Wednesday, 23 July 2014

সেমিনার শুনতে শুনতে কি করে জেগে থাকতে হয় বলুন তো?

গুগল ইমেজ থেকে

আজ একখানা সেমিনার শুনতে হচ্ছিলো। সকাল সকাল ছিল আর ভদ্রলোক বলছিলেন ভালই। যথেষ্ট গলার জোর, দারুন উদ্যম তাই রক্ষে। খুব একটা অসুবিধা হয়নি। দুপুরবেলা একপেট ভাত-ডাল-তরকারী-মাছ-টাছ দিয়ে সাপটে খেয়ে ঠান্ডা-ঠান্ডা সেমিনার হলে টানা দুঘন্টা বসে সেঁতানো মুড়ি মার্কা গলায় বোরিং বক্তৃতা শুনতে হলেই হয়েছিল আরকি।

বেশিরভাগ সেমিনার শুনতে গিয়ে প্রথম কয়েক মিনিট আমার অন্ততঃ যে অভিজ্ঞতা হয় সেটা হলো-বক্তা প্রাণপণে বোঝাবার চেষ্টা করে চলেছেন যে মনুষ্যদেহের কোনো একধরনের কোষকে মেরে ধরে-রং করে-টেনে বাড়িয়ে-দুমড়ে ছোট করে-নানান আবোলতাবোল প্রোটিন ঢুকিয়ে-বার করে-তাকে আবার ইঁদুর বাঁদরের দেহে ঢুকিয়ে-আরো নানান কিছু ঐন্দ্রজালিকসুলভ কাজকর্ম করে মানব দেহের সব রহস্যই প্রায় তিনি উদ্ধার করে ফেলেছেন, আর আমি ভুরু-টুরু কুঁচকে, পেন্সিল কামড়ে প্রাণপণে সেসব বোঝবার চেষ্টা করে চলেছি। তারপর আস্তে আস্তে ঘটনাবলী আমার মোটা মাথার বোধবুদ্ধি থেকে পিছলে যেতে থাকে আর আমি প্রানপণে খামচে-খুমচে তাকে আটকাবার একটা ব্যর্থ প্রচেষ্টা করতে থাকি। শেষে বক্তা নিজের মতো করে নিজের মহিমাকীর্তন করে যেতে থাকেন, আর আমি নিজের বুদ্ধির পায়ে একটা সাষ্টাঙ্গ প্রণাম সেরে কীর্তন শোনায় ক্ষান্ত দি। আর তখন থেকেই আমার পরবর্তী চেষ্টাটা থাকে কি করে নিজেকে সোজা রাখা যায় আর চোখ দুটো খোলা রাখা যায়। কি জ্বালা! তারপর, সেমিনার শেষে বোদ্ধারা সবাই যখন বক্তার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে চোখা চোখা প্রশ্নবান ছুঁড়তে থাকেন তখন আমার একটা মিশ্র অনুভূতি হয়। প্রথমত আমার মনে হয় আমি ছাড়া আর সবাই সব কিছুই কেমন জানে-কাল থেকে আমিও ইন্টারনেটের আবোলতাবোল সাইটে সারাদিন ঘুরে না বেড়িয়ে প্রচুর পড়াশুনা করব। আর দ্বিতীয়ত মনে হয় "হে ভগবান, বক্তাটিকে সসম্মানে বাড়ি ফিরে যেতে দাও।" এই দ্বিতীয় চিন্তাটা আমার আসে কারণ মা বলেছে, "কারো কোনদিন খারাপ চাইবে না তাহলে তোমারও একদিন ওই খারাপটাই হবে।" আর বক্তার জায়গায় আমি থাকলে সাধারণত যে পরিমাণ ল্যাজেগোবরে হয়ে থাকি তা যদি আপনারা জানতেন তাতে বক্তার জন্য আমার এই মঙ্গলকামনা আমার নিজের জন্য কতটা জরুরি সেটা বুঝতে পারতেন।        

যাক গে যাক সে সব দুঃখের কথা। আসল কথাটা হলো গিয়ে, সেমিনার হলে কি করে জেগে থাকতে হয় জানেন? আমি তো জানতাম না এতদিন। হলে ঢুকলেই রাজ্যের ঘুম আমার চোখে চলে আসে। বাপরে! চেয়ারে সোজা হয়ে বসে-বেঁকে বসে-ঝুঁকে বসে-চোখ কচলে-জল খেয়ে কিছুতেই আর মস্তিস্কটাকে সজাগ রাখতে পারিনা। আর লাঞ্চব্রেকের পরের সেশন হলে তো আর কথাই নেই। অনেক খুঁজে পেতে শেষে আমি একটা পদ্ধতি বার করেছি সেমিনার হলে ঘুমিয়ে পড়া রুখতে। মাঝে মাঝে ইন্টারেষ্টিং কিছু কথাবার্তা শুনতে পেলে অবশ্য শুনিনা তা নয়, তবে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই স্ক্রীনের দিকে তাকিয়ে থেকে আকাশ-পাতাল চিন্তা করি। নানারকম আকাশ কুসুম কল্পনা করাটা আমার বেস্ট টাইমপাস। আর তার জন্যে বেস্ট জায়গা হচ্ছে আমার মতে সেমিনার হল। আপনাকে কেউ বিরক্ত করার নেই। সবাই আপনারই মতো শোনার ভান করছে। উপরন্তু বক্তার বক্তব্যের একটানা গুনগুনানি দারুন একটা আবহসঙ্গীতের কাজ করে। যত বেশি বোরিং বক্তৃতা তত বেশি আপনি নিজের ভাবনায় ডুবে যেতে পারবেন, যত বেশি আপনার না জানা বিষয় তত বেশি আপনি নিজের সঙ্গে থাকতে পারছেন। সুতরাং আমার যদি গভীর ভাবে কিছু ভাবার থাকে আমি তক্কে তক্কে থাকি সেমিনার হচ্ছে খবর পেলেই হই হই করে বোরিং বক্তৃতা শুনতে ছুটে যাই। বক্তা যখন ডেটা-ফেটা নিয়ে নাস্তানাবুদ, আমি হয়ত তখন ভাবছি, 'আজ রাতে ইচ্ছেখাতায় কি হাবি জাবি গপ্প করা যায়' কিংবা 'পরেরবার বাড়ি গেলে কি কি মাস্ট টু ডু' বা 'কি কি দারুন ইন্টারেষ্টিং খবর পিনাকীকে সাপ্লাই করে দুজনে সন্ধ্যেবেলা খানিক হ্যা হ্যা করা যায়'..........ইত্যাদি ইত্যাদি। তখন আর একটুও ঘুম পায় না বিশ্বাস করুন।

এ তো গেল আমার নিজের পদ্ধতি। সেদিন দেখি সেমিনার হলে ঘুম কাটানো নিয়ে ইন্টারনেটে রীতিমত দারুন সব যুক্তিতে ছয়লাপ। কত কি সব পদ্ধতি। আমার না খুব পছন্দ হয়েছে বিষয়গুলো। আপনাদের একটু শিখিয়ে দি। কাজে লাগবে দেখবেন। বিশেষজ্ঞরা বলছেন-

১. সামনে ঝুঁকে বসুন। পেছনে ঠেস দিলে ঘুমনোর সময় আপনার মুখ হাঁ হয়ে যাবে আর আপনার নাক ডাকতে থাকবে।

২. দেয়ালে ঠেস দেবেন না। ঘুমোতে ঘুমোতে মাথাটা দেয়ালে ঠক করে ঠুকে গেলে আপনার তো লাগবেই সবাই সাথে সাথে আপনার দিকে তাকিয়ে থাকবে আওয়াজে। তখন কি হবে?

৩. সোফা -টোফা দেখে আহ্ললাদিত হয়ে ছুটে গিয়ে বসে পড়বেন না। তাতে ঘুমটা বেশ ভালো হবে আর পাশের লোকের গায়ে ঢলে পড়ে যাবার সম্ভাবনা একশ শতাংশ। তবে সিঙ্গল সোফা হলে আলাদা ব্যাপার।

৪. বেশি নোট ফোট নেব বলে পেন পেন্সিল চাট্টি সঙ্গে করে সেমিনার হলে যাবেন না। ঢুলতে ঢুলতে হাত থেকে পেন্সিল পরে গেলে কিন্তু বড্ড শব্দ হয়।

৫. সম্ভব হলে প্যাডিংওয়ালা চেয়ারে বসুন যাতে চেয়ার শুদ্ধু উল্টে গেলে বেশি শব্দ না হয়।

৬. হঠাত চটকা ভেঙ্গেই চশমা টশমা পরে প্রশ্ন করতে শুরু করে দেবেন না যেন। পুরো পরিস্থিতিটা আগে বুঝে নিন।

৭. এত সব কিছু করেও যদি আপনি হঠাত ঘুম ভেঙ্গে দেখেন সবাই আপনার দিকে তাকিযে হাসছে, তাহলে আর কি করবেন? কমপ্লিমেন্ট হিসাবেই নিন আর কি?

৮. সবথেকে ভালো নৈঃশব্দের শব্দে জেগে উঠতে পারলে। তাহলে ঠিক যখন স্পিকার শেষ করবেন তখনি আপনার ঘুম ভাঙবে। এই ব্যাপারটা খুব কঠিন হলেও খুব উপকারী আমার মতে। দেখুন দেখি চেষ্টা করে পারেন কিনা? আমি তো ডাহা ফেল।

৯. আগের দিন রাতে বেশি ঘুমোবেন না। বেশি ঘুমোলে কিন্তু আরো বেশি ঘুম পায়। এ আমি নিজেকে দিয়ে হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছি।

১০. একই সেমিনার বার বার শুনবার বদভ্যাস আছে নাকি? ত্যাগ করুন, ত্যাগ করুন। একই জিনিস শুনতে শুনতে ঘুমিয়ে পড়ার চান্স সবচেয়ে বেশি।

১১.  অন্য শ্রোতাদের সাথে একই সাথে ঘুমোবেন না please। পালা করে ঘুমোন। সবাই মিলে একসাথে ঘুমলে শুনবে কে? বক্তার জন্য ব্যাপারটা বড় বেশিরকম খারাপ হয়ে যাবে না কি?

১২. কাগজপাতি নিয়ে সেমিনার শুনতে যাবেন না। তাতে আপনি ছাড়া অন্যরা আপনার থেকে নিয়ে আপনার কাগজ পড়বে আর হাত ফেরি হতে হতে শেষে আর জিনিসটা ফেরত আসবে না আপনার কাছে।

এর মধ্যে কোন কোন যুক্তি গুলো আপনার মনে ধরছে দেখুন। যেটা সুবিধা সেটা কাজে লাগান। আমি তো আমার ওই সেমিনার হলে ঘুম পেলেই আবোলতাবোল কল্পনা করার মতন কাজের জিনিস একটাও পেলাম না। আপনারাও প্রয়োগ করে দেখুন।

সেমিনারে ঘুমের দুটো মজার গল্প দিয়ে শেষ করব।

প্রথম গল্পটা এই আমাদের দিল্লির। বিজ্ঞান বিষয়ক আন্তর্জাতিক কনফারেন্স চলছে। সবাই মন দিয়ে শুনছে। বক্তা বিদেশী। কোন দেশীয় ভুলে গেছি। বক্তার গুরুগম্ভীর বক্তব্যের মাঝখানে হঠাত কোনো টেকনিকাল কারণে ইলেকট্রিসিটি failure। স্ক্রিন কালো হয়ে গেছে। সবাই বিব্রত। বিদেশী স্পিকার এদিক ওদিক তাকাচ্ছেন। তার মধ্যে হঠাত সেশনটি পরিচালনা করছিলেন যিনি সেই গণ্য মান্য ভারতীয় বিজ্ঞানীটি ধড়ফড় করে বলে উঠলেন-"Now this session is open for discussion"। অর্থাত সেশনের সব স্পিকারদের সব বক্তব্য বলা হয়ে গেলে পরিচালকের যা বলা উচিত আর কি। ভদ্রলোক পুরো সময়টা ধরে ঝিমোচ্ছিলেন। মাঝে ঘুম এতটাই গভীর হয়ে গেছিল যে এই যে কারেন্ট অফ এর ঘটনাটা উনি টেরই পাননি। হঠাত চটকা ভেঙ্গে দেখেছেন স্ক্রিন কালো। ধরেই নিয়েছেন বক্তব্য শেষ সুতরাং প্রশ্নোত্তর পর্ব শুরু করা যেতে পারে। বুঝুন ব্যাপার। বিদেশী স্পিকার তো ব্যাপার দেখে থ। শেষ অবধি বলেই ফেললেন "Incredible India indeed!!!!!"

আর দ্বিতীয় গল্পটা হলো আমার এক বন্ধু আর তার বাবা কে নিয়ে। বেচারা গিয়েছিল একটি গুরুত্বপূর্ণ কনফারেন্সে লখনৌতে। বাবাও গেছেন সঙ্গে উদ্দেশ্য এই ফাঁকে একটু লখনৌ শহরেরে আনাচে কানাচে ঘোরাফেরা করা। তো খুবই গুরুত্বপূর্ণ বক্তৃতা ছিল নিশ্চয়ই বন্ধু তাই বক্তৃতাটি মিস করতে চায়নি। তাই বাবাকে লখনৌ শহরে একা ছেড়ে না দিয়ে বাবাকে নিয়েই সেমিনার হলে ঢুকেছিল। মনোগত বাসনাটা এরকম ছিল যে, এই বক্তৃতাটা শুনে নিয়েই লাঞ্চ খেয়ে বাবাকে নিয়ে বেরিয়ে পড়বে। সবাই তো মন দিয়ে শুনছে বক্তৃতা। খুব হোমড়াচোমড়়া স্পিকার। ফলে হলে তিল ধারণের জায়গা নেই। গম্ভীর গলায় প্রবীন বিজ্ঞানী বলে চলেছেন। শ্রোতারা মুগ্ধ হয়ে শুনছে। হলে পিন পতনের শব্দ শোনা যাবে। এমন সময় "আ আ আ ...খা খা" করে একটা শব্দ হলো। সবাই এদিক ওদিক তাকাচ্ছে। কি রে বাবা? নামজাদা প্রবীন বিজ্ঞানী থমকেছেন। কেউ কি তার এই স্বতসিদ্ধ প্রমানের বিপক্ষে? নাকি কোনো প্রশ্ন আছে? নাকি তাঁর বক্তব্য একঘেয়ে লাগছে কারো? এমন সময় আবার। "আ আ আ ...খা খা খা ", এবারে আর একটু জোরে। এতক্ষণে বোঝা গেছে কে সেই ব্যক্তি? যিনি হিউমান জেনেটিক্স এর প্রবাদপ্রতিম বিজ্ঞানীকে বক্তব্যের মাঝে থামিয়ে দেবার ক্ষমতা রাখেন। সবাই মুগ্ধ হয়ে শুনলেও একজন কিন্তু বোর হচ্ছিলেন। আমার ওই বন্ধুর বাবা। কারণ তিনি বিষয়টির আদ্যোপান্ত কিছু বোঝেন না। কতক্ষণ আর এদিক ওদিক তাকিয়ে, কান চুলকে, মাথা চুলকে, নখ পরিদর্শন করে সময় কাটানো যায়? বিশেষ করে এই লাঞ্চের আগে খিদে পেটে নিয়ে? স্বভাবতই ঘুম পেয়ে যাচ্ছিল। তাই তিনি ওই অদ্ভূত শব্দ করে হাই তুলে ফেলেছিলেন। বন্ধু তো পারলে চেয়ারের তলার ঢুকে আশ্রয় নেয়, তাকাচ্ছে না ওঁনার দিকে। যেন চেনেই না। বাড়িতে ওই ভাবেই হাই তুলে তুলে অভ্যাস খারাপ হয়ে গেছে, ভুল করে বাড়ি ভেবেই বোধহয় শব্দটা করে ফেলেছিলেন। সঙ্গে সঙ্গে তিনি অবশ্য নিজের ভুল বুঝতে পেরেছিলেন কিন্তু ততক্ষণে যা হবার তা হয়ে গেছে।

আপনাদের পরিশেষে বলে রাখি, আমার এই দ্বিতীয় গল্পটিতে যে বন্ধুটির বাবার কথা বললাম তার নাম- পিনাকী। অর্থাত গল্পটির নায়ক হলেন আমার বাপি। অর্থাত কিনা আমার আদরের শ্বশুরমশাই। 

0 comments:

Post a Comment