Tuesday 29 July 2014

চক্রবর্তী to চ্যাটার্জী

একটা মানুষের পদবী কতরকম ভাবে স্থির হতে পারে? সাধারনভাবে জন্মানোর পর 'ভ্যাঁ' বেরোনোর আগেই আপনার আমার পদবী ঠিক হয়ে গেছে। আমি পিজি হাসপাতালে ল্যান্ড করার সাথে সাথেই আমার বাবা আমাকে দেখার আগেই আমি অমুক 'চ্যাটার্জী' হয়ে গেলাম। কোনো এক সত্য যুগে আমার মা 'চক্রবর্তী' ছিল। আমার মধ্যে সেই চক্রবর্তীত্বের ছিটেফোঁটাও নেই। এটাই নাকি নিয়ম। হবে হয়ত। কার যে নিয়ম কে জানে। আমি যদি না চাই তবুও আমায় শুধুমাত্র নিয়ম বলেই নামের পেছনে একটা এক্সট্রা লেজুড় বয়ে বেড়াতে হবে। অবশ্য তাতে আমার কোনো অসুবিধা হয়নি বরং 'অর্পিতা'-র পরে 'চ্যাটার্জী' বিষয়টা বেশ ভালই লাগে। কিন্তু এমনও একজনকে জানতাম যার নাম ও পদবী কোনো ফর্মে ইংরিজি বানান করে লিখতে গেলে মাঝের স্পেসটা ধরলে চব্বিশটা খোপ লাগে। বেচারার পদবি হলো গুহঠাকুরতা। নামটিও ততোধিক লম্বা। সে বেচারাকে মাঝেমাঝেই ফর্ম পূরণ করতে গিয়ে আক্ষেপ করতে শুনেছি "ওফফ ! পদবিটা যখন এতবড় নামটা তো অন্ততঃ ছোটো করে কিছু একটা দিতে পারত। এখন আমি লিখব কোথায়? অতগুলো খোপই তো নেই ফর্মে।" বেচারাকে নাম লেখার জায়গায় পেন দিয়ে কয়েকটা এক্সট্রা খোপ বানাতে হত প্রায় প্রতিটা ফর্মেই। এখন যদি সে নিজের সুবিধার জন্য সে পদবির জায়গায় 'সেন', 'রায়' বা 'দে' লেখে অথবা কিছুই না লেখে তবে তো তার এই আজন্মের ফর্ম পূরণের সমস্যার সমাধান হতে পারে? পারে কিনা বলুন? কিন্তু তা সে পারবে না। কারণ 'নিয়ম নেই'। অতএব "চল নিয়ম মতে"।

যাক গে এইসব গোলমেলে নিয়ম নিয়ে পরে একদিন বসা যাবেখন। আপাতত আমার মায়ের পদবী কি করে 'চক্রবর্তী' থেকে রাতারাতি 'চ্যাটার্জী' হয়ে গেল সে ঘটনার দুচারটে মুখরোচক গল্প বলি। কুমারী মায়ারানী চক্রবর্তী তো কোনক্রমে হুগলী জেলার কোনো এক গন্ডগ্রাম থেকে স্কুলের পড়াশুনা শেষ করে নিজচেষ্টায় চন্দননগর কলেজে ভর্তি হয়ে চুঁচুঁড়ার বড়দির বাড়ি থেকে যাতায়াত শুরু করলো। কলেজের শেষ পরীক্ষার পর কোনো এক সময় হঠাতই জানতে পারল, সেই যে সে তার চারফুটিয়া চেহারাটা নিয়ে স্টেশন যাবার রাস্তাটা দিয়ে দিন দুবেলা গুড়গুড় করে যাতায়াত করত, সেই সময় সে একজনের চোখে পড়ে গেছে। না না, যা ভাবছেন তা নয়। আমার বাবা তখন অনেক অনেক কিলোমিটার দূরে মিলিটারি ব্যারাক থেকে বেরিয়ে প্যারেড ট্যারেড করছেন হয়ত। তাঁর এসব জাগতিক রোম্যান্স-টোম্যান্সের দিকে তাকাবার সময় নেই। আমার মাকে দেখতে পেয়ে গেছিলেন আমার ছোটোপিসি। তিনিও কয়েকদিন সেই গুড়গুড়ে মেয়েটিকে লক্ষ্য নজর করে টরে মনে মনে নিজের 'বিয়েই করবনা' পণ করে বসা ছোটোভাইটির জন্য পছন্দ করে ফেললেন। তারও পরে বেশ কয়েকদিন গেল ভাইটিকে বিয়ের জন্য রাজি করাতে। শেষে দুপক্ষের সম্মতিক্রমে পাত্র-পাত্রীর ছবি দেওয়া নেওয়ার বন্দোবস্ত করা হলো। কুমারী মায়ারানীর বাড়ির লোকজন তো তার সম্ভব্য পাত্রপক্ষকে দেওয়ার জন্য আগে থেকেই তুলে রাখা ঠোঁটের কোণে পাতলা হাসিসহ আড়চোখে তাকানো কুমারী মায়ারানীর একটা ছবি পাঠিয়ে দিলেন আমার ছোটোপিসির জিম্মায়। সমস্যাটা হলো পাত্রপক্ষে। একে তো অনেক কষ্টে ছোটো ভাইটিকে রাজি করানো হয়েছে বিয়ে করতে। তারপর যদি আবার ছবির উত্কর্ষতা নিয়ে বেশি কথাবার্তা বলা হয় তবে হয়ত মিলিটারী মেজাজের চোটে বিয়ের প্ল্যানটাই ভেস্তে যাবে। ফলে হাতের কাছে যে ছবিটা পাওয়া গেল শ্রীমান প্রশান্তকুমারের বাড়ির লোকজন সেটিকেই মেয়ের বাড়ি পাঠিয়ে দিলেন পাত্রীর পাত্র পছন্দ কিনা জানতে। আমি আপনাদের ছবিটি দেখাচ্ছি। দেখে বলুন এই ছবি দেখে কোনো পাত্রীর পক্ষে পাত্র পছন্দ করা সম্ভব কিনা?

           
না না ! আমি মোটেই বলব না কে আমার বাবা। আপনারাই খাবি খাচ্ছেন তো? তাহলেই ভাবুন আমার মা কতখানি খাবি খেয়েছিল বাচ্চা বয়সে বিয়ে করতে গিয়ে। ছবিটা কিন্তু আপনারা যতটা বড় দেখছেন ততটা বড় নয়। digitization এর ফলে খানিকটা বড় দেখাচ্ছে। কি সাংঘাতিক ব্যাপার ভাবুন। তাজমহলের সামনে আপাদমস্তক মিলিটারী পোশাকে দাঁড়ানো দুজন লোকের পুঁচকে এতটুকু একটা ছবি। ভগবানই জানেন এর মধ্যে কে সাম্ভব্য পাত্র। আমার মা বা তার বাড়ির লোকজন কি করে বুঝেছিলেন, রাম-দুই-তিন-চার গুনে, নাকি টস করে, নাকি আমার পিসির কাছে বর্ণনা শুনে আমি জানিনা। আমার শুধু এই ছবিটা দেখে একটা কথাই মনে হয়েছিল যে এই ছবিটার বদলে নিচের এই দ্বিতীয় ছবিটা পাঠালেই বা কি ক্ষতি ছিল?


পাত্র যে মিলিটারী চাকরির সাথে সাথে বেশ জাঁদরেল একখানা ফুটবল প্লেয়ার সেটাও বেশ বলা হয়ে যেত ওই এক ছবিতেই। পাত্রীর চোখে পাত্রের জন্য আরো খানিকটা সমীহ জেগে ওঠার সম্ভাবনা থাকত তাহলে। শুধু ছবিটার মধ্যে পাত্রের মুখটাকে পেন দিয়ে গোল করে মার্ক করে দিলেই চলত বা মাথার ওপর একটা টিক মার্ক।

যাই হোক না কেন এইসব গন্ডগোলের মধ্যে তো সব কিছু সামলে সুমলে আমার মামার বাড়ির সবাই আর পিসি-জ্যেঠু-জ্যাঠিমা ইত্যাদি সবাই মিলে শ্রীমান প্রশান্তকুমার আর কুমারী মায়ারানির শুভবিবাহ সুসম্পন্ন করার একটা দিনক্ষণ বার করলেন। তখনও পাত্র-পাত্রীর চাক্ষুষ দেখা হয়নি। শ্রীমান প্রশান্তকুমারের মনে মনে বোধহয় পাত্রীকে দেখার একটা সুপ্ত বাসনা ছিল। কিন্তু বেচারা মিলিটারী চাকরি থেকে বিয়ের আগে প্রয়োজনীয় ছুটি না পাওয়ায় সে ইচ্ছা পূরণ করতে পারেনি। দাদা-দিদি-বৌদিদের পছন্দের ওপরেই ভরসা করতে হয়েছিল। অগত্যা বিয়ের দিন আমার মামারবাড়িতে পৌঁছে সে প্রানের বন্ধুকে পাঠালো ভিতর বাড়িতে গিয়ে একবার পাত্রীটিকে দেখে আসতে। বন্ধু এসে আস্বস্ত করলো পাত্রীটি বেশ ভালই। সুন্দরী। শ্রীমানের এতে কি চতুর্বর্গ লাভ হয়েছিল জানিনা। কারণ বিয়ে করতে এসে বিয়ের একঘন্টা আগে যদি জানা যায় পাত্রীটি খেঁদি-পেঁচি বিশেষ, তবে তো আর যাই হোক বিয়ে আটকায় না। যাই হোক বন্ধুর মুখে শুনে আস্বস্ত হয়ে শ্রীমান প্রশান্তকুমার প্রশান্ত মনে বিয়ে করতে বসলেন। বিয়ের দিন আর বিশেষ কিছু গন্ডগোল হয়নি। শুধু বিয়ে করতে করতে শ্রীমান প্রশান্তকুমার মাঝে মাঝেই অধৈর্য্য হয়ে পুরোহিতমশাইকে প্রতি পনের মিনিট অন্তর অন্তরই নাকি জিজ্ঞাসা করছিলেন আর কত পাতা মন্ত্র পড়া বাকি আছে? এই তথ্যটা আমায় আমার মায়ের সাপ্লাই দেওয়া।

এই বিয়ে সংক্রান্ত আর একটি মজার ঘটনা বলে শেষ করব। আমার এক জ্যেঠুর ইচ্ছে ছিল গাড়ি করে বিয়ে করে ফেরার। নিজের বিয়েতে সেই ব্যবস্থা তিনি করতে পারেননি। জ্যেঠিমার মুখে শোনা যে তাঁদের বিয়ের একটি বিশেষ প্রমান হলো একটা ছবি। যাতে দেখা যাচ্ছে সার সার রিক্সার পিছন দিক। আর ছবির পেছনে লেখা ১৯৬২। সুতরাং জ্যেঠু তাঁর আদরের ছোট ভাইয়ের বিয়েতে সেই সার সার রিক্সার পুনরাবৃতির যাতে না হয় তার জন্য পড়িমড়ি করে একখানা ambassador গাড়ির ব্যবস্থা করেছিলেন। পরের দিন নতুন বরকনেকে নিয়ে সেই গাড়িটি এসে পৌঁছালো আমাদের গ্রামের বাড়ির কাছে। তখন সেই ১৯৭৭ সালে গাড়ি চেপে বিয়ে করার রেওয়াজ বিশেষ ছিল না। বিশাল ভাই বোনেদের পরিবারে আমার বাবাই প্রথম গাড়িতে করে মাকে বিয়ে করে আনেন। আমার ঠাকুমার কাছেও গাড়ি বিষয়টি বিশেষ পরিচিত ছিল না। নতুন বরকনেকে গ্রামের মন্দিরে প্রনাম করে তবে ঘরে ঢোকার রীতি। গাড়িটিও নতুন বরকনেকে নিয়ে সোজা মন্দিরের সামনে এসে থামল। সেখানে ভিড় করে আছে বাড়ির বাকি সব লোকজন সঙ্গে আমার ঠাকুমাও। বরকনে মন্দিরে ঢুকে যাবার পরে আমার রসিক সেজজ্যেঠু তাঁর মা অর্থাত আমার ঠাকুমাকে নিয়ে খানিক মজা করার লোভ সামলাতে পারলেন না। তিনি আমার ঠাকুমাকে বললেন যে, "মন্দির থেকে তুমি কেন হেঁটে বাড়ি যাবে মা? গাড়িতেই চলে যাও, উঠে যাও গাড়িতে।" ঠাকুমা উঠে বসলেন গাড়িতে। জ্যেঠু হাঁ হাঁ করে উঠলেন। "কর কি? কর কি? ওখানে নয় ওপরে উঠে বসো।" ঠাকুমা আকুল হয়ে বললেন, "ও বেণী (জ্যেঠুর নাম ছিল বেনীমাধব), মাথা তুলতে পারছিনা যে। মাথা ঠেকে যাচ্ছে তো গাড়ির ছাদে।" জ্যেঠু গম্ভীর হয়ে বললেন, "তা তো যাবেই, গাড়িতে তো ওরকম করেই বসে হয়। তুমি গাড়িও চাপবে-মাথা সোজা করেও বসবে, দুটো তো একসাথে হবে না মা। ওভাবেই বসতে হয়। চুপ করে বসে থাক।" ঠাকুমাও ঘাড় গুঁজে বসে রইলেন। ঘটনাটা হলো, জ্যেঠু ঠাকুমাকে গাড়ির সিটে না বসিয়ে ব্যাকরেস্টের ওপর বসিয়েছেন সিটের ওপর পা রেখে এবং বুঝিয়েছেন যে গাড়িতে ওভাবেই বসতে হয়। বুঝিয়ে সুঝিয়ে জেঠু তো সরে পড়েছেন অকুস্থল থেকে। আর বেচারী আমার নির্দোষ ঠাকুমা তাঁর সারারাত বিয়ে করে -সারা সকাল জার্নি করে ক্লান্ত-রাগী ছোটোছেলেটির কাছে বকুনি টকুনি খেয়ে একসা।

এইভাবে সাড়ে চার ফুটের কুমারী মায়ারানী চক্রবর্তী সাড়ে পাঁচ ফুটের শ্রীমান প্রশান্তকুমারের হাত ধরে রাতারাতি নিজের চক্রবর্তীত্বের মায়া সম্পূর্ণ ত্যাগ করে শ্রীমতি মায়ারানী চট্টোপাধ্যায় হয়ে গেলেন। আর ভবিস্যতে পারফেক্ট average কম্বিনেশনের পুরোপুরি পাঁচফুটিয়া আমার জন্ম দিলেন।

0 comments:

Post a Comment