Sunday 27 July 2014

কম্পোজিশন

যাহ, ব্যাটারী শেষ ক্যামেরাটার। বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে লোকদুজন যে গাড়ি পরিস্কার করছিল সেই ছবিটা দূর থেকে জুমিং করে তুলবে ভেবেছিল দেহলী। কয়েক দিনের বর্ষায় চারিদিক সবুজ হয়ে উঠেছে। এখানে আর যাই হোক না হোক গাছপালার কোনো অভাব নেই। তাই ঝম ঝম বৃষ্টির মধ্যে সাদা রঙের গাড়িটাকে একজন সাদা আর একজন টুকটুকে লাল টি-শার্ট পরা লোকদুজন যখন দুদিক থেকে পরিস্কার করতে শুরু করলো তখন সবুজ পটভূমিতে সাদা-লাল আর ঝম ঝম বৃষ্টির এক সুন্দর জলছবি ফুটে উঠেছিল। জানলা দিয়ে সেই জলছবি দেখে দেহলীর মনে হয়েছিল, বাহ, বেশ পারফেক্ট কম্পোজিশন তো! কম্পোজিশন শব্দটা সে খুব ছোটবেলা থেকে জানে। সে যখন স্কুলে ভর্তি হয়নি প্রায় তখন থেকেই আঁকার মাস্টারমশায়ের মুখে শব্দটা শুনে শুনে শিখে গেছিল। যদিও মানে বুঝেছে অনেক পরে। ছবি আঁকতে আঁকতে মাস্টারমশাই তাকে আস্তে আস্তে দেখতে শিখিয়েছেন কেমন করে ঠিক করতে হয় ছবির কম্পোজিশন, পার্সপেক্টটিভ। দেহলী ছোট থেকেই দৃশ্যচিত্র বেশি আঁকত। কেন কে জানে। বোধহয় অন্য কিছু মনের মত করে আঁকতে পারত না তাই। কিংবা ছোটো থেকেই চারপাশের দৃশ্যপট ঠিক নিজে যেমনটি চায় তেমনটি করেই সাজাবার একটা প্রবণতা অবচেতনে ছিল তাই। তার ফলে ধীরে ধীরে আর কিছু হোক না হোক দৃশ্যচিত্রের কম্পোজিশন এবং পার্সপেক্টটিভ এর একটা মোটামুটি স্বচ্ছ ধারণা তৈরী হয়ে গেছিল অনেক ছোট বয়সেই। এই মধ্য তিরিশে এসে রং তুলির চেয়ে যদিও ক্যামেরাটাই হাতে আসে বেশি, তবু সেই ছোটবেলার ল্যান্ডস্কেপ আঁকা আর তার কম্পোজিশন, পার্সপেক্টটিভ এর ভূত এখনো তার ঘাড় থেকে নামেনি। তাই সে এখনো ক্যামেরাদিয়েই সাজাতে চায় তার মনমত দৃশ্যচিত্র।

সাদারঙের গাড়ি আর তার দুপাশের লাল- সাদা টি- শার্টের লোক দুজনের অবস্থান ধরে রাখতে ক্যামেরা অন করতেই ডিসপ্লে দেখালো ব্যাটারী শেষ। পারফেক্ট কম্পোজিসনটা আর ধরে রাখতে পারল না দেহলী। এই হয় ওর সাথে। আর ও জানে এর জন্য ও-ই দায়ী। কাল বারান্দা থেকে সূর্যাস্তের ছবি তোলার সময়ই দেখেছিল ব্যাটারি লো, গড়িমসি করে চার্জ দেওয়া হয়ে ওঠেনি। আসলে সে ভাবেই নি যে, ছুটির দুপুরে এরকম ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি নামবে আর সে এরকম একটা কম্পোজিসন পেয়ে যাবে তোলার জন্য। অনেক কিছুই তার এই অহেতুক আলসেমির জন্য এরকম ভাবেই বেরিয়ে যায় হাত থেকে জানে সে। কিন্তু তাও মাঝে মাঝে তাকে যে কি আলসেমির ভূতে চেপে ধরে কে জানে। দেহলীর অবশ্য ভালই লাগে এই সময়গুলো, যখন হাতে বেশ খানিকটা কাজ থাকা সত্বেও সে চুপ করে বুঁদ হয়ে নিজের মধ্যে ডুবে থাকে। আশে পাশে লোকজন থাকলে হয়ত ভাবে তার মন খারাপ। প্রথম প্রথম দেহলী তাদের বোঝাতে চেষ্টা করত যে তার কিছুই হয়নি। তাতে সকলে ভাবত যে, সে কোনো কারণে রেগে আছে কারো ওপর। অবশ্য ভাবাটাও কিছু অস্বাভাবিক নয়, কিন্তু তার আজকাল আর এসব কথায় লোকজনকে আর শুধরে দিতেও ইচ্ছে করে না। তাতেও কেমন একটা আলসেমি পেয়ে বসে তাকে। মনে হয় ঠিক আছে থাক না। বুঁদ হয়ে বসেই থাকে, বসেই থাকে যতক্ষণ না চারপাশ চঞ্চল হয়ে উঠছে।

এখনও যেমন বৃষ্টি ভেজা দুপুরে ফাঁকা ঘরে বেয়াদব এক আলসেমি পেয়ে বসেছে তাকে। ক্যামেরাটার ব্যাটারী জবাব দিতে কিছুক্ষণ বৃষ্টির মধ্যে বাইরে তাকিয়ে রইলো সে। চারপাশ সাদা করে বৃষ্টি পড়ছে। ব্যালকনির দিক থেকে বৃষ্টির ছাঁটে ভিজে যাচ্ছে পুরু পাপোষটা। শোকাতে অন্তত তিনদিন লাগবে। ওটা সরিয়ে নিতে হবে, হাতের ক্যামেরাটা চার্জে লাগাতে হবে, দুপুরে খাবার পর রান্নাঘরে ঢোকা হয়নি-টুকিটাকি অনেক কাজ এইবেলা সেরে ফেললে ভালো হয়, ফ্রিজে চিকেনপিসগুলো অনেকক্ষণ থেকে ম্যারিনেটেড হচ্ছে- এবার রান্না না করলেই নয়। এইসব ভাবতে ভাবতে দেহলী ক্যামেরাটা কোলে নিয়ে আস্তে আস্তে বসেই পড়ল ঘরের মেঝেতে। ব্যালকনিতে ঝুপ-ঝুপ বৃষ্টি পড়ছে। জল বেরোনোর নালীটা ঠিকঠাক না হওয়ায় চট করে জল বেরোয়না খোলা ব্যালকনিটা থেকে। ফলে জোরে বৃষ্টি পড়লে বেশ পায়ের পাতা ডোবা ছিপছিপে জল জমে ব্যালকনিতে। তার ওপর বড় বড় বৃষ্টির ফোঁটা পড়লে কেমন যেন তার বাড়ির পাশের ডোবাটার কথা মনে পড়ে যায়। বৃষ্টি হলেই বাড়িতে থাকলে দেহলী সোজা গিয়ে ডোবাটার দিকের জানলায় গিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ত। জলের মধ্যে বৃষ্টির ফোঁটা দেখতে তার খুব ভালো লাগে। মাঝে মাঝে বর্ষাকালে বড়পুকুরে স্নান করতে গেলে বৃষ্টি পড়তে শুরু করলে সে উঠে আসতেই চাইতো না পুকুর থেকে। একবুক জলে দাঁড়িয়ে ভিজত। ব্যালকনির ছিপছিপে জলের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে দেহলির মনে হলো কতদিন সে পুকুরে সাঁতার কেটে স্নান করে না, কত দিন সে জানলায় দাঁড়িয়ে জলের ওপর বৃষ্টি পড়া দেখেনি। এবার বাড়ি গেলে যদি বৃষ্টি নামে সে নিশ্চয়ই বড়পুকুরে একবার স্নান করতে যাবে। মা সেদিন তাকে ফোনে বলছিল আজকাল নাকি কেউ পুকুরে স্নান করে না, সকলের ঘরে ঘরে পঞ্চায়েত থেকে জলের ব্যবস্থা করে দিয়েছে। যে যার ঘরেই স্নান সেরে নেয়। তাদের গ্রামটাও আস্তে আস্তে শহর হয়ে যাচ্ছে। তাতে অবশ্য সকলের সুবিধাই হচ্ছে। দেহলী বোঝে সে কথা। তার ছোটোবেলায় মনে আছে গরমকালে সকাল দশটা থেকে বারোটা পর্যন্ত বড়পুকুরে স্নান করতে গেলে অনেক সময় ঘাটে সাবান-গামছা নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে হত। একদল স্নান করে উঠলে আর একদল নামবে। বড়পুকুরের জল ভালো, সারাদিন রোদ পায়। ওই জলে স্নান করলে কারো শরীর খারাপ হয় না তাই সক্কলে ওখানেই আসত স্নান করতে। ওই পুকুরেই পিতলের কলসী ধরে সাঁতার শিখেছে দেহলী। বেশ ছোট থেকেই বড়পুকুর পারাপার করতে পারে সে। আর সেই নিয়ে সেই ছোট বয়সেই বোধহয় তার একটা চাপা গর্বও ছিল। নইলে বাড়িতে কেউ বেড়াতে এলেই সে নিজের সাঁতারের পারঙ্গমতা দেখাতে অতিথিকে নিয়ে সোজা স্নানের সময় বড়পুকুর চলে যেত কেন? এত বছর পর সেসব বোকামির কথা মনে পড়ে যেতে ঘরের মেঝেতে বসে ঠোঁটের কোনে একচিলতে হাসি এলো দেহলীর। আজন্ম হাঁদা সে।

চোখে মুখে বৃষ্টির ছাঁট আসছে দেহলীর। ক্যামেরাটাকে হাত দিয়ে যথাসাধ্য আড়াল করে চুপ করে বাইরের দিকে তাকিয়ে বসে আছে সে। দেখছে মোটা পাপোষটা ক্রমশঃ ভিজে চুপচুপে হয়ে উঠছে। পরে ওটা তাকেই উল্টে পাল্টে শুকনো করতে হবে। তাও উঠে গিয়ে পাপোষটা সরিয়ে নিতে ইচ্ছে হলো না। একসময় টমির পায়ের ঠেলায় সম্বিত ফিরল দেহলীর। টমিটা ঘরের মেঝেতে শুয়ে সেই কখন থেকে ঘুমোচ্ছে। দুপুরে খেতে বসার আগেই ওকে খাইয়ে দিয়েছে সে। সেই থেকে এপাশ-ওপাশ করে ঘুমোচ্ছে। পাশ ফিরতে গিয়ে দেহলীর গায়ে পা ঠেকেছে বিচ্ছুটার। শোবার জায়গা কম পড়তে পা দিয়ে ঘুমের ঘোরেই ঠেলছে দেহলীকে। একটু গায়ে হাত বুলিয়ে আদর করে দিল দেহলী টমিকে। গায়ে একটু আধটু পোকা হচ্ছে টমির। দেখতে পেলে তুলে ফেলে দেয় দেহলী। বজ্জাতটা বাইরের কুকুরদের সাথে মারামারিতে পারে না, তাও রাগ দেখানো চাই। শেষে মার খেয়ে পায়ে ক্ষত নিয়ে ফিরে এসেছে। যদিও নিজেই চেটে চেটে ভালো করে এনেছে। টমিকে একবার ডাক্তারখানা নিয়ে যেতে হবে। তাও হচ্ছে না। সবেতেই আলসেমি তার। টমির পেটে একটা মাঝারি গোছের নির্দোষ টিউমার আছে। দেহলীর এক জ্যেঠুর পিঠেও ওরকম একটা টিউমার আছে। ছোটোবেলায় সেটা সে যথেচ্ছ টেপাটেপি করত, কারণ টিপলে তাতে আঙ্গুল বসে যেত আবার কিছুক্ষণ পর ঠিক হয়ে যেত। সেটা বেশ একটা মজার খেলা ছিল তার। জ্যেঠুও কিছু বলতেন না তাকে। টমির পেটের এই টিউমারটা দেখলেই সেটা মনে পড়ে যায় দেহলীর। টমিকে ঠেলে সরাবার চেষ্টা করলো সে। ঘুমের ব্যাঘাত হতে রাগী গলায় গোঁ-গোঁ করে বিরক্তি প্রকাশ করলো টমি।

বৃষ্টিটা কমে এসেছে। বারান্দায় সব জামাকাপড় ভিজেছে। তোলেনি দেহলী। বৃষ্টি থামলে দেখা যাবে। আস্তে আস্তে টমির পিঠে হাত বোলাতে বোলাতে মৃদু গলায় গাইতে শুরু করলো 'জীবন মরণের সীমানা ছাড়ায়ে বন্ধু হে আমার রয়েছ দাঁড়ায়ে'। বেশ কয়েকটা গান দু-চার লাইন করে গেয়ে মনটাকে যখন ফিরে পেল দেহলী বৃষ্টি তখন যাব যাব করছে। বারান্দায় ছোট্টো টবের পুঁচকে গাছটা চকচকে হয়ে উঠেছে। জামাকাপড় শুকনো করার ক্লিপ গুলো থেকে টুপ টুপ করে ঝরছে জল। আরও কিছুক্ষণ বুঁদ হয়ে নিজের মধ্যে ডুবে রইলো দেহলী। শেষে ছাতার পাখিরা যখন চেঁচামেচি করতে করতে তার ব্যালকনিতে হুটোপুটি করতে শুরু করলো তখন একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে উঠে দাঁড়ালো সে। ব্যালকনিতে পাতলা  রোদ। ক্যামেরাটা চার্জে লাগাতে লাগাতে চোখ গেল পাশে রাখা ইজেলটার দিকে। ধুলো জমেছে। অনেক দিন আঁকে না সে। আলতো করে হাত বোলালো ইজেলটার গায়ে। এসময় হঠাতই যেন ভেতর থেকে একটা তাড়া অনুভব করলো দেহলী। ক্যামেরাটা ঝটপট প্লাগে লাগিয়েই ফ্রিজ খুলে চিকেনসমেত কৌটোটা নিয়ে রান্নাঘরে যেতে যেতে দেখল টমিটা কুন্ডলী পাকিয়ে শুয়েছে। বৃষ্টি হয়ে একটু ঠান্ডা হয়েছে আবহাওয়াটা। শীত করছে বোধহয়। টমির মাথায় একবার হাত বুলিয়েই গুন গুন করতে করতে রান্না ঘরের দিকে চলল দেহলী। চটপট সব কাজ সেরে নিতে হবে তাকে। আজ দেহলী অনেকদিন পরে ছবি আঁকবে একটা। তার মনের মতন সুন্দর একটা দৃশ্যচিত্র। যেমন সে আঁকত আগে পারফেক্ট একটা কম্পোজিশন। ঠিক সেরকম।                  

0 comments:

Post a Comment