Monday, 8 December 2014

তারকেশ্বর-বালিপুর-রাধানগর............প্রথম পর্ব

আগের দিন যে কথাটা বলছিলাম, ওই যে বালিপুর বেড়াতে যাবার গল্প। সে গল্পটাই আজ শোনাতে বসেছি। বালিপুর হল হুগলী জেলার ছোট্ট গ্রাম। তারকেশ্বর থেকে দুই নম্বর জাতীয় সড়ক ধরে আরামবাগের দিকে যাবার সময় চাঁপাডাঙ্গা-র পরে দামোদরের পাকা সেতু পেরিয়েই পুরশুড়া থেকে যে পাকা রাস্তাটা গাছ-গাছালি আর আদিগন্ত ধানক্ষেতের মধ্যে দিয়ে বামদিকে ছত্রশালের দিকে এগিয়ে গেছে সেই রাস্তা ধরে দশ বারো কিলোমিটার গেলেই বালিপুর। সেই যেখানে মুন্ডেশ্বরী নদী পথচলার ক্লান্তিতে দুভাগ হয়ে আবার পরে দুটি ধারা মিশে গিয়ে সৃষ্টি করেছে 'উদনা'-র চর, সেই সেখানে হলো গিয়ে বালিপুর গ্রাম। সেখানে আছে একটি মাত্র স্কুল- একটিমাত্র বাজার-বেশ কয়েকটি মন্দির-সঙ্গে ঘরে ঘরে হরেক চ্যানেল এর হরেক কিসিমের সিরিয়াল এর সাড়ে বত্রিশ ভাজা-এমুড়ো থেকে ওমুড়ো পর্যন্ত ধান আর শাকসবজির ক্ষেত-মুন্ডেশ্বরী নদীর বাঁকে প্রতিদিনের নরম-আদুরে সূর্যাস্ত-আর আছে পিনাকীর ফেলে আসা ছেলেবেলার প্রথম পাঁচটি বছর। 
বালিপুরে সন্ধ্যে নামার আগে মুন্ডেশ্বরী নদীর ঘাটে 
সেই ফেলে আসা পাঁচটি বছরের স্বাদ নিতেই এত বছর পর আবার যাওয়া। তারকেশ্বরে ট্রেন থেকে নেমে আমরা গেলাম তারকেশ্বর মন্দির দেখতে। বহু ছোটোবেলায় আমি নাকি গেছিলাম, মা বাবার মুখে শুনি। অবশ্যই একা নয়, আয়েশ করে গ্যাঁট হয়ে তাঁদের কোলে চেপে বসে। তা  "সেসব আমার মনে তো নেই।" তাই সে অর্থে আমার প্রথম বার দেখা তারকেশ্বর মন্দির। বিশেষ কিছু বলার নেই। বিখ্যাত মন্দির যেমন হয়। জল-কাদা-অতি উত্সাহী ভক্ত কুলের ঠেলাঠেলি। এই বুঝি পুণ্যের খাতায় এন্ট্রিটা ফসকে গেল। মন্দিরের সামনে গলি। পেঁড়ার দোকান। জুতো রেখে যাবার জন্য আকুল টানাটানি ইত্যাদি ইত্যাদি। আমরা চারজন মন্দিরের সামনে থেকে ঘুরে, দুধপুকুর দেখে,  "এই ঠেলাঠেলিতে আর তোমার দরবারে সশরীরে পৌঁছবার দুঃসাহস দেখালাম না বাবা, খ্যামা দাও"- এই বলে দূর থেকে বাবা শিবের কাছে এপ্লিকেশন পাঠিয়ে গলির দোকানে ধোঁয়া ওঠা ভাত-তরকারী সাঁটিয়ে সোজা বালিপুরের দিকে। 

বালিপুরের কথা আমি পিনাকীর মুখে শুনে এসেছি সেই প্রথম দিন থেকেই। পরের দিকে হয়ত বারবার বলার কারণে উত্সাহ হারিয়ে হুঁ-হা দিয়ে কাজ সেরেছি। আমার ছেলেবেলা-বুড়োবেলা সবটাই একই জায়গায় কেটেছে এবং ভবিষ্যতেও কাটবে বলে হয়ত ছোটবেলার একটা বড় অংশ বেমালুম হাতছাড়া হয়ে যাবার ব্যথাটা ধরতে পারতাম না ঠিক করে। কিন্তু সেখানকার সময়টুকু, মানুষজন বোধহয় ঢুকে গেছিল আমার ভেতরেও। তাই সেখানে যাবার প্ল্যানিং হতেই দেখলাম আমিও চার হাত পা তুলে "কবে যাওয়া হবে? কবে যাওয়া হবে?"বলে নাচতে লেগেছি। আসলে মানুষ তার ছোটবেলার প্রতিটি কণা সঞ্চয় করে রাখতে চায় সযত্নে। তাই এত বছর পরেও জীবনের প্রথম পাঁচটি বছর যে জায়গার সাথে আস্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে, যার বেশিরভাগ স্মৃতিই মস্তিক কোষে জায়গা নিয়ে পারেনি এই ত্রিশ-বত্রিশ বছরের অজস্র হাবিজাবি স্মৃতির ভিড়ে, সেই জায়গাটার-সেই এককামরার ভাড়ার ঘর- প্রথম স্কুল-দুচার টুকরো স্মৃতির সন্ধানে ফের আমরা বালিপুরের পথে। বালিপুরে কি কি আছে বলতে গিয়ে যে কথাটা বলা হয়নি সেটা হলো ওখানে আছে একটি এলাহাবাদ ব্যাঙ্কের শাখা। আর সেই শাখাটিই হলো বাপি মানে পিনাকীর বাবার প্রথম চাকরিস্থল। ব্যাঙ্কটি এবাড়ি-ওবাড়ি ঠিকানা বদলে বদলে এখন বালিপুর বাজারের কাছে গিয়ে স্থায়ী ঠিকানা পেয়েছে। প্রায় পঁয়ত্রিশ বছর আগে পুঁচকে এই ব্যাঙ্কটিতেই লোটাকম্বল নিয়ে জীবিকার প্রয়োজনে এসে থানা গেড়েছিলেন বাপি। প্রথমে ব্যাঙ্কের মেস তারপর বিবাহপরবর্তী জীবনে বাজারের কাছেই বারোয়ারী এক ভাড়াবাড়ির এককামরার ঘরে। সেই ঘরে এখন জরির এমব্রয়ডারীর কাজ হয়। পুরো বাড়িটিতেই এখন আর কোনো পরিবার বাস করে না। কোনো ঘরে কাঠের কাজ, কোথাও হারমোনিয়াম তৈরী হয়। এই সেই ঘর দেখুন। এই যে ছবি। 

এই ঘরেই বছর ত্রিশ-বত্রিশ আগে পিনাকী বাবু চুষিকাঠি মুখে গম্ভীর হয়ে হামাগুড়ি দিতেন 
সেখানথেকে বালিপুর বাজারে আমরা টহল দিলাম পথে পড়ল একটি জায়গা। যেটি এককালে পিনাকীর স্কুল ছিল। কুঁচো বেলার প্রথম কিন্ডারগার্টেন স্কুল। আমাদের দুজনের অনেক মিল আর অমিলের লিস্টে প্রথমেই যেটা আসে সেটা হলো প্রথম স্কুল। আমি হলুম গিয়ে সরকারী প্রাইমারী স্কুল-বাংলা মাধ্যম ওয়েস্টবেঙ্গল বোর্ড স্কুল-অনামী কলেজ-ইউনিভার্সিটি-অনামী পিএইচডি ল্যাবরেটরি পেরিয়ে আসা আপাদমস্তক তকমাহীন এক মহিলা। পিনাকীও তাই হতে হতেও হলো না তার একটা কারণ তার পিএইচডি ল্যাবরেটরিটি অন্ততঃ কলকাতা শহরের ছাত্রছাত্রীরা চেনে। আর দ্বিতীয় কারণটা এই অখ্যাত বালিপুরের আনন্দমার্গ স্কুল। যেটিতে নাকি লাল জামা-কালো প্যান্ট-কালো জুতো-সর্বোপরি একটি কালো টাই পর্যন্ত পরে, কপালে ধেবড়ে যাওয়া ইয়াবড় একটা কাজলের টিপ নিয়ে প্রচন্ড গম্ভীর হয়ে পিনাকীচরণ এককালে বছর দুয়েক প্রচন্ড পড়াশুনা করেছিলেন। পরে অবিশ্যি খড়গপুরের সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে এসে ক্লাস ওয়ানে ভর্তি হয়েছিলেন। আমার স্কুলের গল্প তো আগেই বলেছি আপনাদের। সেসব কথা মনে থাকলেই বুঝবেন প্রথম স্কুল এর ব্যাপারটাতেই তার সাথে আমার কোথায় অমিল। যাই হোক, তো সেই আনন্দমার্গ কিন্ডারগার্টেন স্কুল এখনো আছে। কিন্তু এরও ঠিকানা বদল হয়েছে। নতুন ঠিকানায় আর যাওয়া হয়নি। পুরনো ঠিকানাটা বর্তমানে হোমিওপ্যাথি ওষুধ আর ডাক্তারখানা। এই যে দেখুন এখানেই পিনাকীচরণ গাল ফুলিয়ে টিনের বাক্স হাতে রিম্পার হাত ধরে পড়াশুনা করতে যেতেন। বাল্যপ্রেম-ট্রেম ছিল কিনা সেটা অবিশ্যি আমি জানিনা। যাক গে যাক, অবান্তর কথা ছেড়ে এই যে দেখুন ছবি। 
এটি এককালে পিনাকীর স্কুল ছিল
 তারপর বালিপুর হাইস্কুলের মাঠে। আজ থেকে ত্রিশ বছর আগেকার যে কিরকম গ্রাম ছিল সেটা আজকের বালিপুর দেখেই আন্দাজ করা যায়। তখন সেই অজ গ্রামে বাইরে থেকে গিয়ে ব্যাঙ্ক কর্মচারী বা স্কুলের মাস্টারমশাইরা কাজের শেষের বাকি সময়টা কিভাবে কাটাবেন বুঝে উঠতে পারতেন না। কোনোরকম এন্টারটেইনমেন্ট এর ব্যবস্থা ছিলনা সেদিনের বালিপুরে। তাই বহিরাগত সেসব ব্যাঙ্ক কর্মচারী বা স্কুলের মাস্টারমশাই দের উদ্যোগেই গড়ে উঠেছিল একটি ক্লাব। এবং তাদেরই ব্যবস্থাপনায় হয়েছিল ব্যাঙ্ক কর্মচারী vs স্কুলের মাস্টারমশাই ফুটবল ম্যাচ স্কুল এর মাঠে। গ্রামবাসীদের প্রবল উত্সাহের সেই খেলা মনে রাখার একটি কারণ হলো বাপির দেওয়া গোল। এই সেই মাঠ। এখন নাকি অনেক ছোটো হয়ে গেছে। এই যে ছবি। 

বালিপুর স্কুলের মাঠ
সেখান থেকে মুন্ডেশ্বরী নদীর পাড়ে গেলাম। সন্ধ্যে নেমে এলো আসতে আসতে। ফিরে এলাম বালিপুর বাজারে। পথে অবশ্য অজস্র লোকজন-অজস্র দোকানপাটে দাঁড়াতে দাঁড়াতে আসতে হলো। পুরনো চেনা লোকজন। আমরা দুজন অবশ্য হোঁদল কুতকুতের মত দাঁড়িয়ে দাঁত বের করে রইলাম সব ক্ষেত্রেই। আমার তো প্রশ্নই ওঠেনা, পিনাকীও চেননা  কাউকে। বড়রা দুজন আপ্লুত হয়ে কথাবার্তা বললেন। তারপর আমরা ফিরে এলাম বাড়িতে। কি বললেন? বাড়ি মানে? বাড়ি মানে স্বপনকাকাদের বাড়ি। এঁনাদের কথা একটু গুছিয়ে বলতে হবে। বালিপুরে থাকার পুরো সময়টাতেই এই পরিবারটিকে পাশে পেয়েছিলেন বাপি মামনি। এঁনাদের টানেই, এঁনাদের ডাকেই এই বালিপুর ভ্রমণ। রক্তের সম্পর্ক টম্পর্কের কথা যাঁরা বলেন তাঁদের জন্য শ্রেষ্ঠ উদাহরণ হলো এই দুটি পরিবারের সম্পর্ক। আপনজন হয়ত এঁদেরই বলে।

ছোটখাটো কারখানার মজদুরি, বাড়ির গরুর দুধ বিক্রি, মুড়ি-বাদাম ভেজে বিক্রি ইত্যাদি নানান ছোটখাটো কাজ করে সৎপথে কোনোমতে দিন আনি দিন খাই এর সংসার ছিল দাদু মানে স্বপনকাকার বাবার। তিনটি ছেলেমেয়ে। তপন, স্বপন আর মাধবী। নয়- দশ বছরের ছোট্ট মাধবী পিসির সাথে কেমন করে যেন আলাপ হয়ে গেল মামনির। সেই থেকে সদ্যজাত পিনাকীর টানে তার মায়ের নেওটা হয়ে পড়ল মাধবী পিসি। সেই থেকে দুটি পরিবারের সম্পর্ক শুরু। ত্রিশ-বত্রিশ বছরের সময়ের টানে এই পরিবারটি অর্থনৈতিক ভাবে উঠে এসেছে অনেকখানিই। কিন্তু বদলায়নি এঁনাদের আন্তরিকতা আর সততা। জীবনে প্রথমবারের জন্য এখানে গিয়ে আমার মনে হচ্ছিল বুঝি কত কালের চেনা এঁনারা আমার।  

এই বাড়ির আর এক সদস্য হলো কুহেলি। কুহেলি চেহারাতেই গরু। স্বভাবে কুকুর। বাড়িতে নতুন কেউ ঢুকতে গেলে কুহেলির সামনে যদি পড়ে তবে তাকে টপকে বাড়িতে ঢোকা প্রায় অসম্ভব। শিং নাড়িয়ে তেড়ে যাবে সে। রোজ দুকেজি আলু খায় সে। সাথে আর যা কিছু গরুর খাবার সেসব তো আছেই। সবচেয়ে আশ্চর্যের কথা সে নাকি ছোটবেলায় ঠাকুরমার সাথে মশারির মধ্যে শুতো। সে অভ্যাস খানিকটা বদলে আজও বর্তমান। তার জন্য গোয়ালঘরে রাতে মশারি টাঙিয়ে দিতে হয়। সে রাতে মশারির ভেতরে ঘুমোয়। এই যে দেখুন ছবি। কুহেলীর পেছনে তার মশারিটি দেখা যাচ্ছে কি? 

কুহেলি ও তার মশারি 
পুরনো শিব মন্দিরে যাওয়া হলো দল বেঁধে। মন্দির তো নতুন রং এ সেজেগুজে একদম নতুন হয়ে গেছে। মন্দিরের গায়ে দশ মহাবিদ্যার মূর্তি গড়া রয়েছে। তাতে আধুনিকতার ছাপ সর্বত্র। তবে মন্দিরে যাবার তন্বী রাস্তাটি ধানক্ষেতের মধ্যে দিয়ে এঁকেবেঁকে সুন্দর গতিতে চলেছে। ধানক্ষেতে অজস্র সারস সবুজের মধ্যে যেন সাদা বুটিদার শাড়ী তৈরী করেছে।

গ্রামের শিব মন্দিরে যাবার রাস্তা

মন্দিরের গায়ে দশমহাবিদ্যা 

শিব মন্দির নতুন রূপে, পাশে নির্মীয়মান শীতলা মন্দির
আমরা যেদিন গিয়ে পৌছলাম বালিপুর সেদিন ছিল রাসপূর্নিমা। আর হুগলীর এই অঞ্চলে রাসপূর্নিমা পালন করা হয় বড় জাঁকজমক সহকারে। স্বপনকাকাদের বাড়িতেও পাড়ার অন্যবাড়ির মত রাধা কৃষ্ণের রাস উত্সব পালন করা  হচ্ছিল। আর পাশেই রয়েছে মনসা মূর্তি। বালিপুর বাজারেও দোকানে দোকানে বিক্রির জন্য রাখা অজস্র রাধাকৃষ্ণ আর গোপিনীদের মূর্তি। 


পরেরদিন আমরা যখন রাধানগর গেলাম তখনও খানাকুলের বিখ্যাত গোপিনাথজীর রাসের মেলা দেখলাম। সাথে দেখলাম আরো অনেক কিছু। সে গল্প পরের দিন হবেখন আজ এপর্যন্তই থাক কেমন?  

  

0 comments:

Post a Comment