Tuesday 20 January 2015

অ্যাচিভমেন্ট

আচ্ছা “এখন নয়, বড় হও তারপর করবে” এই কথাটা বিভিন্ন ভাবে, বিভিন্ন পরিস্থিতিতে কে কে শোনেননি? আমার তো মনে হয় এমন একজনকেও পাওয়া যাবে না যিনি এই কথাটি ছোটবেলায় একবারও শোনেননি।
বিয়ে বাড়িতে বড় দিদিরা শাড়ি টাড়ি পরে সাজুগুজু করে ঠোঁটে লিপস্টিক লাগাচ্ছে। আর আমি সাদা রঙের ফ্রক আর পায়ে কেডস টাইপের জুতো পরে ন্যাড়া মাথায় সেই দিকে হাঁ আ আ করে তাকিয়ে আছি দেখে দিদিদের মধ্যেই কেউ অমোঘ ভবিষ্যৎ বাণী করল “তাকাস না। তোর এখনও অনেক দেরি।”
তারপর ধরুন মা-জ্যেঠিমায়েরা বাৎসরিক পারিবারিক জটলায় গুজগুজ করছে। আমি দাঁত বের করে সেখানে গিয়ে দাঁড়াতেই মা দুই তিন সেকেন্ড স্থির চোখে তাকাল আর আমার মনে পড়ে গেল যে এখানে তো বড়রা কথা বলছে আমার প্রবেশ নিষেধ। পত্রপাঠ আমি দাঁত বন্ধ করে গুটি-গুটি পায়ে ফের নিজের রাজ্যে ফিরে এলাম। ছোট ছোট মানুষদের এইসব বড় বড় দুঃখের কথা প্রায় সকলেরই জানা। তাইনা? তখন খালি মনে হত দাঁড়াও না একবার বড় হয়ে যাই। তারপর দেখবে।

ক্লাস ফাইভে ওঠার পরে যখন বাবা বাজারে মান্না সেলুনে নিয়ে গিয়ে মাথাটা ন্যাড়া করিয়ে আনল খুব গরম পড়েছে বলে, আমার তখন বিশেষ দুঃখ টুঃখ হয়নি মনে বিশ্বাস করুন। কারণ আমার ন্যাড়া হবার ফ্রিকোয়েন্সি এত বেশি ছিল যে চুল না থাকার দুঃখ তো দূর অস্ত, প্রথমেই মনে হল “যাক বাবা, গরম পড়েছে, এবার স্নানের সময় বাদ দিয়েও বিকেলবেলা দৌড় ঝাঁপের পর “গা ধুতে যাচ্ছি” বলে পুকুরে ঘণ্টাখানেক কাটিয়ে এলেও মাথা দেখে মা কিছু বুঝতে পারবে না। পুকুরের জল ঘুলিয়ে না ওঠা পর্যন্ত  ডুব-সাঁতার, চিত-সাঁতার, আরও এক্স-ওয়াই-জেড নানারকম সাঁতার নিশ্চিন্তে চালিয়ে যাওয়া যাবে। পুকুর থেকে উঠে মাথায় একবার গামছা বুলিয়ে নিলেই হল। চুলই তো নেই। মাথা ভিজে বলে মা বকবে কি করে? অতএব ফুরফুরে মনেই পরদিন স্কুলে চলে গেলাম। গিয়েই মনে হল ফুরফুরে তো আর থাকা যাচ্ছে না। কি হল? বন্ধুরা সব বলছে তুই এখনও ন্যাড়া হস? বলে খিক খিক করে হাসছে। বন্ধুদের দুজনের দিব্বি কোঁকড়া কোঁকড়া ম্যাগি টাইপ এর চুল। তাতে ছোট্ট মিকি মাউস ক্লিপ। একজন মোটা চুল এর যত্নে বেশ করে শালিমার নারকেল তেল জাবড়ে এসেছে। রগ দিয়ে প্রায় তেল গড়াচ্ছে এমন অবস্থা। আর দুজন তো রীতিমতো কাঁটালি কলা সাইজের বেণীধারিণী। আমি হংস মধ্যে বক যথা হয়ে ক্যাবলা মুখে দাঁড়িয়ে আছি। টিফিনব্রেক এ খেলার সময় আরও একচোট খিক খিক। বড় ক্লাস এর দিদিরা কেউ কেউ “কিরে আবার ন্যাড়া?” –বলে মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে চলে যাচ্ছে। শেষে যখন লাস্ট পিরিয়ডে সরকার দিদিমনিও বললেন যে, “আবার ন্যাড়া হলি? এবার একটু রাখ চুল”-তখন কি জানি কেন প্রথম বার মনে হল ন্যাড়া না হলেই ভাল হত। মনে হল আর বুঝি ন্যাড়া হওয়া যায় না, আমি বড় হয়ে গেছি। হয়ত সেটাই সজ্ঞানে বালিকা থেকে কৈশোরে পদার্পণে আমার প্রথম সৌন্দর্য সচেতনতা। বাড়িতে এসে মাকে বলেছিলাম মনে আছে যে আমি আর ন্যাড়া হব না। স্কুলে সকলে হাসে। আর আমায় অবাক করে দিয়ে মাও আমার কথায় সেদিন সায় দিয়েছিল মনে আছে। বোধহয় সেদিন থেকেই শুরু হয়েছিল আমার বড় হওয়া। তারপর আস্তে আস্তে ফ্রক বা স্কার্ট এর সাথে বন্ধুরা বেল্ট দেওয়া কিশোরীসুলভ জুতো পরছে দেখে কোন একদিন আমার কেডস এর প্রতি অনীহা, এক মন অনিচ্ছা নিয়ে কেডস পরে বিয়ে বাড়ি যাওয়া, তারপর ক্লাস সেভেন-এ প্রথম বার পায়ে মেয়েদের জুতো পাওয়া-এভাবেই আস্তে আস্তে আমি-আমরা সবাই বালিকা থেকে ধীরে ধীরে কিশোরী হয়ে পড়ি। প্রায় সকলেরই এবিষয়ে কমবেশি অভিজ্ঞতা একই।

কিন্তু যে বিষয়ে অভিজ্ঞতাটা মেলে না সেটা হল, এই বড় হয়ে ওঠার দিনগুলোতে একএকটা ঘটনা মাইলস্টোনের মতন হয়ে পড়ে । এই মাইলস্টোনগুলো আমি আপনি প্রত্যেকের জন্যে আলাদা আলাদা। মনে হয় এই মাইলস্টোনগুলো ছুঁতে পারলেই বুঝি বড় হতে পারা যায়। বড় হতে থাকার সাথে সাথে এই লক্ষ্যগুলোও যায় বদলে। একেকটা মাইলস্টোন ছুঁতে পারার অ্যাচিভমেন্ট স্থির করে দেয় পরের মাইলস্টোন। আমার ছোট্টবেলার সেইসব কয়েকটা মাইলস্টোন এর গল্প শোনাতে বসেছি আজ। যেগুলো ছিল ভাগ্যিস। তাই তো এত বড় (বুড়ো) হলাম। নতুন নতুন মাইলস্টোন সেট করতে পেলাম।

খুব ছোটবেলায় এখনকার এই পাঁচফুটিয়া চেহারাটা লম্বায় কতটা মাক্সিমাম হতে পারে বুঝতেই পারছেন। এবং কুঁজোর যেহেতু সবসময়ই চিত হয়ে শুতে সাধ হয়, সেহেতুই বোধহয় নিজের জন্যে সেট করা আমার প্রথম মাইলস্টোন ছিল, “কবে আমি শোবার ঘরের শিকলটা খুলতে লাগাতে পারব?” তার আগে রান্না ঘরের শিকল নীচে থেকে ঠেলা মেরে খুলতে শিখে গেছি। ওটা ছিল শোবার ঘরেরটার চেয়ে নিচু। আমার যথেষ্ট লম্বা (বড়) হবার প্রমাণ হিসেবে এটা ছিল একটা গুরুত্বপূর্ণ মাইলস্টোন।    

পরেরটা ছিল আর একটা হাস্যকর ইচ্ছে। রোজ মনে মনে ঠাকুর প্রণাম করার সময় মায়ের শিখিয়ে দেওয়া বুলি “ঠাকুর সকলকে ভাল রেখ” বলার সাথে সাথে এটাও নিজে থেকে যোগ করে দিতাম যে, “ঠাকুর টুসিদিদির মতন আমিও যেন থ্রী তে পড়ি।” পাশের বাড়ির টুসিদিদির ক্লাস থ্রী তে পড়াটাই তখন আমার উচ্চশিক্ষার মার্কামারা প্রমাণ ছিল কারন আমার তখনও স্কুল বস্তুটির সাথে পরিচয় হয়নি।

তারপর ক্রমে ক্রমে সময়ের নিয়মেই আমি যখন ক্লাস থ্রী তে উঠলাম, ক্লাস থ্রী র ক্লাস রুম এর জানালা দিয়ে পাশের গার্লস স্কুলের মাঠে নীল স্কার্ট-সাদা শার্ট-সাদা কেডস পরে পিটি ক্লাস করতে আসা মেয়েদের দিকে তাকিয়ে চুপি চুপি প্রার্থনা করতাম, “উফফ, কবে ওরকম স্কুল ড্রেস পরে মাঠে পিটি করব?” সরকারী প্রাইমারী স্কুলে পড়া আমার কোন নির্দিষ্ট স্কুল ড্রেস ছিল না। মনে আছে ক্লাস ফাইভে ওঠার পর নতুন তৈরি হয়ে আসা নীল স্কার্ট-সাদা শার্টটাকে পুজোয় পাওয়া নতুন জামার থেকেও বেশি যত্নে রাখতাম বেশ কয়েকদিন।

আস্তে আস্তে শরীরে-মনে বড় হতে হতে মাইলস্টোনগুলোও বদলাতে থাকল। তার কিছু কিছু ছুঁতে পারা গেল কিছু কিছু রয়ে গেল অধরাই। বড় হবার সাথে সাথে চাহিদাগুলো তো সেরকম সোজা সাপটা থাকে না। আর বড়বেলার অধরা লক্ষ্যের কথা বুক বাজিয়ে বলার মতন শক্তপোক্ত বুকের পাটা যে আমার কস্মিন কালেও নেই সে কথা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। অতএব সে কথা নাহয় উহ্যই থাকুক।    

এরপর বাকি থাকে যা, তা আর এক- দুই-তিন করে সাজিয়ে দেবার মতন না। যেগুলো ছিল সেগুলোকে ঠিক অ্যাচিভমেন্ট বলা যায় না। জীবনের নিয়মেই ঘটতে থাকা কতগুলি ঘটনা। যেমন মাধ্যমিক-উচ্চমাধ্যমিক-কলেজ-ইউনিভার্সিটি-ল্যাব-পেপার সবক্ষেত্রেই “হে ভগবান, পার করে দাও” বলে  ভগবানকে মেন্টাল টর্চার করে করে পার হয়ে আসার ইতিহাস। সেসব আর বলার মতন কিছু নয়। সকলেই কম বেশি এসবের মধ্যে দিয়ে এসেছেন। তবে একটা জিনিস সব ক্ষেত্রেই কমন, যে দরজার শিকলে হাত পৌঁছে গেলে আর সেই মাইলস্টোনটির কোন মূল্য থাকেনা ঠিকই, কিন্তু একথাও অনস্বীকার্য যে শিকল অবধি পৌঁছাতে চাওয়ার ঐকান্তিক বাসনাতেই হয়ত লম্বা হবার পদ্ধতিতে কোন ফাঁক পড়েনা। আর তাতেই তাড়াতাড়ি লম্বা হওয়াটা হয়ে যায়।

ভাবতে অবাক লাগে যে, “ঠাকুর টুসিদিদির মতন আমিও যেন থ্রী তে পড়ি”- এই প্রার্থনাটা বত্রিশ বছরের মরচে পড়া জীবনে কত অকিঞ্চিৎকর এখন। অথচ এই একটি বাক্য আমি প্রতিদিন-দুবেলা পরম ভক্তিভরে জপ করেছি পরপর কতগুলি বছর। চার বছরের আমির দিকে তাকিয়ে ঠোঁট বেঁকিয়ে হাসছে বত্রিশ বছরের যে আমি, আমি নিশ্চিত, সেই আমির দিকে তাকিয়ে বাহাত্তর বছরের আমিও সেই একই রকমভাবে তাচ্ছিল্যের হাসি হাসবে। এই আমি লিখে দিলাম। বড় হবার প্রসেস এ আছি। আস্তে আস্তে আরও যখন বড় হব আজকে সেট করা বেশিরভাগ মাইলস্টোনগুলোর (অবশ্যই সেগুলো আমি এখন বলবনা, পাগল নাকি!) দিকে ফিরেও তাকাতে ইচ্ছে হবে না এ আমি হলফ করে বলতে পারি।


আপনাদেরও নিশ্চয়ই এরকম সব ভারি ভারি লক্ষ্য ছিল ছোটবেলায়? জানি তো থাকতেই হবে। সক্কলের থাকে। আমারগুলো তো জানিয়ে দিলাম। আপনাদের গুলো?

4 comments:

  1. খুউব ছোটবেলায় হঠাৎ একদিন বিকেলবেলায় দেখলাম একটা চোঙ মত জিনিস। ভিতরে তাকালে নানা রকম রং। চোঙটা ঘোরালে নতুন ধরনের সব রঙেরা এসে যাচ্ছে। ভীষণ ইচ্ছে হয়েছিল ওরকম একটা জিনিসকে সবসময়ের জন্য হাতে পাওয়ার। বহুবছর পরে বইমেলায় সেই জিনিসটা কিনলাম। এখনো কাছে আছে। তার উপরে প্রচুর ধুলো পড়েছে। শেষ কবে ওটা হাতে নিয়ে দেখেছি মনে পড়ছে না !

    ReplyDelete
    Replies
    1. ক্যালিডোস্কোপ............। আমারটা হারিয়ে গেছে।

      Delete
  2. আমার লম্বা হওয়ার মাপকাঠী ছিল বাথরুমের সুইচ বোর্ডে হাত পাওয়া। একটা সময় লাফ দিয়ে on করতে পারতাম কিন্তু off করতে পারতাম না। সেই সময় লম্বা হওয়ার আগ্রহটা ছিল সব চেয়ে বেশী। যেকোনো মাইলস্টোন, ছোটো হোক বা বড়, ছোঁয়া হোক বা না হোক, একটা সময় পর বোধহয় অকিঞ্চিৎকর হয়ে পড়ে। বাহাত্তর বছরের তুমি হয়তো বত্রিশ বছরের তুমির মাইলস্টোন নিয়ে নতুন করে লিখতে বসবে, ততদিনে বুকের পাটা শক্তপোক্ত হয়ে যাবে।

    ReplyDelete
    Replies
    1. সুইচবোর্ড অনেকের কাছেই একটা মাপকাঠি। আমাদের বাড়িতে একজায়গায় একটা পেরেক পোঁতা ছিল। আমি মাঝে মাঝে সেই পেরেকটার নিচে গিয়ে দাঁড়াতাম। পেরেকে মাথা ঠেকছে কি না দেখতে।
      আর আমি চাই বাহাত্তর এর অনেক আগেই যেন জীবনের সত্যি কথাগুলো সহজ করে নির্দ্বিধায় বলার মতন বুকের পাটাটা তৈরি হয়ে যায়। যাতে বাহাত্তরে গিয়ে নতুন মাইলস্টোন সেট করতে পারি।

      Delete