Wednesday 3 June 2020

যন্ত্রণার অনুভূতি


কোনো কোনো মানুষ নাকি প্রবলভাবে যন্ত্রনা সহ্য করার ক্ষমতা রাখতেন বা রাখেন। তাঁদের অনেককেই আমরা সিদ্ধপুরুষ বলে মানি। তবে ওই এনেস্থেসিয়া ছাড়া সার্জারি করে ফেলা বা অন্য ছোটখাটো শারীরিক যন্ত্রণা যা অন্য আর সকলের কাছে মুখ বুজে সহ্য করা বেশ কঠিন ব্যাপার, তা তাঁরা যে অবলীলায় সহ্য করার ক্ষমতা রাখেন তার সাক্ষী অনেকেই। যদিও বিষয়টিকে এতদিন পর্যন্ত খানিকটা সন্দেহমিশ্রিত বিস্ময় নিয়েই দেখেছি। অনেকে অবশ্য সন্দেহাতীতভাবে স্রেফ সাধুদের ভণ্ডামিতেই স্ট্যাম্প লাগিয়েছেন। আজকে একটা বিষয়ে পড়ে এই ঘটনাটাকে খানিকটা অন্যরকমভাবে বিশ্লেষণ করতে হচ্ছে।

আজ পড়লাম, ডিউক উনিভার্সিটির একটি রিসার্চ সম্পর্কে যেখানে ওঁরা দেখিয়েছেন, ব্রেনের একটি ছোট্ট অংশ এক্টিভেটেড হলে যন্ত্রনার অনুভূতিটাই পুরো বন্ধ হয়ে যায়। অংশটি হলো আমিগডালা (Amygdala), যেটি নাকি নেগেটিভ ইমোশন তৈরির কারখানা বলেই পরিচিত। এই মানে "Fight or flight" গোছের ইমোশোনই হোক বা সাধারণ anxiety, সবেরই ডিপো এই amygdala। সুতরাং ব্রেনের আর যে অংশই হোক না কেন, এখানে কেউ যন্ত্রণার অনুভূতি বন্ধ করার সার্কিট খোঁজার চেষ্টাও করেনি এতদিন। কিন্তু প্রশ্নটা ছিলই অনেকদিন ধরেই। আসলে মানুষ ভাবছিলো কোনো একটা অংশের কাজ বোধহয় নয় এটা।  তাই যন্ত্রনা তৈরী করে যে সমস্ত স্নায়ুপথ, সবকটা বা তাদের মধ্যে বেশ কয়েকটা বন্ধ করলে তবে বুঝি যন্ত্রনা বন্ধ হবে। কিন্তু সেতো মারাত্মক কঠিন কাজ। প্রথম তো সবকটা পথ খুঁজে বের করা। তারপর তাদের কাজ পুরোপুরি বোঝা, তারপর তাদের কাজ বন্ধ করলে যদি আর অন্য কোন দরকারি কাজ বন্ধ হয়ে যায় তবে আবার তাদের অমন দুম করে বন্ধ করে দেওয়া যাবে না। সুতরাং বিস্তর ঝামেলা!

কিন্তু যন্ত্রণার অনুভূতি যদি বন্ধ করে দেওয়া যায় তাহলে অনেক কাজ অনেক সহজে করা যাবে তাই না বলুন? এই মানে সার্জারির সময় এনাস্থেসিয়ায় যেসব রোগীর সমস্যা হয় তাঁদের মারাত্মক উপকার হতে পারে। তারপর যুদ্ধবাজ পৃথিবীর বোড়ে, মানে সাধারণ সৈন্যদের যুদ্ধক্ষেত্রে আঘাত লাগলে চিকিৎসা শুরুর আগের সময়টাতে যদি কোনোভাবে যন্ত্রণার অনুভুতিটা বন্ধ করে দেওয়া যায় কি ভালো হয় তাই না? তাই মানুষ খুজঁছিলোই। কিন্তু সে জিনিস যে amygdala তে বসে আছে তা আগে কেউ ভাবেনি।

তা ডিউক উনিভার্সিটির স্কুল অফ মেডিসিনের প্রফেসর Fan Wang এর ল্যাবরেটরিতে হঠাৎ হলোটা কি যে তাঁরা ওই নেগেটিভ ইমোশনের হট স্পট amygdala তে খুঁজতে শুরু করলেন? আসল কথাটা হলো, ওঁরা ওটি খুঁজবেন বলে খোঁজেননি তো। হঠাৎই পেয়ে গেছেন। ওঁরা সাধারণ এনেস্থেসিয়া দিয়ে দেখছিলেন ব্রেনে (অবশ্যই ইঁদুরের ব্রেনে) কোন কোন জায়গা ইনএক্টিভ হয়। সে করতে গিয়ে দেখলেন, বেশ কিছু জায়গা নিষ্ক্রিয় তো হয়ই তার ফলে ঘুমের মতো একটা পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়। তার সাথে সাথে আশ্চর্য ভাবে কিছু জায়গা অ্যাক্টিভেটেড বা সক্রিয় হয়ে ওঠে। তার মধ্যে amygdala একটা। amygdalaর পুরোটা নয় অবশ্যই। মাঝের কিছু স্নায়ু, নাম দিলেন ওঁরা CeAga neurons (CeA stands for central amygdala; ga indicates activation by general anesthesia) তা সে নাম যাই হোক, Wang এর ল্যাবরেটরি দেখলো যে, ইঁদুরে খুব অল্প মাত্রায় যন্ত্রনা দিলে ব্রেনের ১৬ টি অংশের স্নায়ু উত্তেজিত হয় এবং এগুলোর মিলিত প্রয়াসই হলো যন্ত্রনার অনুভূতি। এবং এই CeAga neurons এই মিলিত অনুভূতির সম্পূর্ণ ভিন্ন এবং বিপরীত অনুভূতি সৃষ্টি করে। অর্থাৎ যন্ত্রণার অনুভূতিকে বাধা দেয়। এবার বলুন এই ১৬টি অংশকে একযোগে বন্ধ করা সহজ নাকি এই একটি অংশকে সক্রিয় করা সহজ? অবশ্যই পরেরটা তাইনা? 

ইঁদুররা যখন যন্ত্রনা পায় তখন আহত অংশটিকে চাটে, বা দুহাত (সামনের দুই পা) দিয়ে মুখ মোছে বার বার। এখন প্রফেসর Wang এর দলবল করেছিল কি, তারা একটি বিশেষ তরঙ্গদৈঘ্যের আলো দিয়ে ব্রেনের ওই CeAga neuron গুলোকে এক্টিভেট করছিলো। যেই আলোর সুইচ অন হচ্ছে অমনি ওদের যন্ত্রণার অনুভুতি চলে যাচ্ছে। ওরা পা চাটা বা মুখ মোছা বন্ধ করে দিচ্ছে। বার বার একই ঘটনা! যেন ম্যাজিক! এবার প্রফেসর Wang এর দলবল আরো নিশ্চিত হবার জন্য এমন কিছু ইঁদুরে একই এক্সপেরিমেন্ট করলেন যাদের ওই বিশেষ নিউরোন এক্টিভেট হবার ক্ষমতা লোপ পেয়েছে। তাদের ক্ষেত্রে কিন্তু যন্ত্রণার অনুভূতি বেড়ে গেলো সাংঘাতিক রকম। অর্থাৎ ওই CeAga neuron গুলোর এক্টিভেশন দরকার যন্ত্রণার অনুভূতি বন্ধ করার জন্য। 

এই হলো গল্প। এই পরীক্ষার সমস্ত ফলাফল প্রকাশিত হয়েছে Nature Neuroscience জার্নালে এই গত ১৮ই মে।  

এখন মনে করুন, এমন একটা ওষুধ পাওয়া গেলো যা আপনি টুক করে খেয়ে নিলেন আর অমনি আপনার ব্রেনের CeAga neuron গুলোর এক্টিভিটি চড়চড় করে বেড়ে গেলো। আপনার যন্ত্রণার অনুভূতি কিছুক্ষনের জন্য 'নেই' হয়ে গেল। এবার আপনি নির্দ্বিধায় সাংঘাতিকসব দুঃসাহসিক কাজ করতে পারবেন। তাই না? মানে ইচ্ছে মত যন্ত্রণার সুইচ অন বা অফ আপনার হাতে। সাংঘাতিক পাওয়ারফুল পেনকিলার! সেসব এখন অবশ্য ভবিষ্যতের হাতে।

তা যে গল্প দিয়ে শুরু করেছিলাম, কিছু মানুষের যন্ত্রণার অনুভূতি অলৌকিক বলে আমরা চোখ গোলগোল করি বা ভড়ং বলে মুখ বাঁকাই, তাঁদের ক্ষমতার একটা ব্যাখ্যা অন্তত পাওয়া যাচ্ছে এই কাজটি থেকে। তাঁদের মস্তিষ্কের amygdala র এই CeAga neuron গুলিকে তাঁরা হয়তো ইচ্ছে মত সক্রিয় করতে পারেন বা পারতেন। কে বলতে পারে! 







0 comments:

Post a Comment