Monday, 21 July 2014

ছুটির দুপুর আর বারান্দায় রোদ্দুর


রবিবার দুপুরে আমি এই ছবিটি তুলেছি। এটি আমাদের তিনটি ব্যালকনির একটি। অনেকদিন পর ছুটির দুপুরে বারান্দার ফাঁক দিয়ে আসা এই রোদ্দুর আমাকে একধাক্কায় নিয়ে গিয়ে ফেলল আমার ছোটবেলাকার দোতলার বারান্দায়। আমার নিজের বাড়িটা জানেন গ্রামের দোতলা মাটির বাড়ি। এখনো। যদিও এখন সেই বাড়িতে অনেক পরিবর্তন ও পরিবর্ধন হয়েছে। কিন্তু মূল বাড়ির কাঠামোটি একই আছে। আমি যখন ক্লাস ফাইভ-এ পড়ি তখন বাড়ির একটা অংশ ভেঙ্গেচুরে নতুন করে ইঁট-সিমেন্ট দিয়ে ছাদ ঢালাই করা হয়। মাটির দোতলার বারান্দার অংশটুকুও তার সাথে সাথে ভেঙ্গে ছাদের সাথে মিশিয়ে দেওয়া হয়। ফলে বিষয়টা এখন যা দাঁড়িয়েছে তা হলো আমাদের মূল বাড়িটুকু অর্থাত শোবার ঘরগুলি বর্তমানে মাটির দেওয়াল-ওপরে মাটির পাটাতন-তার ওপরে দোতলার মাটির ঘর-তার ওপরে টিনের ছাউনি। দোতলার বারান্দা আর ছাদ পাকা ইঁটের। বাড়ির বাদ বাকি অংশ মানে ঠাকুরঘর, রান্নাঘর, টেনিস কোর্টের সাইজের উঠোন, এক্স্ট্রা আরো দুচারটি ঘর, উঠোন ও বাগান ঘেরা পাঁচিল সবই পাকা। হয়ত আমার বাবা চাইলে উপর ও নিচের ঘর চারটিকেও ভেঙ্গে কাঁচা থেকে পাকা করে নিতে পারতেন, তাতে তাঁর বাড়ি সংরক্ষণ ও মায়ের বাড়ি পরিস্কার দুটোরই সুবিধা হত। কিন্তু তৈরী ঘর ভেঙ্গে দেওয়ার হ্যাপা, যথাসময়ে যথেষ্ট পয়সাকড়ির অভাব এইসব কারণে হয়ত ভাঙ্গাটা হয়ে ওঠেনি। একটা সময় পর্যন্ত পাকা ঘরে থাকার একটা লোভ যে ছিল না তা বলব না। কিন্তু এখন মনে মনে ভাবি, ভাঙ্গা যে হয়নি ভালই হয়েছে। কারণ, বাবার ছোটোবেলা-বড়বেলা সবই ওই বাড়িতে। তাঁর মা বাবা দাদা দিদির বিশাল একান্নবর্তী পরিবারের সমস্ত স্মৃতিই তো এই বাড়ি জুড়ে। আগেকার বাড়ির একটা অংশ শুনেছি ১৯৭৮ সালের বন্যায় ভেঙ্গে পড়ে গেছিল-যে জায়গাতে এখন বাগান। বাকিটা পরিবর্তিত হতে হতে ক্রমশঃ নতুন রূপ পেয়েছে। সুতরাং বাবার স্মৃতির বাড়ির অবশিষ্টাংশ বলতে এখন ওই মাটির চারটি ঘর। কত কত বছর কেবলমাত্র মা ও বাবা ছাড়া ওই বাড়িতে কেউ না থাকা সত্বেও প্রতিটা ঘর এখনো তাঁর কাছে 'মায়ের ঘর'-'বড়দার ঘর'-'দাদার ঘর' বা 'সেজদার ঘর'। আমার এখন মনে হয় ওই ঘরগুলিও না থাকলে বোধহয় বাবা তাঁর ছোটবেলা-তাঁর মূল জীবনটিকেই হারিয়ে ফেলতেন। যাঁরা নানা কারণে মূল বাড়ি থেকে বেরিয়ে এসে নতুন বাড়ি বানিয়ে থাকেন তাঁদের আবেগ অনেকাংশেই দ্বিখন্ডিত হয়ে যায়। কিছুটা পড়ে থাকে জন্মভিটে যেখানে তাঁদের ছোটবেলা কেটেছে তার কাছে, কিছুটা তাঁদের রক্ত জল করা পয়সায় বানানো নতুন বাড়ির কাছে। প্রথমটি বাবা মা কে ভালবাসার মতো, যাঁদের কাছে পা ছড়িয়ে বসে আবদার করা যায়। আর দ্বিতীয়টি নিজের সন্তানকে ভালবাসার মত, যাকে নিজের হাতে তিল তিল করে তৈরী করে তার গায়ে লাগা প্রতিটা ধুলোর কণাও ঝেড়ে পরিস্কার করে দিতে ইচ্ছে করে। বাবার ক্ষেত্রে দ্বিতীয়টি হয়নি, তাঁর আবেগ-নস্টালজিয়া-সুখ দুঃখের সমস্ত স্মৃতিই এই বাড়ি জুড়ে। তাই পুরো বাড়ির মধ্যে মাটি দিয়ে বানানো পুরনো এই কটি ঘর শুধু বাবা নয় আমার অন্যান্য জ্যেঠুমনি-পিসিমাদের জন্যও হয়ত বড় আদরের-বড় আপনার ছিল। এখনো আছে। যার টানেই হয়ত বড়-মেজ বা সেজ জেঠুমনিরা বৃদ্ধ বয়সে কলকাতার সমস্ত সুখস্বাচ্ছন্দযুক্ত নতুন বাড়িতে বসেও মৃত্যুর আগে পর্যন্ত একবার এই বাড়িটাতে আসতে চেয়েছিলেন। দুর্ভাগ্যবশতঃ অসুস্থতার কারণে কেউই তাঁদের সেই ছোটোবেলার স্মৃতিটুকু ফিরিয়ে দিতে পারেনি। এজন্য মনে হয়, আমার বাবার জন্য এই ধুলো পড়া মাটির বাড়িরটুকুর টিকে থাকাটা বড় জরুরি। নইলে এই বাড়ি সংলগ্ন তাঁর পুরো ছোটোবেলাটাই হয়ত বেমালুম হাওয়া হয়ে যাবে। 

অনেকদিন পর্যন্তও এভাবে ভাবতাম না। অনেকদিন বাড়িতে না থাকার কারণেই হোক বা বয়স বাড়ার কারণেই হোক নিজের ছেলেবেলাটা কোথাও যেন তেমন করে খুঁজে পাই না। তাই নিজেকে দিয়েই বুঝতে পারি যে ছোটবেলাকার বাড়িটা বড় হয়ে যাবার পর কেন মানুষের এত কাছের হয়ে পড়ে। দোতলার পুরনো মাটির বারান্দাটা যখন ভেঙ্গে পাকা করে নিয়ে ঠাকুরঘর আর রান্নাঘরের ছাদের সাথে মিশিয়ে দেওয়া হলো তখন আমার ক্লাস ফাইভ।ছেলেবেলাটা তখনও ফুরোয়নি। তাই তেমন করে বুঝিনি কিছুই। কিন্তু পরে ওই বারান্দার লোহার রড দেওয়া সবুজ রঙের কাঠের ফ্রেমের রেলিং, শীতের দুপুরে রেলিঙে পিঠ দিয়ে গল্পের বই পড়া, বর্ষায় ওই বারান্দায় দাঁড়িয়ে টিনের চালে বৃষ্টি দেখা এসবের জন্য মাঝে মাঝে বড় কষ্ট হত। তাই বোধহয় এখন মনে হয় আমাদের ওই মাটির চারটে ঘর অন্ততঃ বাবার জন্য বড় বেশিরকম জরুরি।

দোতলার ওই বারান্দাটাকে আমি খুব ভালোবাসতাম জানেন। যেহেতু আমি, মা আর বাবা এই আড়াই জনের জন্য উপরের ঘর দুটো প্রতিদিন খোলার দরকার হত না, নিচের দুটো ঘরেই হয়ে যেত। তাই উপরের দুটি ঘর বছরের বেশির ভাগ সময়টাই চাবি দেওয়া থাকত। স্বভাবতই মা-বাবারও ওপরে আসা যাওয়ার বিশেষ দরকার পড়ত না। ফলে দোতলার ওই রেলিং দেওয়া মাটির বারান্দাটা সম্পূর্ণ আমার একার একান্ত নিজস্ব এলাকা হয়ে গেছিল। ওই বারান্দার সাথে যে আমার কত স্মৃতি জড়িয়ে তা বলার নয়। পরে ওই রেলিংহীন ন্যাড়া বারান্দা যা কিনা প্রায় ছাদের একটা অংশই হয়ে গেছিল তার সাথে ঠিক তেমন করে আর আমার বন্ধুত্ত্ব হয়ে ওঠেনি। রুমার কথা তো আগেই বলেছি, সেই রুমার সাথে ঝগড়া হলে বিকেলে খেলতে না গিয়ে দোতলার বারান্দায় রেলিঙে চড়ে বসে সারা বিকেল পা দুলিয়েছি আর পরদিন কি করে রুমার সাথে ভাব করা যায় তার যুক্তি করেছি মনে মনে। আবার ফেলে দেওয়া প্যাকিং কেস আর ঝ্যাঁটার কাঠি দিয়ে ঘর বানিয়ে পুতুল খেলেছি ওই বারান্দার কোণে রুমার সাথেই। চুরি করে গুঁড়ো দুধ খাওয়াই হোক বা নিচের এক আলমারি ভর্তি গল্পের বইয়ের মধ্যে থেকে বেছে বেছে বড়দের জন্য নির্দিষ্ট একটি বই বের করে নিয়ে চুপি চুপি পড়ে ফেলাই হোক সব নিষিদ্ধ কাজের জন্যই আমার নির্দিষ্ট ছিল ওই রেলিং ঘেরা মাটির বারান্দা। ওই বারান্দাতেই মনে আছে একবার একবাড়ি ভর্তি লোকজনের একসাথে সবাই মিলে চলে যাওয়া রুখতে গড়াগড়ি করে কেঁদেছিলাম। এবং বাড়ির ক্ষুদ্রতম সদস্যের প্রবল কান্নাকাটিতে গলে গিয়ে জেঠু-পিসি-দাদা-দিদি সবাই সেদিন যাওয়া ক্যানসেল করে বাসস্ট্যান্ড থেকে ফিরে এসেছিল। আবার বাবা বা মায়ের কাছে চড়-চাপাটি বা উত্তাল বকাঝকা খেলেও ওই বারান্দাতেই গিয়ে রেলিঙে উঠে পা ঝুলিয়ে বসে কাঁদতাম। বারান্দাটা ছিল আমার খেলার, নিষিদ্ধকে ছোঁয়ার, মন খারাপের, এককথায় আমার সমগ্র বড় হয়ে ওঠার একান্ত নিজস্ব সঙ্গী। 

বর্ষাকালে বারান্দাটাকে ছই বা ত্রিপল দিয়ে ঢেকে দেওয়া হত। কারণ নইলে বৃষ্টির ছাঁটে মাটির বারান্দা থেকে সব মাটি ধুয়ে যেত। ওই সময়টা মনে আছে আমার বড় মনখারাপ হত। কারণ ওই কয় মাস আমি রেলিঙে উঠে বসতে পারব না, বারান্দা অন্ধকার হয়ে যাওয়ায় বসে বই পড়তে পারব না। আমি তখন বৃষ্টি পড়লে বারান্দার ছই বা ত্রিপলের বাঁধন কোথাও কিছুটা খুলে ফাঁক-ফোঁকর দিয়ে টিনের চালে বৃষ্টি পড়া দেখতাম মনে পড়ে। কালিপুজোর দিন রেলিঙে মোমবাতি দিয়ে সাজাতাম আর পরদিন সেই মোমের গলেপড়া জমে থাকা অংশ খুঁটে খুঁটে তুলে আনতাম। কাঠের রেলিং থেকে সহজেই উঠে আসত মোম। পরে বালি-সিমেন্টের খরখরে ছাদের আলসে থেকে আর ঐভাবে মোম খুলে আসত না।  সেই থেকেই বোধহয় কালিপুজোর পরদিন ওই মোম খুঁটে তোলার উত্সাহটাই আমি হারিয়ে ফেলেছিলাম। শীতকালে দুপুরে মা একটা ছোট্ট মাদুর নিয়ে ওপরে বারান্দায় রোদে শুতে যেত। ছুটির দিনে আমি মায়ের সঙ্গী। একটা স্মৃতি খুব জ্বলজ্বলে এখনো আমার কাছে। শীতকালে তখন রাজ্যভিত্তিক বিজ্ঞান প্রদর্শনী ও প্রতিযোগিতা বলে একটা সপ্তাহব্যাপী অনুষ্ঠান হত আমাদের গ্রামে। দূর্গাপুজো ছাড়া ওই এলাকার সবচেয়ে বেশি উত্সাহ উদ্দীপনা থাকত এটি নিয়ে। তাতে নানা বয়সের প্রতিযোগীদের জন্য গণসঙ্গীত, বিতর্ক, তাত্ক্ষণিক বক্তৃতা, একাঙ্ক নাটক, কুইজ, ছবি আঁকা, ছোটখাটো বিজ্ঞানভিত্তিক মডেল প্রদর্শনী ইত্যাদি নানান প্রতিযোগীতা থাকত। সব কিছুরই বিষয় বিজ্ঞান বা সমাজসংস্কার। এরকমই একবার বাচ্চাদের বিভাগের বসে আঁকো প্রতিযোগিতার বিষয়বস্তু ছিল সাক্ষরতা অভিযান। মনে আছে আমি আঁকার মাস্টারমশাই তথা আমার জ্যাঠতুতো দাদার কাছে শিখে আসা ছবি বাড়িতে এসে ওই বারান্দায় শীতের রোদে পিঠ দিয়ে বসে মায়ের তত্বাবধানে অভ্যেস করছি আর মা আমার একের পর এক ভুল ধরে চলেছে। দুপুর শেষ হয়ে ক্রমশঃ বিকেল হয়ে চলেছে আর বারান্দায় রেলিঙের লোহার রডগুলোর ছায়া ক্রমশঃ লম্বা হয়ে চলেছে। এত চকচকে এই ছবিটা আমার মনে যে বারান্দা-ছুটির দুপুর আর রোদ্দুর বলতে আমার সবার প্রথমেই এই দৃশ্যটাই মনে পড়ে।  

তাই বাড়ি থেকে এত দূরে এসে সরকারী কোয়ার্টারের অস্থায়ী বাসস্থানের এই বারান্দার ইঁটের ফাঁক দিয়ে আসা রোদ্দুর যেন একপলকেই মনে করিয়ে দিলো মন জুড়ে বসা একবারান্দা ভর্তি রোদ্দুর আর সেই রেলিং ঘেরা আমার সমস্ত ছেলেবেলাটাকেই। যা কিনা কতদিন আগে আমার ক্লাস ফাইভে পড়া দশ-এগারো বছরের মনটাকে নিয়ে আমায় কিচ্ছুটি না বলে কোথায় যেন নিরুদ্দেশ হয়ে গেছে। হাজার চেষ্টাতেও যাকে আর চেপে ধরতে পারবনা কোনদিন।কক্ষনো।   

0 comments:

Post a Comment