Saturday 12 July 2014

লোহাঘাট-মায়াবতী-১,......উদ্যোগ পর্ব

চার-পাঁচ মাস একটানা পরিশ্রমের, মানে গোদা বাংলায় ঘসটানোর পরও যখন এক্সপেরিমেন্টের এক শতাংশও পজেটিভ রেজাল্ট এলো না এবং দিন কে দিন আমাদের মেজাজও হরিয়ানার রুক্ষ গরমকে পাল্লা দিয়ে বেড়ে চলল, তখন ল্যাব ছেড়ে ধুত্তেরি বলে বেরিয়ে পড়া ছাড়া আর কী বা করার থাকে? অগত্যা মে মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে আর সহ্য করতে না পেরে শ্রীমান পিনাকীচরণ ঘোষণা করলেন যে, "এই উইকএন্ড এ যাবই যাবো। তুই না গেলে আমি একাই যাবো।" বলে কি রে !!!! আমার বলে কিনা বারো মাসের এগারো মাসই ঘুরে বেড়াতে পারলে ভালো হয়, আর বলে কিনা একাই যাবো? কী কান্ড!

তো মোটামুটি বুধবার থেকেই এক্সপেরিমেন্টগুলো এমন ভাবে ফাঁদলাম যে, কোনো মতেই শুক্রবার সন্ধ্যে পাঁচটা থেকে সোমবার সকাল এগারটার আগে আমায় ল্যাবমুখো না হতে হয়। সেদিন থেকেই মনটা বেশ ফুরফুরে বোধ হতে শুরু করলো । মানে মাথার গজালগুলোকে বেশি পাত্তা না দিয়ে গুগল এ সার্চ দিলাম - ‘weekend gateways from Delhi’। কিন্তু যাবোটা কোথায়? জায়গা পছন্দ হয় তো ট্রেন/বাসে টিকিট নেই। টিকিট আছে তো, মনে বাসে আরকি, সেই বাস এমন জায়গায় নিয়ে গিয়ে ফেলবে যে সে জায়গায় যাবার চেয়ে গুরগাঁও এর শপিং মলে ঘোরাঘুরি করা ঢের ভালো। বেশ শরীর ঠান্ডা হবে।

ভেবে ভেবে যখন দুদিন পিনাকীর আঙ্গুলের নখ আর আমার রাতের ঘুম উড়ে যাবে যাবে এমন সময় এক সহকর্মী বলল, "তোমাদের যদি বাড়িতে ঘুমোতে ইচ্ছা না করে তো দিল্লী গিয়ে হোটেল বুক করে থেকে যেতে পারো।" কী অপমান-কী অপমান!!!! আমি যে বেরিয়ে পড়ার পোকা, সে হেন আমি কিনা দিল্লী-র মতো জংশন থেকে একটা weekend ট্রিপ এর ভেন্যু ঠিক করতে পারছি না। নিজেকে বেশ খানিকটা ছি ছি করে ভাবলাম হরিদ্বারেই যাবো, হোক ভিড়, না হোক হিল স্টেশন। যাবই। তত্কালে টিকিট বুক করবো বলে দুই মক্কেল বৃহস্পতিবার ঘুম ঘুম চোখে দুটো ল্যাপটপ খুলে প্রাণপণ চেষ্টা করতে লাগলাম IRCTC র দয়া পেতে। ল্যাবের দেরি হছে। পিনাকী বলল- "তুই চলে যা ল্যাবে, আমি এগারোটা পর্যন্তও দেখে আসছি।" এরপর কী হলো সেটার বিশদ ব্যাখ্যার দরকার নেই, যাঁরাই IRCTC র ওয়েবসাইট থেকে তত্কালে টিকিট কাটেন মানে কাটার চেষ্টা করেন আর কি, তাঁরা সবই জানেন কী কী হতে পরে। বলাই বাহুল্য টিকিট পেলাম না। মানে পেলাম, waiting আট আর নয়। বাসের চেষ্টা করা হলো কিন্তু সেরকম suitable বাস মিলল না। টাইম, প্লেস অফ বোর্ডিং ইত্যাদি ঠিক মনের মতো হলো না। পিনাকী বলল, "waiting আট, নয় হয়েও যেতে পারে বুঝলি!" বুঝলাম। আবার সার্চ…. সার্চ….সার্চ। কোথায় আছে এমন সে দেশ যেথায় যেতে সময় লাগে কম, পয়সা লাগে কম, টুরিস্ট যায় কম, মে মাসে হরিয়ানার গরমকে কাঁচকলা দেখাবার মতো উত্কৃষ্ট ও মানানসই টেম্পারেচার এট্সেটরা এট্সেটরা। অতএব বোঝাই যাচ্ছে যে সার্চটা খুব সহজ হয়নি।

সারাদিন অক্লান্ত পরিশ্রমের পর ঠিক হলো ল্যান্সডাউন যাবো। বেশ বেশ। বেশ সাকসেসফুল মনে হছে নিজেকে। তিন দিন এর চেস্টায় একটা জায়গা তো ঠিক করেছি দুই বাহাদুরে মিলে। সেদিন রাতে দুজনের দুটি ব্যাকপ্যাকে ঠুসে জিনিসপত্র ঢুকিয়ে সব রেডী করে শুতে গেলাম। মানে মেঝেতে জল ঢেলে-মুছে-দুটো বালিশ টেনে নিয়ে শুলাম। এটাই মে থেকে মিড অগাস্ট পর্যন্ত আমাদের বিছানা। সেদিন রাতে আমার ঘুম এবং পিনাকীর নখ দুটোই অক্ষত ছিলো। পিঠের দিকে মেঝের গরম আর ওপর থেকে ছাদের গরমে sandwich হতে হতে, 'কালকে বেশ হিল স্টেশনের দিকে যাবো' এটা ভাবলেই ফ্যানের হাওয়াটা বেশ মধুর মনে হচ্ছিল।

পরদিন ঘুম থেকে উঠে ভাবলাম ভ্রমনে ল্যান্সডাউন সম্পর্কে একটু দেখে নেওয়া যাক। কী হোটেল, কতো দাম, ইত্যাদি ইত্যাদি। ভ্রমন খুলে মাথায় হাত।নেই নেই কোত্থাও নেই ল্যান্সডাউন। আঁতিপাঁতি করে তিন চারবার খোঁজাখুঁজি করে দেখে নিশ্চিন্ত হলাম যে আবার আমায় ল্যাপটপ খুলতে হবে। খুললাম। ল্যান্সডাউনে একটি হোটেল মনোমতো হলো যেটি আমাদের বাজেটের এর মধ্যে। বাকিরা সব বড়দের জন্য। তো সেই ছোটদের হোটেলে ফোন করলাম এবং জানলাম যে পৃথিবী সুদ্ধু সক্কলে ঐদিন আন্ডা-বাচ্চা-বাক্স-প্যাঁটরা নিয়ে ল্যান্সডাউনই যাচ্ছে আর গিয়ে ওই হোটেলেই উঠছে। সুতরাং "ঠাঁই নাই, ঠাঁই নাই ছোটো সে হোটেল।" এবং বাকি হোটেলগুলোর tariff-এ লেখা সংখ্যার দিকে তাকালে মনে হয় "হবে নাই, হবে নাই, ছোটো সে পকেট।"

মুখটা বোতলের মতো করে পিনাকীকে ঠেলা মেরে বললাম, "ওঠ রে, আমরা তিন দিন আগে যে জায়গায় ছিলাম আবার সেই জায়গাতেই ফিরে এসেছি, আমাদের ভেন্যু ঠিক করতে হবে- আমরা আজ সন্ধ্যেতে ঠিক কোথাকার বাস ধরবো।"  ঘুম থেকে উঠেই এরকম একটা সুসংবাদ শুনে সে বেচারা ঘাবড়ে গেল দেখে তাকে সান্ত্বনা দিতে বলি-"একটা প্লাস পয়েন্ট যে, আমাদের ব্যাগ গোছানো কমপ্লিট। একটা কাজ তো এগিয়ে আছে। ডেস্টিনেশনটা ঠিক নেই তো কী হয়েছে।" শুনে সেও উদীপ্ত হয়ে হাই-টাই সামলে ভ্রমন ও ল্যাপটপ নিয়ে বসলো।

হরিদ্বারে হোটেলে ফোন করে জানা গেলো যে, সেখানে জায়গা আছে।  অতএব, আমাদের হরিদ্বারের ট্রেনের টিকিট কনফার্ম হলে আমরা হরিদ্বার যাবো নইলে ……..ঘন্টা দেড়েকের ধস্তাধস্তির পর ঠিক হলো আমরা লোহাঘাট যেতে পারি। ওখান থেকে মায়াবতী যেতে পারি। গুড। তা থাকার জায়গা পাবো তো? KMVN এর গেস্ট হাউসে ফোন করে জানা গেলো জায়গা তো আছে কিন্তু “স্যারজি কল তো গেস্ট হাউস পে বারাতওয়ালী পার্টি হ্যায়….আপলোগোঁকা প্রবলেম তো নেহি হোগা?” আরে কোনো প্রবলেম হবে না……. আমরা রাতে থাকতে পেলেই বর্তে যাই ভাই। চাই কী বারাতের সাথে নেচেও নিতে পারি একটু। পাহাড়ী বিয়েও দেখা হয়ে যাবে। ফোন রেখে দুজনে দুজনের দিকে তাকিয়ে আকর্ণ হাসলাম, ঠিক দুই দিন পর।এইভাবে আমাদের ভেন্যু ঠিক হলো।

বিজয়দর্পে দুজন মিলে দুহাতে ল্যাপটপ, ছাতা, মোবাইল সামলে ল্যাবে চললাম। ব্যাগ নেই, কারণ কাল রাত থেকেই সব অকাজের জিনিস (মানে ল্যাপটপ, চার্জার, ল্যাব নোটবুক ইত্যাদি, ইত্যাদি) ব্যাগ থেকে বের করে বেড়াতে যাবার সব কাজের জিনিস ঢুকিয়ে রেখেছি। ল্যাবে সবাই বলল, "কোথায় যাবে শেষ পর্যন্তও ঠিক হলো?" বললাম, "যদি টিকিট কনফার্ম হয় তো হরিদ্বার (যদিও এই ব্যাপারটা আমার পছন্দ ছিলনা প্রথম থেকেই) নয় তো টনকপুর, সেখান থেকে লোহাঘাট।" সবাই বলল, "সেটা কোথায়?" এই একটি প্রশ্নেই বুঝে গেলাম যে ঠিক জায়গা সিলেক্ট করা হয়েছে। বেশি লোক জানে না, মানে বেশি টুরিস্ট যাবে না। বেড়াতে গিয়ে চারদিকে তাকিয়ে যদি গুরগাঁও এর রবিবার বিকেলের Auchan mall এ ঢুকে পড়েছি বলে মনে হয়, তবে মনের দুঃখে চাট্টি চিপস-ফিপস খেয়ে ফিরে আসা ছাড়া গতি থাকে না। যাই হোক কোনক্রমে কয়েক ঘন্টা কাটিয়ে সব এক্সপেরিমেন্ট এর failure, পাঁচ মাসের ডিপ্রেশন, রুক্ষ গরম - সব কিছু কে টাটা বলে সাড়ে পাঁচটার বাসে উঠে বসলাম।

কী আনন্দ। আজ এরা সবাই কাজ সেরে বাড়ি ফিরছে আর আমরা দুই স্যাঙ্গাত দুটো ফাটো-ফাটো ব্যাকপ্যাক নিয়ে বেরিয়ে পড়েছি। এখনো জানিনা কোথায় যাবো। আনন্দবিহার স্ট্যান্ড থেকে টনকপুরের বাস না নিউ দিল্লি রেলওয়ে স্টেশন থেকে হরিদ্বারের ট্রেন। যদিও আমি personally প্রথমটাকেই এগিয়ে রেখেছিলাম (কারণ লোহাঘাট এর এলিভেশন হরিদ্বারের চেয়ে অনেক বেশি) এবং মনে মনে প্রার্থনা করছিলাম যেন টিকিটটা কনফার্ম না হয়। তবুও ভাবলাম যদি আলটিমেটলি যেতেই হয় হরিদ্বার, তো হাসি মুখেই যাবো। 'কোথাও তো যাওয়া হচ্ছে', এই ভেবে বেশ প্রাণ ঠান্ডা হয়ে এসেছে, এমন সময় বাসের জানলা দিয়ে দেখি আকাশ কালো করে এসেছে আর ঝড় শুরু হয়েছে। কেমন লাগে এবার? এতদিন গরম এ পুড়ে ভাজা ভাজা হয়ে গেলাম, একফোঁটা বৃষ্টি নেই, আর আজ এখানে বৃষ্টি-আমরা যাচ্ছি অন্য জায়গায়। এখানকার লোকজন সম্পর্কে মনে একটু হিংসা হবো হবো হচ্ছে…. সামলে নিলাম, ওরা তো বেড়াতে যেতে পারছে না, আমরা তো যাচ্ছি। এই ভেবে উদার হয়ে গেলাম। ওদের এটুকু বৃষ্টির ভাগ না পেয়ে হিংসা করবোনা আজ যাহ্……এছাড়া আমরা কোথাও বেরোলে, ‘হালকা থেকে- মাঝারি থেকে- বজ্র-বিদ্যুত সহ ভারী বর্ষন’ হয়েই থাকে। আজ অবধি তার ব্যত্যয় হয়নি। যাক গে, বলে জানলার বাইরের ঝড় এনজয় করতে করতে চললাম। বাস থেকে নেমে যখন অফিস ফেরত যাত্রীদের ভিড়ে ঠাসা মেট্রোতে উঠলাম তখন সন্ধ্যে পৌনে সাতটা।  

তারপর? ........এখানে দেখুন


0 comments:

Post a Comment