Saturday 27 June 2020

Near Death Experience - 2

যে কথা বলছিলাম আগের দিন, 'Near death experience' বা 'NDE' সংক্রান্ত গবেষণার কথা। কিন্তু এই বিষয়ে গবেষণার প্রধান সমস্যাটা হলো, মডেল। অর্থাৎ, প্রায় মারা যেতে যেতে ফিরে আসছেন এরকম কোনো মানুষ গবেষকরা কোথায় পাবেন? যখন পাবেন তখন তাঁদের NDE অভিজ্ঞতা চলাকালীন মস্তিষ্কের সমস্ত স্নায়বিক কার্যকলাপ শেষ হয়ে গিয়েছে। যদিও NDE- কে বর্তমানের মস্তিষ্কের কার্যকলাপ সংক্রান্ত জ্ঞান দ্বারা বিচার করা, ব্যাখ্যা করা যে অসম্ভব তা বহু গবেষক বা চিকিৎসকই বলেছেন, তবুও ওই সময়ে মস্তিষ্কে বা স্নায়বিক কার্যকলাপে অন্তত কি পরিবর্তন হয় সেটি মাপা যেত যদি অভিজ্ঞতা চলাকালীন পরীক্ষা করা সম্ভব হতো। কিন্তু তা প্রায় অসম্ভব। ভার্চুয়াল রিয়েলিটি দ্বারা সুস্থ ভলেন্টিয়াকে প্রায় তিনি মারা যাচ্ছেন এমন একটা পরিস্থিতির মধ্যে ফেলে একটি মডেল তৈরি চেষ্টা হয়েছিল কিন্তু তা আসল ব্যাপারের অনেকটাই দূর দিয়ে গেছে। 

অন্য কোনো উপায়ে NDE-র মতন কোনো অনুভূতি তৈরী করা যায় কিনা সে চেষ্টাও হয়েছে। যার একটার কথা আমি আগের দিনের প্রথম পর্বের লেখায় বলেছিলাম। সেটি হলো DMT প্রয়োগ করে কিছুটা NDE -র মতো অভিজ্ঞতা তৈরী করা হয়েছিল। তবে এ বিষয়ে আরো একটি মাল্টিসেন্টার স্টাডি পাচ্ছি ইউরোপের বিভিন্ন ইউনিভার্সিটির মিলিত গবেষণার ফল। প্রকাশিত হয়েছে ওই ২০১৮ তেই। এই স্টাডিটি আরো লম্বা সময় ধরে চলেছিল। প্রায় তিন বছর। এখানে উইলিয়াম ভ্যান গর্ডন এবং তাঁর সহগবেষকরা খানিকটা অদ্ভুতভাবেই NDE তৈরী (induce) করেছেন। করেছেন মেডিটেশন বা মনসংযোগ দ্বারা। তাঁরা জানাচ্ছেন, প্রাচীন বৌদ্ধপুঁথিতে এক বিশেষ পদ্ধতির মেডিটেশন এর সাহায্যে NDE তৈরি করা সম্ভব একথার উল্লেখ আছে। একে বলা যাক MI-NDE (Meditation Induced- NDE)আধুনিককালের বৌদ্ধ মেডিটেটররা মনোসংযোগের দ্বারা আগে থেকে প্ল্যান করা সময়ে MI-NDE তৈরী করতে সমর্থ হয়েছেন। এর ফলে তাঁদের নিয়ে পরীক্ষা করলে অন্তত পরীক্ষা করার জন্য একটি মডেল পাওয়া সম্ভব হবে। এই স্টাডিতে তাঁরা ১২ জন বৌদ্ধ মেডিটেটরের ওপর পরীক্ষা করেন। সেখানে MI-NDE তৈরী করে এমন পদ্ধতির মেডিটেশন এবং তার সাথে আরো দুটি আলাদা ধরণের মেডিটেশন পদ্ধতি, যা MI-NDE পদ্ধতির কন্ট্রোল (যেমন অন্য পরীক্ষার ক্ষেত্রে placebo থাকে) হিসেবে কাজ করবে এমন দুটি পদ্ধতি পরীক্ষা করে দেখা হয়। এবং সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় এই স্টাডিটির ক্ষেত্রে এই যে, স্টাডিটি চলেছিল একটানা তিন বছর। অর্থাৎ, MI-NDE পদ্ধতিতে করা মেডিটেশনের ফলে তিনবছর ধরে একই মানুষের উদ্ভুত NDE তীব্রতা ক্রমান্বয়ে বাড়তে দেখা গিয়েছিলো। অন্যান্য দুটি পদ্ধতিতে করা মেডিটেশনের ফলে কিন্তু সেটি বাড়েনি। এই পদ্ধতিতে মেডিটেটররা নিজেদের ইচ্ছেমতো সময়ে সচেতন ভাবে NDE তৈরী করতে পেরেছিলেন। এই স্টাডিটি একটি আশার আলো দেখায় যে ভবিষ্যতে এই অ্যাডভান্স স্টেজের মেডিটেটরদের নিয়োগ করে NDE চলাকালীন সরাসরি মস্তিস্ক এবং স্নায়ুসংক্রান্ত পরিবর্তনগুলি মাপা যেতে পারে। কিন্তু একটি প্রশ্ন থেকেই যায়, এক্ষেত্রে মেডিটেটররা সচেতন যে তাঁরা NDE তৈরী করছেন, সাধারণ NDE -র ক্ষেত্রে যা হয়না। ফলে দুটি অবস্থার শারীরবৃত্তীয় পার্থক্য থেকেই যায়। 

২০১৭ তে conscious cognition জার্নালের আর একটি আর্টিকেল পাচ্ছি এটিও ইউরোপের একাধিক দেশের ইউনিভার্সিটি এবং গবেষনা সংস্থার মিলিত ফসল। যেখানে তাঁরা ১৫২ জন মানুষের ওপর পরীক্ষা করে দেখছেন NDE-র তীব্রতা যাঁর যত বেশি, অর্থাৎ গ্রেইসন স্কেলের স্কোর যত বেশি, তাঁর সেই অভিজ্ঞতা লম্বা সময় ধরে মনে রাখার ক্ষমতাও তত বেশি। অর্থাৎ NDE পরবর্তী life-transforming ঘটনা ঘটার ব্যাপারটাকে এই ফলাফল কিছুটা হলেও সমর্থন করে। NDE-র তীব্রতা যাঁর যত বেশি, তাঁর জীবনের ক্ষেত্রে life-transformation এর ঘটনা তত তীব্র। স্মৃতি এক্ষেত্রে পজেটিভ অনুঘটকের কাজ করে। NDE-সংক্রান্ত স্মৃতির কথা যখন উঠলোই, তখন ইতালির University of Padova Padova থেকে করা একটি স্টাডির কথা বলা যাক। আর্টিকেলটি প্রকাশিত হয়েছিল ২০১৪ সালে Frontier of human neuroscience জার্নালে। এই কাজটিতে তাঁরা EEG-র মাধ্যমে দেখার চেষ্টা করেন যে, NDE - র স্মৃতি, সাধারণ সত্যিকারের ঘটনার স্মৃতি এবং কোনো এক কাল্পনিক ঘটনার স্মৃতিচারণ করার ক্ষেত্রে ব্যক্তির মস্তিষ্কের কার্যকারিতার কি কি পরিবর্তন হয়। এই পরীক্ষায় ১০ জন অংশগ্রহণকারী ছিলেন যাঁদের গ্রেইসন স্কেল অনুসারে NDE আছে আর আরো ১০ জন অংশগ্রহণকারী ছিলেন যাঁদের কখনো NDE র সামনাসামনি হতে হয়নি। এই পরীক্ষায় আরো একটি উল্লেখযোগ্য দিক উঠে আসে। NDE -র স্মৃতিচারণা এবং সত্যিকারের ঘটনার স্মৃতিচারণের সময়ে মস্তিস্কের কার্যকলাপ দেখা যায় একই রকম। তুলনায় কাল্পনিক ঘটনার স্মৃতিচারণে ঘটে মস্তিস্কের কার্যকারিতার সম্পূর্ণ আলাদা। আর্টিকেলটির লেখকদের ভাষায় বললে, " Findings showed that NDE memories were similar to real memories in terms of detail richness, self-referential, and emotional information. Moreover, NDE memories were significantly different from memories of imagined events." EEG- র ফলাফল দেখে এই আর্টিকেলের গবেষকরা সিদ্ধান্ত নেন যে, NDE -র স্মৃতি কোনোমতেই কাল্পনিক কোনো ঘটনার স্মৃতির সাথে তুলনীয় নয়। 

এই যে NDE-র পরে দীর্ঘ্যকালীন একটা চরিত্রগত পরিবর্তন (Long term positive life transformation) লক্ষ্য করা যায়, সেই পরিপ্রেক্ষিতে এখন পর্যন্ত যে থিওরিটি আছে সেটি হলো, এই অবস্থায় চেতনা (Consciousness) মস্তিষ্কের স্নায়বিক তন্ত্রের (Neural system) থেকে আলাদা (Detached) হয়ে যায়। কিন্তু সেটি কি করে হওয়া সম্ভব সেটি এখনো ল্যাবরেটরিতে নকল করা সম্ভব হয়নি। আর একটি থিওরি হলো, এই অভিজ্ঞতা মারাত্মক বিপদ বা প্রাণহানির সময়ে মস্তিকের অস্বাভাবিক কার্যকারিতার দ্বারা মস্তিষ্কের সম্ভাব্য ক্ষতি থেকে বাঁচতে এর বিরুদ্ধে মস্তিষ্কেরই একটি প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা। NDE -র সময়ে শারীরবৃত্তীয় পরিবর্তন পরীক্ষা করা হয়েছে এমন আপাতত একটিমাত্র স্টাডিই পাচ্ছি 'Critical Care' জার্নালে। ২০১০ সালের স্টাডি। স্লোভেনিয়ার তিনটি বড় হাসপাতালের ৫২ জন কার্ডিয়াক এরেস্টের রোগীর ওপর করা। যাঁদের গড় বয়স ৫৩.১ বছর এবং এই ৫২ জনের মধ্যে ৪২ জনই ছিলেন পুরুষ। এদের মধ্যে ২১.২% এর গ্রেইসন স্কেল অনুসারে NDE ছিল। এই স্টাডিতে দেখা গিয়েছিলো, NDE আছে এমন রোগীদের ক্ষেত্রে ধমনীর কার্বন-ডাই-অক্সাইডের আংশিক চাপ এবং রক্তে পটাশিয়াম এর ঘনত্ব বেশ বেশি যাঁদের NDE ছিল না তাঁদের তুলনায়। 

তবে বড় জটিল অস্ত্রপ্রচার বা বয়স্ক মানুষদেরই এই অভিজ্ঞতা হবে তা নয়, জেনিভার ইউনিভার্সিটি হাসপাতালে একটি ১২ বছরের ছেলের সাধারণ এনেস্থেসিয়া দিয়ে অতিসাধারণ অস্ত্রপ্রচার চলাকালীন তার NDE হয়। এই কেস স্টাডিটি পাচ্ছি 'Pediatric Anesthesia' জার্নালে প্রকাশিত হয়েছে ২০০৬ সালে। 


আগেই বলেছি যে হাসপাতালের কার্ডিয়াক ইউনিটগুলোতেই NDE-র ঘটনা সবচাইতে বেশি ঘটতে দেখা যায়।নেদারল্যান্ডের Rijnstate Hospital এর কার্ডিওলজি বিভাগের অধ্যাপক Dr. Pim van Lommel নেদারল্যান্ডের ১০টি হাসপাতাল থেকে ৩৪৪ জন কার্ডিয়াক এরেস্ট হওয়া মানুষ নিয়ে প্রায় আট বছরের বেশি সময় ধরে একটি স্টাডি করেছিলেন যেটি ২০০১ সালে 'Lancet' জার্নালে প্রকাশিত হয়েছিল। এই ৩৪৪ জনের মধ্যে ১৮% এর NDE ছিল। সেখানে তিনি দেখেন, কার্ডিয়াক এরেস্ট কতটা সময় ধরে হচ্ছে, কতক্ষন ধরে মানুষটি অচেতন থাকছেন, কি ধরণের ওষুধ তিনি খাচ্ছেন, মৃত্যুভয় মানুষটির মনের মধ্যে ছিল কিনা ইত্যাদি কোনো কিছুর সাথেই এই অভিজ্ঞতা হওয়া বা না হওয়ার কোনোরকম সম্পর্ক নেই। 

এই Dr. Lommel ২০১১ সালে একটি রিভিউ লেখেন Annals of the New York Academy of Sciences জার্নালে। সেখানে তিনি প্রবন্ধটি আরম্ভ করেন এই বাক্যটি দিয়ে- "কার্ডিয়াক এরেস্ট হবার পর যাঁরা ফিরে এসেছেন, তাঁদের বর্ণিত অভিজ্ঞতার থেকে যে সমস্ত গবেষণাপত্র প্রকাশিত হয়েছে সেগুলোর ফলাফল ও সিদ্ধান্তের এতটাই মিল, যে NDE -র ব্যাপারটিকে বৈজ্ঞানিকভাবে আর অবহেলা করা যাবে না।" এই প্রবন্ধে তিনি আরও সিদ্ধান্ত করেন যে, "The NDE is an authentic experience that cannot be simply reduced to imagination, fear of death, hallucination, psychosis, the use of drugs, or oxygen deficiency." অর্থাৎ NDE একটি সত্যিকারের অভিজ্ঞতা। কল্পনা, মৃত্যুভয়, দৃষ্টিভ্রম, মানসিক বৈকল্য, কোনো রাসায়নিকের প্রভাব বা মস্তিষ্কে অক্সিজেনের অভাব নয়। 

আপাতত NDE সংক্রান্ত গবেষণা যা পাচ্ছি তার সারাংশ মোটামুটি এইই। বাকি যা আর্টিকেল তা প্রধানত কেস স্টাডি। অর্থাৎ অস্ত্রোপ্রচারের সময় বা দুর্ঘটনা বা কার্ডিয়াক এরেস্টের সময় শরীরের বাইরে থেকে শরীরটিকে দেখতে পাওয়া বা আপনজনদের বা সামনের সমস্ত দৃশ্য দেখতে পাওয়ার অভিজ্ঞতার বর্ণনা। এসম্পর্কে পর্যাপ্ত গবেষণার অভাব রয়েছে। তার মূল কারণ আমাদের বোধ, বিজ্ঞান, মাপজোকের যন্ত্রপাতির সীমাবদ্ধতা। তবে যেহেতু NDE একটি Life transforming event বলেই বেশিরভাগ রিপোর্ট বর্ণনা করছে এবং সেই পরিবর্তনটি প্রায় সর্বক্ষেত্রেই ভালোর দিকে, সেহেতু NDE-র পদ্ধতিটি ঠিকঠাক বুঝতে পারা গেলে এবং তাকে প্রয়োজন মতো induce করা সম্ভব হলে (যেমন কিনা MI-NDE-র ক্ষেত্রে মেডিটেশন দিয়ে করার কথা বলা হচ্ছে) ড্রাগ বা এলকোহল এডিকশন বা আত্মহনন মানসিকতা বা PTSD-র মতো দীর্ঘকালীন মানসিক সমস্যার চিকিৎসার ক্ষেত্রে আরো একটি বিকল্প পদ্ধতি হলেও হতে পারে। তবে এই Alternative treatment পদ্ধতির কথা এখনই ভাবা অসম্ভব। আরো একটি অর্ধশতক বা শতক পরে হয়তো এ বিষয়ে আশা করা উচিৎ হবে।    

আজ এপর্যন্তই। 
ভালো থাকবেন।
অর্পিতা।    

Tuesday 23 June 2020

Near Death Experience - 1

খুব কাছ থেকে মৃত্যুকে দেখেছেন যাঁরা অর্থাৎ মরতে মরতে বেঁচেছেন এমন কিছু মানুষ, যেমন ধরা যাক- কোনো একটা জটিল অস্ত্রপ্রচারের সময় হার্টবিট কিছু সময়ের জন্য বন্ধ হয়ে গেল তারপর কয়েকসেকেন্ড পরে আবার তা ফিরে এলো, অথবা বীভৎস কোনো দুর্ঘটনায় পড়ে কেউ একজন মারা পড়তে পড়তেও বেশ গেলেন, বা  কেউ বেশ কয়েকদিন কোমাতে কাটিয়ে এলেন বা কার্ডিয়াক এরেস্ট হলো বা ভূমিকম্পের ফলে মরতে মরতে বেঁচে গেছেন এমন মানুষ, ইত্যাদি ইত্যাদি। মানে আমরা যেমন ভাবে সন্ধ্যেবেলায় গল্প করতে করতে বলি যে, "আজ একেবারে মরতে মরতে বেঁচে গেলাম", সেরকম নয়, সত্যিকারের মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে আসেন যাঁরা তাদের কথা বলছি। ওই কয়েকসেকেন্ডের অভিজ্ঞতা তাদের ঠিক কি রকম? এই অভিজ্ঞতাকেই বলা হচ্ছে 'near death experience' বা সংক্ষেপে 'NDE' অদ্ভুতভাবে  ওই মানুষেরা ঐসময়ের এমন কিছু অভিজ্ঞতার কথা বলেন যা দেশ-কাল ভেদেও একইরকম। বেশ একটা মিল লক্ষ্য করা যায় তাঁদের বর্ণিত বিষয়টিতে। যেমন, নিজের শরীরকে শরীরের বাইরে থেকে দেখতে পাওয়া (out of body experience), নিজের পুরো জীবনের গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাবলী পুনর্বার ফিরে দেখা (life review), বা একটি উজ্জ্বল আলোর টানেলের মধ্যে দিয়ে যাওয়ার কথা বলেন তাঁরা। সর্বোপরি, একটা ভীষণ সুন্দর, শান্ত, সমাহিত, সমস্তরকম দুশ্চিন্তা থেকে মুক্ত উন্নততর মনের অবস্থার কথা তাঁরা প্রত্যেকেই বর্ণনা করেন। এই বর্ণনাগুলি আগেই বলেছি দেশ-কাল ব্যতিরেকে সকলের ক্ষেত্রে একই।  

Near death experience (NDE) নিয়ে প্রথম পাবমেড (Pubmed) আর্টিকেল পাচ্ছি ১৯৮৩ সালে। লিখেছেন ব্রুস গ্রেইসন (Bruce Greyson)। Dr. Greyson এর পরিচয় এককথায় বলতে গেলে বলতে হয় তিনি ভার্জিনিয়া ইউনিভার্সিটির Professor Emeritus of Psychiatry and Neurobehavioral Sciences. তাঁর আরো পরিচিত পরিচয় হলো, 'the father of research in near-death experiences.'  এই near-death experiences শব্দবন্ধটি অবশ্য প্রথম ব্যবহার করেছিলেন রেমন্ড মুডি। তাঁর শুরু করা চিন্তাধারাকে নতুন ভাবে একটা কোয়ান্টিটেটিভ রূপ দেবার চেষ্টা করেছেন গ্রেইসন। একা গ্রেইসন নন আরো অনেকেই এই NDE রিসার্চকে এগিয়ে নিয়ে চলেছেন। তবে গ্রেইসন NDE কে ঠিকঠাক চিহ্নিত করবার জন্য একটি পরিমাপন পদ্ধতি প্রণয়ন করেন যা 'গ্রেইসন স্কেল' নামে বহুল বিখ্যাত একটি মডেল। অর্থাৎ কেউ একজন যদি মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে আসেন তবে তাঁর তিনি আদৌ কিছু অনুভব করতে পেরেছেন কিনা, মানে তার অভিজ্ঞতাকে আদৌ NDE বলা চলে কিনা, বা বললেও সেই অভিজ্ঞতা ঠিক কোন পর্যায়ে পড়ে সেটির মাপকাঠি এই গ্রেইসন স্কেল। তবে গ্রেইসন স্কেল এর প্রণেতা কিন্তু শুধু NDE -র পরিমাপ নয়, NDE- র সাথে কার্ডিয়াক কেয়ার বা অন্যান্য ক্লিনিকাল প্রভাব, আধ্যাত্মিকতার সাথে তার সম্পর্ক সংক্রান্ত বিষয় এমনকি আমাদের কুণ্ডলিনী শক্তি সম্পর্কেও লিখেছেন। 

এখন এই অভিজ্ঞতাগুলিকেই গ্রেইসন স্কেল অন্তত চারটি ভাগে ভাগ করে। অর্থাৎ মানুষটির মানসিক অবস্থা, স্নায়বিক অবস্থা, বেড়ে ওঠার পরিবেশ, আধ্যাত্মিক বিশ্বাস ইত্যাদি বেশ কিছু বিষয় এই অভিজ্ঞতাগুলিকে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে এই চারটি ভাগে ফেলে। Cognitive type, Transcendental type, Affective type এবং Paranormal type. বাকি আর যা অন্য চারটের মিশ্রণ তাকে আর শ্রেণীবিন্যাস করা যায় না।  ফলে বাকি সবগুলো হলো মিশ্র বা unclassified type. এখন NDE -র অভিজ্ঞতার ভিন্নতা অনুসারে এই টাইপগুলি ঠিক কি? অভিজ্ঞতার তীব্রতা অনুসারে তার গ্রেডিং করতে বলা হয়। পদ্ধতিটি self assessment গোত্রীয়। প্রায় ষোলোটি প্রশ্নের ০, ১ বা ২ হিসেবে গ্রেডিং করতে বলা হয় NDE প্রত্যক্ষ করেছেন এমন মানুষকে। গ্রেইসন স্কেল বলছে, এই ষোলোটি প্রশ্নের (অভিজ্ঞতার) ধরণ হলো ওই Cognitive type, Transcendental type, Affective type অথবা Paranormal type এর। এখন কোনো একজন মানুষের অভিজ্ঞতা অনুসারে গ্রেডিং করতে করতে কোনো একটি টাইপ এর গ্রেড ৫ বা তার বেশি হলে মানুষটির NDE- কে সেই টাইপ এ বা গোত্রে ফেলা যাবে। এখন ওই ষোলোটি প্রশ্ন একটু দেখে নিই। 

যখন আপনি NDE- র মধ্যে দিয়ে যাচ্ছেন, অর্থাৎ ঠিক মৃত্যু হবো হবো থেকে আবার ফিরে আসছেন ওই কয়েক মুহূর্তের মধ্যে আপনার কি মনে হয়েছে-

১. সময়ের গতি অস্বাভাবিক বেড়ে বা কমে যাচ্ছিলো? অর্থাৎ সব কিছু ভীষণ দ্রুত বা ধীর লয়ে ঘটছিল?
২. আপনার চিন্তা করার ক্ষমতা অস্বাভাবিক দ্রুত বা ধীর লয়ে চলছিল?
৩. আপনার জীবনের পুরোনো ঘটনাবলী কি আপনার মনে আবার ফিরে আসছিল?
৪. আপনি কি হঠাৎ করেই আপনার বা আপনার চারপাশে ঘটে চলা সমস্ত জানা অজানা ঘটনার ব্যাখ্যা করতে পারছিলেন? বুঝতে পারছিলেন সমস্ত কিছু?
৫. আপনি কি অসম্ভব একটা শান্তি, স্বস্তি অনুভব করছিলেন? 
৬. আপনার কি ভীষণ একটি আনন্দ হচ্ছিলো?
৭. আপনি কি নিজেকে বিশ্বজগতের সাথে একসূত্রে বাঁধা, একাত্ম একজন মনে করছিলেন? 
৮. আপনি কি নিজের চারিদিকে উজ্জ্বল একটা আলোর গোলক দেখেছিলেন বা অনুভব করেছিলেন?
৯. আপনার সমস্ত ইন্দ্রিয়ানুভূতিগুলি কি সাধারণ অবস্থার তুলনায় আরো শক্তিশালী বা তীব্র হয়ে উঠেছিল?
১০. আপনার কি মনে হচ্ছিলো, মানে আপনি কি অনুভব করতে পারছিলেন যে অন্যকোথাও একটা চলে যাচ্ছেন বা আশেপাশের জিনিষগুলি অন্য কোথাও চলে যাচ্ছে?
১১. ভবিষ্যতের কোনো দৃশ্য কি আপনার চোখের সামনে ভেসে উঠেছিল? 
১২. আপনি কি অনুভব করেছিলেন যে আপনি আপনার শরীর থেকে আলাদা হয়ে গেছেন (Out of body experience, OBE)? 
১৩. আপনার কি মনে হচ্ছিলো আপনি অপার্থিব কোনো জায়গায় পৌঁছে গেছেন?
১৪. আপনি কি রহস্যময় কোনো বস্তুর উপস্থিতি অনুভব করেছিলেন বা অচেনা কোনো কণ্ঠস্বর শুনেছিলেন?    
১৫. আপনি কি আপনার মৃত কোনো আত্মীয় বা আধ্যাত্মিক কোনো মানুষকে দেখেছিলেন বা অনুভব করেছিলেন?
১৬. আপনি কি এমন একটা জায়গায় পৌঁছেছিলেন যেখান থেকে প্রায় আর ফিরে আসা যায় না? 

এই হলো গিয়ে গ্রেইসন স্কেলে উল্লিখিত ষোলোটি প্রশ্ন। এখন এই প্রতিটি প্রশ্নের উত্তরের ধরণ অনুসারে, ০, ১ বা ২ গ্রেডিং করা হয়। যেমন এই শেষ প্রশ্নটিই ধরা যাক, 'আপনি কি এমন একটা জায়গায় পৌঁছেছিলেন যেখান থেকে প্রায় আর ফিরে আসা যায় না?' এই প্রশ্নের উত্তর যদি "না" হয় তবে তার জন্য বরাদ্দ নম্বর হলো '০', যদি উত্তর হয় এরকম-"আমি নিজে সচেতনভাবে জীবনে ফিরে আসার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম" তাহলে তার জন্য বরাদ্দ নম্বর হলো '১', আর যদি উত্তরে NDE অভিজ্ঞতাসম্পন্ন মানুষটি বলেন যে-"আমি একটি বাধার সম্মুখীন হয়েছিলাম যে বাধাটি পার হবার অনুমতি ছিল না। বা আমায় জোর করে ফেরত পাঠানো হয়েছে" তাহলে তার জন্য বরাদ্দ নম্বর হলো '২'। এখন এইসবগুলি প্রশ্নের মিলিত উত্তর ৭ বা তার বেশি হলে তবেই ধরা হয় যে আদৌ মানুষটির near death অভিজ্ঞতা হয়েছে। 
এখন ১ থেকে ৪ নম্বর প্রশ্ন হলো cognitive component, ৫ থেকে ৮ নম্বর প্রশ্ন হলো affective component, ৯ থেকে ১২ নম্বর প্রশ্ন হলো paranormal component এবং ১৩ থেকে ১৬ নম্বর প্রশ্ন হলো transcendental component. কোন ধরণের প্রশ্নে মানুষটির স্কোর বেশি হচ্ছে তার ওপরে মানুষটির অভিজ্ঞতার ধরণ নির্ণীত হয়। 
তাঁরা যা যা অভিজ্ঞতা বা অনুভূতির কথা বলেছেন সেসবের ওপর ভিত্তি করে ১৫৮ জন NDE সম্পন্ন মানুষের ওপর করা সাম্প্রতিকতম আর্টিকেল পাচ্ছি এই বছরেরই অর্থাৎ ২০২০ -র জানুয়ারিতে প্লস ওয়ান (PLoS One) জার্নালে প্রকাশিত। সেখানে গ্রেইসন স্কেলে করা প্রশ্নগুলো ছাড়াও নিজেদের ভাষায় (Descriptive) তাদের অভিজ্ঞতা বর্ণনা করতে বলা হয়েছিল। তাতে গ্রেইসন স্কেলে বেঁধে দেওয়া প্রশ্নোত্তরের গন্ডি তা থাকে না। তাতে তাঁরা যে কথা গুলি বলেছেন তার মাধ্যমেও NDE -র মূল ব্যাপারটাকে খানিকটা বোঝা বা ধারণা করা যাচ্ছে। এখানে মূলত তাঁরা NDE কে বর্ণনা করতে যে যে শব্দ বা শব্দবন্ধ বর্ণনা করেছেন তার প্রকৃতি মূলত তিন ধরণের: visual perceptions, emotions and spatial components অর্থাৎ দেখা, অনুভব করা বা অবস্থানগত বৈশিষ্ট্য। 

এবারে কিছু উল্লেখযোগ্য স্টাডির কথা বলি যা পাবমেড থেকে আপাতত পাচ্ছি। অবশ্যই এছাড়াও অজস্র স্টাডি আছে যাতে ইনভেস্টিগেটররা NDE-র ঘটনাগুলিকে কেস স্টাডি হিসেবে প্রকাশ করেছেন। আমি সেই কেস স্টাডিগুলি আপাতত বলছিনা। বলছি সেই স্টাডিগুলোই যেগুলিতে গবেষকরা NDE-র কিছু অন্তর্গত কারণ, এসোসিয়েশন বা নিউরোনাল পরিবর্তনের কথা আন্দাজ করেছেন (অবশ্যই কারণসহ) বা করার চেষ্টা করেছেন আমাদের বর্তমান বিজ্ঞানে ব্যবহৃত জ্ঞান, থিওরি বা যন্ত্রপাতিতে যতটুকু মাপা সম্ভব আর কি, তাই দিয়ে।

NDE-র কারণ হিসেবে সবচাইতে প্রচলিত থিওরিটি হলো দৃষ্টিভ্রম বা হ্যালুসিনেশন। যদিও বর্তমানে গুচ্ছ গুচ্ছ এমন NDE কেসের কথা পাওয়া যাচ্ছে যা কেবলমাত্র একটি প্রায় মৃত মস্তিষ্কের বিভ্রম বা হ্যালুসিনেশন বলে ব্যাখ্যা করা যাচ্ছে না। এবিষয়ে সাম্প্রতিকতম আর্টিকেলটা পাচ্ছি এই বছরের (২০২০) মার্চ মাসে প্রকাশিত এক্সপ্লোর জার্নালে। প্রকাশ করেছেন Institute of Neuroscience, Department of Human Physiology, University of Oregon এর গবেষকরা। সেখানে ৩২ বছর বয়সী একজন চিকিৎসকের তৃতীয় সন্তানের জন্ম দিতে গিয়ে কার্ডিয়াক এরেস্ট হয় এবং তাঁর NDE-র অভিজ্ঞতা হয়। তারপর তিনি নিজেই তাঁর কেস অত্যন্ত বিশদভাবে পরীক্ষা করে মূলত দুটি সিদ্ধান্তের কথা এই রিপোর্টে প্রকাশ করেন যে, ১) আমাদের বস্তুগত ধারণা অনুসারে, মানুষের চেতনা (Consciousness) যদি শুধুমাত্র মানুষের মস্তিস্ক থেকে তৈরী হয় তবে তা দিয়ে NDE-র সময়, মানুষের যে যে ইন্দ্রিয়গত অনুভূতি হয় তাকে ব্যাখ্যা করা অসম্ভব। এবং ২) NDE-র পরে মানুষের চেতনা (Consciousness) সম্পর্কে মূল ধারণাটিই পাল্টে যায়।এই দ্বিতীয় সিদ্ধান্তটির অবশ্য ভুরি ভুরি প্রমাণ আছে। জীবন সম্পর্কে, ধারণার আমূল পরিবর্তন, সাংঘাতিক একটা চরিত্রগত পরিবর্তন (অবশ্যই ভালোর দিকে), নেশা ছেড়ে দেওয়া, আলস্য ছেড়ে জীবনকে গুরুত্ব দেওয়া ইত্যাদি life changing ঘটনার অজস্র উদাহরণ আছে NDE-র পর। এমনকি Suicidal প্রকৃতির মানুষ বা post traumatic stress disorder এর মতো long term চিকিৎসাধীন রোগীদেরও NDE-র পর সম্পূর্ণ অন্যরকম মানুষ হয়ে যাবার বেশ কিছু প্রমান বা কেস স্টাডির উল্লেখ পাওয়া যায়। গত বছরে জার্মানি এবং ডেনমার্কের একাধিক বিশ্ববিদ্যালয় এবং গবেষণাকেন্দ্র থেকে প্রকাশিত একটি আর্টিকেলের কথা বলি, যেখানে পৃথিবীর পঁয়ত্রিশত দেশ থেকে ১০৩৭ জন মানুষের ওপর পরীক্ষা করে দেখা হয় এবং এঁদের ৮১ জনের মধ্যে মানে প্রায় ৭.৮% মানুষের NDE ছিল। এই পরীক্ষায় আর একটি বিষয় উঠে আসে। সেটি হলো, এই ৮১ জনের মধ্যে ৩৩ জনের একটি বিষয় মিল ছিল সেটি হলো মাইগ্রেন অরা। অর্থাৎ খুব সোজা কোথায় বললে, মাইগ্রেনেই মাথা ব্যাথার সময় তাঁরা উজ্জ্বল একটি আলোর উৎস দেখতে পান। অর্থাৎ মাইগ্রেন অরা সংক্রান্ত স্নায়বিক কার্যকলাপ বোঝা গেলে তার কিছুটা দিয়ে NDE -র ধারণাটিকে নেড়েচেড়ে দেখা যেতে পারে ভবিষ্যতে। আবার ওই গতবছরেরই কথা, Medical hypothesis জার্নালে Center for Integrative Medicine, University of Arizona College of Medicine থেকে একটি রিভিউ প্রকাশ করলেন ড: জেমস লেক। সেখানে তিনি বললেন, NDE একটি "Higher cognitive trait" যা জেনেটিক, বা এপিজেনেটিক উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া সম্ভব। এখানে, আমার একটা ব্যক্তিগত wild চিন্তার কথা বলি। মনে করা যাক, NDE বা ঐধরণের অভিজ্ঞতাগুলিকে যদি আধ্যাত্মিক (Spiritual) অভিজ্ঞতা হিসেবে মনে করি এই মুহূর্তের জন্য, তাহলে "Higher cognitive trait", এই কথাটিকে খানিক চেনা চেনা লাগে। আমাদের দেশে সেজন্যই কি বলা হয় যে যিনি মনের দিক থেকে (In case of consciousness) যত উন্নত ততই তাঁর আধ্যাত্মিক অভিজ্ঞতা তত স্পষ্ট? দু ক্ষেত্রেই মোদ্দা কথাটা একই কেবল টার্মিনোলজিটা আলাদা?                

NDE -র স্টাডি সব থেকে বেশি হয়েছে হাসপাতালের "terminally  ill" রোগীদের ওপরে, বা কার্ডিয়াক ইউনিটের ক্রিটিকাল অস্ত্রপ্রচারের রোগীদের ওপরে। সাধারণ হাসপাতালের রোগীদের ওপর একটি উল্লেখযোগ্য স্টাডি পাওয়া যাচ্ছে শ্রীলংকার কলম্বো নর্থ টিচিং হাসপাতাল থেকে। ৮২৬ জন সাধারণ রোগীর ওপর গ্রেইসন স্কেল অনুসারে পরীক্ষা করে ৩% মানুষের মধ্যে NDE চিহ্নিত করতে পেরেছেন তাঁরা। এছাড়া অজস্র স্টাডি হয়েছে কার্ডিয়াক সার্জিক্যাল ইউনিটগুলোতে। সমস্যা একটা জায়গায় আটকে আছে যে ঠিক ওই অভিজ্ঞতা ঘটাকালীন শারীরিক, স্নায়বিক পরিবর্তনগুলি খুব ভালো করে মাপা বা পর্যবেক্ষণ করা সম্ভব হয়না এখনো পর্যন্ত। ফলে ফিজিওলজিক পরিবর্তনগুলি এখনো অধরা। আশ্চর্য্যের বিষয় এই যে ওই যে ওপরের প্রশ্নাবলী বললাম না, মানুষটির দেশ, জাতি, বড় হয়ে ওঠা, আধাত্মিকতা এবং ধর্মীয় মতবাদ বা যদি সে নাস্তিকও হয়, সমস্ত ভিন্নতা স্বত্তেও সব ক্ষেত্রেই ঘুরিয়ে ফিরিয়ে এই ধরণের অভিজ্ঞতার কথাই তাঁরা বলেন। সাধারণত এই জাতীয় অভিজ্ঞতায় ধর্মবিশ্বাসের সাথে সম্পর্ক থাকার ভাবনাটা খুব স্বাভাবিক। কিন্তু ১৯৮৪ সালের একটি স্টাডি হয়েছিল তাতে বিভিন্ন ধর্মীয় বিশ্বাসের মানুষের সাথে NDE -র গভীরতা সম্পর্কে কাজ হয়েছিল। এই স্টাডিতে SA McLauhlin ধর্মীয় বিশ্বাসের সাথে NDE -র কোনো সম্পর্ক খুঁজে পাননি। বছর দুই আগে Imperial College London, London, এবং University Hospital of Liège, Belgium এর বিজ্ঞানীদের দ্বারা প্রকাশিত আর একটি গুরুত্বপূর্ণ স্টাডির কথা এখানে বলি, আমাদের শরীরে সেরোটোনার্জিক নিউরন, যা কিনা আমাদের সামগ্রিক আনন্দে থাকার ব্যাপারটা খানিকটা হলেও নিয়ন্ত্রণ করে তা থেকে উৎপন্ন N,N-Dimethyltryptamine (DMT) প্রয়োগ করেছিলেন ১৩ জন সুস্থ মানুষের দেহে এবং তারপর পরে আলাদা ভাবে তাঁদের দেহে প্লাসিবো (placebo) কিছু তরলও প্রয়োগ করেছিলেন। অবশ্যই কখন কোনটা প্রয়োগ করা হচ্ছে সেসময় তাঁদের সেটি জানানো হয়নি। অর্থাৎ যাকে বলে 'within-subjects placebo-controled study' এবং দুই ক্ষেত্রেই NDE -র বৈশিষ্ট্যগুলি পরীক্ষা করা হয়েছিল। এবং দেখা গিয়েছিলো, DMT প্রয়োগের পর তাদের NDE মতো বেশ কিছু অনুভূতি হয়েছিল। অর্থাৎ এটিও NDE -কে স্নায়বিকভাবে ব্যাখ্যা করার আরো একটি পদ্ধতি হলেও হতে পারে।

আরো কিছু গবেষনা হয়েছে NDE নিয়ে। সবই আপাতত খুবই প্রাথমিক পর্যায়ে। তবুও আপাতত যা পাওয়া যাচ্ছে সেগুলোর গল্প নিয়ে আবার পরের দিন ফিরে আসছি।
আজ এপর্যন্তই। 
ভালো থাকবেন।
অর্পিতা।             
            

Wednesday 17 June 2020

Hitchcock Nature Center

Today’s trail. In the morning, usual way to the lab has shown an unusual combination of colors. The bright yellow speed caution board in the foreground on a background of a grayish cloudy sky. The chimney usually smokes in the morning but today it was sleeping I guess.

After completion of a routine day we headed towards Hitchcock Nature Center, our nearest and easy way out to collect our scattered mind.

We took our usual trail to the west end of the nature center. It gives us the majestic sunset at the end of the trail every time. Today the trail was not crowded, only a family for photo-shooting during the upward trail and a father-kid camping duo during the way back said “hi” to us.

End of the winter, the forest is flooded with green foliages and full of birds. We do not know the name of the birds but that did not hinder us to be a part of the grand ceremony of ending of a day.

With every shades of green, serenity of sunset colors, whistle of a passing train on a single track, choir of birds and whispering wind in the years old oaks. I touched the leaves and the trunks of them during my way back and took the feeling of the rough surface with me. Every time I touch the rough trunk of an aged tree, I feel a touch of someone, I can depend on. Like the elderly person of the family, like a loving, wise grandpa.

We were returning with the last ray of the day, with bunch of busy butterflies and the velvety bees. A hummingbird also said good night to us from a bunch of yellow grass flowers. They may have a specific name but I do not bother to know the names of plants and the animals always. The “yellow grass flowers” is enough to memorize their beauty under a green canopy and a serene ray of sun.

A small beagle kissed me today during the returning trail. He was going with his human friends for a walk towards the same trail. After a long three months time this was the first touch of a dog for me due to Covid-19. This is another friendly touch that I never miss to realize.

We started towards Hitchcock with a dumbed mood. The jungle filled us with part of her green, part of her silence, part of her sunlight and part of her chorus of natural sounds.

We returned with the flood of nature within us. A place who never refuses us.

https://youtu.be/d2mBQkod4as

Saturday 13 June 2020

সেদিন হঠাৎ করেই


সাতই মার্চ ২০২০, দিনটা শনিবার। কোনো পড়ে থাকা কাজ নেই যা সেইদিনই শেষ করতে হবে। মিডওয়েস্টের মারকাটারি ঠান্ডাটা একটু সহ্য করার মত অবস্থায় এসে পৌঁছেছে। সুতরাং মনটা ঘরে থাকছিল না। স্যান্ডহিল ক্রেনরা ফিরছিলো তাদের বাৎসরিক পরিক্রমা সেরে, সে খবর পেয়েছিলাম। নেব্রাস্কার পুব দিক ঘেঁষে এঁকেবেঁকে বয়ে যাওয়া প্ল্যাট নদীর ধারে ধারে ওদের অস্থায়ী বসবাস শীতের শেষে। কিন্তু তার জন্য আমাদের পশ্চিমে ঘন্টা দেড়-দুই উজিয়ে যেতে হবে, ওদের সাথে মোলাকাত সেরে সন্ধ্যের আগেই ফিরে আসতে হবে। ফিরে আসার সময়ের বাধ্যবাধকতার ব্যাপারটা একটা প্ল্যানিং এর কারণে। সেই যে ছোটবেলায় স্কুলে মাঝে মাঝে মুড়ির পিকনিক হতো না, তখন অবশ্য 'ফিস্ট' বলতাম। সমস্ত স্কুলে হতো কিনা জানিনা। আমাদের মতো মফস্বলের গার্লস স্কুলগুলোতে হতো জানি। সেরকমই একটা মুড়ির ফিস্ট হবার কথা ছিল দুই একদা মফস্বলী গার্লস স্কুলে পড়া মূল- উৎপাটিত মেয়ের উদ্যোগে। পুরোনো স্বাদে ফেরা মাঝে মধ্যে, এই আর কি! এই নস্ট্যালজিক সময়ে ফিরে যাবার আকর্ষণ কম নয় অথচ এমন একটা পড়ে পাওয়া দিনে বাড়িতে বসে থাকতেও ইচ্ছে করছে না। শেষ পর্যন্ত বেরিয়ে পড়ার দিকেই মন বেশি টানলো।  সু কে বললাম তোর বাড়ির মুড়ির পার্টিটা বরং পরের সপ্তাহে পিছিয়ে দেওয়া যাক। আজ বরং বক দেখে আসি চল। করোনার চক্রান্তে সে পার্টি এখনো মুলতুবি আছে যদিও। সু আর বড়দাদাও ছিল ল্যাবে। দুটোকেই ভুজুং ভাজুং দিয়ে বগলদাবা করলাম। অমন দুম করে বেরোনো একটু কঠিন। তাদের কাজ শেষ হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করা হলো তারপর চারজনে বেরিয়ে পড়লাম। দুপুরের খাওয়া সেরকম কিছু হয়নি ওদের। রাস্তাতেই অল্পসল্প স্যান্ডউইচ - ফলমূল জাতীয় কিছু দিয়ে দুপুরের জ্বলন্ত খিদে সামলে সাঁই-সাঁই করে এগোচ্ছি ইন্টারস্টেট ৮০ ধরে সিধে পশ্চিমমুখো। সূর্যাস্তের অন্তত এক দেড় ঘন্টা আগে পৌঁছাতে হবে নইলে অন্ধকার হয়ে পড়লে ওদের দেখবো কি করে? আর আমরা যে জায়গা লক্ষ্য করে বেরিয়েছি সে জায়গায় ওদের কোনো বড়ো ঝাঁক নাও থাকতে পারে। সেক্ষেত্রে একটু আশেপাশে খোঁজাখুঁজি করতে সময় লাগবে। মাঝে একজায়গায় থামা হলো। তখন সবে এখানে করোনা ঘাঁটি গাড়তে শুরু হয়েছে। তেমন ভাবে সকলকে পঙ্গু করে দিতে পারেনি তখনও।

আমরা পৌঁছলাম কার্নে। নেব্রাস্কার কার্নে, নর্থ প্ল্যাট, গ্র্যান্ড আইল্যান্ড - প্ল্যাট নদীর অববাহিকায় এইসমস্ত জায়গা বছরের দুবার প্রায় আড়াইশো প্রজাতির পরিযায়ী পাখির বিশ্রামস্থল হয়ে দাঁড়ায়। এযাত্রা শীতের শেষে ঘরে ফেরার পথে আমরা ওদের সাথে দেখা করতে এসেছি। কিন্তু আমাদের পুরোনো জায়গায় পৌঁছে দেখলাম এবছর ওই জায়গায় কোনো বড় পাখির ঝাঁক নেই। তবুও নদীর কাছে নেমে পায়ে হেঁটে শুকনো ঘাসের জঙ্গলে জঙ্গলে বেশ কিছুটা এগিয়েও তেমন লাভ হলো না। দূরে নদীর ঠিক মাঝখানে একখানা চড়া তৈরী হয়েছে। সেখানে একঝাঁক পাখি উঠছে নামছে দেখতে পাচ্ছি। কিন্তু সে অনেক দূরে। সামনে দিয়ে মাঝে সাঝে পাঁচ-সাতটি পাখির ঝাঁক আমাদের দেখতে পেয়ে কর্কশ গলায় ধমক দিতে দিয়ে উড়ে যাচ্ছে। কিন্তু ক্যামেরাধারীদের জন্য তা যথেষ্ট নয়। এদিকে সূর্য পশ্চিমে ঢলে পড়ছে প্রায়। আমরা পড়ি কি মরি করে সূর্য্যের সাথে পাল্লা দিয়ে ছুটে আবার অন্য রাস্তা দিয়ে নদীর অন্য আর একটি দিকে পৌঁছাতে চেষ্টা করলাম। কিন্তু তাড়াহুড়োয় যেখানে গিয়ে পৌঁছালাম সে রাস্তা একটি প্রাইভেট ফার্মহাউসের সামনে গিয়ে শেষ হয়ে গেছে। নদীর ধারে পৌঁছাতে পারলাম না ঠিকই, কিন্তু যেখান দিয়ে এলাম সেটি ফসল ক্ষেতের মাঝখান দিয়ে গ্রাম্য রাস্তা। এবং ফসল কাটার পর, পরে থাকা ভুট্টার দানা খেতে সেসব ক্ষেতে নেমেছে অসংখ্য পরিযায়ী পাখি। তাদের কর্কশ গলার মিলিত কোরাসে সরগরম পুরো জায়গাটা। নদীতে না পৌঁছাতে না পেরে ভালোই হলো। পড়ন্ত সূর্য্যের কমলা আকাশের প্রেক্ষাপটে অজস্র বিশালাকায় পাখির ঝাঁক। উড়ছে, নামছে, নানানরকম আকৃতি তৈরী করছে ঝাঁকের, নিজেদের মধ্যে কথা বলছে। সে এক মহোৎসব যেন। জায়গাটা যেহেতু পক্ষিসন্ধানী টুরিস্টদের সাধারণ রুটের বাইরে, ইতিউতি দুএকটি ফার্মহাউস আর দিগন্ত বিস্তৃত ফসলক্ষেতের মধ্যেকার একটি গন্ডগ্রাম বিশেষ, সেহেতু অনাবশ্যক মনুষ্যসৃষ্ট শব্দ সেখানে অমিল। আমরা চারজনে প্রাণভরে ছবি তুললাম। মন ভরে তাদের সমবেত কথোপকথন শুনলাম। লাল আকাশের প্রেক্ষাপটে ঝাঁকেঝাঁকে পাখির সারি আর তাদেরই সৃষ্টি করা কোরাসে, উদাত্ত হাওয়া আর মধ্যে নেব্রাস্কার বিখ্যাত আদিগন্ত সমভূমির মাঝখানে ব্যোমকে গিয়ে দাঁড়িয়েই রইলাম কিছুক্ষণ।

ফেরার জন্য পিছন ফিরলাম যখন ততক্ষনে অন্ধকার হতে শুরু করেছে। কি ভাবছেন ভ্রমণ শেষ? আরে না না, এত সহজে ঘর ঢুকবো বলে লিখছি নাকি? বলছি সব আস্তে আস্তে।

গ্রামের মেঠো রাস্তায় ঢুকে গিয়েছিলাম অনেকটা। ফলে বড় রাস্তায় এসে পড়তে বেশ কিছুটা সময় লাগলো। এদিকে সেই যে বাড়ি থেকে বেরিয়ে মাঝে একটি জায়গায় দাঁড়িয়েছিলাম তারপর থেকে জলযোগ হয়েছে কিঞ্চিৎ কিন্তু জলবিয়োগের অবকাশ পাইনি। সেই থেকে দৌড়েছি। এখন ফেরার আগে সে প্রয়োজন সকলেরই উত্তাল হয়ে উঠেছে এবং সাথে পেটে চোঁ চোঁ করছে খিদে। পথের পাশে একটি ছোট দোকানে দাঁড়ানো স্থির হলো। নেব্রাস্কার এরকম ভেতরদিকের গ্রামে ভারতীয় মুখের আনাগোনা বেশি নয় এখনও। ফলে কিছু জায়গায় এখনো পুরোনো দিনের মানুষেরা দুবার ফিরে তাকান। নতুন প্রজন্মের কমবয়সী দোকানি মেয়েদুটি ভারী মিষ্টি। দোকানটি যেমন পথের পাশের দোকান হয় সেরকমই হরেকরকম্বা গোত্রীয়। আমরা কিছু খাবার দাবার কিনলাম। সাথে ওয়াসাবি পেস্ট লাগানো রোস্টেড সবুজ মটর একপ্যাকেট। সেই বস্তু ভুল করে একমুঠো একসাথে মুখে ফেলে দেবার পরেই টাং করে মাথার সমস্ত স্নায়ুতন্তুর জট খুলে যায়, চোখ থেকে দরদরিয়ে জল পড়তে থাকে, নাকের ভেতরে এককিলো নস্যির সমান জ্বলন শুরু হয়, মুহূর্তে ক্লান্তি গায়েব হয়ে মাথা পরিষ্কার হয়। আহা! সে স্বর্গীয় গাট্টাটি গলাধঃকরণ করেই কিনা জানিনা আর একটি চিন্তার উদয় হলো মাথায়। বললুম, এখনই বাড়ি না ফিরে যদি আর একটু দূরে কোথাও গিয়ে, একটা রাত্তির কাটিয়ে কাল আর একটু এদিক ওদিক দেখে তারপর নয় কাল বিকেল নাগাদ ফিরি? বলেই চোরা চোখে সু কে একটু দেখে নিলুম। প্রথম কিলটা আসলে ওর দিক থেকেই আসবে। আমরা নয় আগে থেকেই এই শনি-রবি কাজ করবো না ঠিক করেই রেখেছিলাম। কিন্তু বাকি দুজনকে তো ল্যাব থেকে ফুসলিয়ে নিয়ে আসা হয়েছে। বড়দাদা নয় খানিক বড়ো হয়ে গেছে বলে নিজের কাজ নিজের সময়মত করার খানিক স্বাধীনতা আছে কিন্তু সু এর তা এখনো নেই। ফলে সে খানিক কাঁইকিচির জুড়লে। কিন্তু দোকানেরই এক কোণে রাখা ছোট দুটি টেবিলে বসে খেতে খেতে শেষ পর্যন্ত সমস্ত নেগেটিভ ভোট পজেটিভ হয়ে গেলো। এক্সপেরিমেন্টগুলোর কাল বিকেল পর্যন্ত অপেক্ষা করানোর ব্যবস্থা হিসেব করা গেলো। সকলেই তৈরী কোথাও একটা যেতে। এখন প্রশ্ন যাবোটা কোথায়? 

এই আদিগন্ত প্রেইরি অঞ্চলে ঘাসজমি ছাড়া দেখার বিশেষ কিছু নেই। তা ঘাসজমিই দেখতে পারি কিন্তু থাকার জায়গা একটি লাগবে রাতের মতো। চারটি ফোনের ম্যাপ খুলে এদিক ওদিকের বিস্তর গবেষণা করে স্থির হলো আমরা যাবো নিওব্রারা স্টেট পার্ক। সেটি এখান থেকে সিধা উত্তরে ২০০ মাইল। ঘন্টা তিনেক লাগবে। নেব্রাস্কা আর সাউথ ডাকোটার সীমান্ত বরাবর নিওব্রারা এবং মিসৌরি নদীর সঙ্গমস্থলের একটি জঙ্গুলে জায়গা। সুবিধেটা এই যে  আগামীকাল সেখান থেকে কোনাকুনি দক্ষিণ পুব মুখো রওনা হলে সোজা ওমাহাতে গিয়ে পড়া যাবে। পথ অনেক কমে যাবে। সু বিকেল বিকেল ফিরে গিয়ে ঘানিগাছটায় আবার জুড়ে যেতে পারবে। সুতরাং নিওব্রারাই স্থির হলো। আবার কিছু এদিক ওদিক ফোনকলের পর নিওব্রারার দক্ষিণে নেলি (Neligh) তে একখানা মোটেলে রাতের মত ঠাঁই মিলবার আশ্বাসও পাওয়া গেলো। সুতরাং চল পানসি নেলি পানে।

নেলি খুবই ছোট্ট গ্রাম। মাত্র দেড়হাজার মানুষের বাস। উত্তরে নিওব্রারা থেকে পনকা (Ponca) উপজাতিদের যখন তাড়িয়ে ঠেলে দেওয়া হচ্ছিলো নিচে ওকলাহামার দিকে তখন সেই পরিযায়ী পনকা উপজাতির অসংখ্য মানুষ রাস্তায় মারা যান। পথের কষ্ট সব যুগেই সমস্ত মানুষের জন্যই সমান। সেসময় এই নেলির কাছেই মারা যায় পনকা উপজাতির একজন গোষ্ঠীপতির দেড়বছর বয়সী মেয়ে। তার সমাধি এখনো আছে নেলিতে।  এই সাউথ ডাকোটা থেকে নিচে ওকলাহামার মাঝে বহু গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটেছে পুরোনো কালে। আমেরিকান আদি ইন্ডিয়ান উপজাতির বিভিন্ন গোষ্ঠী ছিল ছড়িয়ে ছিটিয়ে এই অঞ্চলে। ইউরোপীয় ঔপনিবেশিকতার চাপে ক্রমশই তারা নিচের দিকে সরে যেতে বাধ্য হয়। আর সাথে এই আইওয়া, নেব্রাস্কা, সাউথ ডাকোটা, ওকলাহামা,আর্কানসা এসব জায়গায় ফেলে যেতে থাকে অজস্র ইতিহাস। এই অঞ্চলের সেসময়ের গুরুত্বপূর্ণ শহর ছিল ওমাহা। আমাদের বর্তমান কর্মস্থল। ওমাহার আশেপাশে এধরণের অসংখ্য ইতিহাস দেখা যায়।  তেমন করে নজর চলে না যদিও। হেরো মানুষের ইতিহাস-প্রদর্শনীতে দয়া থাকে, করুণা থাকে, বিজয়ীর প্রচ্ছন্ন গর্ব থাকে। কিন্তু বিজয়ীর ইতিহাসের প্রদর্শনীর মতো জাঁক তার কোথায়? সুতরাং আমেরিকান-ইন্ডিয়ান গোষ্ঠীপতিদের নামে হ্রদ বা একটি বনাঞ্চলের নাম দেওয়া হয় মাত্র নতুন পৃথিবীতে। বাকি ইতিহাসের খবর জানতে গেলে ইউনিভার্সিটির নেটিভ-আমেরিকান ইতিহাসের ছাত্র হতে হবে। তা ভিন্ন বিশেষ কিছুই বাকি নেই বাইরের জগতে। 

নেলিতেও কিছু নেই। কয়েক ঘর মানুষের বাস ইতিউতি। একটি ছোট বাজারপাড়া। একটিই রাস্তা আর তার পাশেই আমাদের এই রাতের আস্তানা। সেখানে পৌঁছাতে পৌঁছাতে আমাদের প্রায় রাত এগারোটা বাজলো। শুনশান চারিদিক। একটি ছোট আলো জ্বলছে মোটেলের নাম দেখার জন্য সে আলো যথেষ্ট। আর কোনো কাজ সে আলোর দ্বারা হবে না। রাস্তার গায়ে লাগানো একটা পুঁচকি পার্কিং-এর জায়গা আর তার গা ঘেঁষে ঘেঁষে L -আকৃতির গোটা সাত-আট ঘর। এই হলো নেলির মোটেলটি। আস্ত একটি ভূতুড়ে গল্পের পটভূমি যেন। ঘুমন্ত নেলি গ্রামটিতে পৌঁছে আমরা রাস্তা থেকেই সাঁৎ করে ঢুকে গেলাম মোটেলের পার্কিং লটে -"এই তো এইটাই এইটাই।" কালো রঙের আরো একটি জগদ্দল ট্রাক দাঁড়িয়ে আছে অন্ধকারে মিশে গিয়ে। তার পাশেই আমাদের পুঁচকে গাড়িটাকে দাঁড়াতে বলে চারমূর্তি নামলাম। এদিক ওদিক তাকিয়ে কাউকেই দেখতে পেলাম না।  আমাদের ঘরের চাবিটা নেবো কোথা থেকে? অনেকসময় এখানে মোটেলের অফিস খোলা না থাকলে অফিসের সামনে পথিকের নাম লেখা বন্ধ খামে করে চাবি রাখা থাকে। অফিসটা খুঁজে বের করতে হবে। সবই অন্ধকার। সমস্ত দরজাই বন্ধ। সামনে জাঁদরেল সাইজের গুঁড়ি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে একটা বিশাল ঝুপসি মহীরুহ। কি গাছ কে জানে! জায়গাটা রাস্তার আলোর থেকে আড়াল করে আরো বেশি অন্ধকার করে তুলেছে। কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে এদিক ওদিক তাকাচ্ছি, এমন সময় পায়ের কাছে লোমশ কি যেন একটা র উত্তাপ। তাকিয়ে দেখি মাটির কাছাকাছি সবুজ দুটো জ্বলজ্বলে চোখ। ওরকম পরিবেশে বুকটা যে ধক করে ওঠেনি তা নয়, তবে আমার অনুভূতিগুলো বোধহয় একটুখানি ভোঁতা। এই পরিবেশে ওরকম দুটো চোখ দেখে আমি ভয় পেরিয়ে উঠে দেখলাম, কালোর সাথে মিশে থাকা কুচ্কুচে কালো একটা গোবদা বেড়াল আমাদের মোটেলের তরফ থেকে অভ্যর্থনা জানাচ্ছে। আমাদের অফিসঘর খুঁজতে দেখেই বোধহয় বাঁদিকের একটা সরু দরজার সামনে গিয়ে বললো, "ম্যাঁও।" সেই দরজার ঐপারে টিমটিমে একটা আলো জ্বলছে। কাঁচের বাইরে থেকে একটি বড় এন্টিলোপের মাথার স্টাফিং দেখা যাচ্ছে দেওয়ালে। কোথাও কোনো লোকজন দেখা যাচ্ছে না। বেড়াল পায়ের চারপাশে ঘোরে আর বলে "ম্যাঁও।" শেষকালে খাঁটি ভারতীয় পদ্ধতিতে ঠকঠক করতে শুরু করতে, ভেতর থেকে বেরিয়ে এলেন এক প্রৌঢ় মানুষ। আমাদের সকলের চেয়ে তিনি বেশি শক্তি ধরেন এতটাই গাঁট্টাগোট্টা চেহারা। পরনে সাদা টি-শার্ট আর বাদামি প্যান্ট। মাথায় মেক্সিকান হ্যাট। এই রাত্তিরেও মুখে সিগার। বাহুতে ট্যাটু। খাঁটি মধ্য-আমেরিকান চেহারা। চারজন টিংটিঙে বঙ্গসন্তানকে দেখে আশ্রয় প্রত্যাশী বলে চিনে নিতে ভুল হলো না তাঁর। নাম ধাম, সনাক্তকরণ ইত্যাদি মিটিয়ে নিতে অফিসে ঢোকা হলো। অফিস বলতে, বাড়ির সামনের বারান্দাটিতে একটি কাউন্টার বানানো আর কাউন্টারের পেছনে একটি চেয়ার। ব্যাস এই অফিস। সাধারণত এইধরণের রাস্তার পাশে মোটেলগুলোতে প্রাতরাশের ব্যবস্থা থাকে। এটিতে সেসবের বালাই নেই। প্রাতরাশের প্রত্যাশী আমরা ছিলামও না যদিও। নেলির মতো জায়গায় হুট্ করে চলে এসে থাকার জন্য একটি ঘর, ঘুমোবার জন্য একটি বিছানা পাচ্ছি এই ঢের। মোটেলের মালিক বেজায় গম্ভীর। ঘুম থেকে উঠে এসেছেন কিনা কে জানে! ঝটপট কাজ সেরে চাবি ফেলে দিলেন কাউন্টারে। আমরাও মানে মানে চাবি নিয়ে বেরিয়ে এলাম। কিন্তু বিশেষ দর্শনীয় বিষয়টি হলো, এই যে মিনিট পাঁচেক সময় আমরা অফিস ঘরটিতে ছিলাম, তার মধ্যে আমি চারিদিকে চোখ ছড়িয়ে অন্তত গোটা পঞ্চাশেক পশু পাখির স্টাফিং দেখতে পেয়েছি। কি নেই তার মধ্যে! বেশ কয়েকটি এন্টিলোপের মাথা, তার একটা বাইরে থেকে দেখেছি বললামই। এছাড়া, ঈগল, পেঁচা, ববক্যাট , শেয়াল, রাকুন। এমনকি একখানি সাপ পর্যন্ত। অর্থাৎ আমাদের হোস্টিং করছেন একজন শিকারী। 

 চার্ বঙ্গসন্তানের রাত এগারোটার সময় অপরিকল্পিত ভাবে চলে আসা মধ্য-পশ্চিম আমেরিকার এক শুনশান গ্রামে, কুচকুচে কালো বেড়ালের অভ্যর্থনা, নিঝুম মোটেলে গম্ভীর শিকারী মালিক, অফিসঘরে ঠাসা মৃত জানোয়ারের দেহ! আমার ভোঁতা ইন্দ্রিয়ের পক্ষেও যথেষ্ট ছিল সেদিন। জোরদার ভূতুড়ে গল্পের মশলা একেবারে। 

তারপর আর কি? সাথে তো জামাকাপড়-ব্রাশ-পেস্ট কিছুই ছিল না রাত্রিবাসের জন্য। ব্রাশ -পেস্টের ব্যবস্থা করা গিয়েছিলো গতরাতের ওই হরেকরকম্বা দোকান থেকেই। কিন্তু জামাকাপড় বদলাবার বালাই নেই। চাবি দিয়ে কোণার একখানা ঘর খুলে চারজনে দুটো বিছানায় ফ্ল্যাট হয়ে গেলাম। বেড়াল আমাদের ঘর পর্যন্ত পৌঁছে দিলো। আমাদের ঘরের পাশেই দেখলাম তার ঘর। মানে একটি বড়সড় কাঠের বাক্স, তার ভেতরে মোটা করে খড়, কম্বলের বিছানা। অর্থাৎ ইনি বাড়ির ভেতরের পোষ্য নন। বাইরেই তাঁর চৌকিদারী। কালো শরীর আর সবুজ জ্বলজ্বলে চোখে প্রথমটা চমকে দিলেও দিব্য ভাবসাব করতে চান দেখলাম। কিন্তু আশ্চর্য পরদিন সকালে বেড়াল এবং তার মালিকের দেখা আর আমরা পাইনি। ঘরে চাবি রেখে ঘর খোলা রেখেই সাত সকালে স্নান সেরে বেরিয়ে পড়েছিলাম। রাতে অবশ্য নাক ডাকিয়ে দিব্য ঘুমিয়েছি। চারজনের মধ্যে তিনজনই নাক ডাকতে ওস্তাদ। ফলে সকালে উঠে দেখলাম সু এর মুখ রাগে গনগনে করছে। বেচারী একটুও ঘুমোতে পারেনি বাকি তিনজনের রাতভর কনসার্টের চোটে। নেলিতে একজায়গায় পেট ঠুসে খেয়ে নিওব্রারা স্টেট পার্কে গিয়ে পৌঁছলাম। নেলি অসাধারণ সুন্দর ভ্যালি। নেলি থেকে নিওব্রারার রাস্তাটি নেব্রাস্কার সুন্দরতম রাস্তাগুলির একটি। দু পাশে উঁচু-নিচু উপত্যকা। ফসলি জমি। মাঝে মাঝে লাল ছাদওয়ালা সাদা দেওয়ালের ফার্মহাউস। আর দৈত্যাকৃতি হাওয়াকল। একেবারে ক্যালেন্ডারের পাতার দেখা ছবিগুলোর মত সুন্দর। কিছুক্ষন চলার পর বাঁদিকে এসে পড়লো নিওব্রারা নদী। চুপ করে দেখার মত প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্য। নিওব্রারা স্টেট পার্কে পৌঁছে বাহনকে বিশ্রাম দিয়ে চারমূর্তি জঙ্গলে ঢুকলাম। জঙ্গলে হাঁটতে পারলে আর কিছু চাইনা আমি। অনেকটা ভেতর অবধি গিয়ে একজায়গায় বসে গল্পগাছা হলো। বেড়ানো, হাঁটা, দেখা, এ-ওর পেছনে লাগা এসব তো ছুতো। আসল কথা হলো আমরা চিরকালীন যে নেই রাজ্যে বাস করি, তাতে মাঝে মধ্যে শ্বাস ফেলতে না পারলে অবসাদ অবধারিত। নিজের নিজের হতাশাগুলো বেরোবার পথ পায় এই জলে জঙ্গলে একে ওপরের সাথে কথা ভাগ করে নিতে নিতে। কোনো কিছুরই আশু সমাধান নেই, তবুও একে অপরকে বলা যে, "সাথে আছি আমিও"- এই আর কি। ঘাসে পিঠ পেতে শুয়ে ওপরের নীল আকাশ থেকে আশ্বাস ধার করে নেওয়া। 

আর কি? ভ্রমণ শেষ। এবার ফেরার পালা। 

তারপর সেই কোনাকুনি পথে ওমাহামুখো হলাম আবার। মাঝে একজায়গায় জিরিয়ে নিয়ে বিকেল বিকেল ওমাহা পৌঁছে গেলাম। বড়দাদা এখানে আছে প্রায় এক দশক। অলিগলি চেনে সে। সেদিন আমাদের ছাগলের দলকে একখানি নতুন শাকের ক্ষেত দেখিয়েছিলো। তারপর থেকে সে ক্ষেতে বসে খাওয়া বন্ধ বলে আর ওমুখো হওয়া হয়নি। কিন্তু পরে নিশ্চয়ই যাবো। একখানি জাপানি সুশির দোকান। সেখানে খাবার পরিবেশনের ট্রেগুলি সব কাঠের নৌকাকৃতির। আমাদের খিদে পেয়েছিলো প্রচন্ড। সকালে সেই নেলির দোকানে খেয়েছি। তারপর মাঝে একটু চা-কফি পড়েছে পেটে। ভালো করে বসে খাওয়া হয়নি। ওমাহা পৌঁছাবার তাড়া ছিল। আমি আর সু বাথরুম ঘুরে এসে (সেখানে আমাদের দুদিনের ব্যবহৃত দোমড়ানো জামা, জল-জঙ্গলে হেঁটে কাদামাখা জুতো, হাওয়ায় জট পাকানো চুল ইত্যাদির মিলিত প্রয়াসে জবরদস্ত চেহারা দেখে সকলে কিরকম একটা চোখে তাকাচ্ছিলো। আমরা যদিও পাত্তা দিইনি। ডাঁটসে কাজ সেরে বেরিয়ে এসেছি।) দেখি পিনাকী আর বড়দাদা গুছিয়ে অর্ডার করে ফেলছে। "এটা একটা বলি?" "দুটো বলে দাও।" আমাদের খিদের পরিমাপ করে বেচারারা একটার জায়গায় চারতে করে অর্ডার করে ফেললো। তারপর অপেক্ষা করছি যখন, তখন দেখি পাশের টেবিলে আট-দশ জনের একটা পরিবারের জন্য টেবিল জোড়া একটা কাঠের নৌকা করে বিভিন্ন ধরণের সুশি এসেছে। সে দেখে আমরা বাংলায় চুটিয়ে নিন্দে-মান্দা সেরে একঢোক জল খেয়ে যখন সবে ঠান্ডা হয়ে বসেছি, দেখি আমাদের চারজনের জন্য ওই সমপরিমাণ সুশি আসছে ওরকমই একটা কাঠের নৌকায় চেপে। আমাদের চারজনের টেবিল ছোট। ওদের বড় টেবিলে অন্তত নৌকাটাকে রাখতে অসুবিধা হয়নি। আমাদের টেবিলে যখন ঠকাস করে নৌকাটাকে বসিয়ে দিয়ে গেল, তখন দেখলাম আর প্লেট রাখবার জায়গা পর্যন্ত নেই। অগত্যা সরাসরি নৌকার ওপরেই ঝাঁপিয়ে পড়লাম চারজন চারদিক থেকে। পেটপুরে খেয়ে, বাকিটা চার ভাগ করে ছাঁদা বেঁধে নিয়ে এসে পরের দিন পর্যন্ত খেলাম। 

পাশের টেবিলের লোকেরা খেয়ে উঠে যাবার সময় খাবারের পরিমাণ আড়চোখে দেখছিলো দেখেছি। তাতে যদিও আমাদের ঘন্টা!    

 

Wednesday 10 June 2020

চিঠি

মাস-দেড় দুই আগের কথা বোধহয়, তখনও বিপদ এসে বাসা বাঁধেনি মাথার উপর। অন্যের বিপদ দেখলে ভয় হয়, চিন্তা হয়। আতঙ্ক বোধহয় হয়না। কারণ বিপদটা অন্যের। জিমে ছিলাম কাকভোরে। বাইরে অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে শরীরটাকে সচল করার চেষ্টায় আছি। সামনে টিভির খবরে কেবলই মহামারী আর মৃত্যুর সচল সংবাদ পরিবেশিত হচ্ছে। প্রায় সবই ইউরোপ এবং চীনের খবর তখন। সাতসকালে পরিবেশিত সংবাদে জীবন না থাকলে সে সংবাদ চট করে কানে ঢোকে না আমার। আর আজকাল সংবাদ মানেই যেহেতু দুঃসংবাদ, তাই প্রয়োজন ছাড়া বড় একটা ওদিক পানে পা না রাখারই চেষ্টা করি। সেদিনও কান ছিল অন্যকিছুতে। একটি অডিওবুক। 'শ্রুতিগ্রন্থ' বলি যদি বেশ লাগে তাই না? তা সে যাই হোক, কানের মধ্যে দিয়ে ফের পড়ে নিচ্ছিলাম সেদিন ‘ন হন্যতে।’ সেদিন পড়ছিলাম বললে ভুল হবে। বিগত বেশ কয়েকদিন ধরে ধারাবাহিক ভাবে শুনছিলাম। ল্যাবে হাতের কাজ সারতে সারতে, রান্না করতে করতে, বাসন ধুতে ধুতে, আবার সেদিন যেমন জিমে গা ঘামাতে ঘামাতেও। একটু অবাক লাগছে হয়তো তাই না? জিমে মানুষ দ্রুতলয়ের উচ্চকিত সুরে অভ্যস্ত। আমার কান বা মস্তিষ্কের বোধহয় এ বোধ খানিক কম। আমার কীর্তন শুনতে শুনতে গা ঘামাতেও অসুবিধা হয়না বিশেষ। যা শোনা হয়নি, অথচ শুনতে খুব ইচ্ছে করছে এবং সে মূহুর্তে আর অন্যদিকে কান বা মাথা দেবার তেমন একটা প্রয়োজন নেই, সেরকম সময়ে যেকোনো কিছুই শুনতে আমার অসুবিধা হয়না। 

কিন্তু সেদিনের সেই ন হন্যতে-র পাঠ শুনতে শুনতে কেবলই হাত পা শিথিল হয়ে আসছিলো। পাঠিকা পড়ছিলেন রবীন্দ্রনাথের একখানি চিঠি। তিনি লিখছেন তাঁর স্নেহের অমৃতাকে। 

"....জীবনের পরিণতি একান্ত স্মৃতির মধ্যে দিয়ে নয়, দিনে দিনে বেদনাকে বেদনার মধ্যে দিয়ে নিয়ে গিয়ে, কঠোরকে ললিতে, অম্লতাকে মাধুর্য্যে পরিপক্ক করে তোলাই হলো পরিণতি। তোমার যে তা ঘটবে তা আমি মনে করিনে। কারণ, তোমার কল্পনাশক্তি আছে। এই শক্তি সৃষ্টিশক্তি। অবস্থার হাতে নিষ্ক্রিয় ভাবে নিজেকে সমর্পণ করে তুমি থাকতে পারবে না। নিজেকে পূর্ণতর করে তুমি সৃষ্টি করতে পারবে। আমি জানি আমাদের দেশের পক্ষে উদারশক্তিকে আত্মবিকাশ সম্ভব নয়। বাইরের দিকের প্রসারতার ক্ষেত্র তাদের অবরুদ্ধ। অন্তর্লোকের প্রবেশের যে সাধনা সে সম্বন্ধেও আনুকূল্য তাদের দূর্লভ। তুমি হতাশ হয়োনা। নিজের ওপর শ্রদ্ধা রেখো। চারিদিক থেকে আপনাকে বিচ্ছিন্ন করে নিয়ে সেই গভীর নিভৃতে নিজেকে স্তব্ধ করো, যেখানে তোমার মহিমা তোমার ভাগ্যকে অতিক্রম করে। তোমার পীড়িত চিত্তকে সান্ত্বনা দেওয়ার শক্তি যদি আমার থাকত, আমি চেষ্টা করতুম। কিন্তু একান্ত মনে তোমার শুভকামনা করা ছাড়া আমার আর কিচ্ছু করার নেই। যদি বাইরে কোনো ক্ষুদ্রতা তোমাকে পীড়ন করে থাকে তবে তার কাছে পরাভব স্বীকার করতে লজ্জা বোধ কোরো।"

সেই কোন ১৩৩৭ সালে কোনো এক নিভৃতচারিনী মননশীল স্নেহাষ্পদাকে লিখেছিলেন বৃদ্ধ এক কবি। আর এই ১৪২৭ বঙ্গাব্দে দাঁড়িয়ে সম্পূর্ণ বিপরীত পরিবেশে আর একজন নারীকে স্থবির করে দিল সেদিন সেই একই চিঠি। মনে মনে হিংসা হতে লাগলো। আমি যদি কাউকে ভরসা করে আমার মনের নিভৃত অপূর্ণতাটুকু নিবেদন করি, আমার এত বছরের জীবনেও এমন কি কেউ আছে যে আমায় এমন করে সে লেখার উত্তর দেবে? এমন করে লেখার অক্ষর দিয়ে মনের পাথর সরিয়ে দেবে? ক্ষতের উপশম তো চাইনি কোনোদিন। সে তো আমার নিজের কাজ। কিন্তু তবুও এমন একজন মানুষকে কাছে পেতে ইচ্ছে করে যিনি দূর থেকে হলেও সে ক্ষত যে বাইরের, সে ক্ষত যে কত 'ক্ষুদ্র' সেটুকু মনে করিয়ে দেবেন। তাতে ক্ষত আপনা থেকেই সেরে উঠতে উৎসাহ পাবে। দুকলম চিঠিতে কেউ যদি আমায় লিখতো, "তোমার পীড়িত চিত্তকে সান্ত্বনা দেওয়ার শক্তি যদি আমার থাকত, আমি চেষ্টা করতুম। কিন্তু একান্ত মনে তোমার শুভকামনা করা ছাড়া আমার আর কিচ্ছু করার নেই।" তাহলেও বর্তে যেতুম পরের লাইনটি পড়ে। 

"যদি বাইরে কোনো ক্ষুদ্রতা তোমাকে পীড়ন করে থাকে তবে তার কাছে পরাভব স্বীকার করতে লজ্জা বোধ কোরো।" আহঃ, ঈশ্বর যদি নিজে আসতেন আমার নিভৃত রাতের বন্ধু হয়ে তিনিও কি এর চাইতে অধিক কিছু বলতেন আমায়! 

যা কিছু আমায় পীড়ন করে, যা কিছু আমায় "নিজেকে পূর্ণতর করে সৃষ্টি" করার পথে বিপুল অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায়, যা কিছু আমার "বাইরের প্রসারতার" এবং "অন্তর্লোকের প্রবেশের সাধনা"-র পথরোধ করে দাঁড়িয়ে আমাকেই ক্ষুদ্র বলে নিরন্তর পরিহাস করে চলে প্রতিনিয়ত, সেই সব কিছুকে এই একটি বাক্যে যদি কেউ আমার মন থেকে মুছিয়ে দিতে পারত! আমি নিশ্চিন্তে নতুন জন্ম নিতুম। এসব কিছুই যে শুধু বাইরের, এসব কিছুই যে শুধু ক্ষুদ্রতা তাই নয়, এর কাছে "পরাভব স্বীকার করতে লজ্জা বোধ কোরো।" সত্যি বলছি, একথা কেউ আমায় লিখলে আমি একশ রাতের একলা কান্না ফেলে উঠে ভোররাতে স্নান সেরে চিবুক উঁচু করে যুদ্ধে যেতে পারি।     
   
অন্তর্মুখী মানুষদের বিপদ বিষম। তারা না পারে নিজের মনের সঠিক অবস্থান সামনের কাউকে বুঝিয়ে বলতে, না পারে প্রিয় মানুষদের থেকে পাওয়া নির্মমতাকে অতিক্রম করে নিজের নিভৃতচারণের পথে একলা এগিয়ে যেতে। এমতাবস্থায় অন্তর্মুখী মানুষদের নিজেদের মনের বাইরের পরিসরে প্রতিদিনের রাত্রিদিনে যা অবশিষ্ট থাকে তা হলো, অভ্যাসের দিনযাপন আর তার সাথে ক্রমাগতঃ নিজেকে ক্ষুদ্র মনে করে আত্মমর্যাদার শেষ তলানিতে এসে পৌঁছানো।তাঁদের প্রত্যেকেরই যদি এমন একজন 'কবি' থাকতেন যিনি মনে করিয়ে দিতেন, "নিজের ওপর শ্রদ্ধা রেখো। চারিদিক থেকে আপনাকে বিচ্ছিন্ন করে নিয়ে সেই গভীর নিভৃতে নিজেকে স্তব্ধ করো, যেখানে তোমার মহিমা তোমার ভাগ্যকে অতিক্রম করে।" তবে কি সমস্ত বাইরের ক্ষুদ্রতাটুকু পার হয়ে এসে নতুন করে আর একটি সৃষ্টিশীল মানুষ জন্ম নিতে না? 

এখানেই কবির 'অমৃতা' জিতে গেছেন। অন্তর্মুখী অথচ সৃষ্টিশীল একজন মানুষ। তাই পারিপার্শ্ব তাঁকে ক্ষতবিক্ষত করতে ছাড়েনি। তবুও এমনই একেকটি চিঠি যাঁকে সমস্ত পার্থিব ক্ষুদ্রতা থেকে বের করে এনে বড় হয়ে উঠতে, সৃষ্টিকর্মেই নিজের ঈশ্বরকে খুঁজে নিতে শিখিয়েছিলো। যা সেদিনের সেই কাকভোরে বাইরের অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে আধুনিক জিমের এককোণে গা ঘামাতে থাকা আজকের মেয়েটির কাছে ছিল না। চরম এক অপাঙতেয় মনে হয়েছিল নিজেকে যার সঠিকভাবে ছাত্রী বা শিষ্যা হবার যোগ্যতাটুকুও বুঝি নেই। যাকে এমন চিঠি কেউ কোনোদিন লিখবে না। এমন করেই নানান লেখা থেকে, ছাপার অক্ষর থেকে, রেকর্ডেড অডিও থেকে খুঁটে খুঁটে তাকে জুগিয়ে চলতে হবে নিজেকে ঠেলে তোলার রসদ। এখনো বহুদিন। বিপদে উৎরে দেওয়ার প্রার্থনা যে কোনোদিন করেনি, চেয়েছে শুধু নির্ভয় থাকতে, নিজের শক্তির সঠিক সময়ে সঠিক প্রয়োগ করতে, তারও তো হতাশার দিনে সামনে ঋজু একজনকে দেখতে পেতে ইচ্ছে করে। একজন ব্যক্তিমানুষ। তাঁকে ঈশ্বর বলে ভেবে নিঃসংশয়ে বিপদের মাঝে এগিয়ে যেতে ইচ্ছে করে। তাঁকে দেখে নিজের জীবনকে ঈশ্বরসম করে গড়ে তুলতে ইচ্ছে করে। সে মেয়ে জানে এ নিতান্তই কষ্টকল্পনা। তবুও সেই আবছা ভোরের আলোয় আধুনিককালের এক নারীর মনে সেদিন প্রবল ঈর্ষা জেগেছিলো প্রায় একশ বছর আগেকার এক নারীর অন্ততঃ এই একটি সৌভাগ্যকে মনে করে। 

এতবছর আগের লেখা একটি চিঠির কতগুলি লাইন, সেই একশো বছর আগেকার একনারীর মনেও যে পূর্ণতা এনেছিলো, পৃথিবীর অন্যপ্রান্তে, চতুর্পার্শ্বে সম্পূর্ণ কেজো, কঠিন এক পরিবেশেও, অদ্ভুত এক উচ্চগ্রামের সুর থাকা স্বত্বেও, আজকের সেই অকিঞ্চিৎকর, কোথাও-না-থাকা সেই মেয়েটির মনে যে স্থিরতা এনেছিল, তাকে বোধহয় একাসনে বসানোই চলে। আর সেখানেই সেদিনের সেই বৃদ্ধ মানুষটির প্রাসঙ্গিকতা। যিনি কবি প্রাবন্ধিক, সুরকার, লেখক, দার্শনিক আর যা খুশিই হন না কেন, সব ছাপিয়ে তিনি যে সংবেদনশীল স্নেহাস্পদের মনের সঠিক হদিশ রাখা একজন ঈশ্বরসম পথপ্রদৰ্শক, এ পরিচয় মস্ত হয়ে দাঁড়ায়। পৃথিবীব্যাপী আসন্ন বিপদ, নিজের ক্ষুদ্র জীবনের অপূর্ণতা,  অনিশ্চয়তা, পারিপার্শ্বিকতা থেকে প্রতিনিয়ত প্রাপ্ত অযাচিত অপমান, এ সমস্তই "বাইরের", এ সমস্তই "ক্ষুদ্র" হয়ে দাঁড়ায়। সমস্তকে ম্লান করে কানে বাজতে থাকে, "চারিদিক থেকে আপনাকে বিচ্ছিন্ন করে নিয়ে সেই গভীর নিভৃতে নিজেকে স্তব্ধ করো, যেখানে তোমার মহিমা তোমার ভাগ্যকে অতিক্রম করে।"   

Wednesday 3 June 2020

যন্ত্রণার অনুভূতি


কোনো কোনো মানুষ নাকি প্রবলভাবে যন্ত্রনা সহ্য করার ক্ষমতা রাখতেন বা রাখেন। তাঁদের অনেককেই আমরা সিদ্ধপুরুষ বলে মানি। তবে ওই এনেস্থেসিয়া ছাড়া সার্জারি করে ফেলা বা অন্য ছোটখাটো শারীরিক যন্ত্রণা যা অন্য আর সকলের কাছে মুখ বুজে সহ্য করা বেশ কঠিন ব্যাপার, তা তাঁরা যে অবলীলায় সহ্য করার ক্ষমতা রাখেন তার সাক্ষী অনেকেই। যদিও বিষয়টিকে এতদিন পর্যন্ত খানিকটা সন্দেহমিশ্রিত বিস্ময় নিয়েই দেখেছি। অনেকে অবশ্য সন্দেহাতীতভাবে স্রেফ সাধুদের ভণ্ডামিতেই স্ট্যাম্প লাগিয়েছেন। আজকে একটা বিষয়ে পড়ে এই ঘটনাটাকে খানিকটা অন্যরকমভাবে বিশ্লেষণ করতে হচ্ছে।

আজ পড়লাম, ডিউক উনিভার্সিটির একটি রিসার্চ সম্পর্কে যেখানে ওঁরা দেখিয়েছেন, ব্রেনের একটি ছোট্ট অংশ এক্টিভেটেড হলে যন্ত্রনার অনুভূতিটাই পুরো বন্ধ হয়ে যায়। অংশটি হলো আমিগডালা (Amygdala), যেটি নাকি নেগেটিভ ইমোশন তৈরির কারখানা বলেই পরিচিত। এই মানে "Fight or flight" গোছের ইমোশোনই হোক বা সাধারণ anxiety, সবেরই ডিপো এই amygdala। সুতরাং ব্রেনের আর যে অংশই হোক না কেন, এখানে কেউ যন্ত্রণার অনুভূতি বন্ধ করার সার্কিট খোঁজার চেষ্টাও করেনি এতদিন। কিন্তু প্রশ্নটা ছিলই অনেকদিন ধরেই। আসলে মানুষ ভাবছিলো কোনো একটা অংশের কাজ বোধহয় নয় এটা।  তাই যন্ত্রনা তৈরী করে যে সমস্ত স্নায়ুপথ, সবকটা বা তাদের মধ্যে বেশ কয়েকটা বন্ধ করলে তবে বুঝি যন্ত্রনা বন্ধ হবে। কিন্তু সেতো মারাত্মক কঠিন কাজ। প্রথম তো সবকটা পথ খুঁজে বের করা। তারপর তাদের কাজ পুরোপুরি বোঝা, তারপর তাদের কাজ বন্ধ করলে যদি আর অন্য কোন দরকারি কাজ বন্ধ হয়ে যায় তবে আবার তাদের অমন দুম করে বন্ধ করে দেওয়া যাবে না। সুতরাং বিস্তর ঝামেলা!

কিন্তু যন্ত্রণার অনুভূতি যদি বন্ধ করে দেওয়া যায় তাহলে অনেক কাজ অনেক সহজে করা যাবে তাই না বলুন? এই মানে সার্জারির সময় এনাস্থেসিয়ায় যেসব রোগীর সমস্যা হয় তাঁদের মারাত্মক উপকার হতে পারে। তারপর যুদ্ধবাজ পৃথিবীর বোড়ে, মানে সাধারণ সৈন্যদের যুদ্ধক্ষেত্রে আঘাত লাগলে চিকিৎসা শুরুর আগের সময়টাতে যদি কোনোভাবে যন্ত্রণার অনুভুতিটা বন্ধ করে দেওয়া যায় কি ভালো হয় তাই না? তাই মানুষ খুজঁছিলোই। কিন্তু সে জিনিস যে amygdala তে বসে আছে তা আগে কেউ ভাবেনি।

তা ডিউক উনিভার্সিটির স্কুল অফ মেডিসিনের প্রফেসর Fan Wang এর ল্যাবরেটরিতে হঠাৎ হলোটা কি যে তাঁরা ওই নেগেটিভ ইমোশনের হট স্পট amygdala তে খুঁজতে শুরু করলেন? আসল কথাটা হলো, ওঁরা ওটি খুঁজবেন বলে খোঁজেননি তো। হঠাৎই পেয়ে গেছেন। ওঁরা সাধারণ এনেস্থেসিয়া দিয়ে দেখছিলেন ব্রেনে (অবশ্যই ইঁদুরের ব্রেনে) কোন কোন জায়গা ইনএক্টিভ হয়। সে করতে গিয়ে দেখলেন, বেশ কিছু জায়গা নিষ্ক্রিয় তো হয়ই তার ফলে ঘুমের মতো একটা পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়। তার সাথে সাথে আশ্চর্য ভাবে কিছু জায়গা অ্যাক্টিভেটেড বা সক্রিয় হয়ে ওঠে। তার মধ্যে amygdala একটা। amygdalaর পুরোটা নয় অবশ্যই। মাঝের কিছু স্নায়ু, নাম দিলেন ওঁরা CeAga neurons (CeA stands for central amygdala; ga indicates activation by general anesthesia) তা সে নাম যাই হোক, Wang এর ল্যাবরেটরি দেখলো যে, ইঁদুরে খুব অল্প মাত্রায় যন্ত্রনা দিলে ব্রেনের ১৬ টি অংশের স্নায়ু উত্তেজিত হয় এবং এগুলোর মিলিত প্রয়াসই হলো যন্ত্রনার অনুভূতি। এবং এই CeAga neurons এই মিলিত অনুভূতির সম্পূর্ণ ভিন্ন এবং বিপরীত অনুভূতি সৃষ্টি করে। অর্থাৎ যন্ত্রণার অনুভূতিকে বাধা দেয়। এবার বলুন এই ১৬টি অংশকে একযোগে বন্ধ করা সহজ নাকি এই একটি অংশকে সক্রিয় করা সহজ? অবশ্যই পরেরটা তাইনা? 

ইঁদুররা যখন যন্ত্রনা পায় তখন আহত অংশটিকে চাটে, বা দুহাত (সামনের দুই পা) দিয়ে মুখ মোছে বার বার। এখন প্রফেসর Wang এর দলবল করেছিল কি, তারা একটি বিশেষ তরঙ্গদৈঘ্যের আলো দিয়ে ব্রেনের ওই CeAga neuron গুলোকে এক্টিভেট করছিলো। যেই আলোর সুইচ অন হচ্ছে অমনি ওদের যন্ত্রণার অনুভুতি চলে যাচ্ছে। ওরা পা চাটা বা মুখ মোছা বন্ধ করে দিচ্ছে। বার বার একই ঘটনা! যেন ম্যাজিক! এবার প্রফেসর Wang এর দলবল আরো নিশ্চিত হবার জন্য এমন কিছু ইঁদুরে একই এক্সপেরিমেন্ট করলেন যাদের ওই বিশেষ নিউরোন এক্টিভেট হবার ক্ষমতা লোপ পেয়েছে। তাদের ক্ষেত্রে কিন্তু যন্ত্রণার অনুভূতি বেড়ে গেলো সাংঘাতিক রকম। অর্থাৎ ওই CeAga neuron গুলোর এক্টিভেশন দরকার যন্ত্রণার অনুভূতি বন্ধ করার জন্য। 

এই হলো গল্প। এই পরীক্ষার সমস্ত ফলাফল প্রকাশিত হয়েছে Nature Neuroscience জার্নালে এই গত ১৮ই মে।  

এখন মনে করুন, এমন একটা ওষুধ পাওয়া গেলো যা আপনি টুক করে খেয়ে নিলেন আর অমনি আপনার ব্রেনের CeAga neuron গুলোর এক্টিভিটি চড়চড় করে বেড়ে গেলো। আপনার যন্ত্রণার অনুভূতি কিছুক্ষনের জন্য 'নেই' হয়ে গেল। এবার আপনি নির্দ্বিধায় সাংঘাতিকসব দুঃসাহসিক কাজ করতে পারবেন। তাই না? মানে ইচ্ছে মত যন্ত্রণার সুইচ অন বা অফ আপনার হাতে। সাংঘাতিক পাওয়ারফুল পেনকিলার! সেসব এখন অবশ্য ভবিষ্যতের হাতে।

তা যে গল্প দিয়ে শুরু করেছিলাম, কিছু মানুষের যন্ত্রণার অনুভূতি অলৌকিক বলে আমরা চোখ গোলগোল করি বা ভড়ং বলে মুখ বাঁকাই, তাঁদের ক্ষমতার একটা ব্যাখ্যা অন্তত পাওয়া যাচ্ছে এই কাজটি থেকে। তাঁদের মস্তিষ্কের amygdala র এই CeAga neuron গুলিকে তাঁরা হয়তো ইচ্ছে মত সক্রিয় করতে পারেন বা পারতেন। কে বলতে পারে!