Monday 23 March 2015

বেখেয়ালে

কিছু কিছু সময় থাকে যখন বাইরে থেকে দেখলে শরীরের সমস্ত অঙ্গ প্রত্যঙ্গকে এক্কেবারে সঠিকভাবে কাজ করছে বলেই মনে হয়। হয়ত করেও। পরম কড়া সমালোচকও নড়াচড়ায়, কাজে কর্মে, কথাবার্তায় কোনরকম অসঙ্গতির হদিশ পাবেন না। কিন্তু আপনি মনে মনে জানেন যে, আপনি যেন সম্মোহিতের মতন সমস্ত বাইরের খোলসটুকু বজায় রাখছেন মাত্র। মস্তিস্ক আপনার এক্কেবারে ঘুমন্ত তখন। রোজ সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত যাবতীয় কর্তব্যকর্ম তালিকা অনুসারে হয়ে চলেছে। হচ্ছে আপনারই হাত দিয়ে। কিন্তু আপনি জানেন আপনি এসব কিছুই করছেন না। তাও কি করে যেন যান্ত্রিক পদ্ধতিতে সব হয়ে চলেছে। আর আপনি চোখ খোলা রেখে আদতে ঘুমিয়েই চলেছেন। যা হচ্ছে-যা হবে-যা হলে ভালো হত কিন্তু হলো না-বা যা না হলেই ভালো হত কিন্তু হয়ে গেল, কোনো কিছুতেই আর আপনার মস্তিস্ক কোনরকম ভাবে ভাবিত হচ্ছে না, কোনরকম প্রতিক্রিয়া দেখাচ্ছে না। পারিপার্শ্বিক সমস্ত শব্দ তখন অনেক দূর থেকে ভেসে আসছে বলে মনে হয়। মানুষের কথাবার্তার প্রতিটি শব্দ কানে বিকট তরঙ্গ তোলে। মাথার ভেতরে অবিরত একশ ঝিঁ ঝিঁ কনসার্ট বসায়। মনে হয় নিজের কোনো আলাদা অস্তিত্বই নেই বুঝি। আবহমানের পূর্বনির্ধারিত ঘটনাপ্রবাহে ভাসমান ঘাসফুলের মতন কেবল ভেসে বেড়ানোই বুঝি জীবন। অতীত-ভবিষ্যতের কোনো ঘটনার কণামাত্র যখন নিজের নিয়ন্ত্রণাধীন নয় বর্তমানের তো নয়ই, তখন মস্তিস্কের ভূমিকাটা ঠিক কি এটাই সবচেয়ে বড় প্রশ্ন হয়ে দাঁড়ায়। 

এই রকম অবস্থায় যদি কোনো মুহূর্তে করণীয় কোনো পার্থিব কাজ না থাকে তখন হয়ে যায় আরো মুশকিল। এতক্ষণ শারীরিক ভাবে অন্তত আপনি জীবিত ছিলেন। অতীত-ভবিষ্যত-কার্য-কারণ-ফলাফলের তোয়াক্কা না করে কেবল যা করার যেটি বিন্দুমাত্র ভুল না করে সঠিক ভাবে করে যাবার একটা স্রোত অন্তত সুপ্তমস্তিস্ক আপনাকে, পাঁচটা মানুষের কাছে জীবন্ত প্রমাণ করার দায়গ্রহণ করেছিল। এখন যদি সেই বাহ্যিক কাজকর্মের ঠেলাটাও না থাকে তখন? 

একটা সুবিধা অবশ্য আছে এই অবস্থার। সেটি হলো, যেহেতু আপনি সে অবস্থায় আসলে ভেতরে ভেতরে মৃত তাই আপনার কাজকর্মের ফলাফলের কোনো দুশ্চিন্তা আপনার মস্তিস্ককে ব্যস্ত রাখতে পারছে না। কারো ভালো মন্দ নিয়ে চর্চা করার পার্থিব উত্সাহ আপনার কাছে নিরর্থক তখন। ভবিষ্যতের কুহকমোহ আপনার মস্তিস্কের মতনই আপনার কাছে মৃত। বন্ধুবান্ধব-আত্মীয়স্বজন-কম চেনা-বেশি চেনা লোকজন, বাড়ি-কাজের জায়গা-দেশ-সমাজের নানান ঘটনাও তাই আপনার কাছে নিরর্থক। ফলে আপনার দৃষ্টি-শ্রবণ তখন পরিস্কার। আপনি সব কিছু দেখবেন, শুনবেন। কিন্তু তার জন্য মস্তিস্কের খাটনিটুকুর প্রয়োজন হবে না। আপাত তুচ্ছ ঘটনাও তখন আপনার চোখে ধরা পড়বে। যে মানুষটির সাথে আপনি কাজের সূত্রে দিনের পর দিন কথা বলে চলেছেন এতদিন, হয়ত আবিস্কার করবেন, আপনি এতদিন কথা বলেছেন ঠিকই কিন্তু আরো পাঁচটা চিন্তায় তাকে ভালো লক্ষ্য করেননি কোনোদিনই। তার ডানহাতের মধ্যমায় যে একটি গোমেদ আছে সেটি এতদিন আপনি জানতেনই না। বাড়ির টবে রাখা গাছটিতে প্রতিদিন জল ঢেলেছেন আপনিই, অথচ গাছটি যে ইতিমধ্যে লম্বায় এতটাই বেড়ে গেছে যে আপনার বারান্দার রেলিং পেরিয়ে সে এবার আকাশের দিকে টুকি করছে, সেটি এই আজই হঠাৎ আপনার চোখে পড়বে। সবই খুব তুচ্ছাতিতুচ্ছ জিনিস, এগুলো না দেখেও জীবন দিব্যি বয়ে চলে। ব্যক্তিগত-জীবিকাগত বা বৃহত্তর জীবনে কোথাও এই হঠাৎ আবিস্কৃত ঘটনার কোনো গুরুত্বই নেই, তাও ঘটনাগুলি যে এতদিন আপনার চোখের আড়ালে ছিল এবং তার একমাত্র কারণ এই যে, এতদিন আপনার মস্তিস্কের একশ একটা অহেতুক চিন্তা আপনাকে ভালো করে দেখতেই দেয় নি চারপাশটা। এই সত্যটা একমাত্র তখনই আপনার সামনে আসবে যখন আপনার মস্তিস্ক কাজ করা বন্ধ করবে। ঘটনার ফলাফল নিয়ে চিন্তা করতে গিয়ে হারিয়ে যায় ঘটনার ছোট্ট ছোট্ট ওঠা পড়ার অভিজ্ঞতা। যেমন আমাদের ক্ষেত্রে এক্সপেরিমেন্টের ফলাফল কি হবে ভাবতে গিয়ে কেমন করে নিঃশব্দে আমাদের শরীরে প্রতিনিয়ত নির্ভুলভাবে ঘটে চলেছে জীববিজ্ঞানের এই ঘটনার স্রোত, সেই মৌলিক বিস্ময়টুকুই আর মনে অবশিষ্ট থাকে না। আবার সেই বোধটুকুই ফিরে আসে যখন বারবারের অবিরত চেষ্টায়ও যখন কাঙ্খিত ফলাফলের ধারে কাছেও পৌঁছানো যায় না, তখন কেমন যেন নির্লিপ্ততা চলে আসে মনের মধ্যে। যেন, যা হয় হোক। আমার করার দরকার আমি করব। ফলাফলের বিন্দুমাত্রও যখন আমার হাতে নেই, তখন আর সেদিকে ফিরেও তাকাবো না। ঠিক তখনই কাজ করা বন্ধ করে দেয় মাথা। আর তখনই সরে যায় পর্দা চোখের সামনে থেকে। চলমান সিনেমার মতন সরে সরে যায় দৃশ্য নিজের মতন করেই। কিন্তু সেসবের ধনাত্মকতা বা ঋণাত্মকতা আর মনে মাথায় ছাপ ফেলতে পারে না কণামাত্রও। আর আপনার অবচেতন মন আরো বেশি করে পারিপার্শ্বিকতা সম্পর্কে সচেতন হয়ে ওঠে আপনার অগোচরেই।

এরকম অবস্থার সাথে আমার মনে হয় গ্রীষ্মকালের একটা অমোঘ যোগ আছে। মনে আছে ছোটবেলায় স্কুলের গ্রীষ্মের ছুটিতে নিঝুম দুপুরে ঠিক এরকমই একটা ঝিমধরা অবস্থা হত মনের। মনে হত চরাচর বুঝি চলছে নিজের নিয়মে। আমায় বৃত্তের বাইরে রেখেই। আমি বুঝি দর্শকমাত্র। কোনোকিছুর বিচার-বিশ্লেষণের দায় নেই আমার, কোনো ভালো মন্দের ভাবনা নেই আমার। কেবল পূর্বনির্ধারিত ঘটনাবলীর মস্তিস্কহীন দর্শকমাত্র হয়ে উপগ্রহের মত অবিরত ঘুরে চলেছি বৃত্তের ঠিক বাইরেই। আজীবন। কোনো ভয় নেই, কোনো বিষয়ের প্রতি নির্দিষ্ট ভালোবাসাও নেই। শুধু চুপ করে এককোণে বসে চারিদিকের বয়ে চলা স্রোতকে প্রত্যক্ষ করাই জন্যই আমার জন্ম। 

পশ্চিম ভারতের এই অঞ্চলেও গ্রীষ্ম শুরু হয়েছে কাল থেকে। কালই প্রথম কম্বল ফেলে ফ্যানের হাওয়ার দ্বারস্থ হতে হয়েছে ঘুমোতে গিয়ে।   
   

0 comments:

Post a Comment