Wednesday, 9 July 2014

নেটওয়ার্ক

বাব্বা বাঁচলাম। সারাদিন আধমরা হয়ে ছিলাম। আমাদের বাড়িতে আগে কোনো ঝড়-বৃষ্টিতে ইলেকট্রিক কানেকশন প্রায় দুই আড়াই দিনের জন্য থাকত না মাঝে মাঝে। পশ্চিমবাংলার গন্ডগ্রামের ইলেকট্রিক কানেকশন নিয়ে আর কে আর ব্যস্ত কবে? সে যাই হোক, দুই-আড়াই দিন পরে যখন কারেন্ট আসত তখন যেরকম সকলের মুখ থেকে 'আহ' টা বেরিয়ে আসত, একটু আগে যখন শুনলাম "এই, ইন্টারনেট কানেকশন এসেছে রে" তখন ঠিক সেই 'আহ' টাই  বেরিয়ে এল মুখ দিয়ে। মনে হলো যেন মধ্য যুগ থেকে রেনেসাঁ যুগে পদার্পণ করলাম। কাল রাত থেকে আজ সারাদিন ইন্টারনেট কানেকশন ছিল না আমাদের ইনস্টিটিউটে।

প্রতি পদে বুঝতে পারছিলাম আমরা সারাদিন ইন্টারনেট ছাড়া কতটুকু সময় কাটাই। টেরটা পেলাম সকালেই। ঘুম থেকে উঠেই ঢুলতে ঢুলতে গুগল ক্রোমে ক্লিক করে দেখি সে ব্যাটা ঘুরেই চলে, ঘুরেই চলে। আধঘুমন্ত অবস্থায় বেশ কয়েকবার চেষ্টা করে করে শেষে ঘুমটা খানিক কাটতে ভালো করে দেখি- ও হরি! মেন কানেকশনটাই তো নেই। কি হবে এবার? না হলো ফেসবুকে রাজ্যের লোকের সকালবেলাকার খবর নেওয়া, না হলো মমতা-মোদীর রিসেন্ট আপডেট নেওয়া। বৃথা গেল সকালটা। বেজার মুখ করে ল্যাবে গেলাম এই আশায় যে কিছুক্ষণ পরেই নিশ্চয়ই ঠিক হয়ে যাবে। নইলে ভারত সরকারের এতগুলি রতনকে এত পয়সা দিয়ে নাকি কি কি সব জটিল বিষয়ে গবেষণা করতে বলা হয়েছে, তাদের মহা মূল্যবান গবেষণা চলবে কি করে? কিন্তু না। প্রতি মিনিটে মিনিটে সাধাসাধি করেও নেট দেবীর দয়া হলো না। দুপুরের দিকে শুনলাম নাকি কোথায় তার-ফার কেটে কুটে একশা কান্ড। সময় লাগবে। তখন আমি নিশ্চিন্ত হয়ে গল্পের বই এর পিডিএফ খুলে বসলাম। আর প্রতি সেকেন্ডে মনে মনে "আরে এই বইটা আমার কাছে আছে!"......"ওহ, এটাও আছে?"......."এটা আবার কার biography?"......"ওহো, এটা ডাউনলোড করেছিলাম না? ইশ,পড়া হয়নি, পড়তে হবে"......এরকম সব মন্তব্য করতে থাকলাম। দেখলাম কত কত বই আমি কোনো একসময় ডাউনলোড করেছি পড়ব বলে। অর্ধেকও পড়িনি। কারণ নেট থেকে মুখ তোলার সময় পাইনি। ভাগ্যিস আজ নেট নেই, তাই অন্ততঃ খুলে দেখলাম তো।

ভাবছিলাম নেট না থাকে আজ কি কি নতুন কাজ করেছি। সকালে উঠে চা খেতে খেতে মোবাইলে খবরের কাগজ পড়ার বদলে আজ পি-এন-পি-সি করেছি দুজনে। ল্যাবে এসে ফেসবুক, আরো নানা হাবিজাবি সাইটে ঘুরে না বেরিয়ে আজ আগে থেকে ডাউনলোড করা দুটো মারাত্মক ভালো রিভিউ আর্টিকেল পড়েছি। ল্যাবের দুজন বন্ধুর সাথে প্রাণ খুলে আড্ডা মেরেছি। অন্যদিন যে যার কাজ করি- মানে যে যার ল্যাপটপের স্ক্রীনের দিকে অখন্ড মনোযোগে তাকিয়ে থাকি। কাজ কর্মও বেজার মুখে খানিকটা করতে হয়েছে। ল্যাপটপ মুখে ছদ্ম ব্যস্ততার সুযোগ কম ছিল তো আজ। সন্ধ্যে বেলা কাজ সেরে বাড়ি ফিরে ভদ্র মানুষের মত চাট্টি রান্নাবান্না করেছি। রাত দশটার সময় আঙ্গুল কামড়ে ভাবতে হয়নি, 'কি খাওয়া যায়?' কারণ অন্য দিনের মত বাড়ি ফিরে জামাকাপড় বদলেই দুজনে দুটো ল্যাপটপে মুখ গুঁজে বসে যাবার মতো আকর্ষণ ছিল না আজ। উপরি পাওনা হিসাবে দারুন একটা মন্তব্য শুনবার সুযোগ হলো এই মওকায়। মাস্টারমশাই দিদিমনিরা যে কোনো কারণেই হোক আজ তাড়াতাড়ি বাড়ি চলে গেছেন। তাই ছাত্রছাত্রীরাও তাড়াতাড়ি দোকান বন্ধ করে ব্যাগ গুছিয়ে বাড়ি যাচ্ছিল। আর সবাই সাধারণত যা করে থাকে তাই করছিল অর্থাত বসের নামে খানিক নির্দোষ নিন্দেমন্দ করছিল আর কি। তার খানিকটা অনিচ্ছা সত্বেও আমার কানে এসেছে গেছে। চুপি চুপি বলছি আপনাদের।
--"আজ এত তাড়াতাড়ি চলে গেছেন?"
--"নেট নেই তো। কি করবে?"
--"আরে কিই বা করে নেটে? ফেসবুক টুক ও নেই।"
--"আনন্দবাজার পড়ে।"
--"আরে কতক্ষণ আনন্দবাজার পড়বে?"
--"আরো কি সব করে বসে বসে।"
.
.
.
বুঝলাম একজন সায়েন্টিস্ট এবং তার ছাত্রছাত্রীদের নেট থাকলে সারাদিনে কি কি করা সম্ভব। আমিও এগুলোই করি সঙ্গে একটু আধটু অনলাইন শপিং টপিং ও মন দিয়ে করে থাকি আর কি। সেটা বলতে ওরা ভুলে গেছিল.......হেঁ হেঁ ।

যাই হোক এই রাতদুপুরে নেট আসতে একটু ফেসবুক করে বাঁচি। ঝপাঝপ সারাদিনের পেন্ডিং কাজ যথা, আগের দিনের বাসী সিরিয়ালের গুরুত্বপূর্ণ সব প্যানপানানি দেখে ফেলেছি। রাজ্যের লোকের খবর খবর নিয়ে ফেলেছি। এবং চিন্ময় চট্টোপাধ্যায় এর গলায় "বিধি ডাগর আঁখি" গানটা পরের পর চার বার শুনে সঞ্জীবিত হয়ে আজকের অভিজ্ঞতা নিয়ে এই বোরিং ব্লগ পোস্টটা লিখে ফেলেছি। ভাবছিলাম নেট না থাকলে কি হত! বাপরে।

এই পর্যন্তই লিখেই শেষ করতে পারতাম, কিন্তু কাল একটা খবর শুনে পর্যন্ত আমি মাথা থেকে কিছুতেই বের করতে পারছি না। কোনো ভনিতা না করে কেন এই কথাটি এখানে বলছি হয়ত পড়লে বুঝবেন।

কাল আমার এক অত্যন্ত শ্রদ্ধেয় স্কুলের সময়কার মাস্টারমশাইকে ফোন করেছিলাম। এমনিই। উনি বললেন খবরটা। মাস্টারমশায়ের আর এক প্রিয় ছাত্রী এবং আমার খুব কাছের বান্ধবী, মোবাইলে তার মায়ের সাথে গল্প করছিল। সেসময় তার এক বছর তিন মাসের ছোট্ট ফুটফুটে মেয়েটি আশেপাশেই ঘুর ঘুর করছিল টিভির কাছাকাছি। হঠাত কোনো ভাবে টিভির টেবিলসহ টিভিটি ওই ছোট্ট দেহের ওপর পড়ে যায়। পুরনো ভারী টেবিল ও পুরনো ভারী টিভি।

বাচ্চাটি হাসপাতালে পৌঁছানোর আগেই মারা যায়।

এই ঘটনাটির মর্মান্তিকতা কি সেটা আপনারাই বলবেন। আমি শুধু কাল থেকে ভাবছি, ভগবান! কত কারণেই তো মোবাইল এ নেটওয়ার্ক থাকে না। ওই দিনটাও তো মোবাইল এ নেটওয়ার্কটা না থাকতে পারত। তাহলে হয়ত বাচ্চাটির মা তাকে আর একটু বেশি খেয়াল করতে পারত।    

0 comments:

Post a Comment