Sunday 13 February 2022

বেয়াদব মন

শিশির নামে ক্লান্ত কাঁধ বেয়ে। অযত্নের লালচে চুলের ডগায় জমেছে রুক্ষতা। চিড় ধরেছে। দ্বন্ধ হয়েছে বৃদ্ধি। শিশিরে ভিজেও রুক্ষতা ঘোচেনা তার। মাঝরাতের মেঘহীন আকাশের নিচে দাঁড়িয়ে ধীরে ধীরে ভোর হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করলে কি ধীরে ধীরে গলে যাবে সমস্ত দীর্ঘ্যশ্বাস? অর্ধেকটা প্রশ্বাস নিতে নিতে আর অর্ধেকটা নিঃশ্বাস ছাড়তে ছাড়তে ক্রমশঃ কমে যাচ্ছে হৃদযন্ত্র এবং ফুসফুসের ক্ষমতা। প্রকাশ্যে আসে না এসব কথা। অহেতুক দুঃখ বিলাসিতা বলে একলা মানুষকে আরও একলা করে দেবে বাকিসব আত্মপ্রত্যয়ী মানুষেরা। সকলেরই ভাগ না করে নেবার মতন কিছু যন্ত্রণা থাকে। থাকে কোনো সমাধান না থাকা সমস্যা। থাকে অনিবার্য ক্ষয়। সেসবই ক্লান্তি হয়ে নেমে আসে ঘাড়-পিঠ-চুল বেয়ে। এবং তৎক্ষণাৎ সেসব মনের খোরাক হয়ে যায়। 

মনের কাজই হলো এতটুকু তিলপ্রমাণ বাধার সন্ধান পেলেই তাকে বিশ্বব্যাপী দুর্লঙ্ঘ্য বাধা বলে প্রক্ষেপ করা। তবুও মনের চলনে লাগাম পরানো যায় না। আবার ভালোর সন্ধান পেলে সেই মনই বলে - এই তো বেশ শান্তি! দৈবিক, আধিদৈবিক, আধিভৌতিক সমস্ত পার্থিব যন্ত্রণার ওপরে উঠে মন ঠান্ডা হয়ে আসে। এই যেমন ঘরে ঢুকলেই একটা স্নায়ু শান্তিকর সুগন্ধ আসে নাকে। একটা সুগন্ধী মোমবাতি জ্বলছে কয়েকদিন ধরে। কয়েকদিন বলতে সন্ধ্যায় জ্বলে, রাতে ঘুমোতে যাবার আগে নিভিয়ে দেওয়া হয়। এমন যদি হতো সবকিছুই! এই মনে করো, মন ঠান্ডা করার আয়োজন রইলো হাতের কাছেই সারাদিন ধরে, প্রয়োজন মতো জ্বালিয়ে নেওয়া যেত! এইসব আবোল-তাবোল ভাবনায় সন্ধ্যা কেটে যায়। উদ্যোগী কর্মযোগীরা এরকম পড়ে পাওয়া সন্ধ্যায় কত কীই না করে। বিন্দু বিন্দু কর্ম যোগ করে করে সাগর তৈরী করে। আর আমি বসে এতোল-বেতোল ভেবে মরি। তার মধ্যেই কখন সন্ধ্যে ফুরিয়ে রাত নেমে আসে! এমন করে সাগর কেন, ডোবাও তৈরী হয়না। অবশ্য মাঝে মাঝে ভাবি, এমন কীই বা রয়েছে যা দিয়ে কিছু করা যায়! আমি তো কর্মযোগী নই। এই যে কত কিছুই না ঘটে চলেছে চারিপাশ জুড়ে তার একখানি বেশ সমঝদার শ্রোতা-দর্শক তো চাই। নইলে স্রষ্টা এবং সৃষ্টির উপলক্ষই যে মাটি। আবার মনে হয়, এসব ভাবনা আসলে অলস মনের চলন। যার বেয়াদপিতে আদত আমিটিকেই বেমালুম ভুলতে বসেছি। কাজ না করবার বাহানায় নিজেকেই ফাঁকি দিচ্ছি। হবেও বা। প্রতিদিনের অজস্র খুচরো দাবি মেটাতে গিয়ে প্রধান কাজটিতেই পড়েছে ফাঁকি। মনের এইসব খেলায় ভুলে ছোট ছোট আনন্দের নুড়ি দিয়ে ঝোলা ভরে নিয়ে, সাগরের ঢেউয়ের দোলায় দোলবার বিপুল প্রাণময়তাটিকেই জলাঞ্জলি দিয়ে এইবার ফিরবার সময় হতে চললো। 

সাগরের কথায় মনে পড়লো, একবার একজন গাইছিলেন -"রূপগঞ্জের হাটে আইসা...., পরের কথাগুলি আর মনে নেই। তখন বসে ভাবছিলাম, "রূপসাগর, রূপগঞ্জ, রূপনগর... শব্দকোষের এসব আউলিয়া শব্দ মানবজীবন বা ভবসংসারে মানুষের ক্ষণিকের অবস্থান বোঝাতে ব্যবহার করা হয়। কিন্তু 'রূপ' কথাটা সবেতেই রয়েছে। "রূপ" কেন? একটু ভেবে কিছু মানে বের করতে পারছিলাম না। মাথা দিয়ে সেরকম ভাবে ভাবছিলাম না হয়তো। একজনকে জিজ্ঞাসা করলাম। তিনি বললেন, হয়তো রূপ মানে সৃষ্টি বা ক্রিয়েশন অর্থে ব্যবহার করা হয়। এই যে চোখ খুললেই আমরা এত কিছু দেখছি এবং প্রায় সমস্ত কিছুর মধ্যেই এত সৌন্দর্য্য, সেই কারণেই হয়তো রূপ কথাটা ব্যবহার করা হয়। কথাটা মনে ধরলো। রূপসাগরের রূপক সত্যিই বেশ পরিচিত। আসলে আউলিয়া বা সুফী সাধকদের অল্প কথায়, সহজ সুরে, সাধারণ জীবনযাত্রার রূপক ব্যবহার করে অনন্ত এক সত্যের কথা বলে যাওয়াটা আমাদের মতন দেশের বিশাল সংখ্যক মানুষদের জন্য অজান্তেই আধ্যাত্মিকতার একটা সুর বেঁধে রেখে দিয়েছে। আজকালের এই পল্লবগ্রাহীতার যুগে আধ্যাত্মিকতার কথা বললে অবশ্য অনেকেই ধর্মীয় বাধা নিষেধ ইত্যাদির প্রসঙ্গ তুলে অনর্থক তর্ক করবেন। অথচ তিনি নিজেও ছোটবেলায় শুনেছেন, একটা বয়স পর্যন্ত মনে মনে বিশ্বাস করেছেন, পালন করেছেন এমন কিছু নিয়ম, যা তৈরী হয়েছিল বিস্তারিত একটি সত্যজ্ঞানকে, লালন করার মতো একটি অভ্যাসকে সাধারণ নিয়মের নাম দিয়ে সকলের মধ্যে দিয়ে যুগ যুগ ধরে বয়ে নিয়ে যাবার সাধু উদ্দেশ্যে। 

এসব ভেবে সন্ধ্যে পার করি। এসব ভাবনার না আছে আদি, না আছে অন্ত। শুধু ভাবনার ভেলায় হাল-দাঁড়হীন দিগভ্রান্তের মতো ভেসে চলা। মনের হাতছানিতে ভেসে চলার যে মারাত্মক নেশা, যাঁর আছে সে জানে। চারিপাশের সমস্ত কিছুকে দশেন্দ্রিয় মন্থন করে আদ্যন্ত শুষে নিয়ে, মন আর বুদ্ধির ক্ষুদ্রতা দিয়ে সাধ্যমত বিশ্লেষণ করে, অহং -এর ভ্রান্ত রং মিশিয়ে চিত্তাকাশে যে ছবিটি প্রতি মুহূর্তে রচিত হয়ে চলেছে, তার কত শতাংশ যে আদতে সত্য- তা বোঝার ক্ষমতা বেচারি মনের আর রইলো না। সে বেশ রঙিন একটি ছবি দেখে এবং দেখিয়েই তার দায় শেষ করলো। এখন এই বিপুল ছবি থেকে সত্য-মিথ্যা বাছাই করতে করতে এবং তদসংক্রান্ত অনুভূতির প্রকাশ সামাল দিতে দিতেই 'আমি' বেচারির দিন গেল। আসল সমে আর ঠিক সময়ে তালটি পড়লো না। মনকে শাসন করে এ নেশা কাটিয়ে বেরিয়ে আসা কঠিন। মানসলোকের একটি তিল থেকে কখন যে তাল, আর সে তাল থেকে কখন যে চোখের সামনে ভুলের একটি বিশাল ইমারত তৈরী হয়ে বসবে বোঝার উপায়টি রইবে না। ভালোর ভালোটিকে বাড়াবে না, কেবল কালোর কালোকে মিশকালো করে তুলবে। এমনই বেয়াদব মন!