Saturday 2 November 2019

#এই_সপ্তাহের_শেষে-5

#এই_সপ্তাহের_শেষে

৫. ওষুধ আবিষ্কার (পর্ব-৪) 
--------------------------------
এই যে এসে গেছি কলমিশাকের নির্যাস থেকে ব্রেস্ট ক্যান্সারের ওষুধ বানানো যায় কিনা দেখতে। পূর্ববর্তী পর্বগুলোতে আমরা দেখেছি -একজন বিজ্ঞানী ব্রেস্ট ক্যান্সার রোধে কলমিশাক উপকারি কিনা এই উদ্ভট প্রশ্নের সমাধান করতে কেমন করে গ্রান্ট লিখে ফান্ড জোগাড় করেছেন, লোকজন জোগাড় করেছেন, ব্রেস্ট ক্যান্সার কোষ জোগাড় করেছেন, তাতে কলমিশাকের নির্যাস থেকে প্রাপ্ত কম্পাউন্ড প্রয়োগ করে ক্যান্সার কোষের বাড়-বাড়ন্ত রোধ হচ্ছে কিনা দেখেছেন। তারপর ইঁদুরে ব্রেস্ট ক্যান্সার তৈরী করে তাতে কম্পাউন্ডগুলি ইনজেক্ট করে সেখানে প্ৰাপ্ত ফলাফল, কোষস্তরে প্রাপ্ত ফলাফলের মতোই আশাব্যাঞ্জক কিনা তা দেখেছেন। অর্থাৎ, in vitro (কোষে) এবং in vivo (প্রাণীতে) দুই স্তরের গবেষণার ফলাফলেই আশাজনক ফল মিলেছে। এই পুরো ব্যাপারটা ঘটতে অন্তত সাত থেকে দশ বছর সময় লেগেছে। এখন এই বিজ্ঞানীর করণীয় কি? এই জায়গা থেকে আজ শুরু করব। আগের পর্বগুলোতে লেখা গবেষণার ধাপগুলো ধরলে আজ আট নম্বর ধাপে আছি আমরা। চলুন এই এত নম্বর ধাপ থেকেই গল্পে ঢুকে পড়া যাক তবে?

৮. তো এখন এই যে এতদিন ধরে দিনরাত এক করে আপনি কোষ এবং প্রাণীতে গবেষণা করে আপনার মনে হলো, কলমিশাক ব্রেস্ট ক্যান্সার উপশম করার জন্য উপকারী হলেও হতে পারে, এই মনে হওয়াটাতে কোনো গলদ রয়ে যাচ্ছে নাতো? মানে আপনি নিজের বিদ্যে বুদ্ধিমত কাজ করে যা ফলাফল পেয়েছেন সেগুলো হয়ত ঠিকঠাকই কিন্তু গবেষণার এমন একটা দিক হয়ত আপনার নজর এড়িয়ে গেছে যাতে আরো কিছু প্রশ্ন রয়ে যাচ্ছে আপনার সিদ্ধান্তে। যেমন ধরুন, এই যে আমি বার বার বলছি ব্রেস্ট ক্যান্সার 'রোধ' বা ব্রেস্ট ক্যান্সার 'উপশম' এই দুটি কথা কিন্তু এক নয়। আপনার কম্পাউন্ডটি ব্রেস্ট ক্যান্সারের কোন অবস্থায় কার্যকরী? কম্পাউন্ডটি আগে প্রয়োগ করলে পরে ব্রেস্ট ক্যান্সার হতে বাধা দেয়? নাকি ব্রেস্ট ক্যান্সার দেহে বাসা বাঁধার পর কম্পাউন্ডটি প্রয়োগ করলে ব্রেস্ট ক্যান্সারকে বাড়তে বাধা দেয়? প্রথমটি ঠিক হলে বলা যেতে পারে কম্পাউন্ডটি ব্রেস্ট ক্যান্সার রোধক। কিন্তু সেক্ষেত্রে আরো একটা প্রশ্ন আছে, তাহলে ব্রেস্ট ক্যান্সার হয়ে বসে আছে এমন রোগীদের ক্ষেত্রে তাহলে এই কম্পাউন্ডটি কার্যকরী হবে কি? আর দ্বিতীয়টি ঠিক হলে বলা যেতে পারে কম্পাউন্ডটি ব্রেস্ট ক্যান্সার উপশমে কাজ করে। এখানেও প্রশ্ন আছে। এক, সেক্ষেত্রে ব্রেস্ট ক্যান্সারের কোন স্তরে কম্পাউন্ডটি কার্যকরী? প্রথম অবস্থায়, যখন ক্যান্সারের কোষগুলি স্তনগ্রন্থির চৌহদ্দি পার করে এদিক ওদিক উপনিবেশ তৈরী করতে বেড়িয়ে পড়েনি, জন্মস্থানেই (primary tumor site, প্রাইমারি টিউমার সাইট) বেড়ে চলেছে, তখন? নাকি তারা দিগ্বিজয়ে বেরিয়ে পড়া (Metastasis, মেটাস্টাসিস)-র পরেও এই কম্পাউন্ড কাজ করতে পারে? এই ধরণের আরো অনেক বৃহৎ প্রশ্ন অথবা আপনার পরীক্ষা পদ্ধতি সংক্রান্ত খুঁটিনাটি প্রশ্ন যদি আপনার চোখ এড়িয়ে গিয়ে থাকে তবে আপনার প্রাপ্ত ফলাফলের কিন্তু অনেক ফাঁক থেকে যাবে। সুতরাং আপনার রিসার্চ থেকে আপনি যা সিদ্ধান্ত করছেন তার একটি সুচারু, সুচিন্তিত, বৈজ্ঞানিক কোয়ালিটি কন্ট্রোল মেথড থাকা দরকার। যাতে সে  সে সিদ্ধান্তের ভিত্তিতে পরবর্তী ক্ষেত্রে আরো যা গবেষণা হবে কম্পাউন্ডটিকে মানবদেহে প্রয়োগ করা যায় কিনা দেখতে তার ভিত্তিটিই নড়বড়ে না হয়। তা এই কোয়ালিটি কন্ট্রোল কি করে করা হয়? সেই গল্পই এখন বলব।

আপনাকে আপনার গবেষণার প্রাপ্ত ফলাফল সমস্ত বিজ্ঞানীমহলে প্রকাশ করতে হবে। যাতে আপনার গবেষণা সংক্রান্ত বিষয়ে বিশেষজ্ঞ বিজ্ঞানীরা আপনার কাজের পদ্ধতি, ফলাফল এবং তা থেকে প্রাপ্ত সিদ্ধান্ত সম্পর্কে পুঙ্খানুপুঙ্খ বিচার করে কোথাও ফাঁক থেকে থাকলে বা অন্য কোনো একটি দিক যা আপনার মাথাতেই আসেনি সে সম্পর্কে আপনাকে অবহিত করবেন। তখন আপনি সেই ফাঁক মেরামত করে আপনার গবেষণালব্ধ ফলাফল সম্পর্কে নিশ্চিত হবেন। তা এই বিশেষজ্ঞ বিজ্ঞানীদের আপনি পাবেন কোথায়? আপনার গবেষণার ফলাফল কাগজে লিখে তাঁদের দোরে দোরে  ঘুরে তাঁদের পড়িয়ে বেড়াবেন না নিশ্চয়ই। তাহলে?

আপনাকে যেটা করতে হবে তার প্রথম ধাপ হলো, বিভিন্ন বিশেষ বিশেষ বিষয় নিয়ে সারা পৃথিবীতে নানান বৈজ্ঞানিক সম্মেলন হয়। আপনার কাজের বিষয়ের সাথে মিল আছে এমন একটি নির্ভরযোগ্য সম্মেলন খুঁজে নিয়ে সেখানে আপনাকে যোগদান করতে হবে। কি করে করবেন? সেখানে গেলেই তো আর আপনাকে আপনার কাজ নিয়ে আলোচনা করতে কেউ দেবে না। আপনাকে আপনার কাজের একটি ছোট্ট সারমর্ম (এই ধরুন তিনশো থেকে পাঁচশো শব্দের মধ্যে) লিখে সম্মেলনের বহু আগে জমা দিতে হবে। সম্মেলনের রিভিউ বোর্ড আপনার কাজের মান, গুরুত্ব বুঝে আপনাকে সুযোগ দেবে আপনার কাজ সম্পর্কে সেখানে বলার। দুভাবে বলতে পারেন আপনি। এক, আপনাকে পনের কুড়ি মিনিট সময় দেওয়া হবে তার মধ্যে স্টেজে উঠে আপনাকে সংক্ষেপে বলতে হবে (Oral presentation)। তারপর সেখানে উপস্থিত সমস্ত বিজ্ঞানী বা ছাত্ররা যে কেউ আপনাকে প্রশ্ন করে বা মতামত দিয়ে আপনার কাজের ঠিক ভুল সম্পর্কে আপনাকে অবহিত করতে পারে। আর দুই, আপনাকে স্টেজে উঠে পনের মিনিটে বলতে হলো না। তার জায়গায় আপনি আপনার কাজের যাবতীয় তথ্য একটি বড় কাগজে পোষ্টার আকারে প্রিন্ট করে নিয়ে সেখানে গেলেন তারপর পোষ্টার প্রেসেন্টেশনের নির্দিষ্ট দিনে আরো অনেকের সাথে আপনার জন্য নির্দিষ্ট পোষ্টার বোর্ডে আপনার পোষ্টার লাগিয়ে সেখানে দাঁড়িয়ে রইলেন। আপনার কাজের হেডিং দেখেই আপনার কাজের বিষয়ের মানুষজন আপনার পোষ্টারের কাছে আসবেন এবং আবার সেই একই পদ্ধতিতে আপনাকে প্রশ্ন করে, ভুল ধরিয়ে দিয়ে বা আরো কার্যকরী কিছু উপদেশ দিয়ে আপনার কাজের মূল্যায়ন করবেন। খুব ভাল কাজ করলে এইসমস্ত ন্যাশন্যাল বা ইন্টারন্যাশন্যাল কনফারেন্সগুলোয় আপনি বেস্ট পোষ্টার বা বেস্ট ওরাল প্রেসেন্টেশন এর পুরস্কারও পেয়ে যেতে পারেন। তবে সেসব আমাদের মতন ছোটমানুষদের জন্য। বড়দের এইসব পুরস্কার পাওয়া বা না পাওয়ায় কিছু যায় আসে না। তাই তারা এসব থেকে বাদই থাকেন।

তো আপনি এই ধরণের সম্মেলন থেকে আপনার কাজের একটা প্রাথমিক মূল্যায়ন পেলেন। কিন্তু এটি যথেষ্ট নয়। আরও সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম মূল্যায়ন এবং পরিমার্জনের পর এই কাজের একটা পাকাপোক্ত দলিল থাকা দরকার। নইলে সারা পৃথিবীর বিজ্ঞানীরা বুঝবেন কি করে যে কলমিশাক থেকে প্রাপ্ত কম্পাউন্ডটি ভবিষ্যতে ব্রেষ্ট ক্যান্সারের চিকিৎসার জন্য ভাবা গেলেও যেতে পারে? আপনার মত অন্যকেউ আবার প্রথম থেকে কাজটি শুরু করবেন। তাহলে গবেষণা এগোবে কি করে? সেই তো একই জিনিসের চক্রবৎ আবর্তন চলবে। আরো একটা কথা, আপনিই যে এই কাজটি প্রথম শুরু করেছেন সে বিষয়েও এই দলিলটি সাক্ষ্য দেবে। পরবর্তী ক্ষেত্রে আপনার কাজের ওপর ভিত্তি করে এই বিষয়ে যত কাজ হবে তার জন্য আপনাকে অর্থাৎ এই দলিলটিকে উল্লেখ করতে হবে ভবিষ্যৎ গবেষকদের। তাহলে বুঝতেই পারছেন এই দলিলটি আপনার কাজের জন্য কতখানি দরকারি? এটি না থাকলে আপনি যে কাজটি করেছেন এবং তার থেকে যে ফলাফল পেয়েছেন তার কোনো প্রমান নেই। সুতরাং কোষ এবং প্রাণীদেহে গবেষণার পর, প্রাথমিক মূল্যায়নপর্ব পেরিয়ে আপনার পরবর্তী কর্তব্য এই দলিলটি প্রকাশ করা। অবশ্য কোষস্তরে গবেষণার পরেও এই সম্মেলনে বা দলিলে আপনার কাজ প্রকাশ করা যেতে পারে। তবে প্রাণিদেহেও একই ফল মিলেছে এই প্রমাণ দেখাতে পারলে আপনার দাবির জোর বাড়ে। কারণ প্রাণীদেহ এড়িয়ে আপনি কোনো ভাবেই আপনার কম্পাউন্ডটি মানবদেহে প্রয়োগ করতে পারবেন না। এই যে 'দলিল', 'দলিল' বলছি তখন থেকে, এটি কি ওরকম স্ট্যাম্প পেপারে তৈরী করা দলিল নাকি? মোটেও না। তবে কি? বলছি।

দলিল বলতে 'অরিজিনাল রিসার্চ আর্টিকেল'। ডাকনামে আমরা বলব 'পেপার'। ব্যাপারটা হলো, আপনাকে একটি লেখা লিখতে হবে যাতে থাকবে আপনি কাজটি কেন শুরু করেছেন, অর্থাৎ কাজটির গুরুত্ব। কাজটির ঠিক কোন অংশটি আপনি এই আর্টিকলে বলবার চেষ্টা করছেন, সে সম্পর্কে আগে কি কি তথ্য পাওয়া যায় ইত্যাদি ইত্যাদি। মোটকথা বৈজ্ঞানিক গৌরচন্দ্রিকা (Introduction)। তারপর আপনি ঠিক কি করে পুরো কাজের প্রতিটা স্টেপ করেছেন সেটি বলতে হবে (Materials and methods)। সেটি এতটাই গুছিয়ে বলতে হবে যাতে ভবিষ্যতে আপনার ওই পেপার থেকে নতুন কেউ আপনার কাজটি পুনরায় করে ফেলতে চাইলে কোনো অসুবিধা ছাড়াই একইরকম ফলাফল পায়। তারপর লিখতে হবে আপনি আপনার গবেষণায় যা ফলাফল পেয়েছেন সবটা। সমস্ত তথ্য গ্রাফ বা ছবির আকারে সাজিয়ে স্টাটিস্টিক্যাল আনালিসিসসহ এমন ভাবে লিখতে হবে যে কোথাও কোনো ফাঁক না থাকে (Results)। এর সাথে লিখতে হবে এই ফলাফলের গুরুত্ব কি? অর্থাৎ এই গবেষণা করে এবং তাতে এই ফলাফল পেয়ে হাতি ঘোড়া কি লাভ হলো (Discussion)? অর্থাৎ একটি সম্পূর্ণ গল্প আপনাকে বলতে হবে। তারপর? এইবারই তো আসল ঘটনা!

আপনাকে এই পেপারটি বৈজ্ঞানিক পত্রিকা (Journal)-এ পাঠাতে হবে। অজস্র জার্নাল আছে। কোথায় পাঠাবেন? যে জার্নালটি বা জার্নালগুলি আপনার কাজের ধরণের গবেষণাপত্র প্রকাশ করে তাদের কাছে পাঠাবেন। তবেই তো আপনার কাজ বুঝবে এরকম লোকজনকে পাবেন আপনার কাজের মূল্যায়ন করার জন্য। যদি আপনার পেপারটি সেখানে তাঁরা প্রকাশ করেন, তবে আপনার কাজটি ওই ধরণের কাজে উৎসাহী সমস্ত বৈজ্ঞানিকদের কাছে উন্মুক্ত হয়ে গেল। এবং তাঁরা তখন আপনার কাজ সম্পর্কে জেনে আপনার কাজের ওপর ভিত্তি করে নিজেদের প্রয়োজন এবং প্রজ্ঞামত কাজটিকে এগিয়ে নিয়ে যাবেন। এবং আপনিও আপনার কাজের একটি মান্যতা পাবেন। এখন প্রশ্ন হলো, এই যে আমি বললাম, "যদি আপনার পেপারটি সেখানে তাঁরা প্রকাশ করেন", এই যদি কথাটি মারাত্মক। একটি পেপার পাবলিশ করতে প্রথম আবেদনের দিন থেকে দুই বছরও লেগে যেতে পারে। কেন? কারণ আপনি পাঠালেন আর তারা লুফে নিলো তা তো নয়। যত উঁচুদরের জার্নাল, তত উঁচু তাদের প্রকাশনার মান। এমন কিছু জার্নাল আছে যারা এমন পেপারই ছাপে যার থেকে পরে সারা বিশ্বে ওই সংক্রান্ত চিকিৎসায় সম্পূর্ণ বিপ্লব এসে গেছে। সর্বোচ্চ স্তরের জার্নালগুলোর এডিটর বোর্ডে থাকেন বহু বহু বিজ্ঞানী যাঁরা বিভিন্ন বিষয়ে পারদর্শী এবং সেই বিষয় সংক্রান্ত গবেষনায় রথী-মহারথী। এরকম পাবলিশিং হাউসগুলির দু একটির নাম বলি। যেমন নেচার পাবলিসিং হাউস। যাদের রয়েছে খোদ নেচার জার্নাল, নেচার মেডিসিন, নেচার সেল বায়োলজি, নেচার কমিউনিকেশন, নেচার বায়োটেকনোলজি। আরো আরো অনেককিছু। তারপর ধরুন Elsevier, cell press আরো নানান ছোট বড় পাবলিসিং হাউস আছে। এইসব জার্নালের রিভিউ প্রসেস সর্বোচ্চমানের তাই এখানে প্রকাশিত বিজ্ঞানও সর্বোচ্চমানের।   

যাই হোক, জার্নালের মান অনুসারে সেখানে আপনার পেপার রিভিউ হবে। রিভিউ করবেন সেই সংক্রান্ত বিষয়ে বিখ্যাত বিজ্ঞানীরা। তারপর হয়ত তাঁরা বললেন, বাপুহে, কাজ তো বুঝলাম, কলমিশাকের নির্যাস থেকে ব্রেস্ট ক্যান্সার কমছে। কিন্তু এর সাইড এফেক্ট নিয়ে কিছু বললে না যে? এই বিষয়টি কি ভেবে দেখেছো? দেহের সব কোষ তো আর ক্যান্সার কোষ নয়।  বেশিরভাগই নরমাল কোষ। এখন এই নরমাল কোষগুলি বেঁচেবর্তে না থাকলে যে সমূহ বিপদ। সাধারণ কার্যকলাপই বন্ধ হয়ে যাবে। এ বিষয়ে কিছু না জানলে তো তোমার এই কম্পাউন্ডটিকে সামনে এগিয়ে যেতে দেওয়া যায়না। দেখো দিকি নরমাল কোষে তোমার এই কম্পাউন্ডটি কেমন কাজ করে। নইলে বাপু আমরা ছাপতে পারছি না তোমার কাজ। আপনি তখন অন্য জার্নালে পাঠিয়ে দেখতে পারেন তারা বিষয়টি এড়িয়ে ছেপে দেয় কিনা। কিন্তু সেটা বুদ্ধিমানের কাজ নয়। বেশ কিছু ভুলভাল রিভিউ এর উদাহরণ থাকলেও সাধারণত রিভিউয়ারদের মতামত মতো কাজ করে আবার সাবমিট করলেই আখেরে কাজের মানটি বাড়ে। আমি নরমাল কোষের উদাহরণ দিলাম কারণ ওটাই মনে এলো এখন তাই। এরকম নানান প্রশ্ন আসতে পারে বা আপনার কাজের পদ্ধতিগত কোনো ভুল বা ফাঁক থাকলেও এই পর্যায়ে সেটি সংশোধন হবে। এই কাজ করে আবার জমা দিলে তার পরেও আরো প্রশ্ন আসতে পারে। এরকম করে যাওয়া আসা করতে করতে যখন আপনার গল্পটির সমস্ত ফাঁক বন্ধ হয়ে একটি সম্পূর্ণ গল্প হয়ে উঠবে তখনই একমাত্র আপনার পেপারটি সেই জার্নালে প্রকাশ পাবে। আবার এত কিছুর পরেও গল্পটি না দাঁড়ালে জার্নাল সেটি প্রকাশ করবে না। সুতরাং সময় তো লাগবেই।

এই পেপার আপনিও পড়তে পারেন কিন্তু। পুরোটা না হলেও কিছুটা তো ওপেন থেকেই থাকে সকলের জন্য। কিভাবে পড়তে পাবেন সে গল্প অন্য একদিন ভাল করে করব। আর তাছাড়া কথাই তো ছিল, unsupervised তথ্য আর authentic তথ্য বুঝব কি করে সে গল্প আমি বলব। সুতরাং অন্য একদিন ভাল করে বলা যাবেখন। 

পেপার পাবলিশ হয়ে গেলেই আপনার দায়িত্ব শেষ তা নয় কিন্তু। এবার এই পেপার সারা পৃথিবীতে সবাইয়ের জন্য খোলা কেবল জার্নাল রিভিউয়ারদের কাছে নয়। এখন কেউ যদি পড়তে গিয়ে বা আপনার কাজ রিপিট করতে গিয়ে কোনো ভুল পায় বা কাজটি রিপিট করতে না পারে তখন কিন্তু আবার আপনার কাজ সম্পর্কে প্রশ্ন উঠবে। যদি বোঝা যায় আপনি জেনেশুনে কিছু কারচুপি করেছেন আপনার ডেটায় তাহলে তো হল। জার্নালের দপ্তর থেকে আপনাকে নিজের কাজ পুনরায় ব্যাখ্যা করতে বলা হবে এবং আপনার এই গন্ডগোল ইচ্ছাকৃত হলে বহুকাল আগে প্রকাশিত পেপারও জার্নাল বাতিল করে দেবে তো বটেই, তার সাথে সাথে আপনার কেরিয়ারে যে দাগ লাগলো তা ওঠানো মুশকিল। সে আপনি এই বিষয়ে যতবড় হনুই হননা কেন। এরকম বহু বহু উদাহরণ আছে। এবং লজ্জার কথা তার একটা বেশ বড় শতাংশ ভারতীয় বিজ্ঞানী। সুতরাং পেপার লেখার সময় প্রতিটা শব্দ আপনাকে ভেবে লিখতে হবে। যা লিখছেন, ফলাফল থেকে যা দাবি করছেন তার সপক্ষে একশ শতাংশ তথ্যপ্রমাণ আপনি পেপারে দিচ্ছেন তো? এবং রেজাল্ট থেকে বানানো সমস্ত ছবি, গ্রাফ ইত্যাদি যা দিয়ে আপনি আপনার দাবিটি করছেন তা একশ শতাংশ সঠিক তো?

এই ট্রেনিংটি আমাদের সর্বাগ্রে নিতে হয় যে, যা বার বার করে দেখছি তা ঠিক দেখছি কিনা। যদি প্রতিবার সমস্ত পদ্ধতি ঠিক হওয়া সত্ত্বেও এমন কিছু দেখি, যা আমাদের হাইপোথেসিস এর সাথে মিলছে না তখন আমাদের আরো গভীর ভাবে পড়াশুনা করে ভাবনাটাকেই অন্য পথে নিয়ে যেতে হয় বায়োলজিটা বোঝার জন্য। ফলাফল পরিবর্তন করা যায় না কোনোভাবেই। তাতে সময় লাগে, আরো বেশ কিছু নতুন এক্সপেরিমেন্ট করে দেখতে হয়। কিন্তু এটাই পথ। অন্য কোনো উপায় নেই। জীববিজ্ঞানে যা সত্যি, সেটিই তো আপনি দেখবেন। আপনি যেমন ভেবেছিলেন তেমন তেমন উপায়ে তো আর আমাদের শরীর কাজ করবে না, তাই না? আর সত্যিটা হলো, ভাবনা অনুসারে রেজাল্ট না আসাটাই বেশি ঘটে। যা ভেবে এক্সপেরিমেন্ট শুরু করেছিলেন ঠিক তেমন তেমনই মিলে গেলে পেপারটা যেন কিরকম আলুনি হয়ে যায়। তাই বোধহয় আমরা বলি, life is 90% failure, enjoy the rest 10% to the fullest.

হ্যাঁ যা বলছিলাম, তো রিভিউ পর্ব পেরিয়ে আপনার পেপার পাবলিশ হলো বৈজ্ঞানিক জার্নালে। যত বড় জার্নাল তার গুরুত্ব তত বেশি। এবার এই কাজ থেকে আরো নানান রকম কাজ শুরু করবেন সারা পৃথিবী জুড়ে এই বিষয়ে উৎসাহী বিজ্ঞানীরা। যেমন, অন্য ধরণের ব্রেস্ট ক্যান্সারে একইরকম তথ্য মিলছে কিনা? অনেকদিন ধরে এই কম্পাউন্ডটি ব্যবহার করলে ইঁদুরে কোনো রকম সাইড এফেক্ট দেখা যাচ্ছে কিনা? ক্যান্সারগ্রস্ত ইঁদুরদের দেহে এটি প্রয়োগের পর প্রতিরক্ষাব্যবস্থা, স্নায়ু, মস্তিস্ক কিরকম ব্যবহার করছে? ব্রেস্ট ক্যান্সারের ঠিক কোন অবস্থায় এই কম্পাউন্ডটি সবচাইতে বেশি কার্যকরী? আর অন্য কোনো কম্পাউন্ড বা অন্য প্রচলিত ব্রেস্ট ক্যান্সারের চিকিৎসার সাথে গাঁটছড়া বাঁধলে কি কম্পাউন্ডটি আরো ভালো কাজ করতে পারে? এইসব সমস্ত দিক থেকে সমস্ত প্রশ্নের আণবিক স্তরে গবেষণা চলবে। অর্থাৎ সারা পৃথিবীর এই বিষয়ে কাজ করতে উৎসাহী বিজ্ঞানীরা বিভিন্ন সময়ে, বিভিন্ন দিক থেকে গবেষণা করে, তাঁদের নিজ নিজ কাজের পরিসর অনুসারে একই পদ্ধতিতে গবেষণা চালিয়ে প্রমাণ করবেন অন্তত ব্রেস্ট ক্যান্সারগ্রস্ত ইঁদুরে কলমিশাকের নির্যাস থেকে প্রাপ্ত এই কম্পাউন্ডটি বেশ উৎসাহজনক উপকার দেখাচ্ছে কোনো সাইড এফেক্ট ছাড়াই।

এতক্ষনে সময় এসেছে এটিকে মানুষের শরীরে প্রয়োগ করে দেখার কথা ভাবার। এতক্ষণে আপনার কাজ শুরু থেকে অন্তত পনের আর প্রথম এই বিষয়ে পেপার পাবলিশ করা থেকে অন্তত দশ বছর কেটে গেছে।

এবার মানুষের দেহে কম্পাউন্ডটি প্রয়োগ করা হবে। এই পর্যায়টি হলো "ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল" (Clinical trial)। এখানেও সেই একই কথা, ব্রেস্ট ক্যান্সারের রোগী দেখলাম আর পটাপট কম্পাউন্ডটি ইঞ্জেক্ট করে দিলাম এমন মগের মুলুকের ব্যাপার এটা নয়। তার জন্য নির্দিষ্ট নিয়ম রয়েছে। আইন রয়েছে। সে এক বিশাল কর্মকান্ড।  সে গল্প বরং পরের দিন বলি কেমন? তাড়াহুড়ো না করে বেশ গুছিয়ে গল্প হবে তবে পরের দিন। আজ তবে আসি।

ভাল থাকুন সব্বাই।
অর্পিতা 

0 comments:

Post a Comment