হযবরল এর ন্যাড়াকে মনে আছে? সেই যে গানওলা? সেই যে- "না ভাই, না ভাই, এখন আমায় গাইতে বোলো না, সত্যি বলছি আজকে আমার গলাটা তেমন খুলবে না।" সেই ন্যাড়ার কথা বলছি। আমি আজ আপনাদের আমার দেখা আরো এক ন্যাড়ার কথা বলব। এই ন্যাড়ার সাথে আমার দেখা হয়েছিল মায়াবতীতে।
আপনাদের খানিকটা বলেছিলাম তাঁর কথা। তবে কিনা বড় বড় লোকেদের কথা বড় করে না বললে ঠিক ভালো লাগে না তাই ভাবলাম একটু গুছিয়ে বলি এই ন্যাড়ার কথা। এই ন্যাড়া গানওলা নন। আমাদের দুর্ভাগ্যক্রমে তিনি লেখা লেখি করে থাকেন। কবি কবি ভাব।
প্রথম থেকে বলি, মায়াবতী আশ্রমে পৌঁছেছি সকাল সাড়ে দশটা নাগাদ। শান্ত মেঘলা সকাল, আশ্রম চত্বরের অদ্ভূত সুন্দর ফুলের বাগান আর সর্বোপরি অনাবিল শান্তি। পিনাকী ক্যামেরা বাগিয়ে শুয়ে-বসে-বেঁকে-নিচু হয়ে-উঁচু হয়ে ফটোগ্রাফির শেষ দেখে ছাড়বে এমন একটা চেষ্টায় আছে। আমি ওসব কায়্দাবাজিতে বিশেষ কিছু করে উঠতে পারব না বলে 'আঙ্গুর ফল টক' এরকম একটা ভাব দেখিয়ে দূরে বসে আমার প্রিয়তম কাজ করছি। মানে নানান মাথামুন্ডুহীন আবোলতাবোল চিন্তা ভাবনা করছি আর ফুল টুল দেখে মাঝে মাঝেই মুগ্ধ হয়ে যাচ্ছি।
এমন সময় দেখলাম আশ্রমের কয়েকজন মহারাজ প্রেসের বিল্ডিং থেকে বাগান পার হয়ে মূল ভবনের দিকে আসছেন আর সঙ্গে এক পাজামা-পাঞ্জাবি পরা, শান্তিনিকেতনি ঝোলা কাঁধে ভদ্রলোক তাঁদের সাথে আশ্রমের শান্ত সকালকে ছিন্নভিন্ন করে চেঁচাতে চেঁচাতে আসছেন। ইনিই আমাদের 'ন্যাড়াবাবু'।
---"হ্যাঁ, নরেন্দ্রপুরে অমুক মহারাজ তো বলতেন আমায়, তোমার হবে। লেগে থাকো।"
---উত্তরে মহারাজরা বললেন "ওহ, আচ্ছা তাই?"
---"আমি তো নরেন্দ্রপুরের ছাত্র। ওখানের পরিবেশটাই অন্য জানেন তো?" রামকৃষ্ণ মিশনের মহারাজরা প্রথম জানলেন নরেন্দ্রপুর সম্পর্কে।
মহারাজরা বললেন, "হ্যাঁ, সেই তো।"
ন্যাড়াবাবু বললেন, "আপনাদেরকে শুনিয়ে শান্তি, একটু শোনাই আমার এই লেখাটা। অমুক মহারাজকে শুনিয়েছি জানেনতো। দারুন খুশি হয়েছেন।"
প্রমাদ গুনে মহারাজরা বললেন, "তা আপনি যেন কবে বেরোচ্ছেন? গাড়ির ব্যবস্থা হয়েছে তো?"
ন্যাড়াবাবু বললেন, "হ্যাঁ হ্যাঁ, সেসব হয়েছে। তার পর শুনুন না এই যে এইখানটা........।"
বুঝলাম যে গত কয়েকদিন ধরে নিশ্চয় ন্যাড়াবাবু এঁনাদের প্রচন্ড জ্বালাতন করেছেন তাই সংযমী সাধুরা পর্যন্ত পালিয়ে বাঁচতে চাইছেন। শেষে কিছুটা কবিতা শুনিয়ে, জোর করে মহারাজদের লাইন করে দাঁড় করিয়ে তাঁদের ছবি তুলে, নিজে তাঁদের সঙ্গে দাঁড়িয়ে অন্যদের দিয়ে ছবি তুলিয়ে, বেশ খানিকটা হেঁ হেঁ করে মহারাজরা অবশেষে প্রায় মিনিট পনের কুড়ি পর ছুটি পেলেন।
তখন থেকেই কেমন যেন মনে হচ্ছিল - এই রে, এইবার বোধহয় আমায় চেপে ধরে ন্যাড়ার মত "মিশিমাখা শিখিপাখা......"শোনাবে। কারণ আশেপাশে আর কেউ নেই পিনাকী ছাড়া। সে তো আবার ওই দূরে প্রায় মাটিতে থুতনি ঠেকিয়ে ক্যামেরা চোখে কিসব যেন করছে। অতএব নেক্সট সম্ভব্য টার্গেট আমিই।মনের শান্তি, প্রানের যতসব তূরীয় চিন্তা ভাবনা তত্ক্ষনাত জলাঞ্জলি দিয়ে প্রমাদ গুনতে শুরু করলাম। যা ভেবেছি। দেখি ন্যাড়াবাবু এদিক ওদিক তাকাতে তাকাতে কি যেন একটা গান গুন গুন করতে করতে গুটি গুটি এদিকেই আসছে। প্রাণভয়ে পিনাকীর পেছনে লুকোবার একটা ব্যর্থ চেষ্টা করলাম বটে, হলনা।
--"আপনারা কোথা থেকে এসেছেন? কলকাতা?"
--"না, গুড়গাঁও।"
--"ও আচ্ছা, উনি কি আপনার হাসব্যান্ড?"
--"হ্যাঁ।"
--"উনি কি করেন?"
--"রিসার্চ"
--"আপনি?"
--"আমিও।"
--"না মানে চাকরি টাকরি.....?"
--"আমরা রিসার্চই করি।"
.
.
.
.
ক্রমে ক্রমে আমাদের অরিজিনাল বাড়ি কোথায়? আমরা কবে, কোত্থেকে মায়াবতী এসেছি? এখান থেকে কবে, কোথায় যাব? গুড়গাঁওতেই আমরা কাজ করি কিনা? কেন চাকরি করি না? কেন রিসার্চ করি?.........ইত্যাদি ইত্যাদি পেরিয়ে যখন প্রায় 'কটি বাচ্চা'......'কদ্দিন বিয়ে হয়েছে' এইসব অবশ্যম্ভাবী প্রয়োজনীয় প্রশ্নাবলীর দিকে গাড়ির মুখ ঘুরবে ঘুরবে তখনই দেবদূতের মতো পিনাকী এসে আমায় বাঁচিয়ে দিল। আমিও এই তালে সুট করে সরে গিয়ে মন দিয়ে ফুলের ছবি তুলতে লাগলাম। আর দূর থেকে দেখলাম পিনাকী বেচারা ফেঁসে গেছে। কিছুক্ষণ পর ভয়ে ভয়ে ওদিকে গিয়ে দেখি পিনাকীকে ন্যাড়াবাবু বলছেন "আপনাদের লেখালেখি করার অভ্যেস আছে নাকি?" পিনাকী "না" বলতেই ন্যাড়াবাবু ঝড়ের মত বলতে শুরু করলেন যে তিনি একজন লেখক। অনেক কবিতা-গদ্য লিখেছেন। নানা জায়গায় ছাপাও হয়েছে। ওঁনার একটা লিটিল ম্যাগাজিনও আছে....ইত্যাদি ইত্যাদি। পিনাকীর ফোন নম্বর নিলেন আর হাতের একতাড়া কাগজের বান্ডিল থেকে একটা পাতা আমাদের দিয়ে হাসি হাসি মুখে বললেন, "আমার রিসেন্ট লেখা পড়ে দেখবেন"। দেখি অত্যন্ত ঝাপসা একপাতার একটি লেখার ফোটো - কপি, সুচিত্রা সেনের জীবনাবসান নিয়ে। আমরাও হাসি হাসি মুখে নিয়ে বললাম "নিশ্চয়ই নিশ্চয়ই।" তারপর বললেন "বিবেক লেক দেখেছেন? ওই যে ওদিকে?" বললাম, "নাতো, যাই আমরা বরং দেখে আসি বেশি দূর নয় তো?" ন্যাড়াবাবু বললেন," না না, এই তো সামনে।আমি আপনাদের সঙ্গে গিয়ে বরং দেখিয়ে নিয়ে আসি।" আমরা সমস্বরে বলে উঠলাম " না না আমরা পারব। এই তো সামনেই।" ন্যাড়াবাবু এতে বড়ই মনক্ষুন্ন হয়ে পড়লেন কিন্তু আমরাও বাঁচতে চাইছিলাম। কি করব বলুন? তাই তাঁকে টা টা করে আমরা বিবেক লেক দেখতে গেলাম।
ততক্ষণে মনে যে শান্ত ভাব আসব আসব করছিল তা তালেগোলে কোথায় কেটে পড়েছে। বিবেক লেকের ধরে বসে তিলক মহারাজের সাথে কথা বলতে বলতে আর শুনতে শুনতে ফের যখন সেটা ফিরে আসব আসব করছে, দেখি দূর থেকে ন্যাড়াবাবুও হেলে দুলে ঝোলা কাঁধে এদিকপানেই আসছেন। আমার মতো বোধহয় আর সকলেও প্রমাদ গুনেছিলেন। সকলেই দেখি গা ঝাড়া দিয়ে উঠি উঠি করছেন। "চলো খাবার সময় হয়ে গেছে", "যাই ওদিকটা একটু ঘুরে আসি" ইত্যাদি ইত্যাদি নানান মন্তব্য করে টরে সবাই উঠে পড়লেন। বুঝলাম ন্যাড়া সবাইকেই কোনো না কোনো সময় গান শুনিয়েছে।
পরে আশ্রমের বুকষ্টলে বই কিনতে গিয়ে দেখা হলে ন্যাড়াবাবু আমাদের আবার জিজ্ঞাসা করেছিলেন আমরা লিখি টিখি কিনা। দুজনেই একবাক্যে 'না' বলতে খুব মুষড়ে পড়ে বললেন, "কাজ টাজ সামলে সময় হয় না বোধহয় না?.....হুম.....।" আমার খুব খারাপ লাগছিল বিশ্বাস করুন কারণ হযবরল-র ন্যাড়ার গান তাও শেষ পর্যন্ত কেউ শুনেছিল। আমাদের এই বেচারা ন্যাড়াবাবু নিজের লেখা সবাইকে ফোটো - কপি করে বিলি করা সত্বেও সবাই ওঁকে এড়িয়ে গেল। ভাবলাম বাড়ি গিয়ে ন্যাড়াবাবুর হ্যান্ডবিলটা পড়ে দেখতে হবে। বাড়ি ফিরে অনেক চেষ্টা করলাম জানেন। দুজনের দুটো ব্যাগই হাঁটকালাম। কোথাও খুঁজে পেলাম না ন্যাড়াবাবুর দেওয়া হ্যান্ডবিলটা। সত্যি সত্যি সরি ন্যাড়াবাবু।