Tuesday 25 October 2016

সূর্য ওঠার আগে

সামনে এগিয়ে ডানদিকে বলটা  বাড়িয়ে দে  নন্টে........ আর একটু এগো......দৌড়ো......দৌড়ো না রে গাধা। দেখছিস না ডানদিকটা ফাঁকা রয়েছে ...........চল চল.... পাশ কর......পাশ কর.......এতক্ষনে স্বপন পায়ে পেয়েছে বলটাকে। দৌড়োচ্ছে...দৌড়োচ্ছে।..... ডানদিকের এই ফাঁকাটার ফায়দা তুলতেই হবে.......আর একটু........আর একটু.... একটু বাঁদিক চেপে দৌড়ে রাউন্ড মোশনে বলটা ডানপায়ের সমস্ত জোর দিয়ে ঠেলে দিলেই নিশ্চিত গোল........এই হাফ সার্কল মার্কা গোল এর চান্স পেলে স্বপনকে আটকানোর সাধ্যি কারো বাবার নেই। এই অঞ্চলের ডাকসাইটে রাইট আউট সে। ডানদিক ফাঁকা রেখে খেলেছে এরা? উল্টোদিকে স্বপন?......নিশ্চিত গোল......আর একটু আর একটু দৌড়োলেই শট নেবার পজিশন এ পৌঁছে যাবে স্বপন.......  আর একটু.... আর একটু......এইবার এই বার....... 

"দাদা.....এ দাদা......উঠ যাইয়ে অব। সুবহ হোনেহি ওয়ালে হে। সব লোগ রেডি হো গ্যায়ে।" ......গুরুর ডাক কানে যেতেই একধাক্কায় ফুটবল মাঠ ছেড়ে পাথুরে জমিতে এসে পড়ে স্বপন। ধড়মড়িয়ে উঠে বসে। চোখ কচলে এদিক ওদিক তাকাতেই দেখে আট জনের প্রায় সকলেই প্রায় রেডি, সে ছাড়া। ইশ শেষ রাতে কম্বল এর ওমটা পেয়েছিলো বলে ঘুমটা গাঢ় হয়ে গিয়েছিলো তার। গলায় ঝোলানো বোতল থেকে একটু জল ঢাললো গলায় স্বপন। গলাটা শুকিয়ে গেছিলো এক্কেবারে। ঠান্ডা জলটা গলা-বুক বেয়ে নামছিলো টের পাচ্ছিলো সে। এই সেপ্টেম্বর এর শুরুতেই শিয়ালকোট সেক্টরে  হিম পড়তে শুরু করেছে। গলাটা বেশ ব্যাথা হয়েছে দিনের পর দিন খোলা আকাশের নীচে থেকে থেকে। 

মুখে চোখে জল ঝাপটাতে ঝাপটাতেই আবার তাড়া দিলো গুরু। 

"আরে দাদা.....জলদি কিজিয়ে..... দো নাম্বার রোড মে কাল বম্বিং  হুয়া পাতা হ্যায় না? পুরা রোড উড়া দিয়ে শালো নে। আজ তো এক হি অপশন।... সাত নাম্বার সে যাকে উও পাতলী সি পুল পার করকে জঙ্গল সে যানা পড়েগা।"

"চল গুরপ্রীত, হো গ্যায়া মেরা"...বোতল এর মুখটা বন্ধ করে স্বপন। জিপের দিকে এগিয়ে যেতে যেতে বলে " বৈঠনে কে জাগাহ তো দে ভাই।" 
"নেহি দাদা আপ পিছেওয়ালি জীপ্ মে বৈঠিয়ে।" জীপ্ এর পিছনের সিটে লাফ মেরে উঠতে উঠতে বলে গুরপ্রীত। "ম্যায় থোড়া প্রসাদ কে পাশ বৈঠ যাউঁ? বাত সাত করতে করতে পৌঁছ যাউঁঙ্গা।"

প্রশ্রয় মেশানো কৃত্রিম দীর্ঘশ্বাস ফেলে হাসতে হাসতে পিছনের জীপের দিকে এগিয়ে যায় স্বপন। এই শুরু হলো গুরপ্রীতের। কাজ বাদে বাকি সময়টা ছুটির হিসেবে করে বেড়াচ্ছে। দুমাস হলো বিয়ে করে নতুন বৌকে ফেলে ছুটি ক্যানসেল করে চলে আসতে হয়েছে। এখন সময় পেলেই শুধু হিসেবে কষছে পরের ছুটি কবে পেতে পারে সেই নিয়ে। আর রামপ্রসাদটা হলো দোসর। শুধু তাল দিয়ে যাচ্ছে। এই যুদ্ধ শেষ হলো বলে।  আর দিন পনের পরেই নাকি গুরপ্রীত ছুটির দরখাস্ত করতে পারবে। তার মধ্যেই নাকি সিজ ফায়ার এর আউন্সমেন্ট হয়ে যাবে। মনে মনে হাসছিলো স্বপন। গাড়োল সব। কোত্থেকে যে গুজব শোনে এরা! পিছনের জিপে উঠে বসেই চট করে কিছু মনে পড়ে যেতেই জীপ্ থেকে একদৌড়ে নেমে গত রাতের শোবার জায়গার দিকে গেলো স্বপন। কম্বলটার কথা ভুলেই গেছিলো সে। কাল শেষ রাতে আট নম্বর ট্যাঙ্কের ওয়্যারলেসটা বড্ড বেগ দিয়েছে তাকে। ড্যামেজ যা ছিল সেসব মেরামত করে, ঠিক করে কানেক্শন এনে, কোডিং করতে করতেই রাত দুটো। তারপর সে আর গুরপ্রীত মিলে বাকি তেরোটা ট্যাঙ্ক এর রুটিন ইন্সপেকশন। সেসব সেরে উঠলো যখন তখন ঘড়ির কাঁটা তিনটের ঘর ছাপিয়েছে।  তারপর সে গুরপ্রীতকে বলে বাকি একঘন্টা পিঠ সোজা করে নিতে গিয়ে ঢুকেছিলো দুই নম্বর ট্যাঙ্কের তলায়। এসব সময় ট্যাঙ্কের তলাটাই সবচেয়ে নিরাপদ জায়গা। রাতের বেলা যদিও এয়ার রেড হবার কথা নয়।  তাও বলা যায় না সাবধানের মার নেই। কম্বলটা যেরকম রেখে গেছিলো সেরকমই রয়েছে। ঝট করে তুলে নিয়ে বগলদাবা করেই আবার দৌড় জীপ এর দিকে। সবাই তার জন্যই অপেক্ষা করছে।

"আরে....অব ক্যায়া হুয়া দাদা....... ক্যায়া ভুল গ্যায়ে......" সামনের জীপ থেকে কথাগুলো ছুঁড়ে দিলো গুরপ্রীত। ততক্ষনে সামনের জীপটা চলতে শুরু করেছে। জীপে উঠে কম্বলটা গায়ে জড়িয়ে নিতে নিতেই দেখলো পাশে ফিটার পিল্লাই। "ক্যায়া দাদা ব্লাঙ্কেট লেকে আয়ে থে?" দক্ষিণী হিন্দিতে জিজ্ঞাসা করলো পিল্লাই। জীপ্ ততক্ষণে স্টার্ট নিয়েছে। "লেকে নেহি আয়েথে পিল্লাই, কাল ট্যাঙ্ককে নিচে সে মিলা। বহুত ঢুন্ডে থে, কোই ক্লেম নেহি কিয়া। তো সোচা রাখ লেতে হে।"

-"হাঁ  দাদা আপকা বেডিং তো আভি তক নেহি মিলা না?"

-"নেহি, উও তো শ্রীনগর সে আনেকে টাইম পেহী তো এ আর ভি  মে হি  রাহে গ্যায়ে। অব তো মিলনা ভি মুশকিল হ্যায়।"

-"হাঁ, উও তো হ্যায়। অভিতক ক্যায়সে শোতে থে ফির ?"
-"আয়সে হি "-পিল্লাইয়ের অবাক চাহনির দিকে তাকিয়ে একটু হেসে বলে ওঠে স্বপন। সত্যিই তার আর কিছু মনে হয় না। খাওয়া -পরা-শোয়া এসব নিয়ে সে কোনোদিনই সৌখিন ছিল না।  সৌখিনতার জন্য প্রয়োজনীয় সাচ্ছল্যও ছিল না। আর এই তিন বছরে সেনাবাহিনীর নিয়মানুবর্তিতার জীবনে সে অভ্যস্থ হয়ে উঠেছে আস্তে আস্তে। আগে শখ বা নেশা বলতে তার ছিল একটিই -ফুটবল। যেখানেই খেলা সেখানেই সে। স্কুল থেকে ব্লক, জেলাস্তর পেরিয়ে ইন্টারস্কুল টুর্নামেন্টগুলোর ধারাভাষ্য আজও চোখ বন্ধ করে গড়গড় করে বলে যেতে পারে সে। স্বপন-নন্টে-সাদেক-আর জটাই এই চারজন এর পজিশন বাঁধা টীমে। পায়ে বল পেলে সারা মাঠে দাপিয়ে বেড়াতো রাইট আউট স্বপন। বল-গোলপোস্ট আর স্বপন এছাড়া তার আর কিছু মনে থাকতো না। এখনো তার মনে পড়ে ইন্টারস্কুল টুর্নামেন্ট ফাইনালে জেলাস্তরে তার দেওয়া গোলে গ্রামের স্কুলের খালি পায়ে খেলতে যাওয়া ছেলেরা হারিয়েছিল টাউন স্কুলের বুট পরা, ফুটবল কোচ দিয়ে কোচিং করা ছেলেদের। সারা গ্রাম তারপরদিন তাদের নিয়ে মিছিল করেছিল। পড়াশুনা সে কোনোদিনই খুব একটা মন দিয়ে করেনি। পাশ করে পরের ক্লাসে উঠে যাওয়া ছাড়া আর কোনো চাহিদা ছিল না তার বই পত্তর থেকে। তা সেটুকুতে বাধা পড়েনি কোনোদিনই। সুতরাং একটা কাজই সে মন দিয়ে করতো। ফুটবল। গ্রামের সর্বজন শ্রদ্ধেয় হেড পন্ডিতমশাইয়ের ছেলে হওয়ায় পড়াশুনা ছেড়ে এই খেলে বেড়ানোর জন্য কম বকুনি খেতে হয়নি তাকে। পেটের খিদের জন্য শেষ পর্যন্ত তাকে মনের সেই সবুজ মাঠে দাপিয়ে বেড়ানোর খিদেটাকে  বিসর্জন দিয়ে এই কঠিন জীবন বেঁচে নিতে হয়েছে ঠিকই।  অথচ, মজার ব্যাপার এই যে, যে খেলাকে সে ফেলে আসছে বলে আক্ষেপের অন্ত ছিল না তার সেই খেলার জন্যই সে আলাদা সম্মান পেয়ে এসেছে এই তিন বছরে।

বর্তমান পরিস্থিতি অবশ্য আলাদা। এখন এই চূড়ান্ত অস্থিরতার সময়ে খাওয়া দাওয়ারই ঠিক ঠিকানা নেই তো খেলা। পিঠের ঝোলানো ব্যাগে মজুদ করা একবেলার খাবার, যে খাবার আবার দিনের দিন খাবার হুকুম নেই, আর গলায় জলের বোতল নিয়ে শেষ বিকেলে অল ক্লিয়ার সাইরেন শুনে বেরিয়ে পড়া।  সারারাত ফিল্ডের চোদ্দোটা ট্যাঙ্কের সমস্ত কমিউনিকেশন সিস্টেম এর দেখভাল করা।  অন্য ইলেকট্রনিক ড্যামেজ রিপোর্টিং হলে তার মেরামতি করা। আবার ভোররাতে ফায়ারিং শুরু হবার আগেই তল্পিতল্পা গুটিয়ে অস্থায়ী ডেরায় ফেরা। এই এখন তাদের জীবন। রোজই একটু একটু করে কোম্পানি সামনে এগোচ্ছে। সাথে সাথে তারাও। বর্ডার থেকে প্রায় বাইশ কিলোমিটার এগিয়ে এসেছে তারা।  রোজই নতুন নতুন খবর কানে আসে এই যুদ্ধ সংক্রান্ত। কোনো খবরেই তার কিছু যায় আসে না যদিও। জাহাজের খবরে তাদের মতন সাধারণ সৈনিকদের আর কি? জাহাজীরাই বা কবে আর তাদের মনে রেখেছে?  প্রাণ হাতে নিয়ে এই যে তারা হুড খোলা জীপে খোলা মাঠের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে তার জন্য হাত ঝেড়ে মাসমাইনে বাদে যুদ্ধ বাবদ ভাতা বলে যে কটা টাকা তাদের নামে বরাদ্দ প্রতিমাসে, সেটা নিতে গিয়ে হাসি পায় তার। স্বপন নামে মানুষটার বুকের ভেতরে যে প্রাণটুকু ধুকপুক করছে যেটা এই মুহূর্তেই আগের রাতে প্রতিপক্ষের রেইকি টীমমেম্বারদের পেতে রাখা গোপন মাইন এ পুরো জীপসমেত বেমালুম নেই হয়ে যেতে পারে, সেই প্রাণের দাম নাকি ওই কটা কাগজের টুকরো। হবেও বা। সৈনিকদের প্রতি শাস্ত্রীজীর গভর্নমেন্ট কত গর্বিত, কত আশাবাদী সেসব বলে রেডিওতে ভাষণ দিচ্ছিলো শালারা। দেশপ্রেম এর মাখন লাগাচ্ছিল ফিল্ডে আসার আগে। পেটের ভাত জোগাড় করার তাড়া না থাকলে স্বপনের মতো বেশিরভাগ ছেলেরই যে এখানে আসার দ্বিতীয় কোনো কারণ নেই সেটা এতদিনে পরিষ্কার তার কাছে। আর দেশপ্রেম-ট্রেম তার মতন সকলেই ওই ১৫ই আগস্টের স্কুলের মাঠের পতাকার তলায় ফেলে এসেছে।

"আরে ইয়ে লোগ শুনতে কিঁউ নেহি ?"-পিল্লাইয়ের বিরক্তি মাখানো প্রশ্নে বাস্তবে ফিরে আসে স্বপন।
সামনের আলো আঁধারিতে চারটে ছায়ামূর্তি। মাথায় শুকনো ডালপালার বোঝা। সামনের জীপটা থেমেছে।

"ওহঃ"- বিরক্তি মেশানো একটা শব্দ শুনলো তাদের জীপের ড্রাইভারের মুখে।
সত্যি এই সময় থেমে যাওয়াটা মূর্খামি। পুরোপুরি সকাল হবার আগেই ফিরতে হবে।  আলো ফুটলেই বম্বিং শুরু হতে পারে। এসময় রাস্তায় সময় নষ্ট করার মানেই হয় না।

অজান্তেই ভুরুটা কুঁচকে গেছিলো স্বপনের। ভেতরে ভেতরে একটু টেনশনও যে হচ্ছিলো না তা না। কি ব্যাপার কে জানে। এরকম ভাবে হঠাৎ করে থেমে যাওয়াটা অর্ডার বিরুদ্ধ। কম্বলটা ভালো করে মাথা দিয়ে পেঁচিয়ে নিয়ে বসলো সে। বেশ ঠান্ডা লাগছে ভোরের হাওয়ায়। পিল্লাইটা পাশ থেকে ক্রমাগতঃ শাপ শাপান্ত করে চলেছে সামনের গাড়ির আরোহীদের উদেশ্যে। আর ওই চারজন ক্ষয়াটে ছায়ামূর্তির বিরুদ্ধে। বেজায় ভীতু আর সেজন্যই বোধহয় বেজায় ধর্মবিশ্বাসী এই পিল্লাইটা।  স্বপনের সাথে শ্রীনগর থেকে চলেছে একই ট্রুপে। দিনে একবার করে মুসলমানদের বাপান্ত না করলে ওর দিনশেষ হয়না। ওর মতে সমস্ত পাকিস্থানী মানেই শয়তানের বংশধর। এই যে তারা শিয়ালকোটের ফাঁকা মাঠে সারারাত না ঘুমিয়ে ঠান্ডায় কাঁপছে তার জন্য ও যেকোনো সাধারণ পাকিস্তানি মুসলমানকেই পারলে দায়ী করে। অনেক তর্ক করেছে ওর সাথে স্বপন এই নিয়ে। কিন্তু ওকে কোনো মতে বোঝাতে পারেনি যে যুদ্ধ করে অনেক ওপর তলার লোকেরা। স্বপন বা পিল্লাইদের হাতে রাইফেল দিয়ে। তাদের ছোঁয়া পিল্লাইয়ের কম্মো নয়। তাদের ছোঁয়া যায় না। সামনের ওই চারজন স্থানীয় লোক ভোররাতে বেরিয়েছিল চট করে আগামী কয়েকদিনের উনুন ধরাবার রসদ সংগ্রহ করতে। সেটা জীপথেকে না নেমেই বোঝা যাচ্ছিলো। এদের এখানে থাকার কথা নয় এখন।  অনেক আগেই পুরো গ্রাম খালি করে এদের পিছিয়ে যাবার কথা। কিন্তু জীবন তো যুদ্ধের জন্য থেমে থাকে না। গ্রামে না থাকলেও নিশ্চই আশেপাশেই কোথাও থাকে এরা। তারাও যেমন সন্ধেরাত থেকে শেষ রাতের মধ্যে অলিখিত যুদ্ধ বিরতিটাকে কাজে লাগায় খাবার, এমুনেশন, মেডিক্যাল সার্ভিস আর ড্যামেজ কন্ট্রোল করার জন্য, এরাও তাদের মতোই ফায়ারিং এর আগের সময়টাকে বেছে  নিয়েছে রোজকার জ্বালানি সংগ্রহের জন্য।

"এ প্রসাদ, কা  হুয়া রে? রুকা কিঁউ ?"-  যথা সম্ভব আওয়াজ বাঁচিয়ে দেশওয়ালি হিন্দিতে জিজ্ঞাসা করে মগন, তাদের গাড়ির ড্রাইভার। কোনো উত্তর আসে না সামনের গাড়ি থেকে। "আরে চলো ভাইসব, দের হো গ্যায়া অলরেডি। ইয়ে সব লোগোকো বিশ্ওয়াস নেহি। শালা হারামিকা জাত।" পাশ থেকে মন্তব্য করে পিল্লাই।
"আঃ, বেওয়াযা মুহ কিঁউ খারাব করতে হো সুবহে সুবহে।  দেখলো তো পহেলে  হুয়া ক্যায়া।" ধমকে পিল্লাইকে চুপ করায় স্বপন। বিরক্তিতে তেতো লাগে মুখটা তার। এতো মাথামোটা যে কি করে হয় একটা লোক! রোজ সকালে স্নানের পর পনেরো মিনিট ধরে চোখবন্ধ করে বিড়বিড় করে, আর এদিকে সাধারণ মানুষ দেখলে মুখখারাপ করে।  কারণ তাদের একমাত্র দোষ, তারা মুসলমান। যত্তসব ধার্মিকতার ভড়ং।

প্রায় মিনিট দুয়েক কেটে গেছে  জীপ্ থেমে আছে। এই ভোরবেলা ফেরার সময় প্রতিটা মিনিট মূল্যবান। এবার একটু অধৈর্য্যই হয়ে উঠছে স্বপন। গায়ের কম্বলটা সরিয়ে নামতে যাবে জীপ থেকে, পিল্লাই হাত চেপে ধরলো।  "ক্যা কর রাহে হে দাদা?"
-"দেখনা তো হোগা প্রব্লেম ক্যা হ্যায়?"
-"জীপ সে উতারনে কা পারমিশন তো নেহি হ্যায় দাদা, খতরা হো সকতা হ্যায়। "
-"আরে, জীপ রুকনে কা ভি তো পারমিশন নেহি হ্যায়, ঔর খতরা অভি তক নেহি হুয়া। রাস্তে মে ঔর দের হোনেসে সচমে খতরা হো সকতে হে।"- পিল্লাইয়ের হাত ছাড়িয়ে জীপ থেকে নেমে নিয়ে সামনে এগিয়ে যায় স্বপন।

পাতলা চেহারার এক বৃদ্ধ, এক পনের-ষোলো বছরের কিশোর, আর দুই মধ্য বয়স্ক স্থানীয় গ্রামবাসী। সকলের মাথাতেই কাঠ-কুটোর বোঝা।

এদের মধ্যে দুজন গতরাতে মতিনালার পাশ দিয়ে জঙ্গলে যাবার সময়ে দূর থেকে দেখেছে দুটো লোককে পুলের নিচে ঢুকতে, চাঁদনী রাত থাকার জন্য তাদের বুঝতে অসুবিধা হয়নি। তারা ভেবেছিলো যে তাদের মতোই কেউ হয়তো প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিতে নামছে খালপাড়ে। তারা কিছু না ভেবেই পুল পার হয়ে জঙ্গলের পথে চলে যায়। কিন্তু পরে তাদের সন্দেহ হয় এই ভেবে যে সেরকম কিছু হলে দুজন একসাথে কেন? আর পুলের তলায়ই বা কেন? বাড়ির থেকে এতো দূরে জঙ্গল পেরিয়ে পুলের কাছে আসার তো দরকার নেই। পরে আরও দুজন তাদের সাথে এসে যোগ দেয়, তারা জানায়, যে, তারাও প্রায় ঘন্টাখানেক বাদে ওই লোকদুটিকে পুলের তলায় দেখেছে এবং পাতলা টর্চের আলোয় পুলের নিচে কিছু কাজ করতে দেখেছে। তাতে এদের সবার সন্দেহ হয়েছে কোনো ভাবে ওই পুল উড়িয়ে দেবার জন্য ওখানে বোম্ব লাগানো হচ্ছে কিনা। এখন এদের সমস্যা হচ্ছে যে, তারা ওই মতিনালার পুল পেরিয়ে বাড়ি ফিরতে ভয় পাচ্ছে। আর দ্বিতীয় রাস্তা হলো দুই নম্বর সড়ক, যেটা কিনা লম্বা রাস্তা বাড়ি ফেরার জন্য। সে রাস্তায় হেঁটে বাড়ি ফেরা মানে রাস্তার মাঝে সূর্যোদয়। আর তার পর ফাঁকা মাঠের মধ্যে দিয়ে হেঁটে ফেরা আর আত্মহত্যা করা একই ব্যাপার। তাই তারা এই সেনাবাহিনীর গাড়ি থামিয়ে তাদের একটু এগিয়ে দেবার অনুরোধ করছে।

যা শুনলো তাতে চক্ষু চড়কগাছ স্বপনের। ম্যাপ অনুযায়ী, মতিনালা মানে তো সাতনম্বর রাস্তায় খালের ওপরের পুলটা। যেটা দিয়ে তাদের কিছুক্ষন পরেই যাবার কথা।

সকলেরই কিংকর্তব্যবিমূঢ় অবস্থা। এ ওর মুখের দিকে তাকাচ্ছে।

"লেকিন চাচা, দো নাম্বার সড়ক সে তো হামলোগ নেহি যায়েঙ্গে, ও রোড মে তো কাল বম্বিং হুয়া থা, পাতা হ্যায় না? উও রোড তো যানে কে লায়েক নেহি হ্যায়।" -গুরুর কথায় এবার বিহ্বল হয়ে পড়লো পুরো দলটা।

"ফির কাঁহা সে যায়েঙ্গে ?"-প্রশ্ন করলো একজন।
"হামলোগ উও মতিনালা হো কর হি যায়েঙ্গে।"- জবাব দিলো স্বপন।
"নেহি জি, উস রাস্তেসে মত যাইয়ে। কুচ তো গড়বড় হ্যায় উঁহাপে "
"তুমলোগোকো ক্যায়সে পাতা উও বোম্ব ওয়ালী বাত ?"-চমকে পাশে তাকালো স্বপন। পিল্লাই ভয় চেপে কখন পাশে এসে দাঁড়িয়েছে।

"পাতা হ্যায় জনাব। ম্যায় নে খুদ দেখা বাত্তি জ্বালাকে কুছ কর রাহে থে উও লোগ ঠিক পুলকে নিচে।"-জবাব দিলো কিশোর।

"তুঝে ক্যায়সে পাতা উও বোম্ব ফিট কর রাহে থে? পুলকা মেরাম্মতি ভি তো হো সকতে হ্যায়? " সামনের জীপ্ থেকে প্রশ্নটা উড়ে এলো।

"নেহি জনাব, মুঝে পাতা হ্যায়  কুছ গড়বড় ওয়ালী কাম হো রাহা থা। "

"ফালতু মে টাইম ওয়েস্ট হো রাহা হ্যায় দাদা, ইয়ে লোগোকা জরুর কুছ মতলব হ্যায়, মুঝে লাগতা হ্যায় হামলোগোকো চলনা চাহিয়ে।" পিল্লাই এবার ঝেঁঝে উঠলো।

গোলমেলে পরিস্থিতি। তাদের এই দুটো জীপ কে উড়িয়ে দিতে পারলে চোদ্দটা ট্যাঙ্কের মেকানিক, সিগনালিং সিস্টেম, ফিটার সহ পুরো সাপোর্টিং সিস্টেম ব্লক। অন্তত একদিনের জন্য। সুতরাং কাল ওই চোদ্দটা ট্যাঙ্কের কোনোরকম সাপ্লাই পৌঁছবে না।  যেটার বড়োসড়ো সুযোগ নিতে পারে শত্রুপক্ষ। মতিনালা হয়ে জঙ্গলের পথে ফিরলে হেডলাইট নেভানো ক্যামোফ্লেজ নেট ঢাকা দুটো জীপকে ওপর থেকে লোকেট করে বম্বিং বা ফায়ারিং করা অনেক কঠিন। কিন্তু সেটা অনেক বেশি সোজা হবে যদি কোনো ভাবে দুটো জীপকে দু নম্বর সড়কে নিয়ে গিয়ে ফেলা যায়, যেটার বেশ কিছুটা অংশকে কাল বম্বিং এর পর আর সড়ক বলা যায় না. অন্ধকারে হেডলাইট নিভিয়ে, এবার খেবড়ো পাথুরে মেঠো পথে যেতে হবে অনেকটা। এবং এপথে মাথার ওপর জঙ্গুলে ছাউনি নেই। বলা যায় না হয়তো প্রতিপক্ষের রেইকি ট্রুপ তাদের এই যাতায়াতের রাস্তার সন্ধান পেয়ে স্থানীয়দের দিয়ে কাজটা করাতে চাইছে। এ সম্ভাবনা উড়িয়ে দেওয়া যায়না। সবচেয়ে বড় কথা, এদের কাছে মতিনালার পুল যে উড়িয়ে দেওয়া হবেই এরকম কোনো স্থির প্রমাণ নেই। সবটাই অনুমান। আর এরা স্থানীয় পাকিস্তানি। সুতরাং পিল্লাই এর কথা সবাই উড়িয়ে দিতেও পারছে না।

সিদ্ধান্ত নেওয়া মুশকিল। স্পষ্টতঃই দুই দল হয়ে গেছে তাদের এফ. আর. টি. টিম। একদল পিল্লাইয়ের কথায় সাপোর্ট করছে। অন্য দলের কথায়, যদি এদের কথা সত্যি হয় তাহলেও তো একই ব্যাপার। দুই নম্বর সড়ক উড়ে গেছে কাল সুতরাং তাদের ফিরতে হলে আজ মতিনালার পুল পার হয়েই ফিরতে হবে, আর অন্য রাস্তা নেই। আর এখবরটা প্রতিপক্ষের অজানা নয়। তাহলে, সেই পুলে মাইন ফিট করে পুরো এফ. আর. টি. টিম কে জীপসহ উড়িয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা তো তারা করতেই পারে। বরং এই ব্যবস্থায় একটা সুবিধা হচ্ছে আলো ফোটার আগে এয়ার রেড বা ফায়ারিং শুরু না করার যে অলিখিত নিয়ম সেটাও ভঙ্গ হলো না। এটা ভাবতে কি অসুবিধা হচ্ছে?

দ্রুত ভাবতে শুরু করলো স্বপন, হাতে সময় বেশি নেই। যা সিদ্ধান্ত নেবার তাড়াতাড়ি নিতে হবে। জীবনের প্রয়োজনে মরিয়া হয়ে বেরোনো পাকিয়ে যাওয়া মানুষগুলোকে দেখলে অবিশ্বাস করতে মন চায় না।  সে সপাটে জিজ্ঞাসা করলো বয়স্ক মানুষটিকে তাদের সন্দেহের কথা। পিল্লাইসহ অনেকেই অধৈর্য্য হয়ে উঠেছে।

"ক্যায়া চাচা, আপনে তো শুনা, ক্যায়া সোচ রাহে হ্যায় হামলোগ। আপলোগ জানবুঝকে কর রাহে হ্যায় ক্যায়া? কৌন বোলা আপলোগকো জীপ রোককে ইয়ে সব বাতানেকে লিয়ে? "

"ক্যায়া আপ ভি না দাদা? ইয়ে লোগ সচ বাতায়েঙ্গে আপকো? শালা মুসলমানকা বাচ্চা। চলিয়ে বহুত টাইম ওয়েস্ট হুয়া।" - পিল্লাই ঘড়ি দেখে।

"ক্যায়া বাতাউঁ জনাব, হামারি গাওঁ কে চার-পাঁচ লেড়কা আর্মি মে হ্যায়। হাঁ পাকিস্তানী আর্মি। লেকিন ম্যায় জানতা হুঁ আর্মি মে আপলোগ ইয়ে জঙ্গ কে টাইম পে ক্যায়সে বিতাতে হ্যায়। বর্ডার কে আশপাশকে হর গাঁও মে সব লোগ জানতে হ্যায়। ইন্ডিয়া হো ইয়া পাকিস্তান। বর্ডার তো কাগজ পে হোতা হ্যায় না জনাব। কিসিকা বেটা বোম্ব সে উড় যায়ে তো ক্যায় হোতা হ্যায় উও বর্ডারওয়ালে সবকো পাতা হ্যায়। আপলোগ মেরা লেড়কা য্যায়সা হ্যায়। যো সচ হ্যায় বাতায়, আগে আপলোগোকা মর্জি। "-ধীরে ধীরে ঊর্দূ মেশানো হিন্দিতে একটানা বলে শেষ করে বৃদ্ধ। স্বপন একটানা চেয়েছিল বৃদ্ধের দিকে, আধো অন্ধকারে ভালো বোঝা যায় না মুখের ভাঁজগুলো। তবে গলার স্বরে অভিজ্ঞতা, বর্ডারের গ্রামে থাকার জীবন সংগ্রাম আর কিসের যেন একটা যন্ত্রনা স্পষ্ট। অবিশ্বাস করতে মন চায় না তার।

আরো কয়েক মিনিট বাকবিতন্ডার পর সবাই নিমরাজি হলো দু নম্বর সড়ক নেবার জন্য। পরপর দুদিন একই রাস্তায় বম্বিং এর সম্ভাবনা কম।  আর দ্বিতীয় কথা হলো সূর্যোদয়ের আগে মাঠের অংশটুকু পেরিয়ে যেতে পারলে চিন্তা নেই।

সিদ্ধান্তটা ঠিক কি ভুল হলো জানে না স্বপন, কিন্তু কেন কে জানে বেশ ভালো লাগছে এই বৃদ্ধের কথায় বিশ্বাস করে।

আরো একপ্রস্থ ঝামেলা হলো এদের গাড়িতে তোলা নিয়ে, এদের নেওয়াটা ঠিক হবে কিনা। এটাও সেনাবাহিনীর আইন বিরুদ্ধ কাজ।  কিন্তু মানবতার আইনের কাছে হার মানলো যুদ্ধের আইন।  এদের এখানে ফেলে যাওয়া মানে নিশ্চিত মৃত্যুর মুখে ফেলে যাওয়া। সূর্যোদয়ের আগে এরা কখনোই পৌঁছবে না।

সবাই যে যার জায়গায় গিয়ে উঠলো।  চারজন নিজেদের বোঝাগুলো পায়ের কাছে নিয়ে দুটো জীপে ভাগাভাগি করে উঠলো। পিল্লাই গিয়ে উঠলো সামনের জীপের ড্রাইভারের পাশে। এদের পাশে বসে সে যাবে না। জীপ চলতে শুরু করেছে আবার। প্রায় পনেরো মিনিট নষ্ট হয়েছে রাস্তায়।

স্বপনের পাশে বসলো বছর পনেরোর কিশোরটি। নাম আতিফ।
-"কৌন কৌন হ্যায় ঘর মে? " মন থেকে সামনের রাস্তার ভয়টাকে তাড়াতে আলাপ জমায় স্বপন।
-"আব্বা, ভাবী, ঔর এক ভাতিজা, দেড় সাল কা। "
"স্কুল যাতে হ্যায়  তু ?" - কম্বলটা ফের গায়ে জড়িয়ে নিতে নিতে প্রশ্ন করে স্বপন।
"যাতে তো থে, অভি তো সব বন্ধ হ্যায়।" গায়ের উড়নিটা মাথায় বেশ করে পেঁচিয়ে নিয়েছে আতিফ।
"গাওঁ তো খালি হো যানা চাহিয়ে থা। ইয়ে বম্বিং কে টাইম পে চলে কিঁউ নেহি গ্যায়ে ?"
"কাঁহা যাউঁ  জনাব? যানে কে তো ঔর কোই জাগাহ হি নেহি হ্যায়। দো -চার ঘর রাহে গ্যায়ে গাওঁ মে, ডর ডর কে জিতে হ্যায়। "

"তু  হি  নে দেখা থা না উও বোম্ব ফিটিং ওয়ালে লোগোকো?"
 "হাঁ , কাল শাম কো। "
"তুঝে ক্যায়সে পাতা উও লগ বোম্ব হয় ফিট কর রাহে থে ?"
"পাতা হ্যায় মুঝে। "
"ওহী তো পুছ রাহা হুঁ , ক্যায়সে পাতা?"
মাথা নিচু করে চুপ করে থাকে আতিফ।

"বেশ কিছুক্ষন নানা রকম ভাবে জিজ্ঞাসাবাদের পর মৃদু কণ্ঠে উত্তর আসে, ম্যায় পহেচান লিয়া থা কাল উও দো লোগোকো। "

চমকে ওঠে স্বপন।

"টু ক্যায়সে জানতে হ্যায় উও দোনোকো ?"
- "ছোড়িয়ে না, জনাব। "
- "অভহি তো তুঝে বোলনা হি পড়েগা।"- ভয় হয় স্বপনের, সিদ্ধান্তটা ভুল হলো না তো? এখন তাকে জানতেই হবে, এখনো সময় আছে রাস্তা বদল করার।
 -"ম্যায়নে দেখা থা মেরে ভাইয়া কো বোম্ব লাগাতে হুয়ে। ইয়ে দোনো কে সাথ। "
-"তেরে ভাইয়া?"-আরো সতর্ক হয়ে ওঠে স্বপন।

আবার বেশ কিছুক্ষন চাপাচাপি শেষে ভয় দেখানোর পর বাকিদের কান বাঁচিয়ে আতিফ জানায়, দিন পনের আগে, তখনো এখানে সরাসরি যুদ্ধ শুরু হয়নি। তখন এটা পাকিস্তান আর্মির আন্ডারে। গ্রাম খালি হচ্ছে। আতিফ তার দাদার সাথে এই দুজন অচেনা লোককে কয়েকদিন পরপর কথা বলতে দেখে কৌতূহল বশতঃ দেখতে গিয়ে আসল ব্যাপারটা ধরে ফেলে। মাত্র দুশো টাকার বিনিময়ে এরা স্থানীয়দের লাগায় মাইন প্লেসিং এর কাজে। কারণ তারাই সবচেয়ে ভালো জানে স্থানীয় রাস্তাঘাট।

কয়েক সেকেন্ড লাগে স্বপনের বিস্ময় কাটিয়ে উঠতে।
"তু ভি করতা হ্যায় ইয়ে কাম?"
- "নেহি জনাব?" মুখ নিচু করে বলে আতিফ।
-"কিঁউ দোশো রুপিয়া মিল যাতা তুঝে?"-তীক্ষ্ন চোখে নজর করে স্বপন বাচ্চা ছেলেটাকে।
-"উও তো হ্যায়, সচ মে তো লালচ ভি হুয়া থা, মগর ভাবী বহত রোঁতি হ্যায়। " চুপ করে যায় আতিফ।
বাকিটা শোনার জন্য তাকিয়ে থাকে স্বপন ওর দিকে।

"সাতদিন পহেলে বোম্ব ফিট করনে কি টাইম পে ফাট গ্যায়া থা। ভাইয়াকো পহেচান নেহি পা রাহে থে জনাব। কুছ ভি নেহি বাঁচা থা মিট্টি দেনে কে লিয়ে। এক এক হিস্যা জোড়কে গোর দিয়া হ্যায় ঊনকো।"- হু হু করে কেঁদে ওঠে ছেলেটা।

কাঁপুনি লাগছে স্বপনের। ভোরের ঠান্ডা হাওয়ায় কি না সদ্য শোনা জীবনের সত্যিতে কে জানে।

বাকরুদ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকে আতিফের দিকে। গায়ে ধরে থাকা কম্বলটাকে আরো ভালো করে জাপটে ধরে সে।  এটাই যেন তার একমাত্র সুরক্ষা। সামনের জীপের পিছনের সীটে বসে মেঠো রাস্তার দুলুনির সাথে দুলতে দুলতে চলেছে আতিফের বৃদ্ধ বাবা। নিস্পলক, স্থবির। মাত্র সাতদিন আগে জোয়ান ছেলের গোরে মাটি দিয়ে, মৃত্যু মাথায় নিয়ে বেরিয়েছে জীবনের রসদ সংগ্রহে। গ্রামের বাড়িতে ফেলে আসা বৃদ্ধ হেডপন্ডিতমশাই বাবার ভাঁজ পড়া মুখটা জ্বলজ্বল করে ওঠে চোখের সামনে। আজ যদি সত্যিই তাদের জীপের কিছু হয়?

চোখটা জ্বালা করে ওঠে স্বপনের। যুযুধান এক দেশের সাধারণ এক সৈনিকের। কোন দেশ তাতে কি বা এসে যায়? বর্ডার তো সির্ফ কাগজ পে হোতা হ্যায়।

দুটো ঢাউস গুবরে পোকার মতো নড়ে চড়ে জীপদুটো চলতে থাকে রাস্তা খুঁজে খুঁজে। সূর্যোদয়ের সাথে পাল্লা দিয়ে। অনিশ্চয়তার দিকে।     







Sunday 29 May 2016

বৃষ্টিকথা





কোনো ভরা শ্রাবণের মধ্য দুপুরে
যখন আকাশ অন্ধকার করে মেঘেরা থম মেরে বসে থাকে
যেন আর কোথাও যাবার নেই ওদের,
কোনো তাড়া নেই, কোনো কাজ বাকি নেই-
যেন কিসের অপেক্ষায় নিচের দিকে মুখ করে তাকিয়ে থাকে ঠায়। 

সেসময় মনে কর-
তোমার ডাঁয়ে পাহাড়,
বাঁয়ে পাহাড়-
সামনে দৃষ্টিসীমা অবধি ছোটো-বড়-সবুজ টিলা আর টিলা
ছোটো হতে হতে
ছোটো হতে হতে
ক্রমশ দিগন্তে গিয়ে দম নিয়েছে।

পাথরের চাতালে শুয়ে আছো তুমি
ওই ধোঁয়া রঙের থম মেরে রওয়া মেঘেদের দিকে চোখ মেলে।
শ্রাবণের জলে-হাওয়ায় তরতরিয়ে বেড়ে উঠেছে সবুজেরা।
বাড়তে বাড়তে সে সবুজ কখন যে
তোমার পুরো তুমিটাকেই সবুজে সবুজ করে ফেলেছে
তার ঠিকানা নেই তোমার কাছেও।
    
ঠিক সে সময় বাতাসও যখন
দস্যি ছেলের দলের মত
এক্পুকুর বৃষ্টিতে নেয়ে উঠে
হল্লা শুরু করে
মুখের ওপর
বুকের ওপর।

সমস্ত দৈন্যতা এলোমেলো করে
বৃষ্টি নামে তখন
তোমার মুখের ওপর
বুকের ওপর
বুকের ভেতর
সারা আকাশ জুড়ে।




...........এখানে ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি হয়নি ...... হয়না কতদিন........সমস্ত কিছুতে ধুলোর প্রলেপ........কত পরত তা কে জানে।