Sunday, 6 July 2014

দাদার কীর্তি -২

দাদার কীর্তি -১ এর পরে আর নিশ্চয়ই আমার দাদাটির সম্পর্কে আর নতুন করে পরিচয় করিয়ে দিতে হবে না। প্রমিস করেছিলাম আমার দাদার আরো মজার কীর্তি কাহিনী শিগগিরিই শোনাব আপনাদের। তাই আজ ভাবলাম আরো একটা রোমহর্ষক কাহিনী শোনাই আপনাদের। বেশি আগড়ম বাগড়ম না বকে সোজা ঘটনাতে চলে যাই। কি বলেন?

দাদার পিএইচডি থিসিস জমা দেবার সময় প্রায় সমাগত। সেই সময়কার ঘটনা। থিসিস লেখা চলছে, ছয়- সাড়ে ছয় বছরের অক্লান্ত সাধনার ধন নিবিষ্টমনে একজায়গায় তিল তিল করে জড়ো হচ্ছে। এই গুরুত্বপূর্ণ কর্মকান্ডের লাইনে আমি হচ্ছি ল্যাব এর নেক্সট ক্যান্ডিডেটদ্বয়ের একজন। অতএব, পারলে প্রতি ঘন্টায় ঘন্টায় গিয়ে খোঁজ নিচ্ছি কদ্দূর এগোলো? কি করে কি ক্যালকুলেশন হচ্ছে? কিরকম ফরম্যাটে লেখালেখি চলছে? কি কি জটিল সব অফিসিয়াল পদ্ধতি অনুসরণ করা চলছে? ইত্যাদি ইত্যাদি। মোটকথা কিছুক্ষণ অন্তর-অন্তরই বলির পাঁঠাটির কাছে গিয়ে, আমায় যখন বলি হতে হবে তখন কি কি ভাবে পুজার্চনাদি করতে হবে তার একটা এস্টিমেট করার চেষ্টা করছি। দাদাও অম্লান বদনে বিনা বিরক্তিতে আমায় সব কিছু মহোত্সাহে বুঝিয়ে চলেছে। কি করে কে জানে? আমায় যদি কেউ ওরকম ভাবে বিরক্ত করত, তো আমি বোধহয় তাকে খুনই করে ফেলতাম। যাই হোক, আমি তো আর দাদা নই, কস্মিনকালে হয়ে ওঠার আশাও দেখি না। সোজা কথায়, মোটামুটি একটা যুদ্ধকালীন পরিস্থিতি, যতটা না যে থিসিস লিখছে তার, তার চেয়ে বেশি বোধহয় আমার।

এমতাবস্থায়, একদিন দুপুর নাগাদ আমরা বাকি সব চুনোপুঁটিরা কাজ কর্ম করার একটা ব্যর্থ প্রচেষ্টায় ল্যাজে-গোবরে হচ্ছি। হঠাত ধীরে-সুস্থে দাদা আমার এলেন আমাদের কাছে। এসে ঘোষণা করলেন.....দাঁড়ান, আমি exact ডায়লগ গুলো বলি-
--"কি করছিস তোরা? মন দিয়ে কাজ কর্ম কর, আমার তো হলো না আর, I am finished।"
বলে কি রে ভাই? আমরা সবাই হাঁ করে মুখের দিকে তাকিয়ে আছি। হলো টা কি? ক্যালকুলেট করতে করতে মাথা গরম হয়ে গেল নাকি?
--"কি হয়েছে?"আমরাই কেউ একজন প্রশ্ন করলাম।
উত্তর এল, " I am finished, আমি সুইসাইড করব, আমার আর কিছু করার নেই। তোরা কাল খবর পাবি।"-পুরোটাই কিন্তু শান্ত ধীর কন্ঠে।
--"আরে কি হয়েছে বলবে তো?"
--"তোরা কাল খবর পাবি ঠিক, আজ আমি বার এ যাব, প্রচুর খাব, আমার সব শেষ, I am finished।"
--"ধুত্তেরি ছাতা, খালি বলে finished finished, কি হয়েছে সেটা তো বলবে তো, বেশ তো লিখছিলে দেখে এলাম, কি হলো এর মধ্যে? কি প্রবলেম বলো, সবাই মিলে কিছু একটা করা যাবে।"
--"কিচ্ছু করার নেই তোদের, অনেক চেষ্টা করেছি, কিচ্ছু করা যাবে না, সব failed, আমি বেরোচ্ছি। বার এ যাব আজ।"
সবাই মিলে হাঁ হাঁ করে চেপে ধরতে অনেক চেষ্টার পর বেরোলো যে, দাদার সমস্ত data ও থিসিস এর ড্রাফট সহ হার্ড-ডিস্কটি গেছে খারাপ হয়ে, মানে সেটি দাদার লড়ঝড়ে কম্পিউটারটিতে detect করছে না। ল্যাপটপটি বহু দিনের, সকালে এসে চালাতে গেলে প্রচুর চড়-থাপ্পড় মারতে হয় তাতে। তাতেই দাদাটি আমার সমস্ত লোকজনের ঠাট্টা-মস্করা, টিকা-টিপ্পনী মৃদু- মৃদু হাসি দিয়ে নস্যাত করে এতদিন চালাচ্ছিলেন। হটাত সেই অতিবৃদ্ধ ল্যাপটপের কোনো এক অভ্যন্তরীণ দেহযন্ত্র বিকল হতে তীরে এসে ঠেকার পথে এই মারাত্মক বিপত্তি।
       
আমি তো এই সুযোগে আবার একটু জ্ঞান দিয়ে ফেললাম (চান্স ছাড়ি না কক্ষনো)। "তোমায় সবাই মিলে কবে থেকে বলছে নতুন ল্যাপটপ কিনতে, হলো তো এখন?"
--"আরে কোথাও detect করছে না আমি ল্যাবের সব কম্পিউটার try করেছি।" দোকানেও নিয়ে গিয়েছিলাম, সব failed। সাধে কি আর বলছি আমি finished।"- এত কিছু হয়ে গেছে নিঃশব্দে, কেউ জানে না ল্যাবের। আমার হলে তো চ্যাঁ-ভ্যাঁ করে পুরো ইনস্টিটিউট মাথায় তুলে ফেলতাম।
মাথা টাথা চুলকে বুঝলাম ব্যাপারটার গুরুত্ব। কি করা যায়?

দাদা ফের একবার আমাদের সবাইকে পারলে চিরজীবনের মত টা-টা করে বেরোতে যাবে এমন সময় আমার মনে পড়ল আমার এক বন্ধুর কথা। তার কম্পিউটার নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করার নেশা আছে, আমাদের মত কম্পিউটার সংক্রান্ত জ্ঞানে 'ক' অক্ষর গোমাংস নয়, অতিশয় সুচিকিত্সক এবং ইদানিংকালে এই ধরনের দুর্যোগে সে নাকি ভালই চিকিত্সা করে থাকে বলে খবর। বললাম, " একবার ওর কাছে গিয়ে দেখবে? আমি ফোনে বলে দিচ্ছি।" সমস্ত হাল ছেড়ে দিয়েই নির্লিপ্ত মুখে, সত্যিকারের সাধুপুরুষের মতো  বলল " যাই, দেখি। আর তো কিছু করার নেই।" বলে একটা এমন হাসি দিল- যেটা একমাত্র কাঠমান্ডুতে এলএসডি খাবার পর লালমোহনবাবুর মুখে যে 'লামা স্মাইল' টি শ্রীমান তপেশ দেখেছিল, সেটির সাথেই তুলনীয়। মনে হলো যেন থিসিস জমা দিয়ে সদ্য চাপমুক্ত হয়েছে, জীবনে কোনো ক্রাইসিস নেই। উফফ, কি করে যে পারে লোকটা?

সুখবরটা হলো, শেষ পর্যন্ত সেখানে যাওয়ার পর কোনো ভাবে এই সমস্যার সমাধান হয়েছিল সেদিন।

সব কিছু ঠিকঠাক হয়ে যাবার পর দাদা বোধহয় ধন্যবাদ কিভাবে দেবে বুঝতে পারছিল না তাই তার প্রকাশটা কিরকম হয়েছিল একটু বলি-
--"চল আজ তোকে ডিনার খাওয়াব। কোথায় খাবি বল? "
বন্ধুটি বলল, " আরে না না, তুমি আগে বাড়ি গিয়ে দেখো সব ঠিকঠাক আছে কিনা।"
--"সে তো হবে, তোকে আগে খাওয়াই।"
--"না না, সত্যি খাবনা।"
--"আরে খা না।"
--"না না।"
--"আচ্ছা বেশ, এখন কিছু একটা খাওয়া যাক।"
বন্ধুটির বোধহয় পেটের হাল ভয়ানক রকম খারাপ ছিল সেদিন - আমার অনুমান, নইলে এ প্রস্তাবে সে সচরাচর না করত না। 'খাদ্য-খাদক'-এর ব্যাপারে সে অত্যন্ত সংবেদনশীল, যদ্দূর আমি জানি। যাই হোক, সে এতেও না করাতে শেষে, "এক কাপ চা অন্ততঃ খা"- তে এসে রফা হলো। সাধে কি বলি- বাঙালির সব ইমোশন শেষ পর্যন্ত পেটে এসে ঠেকে! দাদাকেও ধন্যবাদ জানাতে মরিয়া হয়ে শেষ পর্যন্ত ওই পেটেরই দ্বারস্থ হতে হলো আর কি।

আমার যেটা বক্তব্য, এই যে acute condition, তাতেও ভদ্রলোক বিলকুল শান্ত! এরকম অবস্থায় আমি পড়লে, আমার কথা তো ছেড়েই দিলাম আমার চারপাশের সক্কলে আমার লাফালাফি আর ঘ্যানঘ্যানানির চোটে পাগল হয়ে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়াত। আর ইনি কিনা অত্যন্ত শান্ত- স্নিগ্ধ- সমাহিত স্বরে নিজের মৃত্যুসংবাদ আগাম ঘোষণা করছেন। সত্যি, কি জিনিস দিয়ে ভগবান এঁনাকে তৈরী করেছেন কে জানে।
সব কিছু মিটে যাবার পরে অনেকদিন পর্যন্ত দাদার সেদিনের বলা ডায়লগ গুলো তাকেই বলে আমরা কয়েক জন খুব হাসাহাসি করতাম মনে আছে। দাদাও খুব লজ্জা-টজ্জা পেয়ে আমাদের হাসিতে যোগ দিত। এবং এখনো পর্যন্ত আমরা মাঝে মধ্যে সেদিনের কথোপকথন মনে করে মজা পাই। কিন্তু মনে হয় ভাগ্যিস আমাদের কারোর সাথে এরকম হয়নি। আমরা সেই টেনশন নিতে পারতাম না। এঁনার সে ক্ষমতা ভগবানপ্রদত্ত। তাই হয়ত বড় বড় পরীক্ষাগুলোর মুখোমুখী এরকম লোককেই বারবার হতে হয়, হতে হচ্ছে। যাতে আমাদের মতো ভিতু, হেরোদের দল এঁনাদের চোখের সামনে দেখে জীবন থেকে ভয় না পাই। যাতে সমস্ত কিছু দক্ষতা থাকা সত্বেও বছরের পর বছর স্বপ্ন পূরণের জন্য অপেক্ষা করতে করতে ক্লান্ত হয়ে হাল না ছেড়ে দি।

আমার এই মৃদুভাষী-ঋষিপ্রতিম-শান্ত-ধৈর্যশীল দাদাটির গল্প আমার ফুরবেনা। পরে আবার কোনো সময় গল্পের ঝাঁপি খুলে বসা যাবেখন। আজ শুধু বলি, জীবন যতই কঠিন রাস্তা বানিয়ে রাখুক না কেন তার জন্য, আমি জানি সে তার স্বপ্ন পূরণ ঠিকই করবে। এবং তার গান ও তার জীবনবোধের জন্য অনেকের কাছেই সে উদাহরণ হয়ে থাকবে। ভালো থেকো .....দাদা।

6 comments:

  1. Ha ha ha.... Sotti ki sanghatik ghotona ghotechilo sedin.... Ami to bhulei gechilam.... Thanx to tor oi bondhu je tor ekhon kacher manush....:-) Ha ha ha.... Reader der boli sotti sedin ora amake uddhar naa korle eto sohoje hoyto ami fara ta katate partam naa.... Toder ke dhonnobaad janiye choto korte chai naa.... Tora amar borabor e kacher manush.... Aar ekta ki janis to amar moddhye ei cool ness ta bhogobaan prodotto chilo naa, Amar 5 years er Ramkrishan Mission er hostel life amake eta hote anek help koreche.... Tobe ki amio manush to.... Onnoder moton raag dukkho uttejona etc. amar moddhyeo ache... Jetar bohi-prakash hole khub besi matray hoye pore (Jeta hoyto torai lokkho korechis).... Aar seta tei amar bhoy.... Tai nijeke aaro shanto rakhar chesta kori....:-)

    ReplyDelete
    Replies
    1. রামকৃষ্ণ মিশনে তো অনেকেই থাকে তোমার মধ্যে মেটেরিয়াল ছিল তাই হয়েছে। এসব নিয়ে তর্ক করে লাভ নেই। যাই হোক না কেন, কিকরে একটা মানুষ এত শান্ত থাকে এটাই আমার মুখ্য বক্তব্য।

      Delete
  2. This comment has been removed by the author.

    ReplyDelete
  3. খুব বিপদে পড়লে অনেকসময় হয়তো মানুষ চুপচাপ হয়ে যায়, কিছু করার নেই দেখে। কিন্তু সেই বিপদ থেকে বেরোনোর পর-ও যখন কেউ শান্ত থাকে তাকে 'দুঃক্ষেষুঃ অনুদ্বিগ্নমনা, সুখেনঃ বিগতস্পৃহ, ' না বলে কোনো উপায় নেই। অসাধারণ ঘটনা, অসাধারণ মানুষ।

    ReplyDelete
  4. Ore baba anek kothin kothin bangla shobdo use korechis.... Ha ha ha....:-D

    ReplyDelete
    Replies
    1. সে সব করতে গিয়ে খানিকটা ভুল ভাল ও লিখেছে। কথাটা আগে পিছে হয়ে গেছে। হি হি .......

      Delete