Saturday 25 February 2017

আজকের ভোর




 সামনের জানলা তার ওপারে রাস্তা। বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরের পূর্ব সীমানা। রাস্তার ওপারে একটা বাড়ি। বেশ বড় বাড়ি। কিন্তু কখনো এই বাড়ি থেকে কাউকে বেরোতে বা ঢুকতে দেখিনি। আসলে এটা বাড়িটার পিছনের দিক। সামনের দিকে বড় দরজা, বাড়ির সামনে একটা বিশাল গাছ। নাম জানিনা।তাতে একটা দোলনা বাঁধা থাকতে দেখেছিলাম একদিন। তাইতেই বুঝেছিলাম বাড়িতে একটি ছোট সদস্যও আছেন। বাড়ির পিছনের দিকটাতে বিশেষ কেউ আসেনা। একটু জঙ্গুলে মতো। শীতকাল ছাড়া বোঝাই যায় না এখানে একটা বাড়ি আছে। জঙ্গলে ঢাকা থাকে। বাড়িটা একটু উঁচুতে। তাই শীতকাল ছাড়া অন্য সময়, যখন প্রচুর সবুজে বাড়িটা ঢেকে থাকে, তখন মনে করে নিতে খুব একটা কষ্ট হয় না যে, আমার জানলার ওপারে রাস্তা আর রাস্তার ওপারে সবুজে ঢাকা পাহাড়। আমি বুঝি হিমালয়ের কোনো শান্ত গ্রামে আছি।ভাবতে দোষ কি?

এই মুহূর্তে, শীতের দাপটে সব পাতা ঝরে, বাড়িটার পিছন দিকটা ন্যাড়া করে, জঙ্গলের গাছগুলো শুধু অজস্র হাত বাড়িয়ে উর্দ্ধমুখী হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে। আরএই সুযোগে বাড়িটার ফাঁক দিয়ে পূর্বদিকের একফালি আকাশ আমার সামনে ফুটে উঠেছে। আস্তে আস্তে ফর্সা হচ্ছে আকাশ। রাস্তাটা দিয়ে ক্যাম্পাস সিকিউরিটির গোবদা গাড়িগুলো রাতের শেষ টহল দিয়ে গেলো একটু আগে। তখন আলো ফোটেনি। আলো ফুটতে শুরু করতে না করতেই, রাস্তার পাশের হাঁটার রাস্তাটা পরিষ্কার করে দিয়ে গেলো বরফ সাফ করার ছোট গাড়ি নিয়ে। মানুষ চলাচল শুরু হবার আগে হাঁটার রাস্তা পরিষ্কার থাকা জরুরি। অবশ্য স্বাস্থ্যসন্ধানী দৌড়বাজরা ছাড়া বিশেষ কেউ হাঁটেনা এখানে। তাও এরা নাগরিক সুবিধা গুলো বেশ যত্নের সঙ্গেই রক্ষা করে। কাল সারাদিন তুষারপাত হয়েছে। সন্ধ্যে থেকে ক্ষান্ত দিয়েছিলো। বড় রাস্তাগুলো এখানে সাথে সাথেই পরিষ্কার করে দেয়। এই বরফ পরিষ্কার করার গাড়িগুলো তিন রকম হয় দেখেছি। শহরের সবচেয়ে বড় আর ব্যস্ত রাস্তাগুলো পরিষ্কার করতে হয় সাথে সাথেই। তার জন্য সবচেয়ে বড় আর ভারী গাড়ি লাগে। সামনের দিকে বেলচার মতো বিশাল চামচ নিয়ে রাস্তায় ঘুরে বেড়ায়। ছোট রাস্তা পরিষ্কার করার ছোট গাড়ি, আর রাস্তার পাশের হাঁটার রাস্তা পরিস্কার করার জন্য ছোট্ট গাড়ি। একটু আগে দৌড়াদৌড়ি করে তারই একটা আমার সামনের রাস্তাটা পরিষ্কার করে দিয়ে গেলো। গত বছর যখন এখানে প্রথম এসেছিলাম, এই রাস্তার বরফ পরিষ্কার করার গাড়িগুলো দেখে বেশ মজা পেয়েছিলাম। সবচেয়ে বড় গাড়িগুলো বেশ গাঁট্টাগোট্টা। চেহারাটা হুমদো মতো বলে আমরা ওগুলোকে মজা করে বলতাম, হুব্বাগাড়ি। বড় হুব্বাগাড়ি, মেজো হুব্বাগাড়ি , আর এখুনি যেটা দৌড়াদৌড়ি করছিলো সেগুলো ছোট হুব্বাগাড়ি। ছোট হুব্বাগাড়িগুলো খুব মজার। কেমন গুড়গুড়িয়ে চলে সব বরফ সরিয়ে রাস্তা করে দেয়।

লিখতে লিখতে চারদিকে আলো  ফুটে উঠছে। পূর্বদিকের একফালি আকাশে কমলা আভা লেগেছে। যদিও সূর্যোদয় দেখা এখান থেকে সম্ভব নয়। তাও বুঝতে তো পারছি যে এই শুরু হলো দিনের প্রথম ক্ষণ। সম্ভাবনাময় আরো একটা ভোর, মহাবিশ্বের উপহার, সক্কলের জন্য। 


রাস্তায় গাড়ি চলাচল এখনো শুরু হয়নি। আজ শনিবার, ছুটির দিন বলেই। অথচ ঘন্টা দুয়েক আগেও বেশ কয়েকটা গাড়িকে যাতায়াত করতে দেখেছি। রোজই দেখি। শেষরাতে অন্ধকারে কোথায় দৌড়ায় লোকজন কেজানে। হয়তো এয়ারপোর্ট যায়। তাছাড়া অত ভোরে আর কোথায় যাবে মানুষ। এখন রাস্তা ফাঁকা। শুধু সাদা রঙের একটা গাড়ি সারা গায়ে পাতলা তুষারের চাদর জড়িয়ে ঘুমোচ্ছে আমার জানলার সামনে। 

রাস্তার আলোগুলো নিভে গেছে। সামনের বাড়িটার জানলায় এখনো আলো জ্বলছে। শেষরাত থেকেই জ্বলছে।  দুটো কাঠবেড়ালি নেমে পড়েছে রাস্তায়। ওরা সারাদিন খেলা করে।  ছুটির দিনে মাঝে মাঝেই দেখতে পাই জানলা দিয়ে ওদের। ওরা ওই সামনের বাড়ির পিছনের জঙ্গলে থাকে। দুরন্ত ঠান্ডায়, বরফের মাঝেও খেলা করতে দেখেছি ওদের। প্রকৃতিদত্ত শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ নিয়ে ঘুরে বেড়ায় ওরা। কি প্রাণশক্তি। সারাদিন দুটিতে দৌড়ে বেড়াচ্ছে। খাবার খুঁজছে, খেলা করছে, মাঝে মাঝে মনে হয়, আমরা যে ছোটবেলায় ছোঁয়াছুঁয়ি খেলা খেলতাম, ওই খেলাটা ওরা জানে। অবিকল ওই ভঙ্গীতে একে অপরের পিছনে দৌড়ায়। বেশ লাগে দেখতে। 


চারদিক আধোনীল থেকে সাদা থেকে ক্রমশঃ সোনালী হয়ে উঠেছে। চরাচর জেগে উঠেছে। আমিও তার সাথে মিলিয়েছি সুর। এবার শুরু হবে আমার আজকের দিন।







  

0 comments:

Post a Comment