Thursday 31 December 2015

ধোঁয়ার গন্ধ

বাড়িতে একটা ঘর আছে, সেখানে দুটো মাটির উনুন আছে। যদিও চলতি কথায় তাদের কাঠের উনুন বলে ডাকা হয়। কারণ কাঠ কুটো জ্বাল দিয়ে সেখানে রান্নার ব্যবস্থা। অনেক আগে এগুলিই ছিল আমাদের বাড়ির একমাত্র রান্নাবান্নার ব্যবস্থা। সময়ের সাথে সাথে কাঠের উনুন থেকে গুল-কয়লার আঁচের উনুন, পাম্প দেওয়া স্টোভ-পাম্প না দেওয়া স্টোভ-গ্যাস-ইনডাকশন ওভেন পর্যন্ত বিবর্তিত হয়েছে আমার মায়ের হেঁসেল। কিন্তু সে ঘর- সে উনুন এখনো আছে তার অটুট স্বাস্থ্য নিয়ে। সে উনুন ব্যবহারের জন্য প্রয়োজনীয় জ্বালানির জোগাড়ও আছে। প্রতিদিনের অল্প ব্যবহারের সাথে সাথে এখনো বছরের দুটো দিন তারা মহানায়ক এর ভূমিকা পালন করে। কিন্তু যে কথাটা বলতে ইচ্ছে করছে সেটা এই উনুন নিয়ে নয়, উনুন এর ধোঁয়া নিয়ে।      

অনেক ছোট্টবেলার কথা মনে পড়ে। বিনা কারণে হাঙ্গরের মত হাঁ করে কান্নাকাটি আর আদরে-আহ্লাদীপনার বিলাসিতার পর্ব পার করে এসে তখন সদ্য স্লেট-পেন্সিলে পড়েছি। সকাল-বিকেল পড়তে বসা রান্নাঘরে। কারণ মায়ের তাতেই সুবিধা। একখানা আসন ছিলো, মায়েরই হাতে বোনা। সবুজ রঙের উল দিয়ে চৌখুপি-মধ্যে আট পাপড়িওয়ালা লাল উলের ফুল। ধারগুলো মায়ের শাড়ির পাড় কেটে বাঁধানো। আমার পড়তে বসার আসন। আর বইখাতা বলতে, একখানা নামতার বই, বর্ণপরিচয়, হাসিখুশি ইত্যাদি গুরুত্বপূর্ণ পাঠ্যবই, সঙ্গে আমার অধিকারে থাকা কথামালা, ঈশপ-এর গল্পের একরঙ্গা ছবির বই -ইত্যাদি সমস্ত রকম গুরুত্বপূর্ণ সম্পত্তি নিয়ে রান্নাঘরে গিয়ে হাজির হতাম সকাল বিকেল। তারপর ঘন্টা দুই তিন রাম-রাবণের যুদ্ধ সেরে যখন আবার পাততাড়ি গুটিয়ে রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে আসতাম ততক্ষণে ফ্রকের ঝুল দিয়ে ভিজে চোখ মুছতে গিয়ে কেমন একটা গন্ধ পেতাম।  ধোঁয়ার গন্ধ। সেই একই গন্ধ পেতাম মায়ের শাড়িতে রাতের বেলা মাকে আস্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে শোবার সময়। 

শীতের দুপুরে বেলাশেষের আগে তড়িঘড়ি রাতের রান্নাবান্না সেরে ঘরে ঢুকে পড়ার একটা তাড়া থাকত সব বাড়িতেই। প্রায় সমস্ত বাড়িতেই তখন রান্নাঘরগুলো ছিল বাড়ির বাইরের দিকে। শীতকালে আশেপাশের সমস্ত বাড়ি থেকেই তাই শীতের বিকালবেলা বেরিয়ে আসতো ধোঁয়া। সঙ্গে ধোঁয়ার গন্ধ। ভারী হয়ে ভেসে থাকত, আস্তরণ তৈরী করত আমাদের খেলার মাঠের ওপর। শীতকালে খেলতে যাবার আগে জুতো-মোজা, হলুদ-কালো হনুমান টুপির সাথে আবশ্যক ছিল বোরোলিন বা পন্ডস কোল্ড ক্রিম। সুতরাং শীতের ছোট্ট বিকেলে বাড়ির পাশের খামারে বৌবসন্ত বা পিট্টু খেলার আর বোরোলিন বা পন্ডস কোল্ড ক্রিমের গন্ধের সাথে মিশে গেছে সেই গন্ধ। ধোঁয়ার গন্ধ। অঘ্রাণে ধান কাটা হলে, আমাদের বৌবসন্ত বা পিট্টু খেলার জায়গা দখল করে তিনচারটে বাড়ির ধানের গাদা বসত খামারে। আমাদের তখন ধানের গাদার ফাঁকে ফোঁকরে লুকোচুরি খেলার দিন। আর আমাদের সাথে পাল্লা দিতে তখন সব বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসা ধোঁয়ারাও একজোট হয়ে স্তরে স্তরে কুন্ডলী পাকিয়ে ঘুরে বেড়াত ধানের গাদাগুলোর ফাঁকে-ফোঁকরে। পুরনো হিন্দি সিনেমায় স্বপ্নের দৃশ্য দেখাবার জন্য যেমন ধোঁয়ার একটা আস্তরণ তৈরী করা হয়, প্রায় তেমনি একটা দৃশ্য তৈরী হত খামারে। তফাৎটা এই যে এক্ষেত্রে ধোঁয়াটা পায়ের দিকের জায়গায় মাথার ওপরে। তার মাঝে লুকোচুরি খেলার চোরের গলায় ভেসে আসত "অমুক, এক পাঁচ"। এই "এক পাঁচ" কথাটা যে ঠিক কেন বলা হত তা আমি জানি না আজও।কথার মানে, অমুক নামের লোকটি নিজেকে আড়ালে রাখতে পারল না। আর আমি তখন অন্য আর একটি ধানের গাদার পিছনে নিজেকে লুকিয়ে রেখে ধোঁয়া আর কখনো কখনো তার সাথে মিশে আসা সরুচাকলি পিঠের গন্ধ নিচ্ছি। 
সরুচাকলি বানাতো মা। এখনো বানায়। গ্যাসের ওভেনে। তাই তাতে কখনো ধোঁয়ার গন্ধ হয় না আর। আগে মাঝে মাঝে পেতাম। সাথে দুই এক টুকরো ছোট্ট পোড়া কুটো। উনুনের অবদান। রাতের রান্না সেরে পড়ন্ত উনুনে রাখা থাকত একহাঁড়ি ভর্তি জল। ধিকিয়ে ধিকিয়ে যতটুকু উত্তাপ সে দেবে তা রাতে খাবার শেষে মুখ হাত ধোবার জন্য ওই এক হাঁড়ি জল গরম হবার পক্ষে যথেষ্ট। আর মাঝে মাঝে ওই পড়ন্ত উনুন এর পাশে বসত পড়ার আসর। উনুনের গরমে আরামদায়ক হয়ে থাকত রান্নাঘরটা।
  
কুড়ি-পঁচিশ বছর আগেকার ধোঁয়ার গন্ধমাখা শীতের বিকেলবেলার কথা আজ মনে পড়িয়ে দিল সামান্য এক চিমনির ধোঁয়া। বাইরে শীতের হাওয়া। পাশের বিল্ডিং এর চিমনি থেকে গলগলিয়ে বেরিয়ে আসছিল সাদা ধোঁয়া। উনুনের নয় নিঃসন্দেহে। এরা কাঠ পুড়িয়ে রান্না করে না আর। আমিও ছিলাম। বিকেলের খেলার সঙ্গীদের সাথে ধানের গাদায় লুকোচুরি খেলার মাঠে নয়, কোনো এক কাজ পালানো অবসরে ঢাকা দেওয়া কাগজের কাপে বিস্বাদ কফি সঙ্গী করে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত আরামদায়ক কাফের কাঁচের জানলার পাশের চেয়ারে বসে। বোরোলিন-সরুচাকলি মাখা ধোঁয়ার গন্ধের বদলে বাতাসে ছিল চীজ-মায়োনিজ-কফির মিশ্র গন্ধ। তবুও কেন যে একশো কথার ফাঁকে মনে পড়ে গেল সেই ধোঁয়া মাখা বিকেলগুলোর কথা কে জানে। কফির গ্লাসে চুমুক দিতে দিতে দেখছিলাম গলগলিয়ে বেরিয়ে আসা ধোঁয়ারা ব্যস্ত হয়ে হুড়মুড়িয়ে উঠে যাচ্ছে ওপর দিকে। কোনো সমান্তরাল আস্তরণ তৈরী না করেই। হয়ত এখানে ধানের গাদায় লুকোচুরি খেলার কেউ নেই বলেই। হয়ত খেলতে খেলতে ধোঁয়ার সাথে সরুচাকলি পিঠের গন্ধ নেবার কেউ নেই বলেই। কে জানে।         
       

Saturday 12 December 2015

আটপৌরে

আটপৌরে কথাটা প্রথম শিখি মায়ের শাড়ী পরা থেকে। আমার মা বাড়িতে 'আটপৌরে করে' শাড়ী পরে। ছোটবেলা থেকেই দেখতাম  কোথাও বেরোতে গেলে সেই শাড়ীতে কেমন করে যেন গজিয়ে উঠতো বেশ কয়েকটা কুঁচি। আর বাঁদিক এর কাঁধ থেকে ভাঁজ খেয়ে উঠে যাওয়া মাথার অর্ধেকটা চাপা দেওয়া ঘোমটাটা ডানদিকের কনুই পর্যন্ত এসে থমকে গেছে। অর্থাৎ সাধারণত ভারতীয় মহিলারা যে কয়জন এখনো শাড়ী পরেন তাঁদের সিংহভাগ এখনো যেভাবে পরেন আর কি। আর বাড়িতে থাকলে মায়ের ওই কুঁচিটা বেমালুম উধাও হয়ে যায়। আর সেই বাবদ বেঁচে যাওয়া কাপড়টা কয়েকপাক এদিক ওদিক ঘুরে সোজা বাঁকাঁধে। সেখানে থেকে আর ভাঁজ খেয়ে ঘোমটা আকারে মাথায় না উঠে বাঁদিকের পিঠ বেয়ে ডান হাতের তলা দিয়ে পাক খেয়ে আবার বাঁকাঁধে। এইটি হলো 'আটপৌরে করে শাড়ী পরা।' আটপৌরে শব্দটি আমার শেখা এখান থেকেই। ফলত এই শব্দটার সঙ্গে একটা যেমনতেমন করে থাকা বা নিজের প্রতি যত্ন না নিয়ে যাহোক করে কোনো কিছু করার একটা সংযোগ আমার মনে গেঁথে গেছিল ছোটো বয়সে। মনে আছে মাকে আমি অনেকবার বলেছি ছোটবেলায় যে কাকিমার (আমার বন্ধু রুমার মা) মতন করে শাড়ী পড়তে পারো না? মা বলত কেন পরি তো বাইরে গেলে। আমার তর্ক ছিল-'কেন? কাকিমা তো বাড়িতেও ওরকম করে পরে, তুমিও পরবে।' মায়ের যুক্তি ছিল-'এই তো বেশ আছি', বা -'এরকম করে পরে আরাম', বা 'জ্যাঠিমাদের দেখেছিস কখনো বাড়িতে ওরকম করে শাড়ী পড়তে' (আমার জ্যাঠিমারা সকলেই মায়ের মত ফর্মুলায় বা বলা ভালো মা জ্যাঠিমাদের মত একই ফর্মুলায় বাড়ি এবং বাইরের শাড়ী পরার পদ্ধতি অনুসরণ করতেন/করেন।)? কোনটিই বিশেষ জোরালো যুক্তি নয়। সুতরাং ওসব যুক্তি আমার কাছে বিশেষ গ্রাহ্য হত না। কেবলই মনে হতো শাড়ী পরার ধরনের সঙ্গে সঙ্গে মা-টিও এই বুঝি বাকিদের থেকে আটপৌরে হয়ে গেল।  হলেও যে বিশেষ লাভ ক্ষতি নেই সে হিসেব বোঝার বয়স তখন আমার হয়নি। মোদ্দাকথা 'আটপৌরে' শব্দটিই এমন একটি চোখে না পড়া-যেমনতেমন-হালকা গুরুত্বহীন চেহারা নিয়ে আমার কাছে এসেছিল যে, সেই আমির পক্ষে মাকে আটপৌরের বাঁধন থেকে উদ্ধার না করলেই চলছিল না। সুতরাং সেই এক বিষয় নিয়ে মাঝে মাঝেই ঘ্যানঘ্যান করতে থাকতাম। আর মাও মেজাজ-মর্জি অনুযায়ী কখনো মুচকি হেসে কখনো এক ধমকে আমায় থামিয়ে দিত। তারপর স্কুলের শেষের দিকে কোনো এক বিয়ে বাড়িতে দেখলাম কনের খুব কাছের একজন মহিলা অত্যন্ত মহার্ঘ্য একটি শাড়ী আমার মায়ের বাড়িতে পরা সেই সাধারণ- যেমন তেমন-নজরে না পড়া শাড়ীপরার ধরণে পরেছেন, এবং বিয়েবাড়ি শুদ্ধু ফ্যাশনে অভিজ্ঞ মহিলাকুল তাঁকে উচ্চপ্রশংসা করছেন। সম্ভবত সেদিন থেকেই মায়ের শাড়ী পরা নিয়ে আমার অভিযোগ কমতে থাকলো। আর তারপর আস্তে আস্তে বড় হতে হতে 'আটপৌরে' শব্দটির আক্ষরিক এবং অন্তর্নিহিত অর্থ যত আমার কাছে পরিস্কার হতে থাকলো ততই মায়ের বাড়িতে শাড়ী পরার ধরন নিয়ে আমার অভিযোগ কমতে কমতে শেষে কখন যে উধাও হয়ে গেল বুঝতেই পারলাম না। আর এখন তো বিয়ের কনেরাও ফ্যাশনের রাস্তায় উল্টো মুখে হেঁটে আবার পুরনো রীতি অনুসরণ করে আমার মায়ের মতন করে শাড়ী পরে বিয়ের পিঁড়িতে বসছেন। সুতরাং এখন তো এ নিয়ে আমার আর কোনো কথাই নেই। তবুও এখনো আটপৌরে শব্দটা কোথাও পড়লে মায়ের এই শাড়ী পরার ধরনটি এবং সেই সংক্রান্ত আমার অভিযোগ এর কথা আমার মনে পড়ে যায়।   

মায়ের শাড়ী আর আমার ছোটবেলার ধারণা নিয়ে যখন কথা উঠলো তখন আরো একটা কথা মনে পড়ে গেল। মায়ের চিরকালের পছন্দ হালকা রঙের শাড়ী। তাই মায়ের যত্সামান্য শাড়ীর ভান্ডারের অধিকাংশই সাদা-ধূসর-বা এদের আশেপাশের চোখ আরাম দেওয়া অন্য রং এর শাড়ী। জরি-চুমকি তো নৈব নৈব চ। এদিকে আশেপাশের সকলকে দেখি বড় বড় রঙিন ফুলপাতা আঁকা-চকমকে শাড়ীতে। সেটিও আমার আরো একটা ঘ্যানঘ্যানানির বিষয় ছিল মায়ের কাছে। সেই আটপৌরে রং আর পোশাকি রং এর ঝগড়া। বাচ্চা মানুষের বুদ্ধি আর কি। বয়স এর সাথে সাথে কখন যে আমার নিজের কেনা জামা বা মায়ের জন্য কেনা শাড়ীর রংও যে সাদা-ধূসর বা এদের আশেপাশের চোখ আরাম দেওয়া অন্য রং এ বদলে গেছে নিজেও বুঝতে পারিনি।

ভালো লাগা বা কোনো একটি বিশেষ বস্তু বা বিশেষ বিষয়ের প্রতি মানুষের ধারণা বদলে যাওয়াটা শ্বাস গ্রহণ বর্জন এর মত এতটাই স্বাভাবিক ঘটনা সে কখন যে আস্তে আস্তে সে বিষয়বস্তুর প্রতি আমাদের ধারণা বদলাতে বদলাতে বেমালুম উল্টোমুখে চলতে শুরু করে যে আমরা নিজেরাই অবাক হয়ে যাই যে, কোনো এক সময় এই বিষয়টি আমরা এভাবে দেখতাম! বা বিষয়টি আমাদের চোখে এতটাই স্বাভাবিক বা আটপৌরে ছিল সে সম্পর্কে কোনদিন ভেবেও দেখার প্রয়োজন অনুভব করিনি। অথচ আজ সে বিষয়টি তার মহত্ব নিয়ে এমন ভাবে রাস্তা আড়াল করে দাঁড়িয়েছে যে এতবড় বিষয়টি থেকে কি করে এতদিন চোখ বন্ধ করে ছিলাম সেকথা ভেবে লজ্জা পেতে হয়। সে বিষয়টি তখন আটপৌরে থেকে একধাক্কায় রীতিমত পোশাকি হয়ে ওঠে। আর উল্টোদিকে এমন কিছু বিষয় নিয়ে এতদিন নিজের মধ্যেই ঘ্যানঘ্যানানি পুষে রাখতাম সে যেন রীতিমত পোশাকি ব্যাপার। বিলাসিতার মত। প্রয়োজনমতো মনের আলমারি থেকে ন্যাপথলিনের গন্ধ মাখা সাধের দুঃখ তুলে এনে খানিক কান্নাকাটি করে আবার তাকে তুলে রাখা। যে মুহূর্ত থেকে সত্যি সত্যি মন বুঝতে পারলো যে, বিষয়টি কেবলমাত্র পোশাকি বাহুল্য ছাড়া আর কিছু নয়, অমনি সে তার সমস্ত পোশাকিত্ব হারিয়ে ঝুপ করে বাড়ির আলনায় রাখা আটপৌরে শাড়ীটি হয়ে পড়ল। গায়ে জড়িয়ে আরাম। তখন তাতে অবলীলায় হলুদ মাখা হাত মুছে ফেলা চলে। তার পর ধীরে ধীরে রোজকারের ব্যবহারে ছিঁড়ে-রং উঠে- ঘরমোছা ন্যাতা হয়ে শেষে কবে যে মনের সংসার থেকে বিদায় নিল মন জানতেও পারল না। 

এই আটপৌরে থেকে পোশাকি আর পোশাকি থেকে আটপৌরেতে ধ্যান-ধারণার ধীর কিন্তু অবিচল পরিবর্তনের স্রোতটির সঙ্গে খাবি খেতে খেতে চলতে চলতে মনে হয়, এখনো যেসব ঋণাত্মক অনুভূতিগুলি সযত্নে ন্যাপথলিন এর টুকরো দিয়ে পোশাকি আলমারিতে তুলে রেখেছি, দরকার মত বের করে এনে বিলাসিতা করব বলে, সেগুলো হঠাত করে এক ধাক্কায় যদি জাদুমন্ত্রবলে টেনে বের করে এনে আটপৌরে আলনায় ফেলা যেত বেশ হত। জীবনের নিজস্ব নিয়মেই সে একদিন রোজকারের ব্যবহারে ছিঁড়ে-রং উঠে- ঘরমোছা ন্যাতা হয়ে শেষে কবে যে মনের সংসার থেকে বিদায় নিত মন জানতেও পারত না। ওই পোশাকিত্বের মায়া কাটিয়ে আটপৌরে আলনায় টেনে বের করে আনাটাই আসল কথা। বাকিটা আপনিই হয়ে যায়।  দেখা যাক।  

  

Sunday 29 November 2015

চা টা খাবো

Google image থেকে 

গদাম কয় গদামি
জানি তোর বদামি।
আমরা দুটি গাধা রে
গান ধরেছি সা ধা রে।
সুরের চোটে ফাটল ছাদ
সেই থেকে সুর রইল বাদ।
সেই থেকে মন বেজায় ব্যোম
হাত পা ছুঁড়ি দমাদ্দম।
হাত পা ছুঁড়ে ভাঙ্গল কাপ
চা টা খাব কোথায় বাপ?
একটা বাটিও নেই বাকি?
ঠিক বলছ? বাপরে সেকি?
এতো দেখি বেজায় রাগ!
আচ্ছা ছাড়ো, যাক গে যাক।
এবার চল চা টা খাবো
কাপটা না হয় আমিই দেব।
সেই ভাল বেশ চলো চলো
মনটা বরং হবে ভালো।

বড় হয়ে ওঠা


অনেকদিন আগে, সম্ভবত জুন মাস নাগাদ যখন দুই এক দিনের জন্য ব্লগে কিছু লেখার চেষ্টা করেছিলাম তখন বলেছিলাম যে, ভাবনার সহজ প্রকাশ খাতায় কলমে তখনই সম্ভব যখন মস্তিস্ক-হৃদয়-আর পারিপার্শ্বিকতা সবাই একসাথে কোরাস গাইতে পারে। কোনভাবেই সেই কোরাস গানটিকে একসুরে বেঁধে উঠতে পারা যাচ্ছিল না এতদিন। ইদানিং পালে খানিক অনুকূল হাওয়া বইতে শুরু করেছে বলেই মনে হচ্ছে। জানিনা এই মনে হওয়াটা কতখানি ঠিক। সবটাই আশা করে থাকা মনের ভ্রম, যা অদূর ভবিষ্যতে আবারও ভুল প্রমানিত হতে চলেছে? নাকি সত্যি সত্যি গা ঝেড়ে উঠে দাঁড়াবার সময় এসেছে? ভবিষ্যত এর ভাবনা তুলে রেখেই বলি, যাই হোক না কেন, বর্তমান পরিস্থিতিতে খানিকটা লেখালেখি করা যেতেই পারে। অন্তত মন তাতে বিশেষ বাগড়া দেবে বলে মনে হয় না। বেশ কিছু ঋণাত্মক তরঙ্গের ধাক্কা খেয়ে বেসামাল হয়ে মুখ থুবড়ে পড়তে পড়তেও সামাল সামাল বলে সামলে নেওয়া গেছে। তাতে হাত পা ছড়ে-কেটে গেছে হয়ত কিন্তু বড়সড় স্থায়ী ক্ষতি আটকানো গেছে। তাতে চির-অস্থির ঢেউ এর ওপর রাগ হয়েছে। এবড়ো-খেবড়ো সাগরতটের ওপর হতাশায় লাথি কষাতে ইচ্ছে হয়েছে। সব ছেড়ে দিয়ে সাগর পাড়ি দেবার ইচ্ছে ত্যাগ করে ডাঙার নিসংশয় জীবন কাটাবার মতন আত্মবিরোধী ইচ্ছে পর্যন্ত হয়েছে। কিন্তু সত্যিটা এই যে শেষ পর্যন্ত টিকে গেছি। 

চেষ্টা করলে হয়ত প্রতিটি মানুষের সমস্ত জীবনকালটিকে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ ভাগে ভাগ করা যায়। সে তিনি যতই বিখ্যাত বা অখ্যাত ব্যক্তি হন না কেন। বিখ্যাতদের জীবনের সেইসব অখ্যাত অধ্যায় থেকে আমরা ঘুরে দাঁড়াবার প্রেরণা পাই। পরিস্থিতি মোকাবিলা করার সাহস পাই। সেই সব ধাক্কা খাওয়া অধ্যায় থেকে আমরা আমাদের ওপর এসে পড়া ঢেউ এর ধাক্কা সামলে বড় হয়ে উঠি। প্রতিটি মানুষের জীবনেই বড় হয়ে ওঠার এরকম অধ্যায়গুলি আসে আর তার ধাক্কা সামলাতে সামলাতে একটা লাভ হয় যে মানুষটি সত্যিকারের প্রফেশনাল-প্রাকটিক্যাল-আর বাইরের পৃথিবীর জন্য সে সন্দেহশীল হয়ে ওঠে। 

এই লেখাটি হয়ত কিছুটা স্বগতোক্তি। হয়ত কিছুটা ব্যক্তিগত, এখানে লেখার বিষয় নয়। তাও লিখছি। আমি দেখেছি আমার কখনো খুব খারাপ কিছু হয় না। খুব টালমাটাল অবস্থার মধ্যে দিয়ে হয়ত যেতে হয়েছে। অকারণে অনেক প্রতিকূলতার মধ্যে পড়তে হয়েছে। কিন্তু মারাত্মক ক্ষতি কিছু হয়নি। হয়ত আমি বিশ্বাস করি যে আমার কোনো বড় ক্ষতি হতে পারে না, বা যেকোনো খারাপ পরিস্থিতিতে পড়ে সেখান থেকে বেরিয়ে আসার প্রানপণ একটা চেষ্টা থাকে বলেই হয়ত বাইরে থেকে বড়সড় কোনো পরিবর্তন দেখা যায় না। যাই হোক না কেন, এরকম পরিস্থিতির মধ্যে দিয়ে যেতে হয়না বা হয়নি এরকম মানুষ খুঁজে পাওয়া দুর্লভ। স্বেচ্ছায় সমতল ছেড়ে যাঁরা হিমালয় এর শোভা দেখার মনস্থির করেছেন তাঁদের জন্য যে কম বেশি প্রতিকূলতা অপেক্ষা করেই সেতো বলাই বাহুল্য। আর এইসবের ভালো দিকটি এই যে, মানুষ চিনতে পারা-দেহ মনের শান্তি বিঘ্নিতকারী মানুষদের থেকে সযত্নে নিজেকে সরিয়ে নেওয়া-মেরুদন্ডহীন স্বার্থসর্বস্ব মানুষদের চোখের দিকে তাকিয়ে তাদের অন্যায় কৃতকর্মের প্রতিবাদ করার সাহস অর্জন করা-নিজের সামান্য লাভের আশায় এদের অন্যায়কে সহ্য না করার সহজ শক্তি যে নিজের মধ্যে আছে তাকে চিনতে পারা- আর তার ফলে আত্মবিশ্বাস ফিরে পাওয়া। আর সবচেয়ে বড় কথা, মেরুদন্ড সোজা রেখে, মিথ্যাবাদীর চোখে চোখ রেখে সত্যিকথা বলার সাহস থাকার অপরাধে আশেপাশের সমাজে যে অপবাদ ছড়াবার কথা সেই কথা আর সমস্ত বিপ্রতীপ মানুষজন কে অনায়াসে পাত্তা না দিয়ে পাখির চোখের মত নিজের লক্ষ্যে এগিয়ে যাবার মতন বুকের পাটা তৈরী হয়ে যাওয়া। 

সুতরাং, প্রতিকূলতা কারো জীবনেই কখনোই হয়ত কাম্য নয়। কিন্তু যদি তা এসেই যায়, তাকে বুক দিয়ে ঠেকিয়ে রাখতে গিয়ে প্রতিকূলতাকে ভয় না পেয়ে বুক চিতিয়ে সামনে দাঁড়াবার মতন একটা পাথুরে বুক যে তৈরী হয়ে যেতে পারে সেটিও কম লাভ নয়। সেটাই হয়ত সামনাসামনি প্রত্যক্ষ করার জন্য সদ্যবিলীয়মান কিছু পরিস্থিতির প্রয়োজন ছিল আমার 'বড় হয়ে ওঠার জন্য।'

Friday 10 July 2015

মেঘলা দিনে




মেঘলা দিনে নরম হয়ে আসে মেঘলা মন
কেমন নরম জানো?
দুহাতের পাতায়
একমাস বয়সের কাঠবেড়ালীর ছানাকে
ধরে দেখেছ কোনোদিন?
ঠিক সেরকম।

হাতের মধ্যে থরথর করে কাঁপতে থাকে সে,
পালকের মত তিরতিরে লেজটা সিঁটিয়ে যায়
ভয়ে-অনিশ্চয়তায়।

তারপর ধীরে ধীরে
হাতের ওম পেয়ে
কখন যেন নির্ভর করতে শুরু করে হাত দুটিকে।
শিথিল হয়ে আসে তার ভয়াতুর তিরতিরে লেজ।
পাতলা আঙ্গুল দিয়ে জড়িয়ে নেয় আঙ্গুল।
মুখ নামিয়ে দেয় হাতের উপর
পিঠের তিনটে রেখায় আঙ্গুল বোলালে
পরম নিশ্চিন্ততায় চোখ বোজে,
আবেশে।

মেঘলা দিনে যেরকম শিরশিরে ভেজা হাওয়ায়
স্তব্ধ হয় ভাবনা।
আর তারপর
অঝোর ঝরা বৃষ্টিতে আধভেজা হতে হতে
পরম নিশ্চিন্তে মাথা রাখা যায় জানলায়
আর সমস্তকিছুকে সরিয়ে রেখে।     


আজ বৃষ্টি হয়েছে। অঝোরে। সবকিছু ভাসিয়ে নিয়ে গেছে সে। অনেকদিনপর। অনেক সময় নিয়ে।      

Wednesday 24 June 2015

Multitasking

Multitasking ব্যাপারটা শুনতে যতটা কঠিন লাগে ব্যাপারটা আদতে তার চেয়ে শতগুণ বেশি কঠিন। এই আপ্তবাক্যটি আমি সম্প্রতি আবিষ্কার করেছি। বলা ভাল নিজের দৈনন্দিন জীবন দিয়ে বুঝতে শিখেছি বা শিখছি। এতদিন Multitasking বলতে বুঝতাম ল্যাবে তিনটে এক্সপেরিমেন্ট একসাথে করে ফেলার চেষ্টা করা বা বাড়িতে মাছ ভাজা করতে করতে গত দশদিনের ঝাঁট না পড়া ঘরের মেঝেতে ঝাঁটা বুলিয়ে ফেলা বা প্রেসার কুকারে খিচুড়ি চাপিয়ে সেই খিচুড়ি না পুড়িয়ে ফেলে আস্ত একটা সিনেমা দেখে ফেলার মতন কাজ বুঝি। ফলে এযাবৎকাল এই জাতীয় মহান কাজকর্ম একসাথে করে ফেলতে পেরে “ওরে এ তো দারুণ multitasking”- বলে গলা ফুলো পায়রা হয়ে ঘুরে বেড়াতাম। এখন বুঝছি ব্যাপারটা এতটাও বোধহয় ইয়ে নয়। যখন ল্যাবের তিনটে এক্সপেরিমেন্টের মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্কটা হল “চন্দ্রবিন্দুর চ, বেড়ালের তালব্য শ আর রুমালের মা” তখন তার থেকে ‘চশমা’ বানানোটা যে কি বিপুল ঝকমারির কম্ম তা যেকোনো রিসার্চ ল্যাবে বছর তিনেক কাটানো যেকোনো হতভাগ্যই জানেন। আর তার সাথে যদি থাকে নির্দিষ্ট সময়সীমার রক্তচক্ষু তবে তো ব্যাপারটা আর বেশ রসস্থ হয়ে ওঠে। আর তার সাথে যদি যোগ হয় নিজের ভবিষ্যত দর্শনের বৃথা চেষ্টা তাহলে তো সোনায় সোহাগা, দিগ্বিদিকে অন্ধকার। এবং এখানেও শেষ না হয়ে বেয়াড়া মাথা যদি বলে আমার বিনোদনের খোরাকটি গেল কই? ফলে আরও একশো রকম বিষয়ে পড়াশুনা-আলোচনা, আলুভাজা খেতে খেতে একশো রকম ভাবে ব্রেনস্টর্মিং ইত্যাদি। সাথে আবার মনের বায়নায় তার বিনোদনের ব্যবস্থার কথাটিও ভুললে চলে না। নইলে আবার মন আর মাথার ঝগড়ায় মন বা মাথা সমস্ত কাজই ভুন্ডুল হতে বসে। এত কিছুর মধ্যে সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি হল সমস্ত কিছু থেকে সঠিক সময় মন সরিয়ে এনে সেই মুহূর্তের বর্তমান বিষয়টিতে মনোনিবেশ করা। কিন্তু বাকি বিষয়গুলিকেও ভুলে গেলে চলে না। সঠিক সময়ে সমস্ত মন মাথা নিয়ে সেখানে ফিরে আসার কথাটিকে মস্তিস্কের কোন একটি কুঠুরিতে সযত্নে লালন করা চাই। অর্থাৎ ঘরের মেঝেতে ঝাঁটা বোলাতে বোলাতে মাছভাজার কথা ভুলে গেলে সেদিন আর ভাতের সাথে মাছটি জুটলো না। আবার সম্পূর্ণ মাথাটি মাছের দিকে থাকলে ঘরের এদিক ওদিক রয়ে যায় ধুলোর পরত। আমার যেমন মাছ ভাজতে গেলে মনে পড়ে ঘরটা না পরিস্কার করলেই নয়। উশখুশ করতে করতে যেই না ঝাঁটা হাতে নিলাম, অমনি সাঁ করে মন হতভাগা ঝাঁপ মারলো মাছের কড়াইতে। ফলে যা হয়- না হল ঠিক করে মাছ ভাজা, না হল ঠিক করে ঘর পরিস্কার করা। দুপুরে আধপোড়া বা আধকাঁচা মাছ দিয়ে ধুলো কিচকিচ ঘরের মেঝেতে বসে ভাত খেতে হল। উপরি পাওনা ঠিক সময়ে ঠিক কাজ না করায় মন খুঁতখুঁত- বুক দুড়দুড়- জীবনটাকে একবাটি ভর্তি কালমেঘ পাতার রস ছাড়া আর কিছু মনে না হওয়া ইত্যাদি ইত্যাদি। দুইয়ের মাঝে সঠিক ব্যালান্সই যে হল আসল multitasking সেটি এই বুড়ো হয়ে তবে একটু একটু বুঝতে পারছি। আগে তো পুরোটা হৃদয়ঙ্গম করে উঠি তবে তো চেষ্টা করে করে একটু একটু multitasking করার কথা ভাবা যেতে পারে। নির্দিষ্ট সময় নির্দিষ্ট বিষয়ে পূর্ণ মনোনিবেশ আর নির্দিষ্ট সময় নির্দিষ্ট বিষয় থেকে সাময়িক ভাবে মন তুলে নিয়ে পরবর্তী নির্দিষ্ট বিষয়ে পূর্ণ মনোনিবেশ করতে আমার তো অন্তত এখনও ল্যাজেগোবরে অবস্থা। দেখা যাক। চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি।

এই চেষ্টাটা অন্তত শুরু করে উঠতে পেরেছি বলে অন্তত নিজের চোখের দিকে আয়নায় তাকাতে পারা যাচ্ছে। অপরাধবোধ খানিক কম কম বলেই মনে হচ্ছে, তাই হয়ত প্রাণে খানিক হাওয়া লেগেছে। অবশ্য প্রাণে বাতাস লাগার আরও কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ ঘটেছে। এক, মৌসুমি বাতাসের অক্ষরেখা উত্তরপ্রদেশের মাঠঘাট ছাপিয়ে হরিয়ানা ছুঁই ছুঁই হয়ে এসেছে। তার আভাস পাওয়া যাচ্ছে। আর খটখটে হরিয়ানায় বসে থাকা বর্ষা ভেজা সবুজ জল ছপছপ বঙ্গে বড় হওয়া মানুষের কাছে এর চেয়ে ভাল খবর আর কি হতে পারে? আর দুই নম্বর কারণটা হল এই যে, আমরা কাল আবার দুজনে লোটা কম্বল নিয়ে বেরিয়ে পড়ছি তিন-চার দিনের জন্য। এবারের গন্তব্য কুমায়ুন পাহাড়ের খাঁজে লুকিয়ে থাকা-মুক্তেশ্বর। আমাদের বেড়ানোর রুটিন মেনে কালকে যথারীতি বজ্রবিদ্যুৎসহ ঝড়বৃষ্টির পূর্বাভাস ঘোষিত হয়ে গেছে এরই মধ্যে।


এর পরেও প্রাণে বাতাস না লেগে পারে?       

     

Wednesday 6 May 2015

চেনা-অচেনা গাড়ওয়াল-১

মনের কথা সাদা পাতায় নামিয়ে আনার জন্য মনের সহায়তাটাই সবচেয়ে বেশি জরুরী। চার লাইন লিখতে গেলেও যে শান্ত মস্তিস্কের প্রয়োজন পড়ে সে কথা অনস্বীকার্য। সেই মনটাকেই বাবা-বাছা করে, ধরে বেঁধে কোনো ভাবেই সঠিক সুরে বাঁধা যাচ্ছে না কিছুতেই নানা কারণে। তাও খানিক জোর করেই সাম্প্রতিক দু চারটে ঘটনার কথা বলবার চেষ্টা করছি।   

*********************************************************************************


এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহে আমরা দুইজন দুই মাকে বগলদাবা করে বেরিয়ে পড়েছিলাম গাড়ওয়াল হিমালয়ের চেনা পথে। গন্তব্য দেরাদুন হয়ে মুসৌরী, সেখান থেকে ধনৌলটি হয়ে ঋষিকেশ-হরিদ্বার। একযাত্রায় পাহাড়ভ্রমণ আর তীর্থদর্শন। এবার মায়েরা সঙ্গী বলে আর কোনো অনিশ্চয়তা নয়। ট্রেন, হোটেল সবকিছু দুমাস আগে থেকে ঠিকঠাক করে রাখা।নির্দিষ্ট দিনে শুধু 'জয়্মা' বলে চারজনে বেরিয়ে পড়া গেল। যাবার পথে বিশেষ কোনো ঘটনা ঘটেনি। কিন্তু একটি ঘটনা না বলে থাকতে পারছি না সেটা ঘটলো মেট্রো স্টেশনে।

কয়েক মাস আগে দিল্লীর একটি বিয়েবাড়ি সেরে ফেরার সময় আমাদেরই এক সহকর্মী একটি খুব সুন্দর কথা বলেছিল। এই সুযোগে কথাটিকে এখানে উল্লেখ করার লোভ সামলাতে পারছি না। সন্ধ্যের মেট্রো স্টেশন। ভিড়ে ভিড়াক্কার। সকলেই চাইছে সকলের আগে বেরিয়ে যেতে। মনে হচ্ছে এটাই দিনের শেষ মেট্রো। এর পর আর কেউ বাড়ি পৌঁছতে পারবে না সেদিনের মত। এই ছুটন্ত জনস্রোতের মাঝে ধীরে সুস্থে মেট্রো স্টেশনে নেমে ছেলেটি বলল, "ইয়াহি এক চিজ হ্যায় জিন্দেগিমে জিসকে পিছে ভাগনা নেহি পড়তা। এক চলে যায় তো যানে দো, নেক্সট তো আ হি যায়েগা।" -কি দার্শনিক কথা! দিল্লি মেট্রোর বিজ্ঞাপন হিসেবেও দারুন ভাবে চালিয়ে দেওয়া যায় কথাটিকে। যাই হোক সেদিনও সন্ধ্যের সেই মেট্রো স্টেশনটিকে দেখে এই দার্শনিক কথাটিই ভাবতে ভাবতে এগোচ্ছি। এমন সময় দেখি স্টেশনে ঢোকার মুখে বেশ কিছু চেনা মুখের মানুষ বসে থাকেন, স্টেশনই যাঁদের ঘরবাড়ি, এরকম প্রত্যেকটি মানুষের হাতেই কয়েকটা করে মোটা মোটা রুটি আর তার ওপরে খানিকটা করে আলুর তরকারী। একটু অবাক হলাম। সকলের হাতেই একই খাবার, একই রকম ভাবে নেওয়া, একই পরিমাণে? কি ব্যাপার? প্রশ্নের উত্তর পেলাম একটু বাদেই। ভিড় ঠেলে স্টেশনের দিকে একটু এগোতেই চোখে পড়ল আমাদেরই বয়সী বা হয়ত বয়সে আমাদের থেকে খানিক ছোটই হবে দুটি ছেলে মেয়ে, চোখে মুখে উত্তর-পূর্বের ছাপ স্পষ্ট। হয়ত কাছাকাছি কোথাও পড়াশুনা বা জীবিকার প্রয়োজনে থাকে। মেয়েটির হাতে প্লাস্টিকের প্যাকেটে একগোছা রুটি। আর ছেলেটির হাতে প্লাস্টিকের প্যাকেটে বেশ খানিকটা তরকারী। অন্য হাতে একটি বড় চামচ। সিঁড়ির সামনে বসা বাকি চার-পাঁচ জনকে রুটি-তরকারী দিচ্ছে। এবং এই দেওয়া যে কোনো একদিনের হঠাৎ দেওয়া ঘটনা নয়, প্রাত্যহিক বা অন্ততপক্ষে অত্যন্ত প্রত্যাশিত একটি ব্যাপার সেটি দাতা এবং গ্রহীতাদের পারস্পরিক দৃষ্টি আর হাসি বিনিময় এবং দুপক্ষেরই শরীরী ভাষায় স্পষ্ট। আমরা পৌঁছাতে পৌঁছাতে এই চারপাঁচ জনকে খাবার দেওয়া শেষ করে ছেলে মেয়ে দুটি চলল স্টেশনের উল্টোদিকে বসা বাকিদের খাবার দিতে।

স্পষ্টতই বোঝা যাচ্ছে কোনো দোকানের সাথে ব্যবস্থা করা আছে এই ছেলে মেয়ে দুটির। সেখান থেকে বানানো রুটি তরকারী নিয়ে (কোনো মতেই এগুলি বাসি বা ফেলে দেওয়া খাবার বলে মনে হয়নি আমার) এরা মাঝে মাঝেই হয়তবা প্রতিদিনই অন্তত দশ বারো জন লোকের রাতের খাবারের বন্দোবস্ত করেছে। কিছুক্ষণ ধরে ব্যাপারটি ভাবার পরে মনে হলো আমি তো পারিনি কোনো একজনের দিনের একবেলা খাবারের দায়িত্ব নিতে। হঠাৎই কিরকম লজ্জা করতে লাগলো আমার। উত্তর-পূর্বের মানুষদের সম্পর্কে ব্যাঙ্গাত্মক কত মন্তব্য শুনেছি কলকাতায় থাকাকালীন। সেই অঞ্চলেরই দুজন মানুষ আজ চোখের সামনে হু হু করে কত উঁচুতে উঠে গেল দেখে মন ভরে গেল। মুগ্ধ চোখে দেখতে থাকলাম গোলাপী জামা পরা মেয়েলি একটি হাতে রুটির গোছা আর অন্য হাত ধরা পুরুষালি একটি হাতে, যে পুরুষের অন্য হাতে ধরা এক প্যাকেট ভর্তি তরকারী। আস্তে আস্তে মিশে যাচ্ছে সন্ধ্যের মেট্রো স্টেশনের ভিড়ে। এগিয়ে যাচ্ছে উল্টোদিকের সিঁড়িতে বসে থাকা আরো কতগুলি প্রত্যাশী মুখের দিকে। ছোটো হতে থাকা নিজেকে লজ্জায় কুঁকড়ে নিয়ে ভিড়ে লুকিয়ে ফেলা ছাড়া আর কিছু করার ছিল না আমার।

আমাদের চার দিনের গাড়ওয়াল হিমালয় ভ্রমণ শুরু হল এরকম করে।     

Monday 20 April 2015

সকাল

মিটমিটে হলুদ রং হয় বুঝি বিষণ্নতার
তখন হাওয়াতেও বুঝি স্তব্ধতার গতি
জঙ্গুলে ঘন অন্ধকারে তাকিয়ে থাকতে থাকতে
বেতাল মন কেবলি সমন্বয়ে আসার চেষ্টা করে চলে
নিরন্তর।

মধ্যরাতে নিরর্থক ক্লান্ত চোখে নেমে আসে
ঘুমের অনিবার্যতা
পরদিন আবার সকাল।
তারপরদিন আবারও
ভোরের পর ভোর আলো ছড়িয়ে যায়
নিজের নিয়মেই।

শুধু আমারই আজও কি করে যেন
রাত কাটিয়ে সকাল হয়ে ওঠা আর হয়ে ওঠে না।    

Thursday 16 April 2015

নববর্ষ

আপাতত এই বছরের নববর্ষটা বিশেষ শুভ বলতে পারছিনা। কারণ আবার আমাদের অন্ধকার বন্ধ বাড়িতে চাবি খুলে ঢুকতে হচ্ছে আবার আমাদের খিদে বোধ ফিরে এসেছে (এর আগের দুই সপ্তাহ খিদে পাবার আগে হাঁ করলেই মুখে টপাটপ সুখাদ্যের বর্ষণ হচ্ছিল)আবার আমাদের সকালে উঠে একা একা ফাঁকা ঘরে ঘুরঘুর করতে হচ্ছে আবার আমাদের সন্ধ্যেবেলায় ইন্টারনেট মুখে করে সময় কাটাতে হচ্ছে........ইত্যাদি ইত্যাদি। ব্যাপারটা আর কিছুই নয় দিন কুড়ি আমাদের মতন দুই অপগন্ডকে নাইয়ে-ধুইয়ে-গান্ডেপিন্ডে খাইয়ে-পরিস্কার জামাকাপড় পরিয়ে আরো একশরকম বায়নাক্কা সামলে খাটতে খাটতে পনেরো দিনে সাড়ে পনেরো শতাংশ রোগা হয়ে গিয়ে অবশেষে এই নববর্ষের ঠিক আগের দিনেই দুইজনের দুই মা বাড়ির দিকে ইঞ্জিনের মুখ করে রাখা রাজধানীর সিটে গিয়ে বসে হাঁপ ছেড়ে বেঁচেছে। আর আমরা তাদের সিটে বসিয়ে দিয়ে এসে সামনের দশদিনের জন্য তাদেরই তৈরী ফ্রিজ বোঝাই করে রেখে যাওয়া খাবার দাবার বের করে খাচ্ছি আর ফোঁসফাঁস দীর্ঘশ্বাস ফেলছি আর ভাবছি ঘরদোর জামাকাপড় বেশ পরিস্কার-পরিষ্কার লাগছে। কিছুদিন চলে যাবে হাত-পা না নাড়িয়েই। তারপর যাক গে বসে বসে আঙ্গুল চোষা ছাড়া গতি নেই। আসলে ঘোড়া যখন থাকেনা থাকেনা হেঁটেই দিন চলে যায়। কিন্তু একবার ঘোড়ায় চড়া অভ্যেস হয়ে গেলে পর আর দুই পা হাঁটতে গেলেই ঘোড়ার অভাব বোধ হয়। তাই এই নববর্ষটা ব্যাজার মুখে শুরু হয়েছে। আর তাই হয়ত আগের সব নববর্ষগুলো বেশি বেশি করে মনে পড়ছে। 

কুঁচো বয়সে যখন মায়ের বাধ্য ভদ্র বাচ্চা ছিলাম তখন নববর্ষের বেশ একটা উত্সব উৎসব ব্যাপার অনুভব করতে পারতাম। সেটা সাদা মনের অমলিন উৎসবের প্রভাবেই হোক বা অন্য কোন কারণে। একটা কারণ অবশ্যই ছিল এই যে, নববর্ষের ঠিক আগেই শেষ হয়ে যেত বার্ষিক পরীক্ষা। পরীক্ষার খাতায় কতটা হাবিজাবি আর কতটা ঠিকঠাক লিখে এসেছি সেটা বাড়িতে প্রকাশ পাবার এবং জীবনে ভয়ানক দুর্যোগ নেমে আসার জন্য আরো প্রায় দুই সপ্তাহ বাকি থাকতো। সুতরাং 'সখের প্রাণ গড়ের মাঠ'। তার ওপরে আবার বাংলা নববর্ষে নতুন জামা। সে জামা বুকে কমলা সুতোর দিয়ে হাঁস আঁকা সাদা সুতির টেপফ্রক থেকে শুরু হয়ে আমার বয়সের বয়সের সাথে সাথে বিবর্তিত হতে হতে দুই কাঁধে ফিতে বাঁধা সুতির ফ্রক, তারপর সুতির স্কার্ট-ব্লাউজ হয়ে বর্তমানে শালওয়ার-কামিজে এসে ঠেকেছে। সে জামা যেমনই হোক সেটি কেনার সময় দুটি অবশ্য মান্য বিষয় হলো-জামাটিকে অতি অবশ্যই সুতির কাপড়ের তৈরী হতে হবে এবং রংটি গরমে পরার উপযুক্ত, চোখের পক্ষে আরামদায়ক হতে হবে। মানে এযাবৎকালে তাই হয়ে এসেছে আমার ক্ষেত্রে। সুতরাং বার্ষিক পরীক্ষার জুজুকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে কাটিয়ে আসার পরে উপরি হিসেবে নতুন একখানা জামা পেয়েও যদি পয়লা বৈশাখে উত্সব না হয় তবেই বরং আশ্চর্যের বিষয় হত। হাঁস আঁকা টেপজামা বা দুই কাঁধে ফিতে বাঁধা ফ্রক পরার আমলে অবশ্য পয়লা বৈশাখে জামাটা আমার একার জন্যেই আসছে, নাকি মা বাবারও নিদেন পক্ষে একটা ব্লাউজ বা লুঙ্গি গোছের কিছুও দোকান থেকে এসে পৌঁছোচ্ছে কিনা সে বিষয়ে নজর পড়তনা আমার। পরে ঘটি হাতা ফ্রক বা স্কার্টব্লাউজ পরার সময় থেকে এবিষয়ে নজর পড়তে শুরু করলো। আর কোনো বছরে আর্থিক কারণে আমার একার জন্য দোকান থেকে জামা এলে "আমার একার কেন নিয়ে এলে? আমার অনেক জামা আছে, আর চাইনা"-ইত্যাদি বৃথা চেঁচামেচি করা ছাড়া আর আমার কিছু করার না থাকায় ব্যাজার মুখে বিকেল বেলা নতুন জামা পরে খেলতে যেতাম। এবং নতুন জামার কল্যানে সেদিন খেলায় আছাড় খাওয়া বা কাটাছেঁড়ার পরিমাণটা খানিক কম হত। মাঝে মধ্যে অবশ্য না পরে রেখে দেওয়া আগের বছর পুজোয় পাওয়া কোনো সুতির ছাপাশাড়ি ম্যাজিকের মতন বের করে মা বলত এই দেখ আমার নতুন শাড়ি। আর বাবা "আমি এই ঘামে গরমে সাইকেলে করে বাজার দোকান যাই টাই, আমার আর নতুন জামা কি হবে? অনেক জামা আছে, রোদে ঘামে নষ্ট হয়ে যাবে"- এইসব ভুজুং দিয়ে আমায় ঘুরিয়ে দিত। অনেক পরে অবশ্য তিন জনেরই কিছু না কিছু আসতো পয়লা বৈশাখ উপলক্ষ্যে। 

আর একটি জিনিস সে বয়সে কি করে যেন মাথায় ঢুকে গেছিল, মা-ই ঢুকিয়েছিল নির্ঘাত, সেটা এই যে, বর্ষশুরুর দিনে সক্কাল সক্কাল উঠে ভালো মেয়ের মতন পড়াশুনা করতে হয় তাহলে সারাবছর ভালো পড়াশুনা হয় (তখন থেকেই লেট রাইজার মেয়েটাকে একদিন অন্তত ভোর ভোর ঘুম থেকে তোলার চেষ্টা আর কি)। আর দূরদর্শনের সে জমানায় একটি উত্সাহ বড়দের মধ্যে ছিল সেটি হলো নববর্ষের বৈঠক। সেটি এবছর কোথায় হচ্ছে মেট্রো রেল এ, নাকি গঙ্গাবক্ষে বজরায়, নাকি অভিনব অন্য কোনোখানে এবং কোন কোন বিদগ্ধজন এ বছর সেই বৈঠকে আছেন সেটি নিয়ে বিশেষ গবেষণা হতে দেখতাম। আমাদের বাড়িতে সকালে টিভি খোলা হত বছরে মাত্র দুটি দিন। মহালয়ার দিন আর নববর্ষের দিন। নববর্ষের সকালে উঠে টিভিতে সকলে নববর্ষের বৈঠকে গান-কবিতা-আলোচনা শুনত। আর আমাকেও সেখানে বসিয়ে রাখার চেষ্টা করা হত। কিন্তু বিশ্বাস করুন আমার একটুও বসে থাকতে ইচ্ছে করত না। খুব খারাপ লাগত অনুষ্ঠানটা। কারণ যে সময়ের কথা বলছি সে সময় অনুষ্ঠানে একটা নাচ অন্তত না থাকলে সে অনুষ্ঠান আমার কাছে নিতান্তই অর্থহীন লাগত। মনের ভাবটা এরকম থাকত যে-অন্য দিন টিভির কাছে বসার অনুমতি বিশেষ পাওয়া যায়না। সেই অনুমতি যখন পাওয়া গেছে (উপরন্তু ডেকে ডেকে টিভি দেখতে বলছে! এ তো অবিশ্বাস্য ব্যাপার!) তাও আবার সকাল বেলা যখন নাকি ঘুম কাটতে না কাটতেই পড়তে বসাটাই ভালো বাচ্চার লক্ষণ তখন এইসব বকবকানি শুনতে হবে বসে বসে কি যে সময়ের অপব্যবহার! আমি বসে বসে দুধ আর মারি বিস্কুট খেতাম আর অপেক্ষা করতাম যদি ভুল করেও একটা নাচের অনুষ্ঠান থেকে থাকে এই বৈঠকে সেই আশায়। এরপর খানিক বাদে মা বাবা যে যার কাজে উঠে পড়লে আমার ও সে আশায় জল পড়ে যেত। আমাকেও দুধের গ্লাস নামিয়ে রেখে বই-এর ব্যাগ খুলে বসতে হত। আসলে বেশ খানিকটা সাজুগুজু করে রবীন্দ্র সঙ্গীতের সাথে লীলায়িত ভঙ্গিতে নাচ ব্যাপারটা আমার বড়ই লোভের জিনিস ছিল। তার একটা কারণ এখন আমার মনে হয় এই যে, আমি কোনো দিন নাচ শিখিনি। কিন্তু অনেক ছোট থেকে গান টান গাওয়ানোর একটা চেষ্টা করা হয়েছিল আমার ওপর। যার ফলে এদিক ওদিকের অনুষ্ঠান নাচ-গানের যৌথ স্কুল ইত্যাদির কল্যানে বন্ধুবান্ধবদের ছোটো থেকে নাচতে দেখেছি। আর বর্ষবরণ বা পঁচিশে বৈশাখ জাতীয় পাড়ার অনুষ্ঠানে আমি যখন সাদা ফ্রক পরে দুপাশে ঝুঁটি বেঁধে সাত সন্ধ্যেবেলা ফাঁকা আসরে খানিক প্যাঁ প্যাঁ করে গলাবাজি করে নেমে আসতাম তখন বন্ধুরা কেমন ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে শাড়ি টাড়ি পরে, মাথায় ফুল, কাজল, লিপস্টিক, টিপ, চুড়ি ইত্যাদি প্রভৃতিতে ঝলমলিয়ে মঞ্চ দাপিয়ে নাচতো। আর আমি জুলজুল চোখে নিচ থেকে দেখতাম। সেই থেকেই বোধহয় আমার নৃত্যপ্রীতির সূচনা। 

তার কিছুবছর পরে শুরু হলো বৈশাখের অবশ্য পালনীয় আর একটি অনুষ্ঠানের জন্য মহড়া। পঁচিশে বৈশাখ। পয়লা বৈশাখ থেকেই পাড়ার বড় দাদা দিদিরা আমাদের চুনোপুঁটির দলকে নিয়ে তালিম দেওয়া শুরু করত। পয়লা বৈশাখ থেকেই কেন শুরু করত কে জানে? বছরের শুরুতে বাচ্চারা ভালো শিখতে পারে নাকি টিচারদের ঐদিন মাথা ঠান্ডা থাকে? তারা না পারলে বকুনির বহরটা খানিক কম থাকে? তারপর যত বছর পুরনো হতে থাকে ততই টিচারদের মাথার তাপমাত্রা বাড়তে থাকে? কেজানে? মোটকথা পয়লা বৈশাখ থেকে শুরু হয়ে যেত পঁচিশে বৈশাখের মহড়া। কখনো কখনোবা একাধিক অনুষ্ঠানের মহড়া। পঁচিশে বৈশাখের এক দুই দিন এদিকে ওদিকে করে আশেপাশের পাড়ায় হত অনুষ্ঠান। কুশীলবরা সব মোটামুটি একই মুখ। সুতরাং অনুষ্ঠানের কিঞ্চিত বৈচিত্র থাকতে হবে বৈকি। সেসব অনুষ্ঠানে যে আমরা কিরকম কুশলতার পরিচয় রাখতাম সেসব বলতে গেলে একটা আলাদা ব্লগপোস্ট লিখতে হয়। মোটকথা বাংলা বছর শুরু হলেই বঙ্গদেশের বাকি সমস্ত অংশের মতই আমাদের পাড়াতেও সংস্কৃতিপ্রেম উদ্বেলিত হয়ে উঠতো। আমরা ট্যাঁপাটেঁপির দল ছিলাম সে সংস্কৃতি রক্ষা করার গুরুত্বপূর্ণ হাতিয়ার। একে পরীক্ষা শেষ বলে নিয়ম করে পড়তে বসার বালাই নেই তার ওপরে নতুন জামা। এর পরেও বলতে হবে কেন পয়লা বৈশাখ উত্সব ছিল? ছিল বলছি কারণ এখন এই পয়লা এবং দোসরা বৈশাখ আমি উপরোক্ত ভালো ভালো কাজ করার জায়গায় ল্যাবে বসে গবেষণা গবেষণা খেলছি আর ব্লগ লিখছি। কি আর করব-যখন যেমন তখন তেমন।



শুভ নববর্ষ। নতুন বছর সবার খুব ভালো কাটুক। সক্কলে খুব ভালো থাকবেন।  





Monday 13 April 2015

বিছানা-২

বিছানা-১ এর পর.......


জাগরী নিজের বিছানা পাতা সম্পর্কে একটু সচেতন। দিনের বাকি সবকিছুর ওপর বিশেষ নজরদারি না করলেও রাতের বিছানাটি পরিস্কার না হলে তার মন খুঁতখুঁত করে। কিছুটা পিটপিটেই সে বলবে নিজেকে এই ব্যাপারে। বেশ করে বিছানা ঝেড়ে ঝুড়ে তবে সে শোয় বিছানায়। কিন্তু একজন মানুষ নিজের বিছানাটা যে কতখানি আদর করে তৈরী করতে পারে সেটা দেখা বাকি ছিল জাগরীর। স্টেশনই যাঁর রাতের ঠিকানা সেরকম এক বৃদ্ধার রাতের বিছানা তৈরী হতে দেখল সে রাতের ট্রেনের জন্য অপেক্ষা করতে করতে।

বৃদ্ধা মাথা-পিঠ-কাঁধের বোঝা নামিয়ে নিলেন একে একে। তারপর নিজের কাঁধের শুশ্রূষা চলল কিছুক্ষণ কাঁধে হাত ঘষে ঘষে। জাগরীর বেঞ্চের পাশের জায়গাটা মোটামুটি পরিষ্কারই ছিল। খাবারের দোকানের ডাস্টবিনের থেকে একটু দূরে ব্যাগগুলোকে পাশাপাশি রাখলেন বৃদ্ধা। মাথা থেকে নামানো নাইলনের ভারী ব্যাগটা থেকে বেরোলো একটা বহুলব্যবহৃত প্লাস্টিকের শিট, আর একটি ছোটো কাপড়ের টুকরো। কাপড়ের টুকরোটি দিয়ে বেশ করে মেঝেটা ঝেড়েঝুড়ে প্লাস্টিকের শিটটি পেতে ফেললেন বৃদ্ধা। তারপর এদিক ওদিক থেকে টেনেটুনে টানটান করে ফেললেন তাকে। এইটুকু ঘটনা ঘটতে অন্তত মিনিট পাঁচ-সাত সময় লাগলো। প্রতিটি ঘটনা অতি যত্নে সম্পন্ন হচ্ছিল ধীরে ধীরে। তারপর কাঁধ থেকে নামিয়ে রাখা কাপড়ের ব্যাগ থেকে বেরোলো একটি মোটা চাদর গোছের জিনিস। পিটপিটে চোখে লক্ষ্য করলো জাগরী সেটিতেও বেশ ব্যবহারের ছাপ। চাদরটিকে বের করে প্রথমে একটু দূরে নিয়ে গিয়ে ভাঁজ খুলে বেশ করে ঝেড়ে নিলেন বৃদ্ধা। তারপর ফিরে এসে প্লাস্টিকের শিটের ওপরে সুন্দর করে বিছিয়ে দিলেন। এবার হাতের পাতা বুলিয়ে বুলিয়ে চারিদিক থেকে সমান করছেন তিনি। এত যত্নে যে কেউ এই সামান্য বিছানা তৈরী করতে পারে তাই দেখতে দেখতে বিভোর হয়ে যাচ্ছিল জাগরী। সম্বিত ফিরলো মশার কামড়ে। ডানহাতের কনুই এর কাছে জব্বর কামড়েছে মশাটা। প্রতিবর্তে বাঁহাতটা দিয়ে চাপড় মেরেও লাভ হলো না। কনুই চুলকাতে চুলকাতে আবার নজর দিল জাগরী বৃদ্ধার রাত্রিকালীন সংসারের দিকে। 

ততক্ষণে চাদর বিছানো শেষ হয়েছে তাঁর। এবার ব্যাগগুলোর দিকে নজর দিলেন বৃদ্ধা। প্রথমে পিঠ থেকে নামিয়ে রাখা বস্তাটাকে বিছানার মাথার দিক মানে খাবারের দোকানের দেওয়ালের দিকে ঠেসে দিলেন। তার দুইপাশে বড় নাইলনের ব্যাগ আর কাপড়ের ব্যাগদুটোকে এমন ভাবে রাখা হলো যে একটা মাঝারি মাপের মাঝের দাঁড়িটা ছাড়া একটা ইংরাজির 'ই' তৈরী হয়ে গেল। ব্যাপারটা ঠিক বোধগম্য হচ্ছিলো না জাগরীর। এতে করে তো বিছানার প্রায় অর্ধেক অংশই ভরে গেল ব্যাগ রেখে।শোবার জায়গা কই? তার চেয়ে ব্যাগগুলো মাথার কাছে সারি দিয়ে রাখলেই তো ভালো হত। দোকানের দেওয়াল থাকার জন্য নিরাপদও থাকত আর বেশ চওড়া শোবার জায়গাও পাওয়া যেত। নিজের মনেই হিসেব করছিল জাগরী। বৃদ্ধা ততক্ষণে চতুর্থ ছোটো ব্যাগটাকে 'দাঁড়ি ছাড়া ' -এর ঠিক মাঝখানে সুন্দর করে জায়গা করে দিয়েছেন। জাগরী ভাবছিল এবার ঠিক কতটুকু জায়গায় সারারাতের জন্য শোবেন বৃদ্ধা? তখনই তাকে অবাক করে দিয়ে বৃদ্ধা উঠে দাঁড়ালেন। তারপর মৃৎশিল্পী প্রতিমার চোখে তুলির শেষ টান দিয়ে একটু পিছিয়ে এসে যেমন করে মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে থাকেন নিজের সৃষ্টির দিকে তেমনি করে বৃদ্ধা নিজের বিছানার দিকে তাকিয়ে রইলেন কয়েক সেকেন্ড। সেই কয়েক সেকেন্ড জাগরীও বুঝি মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে ছিল এই স্রষ্টার দিকে। ভাবছিল এতক্ষণে বুঝি সারাদিনের শেষে বিশ্রাম নেবার সময় এসেছে তাঁর। 

কিন্তু না। ভারী নাইলনের ব্যাগটার চওড়া ফিতের ভার বহন করছিল বৃদ্ধার মাথার যে চাদরটি সেটি এতক্ষণে তাঁর হাতে উঠে এসেছে। আর ঠিক যেমন করে ঘুমন্ত বাচ্চার নড়াচড়ায় তার গা থেকে ঢাকা খুলে গেলে আদর করে ঢেকে দেন মা তেমনি করেই সেই চাদর দিয়ে তিনি পরম মমতায় ঢেকে দিচ্ছেন তাঁর চারটি ব্যাগ। তারপর চললেন প্ল্যাটফর্মের শেষ প্রান্তের দিকে। কি ব্যাপার! অবাক হল জাগরী। এত যত্ন করে তৈরী করা শয্যা ফেলে এত রাতে চললেন কোথায়? তার যাওয়ার পথের দিকে ভ্রূ কুঁচকে তাকিয়ে রইল জাগরী। তখনি সে সচকিত হলো তার ট্রেনের ঘোষণায়। আগের তিন চারটি ট্রেন প্ল্যাটফর্ম ছেড়ে চলে যাওয়ায় এতক্ষণে তার ট্রেনের ঘোষণা হচ্ছে। চটপট ইলেকট্রনিক বোর্ডে তাদের কামরার সম্ভব্য অবস্থান দেখে নিলো জাগরী। কুলিদেরকে জিজ্ঞাসা করে ঠিক জায়গাতেই বসেছে তারা। তার বেঞ্চের থেকে দশ-বারো পা ডানদিকে এগোলেই বি-সিক্স কোচ এর বোর্ড জ্বলজ্বল করছে। ঠিক আছে, ট্রেন ঢুকতে এখনো মিনিট দশেক দেরী আছে। বসেই থাকে জাগরী। একবার চাদরে ঢাকা পরিপাটি বিছানা আর ব্যাগগুলিকে দেখল সে। তখনি মনে হলো বৃদ্ধা গেলেন কোথায়? বাঁ-দিকে তাকিয়ে দেখতে পেল ক্লান্ত পায়ে ফিরছেন বৃদ্ধা। হাতে কি? ভালো করে ঠাহর করতে করতেই বৃদ্ধা তার সামনে দিয়ে নিজের বিছানার কাছে পৌঁছে গেছেন। হাতে তাঁর কয়েকটা ভাঁজ করা মোটা কাগজের কার্টন। স্টেশন চত্ত্বরের ফলের দোকান-টোকানের হবে। কৌতুহলী হলো জাগরী। এটা কি হবে? বিছানার ঢাকা সরিয়ে বস্তাটির মুখ খুললেন বৃদ্ধা। তারপর কার্টনগুলোকে ভাঁজে ভাঁজে ছিঁড়ে সাইজ অনুযায়ী থাক দিয়ে গুছিয়ে নিলেন তিনি। জাগরীর মনে পড়ল ছোটোবেলায় সে ঠিক এই ভাবেই নিজের হেপাজতের কয়েকটা বই সাইজ অনুযায়ী নিচ থেকে ওপরে গুছিয়ে রাখত সে। বর্ণপরিচয় আকারে সবার চেয়ে ছোটো তাই সেটা সবচেয়ে ওপরে আর পৃথিবীর মানচিত্র বইটা আকারে আয়তনে সবচেয়ে বড় তাই সেটা সবচেয়ে নিচে। আর মাঝখানে বাংলা-ইংরাজি ছড়ার বই, ছোটদের রামায়ণ, ছবিতে ইতিহাস, মনিষীদের ছেলেবেলা ইত্যাদি আরো যা যা সেই সময়কার গুরুত্বপূর্ণ এবং দৈনিক পাঠ্য বই বলে তার সেই চার পাঁচ বছর বয়সে মনে হত সেগুলোকে তার অ্যালুমিনিয়ামের বাক্সে ঠিক এরকম ভাবেই গুছিয়ে রাখত সে। তার মা-ই তাকে এই অভ্যাসটি তৈরী করে দিয়েছিলেন। অনেক পুরনো দিনের সেই স্মৃতিটি ফিরে এলো তার সেই এই বৃদ্ধার কাগজের কার্টনের টুকরো গোছানো দেখে। বৃদ্ধা এইবার বস্তার মধ্যে সেই টুকরোগুলো কে ঢোকাতে থাকেন। বস্তার ভেতরে শুধুই এরকম কার্টনের টুকরোতে ভর্তি। কি হবে ওগুলি দিয়ে? জ্বালানি? চারটি ব্যাগে যিনি পুরো সংসার নিয়ে ঘুরে বেড়ান তাঁর কি জ্বালানির প্রয়োজন আদৌ হয় কখনো? মনে তো হয় না। স্টেশনই যে তাঁর ঘরবাড়ি সে বিষয়ে অন্তত আশিভাগ নিশ্চিত জাগরী। তাহলে কি বিক্রি? কিন্তু ছেঁড়া টুকরো কারা কেনে? এ বিষয়ে আর বিশেষ গবেষণা করতে পারল না জাগরী। কারণ টুকরোগুলি বস্তায় ঢুকিয়ে, বস্তার মুখ বেঁধে, নিজের পায়ের জুতোটিকে কাপড়ের ব্যাগের তলায় চালান করে, সবচেয়ে ছোট ব্যাগটিকে কোলে করে বাকি দুটি ব্যাগ আর বস্তা দিয়ে তৈরী করা 'দাঁড়ি ছাড়া ইংরাজির ই'-এর খোঁদলে ঢুকে গেছেন ততক্ষণে বৃদ্ধা। আর জাগরীর দলের বাকি সকলেও হাতে পিঠে ব্যাগ-ট্যাগ নিয়ে ততক্ষণে উঠে দাঁড়িয়েছে। অগত্যা তাকেও ব্যাগ পিঠে নিয়ে উঠে দাঁড়াতে হয়। আস্তে আস্তে এগিয়ে যায় ডিজিটাল বোর্ডে 'বি-সিক্স' লেখাটির তলায়। আর ঠিক তখনিই জাগরীর চোখে পড়ে ঘটনাটা।

দুই নম্বর প্ল্যাটফর্ম ধোয়া শেষ করে কখন যেন রেলের সাফাইকর্মীর দলটি এই এক নম্বর প্ল্যাটফর্মের দিকে চলে এসেছে। তাদের হুইসিল আর লম্বা লাঠির ঠেলায় দূরের দিকে চাদরমুড়ি দিয়ে শুয়ে থাকা সারি সারি মানুষের দল ঘুমচোখে ধড়মড়িয়ে নিজেদের সম্বলটুকু সামলে উঠে পড়ছে জায়গা ছেড়ে। পিঠের ব্যাগ আর জলের বোতল সামলে চট করে পিছন ঘুরে বৃদ্ধার দিকে তাকায় জাগরী। ছোটো চাদরটা গায়ে টেনে গুটলী পাকিয়ে এতক্ষণে স্বস্তিতে শুয়ে পড়েছেন তিনি সারারাতের নিশ্চিন্ততায়। জাগরী আবার তাকায় সাফাই কর্মীদলটির দিকে। দানবীয় হোসপাইপ, বড় বড় ওয়াইপার, বড় লাঠির ডগায় বাঁধা ঝাঁটা আর হুইসিল নিয়ে ছয় আট জনের দলটি যেন দস্যুদলের মতই হামলা চালিয়েছে শুয়ে থাকা মানুষগুলির দিকে। ক্রমশই এগিয়ে আসছে এইদিকে হোসপাইপে জল ছেটাতে ছেটাতে। এদিকে তার ট্রেন ঢুকছে প্ল্যাটফর্মে আস্তে আস্তে। কয়েকসেকেন্ড ট্রেনের আগমন আর সাফাইকর্মীর দলটির ওপর চোখ বুলিয়ে ফের পেছনে তাকালো জাগরী। এতক্ষণে হুইসিলের আওয়াজ কানে গেছে বৃদ্ধার। উঠে পড়েছেন তিনি। অবিশ্বাস্য ক্ষিপ্রতায় এবং অবিশ্বাস্য মনোসংযোগে একে একে ভাঁজ করছেন চাদর, প্লাস্টিক শিট। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে সেসব যেখান থেকে বেরিয়েছিল সেখানে আবার ঢুকে গেল। নিজের চোখে দেখেও জাগরীর বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছিল পাতার সময় কত মমতায়, কত যত্ন নিয়ে, কত সময় নিয়ে এই বিছানাটি পেতেছিলেন বৃদ্ধা। কয়েক মুহুর্তেই সমস্ত কিছুর উল্টো চলচ্চিত্র অনুষ্ঠিত হতে দেখল জাগরী। ফের পিঠে বস্তা, মাথায় ভাঁজ করা চাদর, সেখান থেকে নাইলনের ফিতে দিয়ে ঝুলিয়ে নেওয়া হলো ভারী নাইলনের ব্যাগটা, কাঁধে উঠে গেল কাপড়ের ব্যাগটা, তার গর্ভে এখন চালান হয়েছে পেতে রাখা মোটা চাদরটা আর প্লাস্টিকের শিট, মাথায় ছোটো ব্যাগ। 

জাগরীদের ট্রেন ততক্ষণে প্ল্যাটফর্মে থেমেছে। সকলের সাথে ট্রেনের দরজা দিয়ে ওঠবার সময় দেখল সে বৃদ্ধা বিড়বিড় করতে করতে হাঁটা লাগিয়েছেন তার পাশ দিয়েই। ট্রেনের থামতে যাত্রীদের কথাবার্তায় তাঁর বিড়বিড়ানি আর কান অবধি পৌঁছালো না জাগরীর। ট্রেনে উঠে নির্দিষ্ট সিটের দিকে যেতে গিয়ে এসি কম্পার্টমেন্টের জানালা দিয়ে চোখে পড়লো তাদের বসে থাকার জায়গার চারপাশটা জলে জলময়। বড় বড় ওয়াইপার চলছে সেখানে। শুধু নির্দিষ্ট সিটে পৌঁছে ব্যাগ ঠিকঠাক করে রেখে তার কাঙ্খিত আপার বার্থে উঠে বিছানা পেতে কম্বল গায়ে টেনে শুতে গিয়ে অনুভব করলো জাগরী তার ক্লান্তিটা কি করে যেন বেমালুম উবে গেছে। ঘুমের লেশমাত্র নেই তার একটু আগে পর্যন্ত ঢুলে আসা চোখে। কব্জির ঘড়িতে তখন রাত ঠিক একটা।


(শেষ) 

Friday 10 April 2015

বিছানা-১


বারোটা উনিশস্টেশনের বড়সড় ডিজিটাল ঘড়িতে সময় দেখলো জাগরী সারাদিন টৈ টৈ করে ঘুরেছে সে। ঝকঝকে রোদে গরমটাও মোটামুটি ভালই টের পাওয়া যাচ্ছিলো। তখন তো নেশার মতন ঘুরে গেছে। এখন এই রাত বারোটা উনিশে স্টেশনের সিমেন্টের বেঞ্চে সোজা হয়ে বসে থাকতে থাকতে সারাদিনের ক্লান্তিতে শরীর ভেঙ্গে আসছে জাগরীর। হাই উঠছে। ঘুমে চোখ জ্বালা করছে। কিন্তু এখনো আধঘন্টা মতন এই যন্ত্রনা ভোগ করতে হবে তাকে। সেই একটা নাগাদ ট্রেন ছাড়বে। বারোটা পঞ্চাশ এর আগে তো নিশ্চয়ই ট্রেন ঢুকবে না স্টেশনে। টার্মিনাল স্টেশন না হলে এই এক ঝামেলা।বসে থাকো পিঠ সোজা করে কখন ঢুকবে ট্রেন। তাও ভালো শেষ মুহুর্তে বুকিং হলেও এসি তে আপার বার্থ পেয়ে গেছে সে। ট্রেন ঢুকলে শুধু ট্রেনে উঠে চাদর পেতে কম্বল মুড়ি দিয়ে শুয়ে পড়তে পারলেই হলো। ট্রেন চলতে শুরু করলে তার আর কোনো অসুবিধা হয়না ঘুমোতে। অনেকের ট্রেনে ঘুম না হলেও জাগরীর কোনো অসুবিধা নেই ট্রেনের দোলানিতে বরং ঘুমটা তার ভালোই হয়। আর আপার বার্থ হলে তো কথাই নেই। কেউ বিরক্ত করার নেই। যতক্ষণ ইচ্ছে ঘুমোলেই হলো। পাহাড়ে বেড়াতে এলে একটা সমস্যা হলো এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় যেতে হলে গাড়িতে ঝিমিয়ে নেওয়া যায়না একটুও। কেবলই পাহাড়ি বাঁকে বাঁকে চলতে চলতে এদিক ওদিক হেলে পড়তে হয়। ফলে তিন চার দিনের ছুটিতে তিন চার জন মিলে পাহাড়ে এসে প্রতিদিনই সকালে চোখ খুলেই দৌড়-দৌড়-দৌড়। তিন চার দিনে এনার্জি একদম তলানিতে ঠেকেছে জাগরীর। তাও স্টেশন থেকে দু মিনিটের হাঁটাপথের দূরত্বে হোটেল পেয়েছিল তারা। ফলে রাত দশটায় হোটেলে ফিরে বারোটা পর্যন্ত বিছানায় পড়ে ছিল সে। সকলে তৈরী হতে ঘুম চোখে বারোটায় বেরিয়ে এসেছে ব্যাগ ঘাড়ে করে রাত একটার ট্রেন ধরতে। এত রাতের ট্রেনের জন্য অপেক্ষা করতে গিয়ে ঢুলে পড়তে পড়তে সামলে নিলো নিজেকে। জেগে থাকার জন্য এদিক সেদিক তাকাতে শুরু করলো জাগরী। এত রাতে স্টেশন চত্বর প্রায় ঘুমন্ত। তবে রাতের শিফটে যাঁদের কাজ করার কথা তাঁরা ঠিকই করছেন নিজেদের কাজ। স্টেশনে ঢোকার সময় অটোওয়ালারা নিয়ম মাফিক জিজ্ঞাসা করেছে তাদের অটো লাগবে কিনা, তারপর স্টেশনের মেন গেটের সামনে চলছে বালি সিমেন্টের কাজ। সকালে যাত্রী চলাচলের ভিড়ে মূলরাস্তায় সিমেন্টের কাজ করা দুইপক্ষের জন্যই অসুবিধাজনক। এত রাতে যে কোনো রাজমিস্ত্রী কাজ করেন চাক্ষুষ দেখা হয়ে ওঠেনি কোনদিন। আজ দেখলো দুজন রাজমিস্ত্রী মন দিয়ে সারাচ্ছে স্টেশনের ঢোকার মূল রাস্তাটা। স্টেশনের দুই নম্বর প্ল্যাটফর্ম ধোয়াধুয়ী চলছে বড় বড় জলের পাইপ আর ওয়াইপার দিয়ে। একটিমাত্র চায়ের ষ্টল খোলা তাদের এই একনম্বর প্ল্যাটফর্মে। স্টেশন ম্যানেজার বা অন্য অন্য অফিসগুলিতেও রাতের শিফটের কাজ চলছে। আসলে এ রাস্তায় এই স্টেশনটি বেশ গুরুত্বপূর্ণ। এই পাহাড়ের সমস্ত পর্যটনস্থান বা তীর্থস্থানের সমস্ত যাত্রীকেই পাহাড়ের ঠিক নিচে অবস্থিত এই স্টেশনটি হয়েই যেতে হয়। সুতরাং যাত্রী চলাচলের বিরাম নেই এ স্টেশনে। তারই মধ্যে স্টেশনচত্বরে যে যার মতন ব্যবস্থা করে ঘুমোচ্ছে সারি সারি মানুষ। সেখানে মাঝরাতে ট্রেন থেকে নামা ভোরের অপেক্ষায় থাকা পর্যটক, তীর্থযাত্রীও যেমন আছে তেমনি আছে স্টেশনই যার ঘরবাড়ি এমন বেশ কিছু মানুষ। একই সাথে পরপর সারি দিয়ে চাদর কম্বল মুড়ি দিয়ে শুয়ে আছে সকলে। যতক্ষননা চাদর থেকে মুখ বের হচ্ছে ততক্ষণ বোঝার উপায় নেই কে অ্যাডভেঞ্চার লোভী বিদেশী ট্রেকার, কে ভারতবর্ষের দূর গ্রাম থেকে তীর্থ করতে আসা বয়স্ক দম্পতি আর কেই বা নিতান্ত নিরুপায় হয়ে অন্য কোথাও ঠাঁই না পাওয়া স্টেশনে ঘুমোতে আসা ভবঘুরে। পাশে রাখা ব্যাগ ব্যাগেজের ধরন আর ওপরের চাদর বা কম্বলের রোঁয়া কতটা উঠেছে তা দেখে কিছুটা আন্দাজ করা যায় মাত্র। তাই দেখছিল জাগরী।

তার বসার বেঞ্চের ঠিক পাশেই বন্ধ হয়ে যাওয়া একটা খাবারের দোকান। আর তার ডাস্টবিন। ডাস্টবিনে বড় বড় ইঁদুরের ছুটোছুটি দেখছিল জাগরী। কি ক্ষিপ্রতায় ছোটো ছোটো খাবারের পড়ে থাকা টুকরোগুলো নিয়ে ছোটাছুটি করছে ইঁদুরগুলো। নানান রকম লোকজন যাতায়াত করছে প্ল্যাটফর্মে।বেশিরভাগই তাদের এই ট্রেনের যাত্রী বলে মনে হচ্ছে। তার মধ্যে বিশেষ একজনের দিকে নজর পড়ল জাগরীর। হয়ত পোশাক-পরিচ্ছদের দিক দিয়ে অন্য সকলের চেয়ে বেমানান বলেই তাঁর দিকে নজর গেল তার। দূর থেকে তারই দিকে এগিয়ে আসছেন রোগা ক্ষয়াটে চেহারার বৃদ্ধা। পরনে পাহাড়ী মহিলাদের মতই ছোটো ঝুলের সুতির ঘাগরা আর লম্বা ঝুলের ব্লাউজ, আর সবজে রঙের পাতলা ওড়না। মাথায় একটি রঙচটা চাদর ছোটো করে ভাঁজ করে মাথায় রাখা কারণ সেই চাদরটিই একটি নাইলনের ফিতের সাহায্যে ভার বহন করছে পিঠে রাখা একটি বড়সড় বস্তার। বস্তার ওপরে রাখা আরো একটি বিশাল নাইলনের ব্যাগ। মাথায় রাখা ছোটো আরো একটি ব্যাগ আর পিঠের বস্তার ওপরে রাখা নাইলনের ব্যাগটিকে ধরে রেখেছে বৃদ্ধার শীর্ণ ডানহাত। আর সেই ডানকাঁধ থেকেই ঝুলছে আরো একটি মস্ত বড় কাপড়ের ব্যাগ, যার আপাদমস্তক জিনিসপত্রে ঠাসা বলে মনে হলো জাগরীর। পাহাড়ী মানুষদের ফুসফুসের জোর বেশি হয় শুনেছে সে, কিন্তু তাবলে এই বয়সে চার-চারটে এই সাইজের ভারী ব্যাগ কি করে বৃদ্ধা বয়ে আনছেন বিস্ময়ের সাথে সেটিই লক্ষ্য করছিল জাগরী। সে নিজে এই কম বয়সে একটি মাত্র মাঝারি মাপের ব্যাকপ্যাক হোটেল থেকে স্টেশন পর্যন্ত বয়ে নিয়ে এসেই হাঁপিয়ে উঠেছে। আর পিঠ বা কাঁধের প্যাডিং জাতীয় নূন্যতম আরামের আয়োজন ছাড়াই তার চেয়ে অন্তত দেড়গুণ বেশি ভারী চারটে ব্যাগ একসাথে একজন বৃদ্ধা মহিলা কি করে বয়ে আনতে পারেন এই বিস্ময়টি থেকে চোখ সরিয়ে নিতে পারছিল না সে। তার বেঞ্চের ঠিক পাশেই খানিকটা ফাঁকা জায়গা। সেখানে এসে বৃদ্ধা একে একে নামালেন চারটে ব্যাগ। বৃদ্ধা যে এই চারটি ব্যাগ নিয়েই সর্বত্র যাতায়াত করেন সেটা ব্যাগ নামানোরও পারম্পর্য থেকেই বোঝা গেল। কোনো তাড়াহুড়ো ছাড়াই প্রথমে মাথার ছোটো ব্যাগটি নামালেন তিনি। তারপর কাঁধের কাপড়ের ব্যাগ তারপর পিঠের বস্তার ওপরে রাখা নাইলনের ভারী ব্যাগটি। সেটি নামাতে বেশ কষ্টই হলো বোঝা গেল বৃদ্ধার। সবশেষে নাইলনের ফিতে সহ বস্তাটা। বস্তাটি বিশেষ ভারী নয় বোধহয়। ঘুম তাড়ানো ছাড়া বিশেষ কিছু করার ছিলনা জাগরীর। ডানদিকে তাকিয়ে বৃদ্ধাকে আর তাঁর কার্যকলাপকে লক্ষ্য করতে লাগলো সে।  



        

Tuesday 31 March 2015

ধর্ম

আরো কত লিটার রক্ত লাগবে
অন্ধকারকে ধুয়ে মুছে সাফ করতে?

কলমে কালির রং ছিল কালো অথবা নীল
আজকে সে রং আবার রক্তে লাল।
কলমের মুখ দিয়ে চলেছে অবিরত রক্ত উদগীরণ।
আর কতদিন?

সুস্থ নির্ভয় নির্মল আকাশ
সে কি ক্রমশই স্বপ্ন কেবল?
অসুস্থ হিংসার নির্দয় ছুরি শান দিয়ে চকচকে।
অথচ তারই নাম নাকি ধর্ম।

সময় চক্রে ধর্মের মানেও বদলে চলে
সমস্ত শব্দের মতন।

ধর্ম মানে তো শুনেছিলাম ভালোবাসা মাত্র
সে বুঝি কোন পূর্বজন্মের স্মৃতি?
তাই হবে।

Sunday 29 March 2015

পরিচয়

কিছুদিন আগে একটি বৈজ্ঞানিক সম্মেলনে উপস্থিত থাকার সৌভাগ্য হয়েছিল। সেদিন অন্য একটি বিশেষ কারণে আমাদের চার পাঁচ জন ছাত্রছাত্রীর দলের সাথে সেই সম্মেলনে আমাদের ল্যাবের অন্যতম অপরিহার্য বন্ধু রাজেশও আমাদের সাথে ছিল। রাজেশের এই বৈজ্ঞানিক আলোচনা শোনার কোনো উত্সাহ ছিল না। তার কারণ হয়ত ওর এই আলোচনার বিষয় সম্পর্কে সম্যক ভাবে অবহিত থাকার কথা নয়। সেই পর্যন্ত পড়াশুনা করার সুযোগ জীবন তাকে দেয়নি। তার অনেক আগেই মিষ্টি স্বভাবের এই রাজস্থানী ছেলেটি আমাদের ল্যাবে আমাদের বিজ্ঞান বিজ্ঞান খেলায় সকলকে সাহায্য করার জন্য ঘর ছেড়েছে। সেদিনের সেই সম্মেলন মোটামুটি ভাবে ঘরোয়া সম্মেলনই বলা যায়। তাই সম্মেলনের বৈজ্ঞানিক কথাবার্তা শুরু হবার আগে সম্মেলনের সভানেত্রী ছোট্ট সভাঘরে উপস্থিত সকলকে নিজের নিজের পরিচয় এবং তিনি কোথায় কি কাজ করেন সে সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত আভাস দেবার প্রস্তাব রাখলেন। এবং সর্বসম্মতিক্রমে সে প্রস্তাব গৃহীতও হলো। যেহেতু সভাটি ছোট্ট তাই সেখানে উপস্থিত প্রথম সারির বৈজ্ঞানিক যাঁদের প্রায় প্রত্যেকেই চেনে এবং তাঁদের কাজকর্ম সম্পর্কে সকলেই কমবেশি ওয়াকিবহাল, তাঁরাও প্রথামাফিক নিজের নিজের পরিচয় দিলেন। ছাত্রছাত্রীরাও একে একে নিজেদের পরিচয় দিতে শুরু করলাম। অবশ্যই তা ইংরাজিতে। সমস্যাটা হলো তখন যখন পালাক্রমে পরিচয় দানের বিষয়টি আমাদের সারিতে এসে পড়ল। ব্যাপারটা আর কিছুই নয়। রাজেশ প্রথাগতভাবে এই সম্মেলনে একেবারেই বেমানান। কোথাওই কোনো সম্মেলনে রাজেশের মতন লোকেদের কোনো জায়গা হয়না। হয়ত তাঁরাও সেখানে উপস্থিত থাকার কোনো উত্সাহ পান না। পালাক্রমে রাজেশের পরিচয়দানের পালা যখন এলো তখন দেখলাম রাজেশকে টপকে আমাদেরই অন্য এক সহকর্মী নিজের পরিচয় দিচ্ছে। এবং অবশ্যই সেটা রাজেশের সম্মতিক্রমে। প্রথমত রাজেশ ইংরাজি ভাষায় নিজের পরিচয় দিতে অপারগ। আর দ্বিতীয়ত পদাধিকারগত ভাবে আমাদের মতন বিজ্ঞান গবেষক নয়, সহকারীমাত্র। সুতরাং সে নিজেই সকলের মাঝে দাঁড়িয়ে উঠতে চায়নি। আর তাতে পাশের বাকি বন্ধুরাও সায় দিয়েছে তাকে বিড়াম্বনা থেকে বাঁচাতে। বাকিরা নিজেদের মতন পরিচয় দিলেন। সভার কাজও যথাবিহিত সুষ্ঠ ভাবেই শেষ হলো। রাজেশ পুরো সময়টা নিজের মতন সিটে বসে ঝিমিয়ে নিলো। পরে সভা শেষে বাইরে বেরিয়ে চা-কফি পানের ফাঁকে তাকে জিজ্ঞাসা করা হলো যে সে ঠিক কি ধরনের কাজ করে তা তার বাড়ি লোকজন জানে কিনা? বা তার কাজ সম্পর্কে তার আশেপাশের লোকজন জানতে বা বুঝতে উত্সাহী কিনা? বা এত বছর এই ল্যাবে কাজ করে প্রতিনিয়ত সকলকে সব কাজে সাহায্য করে চলা এই মানুষটি নিজে বিষয়টি সম্পর্কে জানতে উত্সাহী কিনা? প্রত্যাশা মতই উত্তর এলো। সে যে একটি রিসার্চ ল্যাবরেটরিতে কাজ করে সেটি বাদ দিয়ে তার বাড়ির লোক বা আশেপাশের লোকজন বিশেষ কিছুই জানেন না। বা তার কাছেও কাজটি একটি জীবিকামাত্র। অত্যন্ত স্বাভাবিক একটি ঘটনা। 

রাজেশ আমাদের কাজে অত্যন্ত অপরিহার্য অঙ্গ। আমরা যেকোনো একজন ল্যাবে অনুপস্থিত থাকলে ল্যাবের কাজেকর্মে বিশেষ কোনো বিঘ্ন ঘটবে না। কিন্তু রাজেশ সপ্তাহখানেকের জন্য রাজস্থানে তার বাড়িতে চলে গেলে ল্যাবশুদ্ধু সকলের প্রায় নাভিশ্বাস ওঠার অবস্থা হয়। কিছুটা যদিও এই কারণে যে আমরা সকলেই এখানে এসেছি এই জায়গাটিকে নিংড়ে নিয়ে সিঁড়ির পরবর্তী ধাপটিতে পা রাখতে। আর সে এসেছে এই জায়গাটিকেই নিজের ভেবে যত্ন করে জড়িয়ে ধরতে। এর সাথে তার রুটিরুজির ব্যাপারটিও ওতপ্রত ভাবে জড়িত বলেই হোক বা না জানা অন্য কোনো কারণেই হোক, হয়ত আমাদের সকলের চেয়ে একটু বেশিই আদর যত্নে রাখে সে তার কাজের জায়গাটাকে। অথচ আমরা কোনো দিনই তাকে তার কাজের আসল বিষয়টিকে বুঝে উঠতে সাহায্য তো করিইনি উপরন্তু কোনো আলোচনায় তার উপস্থিতিও অস্বাভাবিক মনে হয়েছে। রিসার্চ ইনস্টিটিউট এর ভেতরের কার্যকলাপের সাথে ঠিক তার বাইরের মানুষদের যে বিন্দুমাত্র যোগাযোগ থাকে না, সে তো সর্বজনবিদিত। কিন্তু কোনো সভায় রাজেশের মতন রিসার্চের জন্য অপরিহার্য কেউ উপস্থিত থাকলেও, তিনি ইংরাজি না বলতে পারলে হিন্দিতে নিজের পরিচয় দিতেও কুন্ঠা বোধ করেন। তিনি খাতায়কলমে গবেষক নন, কিন্তু তাকে ছাড়া যে আমাদের মতন তথাকথিত গবেষকরা ঠুঁটো তা তিনি নিজেও যেমন জানেন আমরাও জানি। তিনি নিজে যতটা কুন্ঠা বোধ করেন তার থেকেও হয়ত আমাদের লজ্জিত হবার যথেষ্ট কারণ রয়েছে এইসব ক্ষেত্রে। আমিও তো সেদিন সেই সভায় তার পাশ থেকে উঠে দাঁড়িয়ে গর্বিত হয়ে রাজেশকে সকলের সাথে পরিচয় করিয়ে দিতে পারিনি। সে যদি লজ্জায় হোক বা অন্য কোনো কারণে নিজের পরিচয় দিয়ে উঠতে না পেরে থাকে তবে আমিও তো উঠে দাঁড়িয়ে বলতে পারতাম- 'এই হলো রাজেশ, একে ছাড়া আমাদের ল্যাব অচল। আমাদের ল্যাবের সবচেয়ে দীর্ঘস্থায়ী, সবচেয়ে একাগ্র, আমাদের সহকর্মী।' তাকে একটু একটু করে তার মতন করে বিষয়টির মধ্যে ঢুকিয়ে নেবার চেষ্টা তো কোনোদিন করিনি। যদি করতাম কে বলতে পারে কয়েক বছর পরে রাজেশকেও হয়ত আর কোনো সেমিনার হল-এ ঢুকে ঝিমোতে নাও দেখতে পারতো কেউ। 

     

Thursday 26 March 2015

গলা খুলে

যাক বাবা 'ছেষট্টির এ' কে হই হই করে ছক্কা মেরে মাঠের বাইরে বের করে দেওয়া গেছে। এইবার আর পায় কে। এইবার ফেসবুকে যত্তখুশি টম-জেরির গল্প শোনাও, ছবি দেখাও আর কেউ কান ধরার নেই। ব্যাপারটা ভালোই হয়েছে নিঃসন্দেহে। যদিও আমি অন্তত 'একুশে আইন'- এর এই ধারার নাম ধাম মানে নম্বর (৬৬এ) টম্বর সম্পর্কে কাল-পরশুর আগে একেবারেই ওয়াকিবহাল ছিলাম না। তাও ফেসবুকে বড়দের সম্পর্কে একটি শব্দও উচ্চারিত হলে, কোনো সময় যে বড়রা এসে কান ধরে নিলডাউন করে দিতে পারে তা সে ছেষট্টিই হোক বা ছিয়াত্তর বা ছিয়াশি, সেটা বিলক্ষণ জানতাম। তাই সকাল বিকেল বাড়িতে বসে চা খাবার সময়টুকুতে দরজা-জানালার ছিটকিনি বেশ ভালো করে বন্ধ আছে কিনা পরীক্ষা করে নিয়ে তবেই বড়দের সম্পর্কে চাট্টি কুকথা কয়েছি। এখন সেই সতর্কতা থেকে কিঞ্চিত শিথিলতা প্রাপ্তির আশা মিলেছে। প্রচলিত অব্যবস্থার প্রতি নূন্যতম অনাস্থা বা অসন্তোষ প্রকাশ মানেই যদি শিবঠাকুরের আপনদেশের আইন তার ফাঁক খুঁজে নিয়ে টপাটপ মানুষ ধরে ঝপাঝপ জেলে ঢোকাতে থাকে, তবে তো একসময় ঠক বাছতে গাঁ উজাড় হবে। হয় রাস্তাঘাট-রেলপথ-ইস্কুল-কলেজ-হাসপাতাল বানানো ছেড়ে পরের পর জেলখানা বানাতে হবে। নতুবা হীরক রাজ্যের মতন প্রজাদের কথা বলা বন্ধ করতে হবে বা একটি 'মস্তিস্ক প্রক্ষালণ যন্ত্র' এর দরকার হয়ে পড়বে। এবার অন্তত আমাদের নিজেদের বিচারব্যবস্থার পরিণতমনস্কতার কিছুটা উদাহরণ চোখের সামনে এসে আমাদের আশ্বস্ত করেছে। ধন্যবাদ শ্রেয়া সিন্ঘল। নিজের পড়াশুনা শিকেয় তুলে এই বয়সেই বনের মোষ তাড়ানোর অদ্ভূত চিন্তাটা মাথায় না এলে এই একুশে আইনকে দরজা দেখাতে আরো কত বছর লাগত কে জানে। রাজনৈতিক বা সামাজিক অব্যবস্থার বিরুদ্ধে যাঁরা আওয়াজ তোলার সাহস রাখেন তাঁদের জন্য এটি একটি বড় পদক্ষেপ বই কি? 

কিন্তু.......,হ্যাঁ এখানে একটি কিন্তুর খচখচানিও আছে। অন্তত আমার মনে। যদিও আইনের এই ধারাটি বিলোপের সাথে এই কিন্তুর সরাসরি বিশেষ সম্পর্ক নেই বলা যায়। তবু এই কিন্তুটিকে বিশ্লেষণ করলেই বোধহয় বোঝা যাবে যে বাকস্বাধীনতা রক্ষার্থে একটি দুষ্টু আইন বিলোপমাত্রেই কি বাকস্বাধীনতা রক্ষা করা যায়? ছোট থেকেই আমাদের প্রত্যেককে "সদা সত্য কথা বলিবে"-র সাথে সাথে এও শেখানো হয় যে, "অপ্রিয় সত্য কথা বলিবে না।" এই দ্বিতীয় নির্দেশটি মেনে চলতে গিয়ে কিঞ্চিৎ বেগ পেতে হয়। কারণ কোন সত্য যে কার কাছে কতটা অপ্রিয় আর কার কাছে কতটা প্রিয় সেটি চট করে বুঝে ওঠা যায় না। সেখানে বাকস্বাধীনতা ব্যাপারটি যে বেজায় ঠুনকো আর আপেক্ষিক সেটা ভুক্তভোগী মাত্রেই জানেন। অফিসে, বাড়িতে এর ভুরি ভুরি উদাহরণ রয়েছে। অর্থনৈতিক ভাবে পরাধীন কোনো নিরক্ষর মহিলা কি পারবেন তাঁর উপার্জনশীল স্বামী এবং শ্বশুরবাড়ির মন্দ দিকটি সম্পর্কে সোচ্চার হতে? বড়সড় অভিযোগ তো দূরস্থান, ছোটখাটো পাওয়া না পাওয়া বিষয়ে মুখ খুলতে আমরা ডরাই। সম্পর্কহানির ভয়ে। কোনো একজন ব্যক্তির চরিত্রগত দুর্বল দিকটি সম্পর্কে ততই কম কথা বলা যায়, যতই মানুষটি সম্পর্কের দিক থেকে আপন হয়। আমার এই মন্তব্যটি হয়ত অনেকেই মানতে পারবেন না। কিন্তু এটি অত্যন্ত সত্যিকথা যে আমরা আমাদের প্রিয় বন্ধুর সমস্ত ভালো গুণগুলিকে সম্পূর্ণ করতে, তাঁকে নিজের বিচার বিবেচনামত পরিপূর্ণ আদর্শস্বরূপ তুলে ধরতে অনেক সময়ই তাঁর চরিত্রের হয়ত একটিমাত্র দূর্বল দিক সম্পর্কে তাঁকে সতর্ক করতে যাই। কিন্তু যদি সেই মানুষটির নিজের সমালোচনা গ্রহণ করার বা নিজেকে পুনরালোচনা করার মতন যথেষ্ট প্রাপ্তমনস্কতার অভাব থেকে থাকে তবে সেই দুর্বলতা সম্পর্কে তাঁকে অবহিত করতে যাবার অব্যবহিত ফলাফল হলো বন্ধুত্বহানি। সেই বন্ধুত্বহানির ভয়ে অনেক সময়ই আমরা ব্যাপারটি চেপে যাই। বা সেই দুর্বলতার সাথে মানিয়ে নিয়ে চলার চেষ্টা করি। কিন্তু মানুষটি যদি তত কাছের কেউ না হন, যদি তাঁর সাথে সম্পর্কের ওঠা পড়ায় আমাদের বিশেষ কিছু লাভ ক্ষতি হবার সম্ভাবনা না থাকে তবে আমরা নির্দ্বিধায় তাঁকে তাঁর ঋণাত্মক দিকটি সম্পর্কে বলতে পারি। এটিও কি এক ধরনের বাকস্বাধীনতার জলাঞ্জলি নয়? কাজের জায়গায় উর্দ্ধতন কর্তৃপক্ষের অন্যায় মেনে নেওয়া, বসের বদখত চেহারায় বদখত জামা দেখে "বাহ, দারুন মানিয়েছে তো আপনাকে"-এসব তো প্রতিদিনের ঘটনা। আমাদের দৈনন্দিন জীবনের সমস্ত ক্ষেত্রেই নিজেদের সমালোচনা গ্রহণ করার মতো প্রাপ্তমনস্কতা যতদিন না তৈরী হচ্ছে ততদিন আইন বিলোপই কর বা নতুন আইনই বানাও সত্যি কথাটা গলা তুলে বলার সাহস কোনদিনই আমাদের হবে না। 

তথ্যপ্রযুক্তিগত বাকস্বাধীনতা আইনের সাথে যদিও এই দৈনন্দিন ঘটনাগুলির বিশেষ কোনো যোগ নেই। এবং ৬৬এ লোপাট হয়েছে বলে অন্য কোনো আইনের শাখায় সোশ্যাল মিডিয়ায় বাকস্বাধীনতা ওপর নজরদারি করা হবে না তাও নয়। তবুও সর্বাঙ্গীন অর্থেই গলা খুলে কথা বলার অধিকারের প্রশ্নে মনে হয় সমস্ত ঘটনাগুলিই তাত্পর্যপূর্ণ। আমরা বাইরে বাইরে যতই প্রাপ্তবয়স্ক হই, আত্মসমালোচক হই না কেন, এই যে আমি বাকস্বাধীনতা এবং সমালোচনা গ্রহণ করার প্রশ্নে এতগুলি কথা আমি খরচ করছি, সেই আমারই মুখের সামনে যদি কেউ আমার একশ একটা দোষ সম্পর্কে আমায় বলে, সেই দোষগুলি সম্পর্কে সম্যকভাবে অবহিত হওয়া স্বত্বেও আমি কতটা আমার সামনের মানুষটিকে তারপর সহজভাবে নিতে পারব সেটি বড় একটি প্রশ্ন।

অম্বিকেশ মহাপাত্র কারো সম্পর্কে সত্যি বলে জেলে কেন যাবেন সেই নিয়ে গলা ফাটাচ্ছি ফেসবুকে অথচ 'অফিসে ঢুকতে কেন রোজ একঘন্টা দেরী হয়, বাড়ি থেকে একঘন্টা আগে বেরোলেই পারো'-বসের মুখে এই কথা শুনলেই বসের ঘর থেকে বেরিয়ে নিষ্ফল আক্রোশে দাঁত কিড়মিড় করব। 'নেহাত আমি অধস্তন, তাই তুমি পার পেয়ে গেলে। এক্ষেত্রে তোমার বাকস্বাধীনতা আছে, আমার নেই। নইলে আমিই তোমায় জেলে ঢোকাতাম'-এরকম একটা ভাব। আসল কথাটা, যেটি নিয়ে এত সমস্যা সেই সময়ানুবর্তিতার প্রশ্নটি থেকে যায় অধরাই। ফেসবুকে রাজ্যসুদ্ধু সকলের নামে নিন্দেই হোক বা সঠিক কারণে কোনো ঘটনার প্রতিবাদ, এসবে কিঞ্চিৎ খোলা হাওয়া এসেছে বলে নিজের দোষগুণ ভুলে হই হই করে ঝাঁপিয়ে পড়ব আর আমার দোষগুণ সম্পর্কে কেউ টুঁ শব্দ করলেই দেশ-রাজ্য-সমাজ সমস্তরকম সচেতনতা ভুলে গালাগালির বন্যা বইয়ে দেব। কারণ আমারও তো বাকস্বাধীনতা আছে তাই না? সুতরাং জয় ৬৬এ। এবার আর ঠেকায় কে?                 
           

Monday 23 March 2015

বেখেয়ালে

কিছু কিছু সময় থাকে যখন বাইরে থেকে দেখলে শরীরের সমস্ত অঙ্গ প্রত্যঙ্গকে এক্কেবারে সঠিকভাবে কাজ করছে বলেই মনে হয়। হয়ত করেও। পরম কড়া সমালোচকও নড়াচড়ায়, কাজে কর্মে, কথাবার্তায় কোনরকম অসঙ্গতির হদিশ পাবেন না। কিন্তু আপনি মনে মনে জানেন যে, আপনি যেন সম্মোহিতের মতন সমস্ত বাইরের খোলসটুকু বজায় রাখছেন মাত্র। মস্তিস্ক আপনার এক্কেবারে ঘুমন্ত তখন। রোজ সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত যাবতীয় কর্তব্যকর্ম তালিকা অনুসারে হয়ে চলেছে। হচ্ছে আপনারই হাত দিয়ে। কিন্তু আপনি জানেন আপনি এসব কিছুই করছেন না। তাও কি করে যেন যান্ত্রিক পদ্ধতিতে সব হয়ে চলেছে। আর আপনি চোখ খোলা রেখে আদতে ঘুমিয়েই চলেছেন। যা হচ্ছে-যা হবে-যা হলে ভালো হত কিন্তু হলো না-বা যা না হলেই ভালো হত কিন্তু হয়ে গেল, কোনো কিছুতেই আর আপনার মস্তিস্ক কোনরকম ভাবে ভাবিত হচ্ছে না, কোনরকম প্রতিক্রিয়া দেখাচ্ছে না। পারিপার্শ্বিক সমস্ত শব্দ তখন অনেক দূর থেকে ভেসে আসছে বলে মনে হয়। মানুষের কথাবার্তার প্রতিটি শব্দ কানে বিকট তরঙ্গ তোলে। মাথার ভেতরে অবিরত একশ ঝিঁ ঝিঁ কনসার্ট বসায়। মনে হয় নিজের কোনো আলাদা অস্তিত্বই নেই বুঝি। আবহমানের পূর্বনির্ধারিত ঘটনাপ্রবাহে ভাসমান ঘাসফুলের মতন কেবল ভেসে বেড়ানোই বুঝি জীবন। অতীত-ভবিষ্যতের কোনো ঘটনার কণামাত্র যখন নিজের নিয়ন্ত্রণাধীন নয় বর্তমানের তো নয়ই, তখন মস্তিস্কের ভূমিকাটা ঠিক কি এটাই সবচেয়ে বড় প্রশ্ন হয়ে দাঁড়ায়। 

এই রকম অবস্থায় যদি কোনো মুহূর্তে করণীয় কোনো পার্থিব কাজ না থাকে তখন হয়ে যায় আরো মুশকিল। এতক্ষণ শারীরিক ভাবে অন্তত আপনি জীবিত ছিলেন। অতীত-ভবিষ্যত-কার্য-কারণ-ফলাফলের তোয়াক্কা না করে কেবল যা করার যেটি বিন্দুমাত্র ভুল না করে সঠিক ভাবে করে যাবার একটা স্রোত অন্তত সুপ্তমস্তিস্ক আপনাকে, পাঁচটা মানুষের কাছে জীবন্ত প্রমাণ করার দায়গ্রহণ করেছিল। এখন যদি সেই বাহ্যিক কাজকর্মের ঠেলাটাও না থাকে তখন? 

একটা সুবিধা অবশ্য আছে এই অবস্থার। সেটি হলো, যেহেতু আপনি সে অবস্থায় আসলে ভেতরে ভেতরে মৃত তাই আপনার কাজকর্মের ফলাফলের কোনো দুশ্চিন্তা আপনার মস্তিস্ককে ব্যস্ত রাখতে পারছে না। কারো ভালো মন্দ নিয়ে চর্চা করার পার্থিব উত্সাহ আপনার কাছে নিরর্থক তখন। ভবিষ্যতের কুহকমোহ আপনার মস্তিস্কের মতনই আপনার কাছে মৃত। বন্ধুবান্ধব-আত্মীয়স্বজন-কম চেনা-বেশি চেনা লোকজন, বাড়ি-কাজের জায়গা-দেশ-সমাজের নানান ঘটনাও তাই আপনার কাছে নিরর্থক। ফলে আপনার দৃষ্টি-শ্রবণ তখন পরিস্কার। আপনি সব কিছু দেখবেন, শুনবেন। কিন্তু তার জন্য মস্তিস্কের খাটনিটুকুর প্রয়োজন হবে না। আপাত তুচ্ছ ঘটনাও তখন আপনার চোখে ধরা পড়বে। যে মানুষটির সাথে আপনি কাজের সূত্রে দিনের পর দিন কথা বলে চলেছেন এতদিন, হয়ত আবিস্কার করবেন, আপনি এতদিন কথা বলেছেন ঠিকই কিন্তু আরো পাঁচটা চিন্তায় তাকে ভালো লক্ষ্য করেননি কোনোদিনই। তার ডানহাতের মধ্যমায় যে একটি গোমেদ আছে সেটি এতদিন আপনি জানতেনই না। বাড়ির টবে রাখা গাছটিতে প্রতিদিন জল ঢেলেছেন আপনিই, অথচ গাছটি যে ইতিমধ্যে লম্বায় এতটাই বেড়ে গেছে যে আপনার বারান্দার রেলিং পেরিয়ে সে এবার আকাশের দিকে টুকি করছে, সেটি এই আজই হঠাৎ আপনার চোখে পড়বে। সবই খুব তুচ্ছাতিতুচ্ছ জিনিস, এগুলো না দেখেও জীবন দিব্যি বয়ে চলে। ব্যক্তিগত-জীবিকাগত বা বৃহত্তর জীবনে কোথাও এই হঠাৎ আবিস্কৃত ঘটনার কোনো গুরুত্বই নেই, তাও ঘটনাগুলি যে এতদিন আপনার চোখের আড়ালে ছিল এবং তার একমাত্র কারণ এই যে, এতদিন আপনার মস্তিস্কের একশ একটা অহেতুক চিন্তা আপনাকে ভালো করে দেখতেই দেয় নি চারপাশটা। এই সত্যটা একমাত্র তখনই আপনার সামনে আসবে যখন আপনার মস্তিস্ক কাজ করা বন্ধ করবে। ঘটনার ফলাফল নিয়ে চিন্তা করতে গিয়ে হারিয়ে যায় ঘটনার ছোট্ট ছোট্ট ওঠা পড়ার অভিজ্ঞতা। যেমন আমাদের ক্ষেত্রে এক্সপেরিমেন্টের ফলাফল কি হবে ভাবতে গিয়ে কেমন করে নিঃশব্দে আমাদের শরীরে প্রতিনিয়ত নির্ভুলভাবে ঘটে চলেছে জীববিজ্ঞানের এই ঘটনার স্রোত, সেই মৌলিক বিস্ময়টুকুই আর মনে অবশিষ্ট থাকে না। আবার সেই বোধটুকুই ফিরে আসে যখন বারবারের অবিরত চেষ্টায়ও যখন কাঙ্খিত ফলাফলের ধারে কাছেও পৌঁছানো যায় না, তখন কেমন যেন নির্লিপ্ততা চলে আসে মনের মধ্যে। যেন, যা হয় হোক। আমার করার দরকার আমি করব। ফলাফলের বিন্দুমাত্রও যখন আমার হাতে নেই, তখন আর সেদিকে ফিরেও তাকাবো না। ঠিক তখনই কাজ করা বন্ধ করে দেয় মাথা। আর তখনই সরে যায় পর্দা চোখের সামনে থেকে। চলমান সিনেমার মতন সরে সরে যায় দৃশ্য নিজের মতন করেই। কিন্তু সেসবের ধনাত্মকতা বা ঋণাত্মকতা আর মনে মাথায় ছাপ ফেলতে পারে না কণামাত্রও। আর আপনার অবচেতন মন আরো বেশি করে পারিপার্শ্বিকতা সম্পর্কে সচেতন হয়ে ওঠে আপনার অগোচরেই।

এরকম অবস্থার সাথে আমার মনে হয় গ্রীষ্মকালের একটা অমোঘ যোগ আছে। মনে আছে ছোটবেলায় স্কুলের গ্রীষ্মের ছুটিতে নিঝুম দুপুরে ঠিক এরকমই একটা ঝিমধরা অবস্থা হত মনের। মনে হত চরাচর বুঝি চলছে নিজের নিয়মে। আমায় বৃত্তের বাইরে রেখেই। আমি বুঝি দর্শকমাত্র। কোনোকিছুর বিচার-বিশ্লেষণের দায় নেই আমার, কোনো ভালো মন্দের ভাবনা নেই আমার। কেবল পূর্বনির্ধারিত ঘটনাবলীর মস্তিস্কহীন দর্শকমাত্র হয়ে উপগ্রহের মত অবিরত ঘুরে চলেছি বৃত্তের ঠিক বাইরেই। আজীবন। কোনো ভয় নেই, কোনো বিষয়ের প্রতি নির্দিষ্ট ভালোবাসাও নেই। শুধু চুপ করে এককোণে বসে চারিদিকের বয়ে চলা স্রোতকে প্রত্যক্ষ করাই জন্যই আমার জন্ম। 

পশ্চিম ভারতের এই অঞ্চলেও গ্রীষ্ম শুরু হয়েছে কাল থেকে। কালই প্রথম কম্বল ফেলে ফ্যানের হাওয়ার দ্বারস্থ হতে হয়েছে ঘুমোতে গিয়ে।   
   

Friday 20 March 2015

স্লীপিং ব্যাগ ও স্লীপার ক্লাস

সার্কাস-১,  যখন লিখেছিলাম তখন যাবার সময় ট্রেনে স্লীপিং ব্যাগে ঘুমোনো হলনা বলে অনেক কাঁদুনি গেয়েছিলাম। আপনারা ভেবেছিলেন হয়ত, “কি আশ্চর্য! স্লীপিং ব্যাগ নিয়ে এত আদেখলাপনা কেন রে বাবা?” তখনই আপনাদের বলেছিলাম যে এই আদেখলাপনার যথেষ্ট কারণ আছে। আমরা দুজনেই এদিক ওদিক বেরিয়ে পড়তে ভালবাসি ঠিকই কিন্তু দুজনের কেউই বড়সড় অ্যাডভেঞ্চার করতে যাইনি কখনও যেখানে স্লীপিং ব্যাগ বিষয়টি অত্যন্ত প্রয়োজনীয় বস্তু বলে মনে হতে পারে। তবুও আমরা যে কেন হুড়মুড়িয়ে গুচ্ছের টাকা খরচ করে স্লীপিং ব্যাগ কিনেছিলাম তার একটা দুর্দান্ত ইতিহাস আছে। আজকে আপনাদের সেই মারাত্মক অভিজ্ঞতার কথাই বলব বলে ঠিক করেছি। 

ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহে আমরা তিনজন যোধপুর যাব বলে ঠিক করলাম। তিনজন মানে আমরা দুজন আর আমাদের এক বন্ধু কাম বোন। ঘটনাচক্রে সে আর আমি সমনামধারিণী। এক্ষেত্রেও যাওয়া-আসার
 টিকিট এবং হোটেল বুকিং কনফার্ম ছিল। সুতরাং আমাদের পূর্ববর্তী ভ্রমণের ইতিহাস অনুসারে কিছু একটা গন্ডগোল হবারই ছিল। কিন্তু ইতিহাসের কালজয়ী ঘটনাবলী কি সেই ঘটনার কুশীলবদের আগে থেকে জানান দিয়ে আসে? স্বাভাবিকভাবেই আমাদের ক্ষেত্রেও আসেনি। আমরা তিনমূর্তি পিঠে একটা করে ছোট ব্যাগ নিয়ে শুক্রবার সন্ধ্যায় বেরিয়ে রাতে পুরনো দিল্লী ষ্টেশন থেকে যোধপুরগামী ট্রেন এ চেপে বসলাম। যদিও সেটা ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহ ছিল আর দিল্লিতে পর্যাপ্ত ঠান্ডা পড়েছিল এইবছর। তাও আমরা ভেবেছিলাম কয়েকঘন্টার তো জার্নি, সকালে চোখ খুললেই যোধপুর। আর আমরা তিনজনেই কেউই খুব একটা আতুপুতু যাত্রী নই, সুতরাং পকেটের স্বাস্থ্যরক্ষার্থে এই কয়েকঘন্টার জার্নির জন্য স্লীপার ক্লাসই ঠিক আছে। 

প্রত্যেক জায়গারই নিজস্ব বিশেষত্ব আছে। সেই বিশেষত্বের সাথে যদি মানিয়ে নেওয়া না যায় তবে ওই জায়গায় বেঁচে থাকাটা যে কি ধরনের মুশকিল ঘটনা
 হতে পারে সেই শিক্ষায় শিক্ষিত হবার জন্য আমাদের সেদিনের সেই জার্নিটাই যথেষ্ট ছিল। ট্রেনে উঠে তিনজনে তিনটে পুঁচকে ব্যাগ নিয়ে বসে আছি। আর বাকি যাত্রীরা দেখছি বড় বড় ব্যাগ নিয়ে উঠছেন। কোথায় কোন ব্যাগ রাখবেন বুঝে উঠতে পারছেন না। যত বড় পরিবার তত বেশি সংখ্যক ব্যাগ। হুলুস্থুল ব্যাপার। ট্রেন চালু হতে স্বাভাবিক নিয়মেই মোটামুটি স্থিতিশীল অবস্থা ফিরে এলো। আর আমরা তিনজনে এই পুরো অরাজকতার সময়টা এ ওর মুখের দিকে তাকিয়ে চোখ মটকে তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে গেলাম। ভাবখানা এই যে, লোকে এত যে কি নিয়ে বেরোয়? অত্যন্ত প্রয়োজনীয় কিছু জিনিস নিয়ে নিলেই তো হলো। তাহলে আর এই জগঝম্প জার্নি করতে হয়না। এত ব্যাগ! আমাদের মতন মিনিম্যালিস্ট হতে আর পারল না এরা। এই সব উত্কৃষ্ট ভাবনাচিন্তা করে মনে মনে বেশ পুলকিতও হয়ে উঠলাম। আত্মতৃপ্তিতে ভরপুর হয়ে তারপর যথাবিহিত নিয়মে খাওয়াদাওয়াও সারা হলো। এবার শোবার পালা। আমার আর দুই নম্বর অর্পিতার (বার বার দুই নম্বর অর্পিতা বলার চেয়ে ওর একটা অন্য নাম দেওয়া যাক। ধরা যাক ওর নাম টুকাই। এরপর থেকে ওকে টুকাই বলে ডাকবো।) শোবার জায়গা দুটো পাশাপাশি আপার বার্থে। আর পিনাকীর সাইড আপার। আমরা যথেষ্ট গরম জামা পরে আছি তাই শোবার জন্য একটা করে গায়ে দেবার চাদর পিঠের ব্যাগে নিয়ে বেরিয়েছিলাম। আমার আর পিনাকীর দুটি শাল। আর টুকাই-এর জন্য মোটামুটি পুরু একটি চাদর। আমরা ওপরে উঠে শুয়ে পড়লাম। চাদর গায়ে দিয়ে। বাকি জনগণ দেখি প্রত্যেকেই একটি করে মোটাসোটা কম্বল বের করে ফেলেছেন তাঁদের বয়ে আনা ব্যাগের পাহাড় থেকে। এদিক ওদিক নজরদারি করে দেখলাম এর কোনো ব্যতিক্রম নেই আমরা ছাড়া। না একটু ভুল বললাম পুরো কামরায় আরো একটি ব্যতিক্রম ছিল আমরা ছাড়া। তাঁর কাছে একটি স্লিপিং ব্যাগ ছিল। তিনি তাতে ঢুকে আরাম করে শুয়ে পড়লেন। আমরা একটু থতমত খেয়ে গেলাম। কি রে বাবা! প্রত্যেকেই তো দেখি কম্বল বের করে। যত বড় পরিবারই হোক না কেন সকলের জন্য একটি করে কম্বল। এতক্ষণে বুঝলাম কেন ট্রেনে উঠে সকলেই দুচারটে করে ব্যাগ সিটের তলায় না ঢুকিয়ে সিটের ওপরে রাখছিলেন। আর তাই দেখে আমরা তাঁদের নাস্তানাবুদ অবস্থা হচ্ছে ভেবে নিজেরা চাপা স্বরে ঠাট্টা ইয়ার্কি করছিলাম। এখন দেখি সেই সিটের ওপরের প্রত্যেকটি ঢাউস ব্যাগ থেকে একটি করে ঢাউস কম্বল বেরিয়েছে। আর সকলেরই ব্যাগের সংখ্যা এক কি দুই এ দাঁড়িয়েছে। আমাদেরই মত। তখন মনে আশা ছিল আমাদের যে, কম্বল কেন লাগবে রে বাবা শুতে?এইতো এখনো ট্রেন ছুটছে, এখন কি আমাদের ঠান্ডা লাগছে নাকি? আমাদের গায়ে মোটা-পাতলা মিলিয়ে দুটি উলিকটনের গেঞ্জি, তার ওপরে জামা, তার ওপরে সোয়েটার-মোটা উলের মায়ের হাতে বোনা, তার ওপরে মোটা হাওয়া নিরোধক জ্যাকেট। এরপরে আর কোথা দিয়ে ঠান্ডা ঢুকবে? শুধু শুধু কম্বল বয়ে বেড়াবার কোনো মানেই হয় না। আমরাই ঠিক কাজ করেছি। এই ভেবে আবার একপ্রস্থ আত্মতৃপ্তির ঢেকুর তুলে শুয়ে পড়লাম। কিছুক্ষণ নিশ্চিন্তে ঘুমোলামও। 

তারপরে? 

তারপরে একটু একটু করে ঘুম কেটে যেতে লাগলো। কারণ আমার গায়ে মোটা-পাতলা মিলিয়ে দুটি উলিকটনের গেঞ্জি, তার ওপরে জামা, তার ওপরে সোয়েটার-মোটা উলের মায়ের হাতে বোনা, তার ওপরে মোটা হাওয়া নিরোধক জ্যাকেট। 

কিন্তু পায়ে?

পায়ের কথা আর কেই বা মনে রাখে শীতে? তুশ্চু প্রত্যঙ্গ। পায়ে আমার পাতলা ইনার এর ওপরে জিন্স। দুটোর কোনটিই হাওয়া নিরোধক নয়। আর এই মধ্যরাতে হুহু শব্দে ছুটে যাওয়া ট্রেনে শেষ ডিসেম্বরে পশ্চিমভারতের ঠান্ডা হাওয়া মোটা কম্বলের তলায় সুরক্ষিত স্লীপার ক্লাসের বাকি জনগনকে কামড় বসাতে না পেরে আমার এই নিরীহ অরক্ষিত পা জোড়াকেই খুঁজে পেয়ে মরণ কামড় বসিয়েছে। তারপর আমার সাথে সেই ঠান্ডা হওয়ার আক্ষরিক অর্থেই সারারাত্রিব্যাপী হাতাহাতি যুদ্ধ শুরু হলো। 

হাত পা গুলো ঠান্ডা হয়ে যেতে লাগলো। আমি ব্যাগ থেকে উলের টুপি আর উলের গ্লাভস বের করে পরলাম। 

তারপর আমার শরীর আরো ঠান্ডা হয়ে যেতে লাগলো। আমি ব্যাগ থেকে মাফলার বের করে টুপির ওপর দিয়ে মাথায় জড়ালাম। 

তারপর আমার শরীর আরো ঠান্ডা হয়ে যেতে লাগলো। তখন আমি ব্যাগ থেকে আরো একটা মোজা বের করে পায়ে থাকা মোজার ওপর দিয়ে পরলাম।

তারপর আমার শরীর আরো ঠান্ডা হয়ে যেতে লাগলো। তখন আমি ব্যাগ হাঁটকে আর কোনো কিছু পরার মতন পেলাম না। তখন আমি গায়ের শালটাকে গা থেকে খুলে দু ভাঁজ করে পায়ের ওপর দিলাম।

তারপর আমার শরীর আরো ঠান্ডা হয়ে যেতে লাগলো। তখন আমি কি করব ঠিক করতে না পেরে পিঠের ব্যাগ টাকেই দুই পায়ের ওপর চাপালাম। মোটেই কিছু সুবিধে হলো না। পা দুটো বাবু হয়ে বসার মতন করে মুড়ে শুলাম। 

তারপর আমার শরীর আরো ঠান্ডা হয়ে যেতে লাগলো। পিঠ দিয়ে ঠান্ডা উঠছে। শেষমেষ উঠে বসলাম। বেশ করে শালটাকে জড়িয়ে, নিজেকে যতটা সম্ভব ছোট্ট করে মুড়ে নিয়ে ব্যাগটাকে কোলে করে টুপির ওপর দিয়ে মাথা মুখ ভালো করে মাফলারে মুড়ে পুঁটলির মতন বসে দেখি- সামনের দুটো বার্থে আরো দুটো ছায়ামূর্তি উঠে গোল্লা পাকিয়ে বসে ঠকঠক করে কাঁপছে। আমাদেরই বাকি দুই মূর্তি। পা দুটো মনে হচ্ছে নেই আমার। প্রচন্ড ঠান্ডায় স্নায়ু কাজ করা বন্ধ করে দেয় পড়েছিলাম। প্র্যাকটিকাল পরীক্ষাটা সেদিন দিলাম। গা থেকে জ্যাকেটটা খুলে পায়ে জড়াবো কিনা ভাবলাম একবার। কিন্তু না। ঠান্ডার চোটে পা অবশ হয়ে গেলেও কাল আমায় লোকজন ট্রেন থেকে চ্যাংদোলা করে নামাতে পারবে। কিন্তু গা থেকে জ্যাকেট খুলে পায়ে দিলে, এ যা ঠান্ডা, তাতে গায়ের সোয়েটার ভেদ করে পাঁজরে গিয়ে ঘা মারলে যদি বুকের হৃৎপিন্ডটাই কোনো মতে জবাব দিয়ে দেয় ঠান্ডার চোটে, তাতে চলন্ত ট্রেনে এই মাঝরাতে আমায় নিয়ে বাকিদের বড়ই অসুবিধায় পড়তে হবে। যদিও জানিনা বাকি দুই জন তখনও বেঁচে আছে কিনা। নাকি ঠান্ডায় জমে গিয়ে জীবাশ্মে পরিনত হয়ে গেছে বাঙ্কে বসে বসেই। 

কিছুক্ষণ পরে দেখি পিনাকী নেমেছে নিচে। পায়চারী করতে শুরু করেছে ট্রেনের শরু প্যাসেজের মধ্যেই। যদিও ওকে তখন পিনাকী বলে চেনা যাচ্ছিল না।  আমি জানি তাই বললাম। চশমায় ঢাকা চোখদুটি ছাড়া বাকি সব পরতের পর পরতে ঢাকা। একই দশা। পায়ে কেবল পাতলা একটি পরতের ওপর জিন্স। টুকাইয়ের তাও নেই। শুধুই জিন্স। টুকাইকে ডাকতে দেখি সামনের বাঙ্কের পুঁটলিটা একটু নড়ে উঠলো আর ক্ষীণ একটা "উঁ" ভেসে এলো। বুঝলাম এখনো জীবাশ্ম হয়ে যায় নি। পিনাকী পায়চারী করেই চলেছে। একবার বললাম "লোকজন বিরক্ত হতে পারে এত বার যাতায়াত করছিস, ঘুমোচ্ছে সবাই।" উত্তর এলো, "হুম"। তারপর দেখি সোজা হয়ে গ্লাভস পরা হাত পকেটে ঢুকিয়ে হেলান দিয়ে দাঁড়ালো। দাঁড়িয়ে আছে তো আছেই। একই রে বাবা? বাকি রাত দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে যাবে নাকি? এখনো তিন চার ঘন্টা জার্নি বাকি? বললাম, দাঁড়িয়ে আর কি করবি? ওপরে উঠে বস। উত্তর এলো, "হুম "। আমি আর ঘাঁটালাম না ভদ্রলোককে। কারণ এই স্লীপারে যাবার বদবুদ্ধিটা প্রধানত আমার। আর তার ফলেই এই দশা। এখন বেশি ঘাঁটালে যদি চড়-থাপ্পড় মেরে বসে? দরকার নেই বাবা। অবশ্য তাতেও বিশেষ অসুবিধা হত না। বরং সুবিধাই হত। দুচারটে কিলচড় খেলে খানিক গা গরম তো অন্তত হত। 

আশে পাশে তাকিয়ে দেখি আমরা তিনজন গর্বিত মিনিম্যালিস্ট ছাড়া কম্বলধারী প্রত্যেক বোকারাই আরাম করে কম্বলের মধ্যে নাক ডাকাচ্ছেন। এঁনারা স্লীপারের নিয়মিত যাত্রী। তাই এই শীতে যে কম্বল ছাড়া চলবে না তা এঁনারা জানেন। শুধু আমাদেরই স্লীপার ক্লাসে নিয়মিত যাতায়াত করা হয়না বলে এই যাত্রার আবশ্যকীয় উপাদানগুলি সম্পর্কে আমরা মোটেই ওয়াকিবহাল ছিলাম না। উল্টে যাঁরা এই যাত্রার নিয়মগুলি মেনে চলছিলেন তাঁদের নিয়ে হ্যাহ্যা করছিলাম। ভগবান তখন আমাদের দিকে তাকিয়ে নিঃশব্দে হ্যা হ্যা করছিলেন আমরা শুনতে পাইনি। তারপর যত রাত বাড়তে লাগলো নিউটনের তৃতীয় সূত্র অনুসারে ভগবানের হাসি তত আমাদের দিকে ধেয়ে আসতে লাগলো। আমার তো সত্যি বলছি এরকমও মনে হলো একবার যে, এই যে প্রত্যেকে একটা করে গোটা কম্বল মুড়ে আরাম করে ঘুমোচ্ছে। আর আমরা তিন তিনজন নিরীহ প্রাণী ঠান্ডায় প্রায় পঁচাত্তর ভাগ মরে গেছি। আর আমি নিশ্চিত বাকি পঁচিশ ভাগও কাল যোধপুর স্টেশনে পৌঁছবার আগেই মরে যাব। এ হেন দুর্ভাগাদের কি অন্তত একটা কম্বলও কেউ ধার দিতে পারে না? তাতেই তিনজনে পা ঢুকিয়ে বসে বাকি রাতে বাকি পঁচিশ ভাগটাকে বাঁচাবার একটা চেষ্টা অন্তত করতে পারব। শীতে দুঃস্থদের উষ্ণতা দেওয়া তো কত পূণ্যের কাজ। কিন্তু সে রাতে কোনো পূন্যাত্মাই পূণ্য সঞ্চয়ের লোভে জেগে বসে ছিলেন না। সুতরাং আমরা বাকি রাত জেগে বসে করুণ চোখে চারপাশের রং-বেরঙের নরম কম্বলের শোভা দেখতে দেখতে কাঁপতে লাগলাম। আর পিনাকী দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কাঁপতে লাগলো। 

সব মহাপ্রলয়েরই তো শেষ আছে। সেরকমই সেই রাত কেটেও ভোর হলো। ট্রেন যোধপুর স্টেশনে এসে পৌঁছালো। আসার আগে এই যোধপুর স্টেশন নিয়ে কত নস্টালজিয়া আমাদের। সোনার কেল্লায় ফেলুদারা এখানেই এসে নেমেছিল ইত্যাদি ইত্যাদি। স্টেশনটা, চারপাশটা, শহরটা এখন কেমন দেখতে সেই নিয়ে কত জল্পনা আমাদের। কিন্তু বিশ্বাস করুন আমায় যদি এখন জিজ্ঞাসা করা হয় যোধপুরে নেমে তুমি কি দেখলে? কেমন স্টেশন? আমি কি বলব জানেন? বলব, "যে প্লাটফর্মে নেমেছিলাম সেখানে কোনো রোদ ছিল না। ওভারব্রিজে উঠে প্রথম পায়ে রোদ লেগেছিল। আর স্টেশনের বাইরে বেরিয়ে পুরো গায়ে রোদ লেগেছিল। আর সেই রোদ  মেখে আমরা স্টেশনের কাছেই হোটেল পর্যন্ত হেঁটে পৌঁছেছিলাম। আমাদের আনতে হোটেল থেকে কেউ গিয়েছিলেন। আমাদের মস্তিস্ক বোধহয় তখনও পুরোপুরি কাজ করতে শুরু করে নি তাই আমরা তিনজনেই তাঁকে নামের প্যাকার্ড থাকা সত্বেও সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে ওভার ব্রিজে উঠে গেছিলাম। বোধহয় ট্রেন থেকে নেমে তিনজনেরই চোখ ছিল ওভারব্রীজের ওই রোদের ফালিটুকুর দিকে তাই আর ওই নশ্বর প্যাকার্ডধারীর দিকে আর কারো নজর পড়ে নি। 

এই হলো আমাদের যোধপুর যাবার ইতিকথা। হোটেলে পৌঁছালাম আমরা শনিবার সকালে। রবিবার রাতে আমাদের ফেরার ট্রেন। এর মধ্যেই আমাদের যোধপুরের যাবতীয় দ্রষ্টব্য শেষ করে একফাঁকে ওঁশিয়া ঢুঁ মেরে আসতে হবে। হোটেলের ছাদে চড়চড়ে রোদে বেশ করে হাত পা সেঁকে একটু সুস্থ হতেই মাথা কাজ করতে শুরু করলো। আর আমরা বেড়ানো-চড়ানো শিকেয় তুলে দৌড়ালাম পরদিনের তত্কালের টিকিট বুকিং করতে। আমাদের ফেরবার টিকিট কিন্তু কনফার্ম ছিল। কিন্তু সেও তো সেই স্লীপার ক্লাসে থুড়ি ফ্রীজার ক্লাসে। হোটেলের ঠিক উল্টো দিকেই রেলওয়ে বুকিং কাউন্টার। পিনাকী সেখানে, আর আমরা হোটেল মালিককে তাঁর চেয়ার থেকে উত্খাত করে তাঁর কম্পিউটারে। কিন্তু শেষ রক্ষা হলো না। আমরা তত্কালে এসির টিকিট পেলাম না। মানে পেলাম কিন্তু সেটা শেষ পর্যন্ত কনফার্ম হলো না। ফলে ফেরার সময় আবার সেই ফ্রীজার ক্লাস।

এবারে মানসিক ভাবে অনেকটা প্রস্তুত ছিলাম বিপর্যয়ের জন্য। তারপর সদ্য বেড়ানোর তাজা মনোভাব আর উত্তেজনাও ছিল। ফলে যুদ্ধের জন্য সবচেয়ে বেশি যা দরকার অর্থাৎ মনোবল, সেটি যাবার সময়ের তুলনায় খানিক বেশিই ছিল আমাদের। ফেরার সময় ট্রেন অনেক ফাঁকা। তবুও যাঁরা আছেন প্রত্যেকেই কম্বল নিয়ে উঠেছেন। দেখে শুনে এবারে আমাদের স্বভাবতই আর হাসি এলো না। ব্যাকুল হয়ে তাকিয়ে রইলাম শুধু। খাওয়া দাওয়া সেরে নিলাম। আমাদের পাশেই একটি কমবয়সী ছেলে উঠলো সাথে একটি মাত্র মাঝারি মাপের ব্যাগ। নিজেদের একার দূর্দশায় যতটা কষ্ট হয়, সাথে আরো কেউ দূর্দশায় পড়লে কষ্টটা ভাগ করে নেবার আরো কেউ থাকে বলে মানুষ কষ্ট খানিক কম পায়। মনে আশা জাগলো। এ বেচারাও আমাদেরই মতন অভাগা। একটাই ব্যাগ নিয়ে উঠেছে। এই ব্যাগে যদি কম্বল নেয় তবে আর অন্য জিনিস কোথায় নেবে? তার মানে নিশ্চয়ই কম্বল নেই এর সাথে। কিন্তু সেযাত্রা আরো ঐশ্বরিক ঠাট্টা বরাদ্দ ছিল আমাদের কপালে। সবে মাত্র ফিসফিস করে টুকাইয়ের কানে কানে কথাটা বলেছি। সাথে সাথে, বিশ্বাস করুন সাথে সাথেই, আমার কথা শুনতে পেয়েছিল কিনা কে জানে, দেখি ছেলেটি তার ওই সবেধন নীলমনি ব্যাগখানি থেকে টেনে টুনে একটা মোটা কম্বল বের করে ব্যাগটাকে ভাঁজ করে মাথার বালিশ করে শুয়ে পড়ল। শোবার সময় আমাদের দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসেছিল কিনা সেটা খেয়াল করিনি। ব্যাগটায় কম্বল বাদ দিয়ে আর কিচ্ছু ছিল না। এই ঘটনায় আমি অন্তত একটা জিনিস শিখলাম, যে, শীতকালে স্লীপারে যেতে হলে যদি একটিই ব্যাগ নিতে হয় তবে কম্বলের ব্যাগটিই নাও অন্য সব মহার্ঘ্য বস্তু ছেড়ে। 

তারপর আমরা চেষ্টা করলাম যদি বাড়তি টাকা দিয়ে এসি থেকে তিনটে কম্বল যোগাড় করা যায়। কারণ আমার মাথায় ছিল যে দিল্লি-হাওড়া দুরন্ত এক্সপ্রেসে স্লীপার ক্লাসে টিকিট কাটার সময়ই বেডরোলের অপশন দেওয়া হয়। কিছু টাকা বেশি লাগে টিকিটের সাথে। এই সুবিধা আমরাও নিয়েছি একবার। সুতরাং এখানেও কি বাড়তি টাকা দিলে তিনটে কম্বল পাওয়া যাবে না? এই বিশ্বাসে অন্তত পাঁচ ছয় বার স্লীপার থেকে এসিতে যাতায়াত করে, দুই টিকিট পরীক্ষক এবং এসির কোচ এটেন্ডেন্টের সাথে কথা বলে বুঝলাম যে, এই ট্রেনে আইনগত ভাবে সেই সুবিধা পাবার কোনো উপায় নেই। কিন্তু এসির কোচ এটেন্ডেন্ট আর একজন টিকিট পরীক্ষকের বদান্যতায় বেআইনি পথে অন্য টিকিট পরীক্ষকের চোখ বাঁচিয়ে আমরা তিনটি কম্বল ব্যবহার করতে পারি আজকে রাতের জন্য।প্রতিটি কম্বল পাঁচশ টাকা। যা সম্ভবত ভাগাভাগি হবে এসির কোচ এটেন্ডেন্ট এবং ওই টিকিট পরীক্ষকের মধ্যে। ভারতীয় রেলের লাভ লবডঙ্কা। ওই মহাপুরুষ টিকিট পরীক্ষকের নাম তার বুকের নেমপ্লেটে লেখা ছিল। ভুলে গেছি এখন। মনে রাখা উচিত ছিল। কারণ তাঁর প্যাঁচালো কথাতেই আর একটু হলে এই বেআইনি কাজটি আমরা করে ফেলতে যাচ্ছিলাম। ব্যাপারটা যে বেআইনি তা অন্য টিকিট পরীক্ষকের সাথে কথা না বলা পর্যন্ত তো আমরা বুঝতেই পারিনি। তারপরে ব্যাপারটা বুঝে ফিরে যখন আসলাম ততক্ষণে এসির প্রায় সমস্ত যাত্রী জেনে গেছেন যে আমরা স্লিপারের যাত্রী। আর তিনটি কম্বলের জন্য ট্রেনের এপ্রান্ত থেকে ওপ্রান্ত পর্যন্ত হন্যে হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছি। 

তারপর আর কি? ব্যাগের সমস্ত জামাকাপড় পরে, এমনকি জিন্সের ওপর দিয়ে রাতে পরে শোবার জন্য যে পায়জামাটা নিয়ে গেছিলাম সেটা পর্যন্ত পরে বাঙ্কে উঠে শুলাম। আর একটু পর থেকেই আগের রাতের অভিজ্ঞতার পুনরাবৃত্তি শুরু হলো। শুয়ে-দাঁড়িয়ে-বসে-কুন্ডলী পাকিয়ে কোনোক্রমে রাত কাটিয়ে যখন গুরগাঁও স্টেশনে এসে নামালাম তখন অন্ধকার। তারপর দুটো অটো বদলে এসে নামলাম আমাদের আস্তানা থেকে তিন কিলোমিটার দূরে। এখান থেকে আমাদের ইনস্টিটিউটের গাড়ি এসে আমাদের নিয়ে যাবে। প্রচন্ড কুয়াশার মধ্যে হেডলাইট জ্বেলে গাড়ি ছুটছে। আমরা দাঁড়িয়ে আছি জাতীয় সড়কের ধারে আমাদের গাড়ির অপেক্ষায়। তখনিই আবার এমন একটা ঘটনা ঘটল যেটা নিয়ে আধখানা ব্লগপোস্ট আমি অলরেডি লিখে ফেলেছি। সেদিন ছিল এই মরশুমের শীতলতম দিন। দিল্লির তাপমাত্রা সেদিন ছিল ২.৬ ডিগ্রী। রাজস্থানের বুকে চলন্ত ট্রেনে সে তাপমাত্রা কত ছিল আমি জানি না। তবে সেযাত্রা দুটো পা নিয়ে আস্ত ফিরে এসে সেই দিনেই আমি দুটো স্লিপিং ব্যাগ অর্ডার করেছিলাম পরবর্তী এরকম কোনো স্লীপার ক্লাসে যাত্রার কথা মাথায় রেখে। 

এখনো কি বলবেন যে জানুয়ারির শিমলা-ফাগু-কুফরী যাবার সময় (সার্কাস-১ এবং সার্কাস-২ তে লেখা) কালকা মেলের স্লীপার ক্লাসে স্লিপিং ব্যাগে ঘুমোতে না পারার দুঃখটা সত্যিকারের দুঃখ নয়? আদেখলাপনা? যদিও সে দুঃখ আমার কালকা থেকে দিল্লি ফেরার সময় স্লিপিং ব্যাগে ঢুকে মুছে গেছিল।