Sunday 26 October 2014

দেওয়ালী.........৩


দেওয়ালী.........২ এরপর  

“আরে ভাই ম্যায় ক্যায়া তেরে লিয়ে পুরি রাত ব্যায়ঠে রহুঁ? যো বাকি হ্যায় জমা কর দে, প্যায়সা লেকে ঘর যা......আরে উও প্যাকেট দে মুঝে......শালা।” বিনোদ মকবুলের হাতের প্যাকেটটার দিকে ইঙ্গিত করে।
মকবুল পায়ে পায়ে এগিয়ে এসে প্যাকেটটা বাড়িয়ে ধরে। শনু নিঃশ্বাস বন্ধ করে অপেক্ষা করে পরবর্তী অগ্নুৎপাতের জন্য। বিনোদ এসে ছিনিয়ে নেয় প্যাকেটটা। নিজে নিজেই বিড়বিড় করে, “অ্যায়সে হি শালা দের হো গ্যায়া।” প্যাকেট খুলে ভুরু কুঁচকে কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে থাকে বিনোদ। শনু এসে মকবুলের পাশে এসে দাঁড়ায়। মকবুল অনুভব করে তার হাঁটুর গরম ভাবটা চলে গিয়ে আস্তে আস্তে ঠাণ্ডা হয়ে যাচ্ছে হাত আর পায়ের পাতা।
বিনোদ তাকালো মকবুলের দিকে। “ইয়ে ক্যায়া? মজাক হো রাহা হ্যায় ক্যায়া?”
শনু এগিয়ে আসে। “বিনোদ ভাইয়া, শুনো না, অ্যাকসিডেন্ট হুয়া হ্যায় মকবুলকা, দেখো না ক্যায়সে খুন নিকল রাহা হ্যায় ঘুটনে সে। গাড়ি ডাঁয়ে প্যায়ের কে উপর সে চলতে চলতে রাহে গ্যায়ে।”
এত বলেও বিনোদের দৃষ্টি প্যাকেট থেকে মকবুলের পায়ের দিকে ঘোরাতে পারলো না শনু। কয়েক সেকেন্ড মকবুলের দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে ভেতর দিকে চলে গেল বিনোদ।
শনু এসে মকবুলের বরফঠাণ্ডা হাত ধরে বলল, “ঘাবড়ানা মৎ ইয়ার। ম্যায় ভি তো হুঁ।” মকবুল একহাতে একটা খুঁটি অন্য হাতে শনুর হাত চেপে ধরল। বিক্রম শেঠ বেরিয়ে এল খুব শান্ত ভাবে। -“কিতনে প্যাকেট দিয়ে থে তুনে শালে কো আজ বিনোদ?”
-পাঁচাশ শেঠজি।
-পুরা গ্যায়া?-মকবুলের দিকে তাকিয়ে শান্ত স্বরে জিজ্ঞাসা করে বিক্রম শেঠ।
শনু তাড়াতাড়ি বলে ওঠে “নেহি শেঠ, বেচা থা না পেহেলে কুছ। দশ- বারা প্যাকেট তো বিক গ্যায়ে থে......হ্যায় না মকবুল?”
“তু চুপ কর শালে, তুঝ সে পুছা ম্যায়নে কুছ?” এক ধমক দিয়ে ওঠে শেঠ শনুকে। তারপর দুপা এগিয়ে গিয়ে মকবুলের মুখোমুখি দাঁড়ায়। “তু বোল, কিতনে প্যাকেট বিকা থা?”
-“চার” মুখ নিচু করে বলে মকবুল।
হঠাৎ ঠাসিয়ে একটা চড় কষায় বিক্রম শেঠ মকবুলের গালে। তার ধাক্কায় পাশে রাখা বস্তা-প্যাকিং কেসের ডাঁই এর ওপরে প্রায় পড়তে পড়তে সামলে নিল মকবুল। “শালা চার প্যাকেট বিকা হ্যায় পুরি দিন মে। বাকি কে সারে ধুল বানা কর লে আয়ে মেরে মু পে ডালনে কে লিয়ে? বাকি কে প্যায়সা কৌন দেঙ্গে? তেরা বাপ? শালা উসকা ভি তো পতা হ্যায় মুঝে। বাকি চালিশ-প্যাঁয়তাল্লিশ প্যাকেটকা প্যাঁয়তিশ রূপেয়া কে হিসাবসে পুরা প্যায়সা ওয়াপাস চাহিয়ে মুঝে। সমঝা কুত্তা শালা?” –চেঁচিয়ে ওঠে শেঠ।
-“শেঠ?”-আস্তে করে ডাকে শনু।
-“তু বিচ মে মৎ বোলনা। তুঝকো ভি ক্যায়া দুঁ ক্যায়া খিঁচকে এক?”
শনু তাও দু পা পিছিয়ে গিয়ে বলে ওঠে, “বহুত খতরনাক অ্যাকসিডেন্ট হুয়া থা শেঠ মকবুল কা। প্যায়ের দেখিয়ে না উসকা শেঠ জি।”
-“সব দিখতা হ্যায় মুঝে। শালা মর তো নেহি গ্যায়া না? আপনে প্যায়ের কি উপর হি তো খাড়া হ্যায় না? কোই হাড্ডি-উড্ডি নেহি টুটা না? কিতনা খতরনাক অ্যাকসিডেন্ট সব পতা হ্যায় মুঝে। শালা কামচোর। পুরি দিন মে চার প্যাকেট? শালা বাকি কে দিন ক্যায়া কর রাহা থা বোল।”
-“শেঠ, উও প্যাকেট কা মোম ফ্যাক্টরি মে দে দেনে সে ফির সে বন যায়েগা” – শনু একটা শেষ চেষ্টা করে।
মকবুলকে ছেড়ে শনুর দিকে এগিয়ে আসে বিক্রম শেঠ। কোমরের প্যান্টটা একটু তুলে নেয়। তারপর খুব ঠাণ্ডা গলায় শনুর ঘাড়টা শক্ত হাতে ধরে বলে, “চল, নিকল ইঁহা সে। বহুত দের সে ফটর-ফটর কর রাহা হ্যায় তু। তু দেগা প্যায়সা মেরা? চল শালে, নিকল ইঁহাসে।” এক ধাক্কায় দরজার কাছে এসে পড়লো শনু।
গোডাউনের দরজায় একটা হাত রেখে হতভম্বের মত দাঁড়িয়ে আছে আসলাম শেখ। উঠে দাঁড়িয়ে তার কাছে গিয়ে অসহায়ের মত বলল শনু, “মকবুল কো বাঁচা লিজিয়ে চাচা। উসকা কোই গলতি নেহি হ্যায় চাচা।” যাকে উদ্দেশ্য করে বলা তার কথাটা কানে ঢুকেছে কিনা বোঝা গেল না। আকুল চোখে ছেলের পরবর্তী হেনস্থা কি হতে পারে তাই দেখছে। তার পেছনে দুচোখে ভর্তি প্রশ্ন নিয়ে জড়ো হচ্ছে সিগন্যাল ফেরত বাকি মনসুর-সুরিন্দর-জাভেদ-রোশনী-আসমারার দল। কারো হাতে টিস্যু পেপার, কারো হাতে গাড়ি মোছার নরম কাপড়, কারো হাতে প্লাস্টিকের বাঁশি, কারো হাতে আবার তাদের মতই মোমবাতি বা আবিরের প্যাকেট। সারাদিন নানান সিগন্যালে ঘুরে ঘুরে ধুলোমাখা রুক্ষ চুল আর খড়ি ওঠা লিকপিকে হাতপা নিয়ে অন্নসংস্থানে বেরিয়েছিল। সবারই টিকি বাঁধা এই বিক্রম শেঠের গুদামে।
বিক্রম শেঠ বাঁ হাতে মকবুলের গলাটা ধরে খুঁটির সঙ্গে ঠেসে ধরল ওকে। বুটপরা পা টা পড়ল মকবুলের জখম ডান পায়ের নখের উপর। যন্ত্রণায় কাতরে উঠলো মকবুল। চোখ- মুখ কুঁচকে হজম করছে সে ব্যাথাটাকে। “বহুত দরদ হো রাহা হ্যায় না শালে। কৌন সি দুনিয়া মে রহেকে কাম করতে হে বোল? কিসিকো কুছ নেহি হোতা তেরে সাথহি খতরনাক অ্যাকসিডেন্ট হোতা হ্যায়? ঝুটে শালা। মুঝে মেরে প্যায়সা চাহিয়ে ব্যস।”- সাথে সাথে হাতও চলছে সমান তালে। মকবুল একদম নেতিয়ে পড়েছে।
ততক্ষণে আসলাম শেখ আর জাভেদ-রোশনীর দল জেনে নিয়েছে পুরো ঘটনা। মকবুলের অবস্থা দেখে বিনোদ এগিয়ে আসে। “শেঠজি, ছোড় দিজিয়ে। মর যায়েগা নেহি তো।”
“ছোড় দিজিয়ে মতলব? কিতনে রূপিয়ে কা নুকশান হুয়া হ্যায় পতা হ্যায় তুঝে? শালা অ্যাকসিডেন্ট দিখা রাহা হ্যায় মুঝে। কৌন ভরেগা নুকশান?”
“উসকা হি রোজ সে কাট লেনা আপ। আভি আউর মৎ মারিয়ে, কুছ হো যায়েগা তো আপ কে উপর মুস্কিল আ সকতা হ্যায়।”
একটু থমকাল বিক্রম শেঠ।
এতক্ষণে সম্বিৎ ফিরে এল আসলাম শেখের। সামনে গিয়ে হাতজোড় করে বলে, “ছোড় দিজিয়ে জনাব। মর যায়েগা বেচারা। দেওয়ালী কে দিন হ্যায় শেঠজি, মাফ কর দিজিয়ে।”
“দেওয়ালী সে তেরা ক্যায়া হ্যায় রে? শালা মুসলমানকে বাচ্চে। দেওয়ালী দিখাতা হ্যায়। মেরা চালিশ প্যাকেট কা প্যায়সা তুঝে ভরনা পড়েগা।”
মাথা নিচু করে বসে পড়ে আসলাম শেখ। “ছোড় দিজিয়ে শেঠজি। ফির সে অ্যায়সা কভি নেহি হোগা মকবুলসে।”
“ফির সে কভি নেহি হোগা ইয়ে তো মুঝে ভি পতা হ্যায়। কিঁউকি কাল সে তু নেহি আয়েগা সমঝা?” –মকবুলকে ঠেলা মেরে বলল বিক্রম শেঠ। মকবুলকে ছেড়ে বিনোদের দিকে গিয়ে বলল, “ইস কো কাল সে গোডাউন মে ঘুসনে মৎ দেনা বিনোদ। ইস তরহ কে বাচ্চে সে মেরা কাম নেহি চলেগা। সমঝা?”
-“অর নেহি হোগা শেঠজি। নিকাল মৎ দিজিয়ে মুঝে।”-এতক্ষণে কোনমতে বলতে পারে মকবুল। খুঁটি থেকে খসে ওখানেই বসে পড়লো মকবুল। আর দাঁড়িয়ে থাকার শক্তি ছিল না তার।
“চোপ শালে।”-চেঁচিয়ে ওঠে বিক্রম শেঠ।
“অ্যায়সা মৎ করনা শেঠজি। মাফ কর দিজিয়ে। ম্যায়নে আপকা পুরা প্যায়সা চুকা দুঙ্গা।” –হাতজোড় করে বলে আসলাম শেখ।
“উও তো তু দেগা হি।”- বলে ভেতরের দিকে চলে যেতে থাকে শেঠ।
বিনোদ হঠাৎ বলে ওঠে, “শেঠজি, মেরা এক বাত শুনিয়ে, আপ ইসকো নিকাল দেঙ্গে ত ইস কা বাপ আপকো প্যায়সা না দে তো? আপ উসকো কাঁহা ঢুঁড়েঙ্গে, মকবুল আপকে আন্ডার রহে তো আপ উসকে রোজ সে প্যায়সা কাট সকতে হেঁ।”
“নেহি বিনোদ তু মুঝে মৎ সমঝা। অ্যায়সা মাফিক কাম করে তো ক্যায়া ফায়দা, পুরি দিন মে চার-পাঁচ প্যাকেট বিকা, উপর সে নুকশান। ইস সে নেহি চলেগা।”
“ঠিক হ্যায় আপ প্যায়সা ওয়সুল তক রাখ লিজিয়ে। ফির নিকাল দেনা। নেহি তো আপ কা প্যায়সা ভি ওয়সুল নেহি হো সাকতা হ্যায়............” –শেঠজির পেছন পেছন ভেতরের অফিস ঘরের ভেতর মিলিয়ে যায় বিনোদ।
এতক্ষণে শনু পায়ে পায়ে এগিয়ে আসে মকবুলের দিকে। “উঠ মকবুল।”
মকবুলের গলার কাছে কেমন যেন একটা হচ্ছে। কান্না পাচ্ছে। শুখনো চোখে আব্বুর দিকে তাকাল মকবুল। গোডাউনের মেঝেতেই বসে আছে সেই থেকে মানুষটা মাথা নিচু করে।
“আব্বু”- আস্তে করে ডাকে মকবুল। কোনো সাড়া নেই। শনুর হাতে ভর দিয়ে উঠে দাঁড়ায় মকবুল। মার খেয়ে তার কান-গাল গরম হয়ে গেছে। নাক দিয়ে গরম নিঃশ্বাস পড়ছে। ঠিক জ্বর হলে যেমন হয়। আস্তে আস্তে এগিয়ে যায় সে আব্বুর দিকে। পাশে বসে পিঠে হাত দিয়ে ডাকে, “আব্বু?”
হঠাৎই যেন রক্ত চড়ে যায় আসলাম শেখের মাথায়। বসে বসেই এক লাথি কষায় মকবুলকে। “শালা, শুয়ার। সরে যা সামনে থিকে। কোথাও শান্তি নেই? একটা কাজও মন দিয়ে করতে পারনি শালা ইবলিসের বাচ্চা? দুটো পয়সা রোজগার হচ্ছিলো, সইলনি সেটা? বাপের ঘাড়ে বসে গিলতে লজ্জা করেনে? খেতে বসে তো কোন ভুল হয়নে। শালা তোকে গোরে দিয়ে তবে আমার শান্তি।”
এতক্ষণে যেন সন্ধ্যে থেকে তার সাথে ঘটা সব ঘটনার যন্ত্রণা উপচে ওঠে মকবুলের দুচোখ বেয়ে। এতক্ষণের মারধর-গালিগালাজ-ডান পায়ের জখম সবকিছুকে দাঁত চেপে সহ্য করেও এবার আর পারে না মকবুল। মেঝেতে বসেই অঝোরে কাঁদতে থাকে সে। দুহাত দূরে দাঁড়িয়ে পাথর হয়ে যায় শনু।
আসলাম শেখ ততক্ষণে বাঁ হাতের উল্টোপিঠটা দিয়ে একবার চোখটা মুছে নিয়ে গোডাউনের দরজা ছেড়ে বেরিয়ে যাচ্ছে। “জাভেদ, মকবুল কো দেখ না”- বলে পেছন পেছন দৌড়োয় শনু।
বিক্রম শেঠকে ভেতর থেকে বেরিয়ে আসতে দেখে মকবুল তাড়াতাড়ি জামার হাতায় চোখ-মুখ মুছে উঠে দাঁড়ালো। তার দিকে এতটুকুও না তাকিয়ে পেছন পেছন আসা বিনোদকে বলল বিক্রম শেঠ, “ম্যায় চলতা হুঁ, ইসকো সমঝা দেনা, ম্যায় এক মাহিনা দেখুঙ্গা, মেরা নুকশান কা প্যায়সা ইসকে অন্দর ভর জানা চাহিয়ে। কৌন ভরেগা, ইয়ে ক্যায়া ইসকে বাপ উস সে মুঝে কই লেনা দেনা নেহি। ফের সে অ্যায়সা হোগা তো উস হি দিন উসকা লাস্ট হোগা। অর বাকি বাচ্চোঁকা হিসাব বরাবর রাখ দে। আজ কা পেমেণ্ট কাল একসাথ হো জায়েগা।”
দরজার সামনে গিয়ে হাতের জাঁদরেল হেলমেটটা মাথায় পরে বাকলস আঁটতে আঁটতে বলে, “হাঁ বিনোদ, জলদি সে গোডাউন বন্ধ করকে শুখলাল কো চাবি দে দেনা। দেওয়ালী কে দিন ফালতু বখেড়া শালা মুসলমানকা বাচ্চা, শালা হারামি, দিন হি খারাব কর দিয়া।” তার দিকে একবার তাকিয়ে মোটরবাইকে স্টার্ট দিয়ে বেরিয়ে যায় বিক্রম শেঠ। মকবুল খুঁটি ধরে দাঁড়িয়ে থাকে।
“আজ কা পেমেণ্ট নেহি মিলেগা ক্যায়া বিনোদ ভাইয়া? মালিক তো চলা গ্যায়া।”- আসমারার কথায় তাকায় বিনোদ। বলে, “শুনি নেহি? মালিক নে ক্যায়া বোলা? কাল একসাথ হো জায়েগা। আভি কিস কে পাশ ক্যায়া বাঁচা হ্যায় জলদি এন্ট্রি কর দে। গোডাউন বন্ধ করনা হ্যায় মুঝে।” আসমারা উশখুশ করে ওঠে। “হামলোগ ক্যায়া কিয়া? উস কে লিয়ে মেরা পেমেন্ট কিঁউ রুকেগা? মুঝে প্যায়সা চাহিয়ে।” 
“এ বাচ্চি, যাদা বোল মৎ। মালিক কো কিঁউ নেহি বোলা ফির? তেরে সামনে সে হি তো গ্যায়া না? ম্যায় তুঝে পেমেন্ট করতা হুঁ ক্যায়া? ইধার আ সব। কিসকা কিতনা প্যাকেট বাকি হ্যায় বোল জলদি।”
বিনোদের টেবিলের চার পাশে ভিড় করে সবাই। আসমারা যাবার সময় ভুরু কুঁচকে তাকায় একবার খুঁটিতে হেলান দেওয়া মকবুলের দিকে। সবার ফেরত আনা জিনিসপত্র জমা করতে করতে একসময় মকবুলের দিকে তাকিয়ে বলে ওঠে বিনোদ, “তু আভি ভি ইঁহাপর কিঁউ খাড়েঁ হ্যায়? যা ঘর যা। কাল সুভে আ যা না জলদি। অর শুন, যাতে টাইম সাঁই মেডিকেল হল সে ডেটল-ওয়েটল- দাওয়াই যো চাহিয়ে লাগা লেনা প্যায়ের মে। সুঁই লাগানা হে তো ওহি লাগা লেনা। ইস সে ফির বুখার-উখার চড় যায়ে তো কাম চৌপাট। তব ম্যায়নে ফির সে তেরে লিয়ে  শেঠ কো কুছ না বলুঙ্গা। ইয়ে ম্যায়নে আজ সাফ বোল দিয়া। যা ঘর যা? কাঁহা গ্যায়া তেরা বাপ?”
সে কথাটা মকবুলও ভাবছিল। পায়ে পায়ে রাস্তায় বেরিয়ে এসে এদিক ওদিক দেখল মকবুল। না শনু না আব্বু কাউকেই দেখতে পেল না মকবুল। শনুটারও হেনস্থা হল আজ তার জন্য। কোথায় যে গেল আব্বুর পেছন পেছন? চকের দিকে কয়েক কদম এগিয়ে ফুটপাথের একধারে ডান পা টা মেলে বসে পড়লো মকবুল। পায়ে অসহ্য ব্যাথা। হাঁটুটা ভাঁজ করতে পারছে না সে। মার খেয়ে নেতিয়ে পড়েছে। সারাদিনের পর খিদেও পেয়েছে প্রচুর। আর টানতে পারছে না সে। আবছায়ায় বসে বসে হঠাৎ মায়ের জন্য মনটা হু হু করে উঠল মকবুলের। কান্নাটাকে কিছুতেই থামাতে পারল না সে। বাঁ হাঁটুতে মাথা রেখে ফুঁপিয়ে উঠলো মকবুল।
হঠাৎই শুনল, “আরে বিচ মে বৈঠ গ্যায়া দেখ। আ বে হট না শালে। ফুতপাথ মে ভি চলনা মুশকিল হো গ্যায়ে হে ইয়েসব কে লিয়ে।” মাথা তুলে মকবুল দেখল বুটপরা দু-জোড়া পা ফুটপাথে ঠিক তার সামনে। তাড়াতাড়ি উঠে দাঁড়ালো সে। লোকদুটো চলে গেল ওর দিকে তাকাতে তাকাতে। ভাল করে চোখ-মুখ মুছে ডানদিক-বাঁদিক দেখতে দেখতেই দেখতে পেল আব্বু আসছে সাথে শনুও। রাস্তার আলো তাদের মুখে না পড়লেও দূর থেকে মানুষ দুজনকে চিনতে ভুল হয়না মকবুলের। ওকেও তারা দেখতে পেয়েছে। সোজা তার দিকেই আসছে।
ভয়ে ভয়ে আব্বুর দিকে তাকালো মকবুল। আব্বুর ভাগেরটা এখনো বাকি আছে তার। শনু বলে ওঠে, “তুমলোগ ইঁয়হি পে থোড়ি দের রুকো চাচা। ম্যায় আজ কা পেমেণ্ট লেকে আভি আয়া।”
“গোডাউন বন্ধ হ গ্যায়া শনু। সবকা পেমেন্ট কাল হোগা, মালিক চলা গ্যায়া আজ।”-মকবুল জানায় শনু কে।
“তুঝে ক্যায়া বোলা মালিক নে যানে কে টাইম পে?” প্রশ্নটা শনু করলেও আব্বুরও চোখে একই প্রশ্ন দেখতে পেল মকবুল। “কাল জলদি গোডাউন আনে কে লিয়ে বোলা হ্যায়। উসকা প্যায়সা এক মাহিনাকে অন্দর ওয়াপাস করনা হ্যায় ব্যাস”-আব্বুর দিকে আড়চোখে তাকিয়ে জানায় মকবুল। শনুর মুখে হাসি ফুটে ওঠে।
আর মকবুলকে অবাক করে একটা পাতলা হাসি ফুটে ওঠে আসলাম শেখের মুখেও। মকবুল তাকিয়ে থাকে আব্বুর মুখের দিকে। আব্বু বলে ওঠে, “চল তবে, ও টাকা আমি রিসকা টেনে শোধ দিয়ে দুবো অনে। এখুন চ মেলার মাঠে বাজি দেখতে যাবি যে তোরা আজ? শনু বলেছে মোকে সব।” হাঁ করে তাকিয়ে থাকে মকবুল আব্বুর দিকে। তারপর শনুর দিকে তাকায়। শনু হাসছে মিটিমিটি। আব্বু বলে- “কি রে চল। রাত দশটা অবধি হবে রোশনাই। এরপর গেলে আর দেখতে পাবিনি। হাঁটতে হবেনি অতটা আর। তোরা ডেঁইরে থাক ইখানে। আমি ঝট করে রিসকাটা লিয়ে আসি। এই যাব আর আসব, ইস্ট্যান্ডে তালা মেরে এসেছি রিসকাটা।”
“ঘরে গিয়ে রান্না করতে হবে যে আব্বু। দেরি হবে।” অস্ফুটে বলে মকবুল।
“নাহ, আসার সময় আমাদের ইস্ট্যান্ডের পাশে জিতেন্দরের ঠ্যালা থেকে তিনটে এগরোল আনব ঠিক করেছি। পরে খিদা পেলে না হয় ঘরকে গিয়ে ভাত ভিজানো আছে, প্যাঁজ লঙ্কা মুলে খেয়ে লিলেই হবে। কি বল? শনু তু এগরোল খায়েগা না?”
শনু একগাল হেসে ঘাড় কাত করে।

মকবুলের চুলগুলোকে একটু ঘেঁটে দিয়ে পিঠে আলতো চাপড় দেয় আসলাম শেখ। বলে, “ডাঁড়া ইখানে দুজনে এট্টু। আমি এই যাবো আর আসবো।” মুখে আলতো হাসি নিয়ে দ্রুত পা চালায় আসলাম শেখ রিক্সা স্ট্যান্ডের দিকে। শহরের হলদে আলোর নিচে দাঁড়িয়ে মকবুল দেখে তার আব্বুর দ্রুত মিলিয়ে যাওয়া অবয়ব। পাশ থেকে শনুর চোখে পড়ে তার বন্ধুর চোখে এক ফোঁটা টলটলে জল রাস্তার আলোয় চকচক করছে। বাঁ হাতটা দিয়ে মকবুলের ডান হাতটা জড়িয়ে ধরে শনু।                     

(শেষ)
দীপাবলি  
অর্পিতা চ্যাটার্জী 



Friday 24 October 2014

দেওয়ালী............২

দেওয়ালী............১ এর পর 

চলতে চলতেই বাঁ-দিকে চোখ ফিরিয়ে দেখতে পেল আবার একটা আলোর ফুলকি। ওপরে উঠে বিশাল ফুল হয়ে ফাটবো ফাটবো করছে। “শনু-উ-উ-উ-উ উপর দেখ”-চেঁচিয়ে উঠল মকবুল। শনু তার দিকে তাকালো তার ডাক শুনে। আর তখনি কেমন যেন সব গণ্ডগোল হয়ে গেল মকবুলের। বাঁ দিকের আকাশ থেকেই যেন বিশাল একটা আলোর ঝরনা নেমে এল মকবুলের ওপর। চারপাশ থেকে গাড়িগুলো হুহু শব্দে ছুটে চলেছে সিগন্যাল সবুজ হতেই। চারপাশ থেকে ধেয়ে আসা অজস্র গালিগালাজ আর হায় হায় এর মধ্যে নিজেকে নিয়ে কোনোক্রমে ছিটকে গেল মকবুল ফুটপাথের দিকে। টেনে-হিঁচড়ে ডান পা খানা ফুটপাথে উঠিয়ে যখন হাপরের মত হাঁপ ছাড়ছে মকবুল ততক্ষণে তার ডান পায়ের হাওয়াই চপ্পলখানা কোথায় চলে গেছে। ডান হাঁটুটা রাস্তায় ঘসে গিয়ে রক্ত ঝরছে। পায়ের বুড়ো-আঙ্গুলের নখ উঠে গিয়ে ঝুলছে।

শনু দৌড়ে এসে দাঁড়িয়েছে তার কাছে। হাতের প্যাকেটগুলো রেখে বসে পড়ে দুহাতে জড়িয়ে ধরেছে মকবুলকে। উদ্বিগ্ন গলায় বলে উঠলো-“ঠিক তো হ্যায় না মকবুল?” হাঁপাতে-হাঁপাতেই আস্তে করে ঘাড় নাড়ে মকবুল। “প্যায়ের মে ক্যা হুয়া? দিখা। আরে দিখা না।” ডান পা টা জোর করে নিজের দিকে টেনে নেয় শনু। মকবুল ততক্ষণে ভয়টা একটু সামলেছে। ব্যাথার অনুভূতিটা আস্তে আস্তে ফিরে আসছে। ক্ষতবিক্ষত হাঁটু আর নখের ব্যাথা দাঁত চেপে সহ্য করে মকবুল। “আরে এ ক্যায়া হুয়া? ইতনা খুন! আরে ইশ!” আস্তে করে হাত বোলাতে থাকে তার পায়ে। “চল উসপার। পানি সে পেহেলে ধো না হোগা। তু তো দেখা থা উস তরফকা সিগন্যাল খুল গ্যায়া থা। ম্যায় দুসরে ফুটপাথকে তরফ চল দিয়ে থে। তো তুঝকো সমঝনা চাহিয়ে থা না কি ইস তরফ ভি এক হি টাইমপে সিগন্যাল খুলেগা। তু বেওকুফ কি তরহ রোড ক্রস কিঁউ করনে লগা?” কি আর বলবে মকবুল? এত যদি সে শনুর মতন সিগন্যাল বুঝত তবে ত হয়েই যেত। “চল,পানি তো উধার দুকানপে মিলেগা। চল পায়েগা?”- তাড়া দেয় শনু। গলার শুখনো ভাবটা এতক্ষণে অনুভব করে মকবুল। আস্তে করে বলে-“হাঁ চল। পানি পিনা হ্যায়।” নিজের আবিরের প্যাকেটগুলো গুছিয়ে নেয় শনু। হঠাৎ খেয়াল হয় মকবুলের।

-“শনু, মেরা প্যাকেট? মোমবাত্তিয়া?”  

নিজের প্যাকেটগুলো গুছিয়ে হাতে ঝুলিয়ে নিতে নিতে চমকে তাকায় শনু। “কাঁহা? তেরা মাল?” বলেই রাস্তার দিকে তাকায় শনু। এদিক ওদিক তাকিয়ে রাস্তায় চোখ যায় মকবুলেরও। ঠিক যেখান থেকে সে আলোর ফুলকিটা দেখতে পেয়ে শনুকে চেঁচিয়ে ডাকতে শুরু করেছিল, আর তার সেই বেয়াদবিকে পিষে ফেলার উদ্যম নিয়েছিল সবুজ সিগন্যাল পাওয়া আটকে থাকা গাড়ির দল, ঠিক সেখানেই তার ডান পা টা একচুলের জন্য পিষে ফেলতে না পারার আক্রোশেই হয়ত তার হাত থেকে পড়ে যাওয়া, তার সারাদিনের রোজগার, সবুজ-গোলাপি-হলদে-রংবেরঙের মোমবাতিগুলোকে নির্দ্বিধায় রাস্তার সাথে মিশিয়ে দিয়ে চলে যাচ্ছে একের পর এক গাড়ি।

কিছুক্ষণ দুজনেই চুপ করে সেদিকে চেয়ে থাকার পর শনু তার কাঁধে হাত রাখে। বলে, “চল মকবুল। পানি লে লেতে হ্যায় দুকান সে।”

কথাটা কানে ঢুকলেও মাথায় ঢোকে না মকবুলের। পঞ্চাশ প্যাকেটের মধ্যে মাত্র চার-পাঁচ প্যাকেট বিক্রি করতে পেরেছিল সে। বাকি পুরোটাই তার হাত আর হাতের বড় প্লাস্টিকের প্যাকেটে ছিল। যেগুলো বাইরে বেরিয়ে আছে সেগুলো এখন রঙ-বেরঙের ধুলো ছাড়া আর কিছু নয়। কিন্তু প্লাস্টিকের প্যাকেটের মধ্যে যে প্যাকেটগুলো ছিল সেগুলোর মধ্যে থেকেও কি এক আধ প্যাকেটও বাঁচবে না? সামনেই আছে। দু পা বাড়ালেই পেয়ে যাবে প্যাকেটটা। সিগন্যাল লাইটের দিকে তাকায় মকবুল একবার। এখনও লাল হতে দেরি আছে। এখনও যদি তুলে আনা যায় প্যাকেটটা- নয়ত সিগন্যাল লাল হতে হতে প্যাকেটের একটি মোমবাতিও বাকি থাকবে না। আস্তে আস্তে ব্যাথা ভুলে উঠে দাঁড়ায় মকবুল। সিগন্যাল লাইটের দিকে আরেকবার দেখে নিয়ে ঝড়ের মত ছুটে আসা গাড়িগুলোর গতি মাপতে থাকে মকবুল। শনু ততক্ষণে বোধহয় তার মতলব বুঝতে পেরেই পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। বলে, “নেহি মকবুল, ছোড় দে। উসমে অর কুছ বাঁচা নেহি।”
“পাঁচাশ প্যাকেট হ্যায় শনু উসমে।”- আর্তনাদ করে ওঠে মকবুল।
“গাড়ি আ রাহা হ্যায় মকবুল। সিগন্যাল খুলা হুয়া হ্যায়।”- বলে শনু নিজের ছোট্ট হাতটা দিয়ে সর্বশক্তিতে চেপে ধরে মকবুলের সরু দুবলা কব্জিটা।
“আভি বাঁচা পাউঁ তো এক দো প্যাকেট মিল ভি সকতা হ্যায়, ছোড় দে মুঝে।”
-“বেওকুফি মত কর ইয়ার, প্যাকেট কা হাল তো দেখ। উসমে এক ভি বাঁচা নেহি। দেখ আভি ভি গাড়ি চল রাহি হ্যায় উসকে উপর।”

দুজনে নিঃশব্দে অপেক্ষা করে সিগন্যাল লাল হওয়া পর্যন্ত। ডান পা টা হাঁটু থেকে নখ পর্যন্ত গরম হয়ে উঠেছে মকবুলের। জ্বালা করছে কেটে যাওয়া জায়গাগুলো। সিগন্যাল লাল হতে তাকে যেতে না দিয়ে শনুই গিয়ে উদ্ধার করে আনে প্যাকেটটা। ফুটপাথে উঠে এসে মুখ খুলে দেখে একটা নির্বাক দৃষ্টি মেলে তাকায় মকবুলের দিকে। যে দৃষ্টির মানে বুঝতে একটুও অসুবিধা হয়না মকবুলের এই বয়সেও। তাও শেষবারের মত প্যাকেটটা শনুর হাত থেকে নিয়ে ভেতরটা আঁতিপাঁতি করে খোঁজে মকবুল। একটা মোমবাতিও যদি গোটা পায় সে আশায়। হতাশায় ছুঁড়ে দেয় প্যাকেটটা ফুটপাথের ধারে ঘাসের ওপর। শনু এসে প্যাকেটটা তুলে নিয়ে ধীরে ধীরে বলে, “ফেঁকনা মৎ ইয়ার, ফ্যাক্টরি মে দে দেনেসে ফির সে মোমবাত্তি বন সকতা হ্যায়। শেঠকে গুদামমে ইস কো লৌটাএঙ্গে তো থোড়া ডাঁট কম ভি পড় সকতা হ্যায়।” অসহায় চোখে শনুর চোখের দিকে তাকায় মকবুল। বিক্রম শেঠের মুখটা ভেসে ওঠে চোখের সামনে।

এরপর দুই বন্ধু মিলে যখন মকবুলের ডানপায়ের চটিটা উদ্ধার করে, রাস্তার পাশের দোকান থেকে জল নিয়ে পা ধুয়ে, শনুর পকেটে থাকা রুমাল দিয়ে ডান পায়ের বুড়ো আঙ্গুলের আধখানা উঠে যাওয়া নখকে বেঁধে উঠে দাঁড়ালো তখন মকবুলের হাঁটু জবাব দিয়েছে। অসহ্য যন্ত্রণা আর জ্বালা। এখনও রক্ত ঝরছে। পিঠে হাত রাখল শনু। “বহুত দরদ হো রাহা হ্যায় ক্যায়া মকবুল? ধীরে ধীরে চলেঙ্গে ইয়ার।” শনুর কাঁধে ভর দিয়ে প্রায় আধঘণ্টা ধরে হেঁটে বহু কষ্টে যখন তারা বিক্রম শেঠের গুদামের দরজায় এসে পৌঁছালো তখন মকবুলের আর বিন্দুমাত্র শক্তি নেই দাঁড়িয়ে থাকার।

তাদের দেখে শেঠের কর্মচারী বিনোদ বলে ওঠে, “আরে, আ গ্যায়া ছোটু? আচ্ছা হি হুয়া। তুম দোনো কে লিয়ে ওয়েট কর রাহা থা। চল, বাকি কে মাল রাখ দে। জলদি জলদি হিসাব নিপটাকে ঘর জানা হ্যায়। দিওয়ালী কে দিন, জলদি কর। কিতনে প্যাকেট বাঁচা হ্যায় বোল। প্যায়সা লে লে মালিক সে। শনু, বাকি কে প্যাকেট দে দে মুঝে।”

শনু আর মকবুল স্থানুর মত দাঁড়িয়ে থাকে বিনোদের মুখের দিকে তাকিয়ে। তাদের দিকে অবাক চোখে তাকায় বিনোদ। বিরক্ত হয়ে বলে ওঠে, “আরে ক্যায়া হুয়া? জলদি কর। ইধার আ শনু কিতনে প্যাকেট বাকি হ্যায় তেরে পাশ? তুঝে গুলাল দিয়ে থে না আজ ম্যায়নে? আরে মকবুল প্যায়ের মে ক্যায়া হুয়া তেরা?”

এতক্ষণে বিনোদের চোখ গেছে মকবুলের পায়ের দিকে। বিপদ বুঝে চট করে সামনে এগিয়ে যায় শনু। “বিনোদ ভাইয়া, ইয়ে মেরা বাকি কে প্যাকেট। পাঁচাশ দিয়ে থে, ইয়ে ষোলা বাকি হ্যায়।”

-“আচ্ছা, সহি হ্যায়? অর মকবুল তেরা কিতনে বাকি হ্যায়?”


ভেতরের ধুকপুকুনিটা শুনতে শুনতে মকবুল শনুর দিকে তাকায়। শনুও ভয়ার্ত চোখে তার দিকে তাকিয়ে আছে। 




Tuesday 21 October 2014

দেওয়ালী........১

“এ ছোটু, ইধার আ। কিতনে কা হ্যায়?” সাদা রঙের লম্বা গাড়িটার কাঁচটা একটু নেমে এল। ভেতর থেকে গোঁফওয়ালা ফর্সা লোকটা মুখ বাড়িয়ে জিজ্ঞাসা করল। মকবুল আকাশ থেকে চোখ নামিয়ে সামনের মেটে গাড়িটাকে পাশ কাটিয়ে এগিয়ে গেল সাদা গাড়িটার দিকে। ভেতর থেকে সবুজ জামা পরা টোবা গালের ফর্সা বাচ্চাটা মকবুলের হাতের দিকে আঙ্গুল তুলে বলে উঠল, “পাপাজি উও অরেঞ্জওয়ালা, উও অরেঞ্জওয়ালা লে লিজিয়ে না।” পাশ থেকে লাল চকমকে সালওয়ার-কামিজ পরা তার মা সাথে সাথে বলে উঠল, “ওয়েট বেটা, কিমাত তো পুছনে দো পাপাজি কো।” “চালিশ রুপেয়া প্যাকেট স্যার, লে লিজিয়ে না স্যার, বহুত দের তক জ্বলেগি”- মুখস্থ স্বরে বলে ওঠে মকবুল। ততক্ষণে তার চোখ চলে গেছে বাচ্চা ছেলেটার হাতের দিকে। কি দারুণ চকচকে বন্দুকটা। নতুন বোঝাই যাচ্ছে। নিশ্চয়ই অনেক ক্যাপও কিনেছে। ইশ তারও একটা বন্দুক ছিল। মা কে বায়না করে আদায় করেছিল। বছর তিনেক আগে অবশ্য। তারপর জং ধরে গেল, আর ওটা দিয়ে ক্যাপ ফাটানো যায় না। অবশ্য ক্যাপই বা কোথায় তার? গেল বার থেকেই তো সেসবের পাট উঠেছে মকবুলের।
“চালিশ!!!? পাগল হ্যায় ক্যা? বিশ পে বিক রাহা হ্যায় পিছলে ক্রসিং পে। সিগন্যাল হো গয়া, দে দে বিশ পে।”-চমক ভাঙ্গে মকবুলের। “নেহি স্যার, প্যাঁয়তিশ দে দিজিয়ে।”
“হঠ শালে, সিগন্যাল হো চুকা। ইশ উম্র সে হি শিখ গয়া শালা বিশ কে চিজ চালিশ পে।”-গাড়ির প্যাঁ-পোঁ হর্নের মধ্যেই কোন ক্রমে গাড়ির জঙ্গল থেকে ছিটকে বেরিয়ে এসে ফুটপাথে ওঠে মকবুল হাতের মোমবাতির প্যাকেটগুলো সামলে। পঁয়ত্রিশ-এর এক পয়সা কমে বেচতে বারণ করেছে বিক্রম শেঠ। কুড়ি টাকায় দিলে তো হয়েই যেত। বাকিটা তার পয়সা থেকে কেটে নিত শেঠ। চলতে থাকা গাড়ির স্রোতের মধ্যে ঘাড় উঁচু করে এদিক ওদিক দেখল মকবুল। শনুকে দেখা যাচ্ছে না কোথাও। বোধহয় উল্টো দিকে আছে। ওদিকের গাড়িগুলোকে থামিয়ে রেখেছে এখন। ওখানেই আছে নিশ্চয়ই শনু। শনু কখনও দাঁড়ায় না। এই এত্তবড় চৌমাথায় কোন না কোন দিকের গাড়ি সব সময়ই আটকে থাকে। শনু ঠিক সিগন্যাল দেখে শুনে খরগোশের মতন লাফ মেরে আটকে থাকা গাড়িগুলোর কাছে পৌঁছে যায়। কোনদিকের কোন সিগন্যালটা কার পরে খুলবে এই ব্যাপারটায় ও-র মতন এখনও সড়গড় হয়নি মকবুল। পরবর্তী লাল সিগন্যালের জন্য অপেক্ষা করে মকবুল।            
ফুটপাথে দাঁড়িয়ে গাড়ির মিছিল দেখতে দেখতে মকবুলের মনে তক্ষুনি দেখা চকচকে কালো রঙের বন্দুকটা চোখের সামনে ভেসে ওঠে। ক্যাপ ফাটাতে দারুণ লাগে মকবুলের। যে বছরে বন্দুকটা কিনে দিয়েছিল মা সেবছর সে আর দীপক মিলে খুব ক্যাপ ফাটিয়েছিল পুরো দশটার প্যাকেট কিনে দিয়েছিল দীপকের বাবা তাদের। আজও সে দেখেছে শেঠের গুদামে কাল নতুন মাল এসেছে। তাতে বন্দুক, ক্যাপ আর অনেক কিছু আছে। এগুলো অবশ্য তাদের দিয়ে বিক্রি করাবে না শেঠ। এগুলো সব দোকানে দোকানে যাবে। জানে মকবুল। সেগুলো অবশ্য এখুনি গাড়িতে দেখা বাচ্চা ছেলেটার হাতের বন্দুকটার মত অত ভাল নয়। সেটা তো যেমন বড়, তেমনি চকচকে। সামনের নলটা কত বড়। শেঠের গুদামের মতনই একটা বন্দুক থাকলে বেশ ভাল হত। একটা ক্যাপের প্যাকেট পেলে শনুর সাথে দেওয়ালীতে বেশ ফাটানো যেত। আব্বুকে বললে হয়ত রাগের মাথায় দুচার ঘা দিয়েই দেবে পিঠে। কি যে হয়েছে আব্বুর? সবসময় রেগেই আছে। কালকে রাতে বিক্রম শেঠের গুদাম থেকে বাকি মাল জমা করে ফেরার সময় চকে এগরোলের গন্ধে দাঁড়িয়ে পড়েছিল মকবুল। খিদেও পেয়েছিল বেজায়। এগরোল সে খেয়েছে দু-দুবার। একবার দুর্গাপুজোর সময় মতিকাকা রোলের দোকান দিয়েছিল হাসপাতাল মাঠের মেলায়। তাকে রেখেছিল মতিকাকা হাতে হাতে যোগান দেবার জন্য। আর একবার দীপকের সঙ্গে রসুলপুরের মেলায় গিয়ে একটা রোল কিনে দুজনে খেয়েছিল। দীপকের কথা মনে পড়লে বড্ড মন খারাপ করে মকবুলের, যদিও এখানে শনুর সাথে তার ভালই ভাব হয়েছে এই দেড়বছরে। তাও দীপকের মত কি আর? শনুর সাথে তো হিন্দি বলতে হয়। যদিও সে এখানকার ভাষা দিব্বি চালিয়ে নিতে পারে তাও ভাল করে কি আর গল্প করা যায় হিন্দিতে? ব্যাটা একবর্ণ বাংলা শেখেনি তার সাথে থেকেও। কাল রোলের দোকানের সামনে শনুও ছিল তাদের সাথে। সে জানত এগরোল কিনতে দেবেনা আব্বু। তাও মুহূর্তের জন্য থেমে রোলের ঠ্যালাগাড়িটার দিকে তাকিয়েছিল সে। আব্বু ওর সামনেই কান ধরে এক থাপ্পড় মারল মকবুলকে-“খাবার দেখলেই ছোঁক-ছোঁক করা না খালি? পেটে কি সেঁধিয়েছে রে হতচ্ছাড়া? চল পা চালিয়ে।” খুব কান্না পাচ্ছিল তখন। মা তাকে খাওয়া নিয়ে কখনও বকেনি। মায়ের কথা মনে হলেই এখনও মনটাকে অন্যদিকে ঘুরিয়ে নিতে হয় তাকে। কতদিন হল? দু-বছর প্রায়। এখানেই তো তাদের প্রায় দেড় বছর হয়ে গেল। সরকারী হাসপাতাল থেকে আব্বু আর চাচাদের সাথে মাকে আনতে গেছিল মকবুল। কেমন যেন ন্যাকড়া জড়ানো পুঁটলি মনে হচ্ছিলো মাকে। অথচ মাটি দেবার আগে সেই মুখটাই কেমন হাসি হাসি লাগছিল মকবুলের। কেমন যেন শান্ত। পুঁচকে ভাইটাও বাঁচলনা, যে জন্য মায়ের হাসপাতালে যাওয়া। আর তারপর থেকেই আব্বুও যেন কেমন হয়ে গেল। মকবুলের সঙ্গে কথাই হত না। চাচীর দাওয়ায় ভাত খেতে বসে একদিন বলল, “তোকে আর ইস্কুলে যেতে হবেনি কাল থেকে। আমরা সামনের রোববার চলে যাব।” “কোথায় যাব”- জিজ্ঞাসা করতে বলেছিল, “অতকথায় তোর কি রে? পেট ঠুসে ভাত গিলছিস, তাই গেল না। আমার সনে যাবি রোববার ব্যাস।” তারপর তো একটা অচেনা লোকের সাথে সারারাত ধরে ট্রেনে চেপে এই শহরে। লোকটা নাকি কামালুদ্দিন চাচার কোন কুটুম। হবে হয়ত। আব্বু তো তার সাথে হেসে হেসে কথা কইছিল ট্রেনে। ট্রেনে আসতে ভালই লাগছিল মকবুলের। এত দূরে ট্রেনে চেপে কোনদিন আসেনি সে। কেমন হু হু করে হাওয়া দিচ্ছিল জানলায় দাঁড়ালে। শুধু দীপকের জন্য একটু একটু মন খারাপ লাগছিল তার। তারা দুজনে এলে বেশ ভাল হত। কিন্তু দীপক কেন আসবে তার সাথে? দীপক তো ইস্কুল ছেড়ে দেয়নি তার মত। সে তো নতুন শহরে কাজ করবে। আব্বু বলেছে এই লোকটাকে তার জন্যও কাজ দেখতে। তারপর সেই লোকটা মানে আব্দুল ভাই-ই আব্বুর রিক্সার মালিকের কাছে আর তার এই সিগন্যালের হকারির জন্য বিক্রম শেঠের কাছে তাদের নিয়ে গেছিল।
সকালে বিক্রম শেঠের গুদাম থেকে মাল তুলেছে সে। কদিন ধরেই রংবেরং এর নানান কিসিমের মোমবাতির প্যাকেট দিচ্ছে তাকে শেঠের লোক। সামনে দেওয়ালী। এসময় বিকবে ভাল। শনুকে আজ দিয়েছে নানা রঙ এর আবির। একটু অবাক হয়েছিল মকবুল তা দেখে। আবির তো দোলের সময় লোকে কেনে বলে জানে সে। এখানে যাকে বলে হোলি। শনু- গুদাম থেকে বেরিয়ে বুঝিয়ে দিয়েছিল, “আরে দেওয়ালী কে টাইম ইশসে রঙ্গোলী বানাতে হ্যায় না, পতা নেহি তুঝে?”
-রঙ্গোলী?
- আরে উও ডিজাইন বানাতে হ্যায় না ঘর পে? ভগবান কে সামনে?
- ও, আলপনা? বুঝেছি।
- ক্যা?
- আরে হামারে দেশ মে আলপনা বলতে হে ইশকো। ম্যায়নে দেখা হ্যায় দীপক কে ঘর মে। কিন্তু শনু উও তো আবির সে নেহি বানাতে থে। এক হি রঙ কা হতে থে। সাদা।
- সাদা? ক্যা? তু ছোড়। ইঁহা পে ইস সে বানাতে হে। রঙ্গোলী-লাড্ডু-মিঠাই-পটাকে ইয়ে সব হোতা হ্যায় দেওয়ালী।
- হ্যাঁ রে, আমাদের ওখানেও সবাই কালীপূজোতে মানে...ইয়ে......দেওয়ালীতে পটকা ফাটাত। কালিপটকা, চকলেট বোম। মুঝে না উও লাইটিংওয়ালী বাজি মানে পটাকে আচ্ছে লাগতে হ্যায়। তুবড়ি, চরকি, তারাবাতি, ইয়েসব।
-আরে হাঁ ইয়ার, তুঝে পতা হ্যায় দেওয়ালী মেলা লগে হ্যায় না পিছে, উঁহা পে না ইয়েসব রোশনাই হোগা, আজ সে হি স্টার্ট। তিনদিন হোগা। চলেঙ্গে ইয়ার। আশমানমে দেখনা কিতনে রোশনাই, তারে-ফুল জ্যায়সা।
-হাঁ শনু, পতা হ্যায় মুঝে। শুন না, আমাদের গ্রামে...মানে...
-হাঁ হাঁ পতা হ্যায় তেরে গাঁও মে......
-দেখা হ্যায় ম্যায়নে। হোতা থা ওয়াসি রোশনাই...         
দেশে থাকতে মায়ের হাত ধরে ফলহারিনী কালিপুজোর দিনে শ্মশান কালী মন্দিরের পেছনের মাঠে বাজি পোড়ান দেখতে যেত মকবুল। দূরে দাঁড়িয়ে হাঁ করে আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকতো। ওপর থেকে আলোর মালা, আলোর ফুলঝুরি, নেমে আসতো। নিচে ঝরনার মত বাজি পুড়ত। একবার সে আর দীপক মিলে ঠিক করেছিল বড় হয়ে যখন টাকা হবে তাদের তখন একটা অন্ততঃ ওরকম বাজি কিনবে তারা। সেই যে যেটা আকাশে উঠে বিশাল জায়গা জুড়ে ফুলের মতন হয়ে ফেটে পড়ে, ওরকম।
তারা কালীপুজোয় বাজি পোড়ান দেখতে যেত শুনে অবাক হয়েছিল শনু।
-তু যাতা থা? কালিপুজা মে?
- হাঁ। কিঁ?
- নেহি...মতলব...তু মুসলমান হ্যায় না?
-তো ক্যায়া হুয়া? হামারে উঁহা পে সব লোক যাতে থে। বাজি...মতলব রোশনাই দেখনে মে ক্যায়া হ্যায়? সবেবরাত মে ভি তো দীপক আতে থে মেরে ঘর। ইঁহা পে নেহি যাতে ক্যায়া?
-নেহি...উও বাত নেহি...পর...ঠিক হ্যায় ছোড়...আজ রাত যায়েঙ্গে...রোশনাই দেখনে। পাক্কা।
-আব্বু কো পুছনা হোগা শনু।
- ঠিক হ্যায় ইয়ার, পুছ লেঙ্গে, রাত কো শেঠকে গুদাম সে তুঝে লেনে আয়েঙ্গে না? তব পুছ লেঙ্গে। জায়েঙ্গে জরুর।
-ঠিক হ্যায়।
সকাল থেকে সময় যেন আর কাটছে না মকবুলের। তিন প্যাকেট মোমবাতি বিক্রি করতে পেরেছে সে সকাল থেকে। দুটো পঁয়ত্রিশে আর একটা চল্লিশে। পঞ্চাশ প্যাকেট দিয়েছে গুদাম থেকে আজ। অন্ততঃ পঁচিশ প্যাকেট না বেচতে পারলে রোজ দেবার সময় কথা শোনাবে শেঠ। কিন্তু বাজির কথা শোনার পর থেকেই আকাশে চোখ চলে যাচ্ছে মকবুলের। পেছনের মাঠের বাজি শুরু হলে লম্বা বাড়িটার পাশ দিয়ে দেখা যাবে। তাই মাঝে মাঝেই ওদিকে চোখ চলে যাচ্ছে তার। বিকেল থেকেই ওদিক থেকে চকলেট বোমের আওয়াজ শুনতে পাচ্ছে মকবুল। কখন শুরু হবে কে জানে।
এইসব এদিক –ওদিক ভাবনার মাঝে দেখল আবার সিগন্যাল লাল হয়েছে। চোখ চারালো মকবুল। গাড়িগুলো এসে জমছে আস্তে আস্তে। মকবুল প্যাকেটগুলো সামলে রাস্তায় নামলো। দূরে শনুকে দেখতে পেল সে এতক্ষণে উল্টোদিকের ফুতপাথে। এদিকে আসার চেষ্টা করছে। সাঁই-সাঁই গাড়ির মিছিল ভেদ করে আসতে পারছে না। নিজের কাজে মন দিল মকবুল। “মোমবাত্তি লিজিয়ে।” লিজিয়ে না আঙ্কল, আচ্ছা হ্যায়।”
-“কিতনে ধুল হ্যায় ইয়ার, সিসা উঠা দে।”- গাড়ির ভেতর থেকে গলা ভেসে এলো। কাঁচ উঠে গেলো গাড়ির।
পেছনের গাড়িটার দিকে গেল মকবুল। যেতে যেতেই শুনল-“দিয়া লেনা থা।” সাথে সাথে গাড়ির পেছনের জানলা দিয়ে চোখ চারিয়ে বলল- “মোমবাত্তি হ্যায় দিদি...বহুত বড়িয়া...আচ্ছা সেন্ট ভি হ্যায় ইশমে...রোজ...জেসমিন... স্রেফ চালিশ রুপেয়া প্যাকেট। লে লো না দিদি।”
-“আচ্ছা এক প্যাকেট দে দে। জেসমিন।”
একটা প্যাকেট গাড়ির জানলা দিয়ে বাড়িয়ে দিয়ে মকবুল বলে ওঠে- “স্রেফ এক? দিদি অর এক লে লিজিয়ে না। বহুত বড়িয়া হ্যায় দিদি। বহুত দের তক জ্বলেগি।”
-“নেহি অর নেহি, দিয়া লেনা থা। ইয়ে লে লিয়া।” কিছুতেই আর আর একটা বেচতে পারল না মকবুল।
চারটে দশ টাকার নোট কোমরের থলিতে গুঁজতে গুঁজতেই প্রথম আতশবাজিটা চোখে পড়লো মকবুলের। আকাশে উঠে বিশাল ফুলের মতন ছড়িয়ে পড়লো সারা বাঁ দিকের আকাশ জুড়ে। বাজির রোশনাই শুরু হয়ে গেছে পিছনের মাঠে। তারপর আর একটা...তারপর আরও একটা। দুমদাম আওয়াজের সাথে আকাশে আলোর মেলা। এখনি শুরু হয়ে গেল, তবে যদি তারা যেতে যেতে শেষ হয়ে যায়? চঞ্চল হয়ে উঠলো মকবুল। শনুকে খুঁজল। এই দিকেই আসছে মনে হচ্ছে। ওহ না তো। কোণাকুণি উল্টো দিকে যাচ্ছে যে। হ্যাঁ তাইতো। ওদিকেই তো গাড়ি আটকাবে এখন এদিকের সবুজ সিগন্যাল দিলে। “শনু-উ-উ-উ” বলে চেঁচিয়ে ডাকল একবার মকবুল। শুনতে পায়নি শনু। শনুকে কথাটা বলে আবার এদিকে চলে আসতে হবে। তাড়াতাড়ি রাস্তা পেরিয়ে ওপারে যেতে শুরু করল মকবুল।



Tuesday 14 October 2014

Sinking

I was roaming around the evening sky
With all of my consciousness
And a humming sound of silence in evening wood
Wrapped me all the way around

In that twilight
In the dark bluish wood
A gentle adoration of universe enfolded me
Toward the fulfillment
I was sinking into me in obvious pace   

It was only in quest of
A hand of love
A touch of warmth
A feel of closeness
That protected me
From that absolute sinking

I was about to touch
The absolute bottom of mind
In the evening dark
In the whispering wood
In that twilight also
The absolute sinking was inexperienced
In quest of a worm touch

Thursday 9 October 2014

মহিষাসুরমর্দিনী ও মিষ্টি বিতরণ

মা দূর্গা তো এইমাত্র সবে কৈলাসে ল্যান্ড করে হাত পা ধুয়ে নন্দী-ভৃঙ্গী-চ্যালা-চামুন্ডাদের কাছে মর্ত্যলোকের গল্পগাছা সেরে ভাবতে বসেছেন কি কি তরিতরকারী আছে ফ্রিজে এবার তো রান্না বান্না সুরু করতে হবে। মা লক্ষী তো ফিরব ফিরব করছেন এখনো ফেরেন নি। মানে এইসব ভ্যানতারা করে আমি বলতে চাইছি যে, এখনো তো পুজোর রেশ মেলায়নি, এখনও পুজোর গপ্প করা যায় তাই না? আমার একখানা মারাত্মক পুজোর গল্প জমে আছে। এখনো না বললে স্রেফ পেট ফেটে মরে যাব। অবিশ্যি গল্পটা এইবছরের পুজোর নয়। বছর বাইশ-তেইশ আগেকার তো বটেই। এতদিন চেপে রেখেছিলাম।  ফলে বুঝতেই পারছেন কি মারাত্মক ব্যাপার। ওই যে ছোটবেলার এক বিশ্বকর্মা পুজোয় আমাদের বাঁদরামোর গল্প বলেছিলাম না, সেখানেই তো আপনাদের একটু বলেছিলাম যে আরো এককাঠি সরেস ঘটনার গল্প শোনাব আপনাদের। সেটাই বলতে বসেছি আজ। এইটিই আমার শেষ বাঁদরামি। এর যে মারাত্মক প্রভাব আমার মনের ওপর পড়েছিল তারপর থেকে আমি আর ও রাস্তায় যাইনি। সেদিন আমার জন্য জনগণের গণপিটুনির চোটে আমার কচি কচি বন্ধুদের যে মৃত্যু হয়নি সেটাই যথেষ্ট। ঘটনাটা? হ্যাঁ হ্যাঁ এই যে বলছি এইবার।

তখন আমাদের কত বয়স হবে? দশের আশেপাশে। মাথায় বাঁদরামি বুদ্ধিতে ভর্তি। দুর্গাপুজোর অষ্টমী। পাড়ার প্যান্ডেলে বসে বোর হচ্ছি সক্কলে। কারণ রোদ পড়তে না পড়তেই নতুন জামা খরমরিয়ে বেরিয়ে পড়েছি অভিযানে। আশেপাশের চারটে প্যান্ডেলের ঠাকুর গত তিনদিন ধরে তিরিশবার দেখা হয়ে যাওয়া সত্বেও একতিরিশতমবার দেখে এসেছি। তারপরে প্যান্ডেলের পেছনে পাড়ার রেশন দোকানের সামনের একটুকরো জমিতে মহালয়ার দিনে টিভিতে দেখা 'মহিষাসুরমর্দিনী' পালার অভিনয় হয়ে গেছে। 'মহিষাসুরমর্দিনী' পালা-র ব্যাপারটা একটু বলার লোভ সামলাতে পারছি না।

পুজোর পাঁচদিনই (মানে আমাদের পুজো তখন ষষ্ঠী থেকে শুরু হত আর কি) আমরা একটা বিপুল আনন্দের কাজ করতাম। যেটা বছরের আর বাকি তিনশ ষাট দিনে করা হত না। ব্যাপারটা হলো মহালয়ার দিনে টিভিতে সকালবেলা যে 'মহিষাসুরমর্দিনী' বা 'দূর্গা-দুর্গতিনাশিনী' গোছের অনুষ্ঠান দেখানো হত সেটি আমরা কুঁচোর দল ষষ্ঠী থেকে দশমী পর্যন্ত প্রতিদিন পাড়ার প্যান্ডেলের পেছনে আধো-অন্ধকারে নিজেদের মতন করে নাচা-নাচি-নকল যুদ্ধ ইত্যাদির মাধ্যমে পুনরোনুষ্ঠিত করতাম। টিভি অনুযায়ী, মা দুগ্গার নাচ জানাটা অত্যন্ত জরুরী। তাই মা দুগ্গার ভূমিকাটা সর্বসম্মতিক্রমে মোমের প্রাপ্য। কারণ আমরা বাকিরা প্রত্যেকেই নাচে এক একটি উদয়্শংকর। মোম দুহাতে বাঁশের কঞ্চি বাগিয়ে ধরে গোলগোল চোখ করে লাফিয়ে-ঝাঁপিয়ে-নেচে-কুঁদে মহিষাসুরের পেছনে গোল হয়ে ঘুরছে। মহিষাসুরও (সে অবশ্যই কোনো একটা ছেলে, কারণ আমরা মেয়েরা কোনো মতেই নতুন জামার মায়া ছেড়ে মাটিতে গড়াগড়ি দেব না) আর একটা কঞ্চি বাগিয়ে ধরে মুখে প্যাঁ প্যাঁর প্যাঁ প্যাঁ বাজনা বাজিয়ে দুর্গার সাথে যুদ্ধ করছে। আমি যথারীতি নতুন ফ্রক গুটিয়ে মাটিতে হাঁটু গেড়ে বসে সিংহ সেজেছি। বেশ খানিকক্ষণ কঞ্চিতে কঞ্চিতে যুদ্ধ হবার পর ঘাসে ভালো করে পা মুছে (নইলে আমার নতুন জামায় ময়লা লেগে যাবে, আর মা আমার সিংহ সাজা বার করে দেবে) আমার ঘাড়ে একটা পা রেখে হাতের লম্বা বাঁশের কঞ্চিটা মহিষাসুরের বুকে খুঁচে দিয়ে চোখ বড়বড় করে দাঁড়িয়েছে দুগ্গা ঠাকুর মানে আমার বন্ধু মোম। তার পায়ের কাছে জোর করে মহিষাসুরকে শুইয়ে দেওয়া হয়েছে। আর চারপাশে লক্ষী-সরস্বতী-কার্তিক-গনেশ যে যার মতন দাঁড়িয়ে গেছে। তখন পাশ থেকে বুবুন মুখেই পুঁ উ উ উ উ করে শাঁখ বাজিয়ে দিল। এই যে প্রচন্ড রোমহর্ষক ব্যাপারটা চলত এটাই হলো আমাদের মহিষাসুরমর্দিনী' পালা। প্রতি বছরই ষষ্ঠী থেকে দশমীতে প্রতিদিন সন্ধ্যেবেলা এটা আমাদের মাস্ট টু ডু লিস্টের এক নম্বর আইটেম।

তো সে যাই হোক, যেদিনের কথা বলছি সেদিন এই রোমহর্ষক খেলাটিও খেলা হয়ে গেছে। পাড়ার প্যান্ডেলে সন্ধ্যারতি-ধুনুচি নাচ এবং তত্সহ পাড়ার উঠতি দাদাদের প্রবল নাচন-কোঁদন শেষ সেদিনের মত। সন্ধ্যারতি সেরে পাড়ার মা-কাকিমা-জ্যাঠিমার দল আমাদের কুঁচোদের গলার বাকলস খুলে দিয়ে নিজেরা বাকি ঠাকুর দেখতে গেছেন। আমরা কিনা সেসব ঠাকুর একত্রিশবার দেখে ফেলেছি তাই বত্রিশতমবার আর যাব না এই অজুহাতে স্বাধীনতা ভোগ করছি। তখন তো আর টাইমপাসের সবচেয়ে ভালো উপায়টা জানতামনা। বেশ লোকজনের নামে সবাই মিলে নিন্দেমন্দ করে সুন্দর নির্বিঘ্নে সময় কাটিয়ে দেওয়া যেত। তাহলে টাইমপাস করতে গিয়ে জনতার হাতে মার খেতে খেতে বাঁচতে হত না। মোদ্দাকথা জীবনের সব ফুর্তি শেষ সেদিনের মত।

এমন সময় কি করে যেন হাতে এসে গেল সেবছরের দুর্গাপুজোর সময় নির্ঘন্টের লিফলেটের একটা বেওয়ারিশ বান্ডিল। আমাদের ওখানে কোনো বছরেই এই বিষয়টি ছাপা হত না। গ্রামের পুজো, মুখে মুখেই সকলে জেনে যেত কোন পুজো কখন হবে। সেবছরই কেন যে এই বস্তুটির আবির্ভাব হয়েছিল কে জানে? বোধহয় আমার মাথা থেকে বাঁদরামির পোকাটা সারা জীবনের জন্যে বার করে দেবার জন্যই হবে। কে জানে। তো সেই হলদে রঙের পাতলা কাগজের বান্ডিলটা দেখে মাথার পোকা নড়ে উঠলো। খুঁজে পেতে সকলের পকেট হাতড়ে কটা খুচরো পয়সাও পাওয়া গেল। বলাই বাহুল্য এই চাঁদা সংগ্রহে সংগ্রহ করা ছাড়া আমার কোনো অবদান ছিল না। আধুলি-সিকি জড়ো করে গুনে গেঁথে মোট গোটা আট-দশ টাকা হয়েছিল। সঠিক কত আমার তা মনে নেই। সেই নিয়ে সোজা পন্ডিতের মিষ্টির দোকানে। সেখান থেকে কেনা হলো মিষ্টির খালি কাগজের প্যাকেট। প্যাকেট এনে খাপে খাপে ভাঁজ করে মিষ্টির বাক্স রেডি। এবার তার মধ্যে এন্তার হাবিজাবি জিনিস ঠুসে, রাবার ব্যান্ড দিয়ে আটকে ওপরে একটা করে সেই হলদে পাতলা কাগজে লালকালি দিয়ে ছাপা দূর্গাপুজোর সময় নির্ঘন্ট দিয়ে আমরা রেডি হয়ে বসে রইলাম সম্ভব্য দর্শনার্থীর আশায়। গোটা পাঁচ-সাত প্যাকেট ছিল মনে আছে। এর মধ্যে ষোলোকলা পূর্ণ করতে প্যান্ডেলের চরণামৃত বিতরণের বাটিটি ঘুরতে ঘুরতে এসে পড়ল আমাদেরই কোন কুঁচোর হাতে। মানে কেউ প্রচন্ড ভক্তি সহকারে পূন্যার্জন করতে এলে তাঁকে ওই চিনি মেশানো ফুল পাতাওয়ালা জল এক কুষি দিতে হবে। আমরাও সানন্দে রাজি হয়ে গেলাম। কারণ তাতে করে আমাদের দেওয়া প্যাকেটের যথার্থতা বাড়ে। কেউ সন্দেহ করবে না।

এই চরণামৃত আর হলদে কাগজের নির্ঘন্টের জোরে আমরা এক দুই করে গোটা তিনেক প্যাকেট গছিয়েও দিলাম লোকজনদের। কেউ তো আর তক্ষুনি খুলে দেখবে না, কি দিল 'সার্বজনীন দুর্গোত্সব কমিটি'-র পক্ষ থেকে। আমাদের মনোবল বাড়তে লাগলো। আর ওভার কনফিডেন্সে মারাত্মক ভুলটা করে ফেললাম। বড়রা খুলে দেখবে না কিন্তু ছোটরা তো এসব চক্ষুলজ্জা টজ্জার ধার ধারে না। ভুল করে চার নম্বর প্যাকেটটা গেল একটি বাচ্চা ছেলের হাতে মানে আমদের তুলনায় বাচ্চা। বছর পাঁচেক হবে। সে তখুনি খোলার চেষ্টা করলো। আমাদের বাঁচিয়ে দিল তার মা। "বাবু, এখন না পরে, বাড়ি গিয়ে। এখন ঠাকুর দেখো।" বাপ বাপ বলে বেঁচে গেলাম। কিন্তু মারে হরি রাখে কে? ভবি ভুলল না। ঠাকুর দেখা শেষ করেই প্যান্ডেল থেকে দুপা বেরিয়েই বাবুর বায়নায় বাবুর মা প্যাকেট খোলার উদ্যোগ নিলেন। নজরে পড়তেই আমরা পড়ি কি মরি করে বাকি প্যাকেট ফ্যাকেট নিয়ে দুদ্দাড়িয়ে প্যান্ডেলের পেছনে। সেখান থেকেই শুনতে পেলাম বাবুর মা হাঁই হাঁই করে বাছাই করা গ্রাম্য গালিগালাজের সম্ভার নিয়ে প্যান্ডেলে বসে থাকা নিরাপরাধ দুই পাড়াতুতো দিদিকে আক্রমন করেছে। শুনেই তো আর একচোট হুটোপাটি। প্যান্ডেলের পেছন থেকে মোমেদের বাড়ি সবচেয়ে সামনে। দৌড় দিলাম সেদিকে। প্যান্ডেল আর মোমেদের বাড়ি মাঝে মোরাম ফেলা রাস্তা। সেই এক পুঁচকি রাস্তা যেন দৌড়ে শেষ করতে পারছিলাম না সেদিন। মাঝে আবার মোরামে পিছলে পড়ে গেলাম আমি। না পড়লেই আশ্চর্য হতাম। সবসময়ই আমি এরকম গুরুত্বপূর্ণ পরিস্থিতিতে পড়ে যাওয়া-আটকে যাওয়া-হোঁচট খাওয়া ইত্যাদি গুরুত্বপূর্ণ কাজ করে থাকি। যাই হোক, পড়ে গেলাম, পড়ে গিয়ে দুটো হাঁটু ফালা ফালা হলো, সঙ্গে নতুন জামা ছিঁড়ল। খোঁড়াতে খোঁড়াতে মোমেদের বাড়িতে গিয়ে ঢুকলাম। বাকিরা আগেই পৌঁছে গেছে। আর আমার দেরী দেখে জনতার হাতে সম্ভব্য নির্যাতন আশংকায় বাড়ির বাকিদের বাইরে বেরিয়ে দেখতে পাঠিয়েছে। মোমের মা-জ্যেঠিমা আমায় বাড়ি নিয়ে গেলেন। মোমের মা আমায় তাঁদের বাড়ির বাথরুমে নিয়ে গিয়ে পা থেকে মোরাম, রক্ত ধুয়ে দিচ্ছেন, ডেটল লাগাচ্ছেন, ছেঁড়া জামা বাড়ি ফেরার উপযুক্ত করে দিচ্ছেন। আর আমি এই পড়ে যাওয়া-কেটে যাওয়া- তার ওপরে ডেটলের অত্যাচার এত কিছু হয়ে যাওয়া সত্বেও এতটুকুও কাঁদছি না। তার কারণ এই নয় যে আমার ছোটবেলা থেকেই দারুন সহ্যশক্তি। কারণটা এটাও না যে, যে দুজন দিদির উপর আমাদের 'বাবুর মা' ঝালটি ঝেড়েছেন আমাদের না পেয়ে, তারা ততক্ষণে আমাদের সন্ধান পেয়ে গেছে আর আমাদের ওপর যত্পরোনাস্তি মধুর বাক্যবাণ বর্ষণ করছে। কারণটা এই যে, তাদের মধ্যে একজন দিদি আমায় শাসিয়েছে, "দাঁড়া তোর বাড়িতে বলে দেব।" আর আমি এই একটি বাক্যেই কাবু। বাড়ি ফিরে আমার যে আজই শেষ দিন, সে বিষয়ে আমার কোনো সন্দেহই ছিল না। মা-বাবা দুজনে পালা করে কম্বল ধোলাইয়ের মত করে পেটাবে। একজন ক্লান্ত হয়ে গেলে অন্যজন দায়িত্ব নেবে পেটানোর। "উফ! মরেই যাব, এবছর আর বিজয়ার দিনে প্যান্ডেলে বসে খিচুড়ি খাওয়া জুটল না আমার ভাগ্যে। কাল নবমী, কালকেই আমি মরে যাব।" এই চিন্তায় আমি প্রায় ল্যাম্পপোস্টের মত হয়ে গেছিলাম। বাইরে প্রবল গন্ডগোল। 'বাবু'-র কান্না-বাবুর মায়ের মুখের তুবড়ি-পুজো কমিটির লোকজনের তাঁকে শান্ত করার প্রচেষ্টা-বাকিদের মজা দেখা-মন্তব্য করা-আর কিছু লোকের আমাদের সন্ধানে চেঁচামেচি করা, লোকজন, চেঁচামেচি সব ছাপিয়ে আমি বোধহয় শেষ দিনের হরিনাম শুনতে পাচ্ছিলাম মনে মনে।

যাই হোক আমার অবস্থা দেখে বোধহয় মা দুগ্গার সেদিন দয়া হয়েছিল। মোমের জ্যেঠিমা বাড়ির সবার বড়। তিনি ওই দিদিটিকে বললেন যাক গে যা হয়ে গেছে যাক, ওর বাড়িতে কিছু বলিস না। সকলেই জানতেন বোধহয় আমার বাবা রাগলে একটি আস্ত শিব ঠাকুর। আমার অবস্থা ঠিক কি হতে পারে তার কিছু আন্দাজ করেছিলেন বোধহয়। দিদিটিও গাঁইগুঁই করে শেষ পর্যন্ত চুপ করে গেল। গজগজ করতে করতে বাড়ি চলে গেল। বেশ খানিকক্ষণ পরে আমায় মোমের মা সঙ্গে করে বাড়ি দিয়ে এলেন। আমি নতুন জামা আর দুটো হাঁটু কুটি কুটি করে ছিঁড়ে ভয়ে কাঠ হয়ে বাড়ি চলে এলাম। পরেরদিন ঘটনাটা বাড়ির লোক জানতে পেরেছিল। কিন্তু আমিও যে সে ঘটনার একজন সক্রিয় কালপ্রিট, সেটা বোধহয় জানতে পারেননি। পারলে মনে হয় এই ব্লগপোস্টটা আজ আর আমায় লিখতে হত না।

আমি অন্ততঃ মাস খানেক ভয়ে ভয়ে থাকতাম এই বুঝি সেই দিদি মাকে বা বাবাকে বলে দিল।  তাকে এড়িয়ে চলতাম। আর পরদিন পুজো প্যান্ডেলে গিয়ে আমি দুই হাঁটুতে ব্যান্ডেজ বেঁধে খোঁড়াতে খোঁড়াতে রুমা-মোম-বুবুন ইত্যাদি বাকি ব্যাটেলিয়ানের সাথে আবার অনেক অনেক সময় নিয়ে বত্রিশতমবারের জন্য অন্য প্যান্ডেলে ঠাকুর দেখতে গেছিলাম। যাতে আমাদের প্যান্ডেলে আমাদের কেউ দেখতে না পায়। দশমীতে খিচুড়িটাও মুখ নিচু করে খেয়ে এসেছিলাম সেবার। ভাগ্যিস বাবু আবার বায়না করে নি তার মায়ের কাছে আমাদের প্যান্ডেলে আবার ঠাকুর দেখতে আসার জন্যে। উফ!!!!! কি যন্ত্রণা নিয়ে যে বেঁচেছিলাম কদিন কি বলব। আর তারপর থেকে এরকম বাঁদরামি আর করিনি কোনদিন। সত্যি বলছি। বিশ্বাস করুন।

                              

Tuesday 7 October 2014

পূজা পরিক্রমা-২


অষ্টমীতে সারা বিকেল সন্ধ্যে গুরগাঁওতে চক্কর কাটার পর আবার পরের দিন যে সারাদিন দিল্লীতে টৈ টৈ কতে পারব নিজের ওপর সে বিশ্বাস আমার ছিল না। তাই আমরা ঠিক করেছিলাম যে দিল্লী রামকৃষ্ণ মিশনে যাব। সারাদিন ওখানেই পুজো দেখব আর বসে থাকব। কিন্তু আমি চাইলেই তো হবে না, না? আমাদের ভাগ্যে ছিল দিল্লির ঠাকুর দেখার। দেখলাম। সকালে বেরিয়ে আমরা প্রথমে কনট-প্লেস এর বার্কোস-এ গান্ডেপিন্ডে খেলাম। খেলাম না বলে সদা আমাদের খাওয়ালো বলা উচিত। বেচারা একাই বিল পে করলো। বার্কোস-এর সবকিছু আমার ভালো লেগেছে। মেনু-খাবারের স্বাদ-খাবারের পরিমান-খাবারের দাম-পরিবেশ সব কিছুই খুব সুন্দর। আমাদের মতন ভোজনরসিক কিন্তু পাতলা পকেটের মানুষদের জন্য লাগসই একেবারে। ধন্যবাদ সদা। দিল্লি গেলে দুপুরের কোথায় খাব আর ভাবতে হবে না এবার থেকে। নিজাম এর সাথে বার্কোসও যুক্ত হলো আমাদের লিস্টে। সদা সেদিন আমাদের খাওয়ালো- চিকেন থুকপা সাথে ক্রিসপি চিলি ল্যাম্ব। তারপর নুডলস সাথে জাম্বো সাইজের প্রণ ইন হট গার্লিক সস এবং স্লাইসড ল্যাম্ব ইন চিলি বিন সস। শেষে মিক্সড ফ্রুট ড্রিংক। নাম 'প্রিটি ওম্যান'।

চিকেন থুকপা আর ক্রিসপি চিলি ল্যাম্ব 
স্লাইসড ল্যাম্ব ইন চিলি বিন সস আর প্রণ ইন হট গার্লিক সস
সুন্দর খাওয়া দাওয়ার শেষে 'সুন্দরী মহিলা'-কে পান করে একদম ফুরফুরে হয়ে গেল মন। বার্কোস থেকে বেরিয়ে কনট-প্লেস থেকে দুর্দান্ত একটা মিষ্টি পান খেয়ে অটো নিয়ে সোজা রামকৃষ্ণ মিশন। আমাদের ধারণা ছিল যে ওখানে দূর্গাপূজো হয়েছে। কিন্তু সে ধারণা ছিল পুরোপুরি ভুল। ভোঁ ভাঁ চারিদিক। সুতরাং সেখান থেকে ফের অটো নিয়ে চিত্তরঞ্জন পার্ক।

অটো থেকে নেমেই পিনাকী বলল এবার সব বাংলা। বলার সাথে সাথেই ডানদিক থেকে বাজখাঁই গলায় আওয়াজ-"বদমাইস ছেলে, ঠাস করে একটা চড় কষালে তবে ঠিক হবে, চল ঘরে চল।" দেখলাম পুজোরসময় নতুন খরখরে জামা পরে ঘাড় চুলকোতে চুলকোতে একটা হাতের জিম্মা মাকে দিয়ে মায়ের হাতের টানে প্রায় ঝুলতে ঝুলতে কান্না কান্না মুখ করে চলেছে সাত বছুরে আমার ছোটবেলা। বুঝলাম ঠিক জায়গাতেই নামিয়েছে অটোওয়ালা। অটো থেকে নেমেই গ্রেটার কৈলাস ২ এর পুজো। এদের কথায় GK-II, এরা যে কেন পুরো কথাটা বলে না কে জানে। কনট-প্লেস-কে CP, সেন্ট্রাল সেক্রেটারিয়েট-কে CS- কি রে বাবা! প্রথম প্রথম আমার এই মান্ধাতার আমলের মাথা নিয়ে বুঝতেই পারতাম না কি বলছে। যাক যে যাক। গ্রেটার কৈলাস ২ এর পুজো খুব ভালো লাগলো। সদার দৌলতে একপেট খেয়ে কোল্ড ড্রিংক-এ চুমুক দিতে দিতে দারুন আড্ডা হলো। সদা গানও শোনালো। মনে হচ্ছিল আমাদের পাড়ার প্যান্ডেলে বসে আড্ডা দিচ্ছি।

গ্রেটার কৈলাস-২ এর পুজো ও মন্ডপ

গ্রেটার কৈলাস-২ এর প্রতিমা
সেখান থেকে কো-অপারেটিভ এর পুজো। এখানে থিম আন্ডার ওয়াটার। বেশ দেখতে মন্ডপ। দেখুন।

কো -অপারেটিভ এর পুজো 
এখানে বসে গতবছর আড্ডা দিয়েছিলাম। এখানেও প্রচুর খাদ্যদ্রব্যের সম্ভার। কিন্তু বার্কোস তখনও পেটে গজগজ করছে। ঠাকুর দেখে বেরিয়ে আসার সময় মা দুগ্গা কে নমো করার সময় বললুম "মা গো, পেটের ভেতরের জায়গাটা আর এক ছটাক বাড়িয়ে দিলে না কেন মা? এই এত ভালো ভালো খাবার-দাবার দেখেও ঢেঁকুর তুলে চলে যেতে হচ্ছে। সেই তো কাল থেকে পান্ডব-বর্জিত জায়গায় গিয়ে ঘ্যাঁট রান্না করে খেতে হবে নয়তো কবে গুরগাঁও যাওয়া হবে সেই দিকে হাঁ আ আ আ করে তাকিয়ে বসে থাকতে হবে। বড় করে দীর্ঘশ্বাস ফেলে জুলজুল চোখে খাবারের স্টলগুলোর দিকে তাকাতে তাকাতে কো-অপারেটিভ এর পুজো প্যান্ডেল থেকে বেরিয়ে এলাম। পরবর্তী গন্তব্য চিত্তরঞ্জন পার্ক কালিবাড়ির পুজো। এও বেশ জাঁকজমকের পুজো। মেলা বসেছে পুজোর সাথে। সাবেকি প্রতিমা। সুন্দর মন্ডপ সজ্জা।

চিত্তরঞ্জন পার্ক কালিবাড়ির পুজো 

কালিবাড়ির প্রতিমা ও কালী মন্দির 
তারপর ভেবেছিলাম মেলাগ্রাউন্ড এর পুজোটাও দেখে ফিরব কিন্তু সেটা আর হলো না। সদাকে যেতে হবে সদার বন্ধুর বাড়ি। আমরাও ল্যাংবোট। তার সাথে দেখা করে, তার মেয়ের মিষ্টি মিষ্টি কথা শুনে, তাঁদের বাড়িতে কলকাতা থেকে আনা ইয়া বড় বড় ক্ষীরকদম খেয়ে আমরা অটো ধরে মেট্রো স্টেশন। সেখান থেকে মেট্রো আর তারপরে ডমিনোস এর pizza  বগলে অটো ধরে বাড়ি। মাঝে অবশ্য প্রিপেইড অটো স্ট্যান্ডে ট্রাফিক পুলিশত্রয়কে আমাদের রিসার্চ সম্পর্কে তিনজন মিলে বিস্তর জ্ঞান প্রদান করেছিলাম। সে গল্প পরে একদিন করা যাবেখন।

এই হলো আমাদের এই বছরের পূজা পরিক্রমা। দশমীর দিন কি আর করব, মিষ্টিমুখ তো করতেই হবে। বাঙালি বলে কথা। এই ধ্যাদ্দেড়ে গোবিন্দপুরে তো জিরে কিনতে গেলেও তিনকিলোমিটার গাড়ি করে যেতে হয়, তা মিষ্টি পাব কোথায়? তাই বাড়িতেই পান্তুয়া-ল্যাংচা-নারকেল নাড়ু-কুঁচো নিমকি বানিয়ে নিয়ম আর রসনা রক্ষা করতে হলো। সেই পান্তুয়া-ল্যাংচা এখন রাত-বিরেতে খিদে পেলে পিত্তরক্ষার দায় সামলাচ্ছে ফ্রিজ আলো করে বসে। এই দেখুন।



শুভ-বিজয়া জানাই সক্কলকে। সবাই খুব ভালো থাকবেন। টা টা।

এই লেখার সমস্ত ছবি পিনাকীর সৌজন্যে।


Sunday 5 October 2014

পূজা পরিক্রমা- ১

শুভ বিজয়া জানাই সক্কলকে। কেমন পুজো কাটালেন সবাই? নিশ্চয়ই অনেক অনেক ভালো মন্দ খেয়েছেন আর অনেক ঘোরাঘুরি করেছেন? আমি তো করেছি। সপ্তমীতে অবশ্য একটু বোকা বনতে হয়েছে। আরে দেখুন না কি কান্ড। সারাদিন ল্যাবে হাবিজাবি টাইমপাস করার পরে কোথায় ভাবলাম সন্ধ্যেবেলা একটু পুজোর গন্ধ নিয়ে আসা যাক। সবাই মাইল সাজুগুজু করে গাড়ি-ফাড়ির ব্যবস্থা করে কোনমতে বেরোনো তো গেল। অমা! সবচেয়ে সামনের পুজোটাই তো হচ্ছে না। অনেক জিজ্ঞাসাবাদ করে এবং অনেক প্রশ্নের উত্তর দিয়ে শেষ কালে জানা গেল যে সেনাবাহিনীর ম্যারাথনের জন্য এইবছর পুজো বন্ধ। ব্যাটারা আর ম্যারাথন করার সময় পেল না! কি আর বলব? তারপর আর কি মনের দুঃখ দূর করতে কাছাকাছি ধোসা প্লাজা তে সবাই মিলে ইডলি-ধোসা-উত্থাপাম-পনীর চপ এসব এর ভুসুন্ডিনাশ করতেই হলো।


তারপর অষ্টমীর দিন সকালে লুচি-ছোলার ডাল, খিচুড়ি-আলুরদম খেয়ে বিকেল বিকেল বেরিয়ে পড়লাম গুরগাঁও পুজো পরিক্রমায়। গুরগাঁও এর সেক্টর গুলো তো গোলকধাঁধা একেকটা। জিপিএস দেখে দেখে পুজো খুঁজে বের করাটাই এডভেঞ্চার। সেখানে তিনটে পুজো দেখলাম আমরা। দাঁড়ান ছবি দেখাই।

ফেজ ফোর এর প্রতিমা ও প্যান্ডেল 
সুশান্তলোক এর পুজো 
ফেজ থ্রি এর প্রতিমা ও মন্ডপসজ্জা 
ফেজ থ্রি এর পুজো তে প্রচুর দোকানপাট খাবার দাবার। আমাদের মত ভজন রসিকদের স্বর্গরাজ্য। আমরা জাম্বো সাইজের ভেটকি ফ্রাই আর এগরোল খেয়ে আইঢাই করতে করতে শেষে লিমকা খেতে খেতে বাড়ি ফিরলাম। ও ফেরার আগে ফেজ থ্রি এর মেলা থেকে একটা স্পাইডারম্যান এর গ্যাস বেলুন কিনলাম। সেই 'স্পাইডু' এখন ফ্রিজের সাথে বাঁধা অবস্থায় ফ্যান এর হাওয়ায় দোল খাচ্ছে আর হাচিকোকে ভয় দেখাচ্ছে। 'স্পাইডু'-র ভয়ে হাচি এখন এঘরে শুচ্ছে না, পাশের ঘরে ঘুমোচ্ছে।

ফেজ থ্রী -র মেলা আর সেখান থেকে নিয়ে আসা 'স্পাইডু'
পরদিন আমরা রাজধানীর পুজো দেখতে গেছিলাম। সে গল্পটা কাল বলব কেমন? আজ এ পযন্তই।