Tuesday 27 February 2018

তবুও তিতিক্ষা




জীবনে যা কিছু ফাঁকি পড়ে গেল,
মৃত অনুভূতি যত,
অজেয় বিষাদ, তাড়া করে শুধু
অমোঘ প্রেমের মত।

পলে অনুপলে অতীত যাপন
মেঘমাখানো স্মৃতি,
প্রেমহারা মন পরশ খোঁজে
মরমী জীবনগীতি।

গতজন্মের ধার করা প্রেম
অলীক স্বপ্নময়,
মরে আর বাঁচে, লজ্জা হারায়
যাপিত জীবন ক্ষয়।

তবুও স্বপ্ন, তবুও আশা,
তবুও প্রতীক্ষা
অশেষ ঋণে ক্ষয়িত কামনা
তবুও তিতিক্ষা।

Tuesday 13 February 2018

প্রোষিতভর্তৃকা

সোনালী রোদ্দুরে ভাসছে তোর উষ্ণতা।
চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে দেখি,
এখনো তাতে তোর জিভের নুন লেগে আছে।
নুনটুকুনির স্বাদ
নিলাম আমার জিভে জড়িয়ে।

রোজকার প্রাত্যহিকতায় জীর্ণ হয়ে আসা চাদরটা,
যার সুতোয় রোঁয়ায় নিজের কিছুটা রেখে গিয়েছিলিস তুই,
তাকেই নিলাম জড়িয়ে।
তোর গন্ধ আর আদর পাবো বলে।

আজ আর জানলা খোলা হল না।
আজ যে আমার ঘরে থাকার দিন।
আজ আমি প্রোষিতভর্তৃকা।

Monday 12 February 2018

শিলং-চেরাপুঞ্জি


এই লেখাটি 'বাতায়ন' পত্রিকার অক্টোবর, ২০১৭ সংখ্যা তে পূর্বপ্রকাশিত। মূল লেখাটি এখানে পাবেন।

বাতায়নের লিনক: 
http://batayan.org/

---------------------------------------------------------------------------
শিলং সম্পর্কে বললে বাঙালিমাত্রেই বলবে 'শেষের কবিতা'-র কথা। আমার কাছে এছাড়াও নারায়ণ সান্যালের 'গজমুক্তা' বা রহস্যের পিছনে ধাওয়া করা প্রৌঢ় কর্নেল এর কাহিনী- আসামের জলা জমিতে, ঘাসের জঙ্গলে হাতি বা মাহুতদের জীবনের প্রতি বা মনিপুর-মেঘালয়ের বৃষ্টিধোয়া জলা প্রান্তরের প্রতি একটা আকর্ষণ তৈরী করেছিল। ২০১১ সালে যখন কোথাও একটা যাবার পরিকল্পনা হলো, তখন আমি শিলং এর নাম করলাম এবং বাদবাকি সব্বাই একবাক্যে রাজীও হয়ে গেলো। এইবেলা এখানে, এই যাবার কারণ সম্পর্কে দুএককথা বলতে ইচ্ছে করছে। 

২০০৯ বা ২০১০ নাগাদ গোপালনগর-কোলাঘাটের চ্যাটার্জী পরিবার এবং ইন্দা-খড়্গপুরের মন্ডল পরিবারের মায়েরা, নিজ নিজ অপোগন্ডদের একবার করে তাড়া দিয়েছিলেন যে যথেষ্ট হয়েছে, এবার বিয়ে নামক হুজ্জতিটি মিটিয়ে যেন তাদের উদ্ধার করা হয়। কিন্তু অপোগন্ডরা যেহেতু চিরকালই অপোগন্ডই থাকে, তাই তখন সেকথা তারা কানে না নিয়ে গবেষণা এবং প্রেমের নামে সাপ্তাহিক কলকাতা যাত্রা চালিয়ে চললো। শেষে দুপক্ষের বাবারা যখন বললেন, আহা কেন বেচারাদের বিরক্ত করছো? থিসিসটা শেষ করতে দাও তারপর নয় হবে ওসব। মায়েরা তো রণে ভঙ্গ দিলেন কিন্তু এবার সমস্যা হয়ে গেলো অপোগন্ডদুটির। কারণ থিসিস শেষ হবার পর বিয়ে হবে এমন মারাত্মক শর্ত দিলে তো জীবনে কোনোদিন বিয়ে নাও হয়ে পারে। শেষে, ২০১১ র মাঝামাঝি দুজনের ল্যাবেই যখন চুড়ান্ত নড়বড়ে অবস্থা, তখন দুজনে যুক্তি করে ঠিক করলাম, কিছুই তো হচ্ছে না কাজের কাজ, তাহলে বিয়েটাই করে না হয় ফেলা যাক। কিছু তো একটা উত্তেজনা থাকুক জীবনে। লজ্জার মাথা খেয়ে নিজের নিজের বাড়িতে বলেই ফেললাম এবার বিয়ের কথা শুরু করা যেতে পারে। কারণ, এখন কথা শুরু হলে ঘটনাটা ঘটতে কমপক্ষে আরো আট-নয় মাস। বাঙালি বিয়ে বলে কথা, পাত্র পাত্রী নির্বাচনের অর্বাচীন কাজটি বাদে সব কিছুই পড়ে আছে। এইবার দুই বাড়িতে হুড়োহুড়ি পড়ে গেলো। তাঁরা ভেবেছিলেন, তাঁদের পড়ুয়া ছেলেমেয়েরা বিয়ে নামক অকিঞ্চিৎকর ব্যাপারটায় জড়াতে বুঝি আরো বেশ কিছু বছর সময় নেবে। কিন্তু বাবাদের ওই থিসিস শেষ করার কথায় ভয় পেয়ে দুই মক্কেলের এই পরিকল্পনা। তাতে সম্মতি পেয়ে, এবার আর এক ধাপ এগিয়ে গিয়ে ভাবলাম, দুই বৈবাহিক পরিবারের প্রথম দর্শন এবং এই প্রাথমিক কথাবার্তা বাড়িতে না হয়ে কোথাও একটু অন্যরকম পরিবেশে হলে কেমন হয়। এতেও সম্মতি পাওয়া গেলো। আগেই বলেছি শিলং এর নামটা প্রথমবারেই সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত হয়েছিল। ঠিক করেছিলাম, চেরাপুঞ্জি দেখবো তো বর্ষাকালেই দেখবো। সুতরাং, ২০১১ এর অগাস্ট মাসের মাঝামাঝি শিলং-চেরাপুঞ্জির সমস্ত পরিকল্পনা হয়ে গেলো।

সেই মর্মে ১২ই অগাস্ট বিকেলে ভরা বর্ষা মাথায় নিয়ে দুই আসন্ন বৈবাহিক পরিবার বিয়ের প্রাথমিক কথা বলতে চটি-ছাতা-বিছানা-বালিশ-তোরঙ্গ-পানের ডাবর নিয়ে জিভ টিভ পরিষ্কার করে কলকাতায় এলেন। পরদিন কাকভোরে গুয়াহাটির উড়ান। ভরা বর্ষা তো ছিলই, তার ওপর, ১৩ই অগাস্ট ভোরে বরুন দেবতা তাঁর সমস্ত শক্তি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়লেন কলকাতায়। অঝোরে বৃষ্টি আর সাথে মুহুর্মুহু বজ্রাঘাত। বেরোতে পারা যাবে এমন সম্ভাবনা প্রায় নেই বললেই হয়। বিধাতা বোধহয় তখনই সাবধান করছিলেন বাবা মায়েদের। দুটো হাড়জ্বালানে পাগলকে এক ছাদের তলায় থাকতে দেবার বন্দোবস্ত করাটা আদৌ ঠিক হচ্ছে কি? বাবা মায়েরা তখন বোঝেন নি।  আমরা তো নয়ই।  বাড়ি থেকে ট্যাক্সিতে উঠতেই ভিজে জুবুথুবু  সক্কলে। এটা অবশ্য আমাদের বেড়াতে যাবার ঐতিহ্য। আমরা বেরোবো আর বৃষ্টি হবে না এমনটি কখনো হয়নি। সুতরাং বেশি ঘাবড়ালাম না। গুয়াহাটির উড়ান যদি বাতিল না থাকে নিশ্চই পৌঁছাবো কোনো এক সময়ে। সেযাত্রা আমরা প্লেনে উঠলাম এবং আকাশে উঠলোও সে উড়ান। আর তার পরেই শুরু হলো খেলা।  মনে আছে, অনেকদিন আগে কলেজ থেকে নিক্কোপার্ক গেছিলাম কজন বন্ধু মিলে। ওখানে একটা রাইড ছিল নাম ভুলে গেছি, সেই ভয়ানক রাইড এর অভিজ্ঞতা আবার শুরু হলো গুয়াহাটির সেই প্লেনে। তারপরে আরো কয়েকবার খারাপ আবহাওয়ায় আকাশযাত্রার অভিজ্ঞতা হয়েছে, কিন্তু গুয়াহাটির সেবারের অভিজ্ঞতার কাছে সেসব নস্যমাত্র। মনে হলো এইবার এই জন্মের শেষ। দুই হাতল চেপে ধরে বসে আছি, ভাবটা এমন, যেন প্লেন ভেঙে পড়লেও আমার সিট এর হাতলদুটো আকাশে ঝুলে থেকে আমায় বাঁচাবে। মহাতিমিরেরও শেষ হয় কিন্তু কলকাতা থেকে গুয়াহাটির ওই চল্লিশ মিনিটের বুঝি শেষ নেই। খুব খারাপ অবস্থায় পৌঁছালে মানুষ ভয় পায়। আরো খারাপ অবস্থায় পৌঁছালে মানুষ আরো ভয় পায়।  কিন্তু ক্রমাগতঃ আধঘন্টার উপর যদি ওই মারাত্মক ভয়ানক ভয় পেতে হয় তখন বোধহয় ভয় পেতে পেতে, ভয় পেতে পেতে, বুকের সব ভয় শেষ হয়ে যায়। কেমন সাধক সাধক হয়ে যায় মনটা। 'Near death experience ' এর পর যেমন মানুষের আত্মিক উন্নতি হয় বলে শুনেছি, আমারও মনে হয় তেমনি হলো। হঠাৎ মনে হলো, সবাই তো একসাথেই আছি। মরলে সবাই একসাথেই মরবো। তবে আর চিন্তা কি। চোখ খুলে পাশে তাকিয়ে দেখি, পাশের সিটে একটু বাঁদিক চেপে জানলায় তাকিয়ে আছে মা। বললাম, "ভয়ের কিছু নেই, আবহাওয়া খারাপ তো তাই প্লেন একটু কাঁপছে।" মা বললো, "দেখ, কত মেঘ চারিদিকে।" মনে পড়লো, এটাই মা বাবাদের প্রথম আকাশ যাত্রা। বুঝলাম, অজ্ঞানতা যে সবসময় ভয়ের জন্ম দেয় তা নয়, অনেক সময় অজ্ঞানতা খুব খারাপ পরিস্থিতিতেও যাত্রাপথটাকে উপভোগ করার মানসিকতা যোগায়। যেহেতু মা জানে না যে আকাশ যাত্রায় এই পরিমান ঝাঁকুনি স্বাভাবিক না অস্বাভাবিক, তাই তার মনে কোনো ভয়ের উদ্রেকই হয়নি। প্রথম আকাশযাত্রাকে অবলীলায় উপভোগ করছে। শিশুর মতো। সব কিছু তাড়াতাড়ি জেনে ফেলার, পৌঁছে যাবার তাড়ায় আমরা জানার পথটাকে উপভোগ করার শিশুসুলভ আনন্দটাকেই মেরে ফেলেছি ধীরে ধীরে। মায়ের হাতটা ধরে বলেছিলাম মনে আছে, "তোমার ভালো লাগছে মা?" আমার স্বল্পভাষিনী মা ইতিবাচক ভঙ্গিতে ঘাড় হেলিয়েছিলেন। এই উড়ান যদি শেষ পর্যন্ত ভালোয় ভালোয় গুয়াহাটির মাটি স্পর্শ নাও করতো সেদিন, তাহলেও বোধহয় শেষ সময়ে কোনো আক্ষেপ থাকতো না আমার।

শেষ পর্যন্ত অবশ্য ভালোয় ভালোয় আমাদের আকাশযান যে গুয়াহাটির মাটি স্পর্শ করেছিল সেদিন, তা বলাই বাহুল্য। গুয়াহাটি এয়ারপোর্ট থেকে একটা গাড়ি নিয়ে সোজা গেলাম ময়ূর হোটেল, গুয়াহাটি স্টেশন এর কাছে এই হোটেলই আমি এর আগে একবার দু-রাত্রি ছিলাম। সেবার এক বড়ো শক্তিসাধকদের দলের সাথে এসেছিলাম কামাখ্যা মন্দির দর্শনে। সে অন্য গল্প। এবার আমাদের পরিকল্পনা ছিল গুয়াহাটি থেকে শিলং যাবার আগে মায়েদের কামাখ্যা মন্দির ঘুরিয়ে দেখানোর। তাই কয়েকঘন্টার জন্য বড়ো কোনো হোটেল বুকিং না করে চেনা হোটেলেই ঘাঁটি গাড়লাম। হোটেলের ঘর খুব একটা পছন্দসই হবে না সেটা আগে থেকেই জানতাম। কিন্তু জানলা থেকে বাইরে একটা নবনির্মিত স্টেডিয়াম দেখে সকলেরই বেশ পছন্দ হলো। হোটেলে স্নান সেরে হোটেলের উল্টোদিকের ট্যাক্সিস্ট্যান্ড থেকে গাড়ি নিয়ে সোজা কামাখ্যা মন্দির। 

কামাখ্যা মন্দিরের মাহাত্ম তার স্থাপত্যে বা ভাস্কর্যে নয়, তার প্রাচীনত্বে, তার পৌরাণিকতায়, মানুষের আজন্মকালের বিশ্বাসে, নানান কথকথায়, অপতান্ত্রিক বিদ্যার কাহিনীতে। আসামের নীলাচল গিরির এই মন্দির আসমুদ্র হিমাচল একান্ন শক্তিপীঠের এক গুরুত্বপূর্ণ পীঠ বলেই মানে। এই মন্দিরের পৌরাণিক কাহিনী সবারই জানা। তাই তার আর পৌনঃপৌনিকতা করলাম না। গতবারে এসে প্রায় একবেলা লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে হয়েছিল মনে আছে। কিছু একটা পুণ্যতিথি ছিল সে সময় হয়তো। এবার মন্দিরে বিশেষ ভিড় নেই। একশ টাকার টিকিট কেটে লাইনে দাঁড়ালাম। পাঁচশো টাকার টিকিটও আছে। সোজা গর্ভগৃহের আগের অংশে এসে ঢুকেছে। আমরা লাইন দিলাম অহম রীতির দোচালা নাটমন্দিরের সাধারণ পথে। আর চারশো টাকা বেশি দেওয়া পুণ্যার্থীদের টাকা বেশি, তাই ভক্তিও বেশি, আর তাই ভিড় এড়িয়ে সোজা ভগবানের কাছে পৌঁছে যাবার সুযোগও বেশি। ভারতের প্রায় সব মন্দিরের মতোই। অবশ্য যদি ওই গর্ভগৃহের বাইরে কোথাও ভগবান নামক ধারণাটি না থাকেন তবেই। তা সে যাই হোক, নাটমন্দিরের লাইনে দাঁড়িয়ে একটা কথা মনে হচ্ছিলো, এই সম্পূর্ণ শক্তিপীঠটির মাহাত্ম- নরনারীর যৌনতা, প্রজনন ক্ষমতা, যা কিনা ধরিত্রী মায়ের শস্যশ্যামলা রূপটিরও একটি রূপক, তাকে স্বাভাবিক মর্যাদা দেবার জন্য। নারীর ক্ষেত্রে ঋতুচক্র যার অন্যতম প্রধান বহিঃপ্রকাশ। এখানে আসা পুণ্যার্থীরা অসীম ভক্তি ভরে গর্ভগৃহের ঐতিহাসিক অন্ধকার পিচ্ছিল সিঁড়ি বেয়ে নেমে ছোট্ট বেদিতে মাথা ছোঁয়ায়, ভক্তিভরে পৃথিবীর গর্ভ থেকে পাথরের ফাটল বেয়ে স্বাভাবিক নিয়মে উঠে আসা জলের ধারাকে আদিমাতার যোনিনিসৃত পবিত্র তরল বলে চোখে, বুকে স্পর্শ নেয়। অথচ সেই পুণ্যার্থীরাই আবার রজঃস্বলা নারীকে পূজার্চনায় বাধা দেয়। অম্ববাচীতে কামাখ্যাতে পুণ্যের লোভে ভিড় উপচে পড়ে, অথচ বাড়ির ঠাকুরঘরে পুজোর দিনে বাড়ির মেয়েটির প্রবেশ নিষেধ থাকে শুধুমাত্র তার শরীর তাকে স্বাভাবিক জৈবিক নিয়মে প্রজনন উপযুক্ত ঘোষণা করেছে বলে। আমরা যুগের পর যুগ ধরে কামাখ্যা মায়ের যোনীপিঠে মাথা ঠেকিয়ে কে জানে কত পুণ্যই না অর্জন করে চলি স্থাবর ধার্মিকতার আড়ালে মুখ লুকিয়ে। মনে পড়লো, একবার সরস্বতী পুজোর দিন সকালে উঠে নিজেকে রজঃস্বলা দেখে খুব কষ্ট পেয়ে মাকে বলেছিলাম, আমি এবার অঞ্জলি দিতে পারবো না? তখন সেই সদ্যকৈশোরে পা দেওয়া দিনে, সরস্বতী পুজোর অঞ্জলিই হয়তো একমাত্র ভগবানের কাছে সরাসরি ভবিষ্যৎ জীবনের এপ্লিকেশন বলে মনে হয়েছিল। মায়ের উত্তর ছিল, "তোর কি খুব অঞ্জলি দিতে ইচ্ছে করছে? তাহলে দে। সরস্বতী সব জানেন।" মা অঞ্জলীর মন্ত্র বলেছেন আর আমি সেই মন্ত্র শুনে বাড়ির ছোট্ট সরস্বতীর মূর্তির পায়ে ফুল দিয়েছি।তারপর কোনোদিন আর এই 'অপবিত্রতা' নিয়ে দ্বিধায় ভুগতে হয়নি। 
কামাখ্যা মন্দিরের গর্ভগৃহে ঢুকলে পাপ-পুন্য, পৌরাণিকতা সব ছেড়ে যে বোধটি মনকে ছেয়ে থাকে তা হলো রহস্যময়তা। ছোট্ট পিচ্ছিল অন্ধকার সিঁড়ি, নিচে ঠান্ডা ভেজা ভেজা একটুকরো জায়গা, ঘিয়ের প্রদীপ ছাড়া কোনো আলো ঢোকার রাস্তা নেই। তার মধ্যে ফুল সিঁদুর এর মিশ্রগন্ধ। ধূপ-ধুনো জ্বালানো নিষেধ। ধোঁয়া বেরোবার জায়গা নেই বলেই। মায়েরা পুজো দিলেন। বাইরে বেরিয়ে দশমহাবিদ্যার মন্দিরগুলি আর মন্দির চত্বর ঘুরে ঘুরে দেখলাম সবাই। মন্দির চত্বরে শত শত উৎসর্গিত পায়রা। মানুষের মানত পূর্ণ হয়েছে, তাই কামাখ্যা মায়ের ভেট। আগে হলে হয়তো বলি হয়ে যেত। ভারতবর্ষ যে বিশ্বাসের দেশ, যেকোনো মন্দিরে বা তীর্থস্থানে গেলেই এই কথাটি সর্বাগ্রে মনে হয়। 

বেশি সময় নেই, আজই শিলং পৌঁছানোর কথা আমাদের। মন্দির থেকে নেমে এলাম। হোটেলে অল্প করে খাওয়া দাওয়া সেরে বেরোলাম শিলং এর উদেশ্যে। ব্রহ্মপুত্রের নদীদ্বীপের মাঝে আগের বার দেখা ভৈরব মহাদেবের মন্দিরটি ও ব্রহ্মপুত্রের বুকে দেশি নৌকায় করে সেই দ্বীপে পৌঁছানোর মনোমুগ্ধকর যাত্রাটির কথা গল্প করলাম সকলের কাছে। এছাড়াও পড়ে রইলো নবগ্রহ মন্দিরসহ প্রাচীন অহম রাজাদের আরো কত পুরাকীর্তি। সময় কম থাকার জন্য এবার বাকি আর কাউকে সেই অভিজ্ঞতার স্বাদ পাওয়াতে পারলাম না। 

গাড়ি চলছে শিলং এর দিকে। বর্ষায় গুয়াহাটি থেকে শিলং যাঁরা গেছেন তাঁরা জানেন যে প্রকৃতির সবুজ রং বলতে কি বোঝায়। হিমালয় এখানে সমতল ছুঁইছুঁই। বাবা অনেককাল হিমাচলে কাটিয়েছে। তার কাছে পাহাড় বলতে একদিকে খাড়া পাথুরে দেওয়াল, অন্যদিকে খাড়া নেমে যাওয়া খাত। শিলংয়ের রাস্তায় দুপাশে সবুজ ঢালু মাঠ, ছবির মতো সুন্দর ছোট্ট ছোট্ট বাড়ি, মাঝে জঙ্গল আর অল্প অল্প পাহাড়। বাবার কাছে শিলং এর পাহাড় অন্যরকম রূপ নিয়ে ধরা দিলো। বাবার সাথে সাথে বাকি সকলেরই চোখে মুখে ততক্ষণে বর্ষাভেজা খাসিপাহাড়ের সবুজ এসে বাসা বেঁধেছে। 

সুন্দর চলছিল আমাদের গাড়ি। হঠাৎ সামনের সিট থেকে শুনলাম, "গাড়িটা একটু থামাও।" গাড়ি থামলো, আরোহী নামলেন, পাহাড়ি পথে, গাড়ির দুলুনিতে গুলিয়ে ওঠা পাকস্থলী খালি করলেন, তাঁকে জল-ওষুধ ইত্যাদি দেওয়া হলো। এ পর্যন্ত পুরোটাই পাহাড়ি পথের অতি সাধারণ ছবি। কিন্তু, যেটি অসাধারণ ছিল সেটি হলো, অসুস্থ ব্যক্তিটি আমার হবু শ্বশুরমশাই আর গাড়িতে আমাদের সঙ্গে আছেন আমার হবু শ্বাশুড়ীমা। ভবিষ্যতে নানা অহেতুক ভীতি আর চিন্তার কারণে যাঁকে আমি 'শ্রীমতী চিন্তামণি' বলে ডেকে থাকি। তো সেই ঘটনায় পাহাড়ি রাস্তায় অনভ্যস্ত শ্রীমতি চিন্তামণি তো ভয়ানক চিন্তিত হয়ে পড়লেন। গাড়িতে ওঠার আগে একটি নির্দোষ croissant এর ওপর তাঁর সমস্ত রাগ গিয়ে পড়লো। তাঁকে সবাই মিলে কিছুতেই বোঝানো গেলো না যে ওটি আমরা সকলেই খেয়েছিলাম। এটা পাহাড়ি পথে অনেকেরই হতে পারে। আমি ভাবছি, মরেছে রে, croissant খাওয়ার বুদ্ধিটা আমারই। বিয়ের কথা বলতে এসেই হবু শ্বশুরমশাইকে অসুস্থ আর হবু শ্বাশুড়ীমাকে চিন্তায় ফেলে দিলাম, বিয়ে অবধি ব্যাপারটা গড়ালে হয় শেষ পর্যন্ত। যাই হোক, ভীষণ চিন্তা করতে করতে শ্রীমতি চিন্তামণি তো শেষে গাড়িতে ঘুমিয়ে পড়লেন আর আমরা ১৩ই অগাস্ট সন্ধ্যে নাগাদ শিলং এর লাবং অঞ্চলে 'বনি গেস্ট হাউস'-এ এসে উঠলাম। এটি হোটেল পাড়া নয়। সাধারণ স্থানীয় জনবসতির মধ্যে ছোট্ট ঘরোয়া গেস্ট হাউস। আন্তরিক। আরো ভালো ব্যাপার, আমরা ছাড়া আর কোনো গেস্ট নেই। মাঝের খাবার আর আড্ডা দেবার জায়গাটা পুরোটাই আমাদের। পৌঁছেই দুটো ঘরে দু জোড়া বাবা-মা কে বিশ্রাম করতে দিয়ে আমরা বেরোলাম পুলিশবাজারের দিকে। পুলিশ বাজার শিলংয়ের প্রধান বাজার বা চক অঞ্চল। ওখানেই মেঘালয় ট্যুরিজমের অফিস। সেই অফিসে গিয়ে পরের দিনের চেরাপুঞ্জি ট্যুর এর ছয়টা টিকিট বুক করলাম। কাল চেরাপুঞ্জি। বর্ষায় কেমন থাকে সে দেশ, দেখার সাধ পূর্ণ হবে।   

পরদিন ১৪ই অগাস্ট, সক্কাল-সক্কাল জল-বিস্কুট-এভোমিনের প্যাকেট গুছিয়ে পুলিশ বাজারের মেঘালয় ট্যুরিজমের অফিসের সামনে। ছোট্ট পনের সীটের দুটি বাসে শুরু হলো জার্নি। সেদিন কিন্তু বৃষ্টি নেই। মনে মনে ভাবছি, চেরাপুঞ্জিতে বৃষ্টি পাবো তো? বাস ছোট্ট ছোট্ট মেঘালয়ী সবুজ গ্রাম পেরিয়ে চলেছে ছোট ছোট সবুজ টিলার গা ঘেঁষে। আশেপাশে দূষণের লেশমাত্র নেই। প্রতিটি বাড়ির সামনে ছোট্ট টব বা পাত্রে ছোট্ট ফুলের গাছ। অপূর্ব জীবনযাত্রা। হয়তো নাগরিক জীবনের অনেক সুবিধা থেকেই বঞ্চিত এখানকার মানুষ। আমি দুই দিনের জন্য বেড়াতে এসে ভাবছি 'কি সুন্দর', যেমন সমস্ত টুরিস্টই ভাবেন। আমরা যথার্থ ভ্রামণিক হয়ে উঠতে পারবো না কোনোদিনই হয়তো। তাই ট্যুরিস্টের দৃষ্টিভঙ্গিতেই মনে হয়েছে 'কি সুন্দর।' তবে জীবনযাত্রার অসুবিধার কথা বাদ দিলে, বর্ষায় মেঘালয় সম্পর্কে একটাই বিশেষণ মনে হয়, 'অপার্থিব।' একটা খচখচানি হচ্ছিলো মনের মধ্যে, চেরাপুঞ্জি চলেছি কিন্তু বৃষ্টি নেই।  এতো কান্ড করে বর্ষাকালে এলাম চেরাপুঞ্জির বৃষ্টি দেখবো বলে। এমনসময়, চারপাশটা কুয়াশাচ্ছন্ন হয়ে যেতে লাগলো। ক্রমশঃ এমন হলো যে, বাসের সামনে কয়েক ফুট মাত্র দেখা যাচ্ছে। বাস থেমে গেলো। এখানে নাকি একটি ভিউ পয়েন্ট আছে। মাউকডক ভিউ পয়েন্ট। বাস থেকে নেমে বুঝতেই পারছিনা কোথায় ভিউ পয়েন্ট? কোথায় কি? সামনে একটা ব্রিজের আবছা অবয়ব চোখে পড়লো। সূচীভেদ্য অন্ধকার হয় জানি। সূচীভেদ্য কুয়াশা কি তাহলে এটাই? পাশথেকে বাসের ড্রাইভার বললেন, "চলে যান এই সিঁড়ি দিয়ে ভিউ পয়েন্ট পেয়ে যাবেন।" হাতে চায়ের গ্লাস। পাশেই একটা চায়ের দোকান আর তার পাশ দিয়ে নেমে গেছে সিমেন্টের বাঁধানো সিঁড়ি। কুয়াশায় এতক্ষন চোখেই পড়েনি। নামতে নামতে মনে হলো, এটা তো মেঘ, কুয়াশা তো নয়।  আমরা মেঘের মধ্যে দিয়ে হাঁটছি। বঙ্গোপসাগর থেকে চার-পাঁচশো কিলোমিটার পথ বাংলাদেশের ওপর দিয়ে ধেয়ে এসে জলভরা মৌসুমী বায়ু সোজা প্রথম ধাক্কা খেয়েছে মেঘালয়ের খাসি পাহাড়ে। পুঞ্জীভূত হয়ে ওপরে উঠেছে। আর এই খাসিপাহাড়ের চেরাপুঞ্জিকে, চিরকালের মতন পুঞ্জীভূত মেঘের দেশে পরিণত করেছে। তাই তো এ রাজ্যের নাম মেঘালয়। ছোটবেলায় পড়া ভূগোলকে জলজ্যান্ত চোখের সামনে দেখে মেঘকে কি করে যেন কুয়াশা বলে ভুল করে ফেলেছিলাম। ভিউ পয়েন্ট থেকে কিছুই প্রায় দেখা গেলো না মেঘের জন্য। বাবা মায়েরা দেখলাম বেশ উপভোগ করছে ব্যাপারটা। এমনকি শ্রীমতি চিন্তামনিও চিন্তা ছেড়ে ছবি তোলায় ব্যস্ত। দেখে ভালো লাগলো। ফিরে এসে বাস ছাড়লো Duwan Singh Syiem Bridge যা কিনা সোহরা সার্কিটে ঢোকার সীমানা, সেটা পেরোতেই দলে দলে মেঘ এসে সঙ্গী হলো আমাদের। বৃষ্টি পড়ছে না কিন্তু গা ভিজে যাচ্ছে জলভরা মেঘের সংস্পর্শে। ইকো পার্কে এসে বাস থামলো। সাধারণ পার্ক যেমন হয়. কিন্তু এই পার্কের বৈশিষ্ট্য হলো, এখান থেকে বাংলাদেশের সিলেট অঞ্চলের সমতল ভূমির অপূর্ব একখানি দৃশ্য দেখা যায়। হঠাৎ করে মেঘ সরে গিয়ে সে দৃশ্যের কিছুটা আমরাও দেখলাম। এই বর্ষায়, সোহরার পাহাড় থেকে নেমে আসছে অজস্র ঝর্ণা। দূরে সবুজ পাহাড়ের গায়ে রচনা করেছে দুধসাদা আল্পনা। এরপর শুরু হলো সত্যিকারের বৃষ্টি। জামাকাপড় যদিও আগেই স্যাঁতস্যাতে হয়ে গেছিলো। থাঙ্গখারাঙ্গ পার্কে এসে যখন বাস দাঁড়ালো তখন চারিদিক বৃষ্টিতে ছেয়ে গেছে। অন্য সকলেই প্রায় বর্ষাতি নিয়ে এসেছে। আমরা বোকার মতন বাড়িতে বর্ষাতিগুলো বাক্সবন্দী করে রেখে বর্ষাকালে চেরাপুঞ্জি বেড়াতে এসেছি কয়েকটা পুরোনো হয়ে যাওয়া ছাতা নিয়ে। দুই জোড়া বাবা মাকে নিয়ে একসাথে বেরোনো হচ্ছে এই আনন্দেই বাকি আর কিছু নজরে পড়েনি বোধহয়। তা সেই পুরোনো ছাতাদের তো চেরাপুঞ্জির বর্ষালী হাওয়া, ঠাট্টার সুরে একদমকেই অকেজো করে দিলো। বাস থেকে নামার পাঁচ মিনিটেই দেখলাম, বাবার ছাতার হাতল আর ছাতার ওপরের অংশ আলাদা হয়ে গেছে। হাতলহীন ছাতার ওপরের অংশটুকু কোনোক্রমে ধরে রেখে বাবা প্রবল উৎসাহে পার্কের গেটের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। আমি ছাতার দিকে হাঁ করে তাকিয়ে আছি দেখে অবাক হয়ে বাবা বললো-"বসে রইলি যে? নামবি না? চলে আয়, চলে আয়।" বুঝলাম, বয়স বেড়েছে ঠিকই কিন্তু বেড়াতে বেরোলে উৎসাহের এটুকুও কমতি হয়নি আমার বাবার। লাফিয়ে নেমে এলাম বাস থেকে। মায়েরাও ততক্ষনে শাড়ি টাড়ি সামলে হাত ধরাধরি করে গুটি গুটি এগোচ্ছে পার্কের গেটের  দিকে বৃষ্টি আর হাওয়ার সাথে লড়াই করে। আপাত দৃষ্টিতে থাঙ্গখারাঙ্গ পার্ক তেমন মনে রাখার মতন কিছু হয়তো হতো না কারণ, মেঘের জন্য বাংলাদেশের সমতলভূমির প্রায় কিছুই আমরা দেখতে পাইনি। কিন্তু একটি বিশেষ কারণে এই থাঙ্গখারাঙ্গ পার্ক আমাদের সমগ্র শিলং চেরাপুঞ্জি ভ্রমণের প্রধান ট্যাগলাইন হয়ে রয়ে গেছে এখনো। সেইটিই এখন বলবো। আমরা দুজন এদিক ওদিক ঘুরছিলাম। বৃষ্টির মধ্যেই। এমন সময় হঠাৎ শুনলাম চিৎকার, "এই তোরা কোথায় এদিকে আয়, দেখে যা। তাড়াতাড়ি আয়।" বাপি  মানে আমার তৎকালীন হবু শ্বশুরমশাইয়ের গলা। কি হলো রে বাবা? চশমা, মোবাইল সব হওয়ার চোটে উড়ে খাদে পরে গেলো নাকি? পড়ি কি মরি করে গিয়ে দেখি, ষাট ছুঁইছুঁই মানুষটা, এঁনাকে আমি ঘরকুনো বলেই জানি, তিনি পনের বছরের ছেলের মতন আনন্দে আত্মহারা হয়ে চিৎকার করছেন পার্কের ঠিক পাশ দিয়ে তিন ধাপে নেমে যাওয়া বর্ষার ভরা যৌবনা Kynrem falls কে দেখে। ঝর্ণার দূর্বার গতি বয়সের ভারকে ভাসিয়ে নিয়ে গেছে দেখার আনন্দটুকুকে রেখে। তখনও তিনি উচ্ছসিত হয়ে বলে চলেছেন, "কি দৃশ্য! উফ, কি দেখলাম।"  আর আমার ষাটোর্ধ বাবা ভাঙ্গা ছাতা সামলে আক্ষরিক অর্থেই প্রায় লাফিয়ে লাফিয়ে একদিক থেকে আর একদিকে যাচ্ছে আর বলছে "শাড়ি যায় যাক, জুতো যায় যাক, আবার হবে, এই দৃশ্য প্রাণ ভরে দেখে নাও।" বৃষ্টিতে সবারই শাড়ি জামাকাপড় আর জুতোর সাড়ে বারোটা বেজে গিয়েছিলো। মায়েরা বোধহয় তার আগেই এই নিয়ে আলোচনা করেছিলেন, আর তাতেই বাবার এই মন্তব্য। মায়েরাও ততক্ষনে শাড়ির মায়া ছেড়ে ছাতা টাতা বন্ধ করে বিপুল বেগে বয়ে চলা ঝর্ণার গতি আর বর্ষালী সবুজ মেখে যেন কিশোরী হয়ে উঠেছেন। আর এই পুরো দৃশ্যটার ভিডিও সৌভাগ্যবশতঃ আমাদের এখনো সেদিনের কথা মনে করায়। সেখান থেকে Nohkalikai Falls, ভারতের উচ্চতম ঝর্ণা। এই ঝর্ণার নামকরণ নিয়ে একটি ভয়ানক গল্প কথিত আছে, বিধবা লিকাই দ্বিতীয়বার বিয়ে করেছিলো। তার দ্বিতীয়স্বামী মনে করতো লিকাই তার চেয়েও তার পূর্বপক্ষের সন্তানকে বেশি ভালোবাসে। সেই ঈর্ষায় সে, লিকাইয়ের অনুপস্থিতিতে, ছোট্ট শিশুটিকে মেরে তার মাংস রান্না করে রেখেছিলো। যা লিকাই কাজ থেকে ফিরে এসে না জেনে খেয়ে নেয়। পরে জানতে পারলে সন্তানহারা সেই মায়ের কি অবস্থা হয়ে পারে তা সবাই আন্দাজ করতে পারেন। লিকাই রাগে শোকে আত্মহারা হয়ে দৌড়াতে দৌড়াতে এই ঝর্ণায় পড়ে মারা যায়। সেই থেকে এই ঝর্ণার নাম নোহকালিকাই ঝর্ণা।সোহরা পাহাড়ের বৃষ্টি আর মেঘ আমাদের সেই ঝর্ণা দেখতে দিলো না। তা বোধহয় একদিকে ভালোই হলো। কেবল শুনলাম প্রবল গর্জন। আজও যেন সন্তান শোকাতুরা মা লিকাই রাগে, দুঃখে গুমরে চলেছে। প্রবল মেঘ, তার সাথে মিশেছে আছড়ে পড়া ঝর্ণার বাষ্প আর অবিরল বৃষ্টি। নোহকালিকাই এর উপস্থিতি আমরা তার শব্দে প্রবলভাবে অনুভব করলাম, ঝর্ণার ঠিক ওপরেই নির্মিত রেস্তোরাঁয় বসে দ্বিপ্রাহরিক খাবার খাওয়ার সময় হয়তো তার বাষ্পও গায়ে মুখে মাখলাম, কিন্তু তার চাক্ষুষ দর্শন পেলাম না। দুর্ভেদ্য মেঘ আর বাষ্পের মিশ্রণ সমস্ত জায়গাটাকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে রেখেছে।     

চললাম মাওসুমাই গুহার দিকে, প্রকৃতি নির্মিত গুহা, জল চুঁইয়ে পড়ে পড়ে সৃষ্টি হয়েছে অদ্ভুত সব আকৃতি। পিচ্ছিল গুহার ভেতরে আলোর ব্যবস্থা অবশ্য বেশ ভালোই। গুহার একদিক দিয়ে ঢুকে আর একদিক দিয়ে বেরোবার রাস্তা। ভেতরে একেকটা জায়গা এতোটাই সঙ্কীর্ণ যে কোনোমতে একজন মানুষ মাথা নিচু করে ঢুকতে পারে। ক্রনিক আর্থাইটিসের দুজন রুগীকে নিয়ে গুহার শেষ পর্যন্ত না যাওয়াই বুদ্ধিমানের কাজ বলে মনে হলো। তবে যতটা দেখলাম তাতে করে এরকম স্ট্যালাগমাইট, স্ট্যালাগটাইট গুহা দেখার সাধটা গেলো বেড়ে। 
মোট্রোপ রক দেখলাম, যা প্রাকৃতিক আবহবিকারে নির্মিত একটু দৈত্যাকার শাঙ্কবাকৃতি পাথর। অনেকে শিবলিঙ্গও বলেন। অদ্ভুত আদিম জায়গাটা। খাসি উপজাতির শত শত বছরের ইতিহাস, ঐতিহ্য সাক্ষী করে দাঁড়িয়ে আছে দৈত্যাকৃতি পাথর। কোথায় পৃথিবীর কোন গর্ভে প্রোথিত তার মূল, মানুষ তার হদিস পায়নি। আর আজকের ক্ষুদ্র আধুনিক আমরা, আরো ক্ষুদ্রতর মন সম্বল করে তাকে দেখতে এসেছি, প্যাকেজ ট্যুরের একটি পয়েন্ট হিসেবে। হায় রে। 

ফেরার পথে বৃষ্টির বেগ কমেছে। ততক্ষণে অবশ্য কারোরই আর জামা-জুতো ভেজা নিয়ে বলার মতন কিছু নেই। কতবার যে চুপচুপে হয়ে ভিজেছি, আর কতবার যে সে জল গায়েই শুকিয়েছে সারাদিনে তার হিসেবে নেই। ফেরার পথে রামকৃষ্ণ মিশনে কিছুটা সময় কাটালাম। তারপর সোজা বনি গেস্ট হাউস। পরদিন সোমবার ১৫ই অগাস্ট। আমরা ঠিক করেছিলাম এই দিন আমরা শিলং দেখবো। আসলে শনি-রবি-সোম পরপর তিনদিন ছুটিটাও আমাদের এই সময় এখানে আসার একটা কারণ। কিন্তু আমাদের জানা ছিল না যে, ১৫ই অগাস্ট আসাম এবং উত্তর পূর্ব ভারত প্রায় বন্ধ থাকে। বোরো আন্দোলনকারীরা ভারতীয় স্বাধীনতাদিবসে বেশ কিছু সমস্যা করার পর প্রশাসন থেকে এই ব্যবস্থা নিয়েছে। সন্ধ্যের পর একটু আধটু দোকানপাট খোলে। সুতরাং ১৫ই অগাস্ট সারাদিন আমরা ঘরেই বসে রইলাম। বাবা মায়েরা বিয়ে সংক্রান্ত আলোচনা করলো যেটা এখানে আসার তাঁদের দিক থেকে একটা মূল কারণ। আর আমাদের কারণ এই অছিলায়, দুই পরিবারকে দু একদিন পরস্পরকে চিনতে সাহায্য করা। বাঙালি বিয়ে তো দুজনের মধ্যে না, দুই পরিবারের মধ্যে হয়। আমরা সারাদিন, খেয়ে ঘুমিয়ে, বাগানে ফুলের ছবি তুলে শেষে বিকালে সবাই মিলে বেরোলাম। পায়ে হেঁটে আশপাশটা দেখে গেলাম পুলিশ বাজার। মায়েদের ইচ্ছে এখন থেকে কিছু কিনে দেন আমাদের দুজনকে। কোনো দোকানপাট খোলা নেই প্রায়। শেষে অর্ধেক ঝাঁপ ফেলা একটা দোকান থেকে দুজনে দুটো বাড়িতে পরার স্লিপার কিনলাম, যেদুটো সেই ভ্রমণের স্মৃতি নিয়ে এখনো আমাদের সাথে আছে। 

পরদিন, আমরা সারাদিন ধরে দেখলাম শিলং। এলিফ্যান্ট ফলস গিয়ে কেউই বিশেষ বিমোহিত হলো না কারণ গতকালই সবাই বর্ষার ঝর্ণার রূপ দেখে এসেছে। শিলং গল্ফকোর্স বেশ লাগলো সবার। অনেকক্ষণ হেঁটে হেঁটে ঘুরে বেড়ালাম। এটি এশিয়ার বৃহত্তম প্রাকৃতিক গল্ফ কোর্স। দেখলাম ক্যাথিড্রাল অফ মেরি হেল্প অফ খৃষ্টানস। স্থাপত্য হিসেবে শিলং এর সবচেয়ে বড়ো ক্যাথিড্রাল এটি। ইংরেজদের বসতি সূত্রে শিলংয়ে খ্রিস্টধর্ম ছিলই। মনে পড়লো, মনিপুরী বন্ধুটির কথা। হিন্দু রাজ্য মনিপুরে ছিল বৈষ্ণব প্রাধান্য। সেই সূত্রে আমার এই বন্ধুটির বাড়িতেও বৈষ্ণব ধর্মের রীতি। মনিপুর থেকে শিলংয়ে পড়তে আসা ছেলেটি, খ্রিস্টধর্মাবলম্বী অন্য বন্ধুদের সাথে চার্চের অনুষ্ঠানে যেত। ক্রমশঃ তার মনে হলো সে ধর্মবদল করবে। ভাবনাটা যদিও খুবই অপরিণত। একমাত্র মানবধর্ম বাদে কোনো ধর্মই কি স্বয়ং সম্পূর্ণ? এতো কেবল অন্য থালায় বসে একই ভাত, একই তরকারি খাবার মতন বিষয়। তাও সেকথা মনিপুরে তার বাড়িতে বলতে রক্ষণশীল হিন্দু পরিবার তাকে ঘরবন্দি করলো। ছেলেটি কিন্তু পালালো বাড়ি ছেড়ে। পাকাপাকি ভাবে বদল করলো ধর্ম। সেকথা শুনে, আজকের এই আধুনিক যুগেও আজ থেকে মাত্র বছর কুড়ি আগে আমার বন্ধুটিকে তার বাবা কোনোদিন ক্ষমা করেননি। ছেলেটি বাড়ি যেত না। গেলেও দিদিদের সাথে দেখা করে চলে আসতো। একদিন বলেছিলো সব ঘটনা। নিজের লোকেরা তাকে পর করে দিয়ে ছিল বলেই হয়তো দুনিয়া তার বন্ধু হয়েছিল। বন্ধুত্বের সংজ্ঞা বুঝি তার কাছেই শিখতে হয়। শিলংয়ে এই চার্চে এসে আমার কেবলি মনে পড়ছিলো এক বিশেষ মতাদর্শের জন্য পরিবার ত্যাগ করা আমার সেই পাগল বন্ধুটির কথা। আমার একমাত্র উত্তর-পূর্বভারতীয় বন্ধুটির কথা। চার্চ থেকে শেষ বিকালে গেলাম শিলং পিক। তখন সন্ধ্যা নেমেছে। দেখা যাচ্ছে পুরো শহরটা। দূরের শিলং শহরের ঝিলমিলে আলো আর শিরশিরে ঠান্ডা হাওয়ায় আলো-আঁধারী শিলং পিকে দাঁড়িয়ে ছিলাম সবাই, পুরো পরিবার, একসঙ্গে। এরপর আর কখনো সবাই একসাথে কোথাও যাওয়া হয়নি।

এখানেই আমার কাহিনী শেষ হতে পারতো কিন্তু হলো না। কারণটি ক্রমশঃ প্রকাশ্য। পরদিন ১৭ই অগাস্ট গুয়াহাটি থেকে আমাদের ফেরার ট্রেন। শিলং থেকে গাড়িতে সোজা লটবহর নিয়ে গুয়াহাটি রেলস্টেশন। এসে ওভার ব্রিজে উঠে দেখলাম বেশ ভিড়। ভাবলাম কোনো ট্রেন সবে এসে পৌঁছেছে বুঝি তাই ভিড়। বাবা-মায়েদের বললাম ওভারব্রিজেই অপেক্ষা করো কোন প্লাটফর্মে ট্রেন দেবে বা লেট আছে নাকি জেনে আসি। শুধু শুধু সিঁড়ি বেয়ে ওঠানামার ধকল নেবে কেন। সেসময় আমাদের হাতে স্মার্টফোন ছিল না।  সুতরাং স্টেশন এর এনকোয়েরিই ভরসা। দুজনে এনকোয়েরিতে যাবো বলে প্ল্যাটফর্মে নেমে দেখি, সেবছরের কুম্ভমেলাটি সেমুহূর্তে গুয়াহাটি স্টেশনের প্ল্যাটফর্মেই হচ্ছে। তিল ধারণের জায়গা নেই। অগুনতি মানুষের মাথা। প্রতি সোমবার সকালে আর শনিবার সন্ধ্যাতে হাওড়া স্টেশন চত্বরের যাত্রী আমরা দুজনেই। মানুষের মাথা দেখে ভয় পাবো এমন বান্দা আমরা নই। ভাবলাম, কয়েকটা ট্রেন একসাথে ঢুকেছে বা কয়েকটা ট্রেন লেট, তাই এই অবস্থা। প্রবল বিক্রমে দেখি দেখি করে তো বহুকষ্টে কাউন্টারের ছোট্ট জানলাটার সামনে গিয়ে পৌঁছলাম। আর তার পরেই গল্পটা শুরু হলো। 

-হাওড়া যাবার অমুক ট্রেন কোন প্লাটফর্মে আসবে?
-এখন বলা যাচ্ছে না। 
-কেন লেট আছে?
-হ্যাঁ। 
-কতক্ষণ লেট?
-বলা যাচ্ছে না। 
-ওমা! এ আবার কি কথা? কতক্ষণ লেট সেটা বলা যাচ্ছে না?
এবার বাজটা পড়লো।
- মালদায় বন্যা হয়ে রেললাইন ভেসে গেছে। জল না কমলে কিছু বলা যাচ্ছে না। কোনো ট্রেন ওই রুটে চলছে না। 

গত তিনদিন বাংলা-হিন্দি-উর্দু কোনো খবরই শুনিনি। তাই বাজের ধাক্কাটা বড়ো বেশিরকমই লাগলো। ভীড় ঠেলে আবার ব্রিজে উঠে বজ্রপাতটা করলাম। আপাতত ঘর চাই থাকার। যা অবস্থা, হোটেলের ঘর গুলো বুক হয়ে যাবে কিছুক্ষনের মধ্যেই। স্টেশনের কাছেই ময়ূর হোটেল। ফের সেখানেই। কোনোমতে চারজনকে ঘরে ঢুকিয়েই বললাম স্নান সেরে নিতে। ফ্লাইটের টিকিট পাই কিনা দেখি। সঙ্গে সঙ্গে চারদিক থেকে প্রশ্ন- "ফ্লাইট!" "সেতো অনেক টাকা?" "অতো টাকা এনেছিস?" "আমাদের থেকে নিয়ে যা।" "তাহলে এখন এয়ারপোর্ট যাবি তোরা টিকিট কাটতে?" ওরে বাবা, তোমরা স্নান করে আরাম করে বসো, এটিএম কার্ড গুলো আমরা ব্যবহার করি। আর সাইবার ক্যাফে বলে একটা বস্তূ পৃথিবীতে আছে। কোনো মতে তাদের ঠান্ডা করে তো বেরোলাম। লোকজনকে জিজ্ঞাসা করে একটা সাইবার ক্যাফের খোঁজও পাওয়া গেলো। তা সে ক্যাফে তে গিয়ে দেখি সেখানে একটি পেজ খুলতে যা সময় লাগে তাতে গুয়াহাটি থেকে প্লেনে করে কলকাতা চলে আসা যায়। আবার খোঁজ-খোঁজ। পাওয়া গেলো একটি ট্রাভেল এজেন্টের অফিস। সেখানে গিয়ে শেষমেশ সেদিন বিকালের ছয়টি টিকিট তো কাটা গেলো। সমস্যা হলো পেমেন্ট এর সময়। কার্ডে পেমেন্ট তিনি নেবেন না। আবার খোঁজ-খোঁজ এটিএম। প্রথম এটিএম খারাপ, দ্বিতীয় এটিএম- খারাপ, তৃতীয়বারের প্রচেষ্টায় পাওয়া গেলো এটিএম কিন্তু লম্বা লাইন। টাকা না শেষ হয়ে যায়। যাইহোক সেযাত্রা সেটি আর হয়নি। টিকিট পাওয়া গেলো। আর এই দৌড়া দৌড়ির পুরোটাই ভিজে ভিজে। বৃষ্টি আবার আমাদের সঙ্গ নিয়েছিল। সব ব্যবস্থা করে যখন হোটেলে ফিরে এসেছি বাবা মায়েদের নিয়ে এয়ারপোর্টের দিকে বেরোবো বলে, ঘরে ঢুকতে ঢুকতে শুনি শ্রীমতি চিন্তামণি বিয়ে সংক্রান্ত ভাবনা-চিন্তার কাজটি একটু এগিয়ে রাখছেন এইবেলা। হবু বেয়ানকে বলছেন, "আমাদের বরযাত্রী তো বেশি হবে না, এই পঁচিশ-ত্রিশ জন।" আর আমার শ্বশুরমশাই তাঁর ভাবনা-চিন্তাকে মাঝপথেই থামিয়ে দিয়ে বলছেন, "আরে, আগে বাড়ি পৌঁছবে কি করে সেটা ভাবো, ছেলে মেয়ে দুটো এই বৃষ্টির মধ্যে কোথায় ছুটছে, টিকিটের ব্যবস্থা করতে পারলো কিনা কে জানে?" কথোপকথন শুনে হাসবো না রেগে যাবো বুঝে উঠতে না পেরে বললাম, "তাড়াতাড়ি বেরোতে হবে, খেয়ে নিয়ে এয়ারপোর্ট, তিনটেতে ফ্লাইট।" 

রাতে কলকাতায় ফিরে এসে বাবা বললো, "এই তোরা ছিলি বলে ব্যবস্থা করে আজ ফিরে আসতে পারলাম। নইলে আমরা কি করতাম? টাকাপয়সাও তো সীমিত ছিল।"বললাম, "এটিএম কার্ডটা ব্যবহার করলেই তো পারো।" সঙ্গে সঙ্গে বরাবরের মতন ফর্দ শুনিয়ে গেলো যে, কবে কাগজের খবরে বা চেনা জানা কার কার এটিএম কার্ড থেকে কত টাকা চুরি হয়েছে। বললাম, "সতর্ক ভাবে ব্যবহার করলে কেন চুরি হবে? সবাই তো ব্যবহার করে, আমরাও তো ব্যবহার করি। এটিএম কার্ড থাকলে এরকম পরিস্থিতিতে কত সুবিধা বলো। নইলে তো নিজেই বললে ফিরতে পারতে না।"

এটিএম কার্ড ভালো না মন্দ সে মীমাংসা অবশ্য আজও হয়নি। দুপক্ষই যে যার জায়গায় অনড় থেকেছে। শিলং ভ্রমণে আরো অনেক কিছুই হয়নি। বড়াপানির ধারে বসে সন্ধ্যে নামা দেখা হয়নি, মাওনিংলং-এর গ্রামের আজন্মের পরিচ্ছন্নতার পাঠ নিয়ে আসা হয়নি, খাসি গ্রামের মাতৃতান্ত্রিক জীবনযাত্রাও শিখে আসা হয়নি, আদিম গাছের শিকড় জুড়ে বানানো জীবন্ত সেতুর ওপর দিয়ে হাঁটা হয়নি, ব্রহ্মপুত্রের বুকে দেশি নৌকায় বসে অহমিয়া মাঝির গলায় অহমিয়া গানের গুনগুন এর সাথে সূর্যাস্ত দেখা হয়নি, শত অসুবিধা সত্ত্বেও উত্তর-পূর্বের মানুষদের অনাবিল হাসিমুখের রহস্যভেদ করাও হয়নি। কিন্তু যা হয়েছে তা অনেক। দুটি অপরিচিত পরিবার পরস্পরের পরিচিত হয়েছে। বাকি না হওয়া গুলো না হয় কোনো একসময় হয়ে যাবে।  



                       







  

Tuesday 6 February 2018

ইচ্ছে ছিল

ইচ্ছে ছিল
শিশির মাখা নরম ঘাসে
উপুড় হয়ে
চোখে মুখে শিশির মাখার।

ইচ্ছে ছিল
খোলা নৌকায় সমস্ত রাত
চিৎ হয়ে
মহাসাগরের মাথার ওপর তারা দেখার ।

ইচ্ছে ছিল
দেখবো বসে তেপান্তরের মাঠের পারে
কেমন করে
ভোর হয়ে যায় রাত্রি থেকে।

ইচ্ছে ছিল
নদীর সঙ্গে পথ চলার
কেমন করে
পাহাড় থেকে পথ খুঁজে নেয় সাগর পানে।  
  
ইচ্ছে ছিল, ইচ্ছে থাকে, ইচ্ছে থাকুক মায়ায় মুড়ে।
আমি কেবল মিথ্যেকারের স্বপ্ন দেখি ইচ্ছেমতন ইচ্ছে জুড়ে।

Monday 5 February 2018

অভিমান



জমানো সব অভিমানগুলোকে
উবে যেতে দেব বলে,
দুপুরবেলার রোদ্দুরের সাথে মিশিয়ে
বিছিয়ে রেখেছিলাম উঠোনে।

তারপর নিশ্চিন্ত মনে ভাতঘুম দিয়ে উঠে দেখি,
উবে যাবার বদলে-
রোদে পুড়ে আরও পোক্ত হয়ে উঠেছে
আমার কাঁচা অভিমানগুলো।

এখন আমার বরাদ্দ দুপুরের রোদ্দুরটাও
গিয়েছে খরচ হয়ে।
হাতের কাছে আর কিছু তো নেই
খরচ করার মতন।

এইবার এই রোদে-পোড়া, জমাট, পোক্ত
অভিমানগুলোকে নিয়ে আমি কি করি?