-‘একটু দেরি হয়ে গেল ভাই। আরে শালা
হাবিবপুরের তারাপদ জানা, ওই যে রে শনিমন্দিরের পাশে হার্ডওয়্যারের গুদাম।
-‘হ্যাঁ, হ্যাঁ বুঝেছি।’
-‘সাড়ে সতের হাজার টাকার মাল নিয়ে তিন হাজার
টাকা ঠেকিয়ে শালা একমাস ধরে ঘোরাচ্ছে। আজকে শালা বহুত ক্যাচাল হয়ে গেছে। সেই সকালে
গেছি। এই করতে গিয়েই তো দেরি হয়ে গেল। যাক গে ছাড়, কেমন আছিস বল। শালা চাকরি পেলি
খাওয়াবি কবে? মালকড়ি ছাড়। ষ্টেশনের পাশে নতুন হয়েছে একটা একদম আসলি মাল, ফরেন। চল
আজ সন্ধ্যেবেলা বেরোই, বাইক তো আছেই।’
- ‘ধুস কি যে বলিস? আমি কি খাই? তুই ত
জানিস। এমনি কি খাবি বল না খাওয়াব।’
-‘এখনও খাস না? তুই শালা বদলালি না। থালে আর
কি? মুড়ি পেঁয়াজি, অনেকদিন পেঁয়াজি খাওয়া হয়নি কাকিমার হাতে, যাবখন সন্ধ্যেবেলা।
কেমন আছেন রে কাকিমা? অনেকদিন যাওয়া হয় না তোদের ওপাশে।’
-মা আছে একইরকম, খাটাখাটনি, দাদুর বয়স
হয়েছে, তাঁকেও নজর দিতে হয় আজকাল।
-দাদুর আবার কি হল? মাঠে দেখি তো মাঝে মাঝে।
-হ্যাঁ যায় তো মাঠে রোজই, এই বয়সে, বললে তো
শোনে না। মায়ের কথাই যা একটু শোনে টোনে। তাই মাকেই দেখতে হয়। তাছাড়া ঘরের কাজ
গোয়ালের কাজ সবই তো আছে।
-হ্যাঁ তা যা বলেছিস, দেবুদার বৌটাকে তো
বাইরেই বেশী দেখি। সেদিন তো আমাদের পাড়ার মোড়ের গেঞ্জিকলের সামনে দেখি গেঞ্জিকলেরই
দুটো চ্যাংড়া ছেলের সাথে দাঁড়িয়ে খুব হাসছে। সাথে বাচ্চাটাও ছিল। তোর বৌদি কি
গেঞ্জি কলে কাজ নিয়েছে নাকি রে? মাঝে মাঝে দেখি আমাদের পাড়ায়।
-হ্যাঁ, তাই তো শুনছি এসে। বড়দার তো সেরকম
কোন......মানে জানিসই তো।
-তোদের ঘরের বউকে সেজন্যে কাজে যেতে হবে?
দেবুদাকে তো দেখি রাধেশ্যাম হাজরার কোঁচা ধরে লটকে আছে সারাক্ষণ। এই তো ভোটের আগে
লিফলেট বিলি করছে, মাইক নিয়ে বেরোচ্ছে, দিনরাত পার্টিঅফিসে পড়ে আছে। পঞ্চায়েত
অফিসে দশটা জল ছেঁচা মেসিন এসেছিল। শালা ভাবলুম একটা তুলব। দরখাস্ত দিলুম। তা
কোথায় কি! কারা যে পেল পাত্তাই পেলুম না। ফাঁকতালে দেবুদা কি করে যেন একটা পেয়ে
গেল। দিব্বি ভাড়ায় খাটাচ্ছে।
- তো তুই বড়দাকে বলতে পারতিস।
- ছাড়, তোর দাদার ব্যাপার আলাদা, বাপ
পঞ্চায়েত প্রধান, রাধেশ্যাম হাজরার ছাতা মাথায়। আরও নানা ব্যাপার আছে। তোর দাদা পাবে
না কি আমি পাব? আমি ওসব দুনম্বরির মধ্যে নেই। হলে হল না হলে না। তাই তো বলছি
দেবুদার বউএর গেঞ্জি কলে যাবার দরকার কি? ছেলে ছোকরা গুলোও সুবিধার নয়। তাদের সাথে
এখান ওখান যাওয়া, একদিন তো আমি বসন্তপুরের মেলায় দেখলুম।
- আমি মানে কি বলব বল?
-না না তোকে আমি এমনিই বললুম। বাদ দে, তোর
খবর বল, কলেজে পড়াচ্ছিস তোর তো ব্যাপার আলাদা রে নবু। বিয়ে ফিয়ে কর এবার একটা।
চুটিয়ে মস্তি হোক।
- আরে না না কই আর। এই তো সবে ঢুকলাম। আর
বিয়ে ফিয়ে.........বাদ দে।
-কেন বাদ কেন? প্রেম ট্রেম করছিস না?
-ধুর। আমার দ্বারা ওসব......।
-তা আমি জানি। তোর মুরোদে কুলবে না। নইলে
শালা অতসীটার এই দশা হয়?
- মানে?
- মানে জানো না? নেকুচরণ । তুই যদি
সত্যকাকাকে গিয়ে একবার বলতিস তবে ওর বিয়েটা আটকাত না? এই ভাবে শ্বশুরবাড়ির লাথি
খেয়ে বাচ্চা কোলে বাপেরবাড়ীতে পড়ে থাকত ও? মাথাটা কত পরিস্কার ছিল তুইই তো বলতিস।
- আমি কি করে ওর বিয়ে আটকাব বল? আমার কি
অধিকার?
-কেন? ওর বাপ মা তোকে পছন্দ করত না? না কি
তোর বাপ মা ওকে পছন্দ করত না? নাকি তুই ওকে পছন্দ করতিস না? সত্যি কথা বল।
-কিন্তু তখন আমি কলেজে পড়ি বিকাশ, আমি কি
করে......?
-তখন কেন? এখন করতিস। বলতিস ওর বাপ কে গিয়ে
দুচার বছর অপেক্ষা করতে। মেয়েটার দিকে তাকিয়ে দেখেছিস? কি অবস্থা করেছে শ্বশুরবাড়ীর
চামারগুলো? শালা স্বামীটা তো এক নম্বরের হারামি। হাবিবপুরের বাজারে তো আমারও কম
দিন হল না। প্রথম থেকেই অন্য মেয়ে নিয়ে ঢলাঢলি। বাজারে তো সবাই জানে। সত্যকাকা না
জেনেশুনে ফট করে সস্তায় জামাই পাচ্ছি ভেবে বিয়ে দিয়ে দিল। মারধর কম করেছে মেয়েটাকে?
শোনা ইস্তক মনে হচ্ছে সব তোর জন্যে।
-কিন্তু বিকাশ আমি তো কখনোও অতসীকে
কিছু...... মানে কিছু তো বলিনি কখনও।
-জানি তো, তা বলবে কেন? বললে ত মেয়েটা তাও
ভরসা পেত। বিয়েটা ঠেকানোর চেষ্টা অন্ততঃ করত। কিন্তু ও যে তোকে আকারে ইঙ্গিতেও
কিছু বলেনি এটা আমায় বিশ্বাস করতে বলিস নি। ব্যাটাছেলে হয়ে তোর মুখে যদি একটা
বাক্যিও না সরে ও মেয়েমানুষ কোন ভরসায় বাড়িতে বলে বল? তুমি কলকাতায় পড়ছ,
গৌরাঙ্গনগরের কালো অতসীকে ছেড়ে যে কলকাতায় কোনও অপ্সরীকে ধরে ফেলনি সেটা তুমি না
বললে সে বুঝবে কি করে?
-এখন আর এসব কথা বলে .........?
-না রে শালা মেয়েটাকে দেখলে কষ্ট হয়। আমার
হাতে থাকলে না প্রথম দিনই ওই সিঁদুর-ফিদুর মুছে ফের ইস্কুলে দিয়ে আসতুম।
দুজনেই কিছুক্ষণ চুপ করে বসে থাকে চাতালে।
রোদ বেড়ে উঠেছে। বেশ গরম। শেষে আস্তে করে বলে নব, বাড়ি যাই এবার বিকাশ। তুই
সন্ধ্যেবেলা আসবি তো?
-হ্যাঁ যাবো। চ উঠি।
-তোর খবর তো জানাই হল না রে বিকাশ।
মোটরসাইকেলটা কবে কিনলি?
-আমার আর কি খবর? হার্ডওয়্যারের অর্ডার
সাপ্লাই তো চলছেই। প্রচুর চাপ বুঝলি। এদিক ওদিক মাল তুলতে, টাকা আদায়ে যেতে হয়।
হুট বলতেই হাবিবপুর যাওয়া তো আছেই। তাই কিনে ফেললুম। পুরো পেমেন্ট হয়নি এখনোও, দশ
হাজার টাকা বাকি আছে। আজই ভেবেছিলুম, তারাপদ জানা টাকাটা দিলে ফুল পেমেন্ট করে দোব। সে শালা হল না।
যাক ঠিক আছে। হয়ে যাবে। ষ্টেশন-হাবিবপুর রুটে একটা বাস নামাব ভাবছি বুঝলি। হেব্বি
লাভ। বছর পাঁচেকে উঠে আসবে টাকা। দেখি কথাবার্তা চলছে। পারমিটের একটু ঘোঁটালা আছে
ওই শালা রাধেশ্যাম হাজরা। বড্ড বেশি দর হাঁকছে। বাবা একবার বলেছিল দেবুদাকে বলতে ।
-তা বললি না কেন?
-দাঁড়া না কদিন দেখি। ওই লোকের পা চাটতে
ভাল্লাগেনা। না খেতে পেয়ে মরছি নাকি?
-তা বিয়ে করবি না? রোজকারপাতি তো মন্দ হচ্ছে
বলে মনে হচ্ছে না।
-না ভাই, ওই নাটকে আমি নেই।
- নাটক কেন?
- নাটক নয় তো কি? ঘরে দিন দুবেলা কাক চিল
বসতে পারছে না। দুই বউ এর ঝগড়ায়। শালা দুই বউদি তো নয় যেন শ্মশানের দুটো পাগলা
শেয়াল। দিনরাত কিছু না কিছু নিয়ে খামচাখামচি। আমার দাদা দুটোও তেমন। শালা দুই
ডাকিনী-যোগিনীর জন্যে নিজের বাপ-মায়ের গায়ে হাত তুলতে শুধু বাকি রেখেছে। আবার
বিয়ে! পাগল?
- কি বলছিস?
- ঠিকই বলছি। সারাদিন নিজের ধান্দায় ঘুরে
বেড়াই। নানা ধান্দাবাজ লোক নিয়ে কারবার। তারপর রাতে ফিরেও যদি চুলোচুলি করতে
হয়......। তার চেয়ে নিজের কাজ কারবার বাড়াব। পয়সাকড়ি জমিয়ে বাড়িটাকে একটু ভদ্রস্থ
করতে হবে বুঝলি। বাপ মা টাকে একটু ভাল ভাবে রাখতে ইচ্ছে হয় এই আর কি। বড়ভাই দুটো
তো শালা এক-একটা যন্তর। কিছুই আশা করিনা ওদের থেকে। মাল খাচ্ছে, বউ পেটাচ্ছে,
রোজকারের তো বেশিটাই চলে যাচ্ছে মনসাতলার চোলাই ঠেকে। উপরন্তু এক একটার দুটো তিনটে
করে প্রোডাক্ট। সারাদিন কাঁইকিচির। শালা ঘেন্না ধরে গেল। ভাল আছিস তুই কলকাতায়।
মাঝে মাঝে মনে হয় চলে যাই। হাবিবপুরের বাজারে মজুমদারদের নীচতলায় একটা গ্যারাজ ঘর
ভাড়া নিয়েছি জানিস। কারবারে লোকজনের সাথে বসে কথা বলার তো একটা জায়গা চাই কি না
বল?
- আচ্ছা, তোর অফিসঘর বল।
-তা বলতে পারিস। তা মাঝে মধ্যে ভাবি
মজুমদারদের বলে নীচের একটা ঘরও ভাড়ায় নিয়ে নি। ওখানেই থেকে যাবো। রোজ-রোজ আর এই
কেত্তন ভাল্লাগেনা। মা-বাবা-বাচ্চা ভাইপো ভাইঝিগুলোর জন্য আবার পিছিয়ে আসি। শালার
সংসার হয়েছে।
-তোর মনে আছে বিকাশ, ক্লাস এইটে তুই আর আমি
ঠিক করেছিলাম উত্তরমেরুপ্রভা দেখতে যাব বড় হয়ে। পয়সা জমাতেও শুরু করেছিলাম, মনে
আছে?
- মনে আছে কিরে? আমি তো এখনও পয়সা জমাচ্ছি।
এত নতুন নতুন কারবার, এত খাটছি কি এমনি এমনি নাকি? পঁয়তাল্লিশ-পঞ্চাশ বছর পর্যন্ত
মোষের মত খাটবো, টাকাপয়সা জমাব। বাপ মা যদ্দিন আছে আছে, তারপর পয়সাকড়ি নিয়ে ঝোলা
কাঁধে বেরিয়ে পড়ব। উত্তরমেরু না হোক উত্তরপ্রদেশটাতো পৌঁছাতে পারব। না কি বল? হা হা
করে গলা খুলে হাসতে থাকে দুজনে।
দুই বন্ধু এবার প্যান্টের ধুলো ঝেড়ে উঠে
পড়ে। বাইকে উঠে স্টার্ট দেয় বিকাশ। বলে, ‘এখন চলি রে নবু। সন্ধ্যেবেলা যাচ্ছি,
কাকিমাকে বলিস পেঁয়াজি খাব গিয়ে। তুই তো আবার সাইকেল এনেছিস। নাহলে তোকে দিয়ে আসা
যেতো।’
-আরে না না আমি সেই সকাল থেকে এদিক ওদিক
ঘুরছি। তাই সাইকেলটা নিয়ে বেরিয়েছি। তুই আয়। সন্ধ্যেয় আসিস।
-হ্যাঁ যাবো। একটু পাত্রপাড়ায় যেতে হবে
বিকেলে। একটু দেরি হতে পারে, এই ধর সাতটা-সাড়ে সাতটা।
- হ্যাঁ হ্যাঁ তুই আয় না। আমি তো বাড়িতেই
থাকব।
বিকাশ চলে যাবার পর একবার
আকাশের দিকে তাকায় নব। চড়া রোদ। বেশ ঘাম হচ্ছে। এবার বাড়ি না গেলেই নয়। সামনে
ধানকল পেরিয়ে মাঠের রাস্তা, তারপরেরই পিপুলতলার মাচানের পাশ দিয়ে তাদের পাড়ার
রাস্তা। তাড়া নেই। সাইকেলে উঠে পড়ে প্যাডেলে চাপ দেয় নব। মাঠের রাস্তায় পড়তেই দূরে
দেখল আদুর গায়ে হেঁটো ধুতি পরে কেউ একজন খুব ধীরগতিতে হেঁটে চলেছে তার রাস্তাতেই।
চোখের উপর হাত দিয়ে রোদ আড়াল করে বোঝার চেষ্টা করল নব। বুড়ো মানুষটাকে বোঝা যাচ্ছেনা
এত দূর থেকে। এই রাস্তায় যখন তখন তাদের পাড়ারই কেউ হবে। এই রোদে বুড়োমানুষটা হেঁটে
যাচ্ছে, সাইকেলের ক্যারিয়ারে তুলে নেবে সে। গতি বাড়ালো নব।
শেষাংশ ফেরা-৩ ......
শেষাংশ ফেরা-৩ ......
0 comments:
Post a Comment