Thursday 26 March 2015

গলা খুলে

যাক বাবা 'ছেষট্টির এ' কে হই হই করে ছক্কা মেরে মাঠের বাইরে বের করে দেওয়া গেছে। এইবার আর পায় কে। এইবার ফেসবুকে যত্তখুশি টম-জেরির গল্প শোনাও, ছবি দেখাও আর কেউ কান ধরার নেই। ব্যাপারটা ভালোই হয়েছে নিঃসন্দেহে। যদিও আমি অন্তত 'একুশে আইন'- এর এই ধারার নাম ধাম মানে নম্বর (৬৬এ) টম্বর সম্পর্কে কাল-পরশুর আগে একেবারেই ওয়াকিবহাল ছিলাম না। তাও ফেসবুকে বড়দের সম্পর্কে একটি শব্দও উচ্চারিত হলে, কোনো সময় যে বড়রা এসে কান ধরে নিলডাউন করে দিতে পারে তা সে ছেষট্টিই হোক বা ছিয়াত্তর বা ছিয়াশি, সেটা বিলক্ষণ জানতাম। তাই সকাল বিকেল বাড়িতে বসে চা খাবার সময়টুকুতে দরজা-জানালার ছিটকিনি বেশ ভালো করে বন্ধ আছে কিনা পরীক্ষা করে নিয়ে তবেই বড়দের সম্পর্কে চাট্টি কুকথা কয়েছি। এখন সেই সতর্কতা থেকে কিঞ্চিত শিথিলতা প্রাপ্তির আশা মিলেছে। প্রচলিত অব্যবস্থার প্রতি নূন্যতম অনাস্থা বা অসন্তোষ প্রকাশ মানেই যদি শিবঠাকুরের আপনদেশের আইন তার ফাঁক খুঁজে নিয়ে টপাটপ মানুষ ধরে ঝপাঝপ জেলে ঢোকাতে থাকে, তবে তো একসময় ঠক বাছতে গাঁ উজাড় হবে। হয় রাস্তাঘাট-রেলপথ-ইস্কুল-কলেজ-হাসপাতাল বানানো ছেড়ে পরের পর জেলখানা বানাতে হবে। নতুবা হীরক রাজ্যের মতন প্রজাদের কথা বলা বন্ধ করতে হবে বা একটি 'মস্তিস্ক প্রক্ষালণ যন্ত্র' এর দরকার হয়ে পড়বে। এবার অন্তত আমাদের নিজেদের বিচারব্যবস্থার পরিণতমনস্কতার কিছুটা উদাহরণ চোখের সামনে এসে আমাদের আশ্বস্ত করেছে। ধন্যবাদ শ্রেয়া সিন্ঘল। নিজের পড়াশুনা শিকেয় তুলে এই বয়সেই বনের মোষ তাড়ানোর অদ্ভূত চিন্তাটা মাথায় না এলে এই একুশে আইনকে দরজা দেখাতে আরো কত বছর লাগত কে জানে। রাজনৈতিক বা সামাজিক অব্যবস্থার বিরুদ্ধে যাঁরা আওয়াজ তোলার সাহস রাখেন তাঁদের জন্য এটি একটি বড় পদক্ষেপ বই কি? 

কিন্তু.......,হ্যাঁ এখানে একটি কিন্তুর খচখচানিও আছে। অন্তত আমার মনে। যদিও আইনের এই ধারাটি বিলোপের সাথে এই কিন্তুর সরাসরি বিশেষ সম্পর্ক নেই বলা যায়। তবু এই কিন্তুটিকে বিশ্লেষণ করলেই বোধহয় বোঝা যাবে যে বাকস্বাধীনতা রক্ষার্থে একটি দুষ্টু আইন বিলোপমাত্রেই কি বাকস্বাধীনতা রক্ষা করা যায়? ছোট থেকেই আমাদের প্রত্যেককে "সদা সত্য কথা বলিবে"-র সাথে সাথে এও শেখানো হয় যে, "অপ্রিয় সত্য কথা বলিবে না।" এই দ্বিতীয় নির্দেশটি মেনে চলতে গিয়ে কিঞ্চিৎ বেগ পেতে হয়। কারণ কোন সত্য যে কার কাছে কতটা অপ্রিয় আর কার কাছে কতটা প্রিয় সেটি চট করে বুঝে ওঠা যায় না। সেখানে বাকস্বাধীনতা ব্যাপারটি যে বেজায় ঠুনকো আর আপেক্ষিক সেটা ভুক্তভোগী মাত্রেই জানেন। অফিসে, বাড়িতে এর ভুরি ভুরি উদাহরণ রয়েছে। অর্থনৈতিক ভাবে পরাধীন কোনো নিরক্ষর মহিলা কি পারবেন তাঁর উপার্জনশীল স্বামী এবং শ্বশুরবাড়ির মন্দ দিকটি সম্পর্কে সোচ্চার হতে? বড়সড় অভিযোগ তো দূরস্থান, ছোটখাটো পাওয়া না পাওয়া বিষয়ে মুখ খুলতে আমরা ডরাই। সম্পর্কহানির ভয়ে। কোনো একজন ব্যক্তির চরিত্রগত দুর্বল দিকটি সম্পর্কে ততই কম কথা বলা যায়, যতই মানুষটি সম্পর্কের দিক থেকে আপন হয়। আমার এই মন্তব্যটি হয়ত অনেকেই মানতে পারবেন না। কিন্তু এটি অত্যন্ত সত্যিকথা যে আমরা আমাদের প্রিয় বন্ধুর সমস্ত ভালো গুণগুলিকে সম্পূর্ণ করতে, তাঁকে নিজের বিচার বিবেচনামত পরিপূর্ণ আদর্শস্বরূপ তুলে ধরতে অনেক সময়ই তাঁর চরিত্রের হয়ত একটিমাত্র দূর্বল দিক সম্পর্কে তাঁকে সতর্ক করতে যাই। কিন্তু যদি সেই মানুষটির নিজের সমালোচনা গ্রহণ করার বা নিজেকে পুনরালোচনা করার মতন যথেষ্ট প্রাপ্তমনস্কতার অভাব থেকে থাকে তবে সেই দুর্বলতা সম্পর্কে তাঁকে অবহিত করতে যাবার অব্যবহিত ফলাফল হলো বন্ধুত্বহানি। সেই বন্ধুত্বহানির ভয়ে অনেক সময়ই আমরা ব্যাপারটি চেপে যাই। বা সেই দুর্বলতার সাথে মানিয়ে নিয়ে চলার চেষ্টা করি। কিন্তু মানুষটি যদি তত কাছের কেউ না হন, যদি তাঁর সাথে সম্পর্কের ওঠা পড়ায় আমাদের বিশেষ কিছু লাভ ক্ষতি হবার সম্ভাবনা না থাকে তবে আমরা নির্দ্বিধায় তাঁকে তাঁর ঋণাত্মক দিকটি সম্পর্কে বলতে পারি। এটিও কি এক ধরনের বাকস্বাধীনতার জলাঞ্জলি নয়? কাজের জায়গায় উর্দ্ধতন কর্তৃপক্ষের অন্যায় মেনে নেওয়া, বসের বদখত চেহারায় বদখত জামা দেখে "বাহ, দারুন মানিয়েছে তো আপনাকে"-এসব তো প্রতিদিনের ঘটনা। আমাদের দৈনন্দিন জীবনের সমস্ত ক্ষেত্রেই নিজেদের সমালোচনা গ্রহণ করার মতো প্রাপ্তমনস্কতা যতদিন না তৈরী হচ্ছে ততদিন আইন বিলোপই কর বা নতুন আইনই বানাও সত্যি কথাটা গলা তুলে বলার সাহস কোনদিনই আমাদের হবে না। 

তথ্যপ্রযুক্তিগত বাকস্বাধীনতা আইনের সাথে যদিও এই দৈনন্দিন ঘটনাগুলির বিশেষ কোনো যোগ নেই। এবং ৬৬এ লোপাট হয়েছে বলে অন্য কোনো আইনের শাখায় সোশ্যাল মিডিয়ায় বাকস্বাধীনতা ওপর নজরদারি করা হবে না তাও নয়। তবুও সর্বাঙ্গীন অর্থেই গলা খুলে কথা বলার অধিকারের প্রশ্নে মনে হয় সমস্ত ঘটনাগুলিই তাত্পর্যপূর্ণ। আমরা বাইরে বাইরে যতই প্রাপ্তবয়স্ক হই, আত্মসমালোচক হই না কেন, এই যে আমি বাকস্বাধীনতা এবং সমালোচনা গ্রহণ করার প্রশ্নে এতগুলি কথা আমি খরচ করছি, সেই আমারই মুখের সামনে যদি কেউ আমার একশ একটা দোষ সম্পর্কে আমায় বলে, সেই দোষগুলি সম্পর্কে সম্যকভাবে অবহিত হওয়া স্বত্বেও আমি কতটা আমার সামনের মানুষটিকে তারপর সহজভাবে নিতে পারব সেটি বড় একটি প্রশ্ন।

অম্বিকেশ মহাপাত্র কারো সম্পর্কে সত্যি বলে জেলে কেন যাবেন সেই নিয়ে গলা ফাটাচ্ছি ফেসবুকে অথচ 'অফিসে ঢুকতে কেন রোজ একঘন্টা দেরী হয়, বাড়ি থেকে একঘন্টা আগে বেরোলেই পারো'-বসের মুখে এই কথা শুনলেই বসের ঘর থেকে বেরিয়ে নিষ্ফল আক্রোশে দাঁত কিড়মিড় করব। 'নেহাত আমি অধস্তন, তাই তুমি পার পেয়ে গেলে। এক্ষেত্রে তোমার বাকস্বাধীনতা আছে, আমার নেই। নইলে আমিই তোমায় জেলে ঢোকাতাম'-এরকম একটা ভাব। আসল কথাটা, যেটি নিয়ে এত সমস্যা সেই সময়ানুবর্তিতার প্রশ্নটি থেকে যায় অধরাই। ফেসবুকে রাজ্যসুদ্ধু সকলের নামে নিন্দেই হোক বা সঠিক কারণে কোনো ঘটনার প্রতিবাদ, এসবে কিঞ্চিৎ খোলা হাওয়া এসেছে বলে নিজের দোষগুণ ভুলে হই হই করে ঝাঁপিয়ে পড়ব আর আমার দোষগুণ সম্পর্কে কেউ টুঁ শব্দ করলেই দেশ-রাজ্য-সমাজ সমস্তরকম সচেতনতা ভুলে গালাগালির বন্যা বইয়ে দেব। কারণ আমারও তো বাকস্বাধীনতা আছে তাই না? সুতরাং জয় ৬৬এ। এবার আর ঠেকায় কে?                 
           

0 comments:

Post a Comment