Monday 18 January 2021

আমরা সেই কজনা

বুঝলি দেবী,  
একটা মানুষের মধ্যে বোধহয় অনেকগুলো মানুষ থাকে। একটা মানুষ ক্লান্ত হয়ে দিনের শেষে চেয়ারে পিঠ ঠেকিয়ে 'আহ' বলে পিঠটা বেঁকিয়ে দেয় পিছন দিকে। সেই একই মানুষের মধ্যে আর একটা মানুষ বলে-'এসব তো হলো ,আসল কাজটা কখন হবে? শুরু করো এবার।' ক্লান্ত শরীরে চনমনে একটা মন নিয়ে চেয়ার ছেড়ে উঠতেই হয় তখন। মস্তিষ্কে অক্সিজেনের পরিমাণ বাড়ন্ত হয়ে পড়ে যেন। খিদেয় মায়ের কথা মনে পড়ে। আর তারই মধ্যে অন্য মানুষটা বসে বসে উত্তেজিত হয়ে পড়ে, কত কি করার বাকি ভেবে। দুজনকে সামলে সুমলে মাঝামাঝি একটা জায়গায় এনে বেঁধে রাখাই দায়। এরই মাঝে মাঝে তোর কথা ভাবি। একগাদা কাজ করতে পারিস তুই। আমার মতন নয়। কেমন সুন্দর ছবি আঁকিস, কেন সুন্দর রাঁধিস। সবচাইতে বড় ব্যাপার, নিজেকে ভালবাসতে পারিস, যত্ন করে, পরিপাটি করে গুছিয়ে রাখতে পারিস নিজেকে। তোকে আমি বিশেষ চিনতাম না ইস্কুলে পড়বার সময়ে। একখানা বেজায় রোগা মেয়ে, চোখে গোলগোল চশমা আর দুটি শিকলি বিনুনি। এর বাইরে তোকে বেশি চেনার কোনো কারণই ঘটেনি কখনো। এখন মনে হয়, তোকে এত খানি চিনলাম কবে? তুই হয়ত বলবি, বাবার অসুখের সময়। আমারও অনেকসময় তাইই মনে হয়েছে। সেদিন ওই বিপদের দিনে মা পাগলের মতন তোকে ফোন করেছিল বলে আর তুই পাগলের মতন আমি পৌঁছানো অবধি মাকে, আর আমি পৌঁছানোর পর আমাকে আগলে রেখেছিলি বলে কি? কিন্তু ভাল করে ভেবে দেখলে পরে মনে হয়েছে ব্যাপারটা অত ব্যবসায়িক নয়। তবে কি বল দিকি? সেই একদিন মনে পড়ে, আমি তখন হরিয়ানায়, তুই ল্যাব আওয়ার্সের মধ্যেই একদিন ফোন করেছিলি। স্কুলের বন্ধুদের একটা হোয়াটস্যাপ গ্রূপ তৈরী করে আমায় তার মধ্যে টেনে নিলি। সেই সেদিন থেকেই বোধহয় তোর প্রতি আমার একটা কৃতঃজ্ঞতা জন্ম নিলো জানিস। আসলে কিছু লোকের কোনো গ্রূপ হয় না। হয়ত তারা আদতে কোনো গ্রূপে থাকতে চায়না বলেই। ওই মোম লাগানো পদ্ম পাতায় জল না লাগার মতোই। আর মানুষ কি অত বোকা? আমি না হাসলে তারা আমার দিকে তাকিয়ে হাসবে কেন? আর এখানেই তোর প্রতি আমার উৎসাহের শুরু জানিস। আমি কারো খবর নিইনা। তাই আমার চিঠির বাক্সও খালিই থাকে। রোজ সকালে ভাবি, এমনও তো হতে পারে, আজ দেখবো নতুন একটা লাল চিহ্ন ফোনের কোথাও। তাও যাঁরা আমায় ভালোবেসে খবর পাঠান, তাদের মধ্যে তুই আছিস। আমি দিনের পর দিন নির্লজ্জের মতন ফোন সাইলেন্ট থেকে অন করতে ভুলে যাই। তাও তুই আমার মাথায় হাত বোলাতে ভুলিস না।  "এখন ঘুমোচ্ছি রাখ"- বলে চরম অসভ্যতা করি তোর সাথে। তাও তুই আমায় জড়িয়ে রাখিস। আমিও একমাত্র তোর সাথেই এই লাক্সারিটা করতে পারি। কেমন একটা ভরসা আছে তুই আমায় তাড়িয়ে দিবি না। ওই যে বলছিলাম না, দুটো বা তার বেশী মানুষ থাকে একটা মানুষের মধ্যে। আমার মনে হয়, তুই আমার মধ্যে ওই দ্বিতীয় মানুষটাকে উস্কে দিস। ওই যে একখানা গোটা ছেলেবেলা তোর জন্য  ফিরে পেলাম, হোক না ফোনের স্ক্রিনে, তবু ওই আমার দ্বিতীয় বিশ্ব। তোরা যদিও আমায় মনে মনে গালাগালি দিবি আমি জানি, যে কেন আমি আরো কথা বলি না সবার সাথে। কিন্তু এখানেও বলতে পারিস আমার ওই প্রথম জন খোলস থেকে বেরোতে চায় না বলেই। ওই যে একখানা চাদর মুড়ি দিয়ে কোণায় বসে মিটমিটিয়ে তোদের সবাইকার হৈ হৈ দেখা, এটার মধ্যে একটা তৃপ্তি আছে। এটা যারা করে, তারা জানে জানিস। আমার প্রথম জনটা বেজায় মজা পায় তোদের দেখতে, কথা শুনতে, ইয়ার্কি দেখতে। কিন্তু কোণ ছেড়ে উঠে যেতেই চায় না। তৃপ্তিটা যে ওই দেখাতেই বেশি। সরাসরি সামিল হবার চেয়েও।

যাই হোক, এই যে মনকেমনে ফিরে যাবার মতন কটা মিষ্টি ঠাকুমা মার্কা (কেউ কেউ আবার বেজায় রাগী। বাচালতা মোটেই সহ্য করেন না। দিদিমনি তো, তাই) মহিলাকে তোর দাক্ষিণ্যে দুহাতে ধরতে পেরেছি আবার, সেই আমার ধন। সেদিন সেজন্যই তোর মতন এক আধা অচেনা ক্ষীণকায়া মহিলাকে নতুন করে চিনতে ইচ্ছে হয়েছিল জানিস। স্রোতের মাঝে নিজের গতি বজায় রেখে চলা সহজ নয় রে মেয়ে। এ আমি নিশ্চিত করে বুঝেছি। স্রোত তোকে ঠেলতে চাইবেই। তুই চেষ্টাটা থামাসনা, থামাসনি এখনো অবধি সেইটিই তোর প্রতি আমার মুগ্ধতা।

জানিস, এমনই একদল পাগলকে জুটিয়েছিস, কবে কোন ফেসবুক পোস্টে লিখেছিলাম যে ছোটবেলায় ওই যমজ দুটো আমায় চিঠি লিখতো গ্রীষ্মের ছুটিতে। সেই দেখে সেই যমজের একটা আমায় একখানা চিঠি হাতে লিখে আমায় ছবি তুলে পাঠিয়েছে। কি পাগল বল দিকিনি? বলেছে আবার আমি গেলে হাতে হাতে দেবে। আমি কি করি এদের নিয়ে? ওই যে সেদিন শহরের চৌরাস্তায় আর একটা কবিতার পাগল কিছু খাওয়াতে পারেনি বলে কেঁদেই ফেলছিল প্রায়, তারপরে শেষে ঝাল লজেন্সের প্যাকেট কিনে দিয়ে শান্ত হয়।  সেই প্যাকেট আমার ব্যাগে চড়ে এখান অবধি এসে পৌঁছেছিল। এসব কথা আমি সেই পাগলটাকে আমাদের চণ্ডীমণ্ডপের আড্ডায় বলতে পারিনি। এসব আবেগের কথা বলতে ভারী লজ্জা হয় জানিস। ওকে বলে দিস, ও যখন সুন্দর করে সেজে স্টেজে ওঠে আবৃতি বা সঞ্চালনা করতে, ইচ্ছে করে বলি, "ভারী মিষ্টি লাগছে।" কিন্তু সে বললে কি আর আসলে যা বলতে চাই সেসব বলা যায়? আজ আবার দেখলুম আমাদের সেই মিষ্টি ফ্রক পড়া দুই বিনুনি মেয়েটি লিখেছে, তার মিষ্টি মেয়েটি নাকি বড় হয়ে গেছে। এক বছর! ধুস ওই তো এখনো বড় হয়নি ওর মেয়ে কিকরে বড় হবে? ভাবলুম লিখি। কিন্তু ওই, যা বলতে চাই সেসব কি লেখা যায় নাকি? আর ওই রাগী দিদিমনিটাকে বলিস ইস্কুলে গিয়ে বেশি বকাবকি না করতে। একদিন দেখি কি, একখানা জম্পেশ শাড়ি পড়ে সাজুগুজু করে পোজ দিচ্ছে। ভাবলুম তার ইস্কুল থেকে ক্লাস সিক্সের ছানাগুলোকে এনে দেখাই দিদিমনি কি করছে। তারপর ভাবলুম থাক, বেতের বাড়ি একটাও বাইরে পড়বে না। এসব কথা আবার দিদিমনিটাকে বলিসনা যেন। এমনিতেই আমায় বালিকার পর্যায়ে ফেলে। আবার কান ধরে সন্ধি-সমাস এর সূত্র ধরলেই হলো। আর বাদবাকি পাগল একটা আছে যেটা আমায় চাট্টি কেক খেতে দেবে বলেছে গেলে। আর একটা বেজায় সিরিয়াস মহিলা আছে যেটার ছবি আবার আমার ফোন বারবার ভুল করে আমি বলে চালাতে চায়। যত বলি, সে ব্যাটা আমার মতন ধুমসো নয়, তাও নাকি মুখ দেখে আমার মতোই মনে হয়।  যাক গে, থাকলেই হলো, যা বলে বলুক গিয়ে যাক। আর একটার মাথা তো আমি তবলার মত করে চাঁটি মেরে বাজাবো বলে দিস। আর একটাও যদি গুডমর্নিং আর ফরওয়ার্ডেড মেজেস পাই চণ্ডীমণ্ডপের জটলায়। মুখ খুলতে পারে না হতভাগী? তারও কি আমার মতন চাদরমুড়ি রোগ হয়েছে? আমি রেগে গেছি বলে দিস।
 
এই দেখ, তোর সাথে কথা কইতে কইতে কেমন মনটা ফুরফুরে হয়ে গেল। বাড়ি যাই বরং। বাড়িতে রাখা বাচ্চাগুলোকে ফোন করতে হবে। রাতের পেট পুজোর ব্যবস্থা করতে হবে, এককাঁড়ি বাসন নিয়ে বাসন-মাজুনি হতে হবে। ওভেন পরিষ্কার করতে হবে। তবে গিয়ে তোদের গালাগালি শোনার সময় পাব। ভেবে এবার মন বেশ তেজ পাচ্ছি বুঝলি। এই কথাটাই এত কথা দিয়ে বলতে চাইছিলুম। যে দিনের শেষে ক্লান্তিতে তোরা থাকিস। তোরাই থাকিস। 

পুনশ্চ: ও হ্যাঁ ওই যমজের একটা আমায় একটা চিঠি দিয়েছে বলছিলাম না।  ঐটা পাঠালাম সাথে। পড়ে দেখ দিকি। বাকি গুলোকেও দেখাস। এক কাজ করনা, সবাই মিলে দল বেঁধে আমাদের বাড়ি চলে যা জগদ্ধাত্রী পুজোর দিন। আমিও মনে মনে তোদের সাথে পৌঁছে যাব। যাবি? যা না রে। বড় শান্তি-বড় আনন্দ তোরা গেলে।  

0 comments:

Post a Comment