Wednesday 10 June 2020

চিঠি

মাস-দেড় দুই আগের কথা বোধহয়, তখনও বিপদ এসে বাসা বাঁধেনি মাথার উপর। অন্যের বিপদ দেখলে ভয় হয়, চিন্তা হয়। আতঙ্ক বোধহয় হয়না। কারণ বিপদটা অন্যের। জিমে ছিলাম কাকভোরে। বাইরে অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে শরীরটাকে সচল করার চেষ্টায় আছি। সামনে টিভির খবরে কেবলই মহামারী আর মৃত্যুর সচল সংবাদ পরিবেশিত হচ্ছে। প্রায় সবই ইউরোপ এবং চীনের খবর তখন। সাতসকালে পরিবেশিত সংবাদে জীবন না থাকলে সে সংবাদ চট করে কানে ঢোকে না আমার। আর আজকাল সংবাদ মানেই যেহেতু দুঃসংবাদ, তাই প্রয়োজন ছাড়া বড় একটা ওদিক পানে পা না রাখারই চেষ্টা করি। সেদিনও কান ছিল অন্যকিছুতে। একটি অডিওবুক। 'শ্রুতিগ্রন্থ' বলি যদি বেশ লাগে তাই না? তা সে যাই হোক, কানের মধ্যে দিয়ে ফের পড়ে নিচ্ছিলাম সেদিন ‘ন হন্যতে।’ সেদিন পড়ছিলাম বললে ভুল হবে। বিগত বেশ কয়েকদিন ধরে ধারাবাহিক ভাবে শুনছিলাম। ল্যাবে হাতের কাজ সারতে সারতে, রান্না করতে করতে, বাসন ধুতে ধুতে, আবার সেদিন যেমন জিমে গা ঘামাতে ঘামাতেও। একটু অবাক লাগছে হয়তো তাই না? জিমে মানুষ দ্রুতলয়ের উচ্চকিত সুরে অভ্যস্ত। আমার কান বা মস্তিষ্কের বোধহয় এ বোধ খানিক কম। আমার কীর্তন শুনতে শুনতে গা ঘামাতেও অসুবিধা হয়না বিশেষ। যা শোনা হয়নি, অথচ শুনতে খুব ইচ্ছে করছে এবং সে মূহুর্তে আর অন্যদিকে কান বা মাথা দেবার তেমন একটা প্রয়োজন নেই, সেরকম সময়ে যেকোনো কিছুই শুনতে আমার অসুবিধা হয়না। 

কিন্তু সেদিনের সেই ন হন্যতে-র পাঠ শুনতে শুনতে কেবলই হাত পা শিথিল হয়ে আসছিলো। পাঠিকা পড়ছিলেন রবীন্দ্রনাথের একখানি চিঠি। তিনি লিখছেন তাঁর স্নেহের অমৃতাকে। 

"....জীবনের পরিণতি একান্ত স্মৃতির মধ্যে দিয়ে নয়, দিনে দিনে বেদনাকে বেদনার মধ্যে দিয়ে নিয়ে গিয়ে, কঠোরকে ললিতে, অম্লতাকে মাধুর্য্যে পরিপক্ক করে তোলাই হলো পরিণতি। তোমার যে তা ঘটবে তা আমি মনে করিনে। কারণ, তোমার কল্পনাশক্তি আছে। এই শক্তি সৃষ্টিশক্তি। অবস্থার হাতে নিষ্ক্রিয় ভাবে নিজেকে সমর্পণ করে তুমি থাকতে পারবে না। নিজেকে পূর্ণতর করে তুমি সৃষ্টি করতে পারবে। আমি জানি আমাদের দেশের পক্ষে উদারশক্তিকে আত্মবিকাশ সম্ভব নয়। বাইরের দিকের প্রসারতার ক্ষেত্র তাদের অবরুদ্ধ। অন্তর্লোকের প্রবেশের যে সাধনা সে সম্বন্ধেও আনুকূল্য তাদের দূর্লভ। তুমি হতাশ হয়োনা। নিজের ওপর শ্রদ্ধা রেখো। চারিদিক থেকে আপনাকে বিচ্ছিন্ন করে নিয়ে সেই গভীর নিভৃতে নিজেকে স্তব্ধ করো, যেখানে তোমার মহিমা তোমার ভাগ্যকে অতিক্রম করে। তোমার পীড়িত চিত্তকে সান্ত্বনা দেওয়ার শক্তি যদি আমার থাকত, আমি চেষ্টা করতুম। কিন্তু একান্ত মনে তোমার শুভকামনা করা ছাড়া আমার আর কিচ্ছু করার নেই। যদি বাইরে কোনো ক্ষুদ্রতা তোমাকে পীড়ন করে থাকে তবে তার কাছে পরাভব স্বীকার করতে লজ্জা বোধ কোরো।"

সেই কোন ১৩৩৭ সালে কোনো এক নিভৃতচারিনী মননশীল স্নেহাষ্পদাকে লিখেছিলেন বৃদ্ধ এক কবি। আর এই ১৪২৭ বঙ্গাব্দে দাঁড়িয়ে সম্পূর্ণ বিপরীত পরিবেশে আর একজন নারীকে স্থবির করে দিল সেদিন সেই একই চিঠি। মনে মনে হিংসা হতে লাগলো। আমি যদি কাউকে ভরসা করে আমার মনের নিভৃত অপূর্ণতাটুকু নিবেদন করি, আমার এত বছরের জীবনেও এমন কি কেউ আছে যে আমায় এমন করে সে লেখার উত্তর দেবে? এমন করে লেখার অক্ষর দিয়ে মনের পাথর সরিয়ে দেবে? ক্ষতের উপশম তো চাইনি কোনোদিন। সে তো আমার নিজের কাজ। কিন্তু তবুও এমন একজন মানুষকে কাছে পেতে ইচ্ছে করে যিনি দূর থেকে হলেও সে ক্ষত যে বাইরের, সে ক্ষত যে কত 'ক্ষুদ্র' সেটুকু মনে করিয়ে দেবেন। তাতে ক্ষত আপনা থেকেই সেরে উঠতে উৎসাহ পাবে। দুকলম চিঠিতে কেউ যদি আমায় লিখতো, "তোমার পীড়িত চিত্তকে সান্ত্বনা দেওয়ার শক্তি যদি আমার থাকত, আমি চেষ্টা করতুম। কিন্তু একান্ত মনে তোমার শুভকামনা করা ছাড়া আমার আর কিচ্ছু করার নেই।" তাহলেও বর্তে যেতুম পরের লাইনটি পড়ে। 

"যদি বাইরে কোনো ক্ষুদ্রতা তোমাকে পীড়ন করে থাকে তবে তার কাছে পরাভব স্বীকার করতে লজ্জা বোধ কোরো।" আহঃ, ঈশ্বর যদি নিজে আসতেন আমার নিভৃত রাতের বন্ধু হয়ে তিনিও কি এর চাইতে অধিক কিছু বলতেন আমায়! 

যা কিছু আমায় পীড়ন করে, যা কিছু আমায় "নিজেকে পূর্ণতর করে সৃষ্টি" করার পথে বিপুল অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায়, যা কিছু আমার "বাইরের প্রসারতার" এবং "অন্তর্লোকের প্রবেশের সাধনা"-র পথরোধ করে দাঁড়িয়ে আমাকেই ক্ষুদ্র বলে নিরন্তর পরিহাস করে চলে প্রতিনিয়ত, সেই সব কিছুকে এই একটি বাক্যে যদি কেউ আমার মন থেকে মুছিয়ে দিতে পারত! আমি নিশ্চিন্তে নতুন জন্ম নিতুম। এসব কিছুই যে শুধু বাইরের, এসব কিছুই যে শুধু ক্ষুদ্রতা তাই নয়, এর কাছে "পরাভব স্বীকার করতে লজ্জা বোধ কোরো।" সত্যি বলছি, একথা কেউ আমায় লিখলে আমি একশ রাতের একলা কান্না ফেলে উঠে ভোররাতে স্নান সেরে চিবুক উঁচু করে যুদ্ধে যেতে পারি।     
   
অন্তর্মুখী মানুষদের বিপদ বিষম। তারা না পারে নিজের মনের সঠিক অবস্থান সামনের কাউকে বুঝিয়ে বলতে, না পারে প্রিয় মানুষদের থেকে পাওয়া নির্মমতাকে অতিক্রম করে নিজের নিভৃতচারণের পথে একলা এগিয়ে যেতে। এমতাবস্থায় অন্তর্মুখী মানুষদের নিজেদের মনের বাইরের পরিসরে প্রতিদিনের রাত্রিদিনে যা অবশিষ্ট থাকে তা হলো, অভ্যাসের দিনযাপন আর তার সাথে ক্রমাগতঃ নিজেকে ক্ষুদ্র মনে করে আত্মমর্যাদার শেষ তলানিতে এসে পৌঁছানো।তাঁদের প্রত্যেকেরই যদি এমন একজন 'কবি' থাকতেন যিনি মনে করিয়ে দিতেন, "নিজের ওপর শ্রদ্ধা রেখো। চারিদিক থেকে আপনাকে বিচ্ছিন্ন করে নিয়ে সেই গভীর নিভৃতে নিজেকে স্তব্ধ করো, যেখানে তোমার মহিমা তোমার ভাগ্যকে অতিক্রম করে।" তবে কি সমস্ত বাইরের ক্ষুদ্রতাটুকু পার হয়ে এসে নতুন করে আর একটি সৃষ্টিশীল মানুষ জন্ম নিতে না? 

এখানেই কবির 'অমৃতা' জিতে গেছেন। অন্তর্মুখী অথচ সৃষ্টিশীল একজন মানুষ। তাই পারিপার্শ্ব তাঁকে ক্ষতবিক্ষত করতে ছাড়েনি। তবুও এমনই একেকটি চিঠি যাঁকে সমস্ত পার্থিব ক্ষুদ্রতা থেকে বের করে এনে বড় হয়ে উঠতে, সৃষ্টিকর্মেই নিজের ঈশ্বরকে খুঁজে নিতে শিখিয়েছিলো। যা সেদিনের সেই কাকভোরে বাইরের অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে আধুনিক জিমের এককোণে গা ঘামাতে থাকা আজকের মেয়েটির কাছে ছিল না। চরম এক অপাঙতেয় মনে হয়েছিল নিজেকে যার সঠিকভাবে ছাত্রী বা শিষ্যা হবার যোগ্যতাটুকুও বুঝি নেই। যাকে এমন চিঠি কেউ কোনোদিন লিখবে না। এমন করেই নানান লেখা থেকে, ছাপার অক্ষর থেকে, রেকর্ডেড অডিও থেকে খুঁটে খুঁটে তাকে জুগিয়ে চলতে হবে নিজেকে ঠেলে তোলার রসদ। এখনো বহুদিন। বিপদে উৎরে দেওয়ার প্রার্থনা যে কোনোদিন করেনি, চেয়েছে শুধু নির্ভয় থাকতে, নিজের শক্তির সঠিক সময়ে সঠিক প্রয়োগ করতে, তারও তো হতাশার দিনে সামনে ঋজু একজনকে দেখতে পেতে ইচ্ছে করে। একজন ব্যক্তিমানুষ। তাঁকে ঈশ্বর বলে ভেবে নিঃসংশয়ে বিপদের মাঝে এগিয়ে যেতে ইচ্ছে করে। তাঁকে দেখে নিজের জীবনকে ঈশ্বরসম করে গড়ে তুলতে ইচ্ছে করে। সে মেয়ে জানে এ নিতান্তই কষ্টকল্পনা। তবুও সেই আবছা ভোরের আলোয় আধুনিককালের এক নারীর মনে সেদিন প্রবল ঈর্ষা জেগেছিলো প্রায় একশ বছর আগেকার এক নারীর অন্ততঃ এই একটি সৌভাগ্যকে মনে করে। 

এতবছর আগের লেখা একটি চিঠির কতগুলি লাইন, সেই একশো বছর আগেকার একনারীর মনেও যে পূর্ণতা এনেছিলো, পৃথিবীর অন্যপ্রান্তে, চতুর্পার্শ্বে সম্পূর্ণ কেজো, কঠিন এক পরিবেশেও, অদ্ভুত এক উচ্চগ্রামের সুর থাকা স্বত্বেও, আজকের সেই অকিঞ্চিৎকর, কোথাও-না-থাকা সেই মেয়েটির মনে যে স্থিরতা এনেছিল, তাকে বোধহয় একাসনে বসানোই চলে। আর সেখানেই সেদিনের সেই বৃদ্ধ মানুষটির প্রাসঙ্গিকতা। যিনি কবি প্রাবন্ধিক, সুরকার, লেখক, দার্শনিক আর যা খুশিই হন না কেন, সব ছাপিয়ে তিনি যে সংবেদনশীল স্নেহাস্পদের মনের সঠিক হদিশ রাখা একজন ঈশ্বরসম পথপ্রদৰ্শক, এ পরিচয় মস্ত হয়ে দাঁড়ায়। পৃথিবীব্যাপী আসন্ন বিপদ, নিজের ক্ষুদ্র জীবনের অপূর্ণতা,  অনিশ্চয়তা, পারিপার্শ্বিকতা থেকে প্রতিনিয়ত প্রাপ্ত অযাচিত অপমান, এ সমস্তই "বাইরের", এ সমস্তই "ক্ষুদ্র" হয়ে দাঁড়ায়। সমস্তকে ম্লান করে কানে বাজতে থাকে, "চারিদিক থেকে আপনাকে বিচ্ছিন্ন করে নিয়ে সেই গভীর নিভৃতে নিজেকে স্তব্ধ করো, যেখানে তোমার মহিমা তোমার ভাগ্যকে অতিক্রম করে।"   

0 comments:

Post a Comment