Monday, 14 July 2014

হলুদ আলোর বৃত্ত

একটু দূর থেকে আসছিল হলদেটে আলোটা
উত্সমুখে আলোটার ঔজ্জ্বল্য যদিও ছিল চোখে পড়ার মতো,
কিন্তু রাতের অন্ধকারে সবুজ জঙ্গলের ওপর দূরের ওই হলদে আলো
কেবলমাত্র একটা আবছায়া সৃষ্টি করছিল মাত্র।
মাঝখানে দাঁড়িয়ে তিনতলার ঝুলবারান্দা থেকে আমি দেখতে পাচ্ছিলাম দুটো দিকই
ডানদিকের চকচকে উজ্জ্বল হলুদ আলোর স্তম্ভ,
এবং তার সাথে সাথে বামদিকের আবছায়া জঙ্গল।

মধ্যরাতের নিঝুমতার সাথে তাল মিলিয়ে নিশ্চুপ ছিল চরাচর।
এমনকি জঙ্গলের দিক থেকে ভেসে আসছিল না কোনো রাতজাগা পাখির আর্তনাদও
ডানদিকে আলোক স্তম্ভের ঠিক নিচেই দেখছিলাম রাত প্রহরার দায়িত্বে থাকা মধ্য চল্লিশের লোকটিকে
কি অদ্ভূত ভাবে দুই পা ছড়িয়ে এলিয়ে দিয়েছে শরীর, প্রায় ভেঙ্গে আসা চেয়ারটির ওপর
যাতায়াতে দেখেছি চেয়ারটাকে, কোনো এককালে লাল রং ছিল
আজ আর চেনা যায় না, কালচে-ধূসর ময়লাটে
আধভাঙ্গা হাতলদুটোর পাশ দিয়ে ঝুলছিল দুটো হাত, শিরাওঠা।
পাশে কোনক্রমে ঠেকনা দিয়ে রাখা রাত প্রহরীর একমাত্র আত্মরক্ষার অস্ত্র,
লম্বা তেল চুকচুকে একটা লাঠি, সঙ্গে একটা টর্চ।

প্রতি রাতেই বদলে যায় রাতপ্রহরী
বদলায় না শুধু রাত-প্রহরার এই নগন্য সরঞ্জাম।
সেই এক আধভাঙ্গা চেয়ার, তেলতেলে লাঠি আর টর্চ।
মাঝরাতে ঘুমের মধ্যে মাঝে মাঝে লাঠির আওয়াজ পাই কনক্রিটের ওপর।
শুনেছি এই জঙ্গলে নাকি আছে ছোটখাটো হিংস্র জন্তুও
মানুষের ওপর আক্রমনের বদনাম তাদের না থাকলেও, তাদের নিরীহ জীবনযাপনই
এই ছোট্ট পাঁচিল ঘেরা জায়গাটির বড় বড় মানুষজনকে জুজু দেখানোর পক্ষে যথেষ্ট।
এসব জানা সত্বেও লোকটি বসে আছে জঙ্গলের দিকে পিঠ ফিরিয়ে,
টুকটাক আলো জ্বলা আমাদের এই পাঁচিল ঘেরা মানুষজনের দিকে মুখ করে।
যদিও সে ঘুমোচ্ছে কিন্তু তাও চটকা ভাঙ্গলে প্রথম তাকাবে সে জঙ্গলের উল্টো দিকেই।

হঠাত কেমন একটা অদ্ভুত নির্দয় চিন্তা খেলে গেল মাথার মধ্যে
হয়ত নিশ্চুপ রাতের মাদকতায় এমনি ভাবেই জেগে ওঠে অপরাধপ্রবণতা-পাশববৃত্তি, জানিনা।
কল্পনায় মনে হলো, এই নিথর বাতাসহীন রাতে-
আবছায়া জঙ্গল থেকে ধীরে ধীরে বেরিয়ে আসছে কোনো শ্বাপদ।
গুঁড়ি মেরে এগিয়ে চলেছে চেয়ারে এলিয়ে পড়া তার নিশ্চিত শিকারের দিকে।
ঠিক যেমন করে দেখেছি গৃহস্থ বিড়ালকে অসতর্ক কোনো ছোট্ট চড়ুইয়ের দিকে এগিয়ে যেতে।
এই মুহুর্তে আমি ছাড়া কোনো সাক্ষী নেই এই নির্মম খাদ্যান্বেষণের।
মনে হলো এরকম হলে আমি ঠিক কি করতে পারি?
চিত্কার করে লোকটিকে সতর্ক করাটা আমার সহজাত কর্তব্য।
হয়ত আমার মনুষ্যসত্তা তাই করবেও।
কিন্তু সেই অভিশপ্ত মুহুর্তে, মনের পাশবসত্তা যদি সেই চিত্কারটুকু করতে না দেয়?
যদি মনে হয়, দেখিই না কেমন করে সম্পাদিত হত পৃথিবীর আদিমতম প্রবৃত্তি
যদি মনে হয়, দেখিই না কেমন করে আজীবন ঘুরে চলেছে খাদ্য খাদকের চক্র।

কয়েক মুহুর্তের জন্য রুদ্ধ হয়ে এল নিশ্বাস
মনে হলো চিত্কার করে বলি লোকটিকে-
'ভাই, দোহাই তোমার সজাগ থাক, পেছনে তাকাও।'
কিন্তু নিথর জঙ্গলের পাশে,
হলুদ আলোর বৃত্তকে লক্ষণরেখা করে নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে থাকা সেই রাতপ্রহরীকে বলিনি কিছুই।
কয়েকটি রুদ্ধশ্বাস মুহুর্তের পর স্বস্তির শ্বাস নিয়ে ফিরে এসেছিলাম ঘরে।
নিশ্চিন্ত হয়ে।

নীরবতা, রাতের আকাশ আর সেই হলুদ আলোর আবছায়া জঙ্গলের মায়ায়-
ঘোর লেগে যাওয়া নিথর পৃথিবী বোধহয় আমায় নিশ্চিন্ত করেছিল তখন,
বলেছিল, বিপদ যতটুকু তা সবই ওই পাঁচিল ঘেরা মানুষজনের দিক থেকে।
জঙ্গলের শ্বাপদের সাহস নেই এই হলুদ আলোর বৃত্তকে পার করার।
তাই তো প্রহরা ও প্রহরী দুজনের মুখ কেবল উল্টোদিকেই।

পরম নিশ্চিন্ততায় কেবল একটি লাঠিমাত্র সম্বল করে রাতের আবছায়া জঙ্গলকে পিঠের দিকে নিয়ে
অবলীলায় ভাঙ্গা চেয়ারেই এলিয়ে ঘুমোতে থাকে সেদিনকার রাতের প্রহরী।    

0 comments:

Post a Comment