Wednesday 11 February 2015

নামাবলী

আবার নাম বিভ্রাট। হাসব না কাঁদব বুঝে উঠতে পারছিনা।  এর আগে নাম নিয়ে কি ঝামেলায় পড়েছিলাম সেটা তো বিশদে বলেছিলাম আপনাদের। আগেরবারভেবেছিলাম পোস্টটার নাম দেব 'নামাবলী' বা 'নামসংকীর্তন', আবার এই নাম বিভ্রাটে সেই পুরনো নামখানা আর না দিয়ে পারলাম না। জ্যেষ্ঠতাত প্রদত্ত সুন্দর একটি নাম থাকতে দিনের পর দিন ক্রমাগত একদল লোক যদি আপনাকে 'পিঙ্কি-পিঙ্কি ' বলে থাকে এবং শুধু তাই নয় নাম বিভ্রাটে আপনার অত্যন্ত প্রয়োজনীয় জিনিষ আপনি হাতে পাচ্ছেন না, এমতাবস্থায় মাথা গরম হয় কি না বলুন? 'পিনাকী' নামটির উত্পত্তি তো আমি যদ্দুর বুঝি 'পিণাক' থেকে অর্থাত কিনা 'পিণাক হস্তে যাহার'। কোন সমাস ভুলে গেছি। মোদ্দা কথা 'পিনাকী' শব্দটির অর্থ মহাদেব, শিবঠাকুর। যিনি নাকি সর্বাংশেই দৃপ্ত পৌরুষের প্রতীক। তাঁর সমনামধারী কোনো মানুষকে নিঃসন্দেহে  কি করে একজন মহিলা হিসাবে ধরে নেওয়া যেতে পারে আমার তো মাথায় ঢোকে না। নাকি 'ই-কার ' অন্ত শব্দের স্ত্রীলিঙ্গ অনুসঙ্গের জন্যই শুধুমাত্র এই ভুল? হিন্দিভাষী বলয়ে পুরুষদের মধ্যে 'পিনাকী' নামটি প্রচলিত নয় একেবারেই। তুলনায় মহিলাদের মধ্যে 'পিঙ্কি' নামটি বহুল প্রচলিত। ফলে প্রথম থেকেই বেচারা পিনাকীকে তার পিতৃদত্ত নামটির মাঝখান থেকে একটি 'আ কার' মায়া ত্যাগ করতে হয়েছিল। অনেকের কাছেই 'শ্রী পিনাকী মন্ডল' 'শ্রীমতী পিঙ্কি মোন্ডাল' হয়ে বিড়ম্বিত হচ্ছিলেন। আর পিনাকীর অবসম্ভাবী মহিলা অনুসঙ্গ যেহেতু আমি, সেহেতু ইনস্টিটিউট এর সিকিউরিটি গার্ড, অনলাইনে কেনা জিনিষপত্র ডেলিভারি দিতে আসা মানুষেরা সকলের কাছেই আমিই হয়ে উঠলাম শ্রীমতী পিঙ্কি মোন্ডাল। কারণ পিঙ্কি তো মহিলাদের নাম। প্রচন্ড কনফিডেন্সের সঙ্গে আমায় লোকে অর্পিতার জায়গায় পিঙ্কি বলে ভুল করতে থাকলো আর আমিও কখনো হেসে, কখনো রেগে সে ডাকে সাড়া দিতে থাকলাম। তার বেশ কিছু ঘটনার কথা তো আপনাদের জানা। ব্যাপারটা আমাদের কাছে বেশ একটা মজার ব্যাপার হয়ে উঠেছিল। কিন্তু সমস্যাটা হয় যখন এই বিভ্রাটে সত্যি সত্যি কিছু ঝামেলার উত্পত্তি হয়। সেরকমই একটি ঘটনার কথা বলি। 

গত তেইশ থেকে ছাব্বিশে জানুয়ারির সাপ্তাহান্তিক ছুটিতে বেড়াতে গিয়ে বীরত্ব দেখাতে গিয়ে লেন্স জুম্ করা অবস্থায় নিজের কম্প্যাক্ট ক্যামেরার ব্যাটারিটি আমি খুইয়েছিলাম। কি করে এই আপাত অবিশ্বাস্য ঘটনাটি আমি ঘটালাম তার ব্যাখ্যা আমি পরে দেবখন। আপাতত আমার সাধের ক্যামেরা ব্যাটারির অভাবে "ব্যাদড়া বালক" এর মতন মুখ ছুঁচালো করে দাঁড়িয়ে রইলো। কোনো ভাবেই তার হাঁ করা মুখ আমি লেন্স কভার এর আবরণে ঢাকতে পারলাম না। শেষে ধুত্তেরি বলে সেই অচল সরু মুখী ক্যামেরার লেন্স টিসু পেপার দিয়ে মুড়ে কোনক্রমে আর্দ্রতা আর ধুলো ময়লা থেকে বাঁচাবার একটা ব্যর্থ প্রচেষ্টা করে হাঁ করা ক্যামেরা বগলদাবা করে বেজার মুখে বাকি বেড়ানো সম্পূর্ণ করে ফিরে এলাম। আর ফিরে এসেই আমার প্রথম কাজ ছিল ক্যামেরার ব্যাটারি অর্ডার করা। অনলাইনে সে অর্ডার দিতে গিয়ে দেখি "পয়সা কড়ি আগে থেকে না দিলে কিন্তু দিতে পারব না বাপু" নোটিশ সাঁটা। আমিও সাথে সাথে "হ্যাঁ বাবা, এই নাও বাবা, আমার ব্যাটারিটা কিন্তু যত শীঘ্র সম্ভব দিয়ে দিও বাবা। ব্যাটারির অভাবে আমার সাধের ক্যামেরা হাঁ করা মুখ বন্ধ পর্যন্ত করতে পারছে না বাবা- একটু তাড়াতাড়ি দিও বাবা " ইত্যাদি করে ঝটপট অর্ডার করে ফেললাম। তারপর হা ব্যাটারি, যো ব্যাটারি। কদিন পরে অনলাইন ট্র্যাকিং এ 'ডেলিভারড' কথাটা দেখেই লাফ দিয়ে উঠে সোজা নিচে রিসেপশনে সিকিউরিটি গার্ড এর কাছে। তার কাছেই দিয়ে যায় সব জিনিস। নেহাত 'ক্যাশ অন ডেলিভারি' তকমা না থাকলে আমাদের নিচে তলব পড়ে না। যে যার সময় মতন নিজের নিজের প্যাকেট সংগ্রহ করে নেয়। অর্ডারটা দেওয়া হয়েছিল পিনাকীর নামে। পিনাকীকে দেখিয়ে বললাম এর নামে কোনো প্যাকেট আছে? সিকিউরিটি গার্ড মুখ বেঁকিয়ে, মাথা নেড়ে বলল না কোনো প্যাকেট নেই। যা বাবা! হলো টা কি?  তারপর পরপর তিন চার দিন একই খবর। প্যাকেট আসেনি। এদিকে ট্র্যাকিং বলছে আইটেম ডেলিভারড। এদিকে আমার হাঁ করা ক্যামেরার লেন্স এ তিনজায়গায় ছত্রাক ফুল ফুটিয়ে ফেলল আমার ব্যাটারির দেখা নেই। রেগেমেগে বিক্রেতাকে এক গ্যালন কটুকাটব্য করব বলে ফোন করতে যাব, হটাত মনে হলো এ সেই পুরনো নাম বিভ্রাটের কেস নয় তো? নিচে গিয়ে বাচ্চা গার্ডটিকে বললাম ভাই একটু ভালো করে দেখনা তোমার ভান্ডারে আমাদের নাম কোনো প্যাকেট আছে কিনা। বড়ই জরুরি প্যাকেট আমার। বলল কি নামে আছে? বললাম "পিনাকী", তার দেরাজ হাঁটকে যথারীতি বেরোলো 'পিঙ্কি মোন্ডাল' এর প্যাকেট। তিন দিন আগে দিয়ে গেছে সেই প্যাকেট। আমি পিনাকী কে দেখিয়ে বলেছিলাম এর নাম কোনো প্যাকেট আছে কিনা। ফলে গার্ড কোনো পুরুষালী নাম খুঁজতে গিয়ে 'পিঙ্কি মোন্ডাল' কে নস্যাৎ করে দিয়েছে। প্যাকেটের গায়ে জ্বলজ্বল করছে 'পি-না-কী" কথাটা। মাঝের একটি 'A' কে অনাবশ্যক ভেবে আর ধর্তব্যের মধ্যে আনেনি হিন্দিভাষী গার্ড ছেলেটি। ফলে নামটি হয়ে পড়েছে 'পিঙ্কি', আর সেটি তো কোনো ছেলের নাম হতে পারে না। সুতরাং পিনাকীর কোনো প্যাকেট আসেনি এই তিনদিন ধরে। আর আমার ক্যামেরার হাঁ মুখ ও বন্ধ হয়নি। 

এই পর্যন্ত শুনেই পিনাকী রিসেপশন কাউন্টার এর পেছন দিকে চলে গেল। এরপর আমি যতক্ষণ ধরে হাত পা নেড়ে, প্যাকেটে লেখা বানান দেখিয়ে দেখিয়ে গার্ডটিকে 'পিনাকী ' আর 'পিঙ্কি' র তফাৎ বোঝাচ্ছিলাম, আর আমার নাম 'পিঙ্কি' নয় 'অর্পিতা', পিনাকীর নামও 'পিঙ্কি' নয় 'পিনাকী' যেটি বঙ্গ অভিধান মতে একটি পুরুষের নামই হওয়া সম্ভব, 'পিঙ্কি'-র সাথে আমাদের দুজনের নামের কোনো সম্পর্ক নেই-কোনদিন ছিলও না, এরপর কোনো প্যাকেট ডেলিভারি দিতে যেন এই ভুলটা না করে-এইসব বোঝাচ্ছিলাম আর রিসেপশনের মহিলা আমার মতন ম্যাদামারা ব্যক্তিত্বের হটাত এই উত্তেজিতার কারণ মগজস্থ করতে না পেরে আমার আর হাত পা নাড়া আর গার্ড এর মাথা নাড়ার দিকে ক্রমান্বয়ে গোলগোল চোখ করে দেখে গেলেন। আর এই পুরো সময়টা ধরে যার নাম নিয়ে এত সমস্যা তিনি রিসেপশন কাউন্টারের পেছনে অটোমেটিক বুট পালিশ মেশিনের সামনে পা বাড়িয়ে জুতোর ধুলো ঝাড়তে ঝাড়তে খ্যাক-খ্যাক করে হেসে গেলেন। সাধে কি বলে 'যার জন্যে করি চুরি সেই বলে চোর'।         

0 comments:

Post a Comment