Wednesday 6 May 2015

চেনা-অচেনা গাড়ওয়াল-১

মনের কথা সাদা পাতায় নামিয়ে আনার জন্য মনের সহায়তাটাই সবচেয়ে বেশি জরুরী। চার লাইন লিখতে গেলেও যে শান্ত মস্তিস্কের প্রয়োজন পড়ে সে কথা অনস্বীকার্য। সেই মনটাকেই বাবা-বাছা করে, ধরে বেঁধে কোনো ভাবেই সঠিক সুরে বাঁধা যাচ্ছে না কিছুতেই নানা কারণে। তাও খানিক জোর করেই সাম্প্রতিক দু চারটে ঘটনার কথা বলবার চেষ্টা করছি।   

*********************************************************************************


এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহে আমরা দুইজন দুই মাকে বগলদাবা করে বেরিয়ে পড়েছিলাম গাড়ওয়াল হিমালয়ের চেনা পথে। গন্তব্য দেরাদুন হয়ে মুসৌরী, সেখান থেকে ধনৌলটি হয়ে ঋষিকেশ-হরিদ্বার। একযাত্রায় পাহাড়ভ্রমণ আর তীর্থদর্শন। এবার মায়েরা সঙ্গী বলে আর কোনো অনিশ্চয়তা নয়। ট্রেন, হোটেল সবকিছু দুমাস আগে থেকে ঠিকঠাক করে রাখা।নির্দিষ্ট দিনে শুধু 'জয়্মা' বলে চারজনে বেরিয়ে পড়া গেল। যাবার পথে বিশেষ কোনো ঘটনা ঘটেনি। কিন্তু একটি ঘটনা না বলে থাকতে পারছি না সেটা ঘটলো মেট্রো স্টেশনে।

কয়েক মাস আগে দিল্লীর একটি বিয়েবাড়ি সেরে ফেরার সময় আমাদেরই এক সহকর্মী একটি খুব সুন্দর কথা বলেছিল। এই সুযোগে কথাটিকে এখানে উল্লেখ করার লোভ সামলাতে পারছি না। সন্ধ্যের মেট্রো স্টেশন। ভিড়ে ভিড়াক্কার। সকলেই চাইছে সকলের আগে বেরিয়ে যেতে। মনে হচ্ছে এটাই দিনের শেষ মেট্রো। এর পর আর কেউ বাড়ি পৌঁছতে পারবে না সেদিনের মত। এই ছুটন্ত জনস্রোতের মাঝে ধীরে সুস্থে মেট্রো স্টেশনে নেমে ছেলেটি বলল, "ইয়াহি এক চিজ হ্যায় জিন্দেগিমে জিসকে পিছে ভাগনা নেহি পড়তা। এক চলে যায় তো যানে দো, নেক্সট তো আ হি যায়েগা।" -কি দার্শনিক কথা! দিল্লি মেট্রোর বিজ্ঞাপন হিসেবেও দারুন ভাবে চালিয়ে দেওয়া যায় কথাটিকে। যাই হোক সেদিনও সন্ধ্যের সেই মেট্রো স্টেশনটিকে দেখে এই দার্শনিক কথাটিই ভাবতে ভাবতে এগোচ্ছি। এমন সময় দেখি স্টেশনে ঢোকার মুখে বেশ কিছু চেনা মুখের মানুষ বসে থাকেন, স্টেশনই যাঁদের ঘরবাড়ি, এরকম প্রত্যেকটি মানুষের হাতেই কয়েকটা করে মোটা মোটা রুটি আর তার ওপরে খানিকটা করে আলুর তরকারী। একটু অবাক হলাম। সকলের হাতেই একই খাবার, একই রকম ভাবে নেওয়া, একই পরিমাণে? কি ব্যাপার? প্রশ্নের উত্তর পেলাম একটু বাদেই। ভিড় ঠেলে স্টেশনের দিকে একটু এগোতেই চোখে পড়ল আমাদেরই বয়সী বা হয়ত বয়সে আমাদের থেকে খানিক ছোটই হবে দুটি ছেলে মেয়ে, চোখে মুখে উত্তর-পূর্বের ছাপ স্পষ্ট। হয়ত কাছাকাছি কোথাও পড়াশুনা বা জীবিকার প্রয়োজনে থাকে। মেয়েটির হাতে প্লাস্টিকের প্যাকেটে একগোছা রুটি। আর ছেলেটির হাতে প্লাস্টিকের প্যাকেটে বেশ খানিকটা তরকারী। অন্য হাতে একটি বড় চামচ। সিঁড়ির সামনে বসা বাকি চার-পাঁচ জনকে রুটি-তরকারী দিচ্ছে। এবং এই দেওয়া যে কোনো একদিনের হঠাৎ দেওয়া ঘটনা নয়, প্রাত্যহিক বা অন্ততপক্ষে অত্যন্ত প্রত্যাশিত একটি ব্যাপার সেটি দাতা এবং গ্রহীতাদের পারস্পরিক দৃষ্টি আর হাসি বিনিময় এবং দুপক্ষেরই শরীরী ভাষায় স্পষ্ট। আমরা পৌঁছাতে পৌঁছাতে এই চারপাঁচ জনকে খাবার দেওয়া শেষ করে ছেলে মেয়ে দুটি চলল স্টেশনের উল্টোদিকে বসা বাকিদের খাবার দিতে।

স্পষ্টতই বোঝা যাচ্ছে কোনো দোকানের সাথে ব্যবস্থা করা আছে এই ছেলে মেয়ে দুটির। সেখান থেকে বানানো রুটি তরকারী নিয়ে (কোনো মতেই এগুলি বাসি বা ফেলে দেওয়া খাবার বলে মনে হয়নি আমার) এরা মাঝে মাঝেই হয়তবা প্রতিদিনই অন্তত দশ বারো জন লোকের রাতের খাবারের বন্দোবস্ত করেছে। কিছুক্ষণ ধরে ব্যাপারটি ভাবার পরে মনে হলো আমি তো পারিনি কোনো একজনের দিনের একবেলা খাবারের দায়িত্ব নিতে। হঠাৎই কিরকম লজ্জা করতে লাগলো আমার। উত্তর-পূর্বের মানুষদের সম্পর্কে ব্যাঙ্গাত্মক কত মন্তব্য শুনেছি কলকাতায় থাকাকালীন। সেই অঞ্চলেরই দুজন মানুষ আজ চোখের সামনে হু হু করে কত উঁচুতে উঠে গেল দেখে মন ভরে গেল। মুগ্ধ চোখে দেখতে থাকলাম গোলাপী জামা পরা মেয়েলি একটি হাতে রুটির গোছা আর অন্য হাত ধরা পুরুষালি একটি হাতে, যে পুরুষের অন্য হাতে ধরা এক প্যাকেট ভর্তি তরকারী। আস্তে আস্তে মিশে যাচ্ছে সন্ধ্যের মেট্রো স্টেশনের ভিড়ে। এগিয়ে যাচ্ছে উল্টোদিকের সিঁড়িতে বসে থাকা আরো কতগুলি প্রত্যাশী মুখের দিকে। ছোটো হতে থাকা নিজেকে লজ্জায় কুঁকড়ে নিয়ে ভিড়ে লুকিয়ে ফেলা ছাড়া আর কিছু করার ছিল না আমার।

আমাদের চার দিনের গাড়ওয়াল হিমালয় ভ্রমণ শুরু হল এরকম করে।     

0 comments:

Post a Comment