Friday 8 May 2020

অন্য শহর


লাস ভেগাসের রাস্তায় ব্রহ্মা মন্দির।

প্রায় দুশো লোকের সাথে সিগন্যাল পেলে একসাথে রাস্তা পার হবার জন্য একটা ব্যস্ত রাস্তার ধারে জেব্রা ক্রসিং এ দাঁড়িয়ে ছিলাম। পায়ে হাঁটার সিগন্যাল হতেই একসাথে পা বাড়ালাম রাস্তায়। এত লোকের সাথে পা ফেলে রাস্তা পার হতে গিয়ে দুটি অনুভূতি মন ছুঁয়েই বেরিয়ে গেল। আমার মত মানুষের জন্য ওমাহার মত শান্ত শহরই ভাল। লোকজনের ভিড় নেই। অনর্থক চঞ্চলতা নেই। তাই এত লোকের সাথে একসাথে পথ পার হবার সুযোগও নেই। এতো গায়ে গা লাগানো ভিড়ে মন তিক্ত হয়ে যেতেই পারত। কিন্তু আমাকে অবাক করে দিলো আমার মন। আমার ভাল লাগছিলো সবার সাথে রাস্তার ধারে অপেক্ষা করতে। আমার ভাল লাগছিলো এত লোকের মাঝে 'কেউ না' হয়ে, ভিড়ের অংশ মাত্র হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে, পথ পার হতে। এই যে অন্তত দুশো লোক আমার ডাইনে-বাঁয়ে, আগু-পিছুতে দাঁড়িয়ে আছে, তাদের কাউকে আমি চিনি না। তারাও আমায় চেনে না। অথচ সকলে একটি নির্দিষ্ট সিগন্যালের দিকে চোখ রেখে অপেক্ষা করছেন। একসাথে হেঁটে রাস্তা পার হবেন বলে। রাস্তাটুকু পার হয়েই হয়তো এই দুশো লোকের পুরো 'ভীড়'টা ছত্রভঙ্গ হয়ে এদিক ওদিক ছড়িয়ে যাবে।তবুও এই অচেনা মানুষের ভিড়ের সকলের আপাতত গন্তব্য একই। রাস্তার ওই ওপারে যেখানে আরো একদল লোক অপেক্ষা করছে সিগন্যাল পেলেই এপারে আসবে বলে, সেই সেখানটায় পৌঁছানো। আমাদের জীবনের মতন না অনেকটা? কিছুদিনের জন্য ছোট্ট একটা রাস্তা পার হবার জন্য অপেক্ষা। আশে পাশের লোকজনের সাথে আদান প্রদান, মান- অভিমান তারপর রাস্তা পার হবার পর গন্তব্য বদলে যাওয়া। এই যে এত লোক আমার আশেপাশে তারা সকলেই আমার অচেনা। মাঝে মাঝে অচেনা লোকের সাথে অদৃশ্য হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে ইচ্ছে করে। নিজের অপরিমেয় "কেউ না" হওয়ার সত্যিটা নতুন করে উপলব্ধি হয়। আমার যা কিছু চাওয়া-পাওয়া- মান-অভিমান, আমার যা কিছু গুরুত্ব, আলাদা ব্যক্তি মানুষ হিসেবে আমার যা কিছু অন্য কারো কাছে এতটুকুও গুরুত্বপূর্ণ সেরকম মানুষের সংখ্যা গুনতে হাতের এক-দুইটি আঙুলের করই যথেষ্ট। আমরা জানি বা না জানি, মানি বা না মানি, পৃথিবী সুদ্ধ বাকি প্রতিটা লোকের কাছে আমি ভিড় মাত্র। জনবহুল রাস্তার আরো একজন মানুষ। এইটি মনে হলে নিজের প্রতি নজর খানিক কমে। এই যে এত লোক আমার গা ঘেঁষে আমার কাছে তো তারা ভিড় মাত্র। কিন্তু প্রতিটা অবয়ব, মন, অনুভব, হাসি কান্নার কারণ সব আলাদা। তাদের কাছে আমিও তো তাইই। এই কদিনে এই অনুভুতিটা বেশ হচ্ছে।
গত কয়েকদিন লাস ভেগাসে এসেছি। লোকজনের কথায় অবশ্য বুঝেছি, এখন 'লাস ভেগাস' -র জায়গায় 'ভেগাস' বলাটাই স্মার্টনেস। তা সে যাই হোক, আলোর আর হুল্লোড়ের শহর। যে বয়সে লোকে লাস ভেগাস যেতে পেলে মনে মনে নাচতে শুরু করে আমি সে বয়স পেরিয়ে এসেছি অনেকদিন আগেই। এখানে এসে অবশ্য প্রতিপদে লোককে বলতে শুনছি -"Ultimately it's Vegas." এবছর Society for Redox Biology and Medicine (SfRBM) বার্ষিক সম্মেলন হচ্ছে এখানে প্ল্যানেট হলিউড রিসোর্টে। প্রতিবছরেই এই সম্মেলনে আমরা আসি। কারণ রেডক্স বায়োলজির এটিই আপাতত সবচাইতে বড় সম্মেলন। এখানেই সমস্ত রেডক্স বায়োলজিস্টরা জড়ো হন। আইডিয়া আদান প্রদান করেন। আমরাও আমাদের কাজের ঠিক ভুল বুঝে নিই। তাই লাস ভেগাস যাবার আলাদা করে উৎসাহ কিছু ছিল না। যেটা ছিল সেটা হলো, এবছর এই দিন চার-পাঁচদিনের পুরো সময়টা আমার নিজের। এইটা আমার কাছে কম বড় পাওনা নয়। সাধারণত এই সম্মেলনে এতদিন আমি আমার গাইডের সাথে এসেছি, থেকেছি। শেষ দিনে হয়ত পিনাকী গেছে। সম্মেলনের পরের এক-দুই দিন সেই নতুন শহরে হেঁটে বেড়িয়েছি। কিন্তু এবছর আমার গাইড আসেননি। পিনাকীও আসবে না। সুতরাং কারো সময়ের সাথে আমার সময় মেলাবার দায় নেই আমার। উপরোন্তু যখন শুনলাম আমার সাথে থাকছে অন্য প্রদেশের, অন্য ইউনিভার্সিটির সম্পূর্ণ অচেনা একমেয়ে, আমার ভালো বৈ মন্দ লাগলো না। সম্পূর্ণ অচেনা মানুষের কাছে বসে তার কথা শুনতে বড় ভাল লাগে। কারণ সে মানুষ আমায় বিচার করবে না। করলেও সে বিচারে আমার কিছু যাবে আসবে না। তাকে ভালো লাগলে, তার কাছে আমার মন আলগা করে দিতে পারলে, সে আমার নিত্যদিনের দৈনন্দিকতায় নতুন মানুষ। আর ভাল না লাগলে তার সাথে সময় কাটাবার দায় আমার নেই। তাকে এড়িয়ে সম্পূর্ণ নিজের মধ্যে ঢুকে গিয়ে সময় কাটাতে আমার কিছুমাত্র অসুবিধা হবে না।
সুতরাং লাস ভেগাসে এসে যখন নামলাম তখন খানিকটা ছুটির দিনে কোনো পূর্বনির্ধারিত কাজ ছাড়া অনেক ভোরে সতেজ হয়ে ঘুম ভাঙার মতন একটা অনুভূতি হলো। হাতে অনেকটা সময় আর অনেকদিন ধরে করতে চাইছেন মনের মত এমন অনেক পড়ে থাকা কাজ আছে। কিন্তু আজই শেষ করতে হবে এমন কোনো তাড়া নেই। আবার শেষ করে ফেলতে পারলে বেশ একটা শান্তি আসে মনে। একা নিজের সময় নিজে নিয়ন্ত্রন করার বেশ একটা সুযোগ পেয়ে বুক ভরে শ্বাস নিয়ে লাস ভেগাসে এয়ারপোর্ট থেকে ল্যাবের আর দুইজনের সাথে প্ল্যানেট হলিউডের ঠিকানায় পৌঁছালাম। বেশিক্ষণের রাস্তা নয়। উবেরের ড্রাইভার আমাদের দেখে লাস ভেগাসের বড় বড় শো গুলির কথা জানাতে লাগলেন। আমি কোনোদিন আসিনি। আমাদের মধ্যে একজনই আগে বার-তিনেক এসেছে। আসলে এদেশে ছেলেপুলেরা প্রথম চাকরি বা পিএইচডি করতে এসে এখানে একবার করে আসেই। হুল্লোড়, গাঁঞ্জা, খোলা যৌনতার আর জুয়ার পীঠস্থান। তবে পুরোটাই নিপুন ভাবে কন্ট্রোলড। কোথাও কোনো বাজে ঝামেলা বিশেষ হয়না। তবে এই এত লোকজন আর এত শব্দ চারিদিকে সে বিষয়ে আমার একটা ভাল না লাগা ছুঁৎমার্গ ছিল। ছিল বলবো না, বলা ভাল আছেই। এখনো কোনো খোলা আকাশের নিচে নির্জন কোনো জায়গাকে আমি একবাক্যে বেশি ভোট দেব যেকোনো হুল্লোড়ে শহরের থেকে। কিন্তু ভিড়ের মধ্যে নিজেকে ভিড় বানিয়ে অদৃশ্য হয়ে যাওয়া ছাড়াও লাস ভেগাস আমায় আর কিছু দিয়েছে। সেটি হলো পারিপার্শ্বিকতাকে অস্বীকার করে মুহূর্তে নিজের খোলসে ভেতরে ঢুকে গিয়ে হুল্লোড়ের মধ্যেও শান্ত থাকার একটা প্রাথমিক পরীক্ষাস্থল।
মাঝে মাঝে নিজেকে ভাল না লাগা জায়গায় ফেলে দিয়ে দেখতে ইচ্ছে করে। কতটা পারিপার্শ্বিকতাকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে, ভীষণ রকম একটা হুল্লোড়ে জায়গায় বসে নিজেকে একটা অদৃশ্য বুদ্বুদের মধ্যে ঢুকিয়ে দিয়ে নিজের মধ্যে বুঁদ হয়ে থাকতে পারি তার একটা পরীক্ষা করতে ইচ্ছে করে। মানে কমফোর্ট জোনের বাইরে বসে মনটা বরফশীতল রাখার একটা চেষ্টা মনে করতে পারেন। প্ল্যানেট হলিউডে চেক ইন করে সন্ধ্যেবেলা যখন বাইরের রাস্তাটায় হাঁটাহাঁটি করব বলে ক্যাসিনোর ভেতর দিয়ে হেঁটে বেরোচ্ছি, তখন মনে হলো এই মানসিক এক্সসারসাইজটা করার জন্য এর চাইতে ভাল জায়গা আর দুটো হয়না। প্ল্যানেট হলিউড সিজার গ্রূপেরই রিসোর্ট। একদম লাস ভেগাসের বিখ্যাত রাস্তা স্ট্রিপ বা লাস ভেগাস বুলেভার্ডের ওপরেই এর অবস্থান। এই রাস্তাতেই ডাইনে বাঁয়ে পর-পর বিখ্যাত এবং সিনেমাখ্যাত ক্যাসিনোসহ হোটেলগুলো। প্ল্যানেট হলিউডের ক্যাসিনো লেভেল সুতরাং অত্যন্ত জনবহুল, সাথে রয়েছে ক্যাসিনো লাগোয়া নামি দামি খাবারের দোকান। ফলে ভিড়, ক্যাসিনোর উচ্চকিত বাজনা আর হুল্লোড়। কি নেই এখানে! ঠিক করলাম এখানেই বসে লেখার চেষ্টা করব। দেখাই যাক না মনস্থির করতে পারি কিনা। একটু চোখ চারাতেই দিব্যি একখানা স্টারবাক্স নজরে এসে গেল। তার সামনে ক্যাসিনোর প্রাইম জায়গাটা, বাঁয়ে ক্যাফে হলিউড নাম দিয়ে এই রিসোর্টের রেস্তোরাঁ আর ডাইনে বিখ্যাত গর্ডন রামসে বার্গার। সুতরাং মনস্থির করার এর চাইতে ভাল জায়গা আর হয়না। মনে মনে স্টারবাক্সটিকে দাগিয়ে নিয়ে বাকি দুজনের সাথে বেরিয়ে এলাম লাস ভেগাস বুলেভার্ডে।
মানুষ লাস ভেগাসে আসেন এই রাস্তায় হাঁটবেন বলে। এই জনজোয়ারে গা ভাসিয়ে সমস্ত ভুলে আলো আর অলীক সুখ স্পর্শ করবেন বলে। রাস্তার উল্টোদিকেই বেলাজিওর ফোয়ারা। গানের সাথে সাথে সে ফোয়ারার নাচ দেখা হলো। লাস ভেগাসের আলো দেখা হলো। বিখ্যাত হোটেলগুলোর আলো, বহিরঙ্গ আর বৈভব দেখা হলো। যা দেখাতে চায় এরা, আর যা দেখতে আসে মানুষ এখানে। বৈভবের প্রদর্শনীর মত লজ্জা বোধহয় আর হয়না। জানি না হয়তো আমিই ভুল। এই যে চারপাশে এত আলো, এত চাকচিক্য জানিনা আমার বুড়োটে মনের জন্যই কিনা, সেদিকে বিস্মিত-আকুল চোখে তো কই তাকাতে পারছিনা? বরং চোখ চলে যাচ্ছে এই জনসমুদ্রের দিকে। আমার কাছে যারা কেবল ভীড় মাত্র। তাদের কাছে আমি যেমন। অজস্র হাসিমুখ, চকচকে চোখ, অর্ধনগ্ন-অদ্ভুত মেকআপ করা মেয়েদের সাথে ছবি তুলছে। ছবি তুলতে দেওয়ার জন্য এই মেয়েরা টাকা পায়। সাথে তাদের বডিগার্ড যাদের কাজ মানুষকে মাঝে মাঝেই ধমকানো। "No free pictures! No free pictures!" নগ্নতার প্রতি মানুষের কৌতূহল আর খিদে এই মেয়েদের খিদে মেটায়।
এটাই "ভেগাস।" এটাও "লাস ভেগাস।"
হোটেল রিও-র বাফে নাকি খুব বিখ্যাত। জনগণ সেখানেই আজকের ডিনারটা করতে চায়। বাইরে বেরোলে আমার কাছে যাহা রিও তাহাই স্টারবাক্সের স্যান্ডউইচের প্যাকেট। ক্ষিদে মেটার মতন পেটে কিছু পড়লেই হলো। গেলাম। রিও থেকে ফেরার সময় ঠিক হলো হেঁটে ফিরবো। ম্যাপ বলছে পঁয়ত্রিশ মিনিট মত লাগবে। এইটা আমার মনের মত কাজ। মেঘ করেছে আকাশে। হালকা শিরশিরে হাওয়ায় হাঁটতে ভালোই লাগছিলো। হাইওয়ের পাশে ফুটপাথ ধরে হাঁটছি। মাঝে হাইওয়ের কাটাকুটির জায়গায় পথচারীদের জন্য ফুট ওভারব্রিজ করে দেওয়া আছে। অন্ধকার সেখানে। শহরের আলো চুঁইয়ে এসে যতটুকুনি আলো হয় কি না হয়। সেখানে বাসা বেঁধেছে এক দম্পতি। মানবেতর নয় মানব দম্পতি। আমাদের দেশে ঠিক যেমন হয়। অজস্র পোঁটলা-পুঁটলি, সাথে একটা হুইল চেয়ার। পাশ দিয়ে নির্দ্বিধায় পেরিয়ে গেলাম। যেমন যাই। যেমন গিয়ে অভ্যস্ত! পেরিয়েই একগাদা ময়লা জড়ো করে রাখা। গন্ধ বেরোচ্ছে পচে যাওয়া জিনিসের। যেমন আমাদের নাক আর চোখ সওয়া! হাইওয়ের দূরে লাস ভেগাসের আলোকোজ্জ্বল স্কাইলাইন। কি আলো! কি আলো !
এই ভেগাস! এও লাস ভেগাস!
হেঁটে এসে লাস ভেগাস বুলেভার্ডের স্কাই ব্রিজ ধরে রাস্তা পার হয়ে হেঁটে আসছিলাম সকলে মিলে, কেউ আইসক্রিম খাবে, কেউ পরদিনের ব্রেকফাস্ট কিনবে। কেউ টুথব্রাশ ভুলেছে। সেসব কিনবে।বাইরে বেরোলে এদিক ওদিক লোক দেখা ছাড়া আমার কখনোই বিশেষ কিছু করার থাকে না। সুতরাং আমি লোক দেখতে দেখতে এগোচ্ছিলাম। স্বল্পবসনা মেয়েরা পোশাকে, মেকআপে আলো আর চোখে বিরক্তি নিয়ে হেঁটে যাচ্ছে। বিচিত্র ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে ছবি তুলে তুলে আর চামড়ার বিজ্ঞাপন করে করে চোখে তাদের বিরক্তি জন্মে গেছে বোধহয়। তার মধ্যেই 'ভেগাস' বেড়াতে আসা কমবয়সী ছেলে মেয়েদের উজ্জ্বল পোশাক, চোখে মুখে যৌবনের উচ্ছ্বাস। এদের কাছে 'Sin City' এখনো তার ঔজ্বল্য হারায়নি। ভাল লাগে দেখতে। এই ভিড়েই ভালবেসে ঠাম্মার কোমর জড়িয়ে ধরে হাঁটছেন দাদু। আমার ঠিক সামনেই। খুনসুটিতে ঠাম্মা টোকা মারছেন বহু বছরের সঙ্গীর গালে। তারপর দুজনেই হাসছেন। 'Sin City' হয়ে উঠছে প্রেমের শহর, বহু বছরের নির্ভরতার শহর। হাঁটছিলাম CVS ফার্মাসির পাশ দিয়ে। কষ্ট করে বৃদ্ধ বেরোলেন সেখান থেকে হাতে ওষুধ ভর্তি প্যাকেট। আস্তে আস্তে ভিড় ঠেলে হেঁটে চলেছেন। সিজার প্যালেস, নামকরা হোটেল। এই দেখতে কত লোক আসে। তার পাশের রাস্তা দিয়ে হাঁটছি। এদিকে আলো নেই বিশেষ। আটপৌরে দিক এইটা হোটেলের। পাঁচিলের গায়ে সাজানো গাছের বেদিতে একগোছা জ্যাকেট, জুতো, কম্বল একসাথে পুঁটলি বানিয়ে রাখা। বোঝা যায় এখানেই রাত্রিযাপনের ব্যবস্থা। পুঁটলির মালিক অবশ্য তখন অনুপস্থিত।
এই ভেগাস! এও লাস ভেগাস!
পরদিন দুপুরে এইলিভ এসে পৌঁছালো। আমার এই কদিনের রুমমেট। সে টার্কির ইসমির থেকে একবছরের জন্য এসেছে এদেশে কিছু কোলাবোরেটিভ এনিম্যাল এক্সপেরিমেন্ট করার জন্য। পিএইচডি স্টুডেন্ট। তার উচ্চারণ শুনেই মনে হয়েছিল তার পর তার সাথে পরে কথা বলে বুঝলাম। সুন্দর চেহারা আর সেই মতোই চোখা সুন্দরী মেয়েটি। টার্কিশ মেয়েরা যেমন হয়। এইবারের কনফারেন্স এইলিভ আমার আর একটা পাওনা। বড় ভাল লেগেছে আমার মেয়েটিকে। সোজা সাপ্টা , স্পষ্ট ধারণা, স্পষ্ট দার্শনিকতার সোজা মেরুদণ্ডের মানুষ সে। সর্বদা হাসছে। আর অজস্র কৌতূহল আমাদের ধর্ম, স্পিরিচুয়ালিটি আমাদের দেবদেবী নিয়ে। আমি যতটা জানি বলার চেষ্টা করছিলাম। ওর সাথে পরদিন রাস্তায় হাঁটতে বেরিয়েছিলাম। মিরাজের ভলক্যানিক ঝর্ণা দেখেছে সে। আমায় দেখাতে চায়। বললে, চলো তোমায় দেখিয়ে নিয়ে আসি। ঝর্ণা দেখা হয়েছে। কিন্তু ভলক্যানিক শো এর সময় তখন নয় তাই সেটি আর দেখাতে পারেনি মেয়ে। তাই নিয়ে তার ভারী আফশোষ। মনে হলো, আমায় সে কতটুকু চেনে? তবুও ভাল কিছু দেখলে বন্ধু বা বোনের মতো সে আমায় দেখাতে চায়। মনটা ভাল হয়ে যায় এমন অপ্রত্যাশিত পেলে কিছু। এইলিভের সাথে বুলেভার্ডে উদ্দেশ্যহীন ভাবে হাঁটতে হাঁটতে গল্প করছিলাম। বেশিরভাগই সে জানতে চায় আমাদের ধর্ম আর আধ্যাত্মিকতা বিষয়ে। আমি জানতে চাই তার টার্কিশ জীবন যাপন, রীতি রেওয়াজ সম্পর্কে। আর দুজনেই জানতে চাই আমাদের খাবার দাবারের রেসিপি সম্পর্কে। টার্কির সাথে আমাদের মোঘলাই খানার বেশ মিল। সে অবশ্য থাকাই স্বাভাবিক। এই করতে গিয়ে লাস ভেগাস বুলেভার্ডের একটি অন্ধকার কোণায় আমরা আবিষ্কার করলাম ফুল, ধূপ দিয়ে সাজানো একটি চতুর্মুখ মূর্তি। আমি ভেবেছিলাম বজ্রযানী বৌদ্ধ দেব-দেবী কেউ হবেন। এইলিভ নজর করে বলল, এতো ব্রহ্মা। দেখো লেখা আছে। আমি লাস ভেগাস বুলেভার্ডে ধূপ-ধূনো-ফুল মালা সজ্জিত ব্রহ্মামূর্তি অন্তত আশা করিনি। এইলিভ জিজ্ঞাসা করলে, এটা কি তোমাদের ওখানে ব্রহ্মা-উপাসনার সময়? ব্রহ্ম-উপাসনার তো আমি ছাই জানি। বললুম 'না তো'। আদতে, পুষ্কর ছাড়া ব্রহ্মা মূর্তির পুজো হয় কিনা সেটাই আমার জানা নেই। দুজনে কিছুক্ষন দাঁড়িয়ে এগিয়ে চললাম। আসা ইস্তক সে আমায় রাতে শোবার আগে, ক্যাসিনো লাগোয়া স্টারবাক্সে বসে ল্যাপটপে ক্রমান্বয়ে বাংলায় টাইপ করে যেতে দেখেছিল। জিজ্ঞাসা করেই ফেললো আমি কি এত টাইপ করছি। বললুম, কিছু নন সায়েন্টিফিক লেখা লিখতে আমার ভালো লাগে। তাই লিখছি। আর লাস ভেগাস সম্পর্কে লিখলে তাতে তুমি একটা বড় অংশ হয়ে থাকবে। ততক্ষনে এইলিভ আমার ভাললাগা মানুষের তালিকায় এসে গেছে। তাই আমার যে তাকে ভাল লেগেছে একথা জানাতে আমার কোনো দ্বিধা নেই। আনন্দ-ভালো লাগা কখনো চেপে রাখতে নেই। বিশেষত সেই কারণ যদি কোনো মানুষ হয়। তার কাছে সেইটুকু ভালবাসা পাবার জন্য কৃতজ্ঞতা তো নিশ্চয়ই জানাতে হয়। এইলিভ বললে, "Oh thank you! say 'Hi' to your readers from me."
দুই সম্পূর্ণ অচেনা মানুষ পৃথিবীর সম্পূর্ণ আলাদা দুটি দেশ থেকে এসে একে অপরের দেশ সম্পর্কে জানতে জানতে 'Sin City' তে বন্ধুত্বের বন্ধনে জড়িয়ে পড়ছিলো।
গতকাল রাতে কনফারেন্স শেষ হয়েছে। আজ ভোর চারটেয় এইলিভ চলে গেছে। ওর ফ্লাইট ছিল সকাল ছটায়। ভোরবেলা ওকে নিচে বিদায় জানিয়ে এসে আমি একা ঘরে বসে টাইপ করছি। এবার বেরোতে হবে আমায়ও। লাস ভেগাস থেকে আমার শান্ত শহর ওমাহার দিকে।


0 comments:

Post a Comment