Monday 27 January 2020

একটি পথ এবং একটি অনুভব-১

কিছু কিছু সময় পরাজয় প্রয়োজন। তাতে নিজের ক্ষমতা সম্পর্কে মিথ্যে ধারণা গুলোর একটা হিল্লে হয়। আর মাথা পরিষ্কার হলে পরাজয়ের ক্ষোভ মিটিয়ে, প্রয়োজনীয় শক্তি সংগ্রহ করে, ফের লক্ষ্য স্থির করে এগিয়ে যাবার খিদে জাগে মনে। বললাম বটে- "প্রয়োজনীয় শক্তি সংগ্রহ করে", কিন্তু এই 'প্রয়োজনীয়' কথাটিই ভারী মারাত্মক। কতটা প্রস্তুতি যে ঠিক 'প্রয়োজন', সেটি আন্দাজ করে ওঠা দুস্কর হয়ে পড়ে। 
কোনো একটি জায়গায় পড়েছিলাম, "Getting better isn't easy. There are no shortcuts. No cheat codes, No quick fixes. It's only work." 
অল্প একটু চেষ্টায় নিজেকে একটু ঠেলে তুলতে পারলেই মনে হয়-এই তো বেশ খানিক পথে এসেছি  বলে মনে হচ্ছে। কিন্তু তাতে অনেকটা পথ হাঁটা গেলেও সর্বদা শেষ রক্ষা হয়না বোধহয়। তবে আরো একটা বিষয় বারংবার দেখেছি যে খুব খানিক চেষ্টা করলে কোনো না কোনো ভাবে শেষ মুহূর্তে অবিশ্বাস্যভাবে সাহায্য এসে যায়। কি করে জানিনা। 

গেল নভেম্বরের কোনো এক দুপুরে আমরা ভরপুর তুষারপাতের মধ্যে উটা -র জায়ণ ন্যাশন্যাল পার্কে এসে পৌঁছেছিলাম। জায়ণের উত্তরদ্বার দিয়ে জায়ণে ঢোকার একটা অসাধারণ সুবিধা আছে। সেটি হলো, পথটি মারাত্মক রকম সুন্দর। কিন্তু অসুবিধাটি হচ্ছে- যদি কোনো কারণে রাস্তাটি বন্ধ থাকে তবে বেশ অনেকটা পথ মানে প্রায় আড়াই ঘন্টা উজিয়ে এসে তবে ঠিকঠাক লোকালয় পাওয়া যাবে থাকা বা পেট্রোল নেবার জন্য। শীতের তুষারপাতের জন্য অনেকসময়ই এই পথটি বন্ধ থাকে।সুতরাং এই পথে পা বাড়াবার আগে আমরা খোঁজ নিয়েছিলাম যে পথটি খোলা কিনা। খোলাই ছিল, কিন্তু দিনের শুরুতে চকচকে রোদ্দুর মাখা আকাশের নিচে চলতে শুরু করে বেলা বাড়ার সাথে সাথে যতক্ষণে আমরা জায়ণের উত্তরদ্বারে গিয়ে পৌঁছলাম, ততক্ষনে অবিশ্রান্ত তুষারপাতে দুধসাদা চারিধার। এবং জায়ণের উত্তরদ্বার ঠিক বন্ধ হবো হবো। রাস্তা পরিষ্কার না করে পর্যটকদের গাড়িকে যেতে দেবে না। তাতে বিপদ হতে পারে। বেশ কয়েকটা গাড়ির জটলা গেটের সামনে। আর একটা ইলেক্ট্রনিক বোর্ডে ঝলমল করেছে লেখা "Road closed due to heavy snowfall." অনেক দূর থেকেই পড়া যাচ্ছে। তবুও আশায় আশায় সামনে এগোলাম। এতগুলো গাড়ি কি করছে তবে রাস্তা বন্ধ যদি? ঢুকতেই একজন ফ্লুরোসেন্ট রঙের জ্যাকেট পরা মানুষ এসে জিজ্ঞাসা করলেন আমরা ভেতরে যেতে চাই কিনা। সে আর বলতে? সমস্বরে "হ্যাঁ" বলতেই ভগবানের দূত বললেন, "এস তবে, আমার গাড়ির পেছনে পেছনে। আমরা দশটা গাড়িকে ছাড়ছি। এরপর আজকের জন্য রাস্তা বন্ধ।" ভদ্রলোক রেঞ্জার। রাস্তা পরিষ্কার হবার খবর পেয়ে শেষ দশটা গাড়িকে এস্কর্ট করে রাস্তাটুকু পার করে দেবেন। এটি তাঁর কর্তব্যের মধ্যেই পড়ে। আর আমরা সেই সাকুল্যে দশটি গাড়ির লাইনের নয় নম্বর গাড়িটি। আমাদের পেছনেই একটি গাড়ি এসে ঢুকেছিলো আর পেছনের গেটটি সেদিনের জন্য বন্ধ হয়ে গিয়েছিলো। অর্থাৎ আর পাঁচটি মিনিট দেরি হলে, বা আমরা ছবি তুলতে দাঁড়িয়ে গেলে সেদিনের জন্য আমাদের এই রাস্তা বন্ধ হয়ে যেত। আর আমাদের সেদিনের রাতের আস্তানায় পৌঁছাতে গেলে পিছন ফিরে আরও অন্তত তিনঘন্টার রাস্তা যেতে হতো। 

তারপর আর কি? রেঞ্জারের গাড়ির পেছনে পেছনে দশটি গাড়ি গুড়গুড় করে সেই ভয়ঙ্কর সুন্দর রাস্তাটি ভয়ে এবং বিস্ময়ে আস্তে আস্তে পার হয়েছিলুম সেইদিন। তাই বলছিলাম আর কি যে খুব করে চাইলে আর চেষ্টা করলে শেষ মুহূর্তে একটা সহায় জুটেই  যায়। 

সেদিন আমরা জায়ণের কিছু জায়গা দেখে রাতের আস্তানায় ফিরে গিয়েছিলাম। এই রাস্তা খারাপ থাকার জন্য আমাদের সেদিনের ঘোরার সময় এবং তালিকা থেকে কিছু কাটছাঁট করতে হয়েছিল। তাতে আমাদের বিশেষ ক্ষোভ ছিল না কারণ আমাদের জায়ণ ভ্রমণের প্রথম এবং প্রধান আকর্ষণ ছিল 'Angel's landing'. অর্থাৎ 'Angel's landing' নামের একটি অর্ধচন্দ্রাকৃতি পাহাড়ের মাথায় চড়া। নিয়মিত পর্বতারোহন করেন যাঁরা তাদের কাছে এটি হয়তো শীতের রোদে পিঠ দিয়ে ধর্মতলায় ঘুরে বেড়ানোর মতোই মনে হতে পারে কিন্তু আমাদের মতন নব্য এবং শখের হাঁটিয়েদের পক্ষে এটি বিশেষ সহজ সাধ্য নয়। বিশেষত আগের দিনের ঐরকম তুষারপাতের পর। যাই হোক, আমরা ভোর চারটেয় বেরোলাম এবং জায়ণের টুরিস্ট ইনফরমেশন সেন্টারে পৌঁছে গেলাম পাঁচটায়। এখান থেকেই জায়ণের ভেতরে যাবার বাস ছাড়বে। তখনও অন্ধকার। আমাদের আগে দুজনমাত্র পৌঁছেছেন। বাসস্ট্যান্ডে বহুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকার পর ধীরে ধীরে আলো ফুটলো। সামনে সূর্যের প্রথম কমলা- হলুদ আলো এসে পড়লো লাল পাথরের দৈত্যাকার পাহাড়ে। সে পাহাড় তখন গতদিনের তুষারপাতের ফলে লাল-সাদা আল্পনায় পরিণত হয়েছে। আমরা মুগ্ধ হয়ে দেখছিলাম। অসাধারণ সুন্দর এই জাতীয় উদ্যান। 
আস্তে আস্তে আরো নানান দেশীয় পর্যটক এসে জড়ো হচ্ছেন বাসস্ট্যান্ডে। ভেতরে যাবার জন্য এদের নিজস্ব বাস ছাড়া অন্য কোনো গাড়ির অনুমতি নেই। সুতরাং বাসস্ট্যান্ডই সকলের গতি। অনেকক্ষন দাঁড়িয়ে থাকার পরও যখন বাস এলো না, তখন চিন্তা বাড়তে লাগলো। এমন তো হবার কথা নয় কোনো আগাম নোটিশ ছাড়া। বেলা যত বাড়বে Angel's landing -এ ওঠা তত বিরক্তিকর এবং কষ্টকর হবে গরম এবং রোদের জন্য। আমরা উসখুস করছিলাম। এমন সময় একজন পার্ক অফিসিয়াল এসে জানালেন যে বাস আপাতত বন্ধ। পার্কের ভেতরের রাস্তা পরিষ্কার করতে শুরু করেছেন ওঁনারা। রাস্তা পুরোপুরি পরিষ্কার না হলে বাস চালানো যাবে না। কাল দুপুরের পর থেকে প্রায় মাঝরাত পর্যন্ত অবিশ্রান্ত তুষারপাত হয়েছে। প্রধান সড়কগুলি রাতেই পরিষ্কার করে দেওয়ায় আমরা সাতসকালে এখানে এসে পৌঁছাতে পেরেছি। কিন্তু ভেতরের রাস্তাতে এখন পরিষ্কারের কাজ চলছে।মনটা দমে গেল। আমাদের এবারের জায়ণ অভিযানের অন্যতম কারণ হলো Angel's landing. এই অবস্থায় সেটিই না মাঠে মারা যায়। এই বাসস্ট্যান্ড থেকে Angel's landing এর হাঁটা শুরু করার পয়েন্টটি অন্তত পাঁচ মাইল পথ। এর কিছুটা পর্যন্ত নিজেদের গাড়িতে যাওয়া যাবে। তারপর থেকে বাইরের গাড়ির প্রবেশ নিষেধ। মনস্থির করে সেখান থেকেই বাকিটা হাঁটব স্থির করলাম। সেই মত গাড়ি নিয়ে কিছুটা এগিয়ে এসে তারপর বাসরাস্তা ধরে ঢিমে তালে হাঁটতে শুরু করলাম। বাঁদিক দিয়ে বয়ে চলেছে ভার্জিন রিভার। লাল পাথরের খাড়াই পাথুরে দেওয়াল ডাইনে বাঁয়ে। আমাদের পরিকল্পনায় এই অতিরিক্ত পাঁচ মাইল হাঁটাটা ছিল না। কিন্তু পরিস্থিতি যখন বলছে তখন হাঁটতে হবেই। ঠিক করলাম কোনো তাড়াহুড়ো করবো না। পুরো রাস্তাটার সৌন্দর্য্য শুষে নিতে নিতে এগোবো। তাতে যদি পুরোটা পৌঁছাতে না পারি তবে তাই সই। ফিরে আসব। কিন্তু কোথাও পৌঁছাতেই হবে এই লক্ষ্যে এগোলে তাতে মোহভঙ্গ হবার সম্ভাবনাই বেশি। উপরন্তু পৌঁছাতে হবে এই তাড়ায় রাস্তাটির সৌন্দর্য্যও হাতছাড়া হয়ে যায়। তাই আমাদের কোথাও পৌঁছানোর তাড়া ছিল না। রাস্তার প্রতিটি বাঁকে দাঁড়িয়ে ছবি তুলতে হয়, এতই সুন্দর জায়ণ। Angel's landing এ উঠবো বলে আমরা কয়েকমাস ধরে নিজেদের মতন কিছু প্রস্তুতি নিয়েছিলাম। নইলে আমাদের এতটা রাস্তা হাঁটার মত শারীরিক সক্ষমতা ছিল না। প্রায় ঘন্টা খানেক রাস্তা ধরে হাঁটার পর পিছন থেকে বাস এলো। আপাতত কিছুটা রাস্তা পরিষ্কার হয়েছে তাই সেপর্যন্ত বাস সার্ভিস চালু হয়েছে। যে পর্যন্ত চালু হয়েছে সেটি এখন থেকে আর একটি স্টপেজ। আর তার পরের স্টপেজটিই আমাদের Angel's landing এর হাঁটাপথের শুরু। অর্থাৎ বেশিরভাগ রাস্তাটি আমরা হেঁটেই চলে এসেছি। তাও যতটুকু শক্তি সঞ্চয় করা যায়, এই ভেবে বাসে করে পরের স্টপেজে এসে পৌঁছলাম। এটি জায়ণ লজ। এখানে এদের প্রধান থাকার জায়গা। জায়ণ লজের রেস্টুরেন্টে ঢুকে কফি দিয়ে কিছুটা ক্যাফিন শরীরে ঢুকিয়ে নিলাম। আর একটা কাজ করেছিলাম যেটি সেদিন আমাদের প্রচন্ড সহায় হয়েছিল পরবর্তী হাঁটার ক্ষেত্রে। সেটি হলো, দুজনে দুজোড়া shoe traction কিনে জুতোয় লাগিয়ে নিয়েছিলাম। আগের দিনের অল্প রাস্তার হাঁটাহাঁটিতেই বুঝেছিলাম তুষারপাতের পর শক্ত হয়ে গেছে বেশ কিছু জায়গাতেই। ফলে তার ওপরে হাঁটা কষ্টকর। ভয়াবহ রকম পিচ্ছিল বেশ কিছু জায়গা। shoe traction এক্ষেত্রে ত্রাতা। জুতোর গ্রিপ বাড়াবে। 

কফি খেয়ে, জুতোয় ট্রাক্শন লাগিয়ে লাঠি বাগিয়ে এবার আসল হাঁটা শুরু হলো। জায়ণ লজ থেকে বেরিয়েই মোলাকাত হলো একটি শিং ওয়ালা হরিণের সাথে। সাতসকালে দুই তিনজন শিংবিহীন বৌ নিয়ে বরফ খুঁড়ে ঘাসপাতা দিয়ে ব্রেকফাস্ট করতে বেরিয়েছে। তাদের বিদায় দিয়ে বাঁদিকে একটা ছোট্ট কাঠের সেতু। সেটি পেরিয়েই ভার্জিন রিভারকে ডানহাতে রেখে চড়াই শুরু। বরফে সম্পূর্ণ ঢাকা সরু পায়ে চলা পথ। ঝুরো বরফে হাঁটতে আপাতত কোনো সমস্যা নেই। আমাদের যা গতি তাতে আমরা খুশি। কারো কারো থেকে বেশি। তাঁদের আমরা পেরিয়ে চলেছি। কারো কারো থেকে কম। তাঁরা আমাদের পেরিয়ে চলেছেন। আমরা জল খেতে খেতে, শুকনো ফল চিবোতে চিবোতে আর ছবি তুলতে তুলতে আঁকাবাঁকা সরু চড়াই পথ হেঁটে চলেছি Angel's landing এর দিকে। রোদ বাড়ছে ক্রমশঃ। 

(পরের পর্বে গল্পের শেষ)              








0 comments:

Post a Comment