সকলের হাচিকো-গুগল থেকে |
খবরটা এখানে পড়ে নিতে পারেন। সংক্ষেপে ব্যাপারটি এরকম, প্রেসিডেন্সি ক্যাম্পাসে ছাত্রছাত্রী, অধ্যাপককুল ছাড়াও ছিল চোদ্দটি কুকুর। এবং যথারীতি কিছু লোকজন তাদের বিরুদ্ধে তত্পর হতে শুরু করেছিলেন ক্যাম্পাসছাড়া করতে। এবং যথারীতি আরো অন্য ছাত্র-ছাত্রী দল ও কিছু অধ্যাপক তাদের পাশে দাঁড়ান ও সকলে মিলে তাদের ভ্যাকসিনেশন, স্টেরিলাইজেশন ইত্যাদির ব্যবস্থা করেন। বর্তমানে তারা বহাল তবিয়তে গম্ভীর হয়ে নতুন বাকলস পরে প্রেসিডেন্সি ক্যাম্পাসে ঘুরে বেড়াচ্ছে। এই হলো সংক্ষেপে খবরটি।
কিন্তু আমি জানি এই পুরো ঘটনাটা এত সহজে হয়নি। কারণ দেখুন, আমরা হলুম গিয়ে দুপেয়ে মানুষের দল। ভগবানের নাকি শ্রেষ্ঠতম সৃষ্টি। আমাদের সাথে কিনা এই নোংরা, কালোকোলো চারপেয়ে গুলো একই সাথে ঘুরে বেড়াবে? তা কি করে হয়? যদিও ওরা আমাদের খাবারে ভাগ বসাচ্ছে না, আমরা যে যেন তেন প্রকারেণ অন্যের পাওনা থেকে ছোটোখাটো চুরি চামারি করে-দুচার পয়সা ঘুষ-ঘাষ নিয়ে নধর ভুঁড়িটুকু কোনো মতে টিকিয়ে রাখার চেষ্টা করছি তাতেও ভাগ বসাচ্ছে না। কিন্তু তবুও, এই যে চারপাশ থেকে আমরা এত চাপ খাচ্ছি-অফিসে দিবারাত্র বস ঝাড়ছে, বাড়িতে নিত্যদিন বউ অন্তর্টিপুনি দিচ্ছে, বাচ্চার স্কুল থেকে অহরহ কমপ্লেইন আসছে, অফিস কলিগ চোখের ওপর দিয়ে নতুন গাড়ি হাঁকাচ্ছে-সুইত্জারল্যান্ডে ছুটি কাটাতে যাচ্ছে আর আমি ছুটিতে লিলুয়া কিংবা গোবরডাঙ্গার বাইরে ভাবতে পারছিনা.........এইসব চাপের একটা রিলিজ পয়েন্ট তো থাকা উচিত তাই না? বলুন? তা আমি কি করব? নিশ্চয়ই বস বা বউ বা বাচ্চা বা কলিগ কাউকেই মনের ঝাল মিটিয়ে কষিয়ে একটা লাথি মারতে পারব না? তা কাউকে তো একটা মারতে হবে, নইলে তো চাপ খেতে খেতে ক্রমশঃ চ্যাপ্টা হয়ে যাব। তা হাতের সামনে এই হাড়-হাভাতে চারপেয়ে গুলো থাকতে আর কাকে লাথি মারব বলুন তো? সুতরাং, ওরা যতই আমায় দেখে কানদুটো নামিয়ে, মিনিটে তিনশ পঞ্চাশ বার প্রবলভাবে লেজ-টেজ নাড়ুক না কেন, আমি দেখতে পেলেই ওদের দুরছাই করব, লাঠি দেখাবো, পাথর ছুঁড়ব, দরকার পড়লে লাথি মেরে এলাকা ছাড়া করব। যতই হোক, পৃথিবীটা আমার বাপের সম্পত্তি। পৃথিবীকে চিবিয়ে ছিবড়ে চচ্চড়ি পাকাবার অধিকার একমাত্র আমার জন্মগত। এইসব কুকুর ছাগল তো জন্মেছে হয় আমার খিদে মেটাতে নয় আমার মনের ঝাল মেটাতে। এদের নিয়ে আবার অত আদিখ্যেতা কি - হ্যাঁ ?
সুতরাং যারা এইসব চারপেয়েদের হয়ে প্রেসিডেন্সিতে গলা ফাটিয়েছেন তাঁদের যে বেশ অনেকখানিই গলা ফাটাতে হয়েছে সে বিষয়ে আমার কোনো সন্দেহই নেই। কিন্তু তবুও যে শেষ পর্যন্ত তাঁরা পেরেছেন এটাই যথেষ্ট। আমি আজ এমন একটি সরকারী প্রতিষ্ঠানের কথা বলব যেখানে মাত্র দুটি অতীব শান্ত কুকুর ও তাদের তিনটি বাচ্চাকে সেই প্রতিষ্ঠানের ছাত্র-ছাত্রীরা মিলে সম্পূর্ণ প্রতিরক্ষা দিতে পারেনি। বাচ্চাগুলিকে চলে যেতে হয়েছে।
দুই তিন বছর আগে একটি পুঁচকে কুকুরছানা এই মহার্ঘ্য প্রতিষ্ঠানের চত্বরে ভুল করে ঢুকে পড়েছিল। প্রেসিডেন্সির মত কিছু বোকা কুকুরপ্রেমী তাকে খাইয়ে দাইয়ে -ভ্যাকসিনেশন দিয়ে ক্যাম্পাসেই থাকতে অভয় দিলেন। সেও আদরে-আদরে, নেচে কুঁদে, পুঁচকে লেজ নাড়িয়ে, স্পেনসার্স এর চিকেন লেগ পিস এর সূপ আর পেডিগ্রী খেয়ে আস্তে আস্তে প্রবল ভিতু আর প্রচন্ড আদুরে একটা কুকুর তৈরী হতে লাগলো। এবং কিংবদন্তি কুকুর হাচিকোর নামে তার নাম হলো 'হাচিকো'। এখন আমাদের হাচিকো লায়েক হয়েছে। তারই মত একটি কালোকোলো বান্ধবীও জুটেছে। 'হাচিকোর বান্ধবী', তাই তাকে আমি 'হাবা' বলে উল্লেখ করব এখন থেকে।
আমাদের ছোট্ট হাচিকো তখন - হাচিকোর ফেসবুক প্রোফাইল থেকে | আমাদের প্রবলপ্রতাপশালী হাচিকো এখন -পিনাকীর তোলা ছবি |
হাবার ছানাদের একটি-ছবিটি পিনাকীর সৌজন্যে |
হাচিকো-রাগী বাবার ভূমিকায় |
হাবা আর তার ছানারা-তখনও পাঁচ জন টিকে আছে |
খবর পাওয়ামাত্র প্রথমেই তো ছাত্রছাত্রীরদল জঙ্গলে ঢুকে এক দেড় ঘন্টার প্রচেষ্টায় খুঁজে পেতে হাচিকোর সাহায্যে বাচ্চাতিনটিকে ক্যাম্পাসে ফিরিয়ে নিয়ে এলো। তার পর তো জানা গেলো যে, কোনো একজন প্রচন্ড দায়িত্বশীল কর্মচারী গার্ডদের নির্দেশ দিয়েছেন যে দেখলেই যেন লাঠির বাড়ি মেরে কুকুরদেরকে ক্যাম্পাস ছাড়া করা হয়। কারণ? কি বোকা- বুঝতে পারলেন না? ক্যাম্পাসে নাকি বিদেশী ভিজিটররা আসবেন রিসার্চের মান নির্ণয় করতে, এমতাবস্থায় ক্যাম্পাসে চাট্টি কুকুর থাকলে কেমন কেমন দেখায় না? তা এখন ছানাগুলো নেই, গবেষনার কি উন্নতি হয়েছে জানিনা। তাই তিন তিনটে মায়ের দুধ না ছাড়া বাচ্চাকে একই বস্তায় পাশবিক ভাবে ঢুকিয়ে এমন জায়গায় দিয়ে আসা হলো যার পাশেই ন্যাশনাল হাইওয়ে, ভুল করে ওদিকে চলে গেলেই দানবীয় ট্রাকের চাকা অপেক্ষা করছে পিষে দেবার জন্য। কেউ যুক্তি দিল ক্যাম্পাসে স্টাফ কোয়ার্টারে এত ছোটো বাচ্চা, যদি কামড়ে দেয়? জানিনা তাঁরা বেবি সিটার ডগ বিষয়টি জানেন কিনা। কোনো মহানুভবের আবার যুক্তি যদি সিঁড়িতে নোংরা করে রাখে। সবই 'যদি', তাই নির্দিষ্ট পদ্ধতি ছাড়া যেমনতেমন ভাবে তাদের পেছনে পড়া গেল। কারণ আমাদের তো বুদ্ধি আছে না? তাই আমরা জানি অজস্র পায়রা যারা ক্যাম্পাসের প্রতিটা কোয়ার্টার এর প্রতিটা ঘর, সিঁড়ি সবসময় নোংরা করছে তাদের ধরতে আমরা পারব না, ধরতে গেলেই পালাবে। কিন্তু এই তিন আঙ্গুল চেহারার কুকুর ছানা গুলো যারা ঠিক করে হাঁটতেই পারে না, তারা তো পারবে না পালাতে, উল্টে লেজ নেড়ে খাবারের আশায় সামনে আসবে। দে নোংরা বলে তাদের ওপর গায়ের ঝাল মিটিয়ে। দুচারটে লাঠির বাড়ি মারলেই বা কোন মানেকা গান্ধী আসছে দেখতে। অতএব, চালাও লাঠি। শোনা গেল যে হাবা সহ হাচিকোকেও নাকি ক্যাম্পাস ছাড়া হতে হবে। তাঁরা অনেক সহ্য করেছেন, কি সহ্য করেছেন তা ঠিক জানা গেল না। এই ভিতুর ডিম কুকুরগুলো কাউকে কোনদিন কামড়ায় না, যাঁরা বলছেন তাঁরা কেউ কোনো দিন তাদের খেতে টেতে দেন বলে জানা যায় না, তাদের ঘরেও এরা যায় না যে নোংরা হবে।
সমস্যাটা হলো যখন দু দশজন ছাত্র ছাত্রী কোমর বেঁধে তাদের হয়ে সওয়াল করে সরাসরি দফতরে চলে এলো। এসে পরিস্কার ভাষায় জানালো যে, হাচিকোর তো বাইরে যাবার প্রশ্নই নেই কারণ ও বাইরে গেলে নিজের মত করে বেঁচে থাকতেই পারবে না, ছোটো থেকেই সে বাড়ির কুকুরের মত ক্যাম্পাসে আছে নিয়মিত সমস্ত ভ্যাকসিনেশন সহ। আর বাচ্চাগুলোর সাথে এই ঘটনা যেন আর না ঘটে, তাদের যথার্থভাবে কোনো adaptation সেন্টারে যতক্ষণ না পাঠানো হচ্ছে ততক্ষণ তারা এখানেই থাকবে। এবং ঠারেঠোরে এটাও জানালো যে তাদের উপর লাঠি-টাঠি চালালে কে কোনদিন ছবি টবি তুলে কোথাও লাগিয়ে দিলে 'PETA' র দলবল এসে পেটালে সেটা কি আর ভালো হবে? সম্ভবত শেষের কথাটিতেই কাজ হলো। কারণ বড় বড় দায়িত্বশীল নাগরিকদের দেখেছি ততক্ষণই দায়িত্বপালন করেন যতক্ষণ সাধের পিঠটা বাঁচছে। যখনই তাতে একটুও আঁচ আসার সম্ভবনা থাকে তখনই সব দায়িত্ব ব্যাগে ভরে মুখ মুছে 'গোপাল বড় ভালো ছেলে' হয়ে যায়। যাই হোক, কয়েক সপ্তাহ পর ছাত্র-ছাত্রীরাই উদ্যোগ নিয়ে বাচ্চা তিনটির adaptation এর বন্দোবস্ত করলো, হাচিকোর স্টেরিলাইজেশন করালো। তালেগোলে হাবাকেও আর বাইরে যেতে হলো না।
বর্তমানে হাচিকো দুপুরে পেডিগ্রী দিয়ে দুধ- চিঁড়ে খেয়ে বহাল তবিয়তে আমাদের বাড়িতে ঘুমোচ্ছে। সন্ধ্যে হলেই বাইরে ক্যাম্পাস এর বাকিদের খবরাখবর নিতে যাবে। আর হাবা বাইরের অন্য কুকুরদের দৌলতে আবার এই বছর কয়েকটি বাচ্চার জন্ম দিতে চলেছে। তাদের কি হবে কে জানে।বছর বছর আমাদের মায়ের থেকে বাচ্চাদের আলাদা করার কাজটা করে যেতে হবে হয়ত। আর তারপর হাবার নীরব শান্ত দৃষ্টির দিকে সোজাসুজি চোখ তুলে তাকাবার পরীক্ষা দিয়ে যেতে হবে। নইলে কিছু অতি দায়িত্বশীল নাগরিকদের অতি দায়িত্বশীলতার ধাক্কায় হাচিকোর মত হাবাকেও তার স্বাভাবিক প্রবৃত্তি থেকে জোর করে টেনে সরিয়ে আনতে হবে। বোকা হাঁদা চারপেয়ে গুলোর জন্য আমাদের মত স্বার্থপর, নিজের কোলে ঝোল টানা দুপেয়েরা আর কি ই বা করতে পারি? প্রেসিডেন্সির ওরা যেমন করেছে।
সুন্দর লেখনি। হাচিকো সম্পর্কে আরো বিস্তারিত জানতে পারেন.
ReplyDeleteহাচিকো