Tuesday 31 March 2015

ধর্ম

আরো কত লিটার রক্ত লাগবে
অন্ধকারকে ধুয়ে মুছে সাফ করতে?

কলমে কালির রং ছিল কালো অথবা নীল
আজকে সে রং আবার রক্তে লাল।
কলমের মুখ দিয়ে চলেছে অবিরত রক্ত উদগীরণ।
আর কতদিন?

সুস্থ নির্ভয় নির্মল আকাশ
সে কি ক্রমশই স্বপ্ন কেবল?
অসুস্থ হিংসার নির্দয় ছুরি শান দিয়ে চকচকে।
অথচ তারই নাম নাকি ধর্ম।

সময় চক্রে ধর্মের মানেও বদলে চলে
সমস্ত শব্দের মতন।

ধর্ম মানে তো শুনেছিলাম ভালোবাসা মাত্র
সে বুঝি কোন পূর্বজন্মের স্মৃতি?
তাই হবে।

Sunday 29 March 2015

পরিচয়

কিছুদিন আগে একটি বৈজ্ঞানিক সম্মেলনে উপস্থিত থাকার সৌভাগ্য হয়েছিল। সেদিন অন্য একটি বিশেষ কারণে আমাদের চার পাঁচ জন ছাত্রছাত্রীর দলের সাথে সেই সম্মেলনে আমাদের ল্যাবের অন্যতম অপরিহার্য বন্ধু রাজেশও আমাদের সাথে ছিল। রাজেশের এই বৈজ্ঞানিক আলোচনা শোনার কোনো উত্সাহ ছিল না। তার কারণ হয়ত ওর এই আলোচনার বিষয় সম্পর্কে সম্যক ভাবে অবহিত থাকার কথা নয়। সেই পর্যন্ত পড়াশুনা করার সুযোগ জীবন তাকে দেয়নি। তার অনেক আগেই মিষ্টি স্বভাবের এই রাজস্থানী ছেলেটি আমাদের ল্যাবে আমাদের বিজ্ঞান বিজ্ঞান খেলায় সকলকে সাহায্য করার জন্য ঘর ছেড়েছে। সেদিনের সেই সম্মেলন মোটামুটি ভাবে ঘরোয়া সম্মেলনই বলা যায়। তাই সম্মেলনের বৈজ্ঞানিক কথাবার্তা শুরু হবার আগে সম্মেলনের সভানেত্রী ছোট্ট সভাঘরে উপস্থিত সকলকে নিজের নিজের পরিচয় এবং তিনি কোথায় কি কাজ করেন সে সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত আভাস দেবার প্রস্তাব রাখলেন। এবং সর্বসম্মতিক্রমে সে প্রস্তাব গৃহীতও হলো। যেহেতু সভাটি ছোট্ট তাই সেখানে উপস্থিত প্রথম সারির বৈজ্ঞানিক যাঁদের প্রায় প্রত্যেকেই চেনে এবং তাঁদের কাজকর্ম সম্পর্কে সকলেই কমবেশি ওয়াকিবহাল, তাঁরাও প্রথামাফিক নিজের নিজের পরিচয় দিলেন। ছাত্রছাত্রীরাও একে একে নিজেদের পরিচয় দিতে শুরু করলাম। অবশ্যই তা ইংরাজিতে। সমস্যাটা হলো তখন যখন পালাক্রমে পরিচয় দানের বিষয়টি আমাদের সারিতে এসে পড়ল। ব্যাপারটা আর কিছুই নয়। রাজেশ প্রথাগতভাবে এই সম্মেলনে একেবারেই বেমানান। কোথাওই কোনো সম্মেলনে রাজেশের মতন লোকেদের কোনো জায়গা হয়না। হয়ত তাঁরাও সেখানে উপস্থিত থাকার কোনো উত্সাহ পান না। পালাক্রমে রাজেশের পরিচয়দানের পালা যখন এলো তখন দেখলাম রাজেশকে টপকে আমাদেরই অন্য এক সহকর্মী নিজের পরিচয় দিচ্ছে। এবং অবশ্যই সেটা রাজেশের সম্মতিক্রমে। প্রথমত রাজেশ ইংরাজি ভাষায় নিজের পরিচয় দিতে অপারগ। আর দ্বিতীয়ত পদাধিকারগত ভাবে আমাদের মতন বিজ্ঞান গবেষক নয়, সহকারীমাত্র। সুতরাং সে নিজেই সকলের মাঝে দাঁড়িয়ে উঠতে চায়নি। আর তাতে পাশের বাকি বন্ধুরাও সায় দিয়েছে তাকে বিড়াম্বনা থেকে বাঁচাতে। বাকিরা নিজেদের মতন পরিচয় দিলেন। সভার কাজও যথাবিহিত সুষ্ঠ ভাবেই শেষ হলো। রাজেশ পুরো সময়টা নিজের মতন সিটে বসে ঝিমিয়ে নিলো। পরে সভা শেষে বাইরে বেরিয়ে চা-কফি পানের ফাঁকে তাকে জিজ্ঞাসা করা হলো যে সে ঠিক কি ধরনের কাজ করে তা তার বাড়ি লোকজন জানে কিনা? বা তার কাজ সম্পর্কে তার আশেপাশের লোকজন জানতে বা বুঝতে উত্সাহী কিনা? বা এত বছর এই ল্যাবে কাজ করে প্রতিনিয়ত সকলকে সব কাজে সাহায্য করে চলা এই মানুষটি নিজে বিষয়টি সম্পর্কে জানতে উত্সাহী কিনা? প্রত্যাশা মতই উত্তর এলো। সে যে একটি রিসার্চ ল্যাবরেটরিতে কাজ করে সেটি বাদ দিয়ে তার বাড়ির লোক বা আশেপাশের লোকজন বিশেষ কিছুই জানেন না। বা তার কাছেও কাজটি একটি জীবিকামাত্র। অত্যন্ত স্বাভাবিক একটি ঘটনা। 

রাজেশ আমাদের কাজে অত্যন্ত অপরিহার্য অঙ্গ। আমরা যেকোনো একজন ল্যাবে অনুপস্থিত থাকলে ল্যাবের কাজেকর্মে বিশেষ কোনো বিঘ্ন ঘটবে না। কিন্তু রাজেশ সপ্তাহখানেকের জন্য রাজস্থানে তার বাড়িতে চলে গেলে ল্যাবশুদ্ধু সকলের প্রায় নাভিশ্বাস ওঠার অবস্থা হয়। কিছুটা যদিও এই কারণে যে আমরা সকলেই এখানে এসেছি এই জায়গাটিকে নিংড়ে নিয়ে সিঁড়ির পরবর্তী ধাপটিতে পা রাখতে। আর সে এসেছে এই জায়গাটিকেই নিজের ভেবে যত্ন করে জড়িয়ে ধরতে। এর সাথে তার রুটিরুজির ব্যাপারটিও ওতপ্রত ভাবে জড়িত বলেই হোক বা না জানা অন্য কোনো কারণেই হোক, হয়ত আমাদের সকলের চেয়ে একটু বেশিই আদর যত্নে রাখে সে তার কাজের জায়গাটাকে। অথচ আমরা কোনো দিনই তাকে তার কাজের আসল বিষয়টিকে বুঝে উঠতে সাহায্য তো করিইনি উপরন্তু কোনো আলোচনায় তার উপস্থিতিও অস্বাভাবিক মনে হয়েছে। রিসার্চ ইনস্টিটিউট এর ভেতরের কার্যকলাপের সাথে ঠিক তার বাইরের মানুষদের যে বিন্দুমাত্র যোগাযোগ থাকে না, সে তো সর্বজনবিদিত। কিন্তু কোনো সভায় রাজেশের মতন রিসার্চের জন্য অপরিহার্য কেউ উপস্থিত থাকলেও, তিনি ইংরাজি না বলতে পারলে হিন্দিতে নিজের পরিচয় দিতেও কুন্ঠা বোধ করেন। তিনি খাতায়কলমে গবেষক নন, কিন্তু তাকে ছাড়া যে আমাদের মতন তথাকথিত গবেষকরা ঠুঁটো তা তিনি নিজেও যেমন জানেন আমরাও জানি। তিনি নিজে যতটা কুন্ঠা বোধ করেন তার থেকেও হয়ত আমাদের লজ্জিত হবার যথেষ্ট কারণ রয়েছে এইসব ক্ষেত্রে। আমিও তো সেদিন সেই সভায় তার পাশ থেকে উঠে দাঁড়িয়ে গর্বিত হয়ে রাজেশকে সকলের সাথে পরিচয় করিয়ে দিতে পারিনি। সে যদি লজ্জায় হোক বা অন্য কোনো কারণে নিজের পরিচয় দিয়ে উঠতে না পেরে থাকে তবে আমিও তো উঠে দাঁড়িয়ে বলতে পারতাম- 'এই হলো রাজেশ, একে ছাড়া আমাদের ল্যাব অচল। আমাদের ল্যাবের সবচেয়ে দীর্ঘস্থায়ী, সবচেয়ে একাগ্র, আমাদের সহকর্মী।' তাকে একটু একটু করে তার মতন করে বিষয়টির মধ্যে ঢুকিয়ে নেবার চেষ্টা তো কোনোদিন করিনি। যদি করতাম কে বলতে পারে কয়েক বছর পরে রাজেশকেও হয়ত আর কোনো সেমিনার হল-এ ঢুকে ঝিমোতে নাও দেখতে পারতো কেউ। 

     

Thursday 26 March 2015

গলা খুলে

যাক বাবা 'ছেষট্টির এ' কে হই হই করে ছক্কা মেরে মাঠের বাইরে বের করে দেওয়া গেছে। এইবার আর পায় কে। এইবার ফেসবুকে যত্তখুশি টম-জেরির গল্প শোনাও, ছবি দেখাও আর কেউ কান ধরার নেই। ব্যাপারটা ভালোই হয়েছে নিঃসন্দেহে। যদিও আমি অন্তত 'একুশে আইন'- এর এই ধারার নাম ধাম মানে নম্বর (৬৬এ) টম্বর সম্পর্কে কাল-পরশুর আগে একেবারেই ওয়াকিবহাল ছিলাম না। তাও ফেসবুকে বড়দের সম্পর্কে একটি শব্দও উচ্চারিত হলে, কোনো সময় যে বড়রা এসে কান ধরে নিলডাউন করে দিতে পারে তা সে ছেষট্টিই হোক বা ছিয়াত্তর বা ছিয়াশি, সেটা বিলক্ষণ জানতাম। তাই সকাল বিকেল বাড়িতে বসে চা খাবার সময়টুকুতে দরজা-জানালার ছিটকিনি বেশ ভালো করে বন্ধ আছে কিনা পরীক্ষা করে নিয়ে তবেই বড়দের সম্পর্কে চাট্টি কুকথা কয়েছি। এখন সেই সতর্কতা থেকে কিঞ্চিত শিথিলতা প্রাপ্তির আশা মিলেছে। প্রচলিত অব্যবস্থার প্রতি নূন্যতম অনাস্থা বা অসন্তোষ প্রকাশ মানেই যদি শিবঠাকুরের আপনদেশের আইন তার ফাঁক খুঁজে নিয়ে টপাটপ মানুষ ধরে ঝপাঝপ জেলে ঢোকাতে থাকে, তবে তো একসময় ঠক বাছতে গাঁ উজাড় হবে। হয় রাস্তাঘাট-রেলপথ-ইস্কুল-কলেজ-হাসপাতাল বানানো ছেড়ে পরের পর জেলখানা বানাতে হবে। নতুবা হীরক রাজ্যের মতন প্রজাদের কথা বলা বন্ধ করতে হবে বা একটি 'মস্তিস্ক প্রক্ষালণ যন্ত্র' এর দরকার হয়ে পড়বে। এবার অন্তত আমাদের নিজেদের বিচারব্যবস্থার পরিণতমনস্কতার কিছুটা উদাহরণ চোখের সামনে এসে আমাদের আশ্বস্ত করেছে। ধন্যবাদ শ্রেয়া সিন্ঘল। নিজের পড়াশুনা শিকেয় তুলে এই বয়সেই বনের মোষ তাড়ানোর অদ্ভূত চিন্তাটা মাথায় না এলে এই একুশে আইনকে দরজা দেখাতে আরো কত বছর লাগত কে জানে। রাজনৈতিক বা সামাজিক অব্যবস্থার বিরুদ্ধে যাঁরা আওয়াজ তোলার সাহস রাখেন তাঁদের জন্য এটি একটি বড় পদক্ষেপ বই কি? 

কিন্তু.......,হ্যাঁ এখানে একটি কিন্তুর খচখচানিও আছে। অন্তত আমার মনে। যদিও আইনের এই ধারাটি বিলোপের সাথে এই কিন্তুর সরাসরি বিশেষ সম্পর্ক নেই বলা যায়। তবু এই কিন্তুটিকে বিশ্লেষণ করলেই বোধহয় বোঝা যাবে যে বাকস্বাধীনতা রক্ষার্থে একটি দুষ্টু আইন বিলোপমাত্রেই কি বাকস্বাধীনতা রক্ষা করা যায়? ছোট থেকেই আমাদের প্রত্যেককে "সদা সত্য কথা বলিবে"-র সাথে সাথে এও শেখানো হয় যে, "অপ্রিয় সত্য কথা বলিবে না।" এই দ্বিতীয় নির্দেশটি মেনে চলতে গিয়ে কিঞ্চিৎ বেগ পেতে হয়। কারণ কোন সত্য যে কার কাছে কতটা অপ্রিয় আর কার কাছে কতটা প্রিয় সেটি চট করে বুঝে ওঠা যায় না। সেখানে বাকস্বাধীনতা ব্যাপারটি যে বেজায় ঠুনকো আর আপেক্ষিক সেটা ভুক্তভোগী মাত্রেই জানেন। অফিসে, বাড়িতে এর ভুরি ভুরি উদাহরণ রয়েছে। অর্থনৈতিক ভাবে পরাধীন কোনো নিরক্ষর মহিলা কি পারবেন তাঁর উপার্জনশীল স্বামী এবং শ্বশুরবাড়ির মন্দ দিকটি সম্পর্কে সোচ্চার হতে? বড়সড় অভিযোগ তো দূরস্থান, ছোটখাটো পাওয়া না পাওয়া বিষয়ে মুখ খুলতে আমরা ডরাই। সম্পর্কহানির ভয়ে। কোনো একজন ব্যক্তির চরিত্রগত দুর্বল দিকটি সম্পর্কে ততই কম কথা বলা যায়, যতই মানুষটি সম্পর্কের দিক থেকে আপন হয়। আমার এই মন্তব্যটি হয়ত অনেকেই মানতে পারবেন না। কিন্তু এটি অত্যন্ত সত্যিকথা যে আমরা আমাদের প্রিয় বন্ধুর সমস্ত ভালো গুণগুলিকে সম্পূর্ণ করতে, তাঁকে নিজের বিচার বিবেচনামত পরিপূর্ণ আদর্শস্বরূপ তুলে ধরতে অনেক সময়ই তাঁর চরিত্রের হয়ত একটিমাত্র দূর্বল দিক সম্পর্কে তাঁকে সতর্ক করতে যাই। কিন্তু যদি সেই মানুষটির নিজের সমালোচনা গ্রহণ করার বা নিজেকে পুনরালোচনা করার মতন যথেষ্ট প্রাপ্তমনস্কতার অভাব থেকে থাকে তবে সেই দুর্বলতা সম্পর্কে তাঁকে অবহিত করতে যাবার অব্যবহিত ফলাফল হলো বন্ধুত্বহানি। সেই বন্ধুত্বহানির ভয়ে অনেক সময়ই আমরা ব্যাপারটি চেপে যাই। বা সেই দুর্বলতার সাথে মানিয়ে নিয়ে চলার চেষ্টা করি। কিন্তু মানুষটি যদি তত কাছের কেউ না হন, যদি তাঁর সাথে সম্পর্কের ওঠা পড়ায় আমাদের বিশেষ কিছু লাভ ক্ষতি হবার সম্ভাবনা না থাকে তবে আমরা নির্দ্বিধায় তাঁকে তাঁর ঋণাত্মক দিকটি সম্পর্কে বলতে পারি। এটিও কি এক ধরনের বাকস্বাধীনতার জলাঞ্জলি নয়? কাজের জায়গায় উর্দ্ধতন কর্তৃপক্ষের অন্যায় মেনে নেওয়া, বসের বদখত চেহারায় বদখত জামা দেখে "বাহ, দারুন মানিয়েছে তো আপনাকে"-এসব তো প্রতিদিনের ঘটনা। আমাদের দৈনন্দিন জীবনের সমস্ত ক্ষেত্রেই নিজেদের সমালোচনা গ্রহণ করার মতো প্রাপ্তমনস্কতা যতদিন না তৈরী হচ্ছে ততদিন আইন বিলোপই কর বা নতুন আইনই বানাও সত্যি কথাটা গলা তুলে বলার সাহস কোনদিনই আমাদের হবে না। 

তথ্যপ্রযুক্তিগত বাকস্বাধীনতা আইনের সাথে যদিও এই দৈনন্দিন ঘটনাগুলির বিশেষ কোনো যোগ নেই। এবং ৬৬এ লোপাট হয়েছে বলে অন্য কোনো আইনের শাখায় সোশ্যাল মিডিয়ায় বাকস্বাধীনতা ওপর নজরদারি করা হবে না তাও নয়। তবুও সর্বাঙ্গীন অর্থেই গলা খুলে কথা বলার অধিকারের প্রশ্নে মনে হয় সমস্ত ঘটনাগুলিই তাত্পর্যপূর্ণ। আমরা বাইরে বাইরে যতই প্রাপ্তবয়স্ক হই, আত্মসমালোচক হই না কেন, এই যে আমি বাকস্বাধীনতা এবং সমালোচনা গ্রহণ করার প্রশ্নে এতগুলি কথা আমি খরচ করছি, সেই আমারই মুখের সামনে যদি কেউ আমার একশ একটা দোষ সম্পর্কে আমায় বলে, সেই দোষগুলি সম্পর্কে সম্যকভাবে অবহিত হওয়া স্বত্বেও আমি কতটা আমার সামনের মানুষটিকে তারপর সহজভাবে নিতে পারব সেটি বড় একটি প্রশ্ন।

অম্বিকেশ মহাপাত্র কারো সম্পর্কে সত্যি বলে জেলে কেন যাবেন সেই নিয়ে গলা ফাটাচ্ছি ফেসবুকে অথচ 'অফিসে ঢুকতে কেন রোজ একঘন্টা দেরী হয়, বাড়ি থেকে একঘন্টা আগে বেরোলেই পারো'-বসের মুখে এই কথা শুনলেই বসের ঘর থেকে বেরিয়ে নিষ্ফল আক্রোশে দাঁত কিড়মিড় করব। 'নেহাত আমি অধস্তন, তাই তুমি পার পেয়ে গেলে। এক্ষেত্রে তোমার বাকস্বাধীনতা আছে, আমার নেই। নইলে আমিই তোমায় জেলে ঢোকাতাম'-এরকম একটা ভাব। আসল কথাটা, যেটি নিয়ে এত সমস্যা সেই সময়ানুবর্তিতার প্রশ্নটি থেকে যায় অধরাই। ফেসবুকে রাজ্যসুদ্ধু সকলের নামে নিন্দেই হোক বা সঠিক কারণে কোনো ঘটনার প্রতিবাদ, এসবে কিঞ্চিৎ খোলা হাওয়া এসেছে বলে নিজের দোষগুণ ভুলে হই হই করে ঝাঁপিয়ে পড়ব আর আমার দোষগুণ সম্পর্কে কেউ টুঁ শব্দ করলেই দেশ-রাজ্য-সমাজ সমস্তরকম সচেতনতা ভুলে গালাগালির বন্যা বইয়ে দেব। কারণ আমারও তো বাকস্বাধীনতা আছে তাই না? সুতরাং জয় ৬৬এ। এবার আর ঠেকায় কে?                 
           

Monday 23 March 2015

বেখেয়ালে

কিছু কিছু সময় থাকে যখন বাইরে থেকে দেখলে শরীরের সমস্ত অঙ্গ প্রত্যঙ্গকে এক্কেবারে সঠিকভাবে কাজ করছে বলেই মনে হয়। হয়ত করেও। পরম কড়া সমালোচকও নড়াচড়ায়, কাজে কর্মে, কথাবার্তায় কোনরকম অসঙ্গতির হদিশ পাবেন না। কিন্তু আপনি মনে মনে জানেন যে, আপনি যেন সম্মোহিতের মতন সমস্ত বাইরের খোলসটুকু বজায় রাখছেন মাত্র। মস্তিস্ক আপনার এক্কেবারে ঘুমন্ত তখন। রোজ সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত যাবতীয় কর্তব্যকর্ম তালিকা অনুসারে হয়ে চলেছে। হচ্ছে আপনারই হাত দিয়ে। কিন্তু আপনি জানেন আপনি এসব কিছুই করছেন না। তাও কি করে যেন যান্ত্রিক পদ্ধতিতে সব হয়ে চলেছে। আর আপনি চোখ খোলা রেখে আদতে ঘুমিয়েই চলেছেন। যা হচ্ছে-যা হবে-যা হলে ভালো হত কিন্তু হলো না-বা যা না হলেই ভালো হত কিন্তু হয়ে গেল, কোনো কিছুতেই আর আপনার মস্তিস্ক কোনরকম ভাবে ভাবিত হচ্ছে না, কোনরকম প্রতিক্রিয়া দেখাচ্ছে না। পারিপার্শ্বিক সমস্ত শব্দ তখন অনেক দূর থেকে ভেসে আসছে বলে মনে হয়। মানুষের কথাবার্তার প্রতিটি শব্দ কানে বিকট তরঙ্গ তোলে। মাথার ভেতরে অবিরত একশ ঝিঁ ঝিঁ কনসার্ট বসায়। মনে হয় নিজের কোনো আলাদা অস্তিত্বই নেই বুঝি। আবহমানের পূর্বনির্ধারিত ঘটনাপ্রবাহে ভাসমান ঘাসফুলের মতন কেবল ভেসে বেড়ানোই বুঝি জীবন। অতীত-ভবিষ্যতের কোনো ঘটনার কণামাত্র যখন নিজের নিয়ন্ত্রণাধীন নয় বর্তমানের তো নয়ই, তখন মস্তিস্কের ভূমিকাটা ঠিক কি এটাই সবচেয়ে বড় প্রশ্ন হয়ে দাঁড়ায়। 

এই রকম অবস্থায় যদি কোনো মুহূর্তে করণীয় কোনো পার্থিব কাজ না থাকে তখন হয়ে যায় আরো মুশকিল। এতক্ষণ শারীরিক ভাবে অন্তত আপনি জীবিত ছিলেন। অতীত-ভবিষ্যত-কার্য-কারণ-ফলাফলের তোয়াক্কা না করে কেবল যা করার যেটি বিন্দুমাত্র ভুল না করে সঠিক ভাবে করে যাবার একটা স্রোত অন্তত সুপ্তমস্তিস্ক আপনাকে, পাঁচটা মানুষের কাছে জীবন্ত প্রমাণ করার দায়গ্রহণ করেছিল। এখন যদি সেই বাহ্যিক কাজকর্মের ঠেলাটাও না থাকে তখন? 

একটা সুবিধা অবশ্য আছে এই অবস্থার। সেটি হলো, যেহেতু আপনি সে অবস্থায় আসলে ভেতরে ভেতরে মৃত তাই আপনার কাজকর্মের ফলাফলের কোনো দুশ্চিন্তা আপনার মস্তিস্ককে ব্যস্ত রাখতে পারছে না। কারো ভালো মন্দ নিয়ে চর্চা করার পার্থিব উত্সাহ আপনার কাছে নিরর্থক তখন। ভবিষ্যতের কুহকমোহ আপনার মস্তিস্কের মতনই আপনার কাছে মৃত। বন্ধুবান্ধব-আত্মীয়স্বজন-কম চেনা-বেশি চেনা লোকজন, বাড়ি-কাজের জায়গা-দেশ-সমাজের নানান ঘটনাও তাই আপনার কাছে নিরর্থক। ফলে আপনার দৃষ্টি-শ্রবণ তখন পরিস্কার। আপনি সব কিছু দেখবেন, শুনবেন। কিন্তু তার জন্য মস্তিস্কের খাটনিটুকুর প্রয়োজন হবে না। আপাত তুচ্ছ ঘটনাও তখন আপনার চোখে ধরা পড়বে। যে মানুষটির সাথে আপনি কাজের সূত্রে দিনের পর দিন কথা বলে চলেছেন এতদিন, হয়ত আবিস্কার করবেন, আপনি এতদিন কথা বলেছেন ঠিকই কিন্তু আরো পাঁচটা চিন্তায় তাকে ভালো লক্ষ্য করেননি কোনোদিনই। তার ডানহাতের মধ্যমায় যে একটি গোমেদ আছে সেটি এতদিন আপনি জানতেনই না। বাড়ির টবে রাখা গাছটিতে প্রতিদিন জল ঢেলেছেন আপনিই, অথচ গাছটি যে ইতিমধ্যে লম্বায় এতটাই বেড়ে গেছে যে আপনার বারান্দার রেলিং পেরিয়ে সে এবার আকাশের দিকে টুকি করছে, সেটি এই আজই হঠাৎ আপনার চোখে পড়বে। সবই খুব তুচ্ছাতিতুচ্ছ জিনিস, এগুলো না দেখেও জীবন দিব্যি বয়ে চলে। ব্যক্তিগত-জীবিকাগত বা বৃহত্তর জীবনে কোথাও এই হঠাৎ আবিস্কৃত ঘটনার কোনো গুরুত্বই নেই, তাও ঘটনাগুলি যে এতদিন আপনার চোখের আড়ালে ছিল এবং তার একমাত্র কারণ এই যে, এতদিন আপনার মস্তিস্কের একশ একটা অহেতুক চিন্তা আপনাকে ভালো করে দেখতেই দেয় নি চারপাশটা। এই সত্যটা একমাত্র তখনই আপনার সামনে আসবে যখন আপনার মস্তিস্ক কাজ করা বন্ধ করবে। ঘটনার ফলাফল নিয়ে চিন্তা করতে গিয়ে হারিয়ে যায় ঘটনার ছোট্ট ছোট্ট ওঠা পড়ার অভিজ্ঞতা। যেমন আমাদের ক্ষেত্রে এক্সপেরিমেন্টের ফলাফল কি হবে ভাবতে গিয়ে কেমন করে নিঃশব্দে আমাদের শরীরে প্রতিনিয়ত নির্ভুলভাবে ঘটে চলেছে জীববিজ্ঞানের এই ঘটনার স্রোত, সেই মৌলিক বিস্ময়টুকুই আর মনে অবশিষ্ট থাকে না। আবার সেই বোধটুকুই ফিরে আসে যখন বারবারের অবিরত চেষ্টায়ও যখন কাঙ্খিত ফলাফলের ধারে কাছেও পৌঁছানো যায় না, তখন কেমন যেন নির্লিপ্ততা চলে আসে মনের মধ্যে। যেন, যা হয় হোক। আমার করার দরকার আমি করব। ফলাফলের বিন্দুমাত্রও যখন আমার হাতে নেই, তখন আর সেদিকে ফিরেও তাকাবো না। ঠিক তখনই কাজ করা বন্ধ করে দেয় মাথা। আর তখনই সরে যায় পর্দা চোখের সামনে থেকে। চলমান সিনেমার মতন সরে সরে যায় দৃশ্য নিজের মতন করেই। কিন্তু সেসবের ধনাত্মকতা বা ঋণাত্মকতা আর মনে মাথায় ছাপ ফেলতে পারে না কণামাত্রও। আর আপনার অবচেতন মন আরো বেশি করে পারিপার্শ্বিকতা সম্পর্কে সচেতন হয়ে ওঠে আপনার অগোচরেই।

এরকম অবস্থার সাথে আমার মনে হয় গ্রীষ্মকালের একটা অমোঘ যোগ আছে। মনে আছে ছোটবেলায় স্কুলের গ্রীষ্মের ছুটিতে নিঝুম দুপুরে ঠিক এরকমই একটা ঝিমধরা অবস্থা হত মনের। মনে হত চরাচর বুঝি চলছে নিজের নিয়মে। আমায় বৃত্তের বাইরে রেখেই। আমি বুঝি দর্শকমাত্র। কোনোকিছুর বিচার-বিশ্লেষণের দায় নেই আমার, কোনো ভালো মন্দের ভাবনা নেই আমার। কেবল পূর্বনির্ধারিত ঘটনাবলীর মস্তিস্কহীন দর্শকমাত্র হয়ে উপগ্রহের মত অবিরত ঘুরে চলেছি বৃত্তের ঠিক বাইরেই। আজীবন। কোনো ভয় নেই, কোনো বিষয়ের প্রতি নির্দিষ্ট ভালোবাসাও নেই। শুধু চুপ করে এককোণে বসে চারিদিকের বয়ে চলা স্রোতকে প্রত্যক্ষ করাই জন্যই আমার জন্ম। 

পশ্চিম ভারতের এই অঞ্চলেও গ্রীষ্ম শুরু হয়েছে কাল থেকে। কালই প্রথম কম্বল ফেলে ফ্যানের হাওয়ার দ্বারস্থ হতে হয়েছে ঘুমোতে গিয়ে।   
   

Friday 20 March 2015

স্লীপিং ব্যাগ ও স্লীপার ক্লাস

সার্কাস-১,  যখন লিখেছিলাম তখন যাবার সময় ট্রেনে স্লীপিং ব্যাগে ঘুমোনো হলনা বলে অনেক কাঁদুনি গেয়েছিলাম। আপনারা ভেবেছিলেন হয়ত, “কি আশ্চর্য! স্লীপিং ব্যাগ নিয়ে এত আদেখলাপনা কেন রে বাবা?” তখনই আপনাদের বলেছিলাম যে এই আদেখলাপনার যথেষ্ট কারণ আছে। আমরা দুজনেই এদিক ওদিক বেরিয়ে পড়তে ভালবাসি ঠিকই কিন্তু দুজনের কেউই বড়সড় অ্যাডভেঞ্চার করতে যাইনি কখনও যেখানে স্লীপিং ব্যাগ বিষয়টি অত্যন্ত প্রয়োজনীয় বস্তু বলে মনে হতে পারে। তবুও আমরা যে কেন হুড়মুড়িয়ে গুচ্ছের টাকা খরচ করে স্লীপিং ব্যাগ কিনেছিলাম তার একটা দুর্দান্ত ইতিহাস আছে। আজকে আপনাদের সেই মারাত্মক অভিজ্ঞতার কথাই বলব বলে ঠিক করেছি। 

ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহে আমরা তিনজন যোধপুর যাব বলে ঠিক করলাম। তিনজন মানে আমরা দুজন আর আমাদের এক বন্ধু কাম বোন। ঘটনাচক্রে সে আর আমি সমনামধারিণী। এক্ষেত্রেও যাওয়া-আসার
 টিকিট এবং হোটেল বুকিং কনফার্ম ছিল। সুতরাং আমাদের পূর্ববর্তী ভ্রমণের ইতিহাস অনুসারে কিছু একটা গন্ডগোল হবারই ছিল। কিন্তু ইতিহাসের কালজয়ী ঘটনাবলী কি সেই ঘটনার কুশীলবদের আগে থেকে জানান দিয়ে আসে? স্বাভাবিকভাবেই আমাদের ক্ষেত্রেও আসেনি। আমরা তিনমূর্তি পিঠে একটা করে ছোট ব্যাগ নিয়ে শুক্রবার সন্ধ্যায় বেরিয়ে রাতে পুরনো দিল্লী ষ্টেশন থেকে যোধপুরগামী ট্রেন এ চেপে বসলাম। যদিও সেটা ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহ ছিল আর দিল্লিতে পর্যাপ্ত ঠান্ডা পড়েছিল এইবছর। তাও আমরা ভেবেছিলাম কয়েকঘন্টার তো জার্নি, সকালে চোখ খুললেই যোধপুর। আর আমরা তিনজনেই কেউই খুব একটা আতুপুতু যাত্রী নই, সুতরাং পকেটের স্বাস্থ্যরক্ষার্থে এই কয়েকঘন্টার জার্নির জন্য স্লীপার ক্লাসই ঠিক আছে। 

প্রত্যেক জায়গারই নিজস্ব বিশেষত্ব আছে। সেই বিশেষত্বের সাথে যদি মানিয়ে নেওয়া না যায় তবে ওই জায়গায় বেঁচে থাকাটা যে কি ধরনের মুশকিল ঘটনা
 হতে পারে সেই শিক্ষায় শিক্ষিত হবার জন্য আমাদের সেদিনের সেই জার্নিটাই যথেষ্ট ছিল। ট্রেনে উঠে তিনজনে তিনটে পুঁচকে ব্যাগ নিয়ে বসে আছি। আর বাকি যাত্রীরা দেখছি বড় বড় ব্যাগ নিয়ে উঠছেন। কোথায় কোন ব্যাগ রাখবেন বুঝে উঠতে পারছেন না। যত বড় পরিবার তত বেশি সংখ্যক ব্যাগ। হুলুস্থুল ব্যাপার। ট্রেন চালু হতে স্বাভাবিক নিয়মেই মোটামুটি স্থিতিশীল অবস্থা ফিরে এলো। আর আমরা তিনজনে এই পুরো অরাজকতার সময়টা এ ওর মুখের দিকে তাকিয়ে চোখ মটকে তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে গেলাম। ভাবখানা এই যে, লোকে এত যে কি নিয়ে বেরোয়? অত্যন্ত প্রয়োজনীয় কিছু জিনিস নিয়ে নিলেই তো হলো। তাহলে আর এই জগঝম্প জার্নি করতে হয়না। এত ব্যাগ! আমাদের মতন মিনিম্যালিস্ট হতে আর পারল না এরা। এই সব উত্কৃষ্ট ভাবনাচিন্তা করে মনে মনে বেশ পুলকিতও হয়ে উঠলাম। আত্মতৃপ্তিতে ভরপুর হয়ে তারপর যথাবিহিত নিয়মে খাওয়াদাওয়াও সারা হলো। এবার শোবার পালা। আমার আর দুই নম্বর অর্পিতার (বার বার দুই নম্বর অর্পিতা বলার চেয়ে ওর একটা অন্য নাম দেওয়া যাক। ধরা যাক ওর নাম টুকাই। এরপর থেকে ওকে টুকাই বলে ডাকবো।) শোবার জায়গা দুটো পাশাপাশি আপার বার্থে। আর পিনাকীর সাইড আপার। আমরা যথেষ্ট গরম জামা পরে আছি তাই শোবার জন্য একটা করে গায়ে দেবার চাদর পিঠের ব্যাগে নিয়ে বেরিয়েছিলাম। আমার আর পিনাকীর দুটি শাল। আর টুকাই-এর জন্য মোটামুটি পুরু একটি চাদর। আমরা ওপরে উঠে শুয়ে পড়লাম। চাদর গায়ে দিয়ে। বাকি জনগণ দেখি প্রত্যেকেই একটি করে মোটাসোটা কম্বল বের করে ফেলেছেন তাঁদের বয়ে আনা ব্যাগের পাহাড় থেকে। এদিক ওদিক নজরদারি করে দেখলাম এর কোনো ব্যতিক্রম নেই আমরা ছাড়া। না একটু ভুল বললাম পুরো কামরায় আরো একটি ব্যতিক্রম ছিল আমরা ছাড়া। তাঁর কাছে একটি স্লিপিং ব্যাগ ছিল। তিনি তাতে ঢুকে আরাম করে শুয়ে পড়লেন। আমরা একটু থতমত খেয়ে গেলাম। কি রে বাবা! প্রত্যেকেই তো দেখি কম্বল বের করে। যত বড় পরিবারই হোক না কেন সকলের জন্য একটি করে কম্বল। এতক্ষণে বুঝলাম কেন ট্রেনে উঠে সকলেই দুচারটে করে ব্যাগ সিটের তলায় না ঢুকিয়ে সিটের ওপরে রাখছিলেন। আর তাই দেখে আমরা তাঁদের নাস্তানাবুদ অবস্থা হচ্ছে ভেবে নিজেরা চাপা স্বরে ঠাট্টা ইয়ার্কি করছিলাম। এখন দেখি সেই সিটের ওপরের প্রত্যেকটি ঢাউস ব্যাগ থেকে একটি করে ঢাউস কম্বল বেরিয়েছে। আর সকলেরই ব্যাগের সংখ্যা এক কি দুই এ দাঁড়িয়েছে। আমাদেরই মত। তখন মনে আশা ছিল আমাদের যে, কম্বল কেন লাগবে রে বাবা শুতে?এইতো এখনো ট্রেন ছুটছে, এখন কি আমাদের ঠান্ডা লাগছে নাকি? আমাদের গায়ে মোটা-পাতলা মিলিয়ে দুটি উলিকটনের গেঞ্জি, তার ওপরে জামা, তার ওপরে সোয়েটার-মোটা উলের মায়ের হাতে বোনা, তার ওপরে মোটা হাওয়া নিরোধক জ্যাকেট। এরপরে আর কোথা দিয়ে ঠান্ডা ঢুকবে? শুধু শুধু কম্বল বয়ে বেড়াবার কোনো মানেই হয় না। আমরাই ঠিক কাজ করেছি। এই ভেবে আবার একপ্রস্থ আত্মতৃপ্তির ঢেকুর তুলে শুয়ে পড়লাম। কিছুক্ষণ নিশ্চিন্তে ঘুমোলামও। 

তারপরে? 

তারপরে একটু একটু করে ঘুম কেটে যেতে লাগলো। কারণ আমার গায়ে মোটা-পাতলা মিলিয়ে দুটি উলিকটনের গেঞ্জি, তার ওপরে জামা, তার ওপরে সোয়েটার-মোটা উলের মায়ের হাতে বোনা, তার ওপরে মোটা হাওয়া নিরোধক জ্যাকেট। 

কিন্তু পায়ে?

পায়ের কথা আর কেই বা মনে রাখে শীতে? তুশ্চু প্রত্যঙ্গ। পায়ে আমার পাতলা ইনার এর ওপরে জিন্স। দুটোর কোনটিই হাওয়া নিরোধক নয়। আর এই মধ্যরাতে হুহু শব্দে ছুটে যাওয়া ট্রেনে শেষ ডিসেম্বরে পশ্চিমভারতের ঠান্ডা হাওয়া মোটা কম্বলের তলায় সুরক্ষিত স্লীপার ক্লাসের বাকি জনগনকে কামড় বসাতে না পেরে আমার এই নিরীহ অরক্ষিত পা জোড়াকেই খুঁজে পেয়ে মরণ কামড় বসিয়েছে। তারপর আমার সাথে সেই ঠান্ডা হওয়ার আক্ষরিক অর্থেই সারারাত্রিব্যাপী হাতাহাতি যুদ্ধ শুরু হলো। 

হাত পা গুলো ঠান্ডা হয়ে যেতে লাগলো। আমি ব্যাগ থেকে উলের টুপি আর উলের গ্লাভস বের করে পরলাম। 

তারপর আমার শরীর আরো ঠান্ডা হয়ে যেতে লাগলো। আমি ব্যাগ থেকে মাফলার বের করে টুপির ওপর দিয়ে মাথায় জড়ালাম। 

তারপর আমার শরীর আরো ঠান্ডা হয়ে যেতে লাগলো। তখন আমি ব্যাগ থেকে আরো একটা মোজা বের করে পায়ে থাকা মোজার ওপর দিয়ে পরলাম।

তারপর আমার শরীর আরো ঠান্ডা হয়ে যেতে লাগলো। তখন আমি ব্যাগ হাঁটকে আর কোনো কিছু পরার মতন পেলাম না। তখন আমি গায়ের শালটাকে গা থেকে খুলে দু ভাঁজ করে পায়ের ওপর দিলাম।

তারপর আমার শরীর আরো ঠান্ডা হয়ে যেতে লাগলো। তখন আমি কি করব ঠিক করতে না পেরে পিঠের ব্যাগ টাকেই দুই পায়ের ওপর চাপালাম। মোটেই কিছু সুবিধে হলো না। পা দুটো বাবু হয়ে বসার মতন করে মুড়ে শুলাম। 

তারপর আমার শরীর আরো ঠান্ডা হয়ে যেতে লাগলো। পিঠ দিয়ে ঠান্ডা উঠছে। শেষমেষ উঠে বসলাম। বেশ করে শালটাকে জড়িয়ে, নিজেকে যতটা সম্ভব ছোট্ট করে মুড়ে নিয়ে ব্যাগটাকে কোলে করে টুপির ওপর দিয়ে মাথা মুখ ভালো করে মাফলারে মুড়ে পুঁটলির মতন বসে দেখি- সামনের দুটো বার্থে আরো দুটো ছায়ামূর্তি উঠে গোল্লা পাকিয়ে বসে ঠকঠক করে কাঁপছে। আমাদেরই বাকি দুই মূর্তি। পা দুটো মনে হচ্ছে নেই আমার। প্রচন্ড ঠান্ডায় স্নায়ু কাজ করা বন্ধ করে দেয় পড়েছিলাম। প্র্যাকটিকাল পরীক্ষাটা সেদিন দিলাম। গা থেকে জ্যাকেটটা খুলে পায়ে জড়াবো কিনা ভাবলাম একবার। কিন্তু না। ঠান্ডার চোটে পা অবশ হয়ে গেলেও কাল আমায় লোকজন ট্রেন থেকে চ্যাংদোলা করে নামাতে পারবে। কিন্তু গা থেকে জ্যাকেট খুলে পায়ে দিলে, এ যা ঠান্ডা, তাতে গায়ের সোয়েটার ভেদ করে পাঁজরে গিয়ে ঘা মারলে যদি বুকের হৃৎপিন্ডটাই কোনো মতে জবাব দিয়ে দেয় ঠান্ডার চোটে, তাতে চলন্ত ট্রেনে এই মাঝরাতে আমায় নিয়ে বাকিদের বড়ই অসুবিধায় পড়তে হবে। যদিও জানিনা বাকি দুই জন তখনও বেঁচে আছে কিনা। নাকি ঠান্ডায় জমে গিয়ে জীবাশ্মে পরিনত হয়ে গেছে বাঙ্কে বসে বসেই। 

কিছুক্ষণ পরে দেখি পিনাকী নেমেছে নিচে। পায়চারী করতে শুরু করেছে ট্রেনের শরু প্যাসেজের মধ্যেই। যদিও ওকে তখন পিনাকী বলে চেনা যাচ্ছিল না।  আমি জানি তাই বললাম। চশমায় ঢাকা চোখদুটি ছাড়া বাকি সব পরতের পর পরতে ঢাকা। একই দশা। পায়ে কেবল পাতলা একটি পরতের ওপর জিন্স। টুকাইয়ের তাও নেই। শুধুই জিন্স। টুকাইকে ডাকতে দেখি সামনের বাঙ্কের পুঁটলিটা একটু নড়ে উঠলো আর ক্ষীণ একটা "উঁ" ভেসে এলো। বুঝলাম এখনো জীবাশ্ম হয়ে যায় নি। পিনাকী পায়চারী করেই চলেছে। একবার বললাম "লোকজন বিরক্ত হতে পারে এত বার যাতায়াত করছিস, ঘুমোচ্ছে সবাই।" উত্তর এলো, "হুম"। তারপর দেখি সোজা হয়ে গ্লাভস পরা হাত পকেটে ঢুকিয়ে হেলান দিয়ে দাঁড়ালো। দাঁড়িয়ে আছে তো আছেই। একই রে বাবা? বাকি রাত দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে যাবে নাকি? এখনো তিন চার ঘন্টা জার্নি বাকি? বললাম, দাঁড়িয়ে আর কি করবি? ওপরে উঠে বস। উত্তর এলো, "হুম "। আমি আর ঘাঁটালাম না ভদ্রলোককে। কারণ এই স্লীপারে যাবার বদবুদ্ধিটা প্রধানত আমার। আর তার ফলেই এই দশা। এখন বেশি ঘাঁটালে যদি চড়-থাপ্পড় মেরে বসে? দরকার নেই বাবা। অবশ্য তাতেও বিশেষ অসুবিধা হত না। বরং সুবিধাই হত। দুচারটে কিলচড় খেলে খানিক গা গরম তো অন্তত হত। 

আশে পাশে তাকিয়ে দেখি আমরা তিনজন গর্বিত মিনিম্যালিস্ট ছাড়া কম্বলধারী প্রত্যেক বোকারাই আরাম করে কম্বলের মধ্যে নাক ডাকাচ্ছেন। এঁনারা স্লীপারের নিয়মিত যাত্রী। তাই এই শীতে যে কম্বল ছাড়া চলবে না তা এঁনারা জানেন। শুধু আমাদেরই স্লীপার ক্লাসে নিয়মিত যাতায়াত করা হয়না বলে এই যাত্রার আবশ্যকীয় উপাদানগুলি সম্পর্কে আমরা মোটেই ওয়াকিবহাল ছিলাম না। উল্টে যাঁরা এই যাত্রার নিয়মগুলি মেনে চলছিলেন তাঁদের নিয়ে হ্যাহ্যা করছিলাম। ভগবান তখন আমাদের দিকে তাকিয়ে নিঃশব্দে হ্যা হ্যা করছিলেন আমরা শুনতে পাইনি। তারপর যত রাত বাড়তে লাগলো নিউটনের তৃতীয় সূত্র অনুসারে ভগবানের হাসি তত আমাদের দিকে ধেয়ে আসতে লাগলো। আমার তো সত্যি বলছি এরকমও মনে হলো একবার যে, এই যে প্রত্যেকে একটা করে গোটা কম্বল মুড়ে আরাম করে ঘুমোচ্ছে। আর আমরা তিন তিনজন নিরীহ প্রাণী ঠান্ডায় প্রায় পঁচাত্তর ভাগ মরে গেছি। আর আমি নিশ্চিত বাকি পঁচিশ ভাগও কাল যোধপুর স্টেশনে পৌঁছবার আগেই মরে যাব। এ হেন দুর্ভাগাদের কি অন্তত একটা কম্বলও কেউ ধার দিতে পারে না? তাতেই তিনজনে পা ঢুকিয়ে বসে বাকি রাতে বাকি পঁচিশ ভাগটাকে বাঁচাবার একটা চেষ্টা অন্তত করতে পারব। শীতে দুঃস্থদের উষ্ণতা দেওয়া তো কত পূণ্যের কাজ। কিন্তু সে রাতে কোনো পূন্যাত্মাই পূণ্য সঞ্চয়ের লোভে জেগে বসে ছিলেন না। সুতরাং আমরা বাকি রাত জেগে বসে করুণ চোখে চারপাশের রং-বেরঙের নরম কম্বলের শোভা দেখতে দেখতে কাঁপতে লাগলাম। আর পিনাকী দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কাঁপতে লাগলো। 

সব মহাপ্রলয়েরই তো শেষ আছে। সেরকমই সেই রাত কেটেও ভোর হলো। ট্রেন যোধপুর স্টেশনে এসে পৌঁছালো। আসার আগে এই যোধপুর স্টেশন নিয়ে কত নস্টালজিয়া আমাদের। সোনার কেল্লায় ফেলুদারা এখানেই এসে নেমেছিল ইত্যাদি ইত্যাদি। স্টেশনটা, চারপাশটা, শহরটা এখন কেমন দেখতে সেই নিয়ে কত জল্পনা আমাদের। কিন্তু বিশ্বাস করুন আমায় যদি এখন জিজ্ঞাসা করা হয় যোধপুরে নেমে তুমি কি দেখলে? কেমন স্টেশন? আমি কি বলব জানেন? বলব, "যে প্লাটফর্মে নেমেছিলাম সেখানে কোনো রোদ ছিল না। ওভারব্রিজে উঠে প্রথম পায়ে রোদ লেগেছিল। আর স্টেশনের বাইরে বেরিয়ে পুরো গায়ে রোদ লেগেছিল। আর সেই রোদ  মেখে আমরা স্টেশনের কাছেই হোটেল পর্যন্ত হেঁটে পৌঁছেছিলাম। আমাদের আনতে হোটেল থেকে কেউ গিয়েছিলেন। আমাদের মস্তিস্ক বোধহয় তখনও পুরোপুরি কাজ করতে শুরু করে নি তাই আমরা তিনজনেই তাঁকে নামের প্যাকার্ড থাকা সত্বেও সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে ওভার ব্রিজে উঠে গেছিলাম। বোধহয় ট্রেন থেকে নেমে তিনজনেরই চোখ ছিল ওভারব্রীজের ওই রোদের ফালিটুকুর দিকে তাই আর ওই নশ্বর প্যাকার্ডধারীর দিকে আর কারো নজর পড়ে নি। 

এই হলো আমাদের যোধপুর যাবার ইতিকথা। হোটেলে পৌঁছালাম আমরা শনিবার সকালে। রবিবার রাতে আমাদের ফেরার ট্রেন। এর মধ্যেই আমাদের যোধপুরের যাবতীয় দ্রষ্টব্য শেষ করে একফাঁকে ওঁশিয়া ঢুঁ মেরে আসতে হবে। হোটেলের ছাদে চড়চড়ে রোদে বেশ করে হাত পা সেঁকে একটু সুস্থ হতেই মাথা কাজ করতে শুরু করলো। আর আমরা বেড়ানো-চড়ানো শিকেয় তুলে দৌড়ালাম পরদিনের তত্কালের টিকিট বুকিং করতে। আমাদের ফেরবার টিকিট কিন্তু কনফার্ম ছিল। কিন্তু সেও তো সেই স্লীপার ক্লাসে থুড়ি ফ্রীজার ক্লাসে। হোটেলের ঠিক উল্টো দিকেই রেলওয়ে বুকিং কাউন্টার। পিনাকী সেখানে, আর আমরা হোটেল মালিককে তাঁর চেয়ার থেকে উত্খাত করে তাঁর কম্পিউটারে। কিন্তু শেষ রক্ষা হলো না। আমরা তত্কালে এসির টিকিট পেলাম না। মানে পেলাম কিন্তু সেটা শেষ পর্যন্ত কনফার্ম হলো না। ফলে ফেরার সময় আবার সেই ফ্রীজার ক্লাস।

এবারে মানসিক ভাবে অনেকটা প্রস্তুত ছিলাম বিপর্যয়ের জন্য। তারপর সদ্য বেড়ানোর তাজা মনোভাব আর উত্তেজনাও ছিল। ফলে যুদ্ধের জন্য সবচেয়ে বেশি যা দরকার অর্থাৎ মনোবল, সেটি যাবার সময়ের তুলনায় খানিক বেশিই ছিল আমাদের। ফেরার সময় ট্রেন অনেক ফাঁকা। তবুও যাঁরা আছেন প্রত্যেকেই কম্বল নিয়ে উঠেছেন। দেখে শুনে এবারে আমাদের স্বভাবতই আর হাসি এলো না। ব্যাকুল হয়ে তাকিয়ে রইলাম শুধু। খাওয়া দাওয়া সেরে নিলাম। আমাদের পাশেই একটি কমবয়সী ছেলে উঠলো সাথে একটি মাত্র মাঝারি মাপের ব্যাগ। নিজেদের একার দূর্দশায় যতটা কষ্ট হয়, সাথে আরো কেউ দূর্দশায় পড়লে কষ্টটা ভাগ করে নেবার আরো কেউ থাকে বলে মানুষ কষ্ট খানিক কম পায়। মনে আশা জাগলো। এ বেচারাও আমাদেরই মতন অভাগা। একটাই ব্যাগ নিয়ে উঠেছে। এই ব্যাগে যদি কম্বল নেয় তবে আর অন্য জিনিস কোথায় নেবে? তার মানে নিশ্চয়ই কম্বল নেই এর সাথে। কিন্তু সেযাত্রা আরো ঐশ্বরিক ঠাট্টা বরাদ্দ ছিল আমাদের কপালে। সবে মাত্র ফিসফিস করে টুকাইয়ের কানে কানে কথাটা বলেছি। সাথে সাথে, বিশ্বাস করুন সাথে সাথেই, আমার কথা শুনতে পেয়েছিল কিনা কে জানে, দেখি ছেলেটি তার ওই সবেধন নীলমনি ব্যাগখানি থেকে টেনে টুনে একটা মোটা কম্বল বের করে ব্যাগটাকে ভাঁজ করে মাথার বালিশ করে শুয়ে পড়ল। শোবার সময় আমাদের দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসেছিল কিনা সেটা খেয়াল করিনি। ব্যাগটায় কম্বল বাদ দিয়ে আর কিচ্ছু ছিল না। এই ঘটনায় আমি অন্তত একটা জিনিস শিখলাম, যে, শীতকালে স্লীপারে যেতে হলে যদি একটিই ব্যাগ নিতে হয় তবে কম্বলের ব্যাগটিই নাও অন্য সব মহার্ঘ্য বস্তু ছেড়ে। 

তারপর আমরা চেষ্টা করলাম যদি বাড়তি টাকা দিয়ে এসি থেকে তিনটে কম্বল যোগাড় করা যায়। কারণ আমার মাথায় ছিল যে দিল্লি-হাওড়া দুরন্ত এক্সপ্রেসে স্লীপার ক্লাসে টিকিট কাটার সময়ই বেডরোলের অপশন দেওয়া হয়। কিছু টাকা বেশি লাগে টিকিটের সাথে। এই সুবিধা আমরাও নিয়েছি একবার। সুতরাং এখানেও কি বাড়তি টাকা দিলে তিনটে কম্বল পাওয়া যাবে না? এই বিশ্বাসে অন্তত পাঁচ ছয় বার স্লীপার থেকে এসিতে যাতায়াত করে, দুই টিকিট পরীক্ষক এবং এসির কোচ এটেন্ডেন্টের সাথে কথা বলে বুঝলাম যে, এই ট্রেনে আইনগত ভাবে সেই সুবিধা পাবার কোনো উপায় নেই। কিন্তু এসির কোচ এটেন্ডেন্ট আর একজন টিকিট পরীক্ষকের বদান্যতায় বেআইনি পথে অন্য টিকিট পরীক্ষকের চোখ বাঁচিয়ে আমরা তিনটি কম্বল ব্যবহার করতে পারি আজকে রাতের জন্য।প্রতিটি কম্বল পাঁচশ টাকা। যা সম্ভবত ভাগাভাগি হবে এসির কোচ এটেন্ডেন্ট এবং ওই টিকিট পরীক্ষকের মধ্যে। ভারতীয় রেলের লাভ লবডঙ্কা। ওই মহাপুরুষ টিকিট পরীক্ষকের নাম তার বুকের নেমপ্লেটে লেখা ছিল। ভুলে গেছি এখন। মনে রাখা উচিত ছিল। কারণ তাঁর প্যাঁচালো কথাতেই আর একটু হলে এই বেআইনি কাজটি আমরা করে ফেলতে যাচ্ছিলাম। ব্যাপারটা যে বেআইনি তা অন্য টিকিট পরীক্ষকের সাথে কথা না বলা পর্যন্ত তো আমরা বুঝতেই পারিনি। তারপরে ব্যাপারটা বুঝে ফিরে যখন আসলাম ততক্ষণে এসির প্রায় সমস্ত যাত্রী জেনে গেছেন যে আমরা স্লিপারের যাত্রী। আর তিনটি কম্বলের জন্য ট্রেনের এপ্রান্ত থেকে ওপ্রান্ত পর্যন্ত হন্যে হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছি। 

তারপর আর কি? ব্যাগের সমস্ত জামাকাপড় পরে, এমনকি জিন্সের ওপর দিয়ে রাতে পরে শোবার জন্য যে পায়জামাটা নিয়ে গেছিলাম সেটা পর্যন্ত পরে বাঙ্কে উঠে শুলাম। আর একটু পর থেকেই আগের রাতের অভিজ্ঞতার পুনরাবৃত্তি শুরু হলো। শুয়ে-দাঁড়িয়ে-বসে-কুন্ডলী পাকিয়ে কোনোক্রমে রাত কাটিয়ে যখন গুরগাঁও স্টেশনে এসে নামালাম তখন অন্ধকার। তারপর দুটো অটো বদলে এসে নামলাম আমাদের আস্তানা থেকে তিন কিলোমিটার দূরে। এখান থেকে আমাদের ইনস্টিটিউটের গাড়ি এসে আমাদের নিয়ে যাবে। প্রচন্ড কুয়াশার মধ্যে হেডলাইট জ্বেলে গাড়ি ছুটছে। আমরা দাঁড়িয়ে আছি জাতীয় সড়কের ধারে আমাদের গাড়ির অপেক্ষায়। তখনিই আবার এমন একটা ঘটনা ঘটল যেটা নিয়ে আধখানা ব্লগপোস্ট আমি অলরেডি লিখে ফেলেছি। সেদিন ছিল এই মরশুমের শীতলতম দিন। দিল্লির তাপমাত্রা সেদিন ছিল ২.৬ ডিগ্রী। রাজস্থানের বুকে চলন্ত ট্রেনে সে তাপমাত্রা কত ছিল আমি জানি না। তবে সেযাত্রা দুটো পা নিয়ে আস্ত ফিরে এসে সেই দিনেই আমি দুটো স্লিপিং ব্যাগ অর্ডার করেছিলাম পরবর্তী এরকম কোনো স্লীপার ক্লাসে যাত্রার কথা মাথায় রেখে। 

এখনো কি বলবেন যে জানুয়ারির শিমলা-ফাগু-কুফরী যাবার সময় (সার্কাস-১ এবং সার্কাস-২ তে লেখা) কালকা মেলের স্লীপার ক্লাসে স্লিপিং ব্যাগে ঘুমোতে না পারার দুঃখটা সত্যিকারের দুঃখ নয়? আদেখলাপনা? যদিও সে দুঃখ আমার কালকা থেকে দিল্লি ফেরার সময় স্লিপিং ব্যাগে ঢুকে মুছে গেছিল। 



          

Tuesday 17 March 2015

ভাগ্যিস!

মাত্র ছয় বছরেই যে জেনে ফেলেছে
কেমন হয় নারীখাদকের নখ,
ভাগ্যিস সে আমার কন্যাসমা,
কন্যা নয়।

জীবন উপান্তে দাঁড়িয়ে
শান্তির ছায়া বিতরণ করতে এসে
ছিন্নভিন্ন হলো যাঁর নারীজীবন
ভাগ্যিস তিনি আমার নিজের পিতামহী নন।

ভাগ্যিস আমার স্বামীর নাম
অভিজিৎ নয় বলে
তাঁর রক্তে স্নান করে
ক্রোধে বন্যা হয়ে যেতে হয়নি আমায় এখনো।

ভাগ্যিস আমার মা কে
ধর্ষিতা মৃতা কন্যার শব কোলে চেপে
একযমুনা কান্না নিয়ে
নিথর চোখে বিচারসভায়
দাঁড়াতে হয়নি এখনো।

তাই তো কালও আমি
নরম কম্বলের ওম নিয়ে
নিশ্চিন্তে পাশ ফিরেছিলাম।
ভাগ্যিস।  

Sunday 15 March 2015

প্রবাস, অনাবাস ও ভারতবর্ষ

কিছুদিন আগে পুরোনো রেকর্ডেড একটি ইন্টারভিউ দেখছিলাম। প্রশ্নকর্তার প্রশ্ন ছিল প্রাদেশিকতাকে ছাপিয়ে কোনো একজন ভারতে জন্মগ্রহণকারী মানুষ হিসেবে আমরা নিজেদের কতটা পূর্ণাঙ্গ ভারতীয় হিসেবে মনে করি? একজন সমাজসচেতন লেখিকা হিসেবে তাঁর মতামত কি? এই প্রশ্নের উত্তরে সাক্ষাৎকারদাত্রী শোভা দে একটি কথা বলছিলেন যেটা আমার বর্তমান সময়ে বড়ই প্রাসঙ্গিক মনে হয়েছে। বিষয়টি হলো, তাঁর মতে, ব্রিটিশ যুগের আগে ভারতবর্ষে অর্থাৎ মানচিত্র অনুসারে যে ভূখন্ডকে আমরা ভারতবর্ষ বলে চিহ্নিত করি সেটির কোনো সামগ্রিক অস্তিত্বই ছিল না। ব্রিটিশ বানিজ্য তরী এসে ঠেকেছিল এমন ভারতের উপকূলে যার উত্তর দিকে বেশ কিছুটা অংশ বাদ দিলে বাকি পুরোটাই ছোটো ছোটো খন্ডিত মেজো সেজো রাজপরিবারের দখলে। তাদের মধ্যেও আবার পারস্পরিক বিবাদ, পারিবারিক ক্ষমতাদখলের যুদ্ধ ইত্যাদি ইত্যাদি। আর উত্তরপশ্চিম দিক থেকে মাঝে মাঝেই অস্তগামী মোঘলদের লুটপাট, অরাজকতা আর সেনাবিদ্রোহের ঘটনা। সুতরাং সে সময় সম্পূর্ণ ভারতবর্ষ বলতে ব্যাপারটা ঠিক কি সেটি একজন খেটে খাওয়া সাধারণ মানুষের ধারণাতেই ছিল না। সবচেয়ে বড় কথা আস্ত ত্রিভূজাকৃতি ভারতবর্ষটাই ছিল না সেসময়। সুতরাং প্রাদেশিকটাই তখন জাতীয়তা। তারপর আত্মকলহরত এতবড় সোনার খনি ভূখন্ডটিকে নেতৃত্ব এবং সুরক্ষা দেবার মতন কোনো সুযোগ্য লোকের অভাবে কি করে ব্রিটিশ বণিককুল নিজের খাস উপনিবেশ বানিয়ে ফেলল সে তো সবাই জানে। ইংরেজরা এদেশের জন্য ভালো মন্দ মিশিয়ে অনেক কাজ করেছে। তার মধ্যে একটি হলো ভারতবাসীর মধ্যে পরিপূর্ণ ভারতের একটি ধারণা ঢুকিয়ে দিয়ে যাওয়া। তার আগে অযোধ্যা রাজ্য ছিল, বারানসীর রাজা ছিলেন, হায়দ্রাবাদের নিজাম ছিলেন, মহিশূর রাজ্য ছিল। কিন্তু জয়পুরের রাজপরিবারকে খাজনা প্রদানকারী কোনো কৃষক নিজেকে বাংলার কোনো কৃষকের সাথে তুলনায় আনতে পারতেন কি? তাঁর কাছে জয়পুরের রাজ্য সীমানাই তাঁর দেশ। কিন্তু ব্রিটিশ এই দেশ ছেড়ে যাবার পর দেখা গেল প্রায় প্রতিটি ভারতবাসীর মনে নিজের দেশ সম্পর্কে ধারনাটা আমূল বদলে গেছে। এত বছরের ঔপনিবেশিক শাসনে দেশী-বিদেশী সংবাদপত্র, রেডিওস্টেশন এবং সর্বোপরি দীর্ঘ স্বাধীনতা আন্দোলন ভারতবাসীকে শিখিয়ে দিয়ে গেছে- এই যে দেখছ সবুজ কাশ্মীর উপত্যকা এ তোমার, ওই যে দূরে গুজরাটের নোনাভূমি ওটাও তোমারই, ওই যে দেখছ দক্ষিণের অবোধ্য ভাষাভাষী লোকটি, ও আর তুমি কিন্তু একই দেশের অন্নগ্রহণকারী। সুতরাং ভারতবাসী নিজেকে পূর্ণাঙ্গ ভারতবাসী বলে চিনতে শিখলো মাত্র এই সেদিন। অথচ একজন কাশ্মীরি-গুজরাটি-তামিল বা বঙ্গভাষী মানুষের মধ্যে 'আমরা ভারতবাসী' এই বোধটি ছাড়া কতটা পার্থক্য বেড়ে ওঠার মধ্যে। ভাষা-আবহাওয়া-খাদ্যাভ্যাস কোনকিছুই কারো সাথে মেলে না। ভারতবর্ষের বাইরে থাকা একটি ভারতবাসীর বরং নিজেকে পরিপূর্ণ ভারতীয় বলে ভাবাটা খুব সহজ। বিদেশের কোনো একটি দেশে ভাষা-আবহাওয়া-খাদ্যাভ্যাস ইত্যাদির সাথে তার এতটাই তফাৎ হয়ে পড়ে যে সে ভাবতে বাধ্য হয় সে প্রথমে ভারতীয়, তার পরে সে তার প্রদেশের। ফলে ভারতে বসবাসকারী ভারতীয়দের চেয়ে ভারতের বাইরে থাকা ভারতীয়দের জাতীয়তাবোধ হয়ত তাদের প্রাদেশিকতার চেয়ে বেশিই হয়। 

ব্যাপারটা আমার মতে খানিকটা এরকম, ধরা যাক আপনার বাড়িতে পারিবারিক কলহ চলছে। ঝগড়াঝাঁটির সময় মাথা ঠিক নেই, দুপক্ষের পারস্পরিক দোষারোপে গলাবাজি তুঙ্গে। ব্যাপারটা এমন পর্যায়ে দাঁড়িয়েছে যে, কি নিয়ে ঝগড়া সেইটিই গেছেন ভুলে। কেবল গালাগালির উত্তরে গালাগালি উদগীরণ চলছে। এমতাবস্থায় যদি আপনারই বাড়ির অন্য একজন সদস্য বাড়ির বাইরে থেকে হঠাৎ এসে পড়েন, তিনি হয়ত এই অস্থির, অপ্রীতিকর পরিস্থিতিতে প্রথমে ঘাবড়ে গেলেও যেহেতু তিনি নিজে সরাসরি সেই গলাবাজিতে যুক্ত নন তাই প্রথম প্রশ্নটা তিনি এটাই করবেন যে, "ঝগড়াটা হচ্ছে কি নিয়ে?" যেটি সেই মুহূর্তে হয়ত সবচেয়ে সঠিক প্রশ্ন। পারস্পরিক কাদা ছোঁড়াছুঁড়ির মধ্যে দুজনেই আসল সমস্যাটা থেকে এত দূরে চলে গেছেন যে সমস্যাটির সমাধানের রাস্তা তো দূরস্থান, নিজেদের পারস্পরিক ঐক্য যা বাড়ির সুস্থ পরিবেশ বজায় রাখার জন্য সবচেয়ে প্রয়োজনীয় বিষয়, সেইটিই ডুবে যেতে বসেছে। এখন, যিনি বাইরে থেকে এলেন তিনি যদি বিচক্ষণ হন তবে তাঁর পক্ষে তৃতীয় পক্ষ হিসাবে সমস্যাটিকে বাইরে থেকে দেখে, সমস্যাটির সাথে সংশ্লিষ্ট সমস্ত মানুষের বা বিষয়ের ভালো মন্দ বিচার করে রায় দেওয়াটা অনেক বেশি নিরপেক্ষ বা সময়োপযোগী হবে বলে মনে হয়। আর এই মানুষটি যদি বাড়িরই সদস্য হন তবে তো বাড়ির অভ্যন্তরীণ বিষয়গুলি সম্পর্কে আরো বেশি ওয়াকিবহাল হবেন। ফলে আরো সঠিকভাবে সমস্যার সমাধান করাটা সহজ হবে। তবে পুরো বিষয়টিতে একটি সমস্যা রয়েই যায়। সেটি হলো, বাইরে থেকে আসা ঘরের লোকটিকে নিজের বলে মনে করার মানসিক বাধা। ঘটনা অনেকসময়ই এরকম হয় যে, কলহরত পক্ষ থেকে অন্য পক্ষকে শুনতে হয় যে, "তুমি বাইরে থেকে এসে আমাদের সমস্যার সমাধান কি করে করবে? তুমি তো এখানে ছিলেই না, আমাদের সমস্যাটা তো তুমি জানোই না। অতএব চুপ থাকো।" কিন্তু সত্যিটা হলো এই যে বহিরাগত ঘরের লোকটি যেহেতু ঘরটিও চেনে ভালো করে, আবার বাইরের পরিবেশটিও দেখেছে। এবং বর্তমানের সমস্যাটিকে ঠিক একটু দূর থেকে দেখার সুযোগ পাচ্ছে সেই হয়ত সহজে সমাধানের রাস্তাটি দেখতে পারবে। তাকে বহিরাগতর তকমা দিয়ে বাইরে ঠেলে দিলে ঘরের পরিবেশ তো স্বচ্ছ হবেই না উপরন্তু আরো ঘোলাটে হবার যথেষ্ট সম্ভাবনা আছে।         

এই উদাহরণের মতই বলা যায় যে, দূর থেকে নিজের দেশকে দেখলে বোধহয় ভালো মন্দ সবটাই চোখে পড়ে সহজে। একজন ভারতবাসী ভারতবর্ষে থেকে তার ভালো মন্দ সব কিছুর সাথে জাপটে জীবনযাপন করতে করতে সমস্ত কিছুতেই এত অভ্যস্ত হয়ে পড়েন যে, যেসব সমস্যা একটু সচেতন হলেই সমাধান করা সম্ভব সেগুলিকে সমস্যা বলে মনেই করেন না। যেমন ধরুন 'স্বচ্ছ ভারত অভিযান'। হঠাৎ করে কোনো একজন বলল বলে আমাদের মনে পড়ল সত্যিতো আমরা বড়ই অপরিচ্ছন্নতার মধ্যে বাস করছি। সুতরাং রোববার দিন লুচি-বেগুনভাজা দিয়ে প্রাতরাশ সেরে বহুমূল্য জিন্স আর জুতো পরে হাতে গ্লাভস আর মুখে মাস্ক পরে ঢেকুর তুলতে তুলতে ঝাঁটা হাতে পাশের রাস্তাটা যেটা নাকি আমারই বারান্দা থেকে ছুঁড়ে ফেলা আবর্জনায় নোংরা হয়ে ছিল এতদিন, সেটাতে ঝাড়ু মারতে শুরু করলামআর পুরো সময়টা মোবাইলের ক্যামেরা তাক করে একজন বসে রইলো। রবিবার সন্ধ্যের মধ্যে ঝাঁটা হস্তে-গ্লাভস-মাস্ক পরিহিত আমার সমাজ সচেতন মুখটি ফেসবুকের কল্যানে দিক-বিদিকে ছড়িয়ে পড়ল। ফেসবুক থেকে 'স্বচ্ছ ভারত অভিযান' এর ঢেউ কমে গিয়ে অন্য কিছুর ঢেউ শুরু হলেই আমার ঝাঁটা-অভিযানের ইতি। আর সেই আমিই যখন বিদেশে গিয়ে সেখানকার লোকজনকে দেখলাম নিজের রাস্তাটুকু পরিচ্ছন্ন রাখতে ডাস্টবিন না থাকলে লজেন্সের মোড়কটা পর্যন্ত সকলে ব্যাগে করে বয়ে বেড়াচ্ছে এবং তাতে কোনো অতিরিক্ত বাহাদুরি বা দেখনদারি নেই, তখন গিয়ে আমার মগজে ঢুকলো যে পরিচ্ছন্নতাটা শ্বাস নেবার মতন একটা খুবই মৌলিক বিষয়। আর নার্সারী স্কুলের দিদিমনির মতন কাউকে এসে নিয়ম চালু করা পর্যন্ত অপেক্ষা করা নয়, বা ফেসবুকে পরিচিত-অর্ধপরিচিত সকলের কাছে বাহবা পাওয়া নয় এই মৌলিক বিষয়টিই মগজস্থ-হৃদয়স্থ করাটিই হলো সবচেয়ে কার্যকরী ব্যাপার ভারতবর্ষকে পরিচ্ছন্ন করার ক্ষেত্রে। ভারতবর্ষের বাইরে গিয়ে তো এই বিষয়টি আমার মগজে ঢুকলো কিন্তু আমার একার দ্বারা কি করে এই ব্যবস্থা কার্যকরী করা সম্ভব? মা ষষ্ঠীর দয়ায় আর আমাদের উদাসীনতার কল্যানে জন্মানো কোটি কোটি ভারতবাসীকে কি করে বোঝানো সম্ভব তোমার নিজের কারণেই রাস্তায় গুটখার পিকটা তোমার ফেলা উচিত নয়? দিনের শেষে পেটভরে খেতে পাওয়াটাই যেখানে শেষ কথা সেই মানুষটিকে কি ধরে বসে মহাভারত বোঝানো যায়? নাকি বোঝানো উচিত? সুতরাং আমি হাত পা গুটিয়ে বসে রইলাম। অথচ আমি এটুকু করতে পারতাম যে আমার মা-বাবা-ভাই-বোন বা আমার ছেলেমেয়েকে 'স্বচ্ছ ভারত অভিযান' না বোঝালেও তাঁদের মনে পরিচ্ছন্নতার মৌলিক প্রয়োজনীয়তাটুকু গেঁথে দিতে পারতাম। আমার বিশ্বাস তাঁদের কাছে যেহেতু আমার কথার মূল্য আছে সেহেতু তাঁরা প্রথমে আমার কথা রাখতে পরে ধীরে ধীরে ক্রমশঃ শ্বাস নেবার মত মৌলিক কারণেই লজেন্সের মোড়কটা ব্যাগে করে বাড়ি নিয়ে আসবেন ডাস্টবিনে ফেলবেন বলে। এভাবেই হয়ত পরিচ্ছন্নতার অভ্যাস তৈরী হবে আর কে বলতে পারে একদিন এই ভাবেই ধীরে ধীরে বাকি আর সকলকে দেখে কোনো মতে নিজের খাবার জোগাড় করা মানুষটি দিনশেষে খাবারের খালি ঠোঙ্গাটা নিজের পাশেই ফেলে না রেখে উঠে গিয়ে দূরের ডাস্টবিনটায় ফেলে এসে নিজের ফুটপাথের বিছানায় শুতে যাবেন। 

নিজের বাড়ি পরিষ্কার করার জন্য নার্সারীর বাচ্চাদের মতন 'এই তুমি ক্লাস নোংরা করলে কেন? কান ধরে দাঁড়াও" বলে ফাইন বা শাস্তির ভয় দেখাতে হবে এর মতন লজ্জার আর কি আছে? তাহলে তো বলতে হয় আমরা বড়ই হইনি, এখনো নার্সারীরই বাচ্চা। তার চেয়ে বিদেশের উদাহরণ দেখে যদি বোঝা যায় কোনখানটিতে মাত্র একটু নজর দিলেই পরিস্থিতির বেশ খানিকটা পরিবর্তন সম্ভব, তবে ক্ষতি কি? দিন কয়েক আগে জন্মসূত্রে জার্মান একজন বিশিষ্ট বৈজ্ঞানিকের সামনে বসে তাঁর কাজের কথা শোনার সৌভাগ্য হয়েছিল।কোনো বিশেষ আশা নিয়ে হয়ত আমি শুনতে যাইনি সেই লেকচার। কিন্তু গিয়ে একটা মূল্যবান অভিজ্ঞতা হলো। নিজের কাজের কথা শুরু করার আগে তিনি যে জায়গায় কাজ করেন সেই জায়গা, সেই দেশ সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত কিন্তু অত্যন্ত মনোগ্রাহী একটি সর্বাঙ্গীন ধারণা আমাদের দিলেন। সেদেশের অর্থনীতি, শিল্প, সেই শিল্পের ব্যাপকতার ফলে সেদেশের জনগনের স্বাস্থ্যগত সমস্যা, সে সমস্যার সমাধানে সে দেশের সরকারের পদক্ষেপ, সেই পদক্ষেপের ফলে প্রতিষ্ঠিত গবেষনাগার, সেই স্বাস্থ্যগত সমস্যা নির্মূল করতে সেই গবেষণাগারের গবেষনার মূল লক্ষ্য সবই এলো একে একে। আরো একটি ব্যাপার তিনি বললেন, তাঁদের দেশের নতুন প্রজন্মকে আবশ্যিক ভাবে অন্তত দুই বছর ফেলোশিপ দিয়ে বিদেশের কোনো এক বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠানো হয় পড়াশুনার জন্য। তা শুধুমাত্র ডিগ্রীর জন্য নয়। তার সাথে নিজের দেশকে আরো ভালো করে জানার জন্য। তিনি বললেন একথা, স্পষ্টাক্ষরে, নিজমুখে। অবাক হচ্ছেন? আমাদেরও ভ্রূ কুঁচকে গিয়েছিল প্রথমে। কিন্তু সে দেশের শিক্ষাব্যবস্থার একজন হর্তাকর্তা হিসেবে তাঁর ব্যাখ্যাটি আমার যথেষ্ট মনে ধরেছে। তাঁর ব্যাখ্যাটি হলো, মানুষ দেশের বাইরে গিয়েই ঠিক করে নিজের দেশকে চিনতে শেখে। কারণ ভারতবর্ষে আমায় কেউ জিজ্ঞাসা করবে না যে তোমার দেশটি কেমন? ফলে একজন অত্যন্ত সাধারণ ভারতবাসী হিসেবে আমি নিজের দেশের খুঁটিনাটি জানার তাগিদও অনুভব করব না। কিন্তু সেই আমিই যদি বিদেশে কোনো একজনের প্রশ্নের সম্মুখীন হই যে, ভারতবর্ষ দেশটি কেমন? সেদেশের মানুষরা কি একই রকম করে ভাবে? নাকি এত বড় দেশের এত প্রদেশভেদে বদলে যায় তাদের ভাবনা? কোন জায়গার কি বৈশিষ্ট্য? কি ইতিহাস? কি অর্থনৈতিক মূলনীতি? তাহলে? সেই পরিস্থিতিতে আমার দেশকে প্রতিনিধিত্ব করার মতন সেই মুহুর্তে যখন আর কেউ নেই, সে মুহুর্তে তখন আমায় ভাবতে হবে বৈকি? পড়াশুনা করতে হবে বৈকি? অথচ এদেশে থাকাকালীন সেই প্রয়োজনীয়তার কথাই মাথায় আসবে না আমার। আজ প্রায় আড়াই বছর হতে চলল আমি বাংলা ছেড়ে হরিয়ানায় আছি। এখন যদি কেউ আমায় জিজ্ঞাসা করে বাংলা বা হরিয়ানার ঠিক যে জায়গায় তুমি ছিলে বা আছো ঠিক সে জায়গার আঞ্চলিক ইতিহাসটি একটু বল তো বাপু। বা হরিয়ানার এই অঞ্চলের চাষীদের সবজি ফলনে ঠিক কি ধরণের সমস্যা আছে বল দেখি। আমি তো অথৈ জলে পড়ব। আমি জানিই না। কারণ আমি জানবার কোনো চেষ্টাই করিনি কোনদিন। কারণ এই প্রশ্নের সম্মুখীনই হতে হয়নি আমায় কোনদিন। যা আমায় হতে হবে হয়ত বিদেশের কোনো মানুষের কাছে কোনো এক সন্ধ্যার ঘরোয়া আড্ডায়। তখন অন্তত আমি জানবার চেষ্টা করার কথা ভাবব। সুতরাং দেশের বাইরে গিয়ে সরাসরি সমস্যার মধ্যে না ঢুকলেও দেশের জন্য টান হেতুই হোক বা বিদেশে সঠিক ভাবে নিজের দেশের প্রতিনিধিত্ব করার তাগিদেই হোক মানুষ নিজের দেশকে জানার চেষ্টা অন্তত করে। ফলে প্রথমে যা দিয়ে শুরু করেছিলাম সেই সূত্রই বলি, ভারতে বসবাসকারী ভারতীয়র চেয়ে বিদেশে বসবাসকারী একজন ভারতীয় এর পক্ষে প্রাদেশিকতার উর্দ্ধে উঠে নিজেকে ভারতীয় ভাবাটা অনেক সহজ। ফলে পৃথিবীর অন্য প্রান্তে একজন মারাঠি তার বিহারী বন্ধুর সাথে সান্ধ্য আড্ডায় বসে "তুমি বিহারি, কেন তুমি আমাদের মহারাষ্ট্রে থাকবে? এস তোমায় লাঠিপেটা করে নয়তো বোমা মেরে তাড়াই মহারাষ্ট্র থেকে"- এ ধরণের বালখিল্যপনার অসারতা নিয়ে অনায়াসেই সহমতে আসতে পারে। অথচ এ বিষয়ে রাজনৈতিক বালখিল্যদের বালখিল্যতার এক্কেবারে কেন্দ্রবিন্দুর মধ্যে পড়ে ভারতে বসবাসকারী কোনো মারাঠি তার বিহারী বন্ধুর সাথে সহমতে আসতেই হয়ত বেশ কিছুটা সময় নিয়ে নেবে। 

উপরোক্ত এই বিশিষ্ট বৃদ্ধ বৈজ্ঞানিকটির বৈজ্ঞানিক কাজ বর্ণনার পূর্ববর্তী এই ভাষণটুকু থেকে আমার একটি কথা মনে হয়েছে যে, কোনো সমস্যার সত্যিকারের সমাধানের জন্য প্রথম ও সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি হলো আগে সমস্যাটির কেন্দ্রবিন্দু থেকে একটু সরে এসে তৃতীয় পক্ষের দৃষ্টি দিয়ে সমস্যাটির মূল বোঝার চেষ্টা কর। সময় দাও। তাড়াহুড়ো কোর না। তাতে ভুল পথে চালিত হবার সম্ভাবনা থেকে যায়। তারপর নিরপেক্ষতা দিয়ে বিচার করে সর্বাঙ্গীন একটি সুষ্ঠু সমাধান খুঁজে বের করে তারপর সমস্যাটির মূলে ঝাঁপিয়ে পড়। নিজের সাধ্যমত সবশক্তি দিয়ে তার মূলটিকে ধরে নাড়িয়ে একেবারে উপড়ে ফেলার চেষ্টা কর। নইলে ওই ঘরোয়া বিবাদের মত কাদা ছোঁড়াছুঁড়িই সার। জল ক্রমশঃই ঘুলিয়ে উঠবে, মাছের নাগাল আর পাওয়া যাবে না। তা সে যে ধরণের সমস্যাই হোক না কেন। 
  

Wednesday 11 March 2015

মনুষ্যকুলের শ্রেণীবিভাগ এবং ফেসবুকের স্টেটাস

ফেসবুকের স্টেটাস আপডেট আপাতত হ্যাপি নিউ ইয়ার, অভিজিত চক্রবর্তী, বাৎসরিক বাংলাভাষা বন্দনা, অভিজিত রায় হত্যা, 'ইন্ডিয়াস ডটার', হ্যাপি হোলি, বাৎসরিক নারীবন্দনা পেরিয়ে এখন বিশ্বকাপ ক্রিকেটে থিতু হয়েছে। অবশ্যই তা কিছুদিনের জন্য। এটা আমাদের মস্ত গুণ যে আমরা ভীষণ জঙ্গম। এঁটুলির মতন কোনো একটি  বিষয়ে আটকে থাকা, ও আমাদের পোষায় না। A থেকে Z পর্যন্ত সমস্ত সামাজিক, রাজনৈতিক বিষয়ে কথা না বলে কি থাকা উচিত? আমরা সমাজবদ্ধ জীব না? পিঁপড়েদের মত। হুলুস্থুল দেশী-বিদেশী বিষয়ে যদি কথাই না বলতে পারলাম তবে দিনের মধ্যে পঁচিশ ঘন্টা ফেসবুকে চোখ লাগিয়ে বসে থেকে কি ছাতার মাথা লাভ হলো রে বাবা? সোজাসুজি কেউ আমার মতামতের তোয়াক্কা যে করে না সে তো হাড়ে হাড়ে বুঝে গেছি এতদিনে। তা বলে মতামত দেব না? গণতান্ত্রিক অধিকার বলে কথা। তা মতামত প্রকাশের এত সুন্দর একটি ব্যবস্থা থাকতে বিছানায় শুয়ে, টয়লেটে বসে আঙ্গুলের একটু নাড়াচাড়া করলেই যদি বিশ্বব্রম্ভান্ডের আপামর জনগনকে আমার বিচক্ষনতার দাপট সম্পর্কে ওয়াকিবহাল করে ফেলা যায় তবে আর কেন লোকের মুখোমুখী চাট্টি কথা বলে সমস্যায় পড়ি? সুতরাং ফেসবুক স্টেটাস আপডেট জিন্দাবাদ।  

ফেসবুক স্টেটাস আপডেট বিচার করে কিন্তু সুন্দর একটি শ্রেণীবিভাগ করে ফেলা যায় আমাদের। মানে সমগ্র মনুষ্যকুলের। কেমন করে? বলছি।
  

এবার একটু বিশদে বলি? বেশ।  প্রথম থেকে শুরু করা যাক কেমন।

সারা পৃথিবীর কোটি কোটি মানুষকে যদি আমি দুই ভাগে ভাগ করি তবে একটি ক্ষুদ্র অংশ থাকবে প্রথম ভাগে। যাঁরা ফেসবুক ব্যবহার করেন না। তাঁদের মধ্যে আবার দুটি ভাগ।  


১.ক: যাঁরা ফেসবুক সম্পর্কে মোটেই উত্সাহী নন: হয় তাঁরা পারেন না, নয় তাঁদের ভালো লাগে না ফেসবুক ব্যাপারটাকে। তাঁদের সম্পর্কে আমার কোনো বক্তব্য নেই। 

১.খ: যাঁরা অন্যের ফেসবুক সম্পর্কে বেজায় উত্সুক: তাঁরা নিজেরা একটি একাউন্ট খুললেই পারেন। 'আমি সকলের চেয়ে আলাদা' এই আহ্লাদে একাউন্টটি খোলা হয় না। কিন্তু সকলের খবর জানা চাই। তাই 'দেখি দেখি অমুকে কি বলল' বা 'তমুকে কোথায় বেড়াতে গেল' বলে পাশের জন ফেসবুক খুললেই হামলে পড়েন। সত্যি বলছি এরকম লোক দেখেছি সামনে থেকে। আরে ভাই তুমিও খোল একটা একাউন্ট। কেউ তো কামড়ে দেবে না তোমায়। "নাহ, কি হবে? এসব আমার পোষায় না।" বলে উদাস জ্ঞানী মুখ করে বসে থাকে। 'কি আর হবে? এখন যা হচ্ছে। সকলের খবরাখবর জানতে পারবে"-বলে দেখেছি। উত্তর এসেছে, "এই তো তোদের থেকে জানতে পেরে যাই।" আশ্চর্য প্রজাতি। কি আর বলব। 

আর যাঁরা ফেসবুক ব্যবহার করেন তাঁদের মধ্যে স্টেটাস আপডেট হিসেব করলে আমি তো স্পষ্ট ছয়টি প্রজাতি দেখতে পাচ্ছি। একে একে বলছি। আরো কোনো প্রজাতি থেকে থাকলে ভুলটা ধরিয়ে দেবেন প্লিজ। 

২.ক:  আপডেট: +; চিন্তাভাবনা: +; অ্যাকশন: +: এঁনারা হলেন করিতকর্মা প্রজাতির মানুষ। যেকোনরকম সামাজিক, রাজনৈতিক বা ব্যক্তিগত টালমাটালে চটপট বিষয়টি নিয়ে চিন্তা করেন। ঝটপট ফেসবুকে আপডেট দিয়ে ফেলেন তারপর বিষয়টির ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েন। যেমন ধরুন যাদবপুর থেকে অভিভাবক তাড়াতে হবে, ঝপ করে চিন্তা করলেন 'ঠিকই তো বাচ্চাগুলো তো ঠিক কারণেই গলা ফাটাচ্ছে।' সুতরাং চট করে কলরব হয়ে গেল মানে স্টেটাস আপডেট এলো আর পরদিনই আপনি ব্যানার হাতে রাস্তায়। সত্যি করিতকর্মা। স্বাধীনতাপূর্ব যুগ হলে এঁনারা নিশ্চয়ই বৃটিশের চক্ষুশুল হতেন। 

কিংবা ধরুন হঠাৎ একদিন সকালে গলার কাছটায় কিরকম যেন একটা গুজগুজ করছে বলে ঘুম ভেঙ্গে দেখলেন সবকিছু কেমন যেন লাগছে। কি যেন একটা বলার আছে। গুরগুর করছে ভেতরটা। কিছুতেই বোঝা যাচ্ছে না ব্যাপারটা কি। কিছুক্ষণ পরে যেই পাশের লোকজন সকালে 'গুড মর্নিং' এর জায়গায় 'সুপ্রভাত' বলল অমনি আপনার টং করে মনে পরে গেল "ওহো! আজ তো একুশে ফেব্রুয়ারী।" অমনি আপনি বাংলা ভাষার অতীত, ভবিষৎ, বর্তমান নিয়ে ভয়ানক রকম চিন্তিত হয়ে উঠলেন আর সাথে সাথে একটা সাড়ে পঞ্চান্ন লাইনের স্টেটাস আপডেট দিয়ে চরাচরকে বাংলা ভাষা সম্পর্কে উদ্দীপ্ত করেই ছাড়লেন। পুরো দিনটাই আপনি বঙ্গভাষার জন্য উত্সর্গ করে ফেললেন। 

অর্থাত শুধু ভাবনা বা আপডেটেই আটকে থাকেন না এঁনারা কাজও সেই অনুযায়ী করেন। এঁনারা হলেন প্রথম প্রজাতি।     

২.খ: আপডেট: +; চিন্তাভাবনা: +; অ্যাকশন: - : এঁনারা হলেন দ্বিতীয় প্রজাতি। চটপট চিন্তা করেন। ঝটপট আপডেট দেন কিন্তু মাঠে নেমে গোল দেন না। মানে, যাদবপুর থেকে অভিভাবক তাড়াতে হবে, ঝপ করে চিন্তা করলেন 'ঠিকই তো বাচ্চাগুলো তো ঠিক কারণেই গলা ফাটাচ্ছে।' সুতরাং চট করে কলরব হয়ে গেল মানে স্টেটাস আপডেট এলো কিন্তু রাস্তায় কি আর নামা যায়? ওটা তোমরাই করো। আমি না হয় পেছন থেকে সাপোর্ট করছি। 
বা ধরুন 'ইন্ডিয়াস ডটার' এর হয়ে ঝড় তুলে ফেলবেন স্টেটাসে। লিখিত বাদ-প্রতিবাদে পাতার পর পাতা ভরে যাবে। সত্যি সত্যি বিষয়টি নিয়ে না ভাবলে এত যুক্তি আসে না কলমে থুড়ি কিবোর্ডে। কিন্তু ঘরোয়া জটলায় কেউ কোনো মহিলার পোশাক নিয়ে সরস মন্তব্য করলে চুপ করে থাকা বা হ্যা হ্যা করা ছাড়া আর কিছু করার থাকে না তাঁদের।   

এঁনারাও মহার্ঘ্য প্রজাতি।

২.গ: আপডেট: + ; চিন্তাভাবনা: - ; অ্যাকশন: - : এই তৃতীয় প্রজাতিটির মধ্যে বড়বড় মহাপুরুষরা পড়েন। তাই অনেক সম্মান নিয়ে এঁনাদের কথা লিখতে বা পড়তে হবে। এঁনারা "আমায়ও এই বিষয়ে বলতে হবে" এই ভাবনায় এত বেশি বিভোর হয়ে থাকেন যে, যে বিষয়ে বলতে চাইছেন, সেটি সম্পর্কে আদ্যপান্ত ভাবার আর সময় পান না। ঝটপট আপডেটটা দিয়ে ফেলেন। সকলেই বলছে, অতএব আমার কি আর চুপ করে থাকা চলে? সমাজ সংসার সম্পর্কে আপডেটেড না থাকা একজন বোকা হাঁদা ভাববে না তো সকলে? অতএব সকালে বিকেলে বাজার চলতি বিষয় নিয়ে আপডেট দিয়ে যাও। 

ধরুন পশ্চিমবাংলার মাঠেঘাটে গরম ঘামে জন্ম থেকে ত্রিশ বছর বয়স পর্যন্ত কাটিয়ে আমি হঠাত করে পৃথিবীর উত্তর গোলার্ধের কোনো এক শীতল দেশে কয়মাস কাটিয়ে অঢেল বরফ টরফের ছবি ফেসবুকে ছড়িয়ে দেশে ফিরে আমার গ্রাম সম্পর্কে প্রথম আপডেট এই দিলাম যে, "so hot and humid here, I hate this." আপনি কি করবেন? এসব ক্ষেত্রে পড়ার পরেই সুস্থ জনগনের প্রথম প্রতিক্রিয়া বোধহয় ভসভসিয়ে খানিকটা হাসি ছাড়া আর কিছুই আসবে না। তারপরেও যদি আমি অভিজিত রায় হত্যা বা 'ইন্ডিয়াস ডটার' এর মতন বিষয়েও আমার মতামত জানাই, সেটার মধ্যে কতটা বিবেচনাবোধ বা বিচক্ষণতা বা সচেতনতা আর আশা করা যায়? তবুও আমি আপডেট দিতে ছাড়ি না।   

সাধারণত 'সাহারায় সীতাহরণ' থেকে শুরু করে 'হন্ডুরাসে হাহাকার' বা 'বোর্নিওর বিভীষিকা' তা সে যাই হোক না কেন পৃথিবীর জনপ্রিয় কোনো বিষয়ই ছাড়া পায়না এই তৃতীয় গোষ্ঠীর হাত থেকে। সকল বিষয়েই এঁনারা প্রাজ্ঞ। সমাজ, রাজনীতি, কূটনীতি, সাহিত্য, বিজ্ঞান, সঙ্গীতকলা, খেলাধূলা, চিত্রকলা, চলচ্চিত্র প্রভৃতি পৃথিবীর সকল বিষয়েই একজন মানুষের এত জ্ঞান যে একজীবনে কি করে হয় এ এক রহস্য আমার কাছে। প্রণম্য এঁনারা। 

যাক গে। পরের প্রজাতিতে যাওয়া যাক। 

২.ঘ:  আপডেট: - ; চিন্তাভাবনা: + ; অ্যাকশন: - :  এঁনারা দার্শনিক পর্যায়ভুক্ত। সব দেখেন, সব বোঝেন, কিন্তু কেউ 'যানতি পারে' না। সকলে ভাবে বুঝি ইনি ঘুমোচ্ছেন আদতে কিন্তু চিন্তাভাবনার চাষ চলে মনের মধ্যে সর্বক্ষণ। সমস্ত পার্থিব বিষয়ে এঁনারা ভাবনাচিন্তা করেন এবং উপরোক্ত সকল পর্যায়ভুক্ত জনগনের মতো স্টেটাস আপডেটটা আর দিয়ে উঠতে পারেন না। এত বেশি ভাবনা ভাবতে হয় যে ক্লান্তিতে আর কিবোর্ডে আঙ্গুল সরে না। কিন্তু কে কি আপডেট দিল আর তাতে কি কি ভুল আছে, কি কি অবান্তর চিন্তার ফসল সেই সব আপডেট, কিভাবে লোকজনের মগজের চিন্তাভাবনাগুলোকে সঠিক দিশা দেওয়া যায় এই সব ভাবতে গিয়ে আর বাকিদের আপডেটের খুঁত ধরতে গিয়ে এঁনাদের আর নিজেদের ভাবনাগুলো ফলপ্রসূ করা তো দূর, নিজেদের আপডেটটাই সময়মত দেওয়া হয়ে ওঠে না।   

২.ঙ: আপডেট: - ; চিন্তাভাবনা: + ; অ্যাকশন: + : এঁনারা চার নম্বরদের মতনই চিন্তা ভাবনা করেন। সাথে সাথে যেখানে যেমন দরকার কাজটাও করেন। আপডেট ইত্যাদি তুশ্চু জিনিসের ধার এঁনারা ধরেন না। কর্মবীর। ২.খ তে যেমন বললাম সেরকম পরিস্থিতিতে পড়লে অর্থাৎ ঘরোয়া জটলায় কেউ কোনো মহিলার পোশাক নিয়ে সরস মন্তব্য করলে চুপ করে থাকা বা হ্যা হ্যা করা তো দূরস্থান সেই দণ্ডেই মন্তব্যকারী বা কারিনীর এঁদের হাতে দুর্দশার অন্ত থাকে না। আর ইনি যেহেতু আপডেট তত্ত্বে বিশ্বাসী নন তাই জটলাকারীরা তো জানে না এঁনার স্টেটাস কি। সুতরাং ভুল মানুষের কাছে বেফাঁস মন্তব্যে বেচারাদের ল্যাজেগোবরে অবস্থা হয়। 

২.চ: আপডেট: - ; চিন্তাভাবনা: - ; অ্যাকশন: - : এই শেষ প্রজাতিটি সবচেয়ে ভালো থাকে। ফেসবুকে জন্মদিনের কেক কাটার ছবি লাগায়, নতুন রান্না করলে তার শৈল্পিক ছবি তুলে লাগায়, নতুন জামা কিনলে নতুন নতুন ভঙ্গিতে মুখ দেখায়, বাচ্চার প্রতি ঘন্টায় হাসা-কাঁদা-খাওয়া-পটি করার ছবি দেখায়, নামী জায়গায় বেড়াতে গিয়ে জায়গার তুলনায় নিজের নতুন সানগ্লাসের ছবি লাগায় তাতে ব্র্যান্ডের নামটা দেখা গেলে আরো ভালো। 

এঁনারা চারপাশের হালহকিকতের বিশেষ ধার ধারেন না। আপডেট থাকে মাঝে মাঝে। সেটা নিতান্তই ব্যক্তিগত।যেমন, বোর হচ্ছি, ঘুম পাচ্ছে, বেড়াতে যাচ্ছি, এই সিনেমা দেখছি, দেখে মাথায় ব্যথা করছে......ইত্যাদি ইত্যাদি। এতে সুবিধা হচ্ছে, বহুল প্রচলিত বিষয় নিয়ে কথা বলতে গিয়ে যুক্তি-পাল্টা যুক্তি তৈরী রাখতে গিয়ে মাথা ঘামাতে হয় না। সেলফি তোলার অনেক সময় পাওয়া যায়। কোনো ঝগড়ায় না থেকে কারো সাথে মনোমালিন্য হবার ভাবনা নেই। আর কোনো বিতর্কিত বিষয়ে খোলাখুলি মতামত প্রকাশ করতে গিয়ে শেষে নিজের তৈরী কাঁচের স্বর্গতে পাটকেল পড়বার ভয় নেই। সবদিক থেকেই একদম সঠিক-নিশ্ছিদ্র-নিরাপদ ব্যাপার।

এই হলো গিয়ে আমার মতে ছয় প্রজাতির মনুষ্যকুল। কিছু বাদ দিয়ে গেলে বলবেন।

কি বলছেন? আমি কোন দলে পড়ি? পাগল নাকি? কোনোমতেই বলব না। সবগুলোর যেকোনো একটা হতে পারি। আপনি? 

Sunday 8 March 2015

শিলাবৃষ্টি

আজকে নাকি কটকটে রোদ্দুর ওঠার কথা। আবহাওয়ার পূর্বাভাষ তাই বলছে। অথচ কাল রাত থেকে আবহাওয়া দপ্তরের ভাষায় বেজায় "বজ্র বিদ্যুতসহ ভারী বৃষ্টিপাত" হয়ে চলেছে। আজ সকাল থেকে আকাশ মেঘলা। বিকেল থেকে ঠান্ডা হাওয়া আর পশ্চিম দিক থেকে কালো মেঘের হুড়ুমদুড়ুমের চোটে বিকেল থেকে আর ঘরে থাকা গেল না। বারান্দায় গিয়ে দাঁড়াতেই হলো। আর যার যা কাজ, পিনাকী ট্রাইপড-ক্যামেরা নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। বেশ গুনগুনিয়ে ছবি টবি তুলছিল। হঠাত দেখি আঁই আঁই করতে করতে ডান গালে হাত ঘষতে ঘষতে লেজ গুটিয়ে সোজা ঘরের দিকে। 'কি রে কি হলো', টি হলো? বলতে বলতেই আমি আমার প্রশ্নের উত্তর পেয়ে গেলাম। ধুপ ধাপ শিল পড়তে লেগেছে। আর হরিয়ানায় বিরল সেই শিলাবৃষ্টির জাঁদরেল মাপের প্রথম শিলটা সোজা এসে বিরাশি সিক্কার থাপ্পড়টি বসিয়েছে সিধে আমার ঘরের নিবেদিতপ্রাণ আলোকচিত্রীর ডান গালে।

তার দিকে বিশেষ নজর আর দিতে পারলাম না। কারণ ততক্ষণে আমাদের বারান্দা আর সামনের মাঠ পেল্লায় মাপের শিলীভূত জলে সাদা হয়ে গেছে। ঠাস ঠাস শব্দে অবিরত শিল পড়ে চলেছে। দরজার বাইরে হাচিকো ভয়ে কাঠ হয়ে বসে আছে। এত বড় মাপের শিল বেচারা বোধহয় আগে দেখে নি। তাকে অভয় দিয়ে ঘরে বসানো হলো। থার্মোকলের বাক্স মাথায় দিয়ে কটা শিল কুড়োলামও। না না ছাতা ছিল আমার, কিন্তু যে সাইজের শিল পড়ছিল তাতে নতুন কেনা ছাতাটার ভেঙ্গে যাবার যথেষ্ট সম্ভাবনা ছিল কিনা তাই আর ছাতা মাথায় দিয়ে বারান্দায় যাবার রিস্কটা নিলাম না আর কি। 

প্রায় দশ মিনিট ধরে আকাশ ভেঙ্গে পেল্লায় পেল্লায় মাপের শিলাবৃষ্টি হলো। আর আমাদের বোরিং ছুটির দিনটাকে দশমিনিটেই চাঙ্গা করে দিল। আমিও নিরাপদ দূরত্বে থেকে চাট্টি ছবি তুললাম। দেখুন কেমন সাদা হয়ে গেছে মাঠ। 



পিনাকীও গাল সামলে ছবি টবি তুলল। তারপর যখন শিলার মাপ আর তার পতনের ফ্রিকোয়েন্সি একটু কমে গেল তখন দেখি হাচিকো ঘরের এককোণে দেওয়াল ঘেঁষে কাঠ হয়ে বসে আমাদের দিকে তাকিয়ে আছে। বেচারাকে গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে শান্ত করার পরে কটা বড় বড় শিলা দিতে দেখি ব্যাটা চেটে চেটে খেল। ক্রিম বিহীন আইস ভেবে বোধহয়। বেচারা। আপাতত বৃষ্টিপত্র হয়ে চরাচর শান্ত। হাচিকো এখন ঘরের বাইরে বসে হাত পা চাটছে। এবার নিশ্চিন্তে ঘুমোবে মনে হয়। আমরাও একপেট ইডলি খেয়ে বুঁদ হয়ে বসে আছি। পিনাকী তবে মাঝে মধ্যেই দেখছি মহাভারত পড়তে পড়তে এখনো ডানগালে হাত ঘষছে। বেচারা!!               

Thursday 5 March 2015

শেষ দোল

পৃথিবীটা জাহান্নম হয়ে যাবার আগে
চল না শেষ বারের মতন দোল খেলে নিই দুজনে। 

এখন কি আর দোল খেলে কেউ?
'হোলি হ্যায়' না? 
তাই সই 
রং তো বটে।  

আয় না সাজাই হরেক রঙের আবীর দিয়ে 
লালের সাথে নীল-সবুজ আর গোলাপী-হলুদ।

আমার প্রিয় হলুদ আবীর
কেমন যেন নরম লাগে দেখলে, হাতে নিলে। 
আয় না হলুদ আবীরে ভরিয়ে দিই তোর দুগাল 
তুই লাগাবি গোলাপী আবীর আমার দুগাল ভরে।

একশ রকম রং নিয়ে
চল না দোল খেলে নিই দুজন মিলে। 
এইবেলা 
এই শেষটি বারে। 

কাল থেকে তো একটাই রং
লাল, লাল আর শুধুই লাল। 

রক্তের রং লাল-ই তো হয়? 
তোর আমার সক্কলেরই?