Friday 1 August 2014

বরেকালা

ওয়েদার রিপোর্ট বলছে এখন নাকি প্রবল বর্ষাকাল। হরিয়ানায় নাকি মুহুর্মুহু বৃষ্টি হচ্ছে। হবে হয়ত! আমি তো ছিটেফোঁটাও প্রসাদ পাচ্ছি না। বাড়িতে থাকলে বৃষ্টিটাকে আস্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ঘুমোনো যেত। যাই হোক সে যখন সম্ভব নয় তখন আর কি করা যাবে? বৃষ্টির স্মৃতিচারণের ঘোলই খেতে হবে।অনেকদিন আগের এক বৃষ্টির সন্ধ্যের কথা মনে পড়ে যাচ্ছে। বছর কুড়ি আগে যখন আমাদের পুঁচকে গ্রামে মাসের মধ্যে তিন মিনিটের বৃষ্টি-আড়াই মিনিটের ঝড়-কোদালে অমাবস্যা-চড়ক ষষ্ঠী-ইলেকট্রিক অফিসের বড়বাবুর সেজজামাই এর জন্মদিন ইত্যাদি ইত্যাদি বিভিন্ন জরুরি কারণ উপলক্ষ্যে একাদিক্রমে দেড়দিন-দুদিন ধরে ইলেকট্রিসিটি থাকত না তখন কার কথা বলছি। তখন আমি ক্লাস ফাইভ বা সিক্স এ পড়ি। আমার বাবা লোকজনের চিঠি-চাপাটির ঠিকঠাক বিলি ব্যবস্থা করতে ইন্ডিয়ান পোস্টাল ডিপার্টমেন্টে একদিন অন্তর রাত জাগছেন। আর আমার মা আমাকে ইতিহাস-ভূগোল-বিজ্ঞান-অঙ্ক-বাংলা-ইংরাজিতে পন্ডিত করে তুলতে গিয়ে প্রতি সন্ধ্যেতে আমার এই মোটা মাথা নিয়ে হাবুডুবু খাচ্ছেন। এরকমই একদিনে ইলেকট্রিসিটি নেই, আগের দিন বেশ ঝড়-বৃষ্টি হয়েছে। সেদিনও টুপটাপ ঝরছে। মা টুকটাক রান্নাবান্না করছেন আর আমি হ্যারিকেনের আলোয় রান্নাঘরেই বসে ঘেমে নেয়ে মায়ের বকুনি আর মশার কামড় খেতে খেতে বই খাতা খুলে ল্যাজেগোবরে হচ্ছি।

এমনসময় এলো পার্বতী বৌদি। কালোকোলো, বেঁটে-খাটো, সদাসর্বদা হাস্যমুখের এই ভদ্রমহিলা আমাদের বাড়িতে দুধের যোগান দিতেন অনেকদিন। সেদিন বৃষ্টি পড়ছিল আর লোডশেডিং। পার্বতিবৌদী বাড়ি যেতে পারছিলেন না। বৃষ্টি থামা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হচ্ছিল। তো সেদিন মায়ের বোধহয় কাজকর্ম শেষ হয়ে গেছিল। তাই মাও পার্বতিবৌদির সাথে টুকিটাকি গল্পগাছা শুরু করলেন। আর লোডশেডিং এর মধ্যে আমায় খাতা পেন্সিল নিয়ে যত্পরোনাস্তি গলদঘর্ম হতে দেখে হয়ত মনে কিঞ্চিত দয়া হয়েছিল তাই খানিক পরে আমি যখন পড়া ছেড়ে গুটি গুটি পায়ে মায়েদের গল্পের মধ্যে এসে দাঁড়ালাম মা বিশেষ কিছু বললেন না। ফলে আমিও হাঁপ ছেড়ে নিবিষ্ট মনে পেন্সিল চুষতে চুষতে পার্বতিবৌদির আগের দিনের ঝড় বৃষ্টির মধ্যে বাড়ি পৌছানোর এডভেঞ্চারের গল্প শুনতে লাগলাম।

বৌদি বলতে লাগলেন-

--"কাল কত রাতে গেছি বাড়ি জানো কাকিমা?" (আমার মাকে কাকিমা বলতেন পার্বতীবৌদি)
--"কখন গেলে? তুমিতো বেরোলে আর তার সঙ্গে সঙ্গেই প্রায় বৃষ্টি নামল।"
--"আর বোলো নি, আমি তো স্বপনদাদের ঠাকুর দালানে দাঁড়িয়ে ছিলুম। কি ঝড় বৃষ্টি বাপরে বাপ! একা একা দাঁড়িয়েছিলুম কি ভয় করছিল কি বলব। কি জোর জোর বিদ্যুত চমকাচ্ছিল বলো ? শেষে একটা বরেকালা এসে দাঁড়ালো। তার পর বৃষ্টি কমতে সেই তো আমায় টর্চ দেখিয়ে বাড়ি অবধি পৌঁছে দিল। "
মা প্রচন্ড অবাক হয়ে বললেন, "কে পৌঁছে দিল?"
--"ওই যে বরেকালাটা, যে দাঁড়িয়েছিল এসে।"
--"ব-রে-কা-লা?"-মা খুব অবাক হয়ে আমার দিকে তাকালেন। যদি আমি কিছু উদ্ধার করতে পারি। কিন্তু আমারও বোধগম্য হলো না ব্যাপারটা।
আমাদের দুজনকে অকূল জলে পড়ে খাবি খেতে দেখে পার্বতীবৌদি উদ্ধারকর্ত্রী রূপে মাঠে নেমে পড়েন।
--"আরে বরেকালা জাননি ই ই ই ই?" আমাদের অজ্ঞতার সীমা পরিসীমা নাই দেখে বৌদি যারপরনাই অবাক হন।
--"আরে বরেকালা গো, যারা বরেক বিককিরি করে।"
আমাদের কাছে তো 'বরেক', 'বরেকালা' দুটোই সমান হিব্রু লাগছে। কি বলছে রে বাবা! 'বরেকালা' টা আবার কি?
বৌদি আবার বলেন "বরেক গো.....বরেক জাননি?"
এই ভাবে প্রায় চার পাঁচ মিনিট ধরে বৌদি প্রাণপণে 'বরেক' জিনিসটা সম্পর্কে নানা তথ্য দিতে থাকেন। তাতেও আমাদের বোধদয় না হতে দেখে শেষে খানিকটা হল ছেড়ে দিয়েই বলে ওঠেন, "আ গো তোমাদের পাড়ায় যে বরেক কল আছে নি, সেখানে যে বরেক তৈরী হয়, সেই বরেক।"

"হা ভগবান !!!!!! বরফ? তাই বল।" মা বলেন। আমিও "হরি হে" বলে হাঁপ ছেড়ে বাঁচি। এতক্ষণ দুজনে নিজেদের অজ্ঞতার পাথারে সাঁতরে কূল পাচ্ছিলাম না।

ব্যাপারটা হলো, আমাদের পাড়ার মোড়ে একটি বরফ তৈরী করার ছোটো কারখানা আছে। সেই যার কথা আমি আমার ছোটবেলার স্বর্গীয় সব খাবার দাবারের কথা বলতে গিয়ে বলেছিলাম না আপনাদের? সেই বরফকল থেকে অনেকে সকালে একটা বড় কাঠের বাক্স করে নানারকম কাঠি আইসক্রিম নিয়ে দিগ্বিদিকে বেরিয়ে পড়ত বিক্রি করতে। সন্ধ্যে বেলায় বরফকলে ফিরে বাক্স রেখে টাকা পয়সার হিসেব নিকেস করে বাড়ি ফিরত। সেরকমই একজন সেদিন বৃষ্টিতে আটকে পড়েছিল পার্বতী বৌদির সাথেই। তাকেই বৌদি এতক্ষণ ধরে 'বরেকালা' 'বরেকালা' বলে চলেছিলেন। বলতে চেয়েছিলেন বরফওয়ালা > সেখান থেকে বরফালা > সেটিও পরিবর্তিত হয়ে 'বরেকালা'-র চেহারা নিয়েছিল। শব্দের কি সাংঘাতিক পরিবর্তন একবার ভাবুন!           

0 comments:

Post a Comment