Thursday 8 March 2018

হাচিকোপুরাণ/ পর্ব-১/ মুখবন্ধ


হাচিকো মস্তান ভৌ ভৌ
হাচিকোপুরাণ হইল হাচিকোর বীরগাথা। এই মহাকাব্য শুরু করিবার আগে এই মহাকাব্যের স্থান কাল, পাত্র-পাত্রী সম্পর্কে কিঞ্চিৎ গৌরচন্দ্রিকা প্রয়োজন। ২০১২ র নভেম্বর হইতে ২০১৫ র অক্টোবর অবধি এক গবেষনা সংস্থাতে থাকাকালীন এই অধমের 'হাচিকো' নাম্নী বীরের সহিত আলাপ এবং পরে কিঞ্চিৎ সখ্যতা করিবার সৌভাগ্য হইয়াছিল। হাচিকো সমস্ত ভয়কে বহু কষ্টেসৃষ্টে দাবাইয়া প্রবল প্রতাপে রাজত্ব করিত। সমস্ত মহাকাব্যেই যেমন একটি করে নায়ক থাকে তেমনি হাচিকো হইল এই মহাকাব্যের মহানায়ক। হাচিকোসহ বাকি প্রধান কলাকুশলীদিগের পরিচয় নীম্নে প্রদান করা হইল। বাকি অন্যান্য চরিত্রদিগের পরিচয় যথাসময়ে প্রসঙ্গক্রমে যথাবিহিতরূপে উন্মোচিত হইবে।

হাচিকোঃ সারমেয়কুলশিরমনি। পুরো নাম 'হাচিকো মস্তান ভৌ ভৌ'। ডাক নাম হাচি। গ্রীষ্ম-বরষা-সর্বদা একটি কালো কোর্ট পরিধান করে (কালো লোম, ভ্রু এবং চতুরপদে হলদেটে ছোঁয়া)। বাংলা, হিন্দি, মালায়লাম এবং ইংরাজি এই চারটি ভাষায় সুপণ্ডিত।  নিন্দুকে বলে, বলার সময় মুখ দিয়ে 'ভৌ' ই বাহির হয়। কিন্তু নিজের দলীয়মন্ডলীতে কথোপকথন চালাইতে কোন অসুবিধা হয়না। নতুন নতুন বাংলা শব্দ শিখতে উৎসাহী। হাবাকে যমের মত ভয় পায়। যদিও তাহা কদাচ স্বীকার করে না।

হাবাঃ হাচিকোর প্রাক্তন প্রেমিকা। ভীষন রাশভারী, সম্পূর্ণ স্বাধীনচেতা, স্বনির্ভরশীল, ঋষিতুল্য, ধীর স্থির সারমেয়নন্দিনী। হাচিকোর কোনরূপ বাঁদরামি সহ্য করে না। হাচিকোই তাহাকে লইয়া আসিয়াছিল একদা। এক্ষণে দুইজনে আদায় কাঁচকলায় সম্পর্ক। সাধারণত হাবা খাওয়া দাওয়া বাদে  বাকি সময়টা ধ্যান করিয়াই কাটায়, কিন্তু তার প্রিয়জনের এতটুকু বিপদের আভাষ পাইলেই ঝড়ের মত ঝাঁপাইয়া পড়ে। বিশেষত সেস্থলে হাচিকো উপস্থিত থাকিলে বিনা বাক্যব্যয়ে হাবা তাকে প্রথমেই খানিক পিটুনি দিয়া লয়।

ভাইপোঃ হাবার একমাত্র জীবিত পুত্রসন্তান। পুরো নাম, 'ভাইপো ভাইপো'। কেন তাহার নামে ভাইপো কথাটি দুইবার আসে তাহা সে জানে না। অনেক চেষ্টা করিয়া হাল ছাড়িয়া দিয়াছে। কেবলই তাহার জলতেষ্টা পায়। তাই জল পাইলেই সে আকণ্ঠ জলপান করে। নিজেকে সে ভীষন ছোটো মনে করে। আর কেবলই থাকিয়া থাকিয়া বলে, "আমি ভীষওওওণ ছোটো কুকুর"। এই বলিয়া সে সব কিছু হইতে পার পাইয়া যেতে চেষ্টা করে। সে হাবাকে মা ও হাচিকোকে কাকা সম্বোধন করে। হাচিকোকে একবার 'বাবা' সম্বোধন করে প্রবল মার খাইয়াছিল মায়ের থেকে। তার মা বলিয়াছিল, "ওই অলপ্পেয়েকে খবরদার যদি বাবা ডেকেছিস তো ঠ্যাঙ খোঁড়া করে দেব।" অতঃপর সে 'কাকা'তেই থিতু হইয়াছে।

আহ্লাদীঃ সর্বদা হাস্য ও লাস্যময়ী এক সারমেয়নন্দিনী। প্রেম ও কামকে সে আহার নিদ্রার মতই অপরিহার্য বলে মনে করে। সর্বদা একগাল হাসি এবং একপাল পুরুষ বন্ধু লইয়া গবেষণা সংস্থাটির প্রধান ফটকের ঠিক বাহিরেই অবস্থান করে। ফলত, প্রতি বৎসরান্তেই তার একপাল সন্তান সন্ততি জন্মলাভ করে। তখন সেই সন্তানদিগের মনুষ্য ইচ্ছামতো গতি হওয়া ইস্তক, গবেষণা সংস্থাটির প্রধান ফটকের ভিতরে নিরাপদে সন্তান পালন করে। তৎপরে পুনরায় সে সন্তানবতী হইবার চেষ্টা করে। তার এই চঞ্চলমতিহেতু ঋষিতুল্য হাবা মোটেই তাহাকে পছন্দ করিত না। তদুপরি, ইদানিং আহ্লাদী ভাইপোর প্রতি কিঞ্চিৎ অধিক উৎসাহী হইয়াছে বলিয়া হাবার আরও বিরাগভাজন হইয়াছে।

দাদাঃ হাচিকোর মনুষ্যকুলজাত দ্বিপদী বন্ধু। সম্মানবশত হাচিকো তাকে দাদা বলিয়া ডাকে। গবেষনা সংস্থাটির চৌহদ্দিতে অন্যান্য সারমেয়দের তিরষ্কার করিয়া খেদাইবার জন্য হাচিকো তাহাকে নিযুক্ত করিয়াছে। ইহা ছাড়াও হাচিকোর রাতের খাবার তৈয়ার ও পরিবেশনে তাহার বড় ভূমিকা রহিয়াছে। ছোকরাকে এমনিতে হাচিকো ভালই বাসে, কেবল নরম গরম লেপ কম্বল ও বিছানার উপরে হাচিকোকে বসিতে দেখিলেই সে কেমন যেন খেপিয়া উঠে। হাচিকোকে তখন বিছানা ছাড়িয়া বাধ্যতামূলক গাত্রোত্থান করিতেই হয়। ইহাকে হাচিকো ছোকরার পিত্তের দোষ বলিয়া অনিচ্ছাসত্ত্বেও মানিয়া লইয়াছে। ইহা ব্যতীত, দিদির সাথে খেলার ছলে কামড়া কামড়ি করিতে গেলেও ছোকরার পিত্ত ক্রমান্বয়ে ঊর্ধ্বমুখী হইতে থাকে। ইহাতে অবশ্য হাচিকোর মানসিক আহ্লাদই জাগিয়া উঠে।

দিদিঃ হাচিকোর মনুষ্যকুলজাত আর এক দ্বিপদী বন্ধু। সম্মানবশত হাচিকো তাকে দিদি বলিয়া ডাকে।  যদিও  পাগল ছিটগ্রস্ত বন্ধুই ভাবে মনে মনে। হাচিকোর বিকেলে কিংবা সন্ধ্যেয় খেলার সময়, অসময়ে ডিমটা, গুলিটা (পেডিগ্রীর বল, হাচিকো গুলিই নামে চেনে এই সুস্বাদু খাদ্যবস্তুটিকে) পেতে এই দুর্মতি বালিকাকেই প্রয়োজন পড়ে। বাকি সময়টা একে সাধারণত একটু দাঁত দেখাইয়া, ঘ্যাঁ ঘোঁ করিয়া দূরে রাখতেই চেষ্টা করে। নতুবা,  যখন তখন "আমার কুচু হাচিকো" বলিয়া বিষম আদরের ঠেলায় হাচিকোর কান, হাত, পা, নাক নাড়াইয়া, চুলকাইয়া তাকে জাপটে চাপিয়া ধরিয়া তাকে নাস্তানাবুদ করিয়া দিবে। এই ছিটেল বন্ধুটির সাথে তার অবশ্য নানা সুখদুঃখ এর গল্প চলে। মাঝে মাঝে দার্শনিক আলোচনাও। তদুপরি, সেই একমাত্র, যে হাচিকোকে বিছানায় উঠিতে দেয়, এবং পছন্দের নরম কম্বলটিতে বসিতে দেয়। অবশ্যই দাদার অজান্তে। এসকল কারণে হাচিকো একে বড়ই ভালবাসে কিন্তু মধ্যে মধ্যে দাঁতও দেখাইয়া লয়।

(চলিবে)


0 comments:

Post a Comment