Monday 13 April 2020

".....now the priority is different."

".....now the priority is different."


দু এক দিন আগে হঠাৎই আবহাওয়া ঠান্ডা হওয়াতে কিছুটা তুষারপাত হয়েছে। আমার ডেরা থেকে ল্যাব বিল্ডিং পর্যন্ত পৌঁছাতে মিনিট পনের সময় লাগে। এর মধ্যে মাত্র মিনিট পাঁচেক বাইরে হাঁটতে  হয় বাকি পুরোটাই হাসপাতালের করিডোর ধরে হাঁটা পথ।  শীতকালে ওই পাঁচ মিনিট বাদে বাকিটা অসুবিধা হয়না বিশেষ। কিন্তু হাসপাতালের ভেতরের পথ এড়িয়ে বাইরে দিয়ে আসতে চাইলে পনের মিনিটের সোজাসাপ্টা পথটাই আরো খানিক বেড়ে যায় আর তার সাথে শীতের কামড়। গতকালও বড় কষ্ট হয়েছে কনকনে হাওয়া আর হিমাঙ্কের নিচে চলে যাওয়া তাপমাত্রায়। তাও নির্দ্বিধায় বাইরের পথটাই নিতে হচ্ছে। হাসপাতালের ভেতরের রাস্তা অপ্রয়োজনে এড়িয়ে চলারই নির্দেশ এসেছে গত সপ্তাহে। হাসপাতালের ক্লিনিক্যাল দিকটায় গেলেই ওরা এখন একটা করে সার্জিক্যাল মাস্ক দিচ্ছে। গতসপ্তাহে এখানেই একটা রিসার্চ এর ফলাফল দেখে এই সতর্কতা নিচ্ছে ওরা। 

অথচ কয়েকসপ্তাহ আগেও কোনো কিছুই হয়নি এরকম একটা আবহাওয়া ছিল চারিদিকে। মনে আছে ফেব্রুয়ারির প্রথম সপ্তাহে আমাদের ল্যাবেরই একজন ছাত্র তার সাংহাইয়ের শহরতলীর বাড়িতে কয়েক বাক্স সার্জিক্যাল মাস্ক পাঠাচ্ছিল পোস্টে। ফেডেক্সের অফিসে তাকে নিয়ে গিয়েছিলাম। পঁচাত্তর না আটাত্তর ডলার লেগেছিলো শিপিং চার্জ। বেরিয়ে এসে বলেছিলাম "ওরে বাবা! এতো অনেক!" যে ছেলেটির সেরকম কোনো বন্ধু নেই, কোনো শখ আহ্লাদ নেই, কোনোক্রমে সেদ্ধ সবজি, মাংস, সাদা ভাত আর ফলমূল হলেই চলে যায়, সে ছেলেটি নির্দ্বিধায় বলে উঠেছিল, "Sometimes money is not important to consider, now the priority is different." এরকম একটা দার্শনিক উক্তি অমন একটা 'কিছুতেই কিছু আসে যায় না' টাইপের মানুষের মুখে গত চার বছরে সেই আমার প্রথম শোনা। অত্যন্ত অবাক হলেও, এখন বুঝতে পারি বিপদের সময় বাড়ির লোকের নিরাপত্তাটা কতটা অগ্রিম অধিকার নিয়ে আসে। তখন ওর স্বদেশেই কেবল বিপদ ছিল। আমার স্বদেশে ছিল না। তাই ও জানত, পড়তো, আপডেটেড থাকত সেই বিপদ সম্পর্কে। আমি থাকতাম না। সে বিপদ যে এদেশেও ঘাঁটি গাড়বে সে সম্পর্কে আজ থেকে দুই মাস আগেই সে ওয়াকিফহাল ছিল। সেই আসন্ন বিপদের গুরুত্ব বুঝে আগাম সতর্কতায় প্রায় তখন থেকেই হাসপাতালের বাইরে দিয়ে যাতায়াত করে। ওকে দেখে আমরা ভাবতাম 'ধুস বাড়াবাড়ি'। আসলে বিপদ যতক্ষণ না আমাদের ঘাড়ে চেপে বসে, আমাদের নিজেদের ব্যক্তিগত স্তরে ক্ষতি করে, ততক্ষন আমাদের সে বিপদ সম্পর্কে যা থাকে তা মেকি সহানুভূতি, সতর্কতা নয়। আমরাও তাই তখন থেকে সতর্ক হইনি। 

আমাদের এই ইউনিভার্সিটি অফ নেব্রাস্কা মেডিক্যাল সেন্টার যদিও ইউনাইটেড স্টেটস এর অন্য ইউনিভার্সিটিগুলো সতর্ক হবার আগে থেকেই একটু বেশি তৎপর ছিল। তার কারণ ওই ক্রুজশীপ থেকে এদেশীয় সমস্ত যাত্রীদের এখানেই আনা হয়েছিল কোয়ারেন্টাইন আর অবসারভেশন এর জন্য। গতবারে ইবোলার সময়ে এই ইউনিভার্সিটি এত ভাল কাজ করেছিল যে সংক্রামক রোগের ক্ষেত্রে এই ইউনিভার্সিটি বেশ ভাল একটা নাম এখন। কিন্তু সেসব যাত্রীদের সাধারণের নাগালের অনেক বাইরে বহু সতর্কতায় রাখা হয়েছিল সে নিয়ে আমাদের চিন্তার কোনো কারণ ছিল না। তারপর দিন বদলাতে থাকলো। পূর্ব উপকূলের রাজ্যগুলি বিশেষত নিউইয়র্কে মারণযজ্ঞ তখন সবে শুরু হয়েছে। আমাদের এই শহরেও ভয় আর আতংক বাড়তে থাকলো। নানা রকম খবর শুনি। জিনিসপত্র কিনে রাখতে শুরু করেছে অনেকেই। সব বন্ধ হয়ে গেলে রেঁধে খাবার জিনিস বাড়ন্ত হবে যে। কিন্তু তখনও বেশ অনেকের কাছেই ব্যাপারটা হাস্যকর নতুন একটা ব্যাপার। ফেসবুক, টুইটার ইন্সট্রাগ্রাম খুলে লোকে দেখাচ্ছে নানান মজা এই নিয়ে যে, লোকে টয়লেট সিট্ চেটে দেখাচ্ছে যে দেখো আমি কত সাহসী। আমার রোগের ভয় নেই। এদিকে সমস্ত সুপারমার্কেটে টয়লেট পেপার, কিচেন টাওয়েল, হ্যান্ড স্যানিটাইজার এবং সমস্ত রকমের ডিসিনফেক্ট্যান্ট বাড়ন্ত। একদিন বাজার করতে গিয়ে সারা শহর খুঁজে খুঁজে একটাও হ্যান্ড স্যানিটাইজার পেলাম না। আমাদের বাজার করতে যেতে দেরি হয়ে গিয়েছিলো। মোটামুটি সপ্তাহ দুয়েক রান্না-বান্না চলার মত বাজার করলাম। এটাও শুনলাম যে এখানে নাকি বন্দুক কেনার হিড়িক পরে গেছে। অর্থাৎ খাবার না পেলে আমি আমার খাবার লুঠ হবার থেকে বাঁচাতে বন্দুক কিনে রাখছি। শুনে কি প্রতিক্রিয়া আসা উচিৎ, আর কি দেখানো উচিৎ সেটা বুঝে উঠতে পারছিলাম না। 

এরমধ্যে খবর পাচ্ছিলাম আস্তে আস্তে পূর্বদিকের শহর গুলির রিসার্চ ল্যাব গুলো বন্ধ হচ্ছে। বন্ধ মানে ওয়ার্ক ফ্রম হোম। কিন্তু যাদের বেঞ্চে এসে কাজ না করলে হবে না তারা কি করবে? অদ্ভুত এক দোলাচল। এদিকে আমি সদ্য একটা পেপার জমা দিয়েছি। সপ্তাহ দুই পরেই তার রিভিউয়ারদের কমেন্ট আসবে। তাঁদের মতামত অনুসারে আমায় যদি আরো বেশ কয়েকটা এক্সপেরিমেন্ট করে দেখতে হয় তাহলে আমি কি এই অবস্থায় কি করে করবো? যদিও এই অবস্থায় সকলেই সময় বাড়াচ্ছে। দেখা যাক। এদিকে ভারতেও সংক্রমণ বাড়তে শুরু করেছে। বাড়ির জন্য চিন্তা বাড়ছে। আমার বাড়ির অনেককেই এখনো নিয়মিত বাইরে বেরোতে হচ্ছে। সত্যি কথা বলতে কি রাতে ঘুম আসতে দেরি হচ্ছে। দিনের বেলা ল্যাবে গিয়ে নানান রকম খবর পাই, সাথে নেটের খবর তো আছেই। মার্চের ষোলো তারিখে এখানে জিম, বার, নাইট ক্লাব, রেস্তোরাঁ সমস্ত কিছুর ওপর দশ জনের বেশি লোক একসাথে জড়ো হওয়া বারণ হলো। তারপর এসব কিছুই বন্ধ হয়ে গেলো। রেস্তোরাঁ থেকে যদিও খাবার অর্ডার করার অপশন এখনো খোলা আছে। তবে পাবলিক হেলথ সম্পর্কে নিজের নিজের ধারণা মেনে কেউ এটাকে বেছে নিচ্ছেন, কেউ না। সারাদিন ইউনিভার্সিটির জিমটা সরব থাকত। গমগম করত ভোরবেলা আর সন্ধ্যাবেলা। এখন যখন জিমের পাশ দিয়ে রোজ হেঁটে আসি মনে হয় একটা মৃত্যুপুরী। তারপর আস্তে আস্তে ল্যাব বিল্ডিংয়ে রিসার্চারের সংখ্যা কমতে থাকলো। কেউ কেউ রাতের দিকে কাজ করতে শুরু করলো। কেউ খুব ভোরে এসে তাড়াতাড়ি কাজ শেষ করে চলে যাবার চেষ্টা করছে। আসলে যতটা মানুষের সংস্পৰ্শ এড়ানো যায়। আমাদের ল্যাবেরও সেল কালচার বা মাইক্রোস্কোপের্ ঘর গুলোতে একসাথে একজনের বেশি এখন ঢোকা বারণ। কারণ ঘরগুলো ছোট। ডিপার্মেন্টাল মিটিং গুলো জুম্ দিয়ে অনলাইনে হচ্ছে। প্রতিটা ল্যাব থেকে দুজনের নাম নিয়ে রাখা আছে এসেন্টিয়াল পার্সন হিসেবে যাতে যদি পুরোপুরি বন্ধ করতে হয় সব কিছু তাহলে এনিম্যাল হাউসের খাঁচায় রাখা ইঁদুরদের দেখাশোনা বা অন্য কিছু জরুরি প্রয়োজনে সেই দুটি মানুষ আসতে পারেন। আমাদের রিসার্চ করোনা বা সংক্রামক রোগ নিয়ে নয়। যাঁরা এই কাজ করছেন তাদের ল্যাবে এখন দিবারাত্র কাজ হচ্ছে হয়ত। মাঝে PPE র যোগান না থাকায় ব্যবহৃত PPE কি করে ডিসইনফেক্ট করে পুনরায় ব্যবহার করা যায় তার পদ্ধতি প্রকাশ করেছে আমাদের ইউনিভার্সিটি। বেশ কিছু এন্টিভাইরাল কম্পাউন্ডের ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল চলছে। আমাদের ইউনিভার্সিটিতেও চলছে। এত দ্রুত বায়োমেডিক্যাল রিসার্চকে আর কখনো প্রোমোট করা হয়নি আগে। সায়েন্টিস্টরা পাগলের মত কাজ করছেন। এত চেষ্টার ফল নিশ্চয়ই অতি দ্রুত সামনে আসবে। কিন্তু ততদিনে বড় বেশি প্রাণহানি হয়ে যাবে। এটা মেনে নিতে কষ্ট হচ্ছে। 

গত সপ্তাহেও দেখেছি মাস দু তিনের বাচ্চাকে প্র্যামে নিয়ে মা ওয়ালমার্টে বাজার করছেন। চারটি শিশুকে নিয়ে বাবামা ছুটির মুডে বাজার করতে বেরিয়েছেন। শিশুটি সবজির আইলের ধাতব পাত হাত দিয়ে ঘষে পরে সেই হাতই মুখে দিচ্ছে। আমি দেখে আতংকিত হয়েছি। মনে মনে চেয়েছি কেন মানুষের হাঁটাচলা নিয়ন্ত্রণ করা হবে না যদি তাঁর নিজের দায়িত্বশীলতা না থাকে! কিন্তু এদেশে সেটি হওয়া সম্ভব নয়। ইতালির খবর শুনে শুনে হঠাৎ একদিন ভয়ে কুঁকড়ে গেলাম। প্যানিক। ততদিনে বিষয়টার ভয়াবহতা স্পষ্ট বুঝতে পারছি। একটা ইতিহাস তৈরী হচ্ছে যার চলন্ত কুশীলব আমরা। আমাদের আজকের বর্তমান, আমাদের আজকের চিন্তাভাবনা, আমাদের আজকের আচরণ আমাদের ভবিষ্যৎ তৈরী করছে। যা প্রথম বা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের মতোই গুরুত্বপূর্ণ হবে ভবিষ্যতের পৃথিবীর জন্য। যার বহুমুখী প্রভাব থাকবে প্রতিটি দেশেই। আমাদের আজকের আচরণের ফলে উদ্ভুত পরিস্থিতির দায়ভার সেদিন নিতে পারবো তো? ভয় পাচ্ছি।

ভারতের লকডাউনের খবর পেয়ে কিছুটা হলেও স্বস্তি পেয়েছিলাম। যাক আমার বাড়ির লোকের আশেপাশে আসা লোকের সংখ্যা কমবে কিছুটা হলেও। কিছুটা হলেও কমবে তাঁদের অসুস্থ হবার সম্ভাবনা। এখানে কবে মানুষ সচেতন হবে জানি না। গত সপ্তাহে পার্কে অজস্র লোকে নাকি হাঁটতে, দৌড়াতে, গল্ফ খেলতে বেরিয়েছিল। ওমাহা নিউয়র্কের মত জনবহুল নয়। কিন্তু তাতেও ঝুঁকি কিছু কম নয়। নেব্রাস্কার সংখ্যাটা সরকারি ভাবে এখনো চারশোর আশেপাশে। কিন্তু বাড়তে কতক্ষণ? এই ঋতু পরিবর্তনে একটু আধটু গলা খুসখুস করলেই ভয় করছে। সারা পৃথিবীর সাথে সাথে আমরাও আশা নিয়ে আর আতংক নিয়ে বেঁচে আছি এখনো। আর বেঁচে আছি যখন, তখন যে কাজ করার জন্য বাড়ি ছেড়ে এখানে আসা, সে কাজটাই মন দিয়ে করে চলেছি প্রতিদিন। যতদিন সকালে উঠে ল্যাবে আসার সুযোগ পাচ্ছি। অত্যন্ত সতর্কতার সাথে, মানুষের ছোঁয়াচ বাঁচিয়ে। এভাবে ভয়ে ভয়ে থাকতে ভালো লাগছে না। কিন্তু আপাতত এই পথই রয়েছে খোলা। ".....now the priority is different."
  

এর চাইতে ভালো, এর চাইতে আলোর পথের প্রত্যাশায়।



0 comments:

Post a Comment