Thursday, 16 April 2015

নববর্ষ

আপাতত এই বছরের নববর্ষটা বিশেষ শুভ বলতে পারছিনা। কারণ আবার আমাদের অন্ধকার বন্ধ বাড়িতে চাবি খুলে ঢুকতে হচ্ছে আবার আমাদের খিদে বোধ ফিরে এসেছে (এর আগের দুই সপ্তাহ খিদে পাবার আগে হাঁ করলেই মুখে টপাটপ সুখাদ্যের বর্ষণ হচ্ছিল)আবার আমাদের সকালে উঠে একা একা ফাঁকা ঘরে ঘুরঘুর করতে হচ্ছে আবার আমাদের সন্ধ্যেবেলায় ইন্টারনেট মুখে করে সময় কাটাতে হচ্ছে........ইত্যাদি ইত্যাদি। ব্যাপারটা আর কিছুই নয় দিন কুড়ি আমাদের মতন দুই অপগন্ডকে নাইয়ে-ধুইয়ে-গান্ডেপিন্ডে খাইয়ে-পরিস্কার জামাকাপড় পরিয়ে আরো একশরকম বায়নাক্কা সামলে খাটতে খাটতে পনেরো দিনে সাড়ে পনেরো শতাংশ রোগা হয়ে গিয়ে অবশেষে এই নববর্ষের ঠিক আগের দিনেই দুইজনের দুই মা বাড়ির দিকে ইঞ্জিনের মুখ করে রাখা রাজধানীর সিটে গিয়ে বসে হাঁপ ছেড়ে বেঁচেছে। আর আমরা তাদের সিটে বসিয়ে দিয়ে এসে সামনের দশদিনের জন্য তাদেরই তৈরী ফ্রিজ বোঝাই করে রেখে যাওয়া খাবার দাবার বের করে খাচ্ছি আর ফোঁসফাঁস দীর্ঘশ্বাস ফেলছি আর ভাবছি ঘরদোর জামাকাপড় বেশ পরিস্কার-পরিষ্কার লাগছে। কিছুদিন চলে যাবে হাত-পা না নাড়িয়েই। তারপর যাক গে বসে বসে আঙ্গুল চোষা ছাড়া গতি নেই। আসলে ঘোড়া যখন থাকেনা থাকেনা হেঁটেই দিন চলে যায়। কিন্তু একবার ঘোড়ায় চড়া অভ্যেস হয়ে গেলে পর আর দুই পা হাঁটতে গেলেই ঘোড়ার অভাব বোধ হয়। তাই এই নববর্ষটা ব্যাজার মুখে শুরু হয়েছে। আর তাই হয়ত আগের সব নববর্ষগুলো বেশি বেশি করে মনে পড়ছে। 

কুঁচো বয়সে যখন মায়ের বাধ্য ভদ্র বাচ্চা ছিলাম তখন নববর্ষের বেশ একটা উত্সব উৎসব ব্যাপার অনুভব করতে পারতাম। সেটা সাদা মনের অমলিন উৎসবের প্রভাবেই হোক বা অন্য কোন কারণে। একটা কারণ অবশ্যই ছিল এই যে, নববর্ষের ঠিক আগেই শেষ হয়ে যেত বার্ষিক পরীক্ষা। পরীক্ষার খাতায় কতটা হাবিজাবি আর কতটা ঠিকঠাক লিখে এসেছি সেটা বাড়িতে প্রকাশ পাবার এবং জীবনে ভয়ানক দুর্যোগ নেমে আসার জন্য আরো প্রায় দুই সপ্তাহ বাকি থাকতো। সুতরাং 'সখের প্রাণ গড়ের মাঠ'। তার ওপরে আবার বাংলা নববর্ষে নতুন জামা। সে জামা বুকে কমলা সুতোর দিয়ে হাঁস আঁকা সাদা সুতির টেপফ্রক থেকে শুরু হয়ে আমার বয়সের বয়সের সাথে সাথে বিবর্তিত হতে হতে দুই কাঁধে ফিতে বাঁধা সুতির ফ্রক, তারপর সুতির স্কার্ট-ব্লাউজ হয়ে বর্তমানে শালওয়ার-কামিজে এসে ঠেকেছে। সে জামা যেমনই হোক সেটি কেনার সময় দুটি অবশ্য মান্য বিষয় হলো-জামাটিকে অতি অবশ্যই সুতির কাপড়ের তৈরী হতে হবে এবং রংটি গরমে পরার উপযুক্ত, চোখের পক্ষে আরামদায়ক হতে হবে। মানে এযাবৎকালে তাই হয়ে এসেছে আমার ক্ষেত্রে। সুতরাং বার্ষিক পরীক্ষার জুজুকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে কাটিয়ে আসার পরে উপরি হিসেবে নতুন একখানা জামা পেয়েও যদি পয়লা বৈশাখে উত্সব না হয় তবেই বরং আশ্চর্যের বিষয় হত। হাঁস আঁকা টেপজামা বা দুই কাঁধে ফিতে বাঁধা ফ্রক পরার আমলে অবশ্য পয়লা বৈশাখে জামাটা আমার একার জন্যেই আসছে, নাকি মা বাবারও নিদেন পক্ষে একটা ব্লাউজ বা লুঙ্গি গোছের কিছুও দোকান থেকে এসে পৌঁছোচ্ছে কিনা সে বিষয়ে নজর পড়তনা আমার। পরে ঘটি হাতা ফ্রক বা স্কার্টব্লাউজ পরার সময় থেকে এবিষয়ে নজর পড়তে শুরু করলো। আর কোনো বছরে আর্থিক কারণে আমার একার জন্য দোকান থেকে জামা এলে "আমার একার কেন নিয়ে এলে? আমার অনেক জামা আছে, আর চাইনা"-ইত্যাদি বৃথা চেঁচামেচি করা ছাড়া আর আমার কিছু করার না থাকায় ব্যাজার মুখে বিকেল বেলা নতুন জামা পরে খেলতে যেতাম। এবং নতুন জামার কল্যানে সেদিন খেলায় আছাড় খাওয়া বা কাটাছেঁড়ার পরিমাণটা খানিক কম হত। মাঝে মধ্যে অবশ্য না পরে রেখে দেওয়া আগের বছর পুজোয় পাওয়া কোনো সুতির ছাপাশাড়ি ম্যাজিকের মতন বের করে মা বলত এই দেখ আমার নতুন শাড়ি। আর বাবা "আমি এই ঘামে গরমে সাইকেলে করে বাজার দোকান যাই টাই, আমার আর নতুন জামা কি হবে? অনেক জামা আছে, রোদে ঘামে নষ্ট হয়ে যাবে"- এইসব ভুজুং দিয়ে আমায় ঘুরিয়ে দিত। অনেক পরে অবশ্য তিন জনেরই কিছু না কিছু আসতো পয়লা বৈশাখ উপলক্ষ্যে। 

আর একটি জিনিস সে বয়সে কি করে যেন মাথায় ঢুকে গেছিল, মা-ই ঢুকিয়েছিল নির্ঘাত, সেটা এই যে, বর্ষশুরুর দিনে সক্কাল সক্কাল উঠে ভালো মেয়ের মতন পড়াশুনা করতে হয় তাহলে সারাবছর ভালো পড়াশুনা হয় (তখন থেকেই লেট রাইজার মেয়েটাকে একদিন অন্তত ভোর ভোর ঘুম থেকে তোলার চেষ্টা আর কি)। আর দূরদর্শনের সে জমানায় একটি উত্সাহ বড়দের মধ্যে ছিল সেটি হলো নববর্ষের বৈঠক। সেটি এবছর কোথায় হচ্ছে মেট্রো রেল এ, নাকি গঙ্গাবক্ষে বজরায়, নাকি অভিনব অন্য কোনোখানে এবং কোন কোন বিদগ্ধজন এ বছর সেই বৈঠকে আছেন সেটি নিয়ে বিশেষ গবেষণা হতে দেখতাম। আমাদের বাড়িতে সকালে টিভি খোলা হত বছরে মাত্র দুটি দিন। মহালয়ার দিন আর নববর্ষের দিন। নববর্ষের সকালে উঠে টিভিতে সকলে নববর্ষের বৈঠকে গান-কবিতা-আলোচনা শুনত। আর আমাকেও সেখানে বসিয়ে রাখার চেষ্টা করা হত। কিন্তু বিশ্বাস করুন আমার একটুও বসে থাকতে ইচ্ছে করত না। খুব খারাপ লাগত অনুষ্ঠানটা। কারণ যে সময়ের কথা বলছি সে সময় অনুষ্ঠানে একটা নাচ অন্তত না থাকলে সে অনুষ্ঠান আমার কাছে নিতান্তই অর্থহীন লাগত। মনের ভাবটা এরকম থাকত যে-অন্য দিন টিভির কাছে বসার অনুমতি বিশেষ পাওয়া যায়না। সেই অনুমতি যখন পাওয়া গেছে (উপরন্তু ডেকে ডেকে টিভি দেখতে বলছে! এ তো অবিশ্বাস্য ব্যাপার!) তাও আবার সকাল বেলা যখন নাকি ঘুম কাটতে না কাটতেই পড়তে বসাটাই ভালো বাচ্চার লক্ষণ তখন এইসব বকবকানি শুনতে হবে বসে বসে কি যে সময়ের অপব্যবহার! আমি বসে বসে দুধ আর মারি বিস্কুট খেতাম আর অপেক্ষা করতাম যদি ভুল করেও একটা নাচের অনুষ্ঠান থেকে থাকে এই বৈঠকে সেই আশায়। এরপর খানিক বাদে মা বাবা যে যার কাজে উঠে পড়লে আমার ও সে আশায় জল পড়ে যেত। আমাকেও দুধের গ্লাস নামিয়ে রেখে বই-এর ব্যাগ খুলে বসতে হত। আসলে বেশ খানিকটা সাজুগুজু করে রবীন্দ্র সঙ্গীতের সাথে লীলায়িত ভঙ্গিতে নাচ ব্যাপারটা আমার বড়ই লোভের জিনিস ছিল। তার একটা কারণ এখন আমার মনে হয় এই যে, আমি কোনো দিন নাচ শিখিনি। কিন্তু অনেক ছোট থেকে গান টান গাওয়ানোর একটা চেষ্টা করা হয়েছিল আমার ওপর। যার ফলে এদিক ওদিকের অনুষ্ঠান নাচ-গানের যৌথ স্কুল ইত্যাদির কল্যানে বন্ধুবান্ধবদের ছোটো থেকে নাচতে দেখেছি। আর বর্ষবরণ বা পঁচিশে বৈশাখ জাতীয় পাড়ার অনুষ্ঠানে আমি যখন সাদা ফ্রক পরে দুপাশে ঝুঁটি বেঁধে সাত সন্ধ্যেবেলা ফাঁকা আসরে খানিক প্যাঁ প্যাঁ করে গলাবাজি করে নেমে আসতাম তখন বন্ধুরা কেমন ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে শাড়ি টাড়ি পরে, মাথায় ফুল, কাজল, লিপস্টিক, টিপ, চুড়ি ইত্যাদি প্রভৃতিতে ঝলমলিয়ে মঞ্চ দাপিয়ে নাচতো। আর আমি জুলজুল চোখে নিচ থেকে দেখতাম। সেই থেকেই বোধহয় আমার নৃত্যপ্রীতির সূচনা। 

তার কিছুবছর পরে শুরু হলো বৈশাখের অবশ্য পালনীয় আর একটি অনুষ্ঠানের জন্য মহড়া। পঁচিশে বৈশাখ। পয়লা বৈশাখ থেকেই পাড়ার বড় দাদা দিদিরা আমাদের চুনোপুঁটির দলকে নিয়ে তালিম দেওয়া শুরু করত। পয়লা বৈশাখ থেকেই কেন শুরু করত কে জানে? বছরের শুরুতে বাচ্চারা ভালো শিখতে পারে নাকি টিচারদের ঐদিন মাথা ঠান্ডা থাকে? তারা না পারলে বকুনির বহরটা খানিক কম থাকে? তারপর যত বছর পুরনো হতে থাকে ততই টিচারদের মাথার তাপমাত্রা বাড়তে থাকে? কেজানে? মোটকথা পয়লা বৈশাখ থেকে শুরু হয়ে যেত পঁচিশে বৈশাখের মহড়া। কখনো কখনোবা একাধিক অনুষ্ঠানের মহড়া। পঁচিশে বৈশাখের এক দুই দিন এদিকে ওদিকে করে আশেপাশের পাড়ায় হত অনুষ্ঠান। কুশীলবরা সব মোটামুটি একই মুখ। সুতরাং অনুষ্ঠানের কিঞ্চিত বৈচিত্র থাকতে হবে বৈকি। সেসব অনুষ্ঠানে যে আমরা কিরকম কুশলতার পরিচয় রাখতাম সেসব বলতে গেলে একটা আলাদা ব্লগপোস্ট লিখতে হয়। মোটকথা বাংলা বছর শুরু হলেই বঙ্গদেশের বাকি সমস্ত অংশের মতই আমাদের পাড়াতেও সংস্কৃতিপ্রেম উদ্বেলিত হয়ে উঠতো। আমরা ট্যাঁপাটেঁপির দল ছিলাম সে সংস্কৃতি রক্ষা করার গুরুত্বপূর্ণ হাতিয়ার। একে পরীক্ষা শেষ বলে নিয়ম করে পড়তে বসার বালাই নেই তার ওপরে নতুন জামা। এর পরেও বলতে হবে কেন পয়লা বৈশাখ উত্সব ছিল? ছিল বলছি কারণ এখন এই পয়লা এবং দোসরা বৈশাখ আমি উপরোক্ত ভালো ভালো কাজ করার জায়গায় ল্যাবে বসে গবেষণা গবেষণা খেলছি আর ব্লগ লিখছি। কি আর করব-যখন যেমন তখন তেমন।



শুভ নববর্ষ। নতুন বছর সবার খুব ভালো কাটুক। সক্কলে খুব ভালো থাকবেন।  





0 comments:

Post a Comment