Wednesday 11 March 2015

মনুষ্যকুলের শ্রেণীবিভাগ এবং ফেসবুকের স্টেটাস

ফেসবুকের স্টেটাস আপডেট আপাতত হ্যাপি নিউ ইয়ার, অভিজিত চক্রবর্তী, বাৎসরিক বাংলাভাষা বন্দনা, অভিজিত রায় হত্যা, 'ইন্ডিয়াস ডটার', হ্যাপি হোলি, বাৎসরিক নারীবন্দনা পেরিয়ে এখন বিশ্বকাপ ক্রিকেটে থিতু হয়েছে। অবশ্যই তা কিছুদিনের জন্য। এটা আমাদের মস্ত গুণ যে আমরা ভীষণ জঙ্গম। এঁটুলির মতন কোনো একটি  বিষয়ে আটকে থাকা, ও আমাদের পোষায় না। A থেকে Z পর্যন্ত সমস্ত সামাজিক, রাজনৈতিক বিষয়ে কথা না বলে কি থাকা উচিত? আমরা সমাজবদ্ধ জীব না? পিঁপড়েদের মত। হুলুস্থুল দেশী-বিদেশী বিষয়ে যদি কথাই না বলতে পারলাম তবে দিনের মধ্যে পঁচিশ ঘন্টা ফেসবুকে চোখ লাগিয়ে বসে থেকে কি ছাতার মাথা লাভ হলো রে বাবা? সোজাসুজি কেউ আমার মতামতের তোয়াক্কা যে করে না সে তো হাড়ে হাড়ে বুঝে গেছি এতদিনে। তা বলে মতামত দেব না? গণতান্ত্রিক অধিকার বলে কথা। তা মতামত প্রকাশের এত সুন্দর একটি ব্যবস্থা থাকতে বিছানায় শুয়ে, টয়লেটে বসে আঙ্গুলের একটু নাড়াচাড়া করলেই যদি বিশ্বব্রম্ভান্ডের আপামর জনগনকে আমার বিচক্ষনতার দাপট সম্পর্কে ওয়াকিবহাল করে ফেলা যায় তবে আর কেন লোকের মুখোমুখী চাট্টি কথা বলে সমস্যায় পড়ি? সুতরাং ফেসবুক স্টেটাস আপডেট জিন্দাবাদ।  

ফেসবুক স্টেটাস আপডেট বিচার করে কিন্তু সুন্দর একটি শ্রেণীবিভাগ করে ফেলা যায় আমাদের। মানে সমগ্র মনুষ্যকুলের। কেমন করে? বলছি।
  

এবার একটু বিশদে বলি? বেশ।  প্রথম থেকে শুরু করা যাক কেমন।

সারা পৃথিবীর কোটি কোটি মানুষকে যদি আমি দুই ভাগে ভাগ করি তবে একটি ক্ষুদ্র অংশ থাকবে প্রথম ভাগে। যাঁরা ফেসবুক ব্যবহার করেন না। তাঁদের মধ্যে আবার দুটি ভাগ।  


১.ক: যাঁরা ফেসবুক সম্পর্কে মোটেই উত্সাহী নন: হয় তাঁরা পারেন না, নয় তাঁদের ভালো লাগে না ফেসবুক ব্যাপারটাকে। তাঁদের সম্পর্কে আমার কোনো বক্তব্য নেই। 

১.খ: যাঁরা অন্যের ফেসবুক সম্পর্কে বেজায় উত্সুক: তাঁরা নিজেরা একটি একাউন্ট খুললেই পারেন। 'আমি সকলের চেয়ে আলাদা' এই আহ্লাদে একাউন্টটি খোলা হয় না। কিন্তু সকলের খবর জানা চাই। তাই 'দেখি দেখি অমুকে কি বলল' বা 'তমুকে কোথায় বেড়াতে গেল' বলে পাশের জন ফেসবুক খুললেই হামলে পড়েন। সত্যি বলছি এরকম লোক দেখেছি সামনে থেকে। আরে ভাই তুমিও খোল একটা একাউন্ট। কেউ তো কামড়ে দেবে না তোমায়। "নাহ, কি হবে? এসব আমার পোষায় না।" বলে উদাস জ্ঞানী মুখ করে বসে থাকে। 'কি আর হবে? এখন যা হচ্ছে। সকলের খবরাখবর জানতে পারবে"-বলে দেখেছি। উত্তর এসেছে, "এই তো তোদের থেকে জানতে পেরে যাই।" আশ্চর্য প্রজাতি। কি আর বলব। 

আর যাঁরা ফেসবুক ব্যবহার করেন তাঁদের মধ্যে স্টেটাস আপডেট হিসেব করলে আমি তো স্পষ্ট ছয়টি প্রজাতি দেখতে পাচ্ছি। একে একে বলছি। আরো কোনো প্রজাতি থেকে থাকলে ভুলটা ধরিয়ে দেবেন প্লিজ। 

২.ক:  আপডেট: +; চিন্তাভাবনা: +; অ্যাকশন: +: এঁনারা হলেন করিতকর্মা প্রজাতির মানুষ। যেকোনরকম সামাজিক, রাজনৈতিক বা ব্যক্তিগত টালমাটালে চটপট বিষয়টি নিয়ে চিন্তা করেন। ঝটপট ফেসবুকে আপডেট দিয়ে ফেলেন তারপর বিষয়টির ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েন। যেমন ধরুন যাদবপুর থেকে অভিভাবক তাড়াতে হবে, ঝপ করে চিন্তা করলেন 'ঠিকই তো বাচ্চাগুলো তো ঠিক কারণেই গলা ফাটাচ্ছে।' সুতরাং চট করে কলরব হয়ে গেল মানে স্টেটাস আপডেট এলো আর পরদিনই আপনি ব্যানার হাতে রাস্তায়। সত্যি করিতকর্মা। স্বাধীনতাপূর্ব যুগ হলে এঁনারা নিশ্চয়ই বৃটিশের চক্ষুশুল হতেন। 

কিংবা ধরুন হঠাৎ একদিন সকালে গলার কাছটায় কিরকম যেন একটা গুজগুজ করছে বলে ঘুম ভেঙ্গে দেখলেন সবকিছু কেমন যেন লাগছে। কি যেন একটা বলার আছে। গুরগুর করছে ভেতরটা। কিছুতেই বোঝা যাচ্ছে না ব্যাপারটা কি। কিছুক্ষণ পরে যেই পাশের লোকজন সকালে 'গুড মর্নিং' এর জায়গায় 'সুপ্রভাত' বলল অমনি আপনার টং করে মনে পরে গেল "ওহো! আজ তো একুশে ফেব্রুয়ারী।" অমনি আপনি বাংলা ভাষার অতীত, ভবিষৎ, বর্তমান নিয়ে ভয়ানক রকম চিন্তিত হয়ে উঠলেন আর সাথে সাথে একটা সাড়ে পঞ্চান্ন লাইনের স্টেটাস আপডেট দিয়ে চরাচরকে বাংলা ভাষা সম্পর্কে উদ্দীপ্ত করেই ছাড়লেন। পুরো দিনটাই আপনি বঙ্গভাষার জন্য উত্সর্গ করে ফেললেন। 

অর্থাত শুধু ভাবনা বা আপডেটেই আটকে থাকেন না এঁনারা কাজও সেই অনুযায়ী করেন। এঁনারা হলেন প্রথম প্রজাতি।     

২.খ: আপডেট: +; চিন্তাভাবনা: +; অ্যাকশন: - : এঁনারা হলেন দ্বিতীয় প্রজাতি। চটপট চিন্তা করেন। ঝটপট আপডেট দেন কিন্তু মাঠে নেমে গোল দেন না। মানে, যাদবপুর থেকে অভিভাবক তাড়াতে হবে, ঝপ করে চিন্তা করলেন 'ঠিকই তো বাচ্চাগুলো তো ঠিক কারণেই গলা ফাটাচ্ছে।' সুতরাং চট করে কলরব হয়ে গেল মানে স্টেটাস আপডেট এলো কিন্তু রাস্তায় কি আর নামা যায়? ওটা তোমরাই করো। আমি না হয় পেছন থেকে সাপোর্ট করছি। 
বা ধরুন 'ইন্ডিয়াস ডটার' এর হয়ে ঝড় তুলে ফেলবেন স্টেটাসে। লিখিত বাদ-প্রতিবাদে পাতার পর পাতা ভরে যাবে। সত্যি সত্যি বিষয়টি নিয়ে না ভাবলে এত যুক্তি আসে না কলমে থুড়ি কিবোর্ডে। কিন্তু ঘরোয়া জটলায় কেউ কোনো মহিলার পোশাক নিয়ে সরস মন্তব্য করলে চুপ করে থাকা বা হ্যা হ্যা করা ছাড়া আর কিছু করার থাকে না তাঁদের।   

এঁনারাও মহার্ঘ্য প্রজাতি।

২.গ: আপডেট: + ; চিন্তাভাবনা: - ; অ্যাকশন: - : এই তৃতীয় প্রজাতিটির মধ্যে বড়বড় মহাপুরুষরা পড়েন। তাই অনেক সম্মান নিয়ে এঁনাদের কথা লিখতে বা পড়তে হবে। এঁনারা "আমায়ও এই বিষয়ে বলতে হবে" এই ভাবনায় এত বেশি বিভোর হয়ে থাকেন যে, যে বিষয়ে বলতে চাইছেন, সেটি সম্পর্কে আদ্যপান্ত ভাবার আর সময় পান না। ঝটপট আপডেটটা দিয়ে ফেলেন। সকলেই বলছে, অতএব আমার কি আর চুপ করে থাকা চলে? সমাজ সংসার সম্পর্কে আপডেটেড না থাকা একজন বোকা হাঁদা ভাববে না তো সকলে? অতএব সকালে বিকেলে বাজার চলতি বিষয় নিয়ে আপডেট দিয়ে যাও। 

ধরুন পশ্চিমবাংলার মাঠেঘাটে গরম ঘামে জন্ম থেকে ত্রিশ বছর বয়স পর্যন্ত কাটিয়ে আমি হঠাত করে পৃথিবীর উত্তর গোলার্ধের কোনো এক শীতল দেশে কয়মাস কাটিয়ে অঢেল বরফ টরফের ছবি ফেসবুকে ছড়িয়ে দেশে ফিরে আমার গ্রাম সম্পর্কে প্রথম আপডেট এই দিলাম যে, "so hot and humid here, I hate this." আপনি কি করবেন? এসব ক্ষেত্রে পড়ার পরেই সুস্থ জনগনের প্রথম প্রতিক্রিয়া বোধহয় ভসভসিয়ে খানিকটা হাসি ছাড়া আর কিছুই আসবে না। তারপরেও যদি আমি অভিজিত রায় হত্যা বা 'ইন্ডিয়াস ডটার' এর মতন বিষয়েও আমার মতামত জানাই, সেটার মধ্যে কতটা বিবেচনাবোধ বা বিচক্ষণতা বা সচেতনতা আর আশা করা যায়? তবুও আমি আপডেট দিতে ছাড়ি না।   

সাধারণত 'সাহারায় সীতাহরণ' থেকে শুরু করে 'হন্ডুরাসে হাহাকার' বা 'বোর্নিওর বিভীষিকা' তা সে যাই হোক না কেন পৃথিবীর জনপ্রিয় কোনো বিষয়ই ছাড়া পায়না এই তৃতীয় গোষ্ঠীর হাত থেকে। সকল বিষয়েই এঁনারা প্রাজ্ঞ। সমাজ, রাজনীতি, কূটনীতি, সাহিত্য, বিজ্ঞান, সঙ্গীতকলা, খেলাধূলা, চিত্রকলা, চলচ্চিত্র প্রভৃতি পৃথিবীর সকল বিষয়েই একজন মানুষের এত জ্ঞান যে একজীবনে কি করে হয় এ এক রহস্য আমার কাছে। প্রণম্য এঁনারা। 

যাক গে। পরের প্রজাতিতে যাওয়া যাক। 

২.ঘ:  আপডেট: - ; চিন্তাভাবনা: + ; অ্যাকশন: - :  এঁনারা দার্শনিক পর্যায়ভুক্ত। সব দেখেন, সব বোঝেন, কিন্তু কেউ 'যানতি পারে' না। সকলে ভাবে বুঝি ইনি ঘুমোচ্ছেন আদতে কিন্তু চিন্তাভাবনার চাষ চলে মনের মধ্যে সর্বক্ষণ। সমস্ত পার্থিব বিষয়ে এঁনারা ভাবনাচিন্তা করেন এবং উপরোক্ত সকল পর্যায়ভুক্ত জনগনের মতো স্টেটাস আপডেটটা আর দিয়ে উঠতে পারেন না। এত বেশি ভাবনা ভাবতে হয় যে ক্লান্তিতে আর কিবোর্ডে আঙ্গুল সরে না। কিন্তু কে কি আপডেট দিল আর তাতে কি কি ভুল আছে, কি কি অবান্তর চিন্তার ফসল সেই সব আপডেট, কিভাবে লোকজনের মগজের চিন্তাভাবনাগুলোকে সঠিক দিশা দেওয়া যায় এই সব ভাবতে গিয়ে আর বাকিদের আপডেটের খুঁত ধরতে গিয়ে এঁনাদের আর নিজেদের ভাবনাগুলো ফলপ্রসূ করা তো দূর, নিজেদের আপডেটটাই সময়মত দেওয়া হয়ে ওঠে না।   

২.ঙ: আপডেট: - ; চিন্তাভাবনা: + ; অ্যাকশন: + : এঁনারা চার নম্বরদের মতনই চিন্তা ভাবনা করেন। সাথে সাথে যেখানে যেমন দরকার কাজটাও করেন। আপডেট ইত্যাদি তুশ্চু জিনিসের ধার এঁনারা ধরেন না। কর্মবীর। ২.খ তে যেমন বললাম সেরকম পরিস্থিতিতে পড়লে অর্থাৎ ঘরোয়া জটলায় কেউ কোনো মহিলার পোশাক নিয়ে সরস মন্তব্য করলে চুপ করে থাকা বা হ্যা হ্যা করা তো দূরস্থান সেই দণ্ডেই মন্তব্যকারী বা কারিনীর এঁদের হাতে দুর্দশার অন্ত থাকে না। আর ইনি যেহেতু আপডেট তত্ত্বে বিশ্বাসী নন তাই জটলাকারীরা তো জানে না এঁনার স্টেটাস কি। সুতরাং ভুল মানুষের কাছে বেফাঁস মন্তব্যে বেচারাদের ল্যাজেগোবরে অবস্থা হয়। 

২.চ: আপডেট: - ; চিন্তাভাবনা: - ; অ্যাকশন: - : এই শেষ প্রজাতিটি সবচেয়ে ভালো থাকে। ফেসবুকে জন্মদিনের কেক কাটার ছবি লাগায়, নতুন রান্না করলে তার শৈল্পিক ছবি তুলে লাগায়, নতুন জামা কিনলে নতুন নতুন ভঙ্গিতে মুখ দেখায়, বাচ্চার প্রতি ঘন্টায় হাসা-কাঁদা-খাওয়া-পটি করার ছবি দেখায়, নামী জায়গায় বেড়াতে গিয়ে জায়গার তুলনায় নিজের নতুন সানগ্লাসের ছবি লাগায় তাতে ব্র্যান্ডের নামটা দেখা গেলে আরো ভালো। 

এঁনারা চারপাশের হালহকিকতের বিশেষ ধার ধারেন না। আপডেট থাকে মাঝে মাঝে। সেটা নিতান্তই ব্যক্তিগত।যেমন, বোর হচ্ছি, ঘুম পাচ্ছে, বেড়াতে যাচ্ছি, এই সিনেমা দেখছি, দেখে মাথায় ব্যথা করছে......ইত্যাদি ইত্যাদি। এতে সুবিধা হচ্ছে, বহুল প্রচলিত বিষয় নিয়ে কথা বলতে গিয়ে যুক্তি-পাল্টা যুক্তি তৈরী রাখতে গিয়ে মাথা ঘামাতে হয় না। সেলফি তোলার অনেক সময় পাওয়া যায়। কোনো ঝগড়ায় না থেকে কারো সাথে মনোমালিন্য হবার ভাবনা নেই। আর কোনো বিতর্কিত বিষয়ে খোলাখুলি মতামত প্রকাশ করতে গিয়ে শেষে নিজের তৈরী কাঁচের স্বর্গতে পাটকেল পড়বার ভয় নেই। সবদিক থেকেই একদম সঠিক-নিশ্ছিদ্র-নিরাপদ ব্যাপার।

এই হলো গিয়ে আমার মতে ছয় প্রজাতির মনুষ্যকুল। কিছু বাদ দিয়ে গেলে বলবেন।

কি বলছেন? আমি কোন দলে পড়ি? পাগল নাকি? কোনোমতেই বলব না। সবগুলোর যেকোনো একটা হতে পারি। আপনি? 

2 comments:

  1. Replies
    1. ইচ্ছেখাতার পাতায় উঁকি দেবার জন্য অজস্র ধন্যবাদ। আর লেখা ভাল লেগেছে বলে তো আহ্লাদে আটখানা। আরও লেখা পড়ার আমন্ত্রণ রইল।

      Delete