Friday 19 December 2014

তারকেশ্বর-বালিপুর-রাধানগর............দ্বিতীয় পর্ব

তারকেশ্বর-বালিপুর-রাধানগর ভ্রমনের যে গল্পটা আপনাদেরকে বলতে শুরু করেছিলাম, ঠান্ডার চোটে আর ল্যাবের চাপে সে গপ্পে খানিক বাধা পড়ে গেছিল। সে জন্য আমি আন্তরিক ভাবে দুঃখিত। গলবস্ত্র হয়ে ক্ষমা টমা চেয়ে নিয়ে বাকি অংশটা বরং বলে ফেলি কেমন?

বালিপুরে দুদিন ধরে ঠাকুমা-কাকিমাদের অনবদ্য রান্নাখেয়ে দেয়ে যখন মনটা তর-চোখটা আধবোজা আর ভুঁড়িটা আরো খানিকটা মোটা হয়ে উঠেছে তখন এসে পৌঁছালো মাধবী পিসি। যাঁর কথা আগের পর্বে বলেছি। সঙ্গে বিশাল এক ক্যান ভর্তি বাড়ির গরুর ঘন দুধ। আর স্বপন কাকা এনে হাজির করলো সাড়ে তিন কেজি ছোটো ছোটো পুঁটি মাছ। কারণ বৌমাটি দুধ এবং পুঁটি মাছের ভক্ত। বৌমাটির তো তখন "এতা কাবো, ওতা কাবো, থব কাবো" গোছের অবস্থা। কোনটা ছেড়ে কোনটা খাই? উঠোনে পা ছড়িয়ে বসে সবাই মিলে সেই মাছের পাহাড় বাছা শেষ হলো। তারপর উঠেই শুনি একটা অপ্রত্যাশিত খবর। বালিপুর থেকে রাধানগর মানে রাজা রামমোহন রায় এর জন্মস্থান নাকি খুব সামনে। ওঁনার নিজের তৈরী বাড়ির ধংসাবশেষ এখনো রয়েছে। এবং আমরা সেখানে যাব দুপুরে খাওয়া দাওয়ার পরে। স্বপনকাকা সারথী। সঙ্গে খানাকুলের বিখ্যাত গোপীনাথজী-র রাসের মেলা আর ঘণ্টেশ্বর মন্দির ফাউ পাওনা। একটা দেখলে দুটো ফ্রি। শুনেই তো আমার পায়ের নিচে সর্ষেগুলো কিলবিল করে উঠলো। মনটা উড়ু-উড়ু হয়ে গেল। এখানে এসে যে অমন একটা দর্শনীয় স্থান অপ্রত্যাশিত ভাবে দেখা হয়ে যাবে, কে জানত? আনন্দের চোটে কোঁত-কোঁত করে খানিকটা দুধ খেয়ে, ঝপাঝপ স্নান সেরে, পুঁটিমাছের ঝাল দিয়ে তারিয়ে তারিয়ে ভাত খাওয়ার লোভ সামলে চটপট ভাত-মাছ খেয়ে নিয়ে, তীর্থের কাকের মত স্বপনকাকার দিকে চেয়ে বসে রইলাম দুজনে। সে বেচারা ব্যবসাপাতি সামলে-সুমলে, ঘরে ফিরে, স্নান খাওয়া সারছে। আর আমাদের দুজনের দুজোড়া চোখ ড্যাবডেবিয়ে তাকে অনুসরণ করে চলেছে। আমাদের নীরব তাড়ার চোটে কোনক্রমে নাকেমুখে দুটো গুঁজেই বেচারাকে মোটরবাইক নিয়ে বেরোতে হলো। 

দুপুর তিনটের সময় দুজনে স্বপনকাকার পিঠে চেপে রওনা হলাম। পথে মুন্ডেশ্বরী পার হলাম কুড়কুড়ি-র ঘাটে। 

কুরকুড়ি ঘাটের পথে

সেই বাঁশের সাঁকো। অদ্ভূত সুন্দর জায়গাটা। নেহাত পঁচিশে ডিসেম্বর আর পয়লা জানুয়ারিতে পিকনিক করিয়ের দল জায়গাটার খোঁজ পায়নি তাই জায়গাটি এখনো কুমারীই রয়ে গেছে। আমাদের রূপনারায়ণ-এর তীরের মতন এখনো একে বছর বছর ডিসেম্বর-জানুয়ারী মাসে গণধর্ষিতা হতে হয়না। শান্ত নিরিবিলি বালির চর। তন্বী মুন্ডেশ্বরী সিধে একটা বাঁশের সাঁকো। সেখানে কখনো কখনো বাচ্চা কাঁকে মা, ধুতি পরা দাদু, সাইকেল বা মোটর সাইকেল এ সাধারণ যাত্রী পারাপার করছে।সেখানে আমাদের মতন শহুরে জামাকাপড় পরা চোখে সানগ্লাস আঁটা বেয়াদবরা বড়ই বেমানান। বাঁশের সাঁকোটার ঠিক সোজাসুজি একটা ঋজু তালগাছ যেন ঠিক ছবি তোলার জন্য মাপ করে বসানো। 

কুরকুড়ি-র ঘাটে মুন্ডেশ্বরী 

সাঁকো পেরিয়ে এসে একটা বাঁশেরই ছোটো মাচা। পারানির কড়ি দিতে হবে এখানে। মন ভরে গেল কুড়কুড়ি-র ঘাট দেখে। স্বপনকাকাকে বলে কিছুক্ষণ দাঁড়ালাম এখানে। তিনি অবাক। তার রোজকারের এই রাস্তা এই সাঁকোতে কেন এতটা সময় নষ্ট করছি আমরা বুঝতেই পারলেন না। আমাদের ছেলেমানুষী দেখে হেসেই খুন। "চল চল দেরী হয়ে যাচ্ছে, অনেকটা রাস্তা যেতে হবে, আরো সুন্দর সুন্দর জায়গা আছে সামনে।" অগত্যা আবার এগোলাম। 

আবার আসতে রাজি আছি এই সাঁকো পেরোতে     
গ্রাম পঞ্চায়েতের তরফ থেকে গ্রামের ভেতর ভেতরের রাস্তা গুলোকেও বাঁধিয়ে দেওয়া হয়েছে, এতটা রাস্তা যেতে কোথাও পুরনো সেই লাল মোরাম ফেলা রাস্তা নেই, সবই ঢালাই করা রাস্তা। কিন্তু এখনো এইসব জায়গা কিরকম গ্রাম তা বলে বোঝানো যাবে না। ভালো হাসপাতাল, ভালো স্কুল- কলেজ কিচ্ছু নেই। শুধু ঘরে ঘরে ডিস্-এন্টেনার বাহুল্য চোখে পড়ার মত। স্বপনকাকা নানান রকম গল্প করতে করতে চলেছিলেন। আমার পেছনে বসে বসে একটা কথা মাথায় ঘুরছিল শুধু। আমরা চলেছি রাজা রামমোহন রায় এর বসত বাড়ি দেখতে। যে বাড়ি নাকি তিনি নিজে বানিয়েছিলেন থাকার জন্য, যখন নাকি তাঁর বাবা তাঁকে ত্যাজ্যপুত্র করেছিলেন সমাজবিধির বিরুদ্ধে যাবার জন্য। আমার মাথায় ঘুরছিল একটা কথা যে, এই জায়গা এখনই এরকম গ্রাম, আজ থেকে প্রায় দুশো বছর আগে রামমোহন রায় এর সময়কালে এই জায়গা কেমন ছিল তার আন্দাজও বোধহয় আমরা আজ ২০১৪ সালে বসে করতে পারি না। সেই শিক্ষা -সভ্যতার সংস্পর্শবিহীন গ্রামে রক্ষণশীল গোঁড়া হিন্দু পরিবারে জন্মে এত মনের জোর, এত পরিস্কার মাথা, এত সজাগ দৃষ্টিভঙ্গি কেমন করে পেলেন তিনি? দাপুটে জমিদার বাবার বিরুদ্ধে গিয়ে, পারিবারিক সম্পত্তির মায়া ত্যাগ করে, সমাজের বিরুদ্ধে গিয়ে এই অজ গাঁয়ের এই লোকটির মত কিছু লোক সেদিন দূরদৃষ্টির পরিচয় দিয়ে সব প্রতিকূলতাকে সরিয়ে মেরুদন্ড সোজা করে দাঁড়াতে পেরেছিলেন বলেই হয়ত আজ আমার মতন মেয়েরা ব্লগ এ নিজের কথা লিখতে পারছে। নইলে শিক্ষা-সভ্যতার আলো দেখতে এদেশের মেয়েদের আরো কত শত বছর লাগত কে জানে? মনে মনে সেইসব মহামানবদের প্রনাম করলাম। চলতে চলতে এসে পৌঁছলাম নাঙ্গুলপাড়া। এখানেই সেই তীর্থস্থান। জীর্ণ বোর্ড ঢোকার মুখে গেটের ওপরে।



ভেতরে ঢুকতেই ডানহাতে বাড়ির মালিকের আবক্ষ মূর্তি। আর সোজা নাক বরাবর তাকালে একটি পাকা ভাঙ্গা বাড়ির কঙ্কাল। সেইটিই আমাদের দ্রষ্টব্য। এই বাড়িতে থাকতেই নাকি নিজের বৌদিকে সহমরণে বাধ্য করার প্রতিবাদে রাজা রামমোহন রায় সহমরণ প্রথার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ান। সেসব কথা এই বাড়ির বাগানের এখানে ওখানে বড় বড় বোর্ড এ লেখা আছে। সাথে তাঁর  জীবনের নানা ঘটনার কথা। এই সেই বাড়ি।

  




আর ডানদিকে বাঁদিকে বাগান। বহু পুরনো আমলের বড় বড় গাছ জায়গাটিকে যেন থমথমে করে রেখেছে। কেমন যেন পুরনো দিনের অনুভূতি মনের মধ্যে জেগে ওঠে। আছে একটি পুকুরও। সেখানে নাকি পিকনিক মরশুমে বোটিংও হয়। এখন পুকুরে অযত্নের ছাপ স্পষ্ট।

বাগানে আছে একটা তিনতলা watch tower, মনে হয় ওটা পরে বানানো। সেখানে উঠে চারপাশটা সুন্দর দেখা যায়। বাগানের প্রাচীনত্বের সাথে এই watch tower টি বেমানান। বসত বাড়িটি দেখে মনটা কেমন যেন ভারী হয়ে গেল। বেরিয়ে এলাম। পরবর্তী গন্তব্য রাধানগর গ্রাম। যেখানে আছে রামমোহন মেমোরিয়াল হল। সেখান থেকে যাব কাছাকাছির মন্দিরগুলো দেখতে। কিন্তু আমার কেমন যেন আর ভালো লাগছিল না কোথাও যেতে। যাই হোক, এগিয়ে চললাম রাধানগরের দিকে।

0 comments:

Post a Comment