Sunday 24 August 2014

ফেরা -১

বুড়োবটতলার চাতালে বসে আনমনে ডান হাত দিয়ে বাঁ হাতের কব্জির বোতামটা ঘোরাচ্ছিল নবকুমার। একটু খিদে খিদে পাচ্ছে। এবার বাড়ি যেতে হবে। সেই কোন সকালে ‘ধুত্তেরি’ বলে বেরিয়ে এসেছে। তারপর ঘোষপুকুরের পাড়ে বসেছিল ঘণ্টাখানেক। নানান এদিক ওদিকের চিন্তা কাজ করে চলেছিল তার মাথার মধ্যে। চমক ভাঙল অতসীর ডাকে। ‘কি গো নবদা, এখানে পুকুরপাড়ে ভূতের মত বসে আছো কেন?’ চমকে উঠে নব বলেছিল ‘ওহ! তুই এখানে?’ হাতের কাপড়চোপড় সামলে গায়ের আঁচলটা ডানদিকে পেঁচিয়ে নিয়ে অতসী বলেছিল ‘আমিতো রোজই এমনসময় এখানে চান করতে আসি। তুমি এই বর্ষাকালের বনবাদাড়ে বসে কি করছ বল দেখি। কোথায় কি আছে তার ঠিক নেই এই বর্ষায়।’ নব কিছু একটা মনগড়া এদিক ওদিক উত্তর দিয়ে কোনোমতে জিজ্ঞ্যাসা করেছিল ‘কেমন আছিস?’ কেমন যেন আলতো হেসে উত্তর দিয়েছিল অতসী ‘যেমন দেখছ।’ সিঁথির আবছা হয়ে আসা সিঁদুরের দাগ, চোখের কোলে কালি, সবুজ রঙের জংলাছাপ শাড়ীতে কেমন যেন জট পাকিয়ে গেছে অতসীটা। কিন্তু তাও অতসীর চোখের দিকে সরাসরি তাকিয়ে কথা বলতে পারেনি নব। কোনদিনই স্বছন্দে কথাবলা হয়ে ওঠেনি নবর অতসীর সঙ্গেসেই যখন সে বসন্তপুরের মাঠ পেরিয়ে হাইস্কুলে যেত আর অতসী ঝুঁটি নাড়িয়ে তার সাথে তিলের খাজার ভাগ নিয়ে ঝগড়া করত তখনও সে পারত না ওর সাথে কথায়। আবার কলেজ থেকে সপ্তাহান্তে বাড়ি ফিরে সত্যকাকার কথায় যখন সে ক্লাস নাইনের অতসীকে পড়াতে যেত তখনও তার মুখের দিকে তাকিয়ে স্বছন্দে কথা বলতে পারত না সে। সে নিয়ে কম টিটকিরি করেনি ছটফটে অতসী। বছর পাঁচেক আগেও যখন সে বাড়ি আসতে বড়বৌদি বলল, ‘তোমার ছাত্রীর তো পাত্তর ঠিক হইছে গো, আসচে মাঘে, বড়োলোক শউরঘর, হাবিবপুর বাজারে দোকান, চালকল।’ অবাক হয়ে নব প্রশ্ন করেছিল ‘সেকি? ও পরীক্ষা দেবে না? ইলেভেনে এত ভাল করে পাশ করল, আর কমাস বাদেই তো ফাইনাল পরীক্ষা!’ চোখ ঘুরিয়ে বড়বৌদি বলেছিল ‘আরে রাকো তোমার ফাইল্যান পরীক্কাওকি তোমার মতন কলিকেতায় থেকে পাশের পর পাশ দিবে নাকি? মেয়েছেলে, একটা পাশ দিছে আবার কি? ছেলের বাপ এসে পচন্দ করে গেছে, ছেলের বয়স একটু বেশি, তা হোক, এত বড়লোক।’ আস্তে করে নব জিজ্ঞ্যাসা করেছিল ‘অতসী রাজি? ও পরীক্ষা দেবে না বলেছে?’ ‘আরে, সে ছুঁড়ি তো কেঁদে-কেটে একশা, কাকী এসে বলতে তো আমি গেলুম। তা কে শোনে কার কতাবল্লুম ওরে অতী, মেয়েছেলে, রান্নাবান্না করে সোয়ামী- পুত্তুরকে খাওয়াবি, শউর-শাউরির যন্নআত্তি করবি, আর কি? কত্ত বড়লোক তোকে যেচে পছন্দ করেচে বল। এত কমে তোর বাপ তোকে পার কত্তে পারবে? একটা মোটরসাইকেল, চল্লিশ হাজার আর যা গয়নাগাঁটি, সে ধর না কেন তোর নিজেরই রইল। এর চেয়ে কমে হয় তুমিই বলনা? ওই ত ভুশুণ্ডি রঙ গায়ের। তা মেয়ে শুনলে তো। শুধু বলে পরীক্কাটা হয়ে যাক অন্ততঃ। আরে বারো কেলাসের সারটিফিট নিয়ে কি তুই ধুয়ে খাবি রে হতভাগী।’ সেবারও মনে আছে নবর ফেরার সময় সত্যকাকাকে প্রনাম করার জন্যও অতসীদের বাড়ি যাওয়া হয়নি। পাছে অতসীর সাথে দেখা হয়ে যায়। তারপর তো এই দেখা । প্রায় বছর পাঁচেক মাঝে। নব এর মধ্যে কলেজ-ইউনিভার্সিটি পেরিয়ে গেছে। নিজেই সে এখন একটা কলেজে পড়াচ্ছে আজ সাত- আট মাস হল। চাকরিটা পেয়েই সে এসেছিল বাড়িতে একবার দুদিনের জন্যতারপর তো এই প্রায় মাস পাঁচেক বাদে বাড়ি এসেছে সে। ইচ্ছে ছিল সপ্তাহ দুয়েক থাকার। সেইমত ছুটিছাটারও ব্যবস্থা করে এসেছে সে। অনেকদিন পর বাড়ি, ছোটবেলাকার মাঠঘাট বড় টানছিল তাকে। কিন্তু দিন চারেক যেতে না যেতেই আর ভাল লাগছে না নবর। বসন্তপুর হাইস্কুলের প্রণববাবু একবার পড়াতে পড়াতে তাকে বলেছিলেন শিক্ষা দান করার জিনিস জানো নবকুমার। যা জানো পারলে অন্ততঃ আর একজনকেও দিয়ে যেয়ো। শুধু বই পড়া বিদ্যে নয়, জীবনের শিক্ষা বুঝলে? তখন সেই বয়সে বিশেষ কিছুই বোঝেনি নব। এখন কলেজে ছাত্রপড়াতে গিয়ে কিছুটা বোধহয় বুঝতে পারে সে সেদিন প্রণববাবু কি বলতে চাইছিলেন তাকে। কলকাতার কলেজের ছাত্রছাত্রীদের বা অন্যান্য মাষ্টারমশাইদের মাঝে নিজেকে কেমন যেন বেমানান মনে হয় নবর। শহরের ফ্যাশান, কথাবার্তার চালিয়াতি, অর্থের প্রদর্শনী সবেতেই সে আজও সেই কোন অজগাঁয়ের ছেলে হয়ে রয়ে গেল। এইসব ছাত্রছাত্রীদের সে কি পড়াবে, কি ভাবেই বা পড়াবে বুঝে উঠতে পারে না সে। সে সাহিত্যের ছাত্র ছিল। আজও বাংলা সাহিত্যের রূপ-লালিত্যর সঙ্গে পরিচয় করাতে চায় তার ছাত্র ছাত্রীদের, সাহিত্যের প্রতি ভালবাসা তৈরি করাতে চায়কিন্তু এই সাত মাসে সে পুরোপুরি ব্যর্থই বলা যায়। কেউ চায় না জানতে নিজের ভাষাকে, তার ইতিহাসকে। কারণ এপথে সহজে অনেক টাকা রোজকার করা যায় না যে। ছেলেমেয়েরা কলেজে আসে, নতুন নতুন নানান ফ্যাশানের জামাকাপড় পরে, নামি দামি জায়গায় কফি খায়, বিদেশি সিনেমা দেখে আর যে দুচার জনকে সে বইপত্তর পড়তে দেখেছে তার সবই প্রায় বিদেশি উপন্যাস। মুখচোরা লাজুক নবকুমার এই শহুরে মিশ্র সংস্কৃতিতে ঠিক মানিয়ে নিতে পারেনি এখনও। হয়ত সময়ে সবই সয়ে যাবে। কে জানে? ভেবেছিল দুদিন বাড়িতে এসে জিরিয়ে নেবে। কিন্তু পৃথিবী বদলাচ্ছে, আর তাদের এই গৌরাঙ্গনগর বদলাবে না তাতো হয়না। হলেই বা ধাদ্দেড়ে গোবিন্দপুর, কলকাতা থেকে ট্রেনে আসতে অন্ততঃ ঘণ্টাতিনেক সময় লাগে, ট্রেন থেকে নেমে বাস, তারপর আবার ভ্যান। এখানেও সুস্থ ভাবে বাঁচতে দেবেনা এরা একটা বাচ্চাকেও। ঘুম থেকে উঠেই আজ জোলা পাড়ায় শীতলা পূজোয় তারস্বরে মাইক বাজতে শুনল সে, ‘মুন্নি বদনাম হুয়ি’, আর তার সাথে বড়দার সাত বছরের পুঁচকে মেয়ে টুকি সাত সকালে খামারে দাঁড়িয়ে কি বিশ্রী ভঙ্গিতে নাচ সেই দেখে হেসে ঢলে পড়ছিল বড়বৌদি আর কুসমী। কুসমীটাকে জন্মাতে দেখল নব। অথচ কি অশ্লীল বাচালতা চোখেমুখে এরই মধ্যে। অতসীরই তো বোন, কিন্তু কি আকাশপাতাল তফাত দুজনের। টুকির জন্য সে এবার আসার সময় অবন ঠাকুরের রাজকাহিনী কিনে এনেছে। সে এসে থেকে অনেক ভাবে চেষ্টা করেছে রাজকাহিনীর গল্প বলে মেয়েটার খানিকটা বইপড়ার নেশা ধরানোর। কিন্তু কদিনে বেশ বুঝে গেছে রাজকাহিনী আপাদমস্তক হেরে ভূত হয়ে গেছে ‘মুন্নি বদনাম হুয়ি’-র কাছে। টুকি, কুসমী এদের কাউকেই বোধহয় আর বাঁচানো যাবে না। প্রণববাবুর কথাটা ইদানীং বড় খোঁচাচ্ছে তাকে। সত্যি কি তার বিদ্যেটুকু কাউকে দিয়ে যেতে পারবে? কলকাতার ছাত্রছাত্রীরা বা কুসমী বা টুকি বা এদের মত কেউ কি সত্যিই চাইবে তার কাছে কিছু জানতে? সে কি পারবে তাদের মনে জানার ইচ্ছেটা জাগাতে? পেরেছিল একজনের মধ্যে কিন্তু সে তো আজ তার আবছা সিঁদুর আর বছর তিনেকের রুগ্ন বাচ্চা নিয়ে বাপের বাড়িতে ফিরে আসার অপরাধে সকলের করুনা আর লাঞ্ছনার পাত্রী।


বোতামটা ঘোরাতে ঘোরাতে বুড়োবটতলায় বসে এইসবই ভাবছিল নবকুমার। বোতামটা আলগা হয়ে খুলে এল হাতে। খানিকক্ষণ বোতামটার দিকে তাকিয়ে একটা ছোট নিঃশ্বাস ফেলে ঘড়ি দেখল নব। নাহ আর অপেক্ষা করবেনা সে অনেক বেলা হয়েছে, এবার বাড়ি না গেলেই নয়। সে এসেছে বলে বাবা আজ মিটিং এ যায়নি। টুকটাক কাজ করছে ঘরেই আর অপেক্ষা করছে একসাথে দুপুরে খাবে বলে। মাও রান্নাবান্না করেছে একাহাতেইপকেটে বোতামটা রেখে উঠে পড়ল নব। সাইকেলটা ঘুরিয়ে নিয়ে সিটে উঠতে গিয়ে দেখল দূরে মাঠের রাস্তায় একটা মোটর সাইকেল আসছে। বিকাশ নাকি? চোখ কুঁচকে ওইদিকে তাকিয়ে একটু অপেক্ষা করল নব। বিকাশই মনে হচ্ছে। বিকাশই কাল তাকে বলেছিল আজ এখানে অপেক্ষা করার জন্য। বিকাশের জন্য সে স্কুলে যাবার সময়ও এখানেই অপেক্ষা করত। তখন অবশ্য দুজনেই পায়ে হেঁটে, হাফপ্যান্ট আর একহাঁটু ধুলো নিয়ে প্রায় আধঘণ্টা হেঁটে বসন্তপুর হাইস্কুলে যেতো। বিকাশ এসে প্যাচ করে একমুখ গুটখার পিক ফেলে ভটভটি বন্ধ করে দাঁড়াল। একগাল হেসে বলল ‘কিরে নবু কদ্দিন বাদে দেখা। কেমন আছিস বল।’ নব বলল, ‘তোর দেরি দেখে তো আমি চলেই যাচ্ছিলাম।’ 


0 comments:

Post a Comment