা? তখনই তাকে অবাক করে দিয়ে বৃদ্ধা উঠে দাঁড়ালেন। তারপর মৃৎশিল্পী প্রতিমার চোখে তুলির শেষ টান দিয়ে একটু পিছিয়ে এসে যেমন করে মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে থাকেন নিজের সৃষ্টির দিকে তেমনি করে বৃদ্ধা নিজের বিছানার দিকে তাকিয়ে রইলেন কয়েক সেকেন্ড। সেই কয়েক সেকেন্ড জাগরীও বুঝি মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে ছিল এই স্রষ্টার দিকে। ভাবছিল এতক্ষণে বুঝি সারাদিনের শেষে বিশ্রাম নেবার সময় এসেছে তাঁর। 

কিন্তু না। ভারী নাইলনের ব্যাগটার চওড়া ফিতের ভার বহন করছিল বৃদ্ধার মাথার যে চাদরটি সেটি এতক্ষণে তাঁর হাতে উঠে এসেছে। আর ঠিক যেমন করে ঘুমন্ত বাচ্চার নড়াচড়ায় তার গা থেকে ঢাকা খুলে গেলে আদর করে ঢেকে দেন মা তেমনি করেই সেই চাদর দিয়ে তিনি পরম মমতায় ঢেকে দিচ্ছেন তাঁর চারটি ব্যাগ। তারপর চললেন প্ল্যাটফর্মের শেষ প্রান্তের দিকে। কি ব্যাপার! অবাক হল জাগরী। এত যত্ন করে তৈরী করা শয্যা ফেলে এত রাতে চললেন কোথায়? তার যাওয়ার পথের দিকে ভ্রূ কুঁচকে তাকিয়ে রইল জাগরী। তখনি সে সচকিত হলো তার ট্রেনের ঘোষণায়। আগের তিন চারটি ট্রেন প্ল্যাটফর্ম ছেড়ে চলে যাওয়ায় এতক্ষণে তার ট্রেনের ঘোষণা হচ্ছে। চটপট ইলেকট্রনিক বোর্ডে তাদের কামরার সম্ভব্য অবস্থান দেখে নিলো জাগরী। কুলিদেরকে জিজ্ঞাসা করে ঠিক জায়গাতেই বসেছে তারা। তার বেঞ্চের থেকে দশ-বারো পা ডানদিকে এগোলেই বি-সিক্স কোচ এর বোর্ড জ্বলজ্বল করছে। ঠিক আছে, ট্রেন ঢুকতে এখনো মিনিট দশেক দেরী আছে। বসেই থাকে জাগরী। একবার চাদরে ঢাকা পরিপাটি বিছানা আর ব্যাগগুলিকে দেখল সে। তখনি মনে হলো বৃদ্ধা গেলেন কোথায়? বাঁ-দিকে তাকিয়ে দেখতে পেল ক্লান্ত পায়ে ফিরছেন বৃদ্ধা। হাতে কি? ভালো করে ঠাহর করতে করতেই বৃদ্ধা তার সামনে দিয়ে নিজের বিছানার কাছে পৌঁছে গেছেন। হাতে তাঁর কয়েকটা ভাঁজ করা মোটা কাগজের কার্টন। স্টেশন চত্ত্বরের ফলের দোকান-টোকানের হবে। কৌতুহলী হলো জাগরী। এটা কি হবে? বিছানার ঢাকা সরিয়ে বস্তাটির মুখ খুললেন বৃদ্ধা। তারপর কার্টনগুলোকে ভাঁজে ভাঁজে ছিঁড়ে সাইজ অনুযায়ী থাক দিয়ে গুছিয়ে নিলেন তিনি। জাগরীর মনে পড়ল ছোটোবেলায় সে ঠিক এই ভাবেই নিজের হেপাজতের কয়েকটা বই সাইজ অনুযায়ী নিচ থেকে ওপরে গুছিয়ে রাখত সে। বর্ণপরিচয় আকারে সবার চেয়ে ছোটো তাই সেটা সবচেয়ে ওপরে আর পৃথিবীর মানচিত্র বইটা আকারে আয়তনে সবচেয়ে বড় তাই সেটা সবচেয়ে নিচে। আর মাঝখানে বাংলা-ইংরাজি ছড়ার বই, ছোটদের রামায়ণ, ছবিতে ইতিহাস, মনিষীদের ছেলেবেলা ইত্যাদি আরো যা যা সেই সময়কার গুরুত্বপূর্ণ এবং দৈনিক পাঠ্য বই বলে তার সেই চার পাঁচ বছর বয়সে মনে হত সেগুলোকে তার অ্যালুমিনিয়ামের বাক্সে ঠিক এরকম ভাবেই গুছিয়ে রাখত সে। তার মা-ই তাকে এই অভ্যাসটি তৈরী করে দিয়েছিলেন। অনেক পুরনো দিনের সেই স্মৃতিটি ফিরে এলো তার সেই এই বৃদ্ধার কাগজের কার্টনের টুকরো গোছানো দেখে। বৃদ্ধা এইবার বস্তার মধ্যে সেই টুকরোগুলো কে ঢোকাতে থাকেন। বস্তার ভেতরে শুধুই এরকম কার্টনের টুকরোতে ভর্তি। কি হবে ওগুলি দিয়ে? জ্বালানি? চারটি ব্যাগে যিনি পুরো সংসার নিয়ে ঘুরে বেড়ান তাঁর কি জ্বালানির প্রয়োজন আদৌ হয় কখনো? মনে তো হয় না। স্টেশনই যে তাঁর ঘরবাড়ি সে বিষয়ে অন্তত আশিভাগ নিশ্চিত জাগরী। তাহলে কি বিক্রি? কিন্তু ছেঁড়া টুকরো কারা কেনে? এ বিষয়ে আর বিশেষ গবেষণা করতে পারল না জাগরী। কারণ টুকরোগুলি বস্তায় ঢুকিয়ে, বস্তার মুখ বেঁধে, নিজের পায়ের জুতোটিকে কাপড়ের ব্যাগের তলায় চালান করে, সবচেয়ে ছোট ব্যাগটিকে কোলে করে বাকি দুটি ব্যাগ আর বস্তা দিয়ে তৈরী করা 'দাঁড়ি ছাড়া ইংরাজির ই'-এর খোঁদলে ঢুকে গেছেন ততক্ষণে বৃদ্ধা। আর জাগরীর দলের বাকি সকলেও হাতে পিঠে ব্যাগ-ট্যাগ নিয়ে ততক্ষণে উঠে দাঁড়িয়েছে। অগত্যা তাকেও ব্যাগ পিঠে নিয়ে উঠে দাঁড়াতে হয়। আস্তে আস্তে এগিয়ে যায় ডিজিটাল বোর্ডে 'বি-সিক্স' লেখাটির তলায়। আর ঠিক তখনিই জাগরীর চোখে পড়ে ঘটনাটা।

দুই নম্বর প্ল্যাটফর্ম ধোয়া শেষ করে কখন যেন রেলের সাফাইকর্মীর দলটি এই এক নম্বর প্ল্যাটফর্মের দিকে চলে এসেছে। তাদের হুইসিল আর লম্বা লাঠির ঠেলায় দূরের দিকে চাদরমুড়ি দিয়ে শুয়ে থাকা সারি সারি মানুষের দল ঘুমচোখে ধড়মড়িয়ে নিজেদের সম্বলটুকু সামলে উঠে পড়ছে জায়গা ছেড়ে। পিঠের ব্যাগ আর জলের বোতল সামলে চট করে পিছন ঘুরে বৃদ্ধার দিকে তাকায় জাগরী। ছোটো চাদরটা গায়ে টেনে গুটলী পাকিয়ে এতক্ষণে স্বস্তিতে শুয়ে পড়েছেন তিনি সারারাতের নিশ্চিন্ততায়। জাগরী আবার তাকায় সাফাই কর্মীদলটির দিকে। দানবীয় হোসপাইপ, বড় বড় ওয়াইপার, বড় লাঠির ডগায় বাঁধা ঝাঁটা আর হুইসিল নিয়ে ছয় আট জনের দলটি যেন দস্যুদলের মতই হামলা চালিয়েছে শুয়ে থাকা মানুষগুলির দিকে। ক্রমশই এগিয়ে আসছে এইদিকে হোসপাইপে জল ছেটাতে ছেটাতে। এদিকে তার ট্রেন ঢুকছে প্ল্যাটফর্মে আস্তে আস্তে। কয়েকসেকেন্ড ট্রেনের আগমন আর সাফাইকর্মীর দলটির ওপর চোখ বুলিয়ে ফের পেছনে তাকালো জাগরী। এতক্ষণে হুইসিলের আওয়াজ কানে গেছে বৃদ্ধার। উঠে পড়েছেন তিনি। অবিশ্বাস্য ক্ষিপ্রতায় এবং অবিশ্বাস্য মনোসংযোগে একে একে ভাঁজ করছেন চাদর, প্লাস্টিক শিট। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে সেসব যেখান থেকে বেরিয়েছিল সেখানে আবার ঢুকে গেল। নিজের চোখে দেখেও জাগরীর বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছিল পাতার সময় কত মমতায়, কত যত্ন নিয়ে, কত সময় নিয়ে এই বিছানাটি পেতেছিলেন বৃদ্ধা। কয়েক মুহুর্তেই সমস্ত কিছুর উল্টো চলচ্চিত্র অনুষ্ঠিত হতে দেখল জাগরী। ফের পিঠে বস্তা, মাথায় ভাঁজ করা চাদর, সেখান থেকে নাইলনের ফিতে দিয়ে ঝুলিয়ে নেওয়া হলো ভারী নাইলনের ব্যাগটা, কাঁধে উঠে গেল কাপড়ের ব্যাগটা, তার গর্ভে এখন চালান হয়েছে পেতে রাখা মোটা চাদরটা আর প্লাস্টিকের শিট, মাথায় ছোটো ব্যাগ। 

জাগরীদের ট্রেন ততক্ষণে প্ল্যাটফর্মে থেমেছে। সকলের সাথে ট্রেনের দরজা দিয়ে ওঠবার সময় দেখল সে বৃদ্ধা বিড়বিড় করতে করতে হাঁটা লাগিয়েছেন তার পাশ দিয়েই। ট্রেনের থামতে যাত্রীদের কথাবার্তায় তাঁর বিড়বিড়ানি আর কান অবধি পৌঁছালো না জাগরীর। ট্রেনে উঠে নির্দিষ্ট সিটের দিকে যেতে গিয়ে এসি কম্পার্টমেন্টের জানালা দিয়ে চোখে পড়লো তাদের বসে থাকার জায়গার চারপাশটা জলে জলময়। বড় বড় ওয়াইপার চলছে সেখানে। শুধু নির্দিষ্ট সিটে পৌঁছে ব্যাগ ঠিকঠাক করে রেখে তার কাঙ্খিত আপার বার্থে উঠে বিছানা পেতে কম্বল গায়ে টেনে শুতে গিয়ে অনুভব করলো জাগরী তার ক্লান্তিটা কি করে যেন বেমালুম উবে গেছে। ঘুমের লেশমাত্র নেই তার একটু আগে পর্যন্ত ঢুলে আসা চোখে। কব্জির ঘড়িতে তখন রাত ঠিক একটা।


(শেষ) 

Friday 10 April 2015

বিছানা-১


বারোটা উনিশস্টেশনের বড়সড় ডিজিটাল ঘড়িতে সময় দেখলো জাগরী সারাদিন টৈ টৈ করে ঘুরেছে সে। ঝকঝকে রোদে গরমটাও মোটামুটি ভালই টের পাওয়া যাচ্ছিলো। তখন তো নেশার মতন ঘুরে গেছে। এখন এই রাত বারোটা উনিশে স্টেশনের সিমেন্টের বেঞ্চে সোজা হয়ে বসে থাকতে থাকতে সারাদিনের ক্লান্তিতে শরীর ভেঙ্গে আসছে জাগরীর। হাই উঠছে। ঘুমে চোখ জ্বালা করছে। কিন্তু এখনো আধঘন্টা মতন এই যন্ত্রনা ভোগ করতে হবে তাকে। সেই একটা নাগাদ ট্রেন ছাড়বে। বারোটা পঞ্চাশ এর আগে তো নিশ্চয়ই ট্রেন ঢুকবে না স্টেশনে। টার্মিনাল স্টেশন না হলে এই এক ঝামেলা।বসে থাকো পিঠ সোজা করে কখন ঢুকবে ট্রেন। তাও ভালো শেষ মুহুর্তে বুকিং হলেও এসি তে আপার বার্থ পেয়ে গেছে সে। ট্রেন ঢুকলে শুধু ট্রেনে উঠে চাদর পেতে কম্বল মুড়ি দিয়ে শুয়ে পড়তে পারলেই হলো। ট্রেন চলতে শুরু করলে তার আর কোনো অসুবিধা হয়না ঘুমোতে। অনেকের ট্রেনে ঘুম না হলেও জাগরীর কোনো অসুবিধা নেই ট্রেনের দোলানিতে বরং ঘুমটা তার ভালোই হয়। আর আপার বার্থ হলে তো কথাই নেই। কেউ বিরক্ত করার নেই। যতক্ষণ ইচ্ছে ঘুমোলেই হলো। পাহাড়ে বেড়াতে এলে একটা সমস্যা হলো এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় যেতে হলে গাড়িতে ঝিমিয়ে নেওয়া যায়না একটুও। কেবলই পাহাড়ি বাঁকে বাঁকে চলতে চলতে এদিক ওদিক হেলে পড়তে হয়। ফলে তিন চার দিনের ছুটিতে তিন চার জন মিলে পাহাড়ে এসে প্রতিদিনই সকালে চোখ খুলেই দৌড়-দৌড়-দৌড়। তিন চার দিনে এনার্জি একদম তলানিতে ঠেকেছে জাগরীর। তাও স্টেশন থেকে দু মিনিটের হাঁটাপথের দূরত্বে হোটেল পেয়েছিল তারা। ফলে রাত দশটায় হোটেলে ফিরে বারোটা পর্যন্ত বিছানায় পড়ে ছিল সে। সকলে তৈরী হতে ঘুম চোখে বারোটায় বেরিয়ে এসেছে ব্যাগ ঘাড়ে করে রাত একটার ট্রেন ধরতে। এত রাতের ট্রেনের জন্য অপেক্ষা করতে গিয়ে ঢুলে পড়তে পড়তে সামলে নিলো নিজেকে। জেগে থাকার জন্য এদিক সেদিক তাকাতে শুরু করলো জাগরী। এত রাতে স্টেশন চত্বর প্রায় ঘুমন্ত। তবে রাতের শিফটে যাঁদের কাজ করার কথা তাঁরা ঠিকই করছেন নিজেদের কাজ। স্টেশনে ঢোকার সময় অটোওয়ালারা নিয়ম মাফিক জিজ্ঞাসা করেছে তাদের অটো লাগবে কিনা, তারপর স্টেশনের মেন গেটের সামনে চলছে বালি সিমেন্টের কাজ। সকালে যাত্রী চলাচলের ভিড়ে মূলরাস্তায় সিমেন্টের কাজ করা দুইপক্ষের জন্যই অসুবিধাজনক। এত রাতে যে কোনো রাজমিস্ত্রী কাজ করেন চাক্ষুষ দেখা হয়ে ওঠেনি কোনদিন। আজ দেখলো দুজন রাজমিস্ত্রী মন দিয়ে সারাচ্ছে স্টেশনের ঢোকার মূল রাস্তাটা। স্টেশনের দুই নম্বর প্ল্যাটফর্ম ধোয়াধুয়ী চলছে বড় বড় জলের পাইপ আর ওয়াইপার দিয়ে। একটিমাত্র চায়ের ষ্টল খোলা তাদের এই একনম্বর প্ল্যাটফর্মে। স্টেশন ম্যানেজার বা অন্য অন্য অফিসগুলিতেও রাতের শিফটের কাজ চলছে। আসলে এ রাস্তায় এই স্টেশনটি বেশ গুরুত্বপূর্ণ। এই পাহাড়ের সমস্ত পর্যটনস্থান বা তীর্থস্থানের সমস্ত যাত্রীকেই পাহাড়ের ঠিক নিচে অবস্থিত এই স্টেশনটি হয়েই যেতে হয়। সুতরাং যাত্রী চলাচলের বিরাম নেই এ স্টেশনে। তারই মধ্যে স্টেশনচত্বরে যে যার মতন ব্যবস্থা করে ঘুমোচ্ছে সারি সারি মানুষ। সেখানে মাঝরাতে ট্রেন থেকে নামা ভোরের অপেক্ষায় থাকা পর্যটক, তীর্থযাত্রীও যেমন আছে তেমনি আছে স্টেশনই যার ঘরবাড়ি এমন বেশ কিছু মানুষ। একই সাথে পরপর সারি দিয়ে চাদর কম্বল মুড়ি দিয়ে শুয়ে আছে সকলে। যতক্ষননা চাদর থেকে মুখ বের হচ্ছে ততক্ষণ বোঝার উপায় নেই কে অ্যাডভেঞ্চার লোভী বিদেশী ট্রেকার, কে ভারতবর্ষের দূর গ্রাম থেকে তীর্থ করতে আসা বয়স্ক দম্পতি আর কেই বা নিতান্ত নিরুপায় হয়ে অন্য কোথাও ঠাঁই না পাওয়া স্টেশনে ঘুমোতে আসা ভবঘুরে। পাশে রাখা ব্যাগ ব্যাগেজের ধরন আর ওপরের চাদর বা কম্বলের রোঁয়া কতটা উঠেছে তা দেখে কিছুটা আন্দাজ করা যায় মাত্র। তাই দেখছিল জাগরী।

তার বসার বেঞ্চের ঠিক পাশেই বন্ধ হয়ে যাওয়া একটা খাবারের দোকান। আর তার ডাস্টবিন। ডাস্টবিনে বড় বড় ইঁদুরের ছুটোছুটি দেখছিল জাগরী। কি ক্ষিপ্রতায় ছোটো ছোটো খাবারের পড়ে থাকা টুকরোগুলো নিয়ে ছোটাছুটি করছে ইঁদুরগুলো। নানান রকম লোকজন যাতায়াত করছে প্ল্যাটফর্মে।বেশিরভাগই তাদের এই ট্রেনের যাত্রী বলে মনে হচ্ছে। তার মধ্যে বিশেষ একজনের দিকে নজর পড়ল জাগরীর। হয়ত পোশাক-পরিচ্ছদের দিক দিয়ে অন্য সকলের চেয়ে বেমানান বলেই তাঁর দিকে নজর গেল তার। দূর থেকে তারই দিকে এগিয়ে আসছেন রোগা ক্ষয়াটে চেহারার বৃদ্ধা। পরনে পাহাড়ী মহিলাদের মতই ছোটো ঝুলের সুতির ঘাগরা আর লম্বা ঝুলের ব্লাউজ, আর সবজে রঙের পাতলা ওড়না। মাথায় একটি রঙচটা চাদর ছোটো করে ভাঁজ করে মাথায় রাখা কারণ সেই চাদরটিই একটি নাইলনের ফিতের সাহায্যে ভার বহন করছে পিঠে রাখা একটি বড়সড় বস্তার। বস্তার ওপরে রাখা আরো একটি বিশাল নাইলনের ব্যাগ। মাথায় রাখা ছোটো আরো একটি ব্যাগ আর পিঠের বস্তার ওপরে রাখা নাইলনের ব্যাগটিকে ধরে রেখেছে বৃদ্ধার শীর্ণ ডানহাত। আর সেই ডানকাঁধ থেকেই ঝুলছে আরো একটি মস্ত বড় কাপড়ের ব্যাগ, যার আপাদমস্তক জিনিসপত্রে ঠাসা বলে মনে হলো জাগরীর। পাহাড়ী মানুষদের ফুসফুসের জোর বেশি হয় শুনেছে সে, কিন্তু তাবলে এই বয়সে চার-চারটে এই সাইজের ভারী ব্যাগ কি করে বৃদ্ধা বয়ে আনছেন বিস্ময়ের সাথে সেটিই লক্ষ্য করছিল জাগরী। সে নিজে এই কম বয়সে একটি মাত্র মাঝারি মাপের ব্যাকপ্যাক হোটেল থেকে স্টেশন পর্যন্ত বয়ে নিয়ে এসেই হাঁপিয়ে উঠেছে। আর পিঠ বা কাঁধের প্যাডিং জাতীয় নূন্যতম আরামের আয়োজন ছাড়াই তার চেয়ে অন্তত দেড়গুণ বেশি ভারী চারটে ব্যাগ একসাথে একজন বৃদ্ধা মহিলা কি করে বয়ে আনতে পারেন এই বিস্ময়টি থেকে চোখ সরিয়ে নিতে পারছিল না সে। তার বেঞ্চের ঠিক পাশেই খানিকটা ফাঁকা জায়গা। সেখানে এসে বৃদ্ধা একে একে নামালেন চারটে ব্যাগ। বৃদ্ধা যে এই চারটি ব্যাগ নিয়েই সর্বত্র যাতায়াত করেন সেটা ব্যাগ নামানোরও পারম্পর্য থেকেই বোঝা গেল। কোনো তাড়াহুড়ো ছাড়াই প্রথমে মাথার ছোটো ব্যাগটি নামালেন তিনি। তারপর কাঁধের কাপড়ের ব্যাগ তারপর পিঠের বস্তার ওপরে রাখা নাইলনের ভারী ব্যাগটি। সেটি নামাতে বেশ কষ্টই হলো বোঝা গেল বৃদ্ধার। সবশেষে নাইলনের ফিতে সহ বস্তাটা। বস্তাটি বিশেষ ভারী নয় বোধহয়। ঘুম তাড়ানো ছাড়া বিশেষ কিছু করার ছিলনা জাগরীর। ডানদিকে তাকিয়ে বৃদ্ধাকে আর তাঁর কার্যকলাপকে লক্ষ্য করতে লাগলো সে।