একটু আগে একটি পুরনো রেকর্ডেড ইন্টারভিউ শুনছিলাম। রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে লেখা 'রানু ও ভানু' উপন্যাস প্রসঙ্গে কিছু বলতে গিয়ে ঔপন্যাসিক শ্রী সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় ইন্টারভিউতে মজা করেই বলছিলেন -"আমরা যখন কম বয়সী ছিলাম তখন ভাবতাম, বুড়ো বয়সটা বড় বাজে ব্যাপার। ষাট বছর বয়সী একটা লোক! একদম যা তা। রবীন্দ্রনাথ আটান্ন বছর বয়সে চোদ্দ বছর বয়সী একটা মেয়ের সাথে প্রেম করছেন? নাহ, এটা কিরকম? কিন্তু এখন নিজে ষাট বছর বয়সে পৌঁছে ভাবি, বেশ তো আছি, কিছুই তো চেঞ্জ হয়নি, এখন একটা চোদ্দ বছরের প্রেমিকা........ভালই তো মন্দ কি?" শুনে বক্তার সাথে সাথে, ইন্টারভিউর হোস্ট এবং সঙ্গে আমরাও বেশ মজা পাচ্ছিলাম।
বয়স জিনিসটা আমার বেশ ভালই লাগে। যদিও বেশি বয়স জিনিসটা বেশির ভাগ লোকের কাছেই খুব একটা কাম্য নয় বলেই আমার মনে হয়। "আরে কতদিন পর দেখছি তোমায়........তুমি কিন্তু সেই একই রকম আছো", " কি সুন্দর লাগছে ......so young!!" "তোমার কিন্তু একটাও চুল পাকেনি আমার তো যা অবস্থা.........." এরকম ধরনের কথা লোকে যা পছন্দ করে না কি বলব! আরে ভাই, কারো যদি ষাট বছর বয়স হয় তো ষাট বছরের মত দেখালে ক্ষতি টা কি? আমি তো বুঝি না। বেশ একটা বয়সের সম্মান পাওয়া যায়। বেশ একটা হনু হনু ভাব আসে মনে। তা না আপনি ষাট বছর বয়সে লাল-নীল-হলুদ -সবুজ রঙের জামা আর একটা ড্রাগন আঁকা হাফ প্যান্ট পরে সমস্ত চুলকে কুচকুচে কালো রং করে (যার খানিকটা কানের পাশের চামড়ায় লেগে আছে) হাতে বাজারের ব্যাগ নিয়ে বাজার করতে যাচ্ছেন। না.............মানে আমি বলছি যে, তাতে আপনার মনটা যে বেশ কুড়ি বছর-কুড়ি বছর আছে সেটা লোককে বোঝানো গেলেও রবিবারের মাংসের দোকানে কুড়ি জনের পেছনে লাইন দিতে গেলে সামনের চল্লিশ বছরের লোকটি কি আর আপনাকে জায়গা ছেড়ে দেবে?
দু চার বছর আগেও যখন প্রতি সপ্তাহে আমি লোকাল ট্রেনের লেডিস কম্পার্টমেন্টে যাতায়াত করতাম, তখন মাঝখানের কোনো এক স্টেশন থেকে একজন ভদ্রমহিলা উঠতেন মনে আছে। সোমবারের ডেইলি এবং উইকলি প্যাসেঞ্জারদের ভিড়ে স্বভাবতই বসার সিট পেতেন না। আমি প্রতি সপ্তাহেই লক্ষ্য করতাম তাঁকে। আমার বাকি জার্নিটার ফুল এন্টারটেইনমেন্ট হয়ে যেত। তিনি অনেক সময়ই প্লাটফর্মের উপর দিয়ে দৌড়াতে দৌড়াতে ট্রেনে উঠতেন। উঠেই ঠেলে ঠুলে সিট এর দিকে চলে আসতেন। কিছুক্ষণ দাঁড়াতেন। উফ আঃ করতে শুরু করতেন। সাড়ে তিন মিনিট পর থেকেই তাঁর পায়ে ব্যথা এবং গত রাতের প্রেসার বেড়ে যাবার গল্প শুরু করতেন। সাড়ে সাত মিনিট পর সামনের কোনো এক নার্সারী স্কুলের পড়ুয়াকে (যদি আবার সে জানালার ধরে সিট পেয়ে থাকে তবে তো হয়েই গেল) টার্গেট করতেন। ওই ট্রেনটিতে হাওড়ার কাছাকাছি কোনো এক নামী এবং ততোধিক দামী স্কুল এর তিন বছর বয়সী বাচ্চারা তিরিশ কেজি ওজনের ব্যাগ নিয়ে তাদের মায়েদের সাথে বাড়ি থকে তিরিশ কিলোমিটার দূরের স্কুলে পড়তে যেত। কেন কে জানে? বাড়ির কাছে স্কুল ছিল না বোধ হয়। যাক যে যাক সে সব কথা। যা বলছিলাম, ওই ভদ্রমহিলা জানলার ধারের কোনো এক কুঁচোকে বেছে নিয়ে তার মায়ের সাথে ভাব জমাতেন, অনেক সময় অনেকদিনের যাতায়াতের সঙ্গী হিসাবে মায়েদের সাথে মুখচেনাও হয়ে গেছিল। বাচ্চাটিকে বলতেন "বাবু তুমি আমার কোলে বসো।" বলেই তার ভিড়ে-গরমে-ঘামে ভিজে-বাচ্চার ত্রিশ কেজি বইয়ের ব্যাগ, নিজের হ্যান্ড ব্যাগ, জলের বোতল নিয়ে জুবুথুবু হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা মাকে কিছু বলতে না দিয়ে বাচ্চাটিকে তুলে দিয়ে জাঁকিয়ে বসতেন। এখন বাচ্চাটি হয়ত কারো কোলে বসতে রাজি নয়। তাই হয়ত তার মা সোমবারের ভিড়ে ওই অমূল্য সিটটিতে বাচ্চাটিকে বসিয়ে নিজে কোনমতে দাঁড়িয়ে আছেন, নইলে তো নিজেই বাচ্চাকে কোলে নিয়ে বসতে পারতেন। বাচ্চাটিও কিছুক্ষণ পর থেকেই উশখুশ করতে শুরু করত। মাঝে মাঝে ওই ভদ্রমহিলা নিজেই উশখুশ করতেন (যাতে বাচ্চাটি অস্বস্তি বোধ করে)। এবং মিনিট দশেকের মাথায় অবধারিত ভাবে দৃশ্যটা এরকম দাঁড়াত যে, জানলার ধারে বসে ভদ্রমহিলা নিজের টিফিন বাক্স খুলে শশা- মুড়ি খাচ্ছেন, বাচ্চার মা ভুরু কুঁচকে প্রতি তিন মিনিট পর পর একবার করে বাচ্চাকে বলছেন "বাবু, বসে পড়ো আন্টির কোলে।" আর বাবু গম্ভীর মুখে জানালার রড ধরে বাইরে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। এবং শশা-মুড়ি শেষ করে, জল খেয়ে, প্রচুর মুড়ি আর জল সিটের সামনে ছড়িয়ে ভদ্রমহিলা পাশের কারো সাথে ছেলের বউ এর নিন্দে করতে লেগেছেন।
বারো মাস-বাহান্ন সপ্তাহের বাহান্নটা সোমবার এই একই গল্প। প্রথম প্রথম ভাবতাম বুঝি সত্যি সত্যি পায়ে ব্যথা, হাই প্রেসার। তারপর ব্যাপারটা বুঝলাম। তাঁর সাজপোশাক, প্লাটফর্মের ছোটা, হাওড়ায় নামার আগে লিপস্টিক ঠিক করা- কোনো কিছু দেখেই বয়স ব্যাপারটা বোঝা যেত না। শুধু ট্রেনে সিট না পেলেই কয়েক মিনিটে বয়সটা তাঁর হুড়-হুড় করে বেড়ে যেত। এটা হলো বয়স বাড়ার সুযোগ নেওয়া।
আবার কিছু লোক কে এমনও দেখেছি যে তাঁরা নিজেদের বয়স সম্পর্কে ওয়াকিবহাল নন। সেই তিরিশেই আটকে আছেন, দোকানে শাড়ী কিনতে গেলে দোকানদার তাঁর দিকে একঝলক তাকিয়ে যখন হালকা আকাশী রঙের তাঁতের শাড়ি মেলে ধরেন, তখন "এত বয়স্কদের মত রং দেখাচ্ছেন কেন" বলে, নিচের ডিপ মেরুন রঙের চকচকেটা টেনে নেন। বাংলা সিরিয়াল দেখে নতুন রকম ব্লাউজের কাটিং করান। বা লাল রঙের ড্রাগন আঁকা বারমুডা আর ফুল ফুল জামা পরে, মোবাইলে বাইশ বছর বয়সী নাতির মুখের মানানসই ভাষা বলতে বলতে বাজারে যান। তবে যাই হোক এঁনারা খুব একটা ক্ষতিকারক নন। আশে পাশে দেখলে বেশ মজাই লাগে। তাঁদের কাজ কর্মে বেশ উত্সাহ দিতে ইচ্ছা হয় কারণ তাতে আমার নিজের বেশ এন্টারটেইনমেন্ট হয়ে যায়, আর anti aging ক্রিম-ট্রিম বানানোর কোম্পানির লোকজনগুলোও খেয়ে পরে বাঁচে। এঁনারাই আবার কিন্তু নিজেদের সময়কার সব ভালো এখনকার সব খারাপ এই বিষয়ে ঝাড়া দেড় ঘন্টা বক্তৃতা দিয়ে দিতে পারবেন।
যাই হোক একটা গল্প বলি, একবার আমার বাত্সরিক চুল ছাঁটার দিনে দিদির সাথে পার্লারে গেছি। আমি কখনো একা একা এইসব ডেঞ্জারাস জায়গায় যাই না, কি করতে কি করে দেবে, কি দরকার বাবা! সেখানে একজন পঞ্চাশোর্ধ মহিলা রূপচর্চা করাচ্ছিলেন। একের পর এক কি সব সাদা-সবুজ-মেটে রঙা লেই মাখিয়ে চলেছিল তাঁকে। সঙ্গে মুখের মধ্যে চড়-থাপ্পড়, চুল ধরে টানাটানি, ভুরু নিয়ে খামচা-খামচি ইত্যাদি ইত্যাদি। দিব্বি সেইসব অত্যাচার হাসি মুখে সহ্য করছিলেন তিনি। আমি গোল গোল চোখ করে হাঁআআ...করে তাকিয়ে আছি দেখে দিদি এমন এক অন্তর্টিপুনি দিলো যে বেশিক্ষণ ব্যাপারটা সরাসরি দেখতে পারলাম না, আড়চোখে মাঝে মাঝে দেখতে হচ্ছিল। শেষকালে আর না থাকতে পেরে আমার পক্ষে যতখানি ফিসফিস করে বলা সম্ভব ততটাই ফিসফিস করে দিদিকে বলতে গেছি যে,"কি দরকার এত পয়সা খরচ করে চড়-থাপ্পড় খাবার, যেরকম বয়স সেরকম দেখালেই তো বেশ দেখতে ভালো লাগে।" ফিসফিসটা বোধহয় ততটা ফিসফিস ছিল না, দিদি দেখলাম খামোখা খুব রেগে-গিয়ে কপাল-টপাল কুঁচকে বলল "উফফ মুন্নি, চুপ কর, উনি আমাকে চেনেন।" আমি তো জিভ টিভ কেটে চুপ করে গেলাম। কিন্তু ততক্ষণে যা হবার তা হয়ে গেছে। আয়না দিয়ে দেখতে পেলাম ভদ্র মহিলা চোখ খুলে আয়্না দিয়ে সো ও ও ও জা আমার চোখের দিকে তাকিয়ে আছেন, আর তাঁকে থাপ্পড় মারছিল পার্লারের যে কমবয়সী মেয়েটি সে ঠোঁট টিপে হাসছে। দেখে শুনে আমি উদাস মুখে কান চুলকোতে চুলকোতে জানলার বাইরে তাকিয়ে রইলাম।
অনেককে শুনেছি কাকু বলে সম্মোধন করলে একটু রেগে যান, দাদা বলতে হয়। আমার তো বেশ লাগে যখন মনে হয়, আমি এই বয়সেই আমার বিরাট পরিবারের সৌজন্যে, বাবার বয়সী কোনো দাদা বা দিদির নাতি-নাতনির সম্পর্কে দিদিমা হয়ে গেছি। যদিও তারা কেউই আমাকে দিদিমা বলে না, দিদি বলে ডাকে, তাও লোকজনের কাছে নিজের দিদিমাত্ব ফলাও করে বলতে আমার বেশ ভালই লাগে। সেদিনও ল্যাবে অপরিসীম হ্যা হ্যা-র মধ্যে ইমরান আমায় ভুল করে 'দিদি' বলতে গিয়ে 'দাদী' বলে ফেলল তখন ভাবলাম ইশ চুল পেকে ষাট বছর হতে এখনো কত দেরী, কত অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করা বাকি। সাতাশি-অষ্টাশি বছরের জ্যেঠুমনির সাথে কথা বললে মনে হয়- কত গল্প জানে, কত বছরের সঞ্চয়, প্রায় এক শতকের জীবন্ত ইতিহাস। শত-শত বিদেশীকে দেখেছি ভারতবর্ষের নানা জায়গায়, যাঁরা জীবনের সব কাজ শেষ করে জীবনসঙ্গীর হাত ধরে নতুন দেশ দেখতে বেরিয়েছেন। অবসর জীবনে নতুন করে জীবন শুরু করেছেন। তবুও যে কেন লোকে খোকা খুকু হয়ে থাকতে চায় কে জানে? সুস্থ থাকো, তার জন্য যা করার করো। কিন্তু মনে মনে আশিতে পৌঁছে গিয়ে বাইরেটাকে চল্লিশে আটকে রাখার আপ্রাণ ব্যর্থ প্রচেষ্টায় মন আর পয়সা খরচ না করে বয়সের স্বাভাবিক মাধুর্য্যটাকে হারিয়ে ফেলে কি লাভ কে জানে।
আমি তো বয়স বাড়ার অপেক্ষায় আছি। বয়স বাড়ার প্রধান ও অন্যতম লক্ষণ ব্লাড প্রেসার নিজের ইচ্ছা মত নাচানাচি করা। সেটা হচ্ছে আশংকা করে বেশি বয়সের প্রথম খেলনা একটা ডিজিটাল ব্লাড প্রেসার মাপার যন্তর কিনে ফেলেছি কিছুদিন হলো। কিন্তু হতভাগা মেশিনটা একদিনও উল্টোপাল্টা রিডিং দেখালো না। সেই একশ দশ- সত্তর এ আটকে আছে। উপরন্তু স্লো স্পীডে বুড়ো হচ্ছি এই দুশ্চিন্তায় বোধ হয় পালস রেট সর্বদা বিরাশি-তিরাশি দেখায়। যা তা। কোথায় বয়স্ক সম্মানীয় মানুষ বলে লোকের খানিক শ্রদ্ধা-ভক্তি পাব, তা না আজও চ্যাংড়া দের দলভুক্ত হয়েই রয়ে গেলাম। ভাল্লাগেনা!
বয়স জিনিসটা আমার বেশ ভালই লাগে। যদিও বেশি বয়স জিনিসটা বেশির ভাগ লোকের কাছেই খুব একটা কাম্য নয় বলেই আমার মনে হয়। "আরে কতদিন পর দেখছি তোমায়........তুমি কিন্তু সেই একই রকম আছো", " কি সুন্দর লাগছে ......so young!!" "তোমার কিন্তু একটাও চুল পাকেনি আমার তো যা অবস্থা.........." এরকম ধরনের কথা লোকে যা পছন্দ করে না কি বলব! আরে ভাই, কারো যদি ষাট বছর বয়স হয় তো ষাট বছরের মত দেখালে ক্ষতি টা কি? আমি তো বুঝি না। বেশ একটা বয়সের সম্মান পাওয়া যায়। বেশ একটা হনু হনু ভাব আসে মনে। তা না আপনি ষাট বছর বয়সে লাল-নীল-হলুদ -সবুজ রঙের জামা আর একটা ড্রাগন আঁকা হাফ প্যান্ট পরে সমস্ত চুলকে কুচকুচে কালো রং করে (যার খানিকটা কানের পাশের চামড়ায় লেগে আছে) হাতে বাজারের ব্যাগ নিয়ে বাজার করতে যাচ্ছেন। না.............মানে আমি বলছি যে, তাতে আপনার মনটা যে বেশ কুড়ি বছর-কুড়ি বছর আছে সেটা লোককে বোঝানো গেলেও রবিবারের মাংসের দোকানে কুড়ি জনের পেছনে লাইন দিতে গেলে সামনের চল্লিশ বছরের লোকটি কি আর আপনাকে জায়গা ছেড়ে দেবে?
দু চার বছর আগেও যখন প্রতি সপ্তাহে আমি লোকাল ট্রেনের লেডিস কম্পার্টমেন্টে যাতায়াত করতাম, তখন মাঝখানের কোনো এক স্টেশন থেকে একজন ভদ্রমহিলা উঠতেন মনে আছে। সোমবারের ডেইলি এবং উইকলি প্যাসেঞ্জারদের ভিড়ে স্বভাবতই বসার সিট পেতেন না। আমি প্রতি সপ্তাহেই লক্ষ্য করতাম তাঁকে। আমার বাকি জার্নিটার ফুল এন্টারটেইনমেন্ট হয়ে যেত। তিনি অনেক সময়ই প্লাটফর্মের উপর দিয়ে দৌড়াতে দৌড়াতে ট্রেনে উঠতেন। উঠেই ঠেলে ঠুলে সিট এর দিকে চলে আসতেন। কিছুক্ষণ দাঁড়াতেন। উফ আঃ করতে শুরু করতেন। সাড়ে তিন মিনিট পর থেকেই তাঁর পায়ে ব্যথা এবং গত রাতের প্রেসার বেড়ে যাবার গল্প শুরু করতেন। সাড়ে সাত মিনিট পর সামনের কোনো এক নার্সারী স্কুলের পড়ুয়াকে (যদি আবার সে জানালার ধরে সিট পেয়ে থাকে তবে তো হয়েই গেল) টার্গেট করতেন। ওই ট্রেনটিতে হাওড়ার কাছাকাছি কোনো এক নামী এবং ততোধিক দামী স্কুল এর তিন বছর বয়সী বাচ্চারা তিরিশ কেজি ওজনের ব্যাগ নিয়ে তাদের মায়েদের সাথে বাড়ি থকে তিরিশ কিলোমিটার দূরের স্কুলে পড়তে যেত। কেন কে জানে? বাড়ির কাছে স্কুল ছিল না বোধ হয়। যাক যে যাক সে সব কথা। যা বলছিলাম, ওই ভদ্রমহিলা জানলার ধারের কোনো এক কুঁচোকে বেছে নিয়ে তার মায়ের সাথে ভাব জমাতেন, অনেক সময় অনেকদিনের যাতায়াতের সঙ্গী হিসাবে মায়েদের সাথে মুখচেনাও হয়ে গেছিল। বাচ্চাটিকে বলতেন "বাবু তুমি আমার কোলে বসো।" বলেই তার ভিড়ে-গরমে-ঘামে ভিজে-বাচ্চার ত্রিশ কেজি বইয়ের ব্যাগ, নিজের হ্যান্ড ব্যাগ, জলের বোতল নিয়ে জুবুথুবু হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা মাকে কিছু বলতে না দিয়ে বাচ্চাটিকে তুলে দিয়ে জাঁকিয়ে বসতেন। এখন বাচ্চাটি হয়ত কারো কোলে বসতে রাজি নয়। তাই হয়ত তার মা সোমবারের ভিড়ে ওই অমূল্য সিটটিতে বাচ্চাটিকে বসিয়ে নিজে কোনমতে দাঁড়িয়ে আছেন, নইলে তো নিজেই বাচ্চাকে কোলে নিয়ে বসতে পারতেন। বাচ্চাটিও কিছুক্ষণ পর থেকেই উশখুশ করতে শুরু করত। মাঝে মাঝে ওই ভদ্রমহিলা নিজেই উশখুশ করতেন (যাতে বাচ্চাটি অস্বস্তি বোধ করে)। এবং মিনিট দশেকের মাথায় অবধারিত ভাবে দৃশ্যটা এরকম দাঁড়াত যে, জানলার ধারে বসে ভদ্রমহিলা নিজের টিফিন বাক্স খুলে শশা- মুড়ি খাচ্ছেন, বাচ্চার মা ভুরু কুঁচকে প্রতি তিন মিনিট পর পর একবার করে বাচ্চাকে বলছেন "বাবু, বসে পড়ো আন্টির কোলে।" আর বাবু গম্ভীর মুখে জানালার রড ধরে বাইরে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। এবং শশা-মুড়ি শেষ করে, জল খেয়ে, প্রচুর মুড়ি আর জল সিটের সামনে ছড়িয়ে ভদ্রমহিলা পাশের কারো সাথে ছেলের বউ এর নিন্দে করতে লেগেছেন।
বারো মাস-বাহান্ন সপ্তাহের বাহান্নটা সোমবার এই একই গল্প। প্রথম প্রথম ভাবতাম বুঝি সত্যি সত্যি পায়ে ব্যথা, হাই প্রেসার। তারপর ব্যাপারটা বুঝলাম। তাঁর সাজপোশাক, প্লাটফর্মের ছোটা, হাওড়ায় নামার আগে লিপস্টিক ঠিক করা- কোনো কিছু দেখেই বয়স ব্যাপারটা বোঝা যেত না। শুধু ট্রেনে সিট না পেলেই কয়েক মিনিটে বয়সটা তাঁর হুড়-হুড় করে বেড়ে যেত। এটা হলো বয়স বাড়ার সুযোগ নেওয়া।
আবার কিছু লোক কে এমনও দেখেছি যে তাঁরা নিজেদের বয়স সম্পর্কে ওয়াকিবহাল নন। সেই তিরিশেই আটকে আছেন, দোকানে শাড়ী কিনতে গেলে দোকানদার তাঁর দিকে একঝলক তাকিয়ে যখন হালকা আকাশী রঙের তাঁতের শাড়ি মেলে ধরেন, তখন "এত বয়স্কদের মত রং দেখাচ্ছেন কেন" বলে, নিচের ডিপ মেরুন রঙের চকচকেটা টেনে নেন। বাংলা সিরিয়াল দেখে নতুন রকম ব্লাউজের কাটিং করান। বা লাল রঙের ড্রাগন আঁকা বারমুডা আর ফুল ফুল জামা পরে, মোবাইলে বাইশ বছর বয়সী নাতির মুখের মানানসই ভাষা বলতে বলতে বাজারে যান। তবে যাই হোক এঁনারা খুব একটা ক্ষতিকারক নন। আশে পাশে দেখলে বেশ মজাই লাগে। তাঁদের কাজ কর্মে বেশ উত্সাহ দিতে ইচ্ছা হয় কারণ তাতে আমার নিজের বেশ এন্টারটেইনমেন্ট হয়ে যায়, আর anti aging ক্রিম-ট্রিম বানানোর কোম্পানির লোকজনগুলোও খেয়ে পরে বাঁচে। এঁনারাই আবার কিন্তু নিজেদের সময়কার সব ভালো এখনকার সব খারাপ এই বিষয়ে ঝাড়া দেড় ঘন্টা বক্তৃতা দিয়ে দিতে পারবেন।
যাই হোক একটা গল্প বলি, একবার আমার বাত্সরিক চুল ছাঁটার দিনে দিদির সাথে পার্লারে গেছি। আমি কখনো একা একা এইসব ডেঞ্জারাস জায়গায় যাই না, কি করতে কি করে দেবে, কি দরকার বাবা! সেখানে একজন পঞ্চাশোর্ধ মহিলা রূপচর্চা করাচ্ছিলেন। একের পর এক কি সব সাদা-সবুজ-মেটে রঙা লেই মাখিয়ে চলেছিল তাঁকে। সঙ্গে মুখের মধ্যে চড়-থাপ্পড়, চুল ধরে টানাটানি, ভুরু নিয়ে খামচা-খামচি ইত্যাদি ইত্যাদি। দিব্বি সেইসব অত্যাচার হাসি মুখে সহ্য করছিলেন তিনি। আমি গোল গোল চোখ করে হাঁআআ...করে তাকিয়ে আছি দেখে দিদি এমন এক অন্তর্টিপুনি দিলো যে বেশিক্ষণ ব্যাপারটা সরাসরি দেখতে পারলাম না, আড়চোখে মাঝে মাঝে দেখতে হচ্ছিল। শেষকালে আর না থাকতে পেরে আমার পক্ষে যতখানি ফিসফিস করে বলা সম্ভব ততটাই ফিসফিস করে দিদিকে বলতে গেছি যে,"কি দরকার এত পয়সা খরচ করে চড়-থাপ্পড় খাবার, যেরকম বয়স সেরকম দেখালেই তো বেশ দেখতে ভালো লাগে।" ফিসফিসটা বোধহয় ততটা ফিসফিস ছিল না, দিদি দেখলাম খামোখা খুব রেগে-গিয়ে কপাল-টপাল কুঁচকে বলল "উফফ মুন্নি, চুপ কর, উনি আমাকে চেনেন।" আমি তো জিভ টিভ কেটে চুপ করে গেলাম। কিন্তু ততক্ষণে যা হবার তা হয়ে গেছে। আয়না দিয়ে দেখতে পেলাম ভদ্র মহিলা চোখ খুলে আয়্না দিয়ে সো ও ও ও জা আমার চোখের দিকে তাকিয়ে আছেন, আর তাঁকে থাপ্পড় মারছিল পার্লারের যে কমবয়সী মেয়েটি সে ঠোঁট টিপে হাসছে। দেখে শুনে আমি উদাস মুখে কান চুলকোতে চুলকোতে জানলার বাইরে তাকিয়ে রইলাম।
অনেককে শুনেছি কাকু বলে সম্মোধন করলে একটু রেগে যান, দাদা বলতে হয়। আমার তো বেশ লাগে যখন মনে হয়, আমি এই বয়সেই আমার বিরাট পরিবারের সৌজন্যে, বাবার বয়সী কোনো দাদা বা দিদির নাতি-নাতনির সম্পর্কে দিদিমা হয়ে গেছি। যদিও তারা কেউই আমাকে দিদিমা বলে না, দিদি বলে ডাকে, তাও লোকজনের কাছে নিজের দিদিমাত্ব ফলাও করে বলতে আমার বেশ ভালই লাগে। সেদিনও ল্যাবে অপরিসীম হ্যা হ্যা-র মধ্যে ইমরান আমায় ভুল করে 'দিদি' বলতে গিয়ে 'দাদী' বলে ফেলল তখন ভাবলাম ইশ চুল পেকে ষাট বছর হতে এখনো কত দেরী, কত অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করা বাকি। সাতাশি-অষ্টাশি বছরের জ্যেঠুমনির সাথে কথা বললে মনে হয়- কত গল্প জানে, কত বছরের সঞ্চয়, প্রায় এক শতকের জীবন্ত ইতিহাস। শত-শত বিদেশীকে দেখেছি ভারতবর্ষের নানা জায়গায়, যাঁরা জীবনের সব কাজ শেষ করে জীবনসঙ্গীর হাত ধরে নতুন দেশ দেখতে বেরিয়েছেন। অবসর জীবনে নতুন করে জীবন শুরু করেছেন। তবুও যে কেন লোকে খোকা খুকু হয়ে থাকতে চায় কে জানে? সুস্থ থাকো, তার জন্য যা করার করো। কিন্তু মনে মনে আশিতে পৌঁছে গিয়ে বাইরেটাকে চল্লিশে আটকে রাখার আপ্রাণ ব্যর্থ প্রচেষ্টায় মন আর পয়সা খরচ না করে বয়সের স্বাভাবিক মাধুর্য্যটাকে হারিয়ে ফেলে কি লাভ কে জানে।
আমি তো বয়স বাড়ার অপেক্ষায় আছি। বয়স বাড়ার প্রধান ও অন্যতম লক্ষণ ব্লাড প্রেসার নিজের ইচ্ছা মত নাচানাচি করা। সেটা হচ্ছে আশংকা করে বেশি বয়সের প্রথম খেলনা একটা ডিজিটাল ব্লাড প্রেসার মাপার যন্তর কিনে ফেলেছি কিছুদিন হলো। কিন্তু হতভাগা মেশিনটা একদিনও উল্টোপাল্টা রিডিং দেখালো না। সেই একশ দশ- সত্তর এ আটকে আছে। উপরন্তু স্লো স্পীডে বুড়ো হচ্ছি এই দুশ্চিন্তায় বোধ হয় পালস রেট সর্বদা বিরাশি-তিরাশি দেখায়। যা তা। কোথায় বয়স্ক সম্মানীয় মানুষ বলে লোকের খানিক শ্রদ্ধা-ভক্তি পাব, তা না আজও চ্যাংড়া দের দলভুক্ত হয়েই রয়ে গেলাম। ভাল্লাগেনা!
0 comments:
Post a Comment