Saturday, 12 December 2015

আটপৌরে

আটপৌরে কথাটা প্রথম শিখি মায়ের শাড়ী পরা থেকে। আমার মা বাড়িতে 'আটপৌরে করে' শাড়ী পরে। ছোটবেলা থেকেই দেখতাম  কোথাও বেরোতে গেলে সেই শাড়ীতে কেমন করে যেন গজিয়ে উঠতো বেশ কয়েকটা কুঁচি। আর বাঁদিক এর কাঁধ থেকে ভাঁজ খেয়ে উঠে যাওয়া মাথার অর্ধেকটা চাপা দেওয়া ঘোমটাটা ডানদিকের কনুই পর্যন্ত এসে থমকে গেছে। অর্থাৎ সাধারণত ভারতীয় মহিলারা যে কয়জন এখনো শাড়ী পরেন তাঁদের সিংহভাগ এখনো যেভাবে পরেন আর কি। আর বাড়িতে থাকলে মায়ের ওই কুঁচিটা বেমালুম উধাও হয়ে যায়। আর সেই বাবদ বেঁচে যাওয়া কাপড়টা কয়েকপাক এদিক ওদিক ঘুরে সোজা বাঁকাঁধে। সেখানে থেকে আর ভাঁজ খেয়ে ঘোমটা আকারে মাথায় না উঠে বাঁদিকের পিঠ বেয়ে ডান হাতের তলা দিয়ে পাক খেয়ে আবার বাঁকাঁধে। এইটি হলো 'আটপৌরে করে শাড়ী পরা।' আটপৌরে শব্দটি আমার শেখা এখান থেকেই। ফলত এই শব্দটার সঙ্গে একটা যেমনতেমন করে থাকা বা নিজের প্রতি যত্ন না নিয়ে যাহোক করে কোনো কিছু করার একটা সংযোগ আমার মনে গেঁথে গেছিল ছোটো বয়সে। মনে আছে মাকে আমি অনেকবার বলেছি ছোটবেলায় যে কাকিমার (আমার বন্ধু রুমার মা) মতন করে শাড়ী পড়তে পারো না? মা বলত কেন পরি তো বাইরে গেলে। আমার তর্ক ছিল-'কেন? কাকিমা তো বাড়িতেও ওরকম করে পরে, তুমিও পরবে।' মায়ের যুক্তি ছিল-'এই তো বেশ আছি', বা -'এরকম করে পরে আরাম', বা 'জ্যাঠিমাদের দেখেছিস কখনো বাড়িতে ওরকম করে শাড়ী পড়তে' (আমার জ্যাঠিমারা সকলেই মায়ের মত ফর্মুলায় বা বলা ভালো মা জ্যাঠিমাদের মত একই ফর্মুলায় বাড়ি এবং বাইরের শাড়ী পরার পদ্ধতি অনুসরণ করতেন/করেন।)? কোনটিই বিশেষ জোরালো যুক্তি নয়। সুতরাং ওসব যুক্তি আমার কাছে বিশেষ গ্রাহ্য হত না। কেবলই মনে হতো শাড়ী পরার ধরনের সঙ্গে সঙ্গে মা-টিও এই বুঝি বাকিদের থেকে আটপৌরে হয়ে গেল।  হলেও যে বিশেষ লাভ ক্ষতি নেই সে হিসেব বোঝার বয়স তখন আমার হয়নি। মোদ্দাকথা 'আটপৌরে' শব্দটিই এমন একটি চোখে না পড়া-যেমনতেমন-হালকা গুরুত্বহীন চেহারা নিয়ে আমার কাছে এসেছিল যে, সেই আমির পক্ষে মাকে আটপৌরের বাঁধন থেকে উদ্ধার না করলেই চলছিল না। সুতরাং সেই এক বিষয় নিয়ে মাঝে মাঝেই ঘ্যানঘ্যান করতে থাকতাম। আর মাও মেজাজ-মর্জি অনুযায়ী কখনো মুচকি হেসে কখনো এক ধমকে আমায় থামিয়ে দিত। তারপর স্কুলের শেষের দিকে কোনো এক বিয়ে বাড়িতে দেখলাম কনের খুব কাছের একজন মহিলা অত্যন্ত মহার্ঘ্য একটি শাড়ী আমার মায়ের বাড়িতে পরা সেই সাধারণ- যেমন তেমন-নজরে না পড়া শাড়ীপরার ধরণে পরেছেন, এবং বিয়েবাড়ি শুদ্ধু ফ্যাশনে অভিজ্ঞ মহিলাকুল তাঁকে উচ্চপ্রশংসা করছেন। সম্ভবত সেদিন থেকেই মায়ের শাড়ী পরা নিয়ে আমার অভিযোগ কমতে থাকলো। আর তারপর আস্তে আস্তে বড় হতে হতে 'আটপৌরে' শব্দটির আক্ষরিক এবং অন্তর্নিহিত অর্থ যত আমার কাছে পরিস্কার হতে থাকলো ততই মায়ের বাড়িতে শাড়ী পরার ধরন নিয়ে আমার অভিযোগ কমতে কমতে শেষে কখন যে উধাও হয়ে গেল বুঝতেই পারলাম না। আর এখন তো বিয়ের কনেরাও ফ্যাশনের রাস্তায় উল্টো মুখে হেঁটে আবার পুরনো রীতি অনুসরণ করে আমার মায়ের মতন করে শাড়ী পরে বিয়ের পিঁড়িতে বসছেন। সুতরাং এখন তো এ নিয়ে আমার আর কোনো কথাই নেই। তবুও এখনো আটপৌরে শব্দটা কোথাও পড়লে মায়ের এই শাড়ী পরার ধরনটি এবং সেই সংক্রান্ত আমার অভিযোগ এর কথা আমার মনে পড়ে যায়।   

মায়ের শাড়ী আর আমার ছোটবেলার ধারণা নিয়ে যখন কথা উঠলো তখন আরো একটা কথা মনে পড়ে গেল। মায়ের চিরকালের পছন্দ হালকা রঙের শাড়ী। তাই মায়ের যত্সামান্য শাড়ীর ভান্ডারের অধিকাংশই সাদা-ধূসর-বা এদের আশেপাশের চোখ আরাম দেওয়া অন্য রং এর শাড়ী। জরি-চুমকি তো নৈব নৈব চ। এদিকে আশেপাশের সকলকে দেখি বড় বড় রঙিন ফুলপাতা আঁকা-চকমকে শাড়ীতে। সেটিও আমার আরো একটা ঘ্যানঘ্যানানির বিষয় ছিল মায়ের কাছে। সেই আটপৌরে রং আর পোশাকি রং এর ঝগড়া। বাচ্চা মানুষের বুদ্ধি আর কি। বয়স এর সাথে সাথে কখন যে আমার নিজের কেনা জামা বা মায়ের জন্য কেনা শাড়ীর রংও যে সাদা-ধূসর বা এদের আশেপাশের চোখ আরাম দেওয়া অন্য রং এ বদলে গেছে নিজেও বুঝতে পারিনি।

ভালো লাগা বা কোনো একটি বিশেষ বস্তু বা বিশেষ বিষয়ের প্রতি মানুষের ধারণা বদলে যাওয়াটা শ্বাস গ্রহণ বর্জন এর মত এতটাই স্বাভাবিক ঘটনা সে কখন যে আস্তে আস্তে সে বিষয়বস্তুর প্রতি আমাদের ধারণা বদলাতে বদলাতে বেমালুম উল্টোমুখে চলতে শুরু করে যে আমরা নিজেরাই অবাক হয়ে যাই যে, কোনো এক সময় এই বিষয়টি আমরা এভাবে দেখতাম! বা বিষয়টি আমাদের চোখে এতটাই স্বাভাবিক বা আটপৌরে ছিল সে সম্পর্কে কোনদিন ভেবেও দেখার প্রয়োজন অনুভব করিনি। অথচ আজ সে বিষয়টি তার মহত্ব নিয়ে এমন ভাবে রাস্তা আড়াল করে দাঁড়িয়েছে যে এতবড় বিষয়টি থেকে কি করে এতদিন চোখ বন্ধ করে ছিলাম সেকথা ভেবে লজ্জা পেতে হয়। সে বিষয়টি তখন আটপৌরে থেকে একধাক্কায় রীতিমত পোশাকি হয়ে ওঠে। আর উল্টোদিকে এমন কিছু বিষয় নিয়ে এতদিন নিজের মধ্যেই ঘ্যানঘ্যানানি পুষে রাখতাম সে যেন রীতিমত পোশাকি ব্যাপার। বিলাসিতার মত। প্রয়োজনমতো মনের আলমারি থেকে ন্যাপথলিনের গন্ধ মাখা সাধের দুঃখ তুলে এনে খানিক কান্নাকাটি করে আবার তাকে তুলে রাখা। যে মুহূর্ত থেকে সত্যি সত্যি মন বুঝতে পারলো যে, বিষয়টি কেবলমাত্র পোশাকি বাহুল্য ছাড়া আর কিছু নয়, অমনি সে তার সমস্ত পোশাকিত্ব হারিয়ে ঝুপ করে বাড়ির আলনায় রাখা আটপৌরে শাড়ীটি হয়ে পড়ল। গায়ে জড়িয়ে আরাম। তখন তাতে অবলীলায় হলুদ মাখা হাত মুছে ফেলা চলে। তার পর ধীরে ধীরে রোজকারের ব্যবহারে ছিঁড়ে-রং উঠে- ঘরমোছা ন্যাতা হয়ে শেষে কবে যে মনের সংসার থেকে বিদায় নিল মন জানতেও পারল না। 

এই আটপৌরে থেকে পোশাকি আর পোশাকি থেকে আটপৌরেতে ধ্যান-ধারণার ধীর কিন্তু অবিচল পরিবর্তনের স্রোতটির সঙ্গে খাবি খেতে খেতে চলতে চলতে মনে হয়, এখনো যেসব ঋণাত্মক অনুভূতিগুলি সযত্নে ন্যাপথলিন এর টুকরো দিয়ে পোশাকি আলমারিতে তুলে রেখেছি, দরকার মত বের করে এনে বিলাসিতা করব বলে, সেগুলো হঠাত করে এক ধাক্কায় যদি জাদুমন্ত্রবলে টেনে বের করে এনে আটপৌরে আলনায় ফেলা যেত বেশ হত। জীবনের নিজস্ব নিয়মেই সে একদিন রোজকারের ব্যবহারে ছিঁড়ে-রং উঠে- ঘরমোছা ন্যাতা হয়ে শেষে কবে যে মনের সংসার থেকে বিদায় নিত মন জানতেও পারত না। ওই পোশাকিত্বের মায়া কাটিয়ে আটপৌরে আলনায় টেনে বের করে আনাটাই আসল কথা। বাকিটা আপনিই হয়ে যায়।  দেখা যাক।  

  

1 comment: