Sunday 20 December 2020

গপ্পগাছা

আচ্ছা খাঁদু, তুই কি সকালবেলার সদ্য নামানো তালের রস খেয়েছিস? একবার ছোটবেলায় খুব সকালে, রোদ ওঠেনি তখনও মনে আছে। কুয়াশা হয়েছিল বোধহয়। সদর দরজা দিয়ে ঢুকেই উঠোনের সামনেটা বুঝলি। ঝুমরোদা দেখি এক ক্যান ভর্তি তালের রস নিয়ে এসেছে। সদ্য নামানো। উফফ সে নাকি এক মহার্ঘ্য ব্যাপার। না মানে সদ্য নামানো তালের রস তো সত্যিই খুব মিষ্টি। আমার জানিস খেয়ে বিশেষ ভাল লাগেনি। তা সেকথা বলতেই তিনজনে বিস্তর অবাক হল। তখন অমন খারাপ লাগলে দুমদাম বলে দেওয়া যেত।  তিনজন মানে মা- বাবা- আর ঝুমরোদা। তারা পুরো একগ্লাস করে খেয়ে ধন্য ধন্য করছে। আর এদিকে আমার নাকে যেন বদখত একটা গন্ধ আসছে মনে হচ্ছে। এমন ছাড়া ছাড়া করে বলছি তার কারণ, অমনই মনে পড়ছে। ঘটনার আগা-পাশ-তলা আর কিছুটি মনে নেই। মিষ্টি স্বাদের বাজে গন্ধওয়ালা তরলটিকে এত তোল্লাই দেওয়ার কি আছে সেটা বুঝতে না পেরে নিজের রসনাকে দোষ দেব, না আর দুচুমুক দিয়ে দেখবো সেই দোটানায় ভোম্বলের মতন দাঁড়িয়ে ছিলাম মনে পড়ে। সত্যিই বেশ খারাপ খেতে লেগেছিল। আসলে কি বলত ছোটবেলায় নাক- কান- জিভ ইত্যাদি বেশ তীক্ষ্ণ ছিল বুঝলি। যত দিন গেছে তত ব্যবহার না করে করে ভোঁতা করে ফেলেছি। ঐ অসাধারণ শর্করার ভাণ্ডারকে ফাঁপিয়ে সুধারস তৈরির পদ্ধতি ততক্ষনে শুরু হয়ে গিয়েছিল যার প্রাথমিক গন্ধটাই আমার নাকে এসে লেগেছিল। ছোটকালে খারাপ অনুভূতি ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য তো থাকেই তার সাথে সাথে খারাপ কে খারাপ বলার উৎসাহও দেখেছি বেশ থাকে। এখন হলে হয়ত ওইটুকু গন্ধ নাক অবধি পৌঁছাতও না। বেশিরভাগ অপছন্দের জিনিস ইন্দ্রিয় অগ্রাহ্য করতে পারে এখন। বড় হয়ে যাবার এই একখানা বেজায় সুবিধা আছে বুঝলি। তুইও যখন আরও বড় হয়ে যাবি দেখবি নাকে বদ্গন্ধটন্ধ বিশেষ পাচ্ছিস না। বদবাক্য কান পর্যন্ত তেমন করে আর পৌঁছচ্ছে না। দূষিত দৃশ্য চোখ পার হয়ে মাথা পর্যন্ত যাবার পথ পাচ্ছে না। ইত্যাদি বিস্তর সুবিধা দেখবি। কেমন নিজেকে বেশ সাধক সাধক মনে হবে। খাবি, ঘুমবি আর নিজের কাজ করবি। একেবারে সরলরৈখিক জীবন। হ্যাঁ তা যা বলছিলাম। এখন মাঝে মাঝে মাথায় দুষ্টু বুদ্ধি খেলে জানিস, মনে কর যদি মাকে বলি, “তুমি আমায় বাচ্চা মানুষ পেয়ে জোর করে সেদিন তাড়ি খেতে বলছিলে! তারপর যদি ভাল লেগে যেত? আর কালক্রমে তাড়িখোর মাতাল হয়ে যেতুম! ও জিনিষের তো অভাব কোনোকালেই ছিল না আশেপাশে।” মনে কর, খুব গম্ভীর, আলোচনাযোগ্য পরিণত মানুষের গলায় যদি মাকে জিজ্ঞাসা করি এসব? করে দেখবো কি জবাব পাই, তারপর তোকে জানাবো। তবে কি জানিস আর কিছুটা বড় হয়ে একবার খালনা গিয়ে গুড়ের শাল থেকে অর্ধতরল তালের গুড় খাবার সৌভাগ্য হয়েছিল। আহা রে! সে কি ভাল! কি ভাল! তোর খালনার কথা মনে আছে? তুই গিয়েছিস বেশ কয়েকবার তোর বাবার মোটরসাইকেলে চেপে। তুই অবশ্য তখন পুঁচকে। মনে থাকার কথাও নয়। তা সে যাই হোক। খালনায় সাবেকি বাঁড়ুজ্জে বাড়ির জটলাটা থেকে বেরিয়েই বাঁয়ে ওই যে জগদ্দল দীঘির মতন পুকুরটা রে, আর তাকে পাক মেরে ইঁট বাঁধানো পায়ে চলা রাস্তাটা। সেইটে ধরে বড় রাস্তায় ওঠার আগেই ডাইনে প্রতি বছরই ওরা গুড় বানাতো জানিস। গুড় বানানোর ওই আয়তাকার জায়গাটা কি দিয়ে ওরা বানাতো সে আমি জানি না। মাটি দিয়ে? কে জানে? কি বিশাল রে বাবা! ওকে যে শাল বলে সে আমি জানতুম না। সেই আমার গুড় তৈরি দেখা। সারা পাড়া ম ম করছে গন্ধে। কি ভাল গন্ধ রে! ওই একই তালের রস থেকে তাড়ির অমন উৎকট গন্ধ আর গুড়ের ওই সুবাস! ভাবা যায়! ওই আর কি যেমন রান্না তেমন স্বাদ। আমি আর টুকুনদিদি বোধহয় ছিলুম। কিরে টুকুনদিদি তুই ছিলি তো সেদিন আমার সাথে? আর কে থাকবে ওখানে! তুইই ছিলি। দাঁড়িয়ে দেখছিলুম দেখে তারা দুজনকে দুটি ছোট বাটিতে করে গরম গুড় দিলে খেতে। ঈষদুষ্ণ গুড়ে তর্জনী ডুবিয়ে তারপর সাবধানে টপ করে পুরো আঙ্গুলটা মুখে ঢুকিয়ে দিবি, বুঝলি। তারপর আর সব ভুলে যাবি। বাটিটা ছোট ছিল বড্ড বুঝলি। তারপর আর কি, বাটি ফেরত দিয়ে দুজনে আঙ্গুল চাটতে ফিরে গেলুম আমি আমার পিসিমার বাড়ি আর টুকুনদিদি তার মামারবাড়ি। সে আর এক দারুণ মজার জায়গা ছিল তখন।

0 comments:

Post a Comment